ভালোবাসার রাত ২ পর্ব ২৫+২৬

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৫+২৬)

তিয়ামতী নিজের কথা শেষ করেই দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে নিলো। ইশ! এটা সে কি বলে ফেললো? লজ্জায় তিয়ামতীর বিছানার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তিয়ামতীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রিদান শব্দ করে হেসে উঠলো। এতে যেন তিয়ামতীর লজ্জা দ্বিগুন হারে বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়াকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। সত্যিই কি পালাবে? কিন্তু যদি ধরে ফেলে?? তিয়ামতী কিভাবে পালাবে সেই ছক সাজানোতে ব্যস্ত।

রিদান নিজের হাসির ইতি ঘটিয়েছে অনেক্ষণ। তিয়ামতীর ঠোঁটের কোনের তিলটাতে তার লোভাতুর দৃষ্টি। গভীর ছোয়ার লোভ জেগে উঠেছে অন্তরে। এক নিমিষেই এতো লোভ তার কি করে জাগলো?? রিদানের থমকে থাকা হাতটা হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠলো। নিজের ঠোঁটে রিদানের হাতের ছোয়াই তিয়ামতীর মনে আঁকা পালানোর ফন্দিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। এক সুখকর অনুভূতির উপস্থিতি অনুভব করছে। অনুভবটা আরো দৃঢ় হলো রিদানের ঠোঁটের স্পর্শে।

বহুবছর আগে একটি রাত দুজনের মনে দাগ কেটে দিয়েছিলো। শুধু কি মনে? মনের সাথে শরীরেও যে দাগ কেটে দিয়েছিলো। সেই দাগ এতোটাই গভীরে চলে গিয়েছিলো যে আজ আবার সেই পুরোনো,পরিচিতি মানুষটার স্পর্শে ধপধপ করে জেগে উঠতে চাইছে। যা পাওয়ার ছিলো তা পাওয়া হয়নি,তাই বলে কি সে পাওয়ার ইচ্ছেটা নিভে যাবে?? অপূরণীয় ইচ্ছেরা কখনোই নিভে যায় না,মনের এক কোনে ঠিক ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অপেক্ষায় থাকে এক নতুন শুভক্ষণের,নতুন করে জেগে উঠার উদ্যমের, নতুন করে পুর্ণতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার। আর সেই ইচ্ছে যদি হয় শরীরের তাহলে তো কথাই নেই। সেই ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই জ্বলে উঠছে। পরিপুর্ণভাবে নিজেকে জ্বলিয়ে শেষ করে দিতে চাচ্ছে দুজনের শরীরে।

রিদানের ঠোঁটের আদরে তিয়ামতীর গলার বিস্তর টয়টুম্বর। ভালোবাসার মানুষটির গভীর ছোয়ায় যখন তিয়ামতী অনুভূতির উচ্চতর শিখরে পৌছুবে ঠিক তখনি তিয়ামতী অন্যকিছু অনুভব করলো। নিজের খোলা গলায় রিদের উষ্ণ ঠোঁটের মধ্যে আরেকটি উষ্মার ছোয়া। তরল উষ্মা। তিয়ামতী আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলোনা। চট করে চোখ মেলে ফেলে। রিদের মাথার দুধার চেপে ধরলো। উচু করতেই তিয়ামতীর কলিজা কেঁপে উঠেছে। সাথে সাথে চোখ ভিজে উঠে গলার স্বরে কান্নার ঢল,,,

“” আপনাল চোখে পানি কেন,লিদ ভাইয়া?””

তিয়ামতীর চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছেনা রিদ। বাতাসের ন্যায় সরে আসে তিয়ামতীর কাছ থেকে। অন্যপাশে মুখ করে অপ্রস্তুতসুর,,

“” কোথায় পানি? কিসের পানি??””

তিল শোয়া থেকে উঠে পড়লো। শাড়ীর আঁচল বুকে জড়িয়ে রিদের কাছে এসে বললো,,

“” আমি আপনাল চোখে পানি দেখেছি। আপনি কাঁদছিলেন,কেন কাঁদছিলেন? কি হলো বলুননা।””

তিয়ামতীর কথার পিঠে রিদ কিছু বলছেনা। বলবে কি করে গলাতো তার বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখ নয়,গলা চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে এতোদিনের পুষে রাখা জমানো পানির দানা। চোখের পানিগুলো এতো বেশি স্পর্শকাতর কেন? আপন মানুষের ছোয়া পেতে না পেতেই ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। তিয়ামতী কিছু ভেবে না পেয়ে শব্দকান্নাতে ভেঙে পড়ে বললো,,

“” বুঝেছি,আপনি আবাল আমাকে ছেলে চলে যাবেন। আবাল আমাকে একলা কলে….””

তিয়ামতীকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলোনা রিদ। ওকে ঝাপটে ধরে হু হু করে কেঁটে উঠলো।

“” আর কোথাও যাবোনা রে বউ!””

**ভালোবাসার সুতোয় বুনা, শাড়ীর আঁচলে
বেধে নিস
লুকিয়ে রাখিস
তোর মনের গহীন অতলে!!**

তিয়ামতী রিদকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,,

“”আমি কোথাও যেতে দিবোনা,কোথাও। আমাল বুকেল খাঁচায় বন্দী কলে লাখবো।””
“” তাই করিস। আমি নির্দ্বিধায় থাকবো। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে। তার বিনিময়ে একটু শাস্তি তো আমার পাওনা। সৃষ্টিকর্তা হয় তো সেই পাওনা চুকাতেই আবার আমায় তোর কাছে পাঠিয়েছে।””

তিয়ামতী রিদের মুখটা হাতের আঁজলে নিয়ে কান্নামিশ্রিত হাসি হাসলো। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,,

“” আমি তো ভেবেছিলাম,আপনাল হাসিটাই বাচ্চাদেল মতো,কিন্তু এখন তো দেখছি আপনাল কান্নাও বাচ্চাদেল মতো। আপনি কি আমাল বাচ্চা বল?””

রিদ তিয়ামতীর দুষ্টু কথাতে চুপ করে রইলো। ওর দিকে সুক্ষ চাহনি একে ধীর কন্ঠে বললো,,

“” তুই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস রে,তিল। অনেক বড়। আমার সেই ছোট্ট তিলটা আজ কত কি বুঝতে শিখেছে। যেখানে আমি একজন ছেলে হয়েও আমার একাকিত্বের বোঝা বয়তে না পেরে এক জঘন্য কাজে প্ররোচিত হয়ে পড়েছিলাম সেখানে তুই মাত্র আঠারোতে পা দেওয়া এক নব্য তরুণী হয়ে সবটা মেনে নিলি। শক্ত হাতে সবটা সহ্য করে বছরের পর বছর কাটালি। না আমার উপর কোনো অভিযোগ তুলেছিলি না ভাগ্যকর্তার উপর!

কিভাবে পারলি তুই? তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতোদিনে অন্য কোনো পুরুষ….””
“” চুপ,কিসব আবিজাবি বলছেন? শক্ত হওয়াল সেলা উপহালটা তো আপনি আমাকে দিয়েছিলেন। নলম হয়ে যদি গলে যেতাম তাহলে শুধু আপনাকে না আমাল ভালোবাসাল উপহালটিকেও যে অপমান কলা হতো,লিদ ভাইয়া!””

