ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা
পর্ব ১+২
তিলকে পাজাকোলে করে চোখের সামনেই কাকিমার রুমে ঢুকে পড়লো রিদ। অস্থিরতায় চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তিলের জামা টেনে খুলার চেষ্টা করছে। জামা খুলতে না পারায় এক পর্যায়ে টান দিয়ে ছিড়তে থাকে। রিদের হাতের আচরে ভ্যা ভ্যা করে কেদে উঠে তিল। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে আর নাকি নাকি কন্ঠে চিৎকার করে বলছে,
“” লিদ ভাইয়া,আমাল লাগছে। ছালো আমাকে। আমাল পুতুলের তো আজকে বিয়ে। ছালো আমাকে। আমার নতুন লাল জামাটা ছিলে ফেলছো কেন? আম্মু আমাকে মালবে,লিদ ভাইয়া,ছালো!””
তিলের কথা রিদের কানে যাচ্ছেইনা। সে তিলের দিকে তাকিয়ে আরো অস্থির হয়ে টান দিয়ে ছিড়ে পুরো জামাটা ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। নিজের গেন্জির ভেতরে প্যান্টের সাথে আটকে থাকা শাড়ীটা বের করে তিলের সামনে মেলে ধরলো। ওর লাল ফ্রকটার সাথে মেচিং করা লাল কুচি দেওয়া শর্ট প্যান্টের কোমড়ের রাবারটার ভেতর দিয়ে শাড়ী গুজতে গুজতে বললো,
“” ক্লাস ফ্লোরে পড়িস এখনো ‘ র’ উচ্চারন করতে পারিসনা? রিদ থেকে লিদ? আমার নামের অপমান করিস তুই? আর আমি তোর কাছে আসলেই তোর কান্না পায়?ব্যথা লাগে? আমাকে দেখলেই তোর চোখে সমুদ্র তৈরী হয়ে যায়? চুপ আর একবার চিৎকার করলে এই শাড়ীটা তোর কোমড়ে না পেচিয়ে গলায় পেচিয়ে ধরবো।””
তিলের কান্নার গতি কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। গলার শব্দ আরেকটু চিকন করে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
“” আমাল নতুন জামা,আমাল পুতুল বউ। আমাল সুলসুলি লাগছে,লিদ ভাইয়া ছালো আমাকে!””
রিদ রক্তচক্ষুতে তাকালো তিলের দিকে। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। নিমেষেই অসহায় ভঙ্গিতে শাড়ীর কুচিটা দিতে দিতে বললো,
“” এভাবে কাদিস না,তিল। আমি শুধু দেখতে চাই শাড়ী পড়লে তোকে কেমন লাগে। আমাকে একটু শাড়ীটা পড়াতে দে। তোর কান্না আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। শাড়িতে তোকে দেখতে কেমন দেখায়, এটা দেখেই চলে যাবো।””
রিদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দরজায় বাড়ি পড়ছে। দরজার অপরপাশ থেকে বাবার কন্ঠ পেয়ে রিদ ভয় পেয়ে যায়। আর তিলও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে,
“” বলো আব্বু,বলো আব্বু। লিদ ভাইয়া আমাল জামা…””
তিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে রিদ। বাবা এবার প্রচন্ড শব্দ আর হুংকার দিয়ে রিদকে দরজা খুলতে বলছে। রিদের চোখটা আবার রক্তরঙে রাঙিয়ে তিলের শরীর থেকে শাড়ীটা খুলতে খুলতে বললো,
“” তোর এই কান্না আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। যেদিন তুই লিদের জায়গায় রিদ বলতে শিখবি সেদিন আমাকে খুজে পাবিনা। আফসোস করবি তুই,খুব আফসোস করবি!””
রিদ হেচকা টানে পুরো শাড়ীটা আবার নিজের গেন্জির ভেতরে ঢুকাতে ঢুকাতে জানালাটা খুলে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেলো।
“” তিল,তুই এখনো রেডি হোসনি? গায়ে হলুদ তো শুরু হয়ে গেছে!””