রিদ আশ্বাসীসুরে বললো,,

“” আমার জন্য তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস। নিজের ইচ্ছেতেও তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,আর নয়। এবার তোকে আমি ভালোবাসা দিতে চাই। ভালোবাসার শেষ ফোঁটাটাও তোর কপালে আঁকতে চাই।””

রিদ তিয়ামতীর দুহাত নিজের হাতের আবদ্ধে নিয়ে বললো,,

“” এই তোকে আমি প্রমিস করছি,আমার জন্য তোর চোখের অমূল্য সম্পদের একফোটাও গাল বেয়ে….””

রিদের কথা শেষ করতে না দিয়েই তিয়ামতী ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। আবদ্ধের বাধন থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে নিলো। রিদের হাত নিজের শরীরের দুদিক দিকে জড়িয়ে দিলো।

~~

তিয়ামতীর শরীরে কম্বল জড়িয়ে দিলো রিদ। ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ মেখে দিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।

জোর কদম ফেলে রাতের রুমের দিকে এগুচ্ছে। বন্ধ দরজার বাইরে দাড়িয়ে সে। সিটকিনি বাইরে থেকে লাগানো। কোথায় আছে সে?? রিদান ভাবনায় ডুবে পা বাকিয়ে চলে যেতে গিয়েও থমকে গেলো। কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে কি? আন্দাজের তীর কতটা সুক্ষ তা জানার ইচ্ছেতেই বন্ধ দরজা খুলে ফেললো। যা ভেবেছিলো তাই।

বিছানার শেষপ্রান্তের এককোনে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে সন্ধ্যা। গলে যাওয়া মোমের ন্যায় চোখের পানি দাগ কেটে আছে সন্ধ্যার চোখের নিচে। রিদান ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে মনে মনে আউড়াল,ছেলেটা আমার সত্যিই কি পাগল হয়ে গিয়েছে?

রিদান সন্ধ্যার মাথার নিচে বালিশ রাখলো। সন্ধ্যার শরীরে পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে ফিরতি পথে পা বাড়াচ্ছে।

~~

নীশিরাতের শেষ প্রহর। সাদা মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুড়ি খেলা চলছে। ছাদের ঠিক মাঝখানে রাত শুয়ে আছে। বালিশ হিসেবে নিজের দুহাতের মুঠোকে ব্যবহার করেছে। চোখের সরলদৃষ্টি চাঁদমেঘের লুকোচুড়িতে। সেও কি এই চাঁদের মতো?? যেই সুখের আলো শরীরে মাখতে যায় তখনি কষ্টগুলো মেঘের ন্যায় তাকে ঢেকে ফেলে। মাঝে মাঝে মেঘের কাছে পরাজিত হয়ে চাঁদ যেমন অভিমান করে হারিয়ে যায় আজ সেও তো এমন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তার আকাশেও যে এখন বৃষ্টির ঢল নেমেছে। রাত প্রাণহীন নিশ্বাস ছেড়ে চোখটা বন্ধ করলো।

রিদান সিড়ি বেয়ে ছাদে এসেছে অনেক্ষণ। ছেলের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। নিজের রুমের বিছানাটা কি ছোট হয়ে গেলো যে ছাদটাকেই বিছানা বানিয়ে নিয়েছে???

রিদান নিঃশব্দে ছেলের পাশে শুয়ে পড়লো। রাতের মাথার নিচ থেকে ওর একটা হাত টেনে বের করলো। হাতবালিশটা ভাগ করে নিয়ে আরাম করে চোখ বন্ধ করে নিলো,নিজের দুহাত নিজের বুকের উপর বিছানো। রিদানের এমন কর্মকান্ডে রাতের অবস্থার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু একবার পলক ফেলে পাশের লোকটিকে দেখে নিলো। রিদান বন্ধচোখেই বললো,,

“” বড় হয়ে গিয়েছিস তোকে তো আর আমার বুকে শোয়ার আমন্ত্রণ করতে পারবোনা। তাই তোর হাতটাই বালিশ বানিয়ে নিলাম। ওজনটা কি বেশি? আমার শরীরের নয়,তোর জমাট বাধা রাগের। রাগ নাকি অনুরাগ??

রিদানের প্রশ্নধ্বনিতে রাতের মনোযোগ ক্ষুন্ন। পাশ ফিরে তাকাবে কি তাকাবেনা তাই ভাবছে। বাধা অনুভব করছে,অদৃশ্য বাধা! কিন্তু কেন?? তাহলে কি এই মানুষটার জন্যও তার মনে চাপা অভিমান রয়েছে??

ছেলের দিক থেকে কোনো উত্তর পেলোনা রিদান। এতে যেন উৎসাহই পেলো। নিজের কথার চড়কি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো,,

“” তুই কি আসলেই আমার বউয়ের উপর বিরক্ত নাকি নিজের বউয়ের উপর?””

রাত না চাইতেও তার চোখ বিধলো রিদানের মুখে। দুজনের চোখে চোখাচোখি। একজনের চোখে দুষ্টু আভাস,আরেকজনের চোখে বিস্ময়ের!

রিদান এবার ছেলের দিকে কাত হলো। ডানহাতটা মেঝেতে ভর দিয়ে গাল ঠেকিয়ে বললো,,

“” চিঠি লেখার সময় তোর চোখে পানি এসেছিলো। মনে ভাবনা এসেছিলো,কপালে বিরক্তের ভাজ পড়েছিলো,এমনকি নাক থেকে ব্যর্থতার শ্বাস পড়েছিলো। আমি কি ঠিক বলছি?””

রিদানের কথায় রাত হকচকিত। যে মানুষটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। চোখের দেখা,মনের দেখা, কিছুই নেই। সে কিভাবে জানলো তার অদৃশ্য অনুভূতির কথা? তাহলে কি একেই বলে রক্তের বন্দন?? বাহিরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও মনোসংযোগে অটল!

“” চিঠিতে বারবার আমার বউয়ের কথা উল্লেখ করলেও তুমি পুরো চিঠিতে অদৃশ্যভাবে নিজের বউয়ের কথা ভেবেছো। এতো দ্রুতই হাল ছেড়ে দিলে?””

রাতের মনে ঝড় বয়ছে,সত্যিই কি তাই? মনের অজান্তেই কি সে নিজের ব্যর্থতার অদৃশ্য ছবিটাই এই মানুষটার কাছে পাঠিয়েছিলো?? কিন্তু কেন? কোন আশায়? না জানা এই মানুষটার কাছেই কেন তাকে ব্যর্থতায় বুনো জাল পাঠাতে হয়েছে?? এতো ভরসা কি করে জেগে উঠেছিলো?? জন্মদাতা বলে??

রিদান আগের ন্যায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। রাতের হাতের কব্জি এবং কনুইয়ের মাঝ বরাবর মাথা রেখেছে। চোখের পাতা দুটো এক করে ভারী গলায় বললো,,

“” ছোটবেলায় সুষম খাবারের নাম নিশ্চয় পড়েছো?? আমিও পড়েছি। বিজ্ঞান বইয়ে। ঠিক কোন ক্লাসে পড়েছিলাম মনে পড়ছেনা। তোমার কি মনে আছে??””

রাতের দিক থেকে নিরব শব্দধ্বনিতে রিদান বেশ গুছিয়ে নিয়ে আবার বললো,,

“” খাদ্যের প্রধান ছয়টি উপাদানের নির্দিষ্ট পরিমানের উপস্থিতি যা ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন মেটায় তাকে সুষমখাদ্য বলে। ভালোবাসাটাও অনেকটা সুষম খাদ্যের মতো। রাগ,অভিমান,ঝগড়া,অবহেলা,শাসন ও যত্ন এই সবগুলো মিলেমিশে একটি মিশ্র অনুভূতি। যাকে আমরা ভালোবাসা বলে নাম দিয়েছি। ভালোবাসা শব্দটিকে যথার্থ মর্যাদা দিতে হলে তোকে এই মিশ্র অনুভূতিগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যখন যেটার প্রয়োজন তখন তোকে সেই নির্দিষ্ট পরিমানটাকেই ব্যবহার করতে হবে। যদি তুই নির্দিষ্ট এর বাহিরে চলে যাস তাহলেই ভালোবাসার অপমান হবে। আর সে অপমানটা সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা থেকে প্রস্থান করবে। সুষম খাদ্যের উপাদানগুলোর পরিমান যেমন মানুষ ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। তেমনি ভালোবাসার মিশ্র অনুভূতিগুলোও ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হয়। উদাহরন হিসেবে আমার বউ মানে তোর মা’কে দিয়েই বুঝায়, ও ছোটবেলা থেকেই আমার রাগ দেখে অভ্যস্ত এখন যদি হুট করে ওর সাথে নরম ব্যবহার শুরু করি, ও আমাকে সন্দেহ করবে,শুধু সন্দেহ বললে ভুল হবে ওর মনে সরাসরি ভয় বাসা বাধবে। তেমনি সন্ধ্যা তোর নরম ব্যবহারে অভ্যস্ত এখন যদি তুই ওর সাথে এমন কঠিন ব্যবহার করিস তাহলে কি ওর তোকে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক? না বরং এটাই স্বাভাবিক।

সমস্যা সন্ধ্যার মধ্যে না,তোমার মধ্যে। কি সমস্যা জানো? সন্ধ্যা কিন্তু চাইছে তোমার সেই ভয়ংকর রুপটা ভুলে যেতে কিন্তু তুমি দিচ্ছোনা। তুমি এতোটাই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছো যে বারবার ওর সম্মুখীন হচ্ছো তাও অদ্ভুত ব্যবহার নিয়ে। একটু আগে তুমি যেটা করেছো সেটা ঠিক করোনি। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি ও ভুলেও তোমার সামনে আসবেনা।””

রিদান চোখ মেললো। রাতের চোখের প্রশ্নটা পড়ে নিয়ে বললো,,

“” আমি কোনো আগন্তুক নই। তোমার আম্মুর স্বামী। তার চিঠিতে আমি সবাইকেই দেখতে পেয়েছি।””

রাত শোয়া থেকে উঠে পড়লো। বাবার জন্য একফোটা বাক্যওব্যয় করেনি। সোজা হাঁটা ধরতেই রিদান গলার স্বর উচু করে বললো,,

“” তুমি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি পারবোনা। তুমি আমার বউয়ের দুইমাত্র ভালোবাসা।””

রাত থমকে দাড়ালো। রিদান কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,

“” তুই যা স্বীকার করছিস না,তা ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করছিনা। তবে হ্যা,তুই আমাকে বাবা বলে না ডাকলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি কি তোকে বাবা বলে ডাকতে পারি? এতো বছর পর বাড়ি এলাম। জন্মদাতার বিয়োগ ঘটায় তাকে তো ডাকতে পারছিনা। মনের ভেতর শূন্যতা অনুভব করছি।””

রাত তখনো দাড়িয়ে। পেছনে-সামনে কোনোদিকেই পা মেলছেনা। রিদান আরেক কদম এগিয়ে এসে মুখটা সামনে বাড়িয়ে বললো,,

“” বাবা,আমি কি তোমাকে একটু ছুতে পারি?””

বাবার এমন আদুরী আবদারে রাত আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। বুকের ভেতর জমে থাকা সকল অভিমান পিষিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।

“” সরি বাবা।””

রিদান ছেলের পিঠে আদুরী কিল দিয়ে বললো,,

“” ইটস ওকে,বাবা!””

~~
বাচ্চারা যেমন হাঁটা-খেলা শেষে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়েজনীয় আধো বুলিতে গল্প জুরে বসে ঠিক তেমনি একটা বয়সসীমা পার হওয়ার পর মানুষ বুড়ো বয়সে জানা-অজানা শব্দ দিয়ে গল্প জুরে দেয়। সেইসব গল্প শোনার প্রচন্ড ধৈর্য্যের প্রয়োজন যা সকলে করে উঠতে পারেনা। জীবনের এমন স্বল্প সময়ে কেই বা চাইবে বুড়ো বাবা-মা,দাদা-দাদী,নানীর গল্প শুনে সময় ব্যয় করতে? তাই সকলেই তাদের এড়িয়ে চলে। সকলেরই কত তাড়া। কিন্তু রিদানের নেই। সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে মায়ের বুলিতে। গভীর মনোযোগী। একসময় মায়ের কথার ঝুরি ফুরিয়ে এলেই মাকে কোলে তুলে বললো,,

“” এইবার ছেলের কোলে করে এঘর-ওঘর ঘুরবে। আবার যদি শুনেছি ঘরে বসে,শুয়ে কাটাচ্ছো তাহলে কিন্তু তোমাকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে আসবো। কেউ তোমাকে দেখতেও যাবেনা।””

রিদান মাকে নিজের পাশের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলো। সামনে নাস্তার প্লেট সাজিয়ে দিচ্ছে। মা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে বললেন,,

“” তোর মুখটা দেখার জন্যই এখনো পৃথিবীর আলো,বাতাসে পড়ে আছি। এখন খোলা আকাশ কেন,মাটির নিচে ফেলে এলেও আমার কোনো আপত্তি নেই!””

একে একে সকলেই নাস্তার টেবিলে হাজির। সবগুলো ভরা চেয়ারের মাঝে একটি শূন্য চেয়ার বড্ড বেমানান লাগছে। রিদান শূন্য চেয়ারের মাঝে নিজের ছেলের মনের ভেতরের শূন্যতাও যেন অনুভব করতে পারছে। সকলকে খাবার শুরু করতে বলে সে পা বাড়ালো ছেলের বউয়ের রুমের দিকে।

~~

সন্ধ্যার ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে। মায়ের ডাকাডাকি শেষে মামির ডাকাডাকিতে ঘুমানো অসহ্যকর। তাই বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হলো। ঠান্ডা পানির ছোয়াতে ঘুমটা চলে গেলেও আলসেমি ভাবটা তখনো সীমিত। জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরে আলো প্রবেশের পথ খোলায় যখন ব্যস্ত তখনি কারো পায়ের আওয়াজ পেলো। দৌড়ে নিজের গুছানো কাঁথাটা মেলে শুয়ে পড়লো। পুরোমুখ ঢাকা।

কয়েক মিনিট পেরিয়ে যেতেও যখন রাতের কন্ঠ পেলোনা সন্ধ্যা চুপচুপ করে কাঁথাটা সরালো। তার বেডের সামনে চেয়ারে কেউ বসে আছে। রাতের মতো দেখতে হলেও রাত নয়। সন্ধ্যা এক ঝটকায় উঠে বসলো। সামনের মানুষটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,,

“” তুমিই তাহলে সেই মামা, যে আমার মামিকে এতো কষ্ট দিয়েছে,অত্যাচার করেছে?””