মায়ের ডাকে তিল ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসলো। আয়নায় মায়ের চোখে চোখ রেখে বললো,
“”আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি আম্মু, রিমাকে কিন্তু সবার আগে আমিই হলুদ লাগাবো। তুমি গিয়ে পাহারা দাও যেন আমার আগে কেউ লাগাতে না পারে।””
তাসমিয়া বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“” এই হলুদ শাড়ীটাতে তোকে হলদে পাখির মতো সুন্দর লাগবে। কি এতো ভাবছিস? রিদের কথা?””
“” আমি নিজেকে ভেবেই কুল পাইনা আবার আরেকজনের কথা ভাববো। শাড়ীটা কোন স্টাইলে পড়বো সেটাই ভাবছিলাম। তুমি যাও তো,তুমি না গেলে আমি পড়বো কিভাবে?””
তাসমিয়া বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলেন।
তিল হাতের হলুদ শাড়ীটার দিকে তাকাতেই চোখটা ভিজে এলো। গলা বন্ধ হয়ে কান্না আসছে। আমি ‘র’ বলা শিখে গিয়েছি রিদ ভাইয়া। আপনি কি আজকেও আসবেননা? আমার আফসোসের পাহাড় ভেংগে গুড়িয়ে দিবেননা? এতো বড় পাহাড়টা আমি আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা। আমার ঐ একটা নালিশ যে আপনাকে আমার থেকে এভাবে কেড়ে নিবে আমি বুঝতে পারিনি। আমার অবুঝের পাগলামীগুলো মনে পড়লেই সেগুলো তীর হয়ে বুকে বিদছে। ৮ টা বছর তো পেরোলো আর কত অভিমান করে থাকবেন? এবার অভিমানটা দিয়ে আমার আফসোসের পাহাড়টা ভেংগে গুড়িয়ে দিননা,প্লিজ!
তিল কাদতে কাদতে আয়নার সামনেই হাটু ভেংগে বসে পড়ে। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব,এতো কষ্ট হচ্ছে কেন রিদ ভাইয়া??
তিল শাড়ীটা ঢিল মেরে ফেলে দিলো। পড়বোনা আমি শাড়ি! আপনার হাত যেদিন পড়াবে সেদিনই পড়বো। সেদিনি নিজের শরীরে শাড়ী জড়াবো।
“” খবরদার তুই আমাকে হলুদ লাগাবিনা।””
রিমা তিলের হাতটা আটকে দিয়ে তিলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“” কেন?””
“” তুই তো আমাকে কথা দিয়েছিলি হলুদ শাড়ী পড়েই হলুদ লাগাবি। তুই কথার খেলাপ করেছিস। আমি তোর হাতে হলুদ লাগাবোনা। আমার সামনে থেকে যা!””