সন্ধ্যার প্রশ্নে রিদান কিছুটা নড়ে উঠলো। প্রথম আলাপেই এতোটা সহজ করে দিবে তা ভাবেনি রিদান। তবে খুব একটা অবাকও হয়নি। তিয়ামতীর চিঠির অনেকাংশ জুরেই থাকতো এই মেয়ের চঞ্চলতা!

রিদান স্বল্পশব্দে হেঁসে উঠে চেয়ার ছাড়লো। সন্ধ্যার পাশে বসে বললো,,

“” তুমিই সেই মেয়ে,যে আমার ছেলেকেটাকে জ্বালাতে জ্বলাতে পাগল বানিয়ে দিয়েছে?””

মামার এমন প্রশ্নে ভাগনি চমকিত। গলার সুরে নেমে এসেছে ইতস্ততা। আমতা আমতা টেনে বললো,,

“” আমি কেন জ্বালাতে যাবো? তোমার ছেলেই তো আমাকে জ্বালাচ্ছে।””

রিদান সন্ধ্যার মাথায় হাত রাখলো। নরমসুরে বললো,,

“” সম্পর্কে তুই আমার অনেককিছু হোস। সবছেড়ে তোকে আমি মা বলেই সম্বোধন করলে তোর কোনো আপত্তি আছে?””

সন্ধ্যা মাথানিচু করে বামে-ডানে দুলালো।

“” বেশি কিছু বলবোনা। এক লাইনে বলছি। আমি জানি আমার মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। সে ঠিক বুঝে নিবে।””

সন্ধ্যা ডান দিকে মাথা কাত করে আচ্ছা বুঝালে রিদ বললো,,

“”তুই যেমন রাতের উপস্থিতে নিজেকে ভয়ের মধ্যে সিটিয়ে নিচ্ছিস। রাত ও তেমন তোর অনুপস্থিতে নিজেকে আমাদের সবার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে নিচ্ছে। এর ফলাফল কিন্তু ভয়ানক হতে পারে। এমন ও হতে পারে ও নিজেই নিজের শরীরের সাথে ভয়ানক কিছু করে ফেলেছে।””

রিদান নিজের স্বল্পবাক্য শেষ করে উঠে পড়লো। ঠোঁটে তার আগমনী বিজয়ী হাসি। কিছু মানুষ আছে,যে নিজের ক্ষতিটা খুব সহজে পুষিয়ে নিতে পারলেও প্রিয় মানুষটার নগন্য আঘাতটাও সহ্য করতে পারেনা। এই মুহুর্তে রিদান সন্ধ্যাকে সেই কিছু মানুষগুলোর দলেই ফেললো।

~~

প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে রাত সন্ধ্যার দরজার সামনে হাঁটাচলে করে নিজের রুমে ফিরেছে। কেন জানি ছোট্ট একটা নক করার সাহসটাও জাগিয়ে তুলতে পারেনি। নিজের চেয়ার-টেবিলের সামনে থম মেরে রইলো। এই জায়গায় বসে কত অদ্ভুত অদ্ভুত আবদারে রাতের ঘুম নষ্ট করেছে তার হিসেব নেই। অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গিয়েছে দুজনের আর খাতাকলম নিয়ে বসা হয়না।

রাত একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই পাশের চেয়ারটা সরে যাওয়ার শব্দ। রাত মাথা উচু করে তাকলো। সন্ধ্যা বসে আছে। সত্যিই কি সন্ধ্যা নাকি মনের ভ্রম??

সন্ধ্যা বুকভর্তি সাহস ভরে বললো,,

“” সরি বলো।””
সন্ধ্যার দিক থেকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে আশায় রাত বাকরুদ্ধ। নির্বাক চোখে চেয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে।

“” কি হলো সরি বলো।””
“” কেন?””
“” তুমি আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছো তাই।””
“” আমি কি এমনি এমনি করেছি?””

সন্ধ্যা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো।

“” আবার ঝগড়া করছো তো? তোমার আব্বুর কাছে নালিশ করবো।””
“” কর।””
“” আমি কিন্তু আবার চলে যাবো।””
“” যা।””

সন্ধ্যা বিরক্ত হয়ে পা চালালো। তবে বাইরে নয়। রাতের বিছানায় শুয়ে পড়ে বললো,,

“” আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমিয়ে নেই। সকালে যাবো।””

রাত সন্ধ্যার কাছে এসে বললো,,

“” তুই আমার রুমে কেন ঘুমাবি? তোর রুম নেই?””
“” না। দান করে দিয়েছি।””
“” তাতে আমার কি? তোর আমার রুমে জায়গা নাই। যা এখান থেকে।””
“” যাবোনা। কি করবে?””
“” তুই যাবি নাতো?””

সন্ধ্যা মুখ বাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। রাত ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পার করলো। কাধে হাত রেখে ওকে সোজা করে শোয়ালো। সন্ধ্যা কপাল কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করতেই রাত ধপ করে ওর উপর শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যা সুক্ষ আর্তনাদে বললো,,

“” ও মা গো,তোমার মেয়েকে মেরে ফেললো গো। তোমার কি জায়গা অভাব পড়েছে,রাত ভাইয়া?””

সন্ধ্যা বেশ বল প্রয়োগ করেও রাতকে সরাতে পারছেনা। রাতের দিক থেকেও কোনো নড়নচড়ন নেই। শিথীলভাবে শুয়ে আছে। সন্ধ্যা আচমকা সন্দেহ নিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া,তুমি কি অজ্ঞান হয়ে গেলে? হলে তো হলে,আমার উপর এসেই হতে হলো?? এখন তো তোমার ভারে আমিও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি!””

চলবে
#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৬)

সন্ধ্যা মুখ বাকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। রাত ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পার করলো। কাধে হাত রেখে ওকে সোজা করে শোয়ালো। সন্ধ্যা কপাল কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করতেই রাত ধপ করে ওর উপর শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যা সুক্ষ আর্তনাদে বললো,,

“” ও মা গো,তোমার মেয়েকে মেরে ফেললো গো। তোমার কি জায়গার অভাব পড়েছে,রাত ভাইয়া?””

সন্ধ্যা বেশ বল প্রয়োগ করেও রাতকে সরাতে পারছেনা। রাতের দিক থেকেও কোনো নড়নচড়ন নেই। শিথীলভাবে শুয়ে আছে। সন্ধ্যা আচমকা সন্দেহ নিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া,তুমি কি অজ্ঞান হয়ে গেলে? হলে তো হলে,আমার উপরে এসেই অজ্ঞান হতে হলো? এখন তো তোমার ভারে আমি নিজেও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।””

সন্ধ্যার চিৎকারেও রাতের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। নিশ্বাস আছে তো মানুষটার?? সন্ধ্যার মনে জড়ো হচ্ছে ভয়েরা। সত্যি সত্যি অজ্ঞান হলো নাকি? কিন্তু কেন? অজ্ঞান হওয়ার মতো তো তেমন কিছুই ঘটেনি। তাহলে অতি সুখে অজ্ঞান?? হতেও পারে। অতি শোকে যদি পাথর হয় তাহলে অতি সুখে অজ্ঞান হবেনা কেন?? গুরুজনদের প্রবাদবাক্যে এই প্রবাদটাও রাখা উচিত ছিলো। সন্ধ্যা ছোট্ট আফসোসের নিশ্বাস ছাড়লো।

কিছুক্ষণের জন্য ভাবনায় হারিয়ে গেলেও পরক্ষণেই সে বাস্তবে ফিরে এলো। রাতের দুবাহু চেপে ধরে চিৎকার করে ডাকলো,,

“” ও রাত ভাইয়া। উঠোনা৷ তোমার জ্ঞান ফিরাতে হলেও তো তোমাকে সরতে হবে। তুমি না সরলে আমি পানিটা আনবো কিভাবে??””

সন্ধ্যা নিজেদের রুমের বন্ধ দরজাটার দিকে চেয়ে আছে। ইশ! কেন যে সে দরজাটা লাগিয়ে নিয়েছিলো। এখন তো কাউকে ডাকলেও শুনবেনা। যদি শুনেও ভেতরে আসবে কিভাবে? দরজাটা তো তাকেই খুলতে হবে। সন্ধ্যা মুখটা আধার করে আরেকদফা চেচিয়ে উঠলো। রাতের কানের দ্বারে। এবারও রাত শীথিল তবে ডান হাতটা নড়লো। উড়ে গিয়ে পড়লো সন্ধ্যার মুখে। মুখ বন্ধ করে বিরক্তসুরে বললো,,

“” দেখছিস তো ঘুমাচ্ছি,তাও কেন ডিস্টার্ভ করছিস? একটু চুপ করে থাকতে পারিসনা? আমার কান ঝালাপালা করে ফেলেছিস। আমাকে কি তোর বয়রা মনে হয়? আর একটা চিৎকারও যেন না হয়। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো। তুইও ঘুমা।””

রাত নিজের বিরক্ত,ঝাড়ি,আদেশ,অনুরোধ সব একসাথে ঢেলে দিলো সন্ধ্যার উপর। পুনরায় আগের ন্যায় নিরব। হাতটা তখনো সন্ধ্যার মুখেই পড়ে আছে। সন্ধ্যা অবাক। এমনভাবে চেয়ে আছে যেন রাত আরোকিছু বলবে আর ও আরেকটু অবাকের মধ্যে বিচরন করবে। কিন্তু রাত তা করেনি। সে আর একটা বুলিও মুখে ফুটাইনি। গভীর নিশ্বাসে চোখ বন্ধ তার।

রাতের কার্যক্রম সন্ধ্যা হজম করতে পারলোনা। ঝটকা দিয়ে রাতের হাত সরিয়ে নিলো। মুক্তমুখে গরম ফুলকি নিয়ে বললো,,

“” আমাকে ভর্তা বানিয়ে তোমার ঘুমানো হচ্ছে? জেগে থেকে এমন অভিনয়? শরীরের উপর অর্ধেক পাহাড়ের বোঝা দিয়ে বলছো ঘুমাতে? আমার সাথে মজা করা? এখনি সরবে নাহলে কিন্তু নিচে ফেলে দিবো তোমায়!””

সন্ধ্যার কথায় রাত মুচকি হাসলো। নিজের হাতজোড়া দিয়ে ওর কোমড় পেচিয়ে ধরলো। বুকের খাদে গভীরভাবে নাক ঠেকিয়ে হামি টানলো। আধোবুলিতে বললো,,

“” পারলে সরা!””

সন্ধ্যা নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়েও রাতকে সরাতে পারছেনা। এতো চেষ্টা,এতো চিৎকার,এতো বকবক যেন রাতের গা’য়ে পড়ছেনা। সে গভীরঘুমে আচ্ছন্ন। ভারী নিশ্বাসের শব্দেই বুঝা যাচ্ছে ঘুমের দেশের কতটা গভীরে পৌছে গিয়েছে। কোনো এক রঙিন স্বপ্নে ডুব দিয়েছে। সাধারণত,গভীর ঘুমে মানুষের শরীর অসার হয়ে থাকে। হাত-পাসহ পুরো শরীর অবশ এবং দুর্বলতায় ভুগে। ফলে চাইলে একজন ঘুমের মানুষকে নাড়ানো যায়। কিন্তু রাতের মধ্যে এর একটাও ঘটলো না। সে যত ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে তত সন্ধ্যাকে শক্তভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে। সন্ধ্যার মনে হলো কোনো সাপের পেটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে৷ গরমে ঘেমে নেয়ে যাওয়া উপক্রম। এভাবে কি ঘুমানো যায়?? সন্ধ্যার কান্না পেয়ে গেলো। এইটুকু মেয়ে হয়ে সে এতবড় একটা বুড়োকে বিয়ে করলো। কোথায় আদর-সোহাগ করবে তা না,শুধু কষ্ট দিচ্ছে। সন্ধ্যা ঝরঝরে পড়া চোখের পানি নিয়ে বিড়বিড় করলো,বিয়ে মানে কষ্ট,কষ্ট আকাশ সমান কষ্ট!

~~

সারারাত নির্ঘুমে রাত কাটালো সন্ধ্যা। মেজাজ পুরোই খিটখিটে। একেতো তার ঘুম হয়নি তার উপর পুরো শরীরে ব্যথারা বিনবিন করছে। মনে হচ্ছে হাত-পা নাড়ানোই যাচ্ছেনা। যেখানে শরীরের কোনো অংশ কিছু সময়ের জন্য একভাবে রাখা হলে ঝিনঝিন ধরে,সেখানে সে সারাটারাত একভাবে কাটিয়েছে তার উপর একটা আটার বস্তা,না একটা বললে ভুল হবে একশ টনের আটার বস্তা বয়েছে

“” কিরে,খাচ্ছিস না কেন?””