তিল অসহায়ভঙ্গিতে রিমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে। একজনের পুতুলের সাথে আরেকজনের পুতুলের বিয়ে হয়েছে কতবার তা অগনিত। রিমা রিদানেরই ছোটবোন। রিদানের বাবা আর তিলের বাবা আপন দুইভাই। সে সুবাদেই তারা জয়েন ফ্যামিলির ন্যায় একসাথে থেকে আসছে। রিদানের বাবা বড় হওয়ায় তিল বড় আব্বু বলেই ডাকেন। আর উনিও রিমার মতোই তিলকে মেয়ের মতোই দেখেন। সেভাবে দেখতে গেলে এ বাড়িতে সব থেকে আদরের মেয়ে হলো তিল। হবেইনা কেন? একটা ভদ্র,ভালো মেয়ের যা যা গুন থাকা সব তিলের মধ্যে বিদ্যমান। বরংচ অন্যদের মধ্যে যেগুলো নেই সেগুলোও আছে। এক কথায় ভদ্র,শান্ত,চুপচাপ মেয়েকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি এই নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা হতো তাহলে বিচারক চোখ বন্ধ করে তিলকে ফার্স্ট প্রাইজটা খুশিমনে তুলে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো।
“” এমন করছিস কেন? শাড়ী দেখলেই আমার চুলকানি শুরু হয়ে যায়,আমার কি দোষ? আমি তো পড়তেই চাইলাম।””
“” তিল, আমার সাথে একদম মিথ্যা কথা বলবিনা। তুই যে মিথ্যে বলতে পারিস না সেটা আমার থেকে ভালো তুই নিজেও জানিস না। তুই যতক্ষননা শাড়ী পড়বি ততক্ষন আমার চোখের সামনে আসবিনা। আমাদের বন্ধুত্বের কসম।””
তিল মন খারাপ করে সেখান থেকে উঠে আসে। তোরা দুইভাইবোন এমন বিচ্ছিরী পোকা কেন রে? যখন তখন কামড়ে দিস। তোদের কি মনে হয়না তোদের বিষদাতগুলো আমার শরীরে কেমন জ্বলন ধরায়? ইচ্ছে তো করে তোদের বিষগুলো নিঙরিয়ে নিয়ে পুকুরের পচা পানির সাথে মিশিয়ে সরবত বানিয়ে তোদেরকে খায়িয়ে মেরে ফেলি। আমি তো শুনছি নিজের বিষ নিজে খেলে সাথে সাথে মারা যায়। সেটা তোদের উপর পরীক্ষা করে সিউর হতে হবে!
তিল বিড়বিড় করে হাটতে হাটতে বড়আম্মুর সাথে ধাক্কা খেলো।
“” উফ! শুভ কাজে বাধা দিলি কেন? একটু দেখে হাটতে পারিসনা?””
“” আবার কি শুভ হলো??””
“” আরে,আমার ছেলে এসেছে। আমার ছেলে আমার বুকে ফিরে এসেছে। আমি জানতাম নিজের আদরের ছোট বোনের বিয়ের কথা শুনে ও না এসে থাকতে পারবেনা। বাবার প্রতি রাগটা তাহলে এবার পড়লো।””
“” কার কথা বলছো,বড় আম্মু?””
“” কার কথা আবার আমার সোনার খনি,আমার রিদান এসেছে!””
“” রিদ ভাইয়া?””
তিলের মনে হলো তার শরীর বেয়ে বড়সড় একটা ঘুর্নিঝড় বয়ে গেলো। চারপাশের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই রিমার সজোরে চিৎকার করে ভাইয়া ডাকটা তিলের নিশ্বাসটা আটকে দিলো।
তিল ড্রয়ার থেকে একে একে সব জামাকাপড় খুলে বের করছে। একের পর একটা পড়ে যাচ্ছে,আর খুলছে। সে তার রিদ ভাইয়ার সামনে কি পড়ে যাবে?? কোনটা পড়লে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগবে?? উফ! আমার তো আজকে বেস্ট জামাটা পড়তে হবে। রিদ ভাইয়া এতো বছর পর বিদেশ থেকে এলো। ইউকে থেকে পড়াশুনা করেছে মানে তার পছন্দগুলোও অমনই হবে। আর তার পছন্দসই নাহলে আমার দিকে তো ফিরেও তাকাবেনা। কি যে করি! উফ! টেনশনে মাথা ভার হয়ে আসছে। সাথে সাথে মাথা ফাটিয়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
তিলের মাথা ব্যথা আরো বাড়িয়ে দিলো তার বড় আম্মু!
“” একি তুই রুম এমন গোয়ালঘরের মতো করে রাখছিস কেন?””
“” এমনি,আমি কোন জামাটা পড়বো ঐটা…””
“” জামা কাপড় পরে খাচিস। রিদানের নাকি মাথা ধরেছে। আমার মাথা ধরলে তুই যে কি মশলা চা নাকি কি চা বানাস ঐটা বানিয়ে দেতো,মা।। যাতে চায়ে চুমুক দিতেই মাথা ব্যথা ফুরুৎ হয়ে যায়!””