মায়ের ঝাড়িতে সন্ধ্যার মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে গেলো। মুখে কিছু না বলে খাবার ছেড়ে উঠে পড়লো। পা চালিয়ে চলে গিয়েও আবার উল্টো পথে ফিরে এলো। রাতের প্লেটে পানি ঢেলে দিলো। সন্ধ্যার আকস্মিক কান্ডে সকলে চমকে গেলেও রাতের কিছু হলোনা। সে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললো,,

“” আম্মু,ভেজা পরোটা খেতে হেব্বি টেস্টি। কেমন একটা রসালো রসালো স্বাদ। তোমরাও ট্রাই করতে পারো।””

রাত নিজের রসালো বাক্য শেষ করে এক টুকরো পরোটা মুখে পুড়লো।

~~

রাত অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। শার্টের বোতাম লাগিয়ে গলায় টাই বাধলো,হাতের আঙুলের সাহায্যে চুলটা ঠিক করলো। গায়ে সুগন্ধী মেখে নিলো।

সন্ধ্যা রাগ আর চোখে গাঢ় ঘুম নিয়ে ঝিমুচ্ছিলো ফাঁকে ফাঁকে রাতের সাজ দেখছে। রাত পকেটে মানিব্যাগটা ঢুকিয়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বেরোবে তখনি সন্ধ্যা রাস্তা আটকালো।

“” কিছু বলবি?””

সন্ধ্যা চুপ। রাতের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি। এমনভাব যেন রাত ওর চোখের ভাষা পড়ে নেক। আজ চোখের ভাষায় মনের কথা প্রকাশ পাক। সবসময় কেন কন্ঠের সুরে প্রকাশ পাবে?? মাঝে মাঝে কি চোখ কথা বলতে পারেনা??

“” কিছু না বললে সামনে দাড়ালি কেন? আমার লেট হচ্ছে সন্ধ্যা। কিছু লাগবে? লাগলে বল আসার সময় নিয়ে আসবো।””

রাতের এমন কথায় সন্ধ্যার গাঢ় দৃষ্টি হালকা হয়ে এলো। কি চাইছে সে আর কি পাচ্ছে। না দুরে সরিয়ে দিচ্ছে না কাছে টেনে নিচ্ছে। যেকোনো একটা হওয়া উচিত। এখন কি আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে,মুভির মতো তুমিও আমায় একটা চুমু খেয়ে যাও।

রাতের ঘড়ি পড়া শেষ। বের হওয়ার পুর্ন প্রস্তুতি নিয়ে সন্ধ্যার ডানগালে হাত রাখলো। ঠোঁটে স্মিত হাসি নিয়ে বললো,,

“” মনে পড়ছেনা? ভুলে গিয়েছিস? এতে মন খারাপের কি আছে? যখন মনে পড়বে তখন কল করে নিস।””

সন্ধ্যার আগের রাগটা এবার ঝাঝ থেকে তেতোতে রুপ নিলো। মুখভার করে সরে দাড়ালো। রাত পা ফেলে চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যা উল্টো ঘুরে থেকেই বললো,,

“” তোমার অফিসের উপর ঠাডা পড়ুক!””

রাত কি শুনলো সন্ধ্যার বিড়বিড়ানি? অবশ্যই শুনেছে নাহলে ঠোঁট টিপে হাসছে কেন?

~~

ডিনার শেষ হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানিক আগে। রিদান আধশোয়া আছে। হাতে কবিতার বই। কোনোকালেই সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষন ছিলোনা। তবে তার একাকিত্বের সময়ের অনেকটা সময় কাটিয়েছে এই বইয়ের মাধ্যমে। ভালো লাগা থেকে নয়,ভালো লাগাতে তার স্যার তার হাতে বেশ কয়েকটি বই তুলে দিয়েছিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অভ্যাসটা এতোটাই ঝুকে বসেছে যে রাতে ঘুমানোর আগে বইয়ে চোখ না বুলালে তার ঘুম আসেনা। সেই অভ্যাস থেকেই সে এখন বই নিয়েছিলো। কিন্তু চোখটা যে তার বইয়ের কালো রঙের অক্ষরগুলোতে আটকাচ্ছেনা। বারবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। তার সহধর্মিণী দিকে! অযত্নে পড়ে থাকা চুলগুলোকে যত্নে আনায় ব্যস্ত সে। কালো চুলের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সাদা চুলের লুকোচুড়িটা বেশ অপভোগ করছে রিদ। রিদান বইয়ের পাতা বন্ধ করে মনোকন্ঠে বললো,তোকে আর দরকার নেই আমার ভালোলাগার সঙ্গিটি এখন আমার সামনে। চাইলেই যখন তখন নেশায় ডুব দিতে পারি। এখন থেকে তোর ছুটি।

রিদান হালকা শব্দে বইটি পাশে রেখে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর কাছে এগুলো। নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,,

“” তোর অযত্নে পড়ে থাকা জিনিসগুলো আমার আয়ত্বে থাক। যত্ন করার দায়িত্ব আমার।””

তিয়ামতীর হাত থেকে চিরুনীটা নিয়ে ওর চুলে আঁকছে। চুলে বেনি পাকিয়ে বললো,,

“” আমার সেই ছোট্ট তিল তুই। চুলে পাক ধরে,চামড়ায় ভাজ পড়লেও তুই আমার সেই ছোট্ট তিলই থাকবি। মানুষের বয়স বাড়লেও ভালোবাসার বাড়েনা। আমার ভালোবাসা এখনো সেই কচি রঙেই আছে। আর তার ভালোবাসার মানুষটাও!””

তিয়ামতী লজ্জায় লাল। তার রিদ ভাইয়া যে এমন মধুবাক্যও বলতে পারে তাতো তার কখনো জানা হয়নি।

রিদান তিয়ামতীকে আরো কিছু বলবে কিন্তু তখনি নজর পড়লো আয়নাতে। তিয়ামতীর কাছ থেকে সরে এসে দরজায় দাড়ালো। দরজা মেলে বললো,,

“” তুই আগে যেমন নির্দ্বিধায় মায়ের রুমে ঢুকতিস এখনো সেভাবেই ঢুকবি। মনে রাখিস,তোর দায়িত্ব তোর আমার দায়িত্ব আমার। আমি এসেছি বলে তুই তোর দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবি তা হবেনা। যা, মাকে ঔষধ খায়িয়ে আয়।””

~~~
সন্ধ্যার মন অশান্ত সাথে হাত-পা,মেজাজ সব অশান্ত। একবার খাটে গিয়ে বসছে তো আরেকবার ধপধপ পা ফেলে হাঁটা চলা করছে। কয়েকবার বারান্দায় গিয়ে খোলা আকাঁশের সাদা চাঁদের রুপোলি আলোতে নিজেকে মাখিয়েও নিয়েছে তাতেও তার অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছেনা। কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে না পেরে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। মুখ ধুলো,পা ধুলো,হাত ধুলো। হাত ভিজিয়ে গলা,পেট,পিঠ,ঘাড় সব মুছে নিলো। চুলটাও ভিজিয়ে আবার রুমে ঢুকলো। খাটের অপরপাশের মানুষটাকে দেখে সন্ধ্যার এবার গা জ্বলছে। ইচ্ছে করছে পানির টাংকিতে ডুবে থাকতে।

রাত খাটের শেষ সীমানায় গা এলিয়ে ফোন টিপছে। গভীর মনোযোগী। ক্ষণে ক্ষণে হেঁসে উঠছে। কিন্তু হাঁসির কারণটা ফোনের জন্য না। সন্ধ্যার কান্ডে। তবে তা সন্ধ্যাকে বুঝতে দিলে তো। সে যে আড়চোখে সন্ধ্যার চালিয়ে যাওয়া খুটিনাটি সব দেখছে তা সন্ধ্যা আন্দাজও করতে পারছেনা। করবে কিভাবে? মেজাজ এমন তিরিক্ষে থাকলে পরিষ্কার জিনিসও ধোয়াশা হয়ে যায়।

সন্ধ্যা রাগ কমাতে গোসলও করে ফেলেছে। এতেও সে রাতের দৃষ্টি ফোন থেকে সরাতে ব্যর্থ। রাগে অভিমানে নিজে ওর পাশে গিয়ে বসলো। তার হাতেও ফোন। ফোনে একটু মনোযোগ দিতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধী চাপলো। রাতের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,,

“” রাত ভাইয়া, দেখ আবির আমাকে নিয়ে কি স্ট্যাটাস দিয়েছে। আমায় কত্ত ভালো…””
“” টানটান হয়ে শুয়ে পড়তো।””

সন্ধ্যা নিজের বাক্যের শেষাংশ গিলে নিয়ে বললো,,

“” মানে?””

রাত আর কোনো কথা খরচ করলোনা। সন্ধ্যার দু’পা নিচের দিকে টান দিতেই ও আধশোয়া থেকে পুরো শোয়া হয়ে গেলো। সন্ধ্যাকে কি হচ্ছে তা বুঝার সময়টুকু না দিয়ে ওর উপর নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। আগের রাতের মতো দ্বিতীয়বারে নয়,প্রথমবারেই ওর কোমড় জড়িয়ে নিয়েছে। রাত ভারকন্ঠে বললো,,

“” গুড নাইট!””

রাতের এমন অদ্ভুত আর বিরক্ত কান্ডে সন্ধ্যার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঝাঝ ছেড়ে খেকিয়ে উঠলো,,

“” সমস্যা কি তোমার? নিজের যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করে যাচ্ছো। সরো বলছি। আদর সোহাগের নাম নাই,আবার কোনো নিস্তারও নাই। তোমার ঘুম পেলে ঘুৃমাও। আমাকে জ্বালাচ্ছো কেন?””

রাত মাথা উচু করে সন্ধ্যার রাগী মুখটার দিকে চেয়ে রইলো।

সন্ধ্যা কপাল কুঁচকে বললো,,

“” তুমি তো রীতিমতো আমার উপর অত্যাচার করছো। অন্যের স্বামীরা বউকে পিটায় তাই তার শরীর ব্যথা করে আর তুমি না পিটিয়েও আমার শরীরে ব্যাথা বানিয়ে দিচ্ছো! আমার ঘুম কেড়ে নিচ্ছো।””
“” তুই যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলি তার কি হবে? মাত্র একরাত ঘুমাতে না পেরে আমার উপর রাগ ঝাড়ছিস। আর আমি ১৭টা রাত নির্ঘুমে কাটিয়েছি।””

সন্ধ্যার বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন,,

“” আমি কখন তোমার ঘুম কেড়ে নিলাম?””
“” যে রাতে সায়নকে বিয়ে করবি বলে নেচে বেড়াচ্ছিলি সে রাত থেকে আমার প্রতিটি রাত নির্ঘুৃমে কেটেছে। আমি তো না জেনে তোর সাথে অমন করেছিলাম কিন্তু তুই জেনেবুঝে করেছিস। কিভাবে পারলি এতোগুলো রাত আমাকে ছাড়া কাটাতে? আমি তো পারিনি!””
“” তুমি প্রতিশোধ নিচ্ছো?””
“” না। তোকে বুঝাচ্ছি।””
“” আমি তো তোমাকে জেগে থাকতে বলিনি। তুমি জেগে ছিলে সেটা তোমার দোষ। তোমার দোষের শাস্তি আমি কেন পাবো?””

রাত সন্ধ্যার বুকে মুখ গুজে বললো,,

“” আমিও তো তোকে জেগে থাকতে বলিনি। তাহলে জেগে আছিস কেন?””
“” তুমি তো ঘুমাতেও দিচ্ছোনা।””
“” দিবোও না।””

সন্ধ্যা কাদোকাদো গলায় বললো,,

“” আমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।””
“” আরো ১৫ টা রাত নির্ঘুমে কাটা তারপর ২৪ ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটাস।””
“” এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা। আমাকে অবলা পেয়ে অত্যাচার করছো। আমি তোমার নামে কেস করবো।””
“” কর।””
“” তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াবো।””
“” আচ্ছা।””
“” তোমাকে মোটা মোটা ডান্ডার বারি খাওয়াবো।””
“” ওকে।””

সন্ধ্যা ঝাড়ি তুলে বললো,,

“” রাত ভাইয়া!””
“”শুনছি।””
“” আমি ঘুমাবো।””
“” ঘুমা।””
“” এভাবে কি ঘুমানো যায়? আমি কাত হয়ে শুবো,গায়ে চাদর টানবো তারপর ঘুমাবো।””

রাত আবার মুখ উচু করলো। বা’চোখটা টিপে বললো,,

“” আজ থেকে তুই আমার বিছানা আমি তোর চাদর। নে এবার ঘুমা!””

সন্ধ্যা রাগে দুঃখে রাতের চুল টেনে ছিড়ে ফেললো,পিঠে নখের দাগ বসিয়ে দিলো,চিৎকার করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলো। তবুও রাতের হাতের বাধন থেকে ছুটতে পারলোনা।

~~

এই নিয়ে ন’বার মায়ের রুমে ঢুকলো রাত। তিয়ামতী আর রিদান সন্দেহ চোখে তাকালো। রিমা এবার প্রশ্ন করেই ফেললো,,

“” তোর কি পেটে অসুখ করেছে রাত? তখন থেকে রুমে ঢুকছিস আর বেরোচ্ছিস। মুখে কোনো কথা নাই। পেটে অসুখ হলে তো বাথরুমে ঢুকবি আর বেরোবি। কিন্তু তা না করে এখানে ঢুকছিস আর বেরোচ্ছিস। দেখছিস না আমরা লুডু খেলছি?””

ফুপির কথায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো সে। তার কি দোষ? তার বিছানা তো রুমে না থেকে মামির কোলে ঘাপটি মেরে বসে আছে। খেলায় তো সে নেই তবুও কেন তার এখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে?? সে কি বুঝছেনা তার চাদর তার জন্যই মনে অসুখ নিয়ে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে??

ঘন্টাখানেক হবে তিয়ামতীর রুমে লুডু খেলার আসর জমেছে। স্বামী VS বউ। লুডুর কোর্ট যেহেতু চারজনের জন্য বরাদ্দ সেহেতু সন্ধ্যা আর রাত বাদ পড়েছে। তবে বাদ পড়ার আরেকটা কারন ছিলো,রাত নিজ মুখে খেলতে অস্বীকার করেছিলো।

রাতের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রিমা আবার বললো,,

“” তুই না বললি কাল সকাল সকাল বের হতে হবে? তাহলে এখনো এখানে কি করছিস? যা ঘুমোতে যা।””

ফুপির কড়া গলা আর আদেশে রাত অনিচ্ছার পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো। তবে বিছানার ধারে এসে আদেশ পালনে ব্যর্থ। গুটিগুটি পা ফেলে সে আবার মায়ের রুমে হাজির। ফুপিকে প্রশ্ন করতে সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে উঠলো,,

“” আম্মু,আমি কিন্তু কাল অনেক সকালে অফিসে যাবো।””

তিয়ামতী ছেলের দিকে তাকালো। তাকে দমিয়ে রেখে রিমার পাল্টা প্রশ্ন,,

“” এক কথা কতবার বলবি? তোর কি মনে হয় বাংলাদেশে শুধু তুই একাই সকালে উঠিস যে সবাইকে বলে বলে বেড়াচ্ছিস। খেলার মজাটাই নষ্ট করে দিচ্ছিস।””

রাত মায়ের দিকে করুন দৃষ্টি ফেললো। ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সন্ধ্যাকে বললো,,

“” অনেক রাত হয়েছে সন্ধ্যা। যা ঘুমিয়ে পড়।””
“”আমার এখন ঘুম পায়নি। পরে ঘুমাবো।””

তিয়ামতী সন্ধ্যাকে নিজের থেকে সরালো। কন্ঠস্বর শক্ত করে বললো,,

“” এখনি ঘুমাবি। আর তুই তো খেলছিস ও না তাহলে এখানে তোর কাজ কি?””
“” আমি খেলা দেখবো।””
“” সন্ধ্যা,আমি কিন্তু যেতে বলেছি।””

সন্ধ্যা এবার জোরালোভাবে বললো,,

“” ঘুমাবোনা আমি। তোমার ছেলের সাথে তো কখনোই না। তোমার ছেলে কি আমাকে ঘুমাতে দেয়? সারারাত জাগিয়ে রাখে। আমার উপর অত্যাচার করে। রাতে তোমার ছেলের জন্য ঘুৃমাতে পারিনা। দিনের বেলা ব্যথার জন্য ঘুৃমাতে পারিনা। আমি থানায় যাবো। আগে তোমার ছেলের নামে কেস করবো তারপর শান্তিতে ঘুমাবো।””

সন্ধ্যা একদমে সবটা বলে যখন থামলো তখন পুরো পরিবেশ থমকিত। সকলের চক্ষু তার দিকে। সিকান্দার সাহেবের হাতে গুটি। ঘর গুনছিলেন। মেয়ের দুঃখের কথা শুনে মাঝপথেই আটকে আছেন।

রিমা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। মেয়ের শরীর হাতরিয়ে বললো,,

“” কোথায় মেরেছে? দেখা আমাকে। দরকার হলে আমিও তোর সাথে থানায় যাবো।””

সন্ধ্যা মায়ের হাত সরিয়ে হতাশ গলায় বললো,,

“” মারলে তো দাগ পাবে আম্মু। তোমার ভাতিজা তো সারারাত আমার উপর….””

রাত সন্ধ্যার মুখ চেপে ধরেছে। কানে ফিসফিস করে বললো,,

“” মাথার বুদ্ধ কি সব পানির সাথে খেয়ে ফেলেছিস? আম্মু-আব্বু,শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সামনে এসব কি বলছিস?””

সন্ধ্যা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য রাতের হাত খামচে ধরলো। ঠিক তখনি রুম অন্ধকার। রিদান লাইটের সুইচে হাত রেখেই বললো,,

“” রুমে আলো আসার পূর্বেই তুই তোর বউকে নিয়ে বিদেয় হ!””

রাত অন্ধকারেই বাবার দিকে কৃতজ্ঞের হাঁসি দিলো। সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলো।

“” রাত ভাইয়া,ছাড়ো বলছি। আমি আর একটা রাতও জেগে কাটাতে পারবোনা। তুমি আমার উপর এমন জোর করতে পারোনা!””

সন্ধ্যার বাক্যের পিঠে রাত জোরালো হাঁসি হেঁসে বললো,,

“” জোর করার অধিকারটা তো তুই আমাকে দিয়েছিস। ভুলে যাস না, বিয়ে তুই করতে চেয়েছিলি আমি না।””