বড় আম্মুর বিপরীতে কথা বলার সময়টাও পায়নি তিল। ওকে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেলো।
তিল হাতে চায়ের ট্রেটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার বেস্ট সাজের বারোটা বাজিয়ে দিলো বড় আম্মু। এতো জামাকাপড় থাকতে কিনা শেষে এই সাদামাটা হলুদ জামাটা পড়েই উনার সামনে যেতে হবে?? শাড়ী পড়বোনা দেখে কি একটা গর্জিয়াস জামাও পড়তে পারলাম না? আর আমি চা বানালাম দেখে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে? এই বড় আম্মুটাও আমাকে বুঝলোনা। রিদ ভাইয়ার সামনে আমাকে চাকরানী বানিয়ে দিলো? তিল মাথায় ওড়নার ঘোমটাটা আরো টেনে নিলো যাতে রিদ চিনতে না পারে।
I
ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!
তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।
চলবে,
#ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা
পর্ব (২)
ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!
তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।
তীল কাপদের ঝাকানি নিয়ে এক সাইড থেকে চা বাড়িয়ে দিচ্ছে সবাইকে। হঠাৎই,,
“” এভাবে সঙ সেজে সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছিস কেন? তো।র কি মনে হয় আমি ইউকে থেকে এসেছি তোর মতো কুৎসিত সঙের সার্কাস দেখার জন্য?? আর আড়াইহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে কি প্রমান করতে চাচ্ছিস,তুই খুব পর্দা করিস? ছেলেদের সামনে আসতে লজ্জা পাস? নাকি নিজেকে খুব রুপবতী ভাবিস যে আমরা দেখলে তোর রুপ খসে খসে নিচে পড়বে???””
রিদের এমন রিদয়ঘাত কথা শুনে তীলের হাত থেকে চায়ের ট্রেটা টুপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো। চায়ের কাপগুলো এবার যেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদেরকে বিসর্জন দিলো। তীলের বুঝতে বাকি রইলোনা এমন ঝাঝালো কথা তাকে কে বলতে পারে। তীলের চোখ নোনা পানিতে তৈ তৈ করছে। কাপা কাপা পা নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসে। মাথাটা উচু করে তার রিদ ভাইয়াকে দেখার সাহস হলোনা। চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলো।
বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করছে। যার অনুপস্থিতে বুকের ভেতরে এতো ব্যথা অনুভব হতো তার উপস্থিতে তা যেন দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো। তীলের ইচ্ছে হলো ব্যথার হারটাকে হিসেব করে বের করতে। কি পরিমান ব্যথা হচ্ছে জানতে পারলে তো মন্দ হয়না। কিন্তু হারটা কি স্বাভাবিকভাবেই ধরবো নাকি চক্রবৃদ্ধীতে???? আর রিদ ভাইয়াকে প্রেজেন্ট ভেল্যু ধরবো নাকি ফিউচার ভ্যলু??
“” তোর এতো দেমাক কিসের, তীল? তুই সামান্য শাড়ীর কাছে আমাকে হারিয়ে দিলি?””
তীল নিজের কাপড় গুছানো রেখে রিমার দিকে তাকালো। পুরো শরীরে হলুদের মাঝামাখি। কি অপরুপ লাগছে রীমাকে। কই আগে তো কখনো এতো সুন্দর লাগেনি তাহলে কি বিয়ের ছোয়া রিমাকে এক ঝটকায় সুন্দরী বানিয়ে দিলো? আমার গায়ে হলুদেও বুঝি আমাকে এমনি সুন্দর লাগবে?
“” কি হলো কথা বলছিস না কেন? কাল তো তোদের ছেড়ে চলেই যাবো। তাই বুঝি আজকেই পর করে দিলি? তুই এতো পাষান তীল?? আমার গায়ে হলুদের ছোয়া লাগাতে এলিনা?””