~~~

সন্ধ্যার আরো কয়েকটি নির্ঘুম কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে সে জেগে জেগে নানা প্ল্যানও করে ফেলেছে। প্রতিরাতেই সে নতুন নতুন প্ল্যান সাজায় কিভাবে রাতের হাত থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু তার কোনো পরিকল্পনায় সফল হয়না। শুরু হওয়ার আগেই রাত ধরে ফেলে। সন্ধ্যার একের পর এক পরিকল্পনার বিফলের ফলে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাতকে খুন করবে। কিভাবে করবে তাও ঠিক করে ফেলেছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে পড়লো যদি তার হুট করে রাত ভাইয়ার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে,ছুতে ইচ্ছে করে তখন রাত ভাইয়াকে কোথায় পাবে?? এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ায় সন্ধ্যার আবার সব পরিকল্পনা ঘেটে গেলো।

অফিস শেষে রুমে প্রবেশ করে সন্ধ্যাকে রুমে পেলোনা রাত। চিৎকার করে ডাকতেই ওয়াশরুম থেকে উত্তর পেলো।

“” তুই এ বেলা গোসল করছিস?””
“” না,তোমাকে মারার প্ল্যান করছি।””
“” বাহ! কি দিয়ে মারবি ঠিক করলি? আর আমার লাশটা কোথায় রাখবি?””
“” তোমাকে কেন বলবো?””
“” বলবি নাতো?””
“” না।””

সাথে সাথে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগানোর শব্দ। সন্ধ্যা পানিটা বন্ধ করে দরজা খোলার চেষ্টা করলো।

“” তুমি বাইরে থেকে লাগালে কেন?””
“” বলবোনা।””

রাত এবার লাইটটাও অফ করে দিলো। সাথে সাথে সন্ধ্যার চিৎকার,,

“” বলবো।””

রাত দরজার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালো। ঠোঁটে দুষ্টু হাঁসি।

“” এখন বললেও খুলবোনা।””
“” কেন?””
“” তুই খুলবি বলে।””
“” আমি তো খোলেই দাড়িয়ে আছি।””
“” উহু,দরজা নয়,অন্য কিছু।””
“” কি?””
“” বড় কাপড় খোলে ফেল।””

সন্ধ্যার কন্ঠ নিভু হয়ে এলো।

“” বড় কাপড় মানে?””
“” তোর ভাষায় বললাম তাও বুঝিসনি? মুভিতে দেখিসনি বড় কাপড় ছেড়ে ছোট কাপড় পরে সুইমিংপুল থেকে উঠে আসে। তুই নাহয় ওয়াশরুম থেকে বের হবি।””
“” ছি! তুমি কি লুচো রাত ভাইয়া। পৃথিবীতে যত লুচো মানুষ আছে তুমি সবার থেকে নিকৃষ্ট। তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে।””
“” তাহলে তালাক দিয়ে দে,তারপর ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখবি,,,পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট লুচো বর হওয়ায় আমি ওয়াশরুমে অর্ধেক গোসল করা অবস্থায়,স্বামীকে তিন তালাক দিলাম,,, পোস্ট আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখবি,তোর তথাকথিত আবির,সায়ন,রবিন,সাজ্জাদ সকলে হাহা রিয়েক্ট নিয়ে তোর সামনে হাজির!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here