“” তুই তো বলেছিলি শাড়ী না ওড়লে তোর সামনে যাওয়া নিষেধ!””
“” আমি রাগ করে বললাম দেখে তুই গেলিনা? এই তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড?? আর আমার জন্য একটু শাড়ী পড়লে কি এমন হতো শুনি?””
তীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা শাড়ী গুটিয়ে বেড়িয়ে গেলো। বেশ অভিমান করেছে খুব বুঝতে পারছে তীল। কিন্তু তাতে তীলের কষ্ট লাগেনি বরংচ ঠোটে হাসি ফুটে উঠেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,
“” বাব্বাহ,এতো রাগ?””
সে রাতে তীলের ঘুম হলোনা। সে তো তার ব্যথার হার বের করায় বিজি ছিলো। যার উত্তরের ডিজিটগুলো একক,দশক,শতকে মিলিয়ে পড়তে পড়তে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেলো। ভোরের আযান কানে আসতেই তীল ওযু করে নামাজটা পরে নিলো। নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। কেন জানি আজ খোলা আকাশের নিচে মনভরে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।
তীল দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে শব্দ করে লম্বা নিশ্বাস নিতেই হালকা কেশে উঠলো। ধুর ছাই! নিশ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে শিখলাম না। কিছুটা মুখটা ভেংচি কেটে নিচে নামতেই মনে হলো রিদ ভাইয়ার রুমে একটু উকি দিতে। আচ্ছা উনিকি এখনো ঘুমাচ্ছে? কোন রুমে শুয়েছেন উনি? আবার এমন নয় তো উনার গরুর পাকবাহিনীকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছে?
তীল এতো ভাবনা ছেড়ে ছোটবেলা রিদ যে রুমে ঘুমাতো সে রুমের কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। দরজায় হালকা বল প্রয়োগে নড়ে উঠলো। তারমানে দরজা খুলেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু কেন? উনিও কি আমার মতো দরজা আটকিয়ে ঘুমাতে ভয় পান নাকি ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছেন?
তীল দরজাটা যেইনা আরেকটু খুলতে যাবে অমনি ভেতর থেকে রিদ বলে উঠে,
“” আমার রুমে রুপ খসিয়ে পড়া মেয়েদের ঢুকা নিষেধ। আর নিষেধ অবজ্ঞা করার শাস্তি কি হতে পারে সেটা জানতে চাইলে ভেতরে আসতে পারে!””
রিদের মুখে শাস্তির কথা শুনেই তীল ভয়ে চোখ বন্ধ সেই ছোটবেলাতে চলে গেলো,
“” এ্যাা,এ্যাা,এ্যাা,আমাল হাতে লাগছে লিদ ভাইয়া। আম্মু! বলো আব্বু,লিদ ভাইয়া আমাকে মালছে। আমাল কষ্ট লাগছেতো,লিদ ভাইয়া!
রিদ বাশের সবুজ,চিকন কুন্চিটা আরোশক্ত করে চেপে ধরে তীলের হাতে লাগাতার বাড়ি মেরে যাচ্ছে,
“” তোকে মানা করেছিলাম রবিনের সাথে খেলবিনা? তোর এতো বড় সাহস আমার নিষেধ অবজ্ঞা করলি? ওর পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে?? আজ মেরে তোর হাত দিয়ে রক্ত বের করে ফেলবো আর সেই রক্ত দিয়ে তোর পুতুলকে রাঙিয়ে বউ সাজাবো। দেখি কত বিয়ে দিতে পারিস।””
তীল সাথে সাথে চোখ খুলে ফেললো,রিদের রুমের দরজাটা ঝট করে টেনে দিয়ে নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে। চোখের সামনে ডানহাতটা মেলে ধরতেই মনে হলো হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে! আজ এতো বছরও কি এই রক্ত পড়া বন্ধ হবেনা???
“” রিমা,তুই নাকি আমাকে ডেকেছিস?””
রিমার চোখে মেকাপ আর্টিস্ট কাজল লাগিয়ে দিচ্ছে তাই তীলের দিকে তাকাতে পারলোনা। চোখদুটো বড়বড় করে একটু বাকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়েই বললো,
“” তোর নাকি জামাই মরে গেছে?””
“” মানে??””
রিমা কাজল দেওয়া শেষ করে তীলের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“”আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে জামাইকে মেরে ফেললি?””
“” এসব কি উল্টাপাটা বলছিস রিমা?””
রিমা তীলকে টেনে নিজে যেখানে বসে বউসাজছিলো সেখানে বসিয়ে দিলো। আয়নায় তীলের চোখে চোখ রেখে বললো,
“” তোকে দেখেতো সেরকমই লাগছে তীল! তোর বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে তীল,কোথায় তুই সেজেগুজে বাড়ি মাতিয়ে রাখবি তা না বিধবা মেয়ের মতো ঘুরঘুর করছিস! আমি চলে গেলে আমার মায়ের মুখটাতে হাসি ধরে রাখার দায়িত্বটা তো তোরই তীল। এমনভাবে মনমরা হয়ে আছিস,যেন সবার কষ্ট তুই একা ভোগ করার দায়িত্ব নিয়েছিস!””
রিমা মেকাপ আর্টিস্টদের চোখের ইশারা দিতেই সবাই এতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তীলের উপর। গলার ওড়নাটায় হাত দিতেই চিৎকার করে উঠে,
“” আরে কি করছেন আপনারা?””
রিমা সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে নিজে তীলের সামনে এসে ওড়নাটা খুলতে খুলতে বললো,
“”তোর এই গোলাপি ঠোট,মায়া চোখ,গোলাপী গাল গুলোকে ঢাকলে তোকে কেমন দেখা যায় সেটা দেখবো। মনে কর এটা আমার তোর কাছে চাওয়া আমার বিয়ের সেরা গিফট।””
রিমা কি বুঝাতে চাচ্ছে বুঝার জন্য ফেলফেল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তীল। যেন ওর মুখের দিকে এভাবে কিছুক্ষন তাকালেই সব বুঝতে পারবে!
“” যা,এই জামাটা ছেড়ে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা পড়ে আায়।””
তীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা বলে উঠে,
“” মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের হলে আমার মুখ দিয়ে কবুল বের হবেনা। আর তুই জানিস আমি যা বলি তা করেই ছাড়ি!””
তীল অসহায়ের মতো মুখ করে রিমার হাত থেকে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
“” এই মেয়ে তোমাকে আমার তীল মায়ের মতো লাগছে! নাম কি গো তোমার?””
তাসমিয়া বেগমের এমন আচরনে তীলের ইচ্ছে হলো আবার যদি মায়ের পেটে ঢুকা যেতো! কি লজ্জা,কি লজ্জা!! নিজের মা, নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেনা,আমি কি এমনি অভাগী মেয়ে??? আচ্ছা এটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেমন হবে? নিশ্চয় হাজার হাজার হা হা রিয়েক্ট আসবে। এমন ও তো হতে পারে এই একটা পোস্ট আমাকে ভাইরাল করে দিলো???
শাড়ী পড়ে বের হওয়ার পর থেকে তীলের মনে হচ্ছে কেউ তাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। এমনভাবেই দেখছে মনে হচ্ছে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। তীল বার বার চারপাশে চোখ বুলিয়েও সেরকম চোখের দেখা পেলোনা। কিন্তু হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারন কী?? তীল পুরো বাড়ী ঘুরে চষে বেড়িয়েও রিদ ভাইয়ার দেখা পাচ্ছে না হঠাৎ এমন নাই হয়ে গেলো কিভাবে? গেলেন কোথায় উনি? রিদকে না পেয়ে চোখগুলো যেমন তাকে খোচাচ্ছে তার চেয়ে দ্বিগুন খোচাচ্ছে তার পড়নের শাড়ী। মাঝে মাঝেই কুচিতে পা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এদিকে মনে হচ্ছে শাড়ীর নীচ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। খুবই বাজে ফিল হচ্ছে। মাঝে মাঝে তো এমন লাগছে মনে হচ্ছে আমি কোনো জামাই পড়িনি। কি অদ্ভুত ফিলিং রে বাবা!
তীল এতোকিছুকে পা মাড়িয়ে রিদকেই খুজে যাচ্ছে। এতক্ষন পযন্ত তাকে যে দেখেছে সেই বলেছে তাকে খুবই সুন্দর লাগছে। আর এই সুন্দরটা তার রিদ ভাইয়া না দেখলেতো সব বৃথততততততা,
কিছু একটার সাথে পা লেগে ধপাস করে তীল পড়ে যেতে নিলে একটা ছেলে এসে ধরে ফেলে,
তীল চোখ,মুখ,কুচকিয়ে একদিকে হেলে আছে। ছেলেটার হাত বাধা হিসেবে কাজ করায় তিল মাঝ পথেই আটকে আছে এখনো মাটিতে পড়েনি।
“” ওয়াও,চোখ জুরিয়ে গেলো। হোয়াটস ইউর নেম প্রিটি গার্ল?””
তীল চোখ মেলে তাকাতেই ছেলেটি বলে উঠলো,
“” আমি সিজাত,ইউ কেন কল মি সিজ!””
তীল ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে হলো তার পেটের ডানপাশটাতে কিছু একটা চেপে বসে আছে। তীল নিজের হাত দিয়ে ওখানটাই হাত দিতেই বুঝতে পারলো ওটা অন্য কিছুনা এই বেটা সিজারের হাত। তীল আবার চোখ মুখ কুচকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
“” সিজার,হাত সরান!””
রিমাকে বিদায় দিয়ে বড় আব্বু,বড় আম্মুকে সামলিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মাঝরাত হয়ে গেলো। তীল বড্ড ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শরীরটা বিছানায় মেলে দিলো। রিমার জন্য মনটা বারবার কেদে উঠছে। ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে এখন থেকে তাকে একাই চলতে হবে,একা একাই সব কিছু করতে হবে। এই পুরো পরিবারটার খেয়ালও তাকে একাই রাখতে হবে। ভাবতেই বুকের ভেতর বড় পাথরের চাপ অনুভব হলো। এতোকিছুর ভেতরেও ক্লান্ত শরীরকে ঠান্ডা করতে চোখে ঘুম নেমে আসলো তীলের।
ঘুমের ঘোরেই তীলের মনে হলো কেউ তার উপর উঠে আসছে। তার পড়নের জামাটায় কেউ হাত দিয়ে পেটের দিক থেকে জামাটা সরাচ্ছে। তীল ঝট করে চোখ খুলতেই মাথাভর্তি ঝাঝড়া চুল দেখতে পেলো। মাথাটা আসতে আসতে নিচের দিকে যাচ্ছে। তীলকে অবাক করে দিয়ে তিলের পেটের ডানপাশটাতে কামড় বসিয়ে দিলো৷ তীল চিৎকার করতে নিলেই ওর মুখটা চেপে ধরে এক জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো,
“” আমি শাড়ী পরাতে গেলেই তোর কান্না পায়,ব্যথা লাগে,সুড়সুড়ি লাগে। আর এখন নিজে পেট বের করে শাড়ী পড়ে ছেলেদের পাগল করে বেড়াচ্ছিস? তাও আমাদের বাড়িতে আমারি ফ্রেন্ডের? এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে তীল!””
ব্যথায় তীলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে কানে গিয়ে ঠেকছে। মুখ থেকে হাতটা সরে যেতেই তীল চাপা স্বরে বলে উঠে,
“” লিদ ভাইয়া??””
“” তুই এখনো ‘র’ বলা শিখিসনি??””
চলবে