ভালোবাসার রাত ২ শেষ পর্ব

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

#অন্তিম_পর্ব

সন্ধ্যার শরীরে চলতে থাকা সব অনুভূতির কথা রাতকে জানিয়ে লম্বা দম নিয়ে বললো,,

“” ইশ! এখন কি সুন্দর নিশ্বাস নিলাম। আমি এখনি ঠিক আছি। তখন অসুস্থ ছিলাম। আমার অমন অসুখওয়ালা আদর চাইনা। আমি ঘুমাবো।””

সন্ধ্যা নিজের সবটুকু কথা শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটলো।

রাত স্বাভাবিকভাবেই সন্ধ্যার চলতিপথের পিছুপানে তাকিয়ে রয়েছে। মনের ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই,কপালে চিন্তার ভাজ নেই,চোখে বিস্ময়ের আভাস নেই এমন কি কন্ঠে কোনো সুরও নেই। সে তার মতো স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কর্ম নিশ্বাসের গতি পরিধি ঠিক রাখার চেষ্টায় আছে। এই মুহুর্তে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো অন্য কিছু হতো। নাকি তার মতোই স্বাভাবিক ভাবে দাড়িয়ে থাকতো??

রাত দৃঢ়পায়ে বারান্দা ছাড়লো। রুমে প্রবেশ করে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। পাতলা কালো রঙের চাদরটা শরীরে মেলে নিয়েছে। শুয়ে পড়তে চেয়েও শুলোনা। এলোমেলো চুলগুলো হাতের আঙুলের সাহায্যে বেনি পাকাচ্ছে। হাতের কাছে বাধুনী না পেয়ে আলসে চাহনি আঁকলো কিছুদুরের ড্রেসিংটায়। আলসে ভাবটা বজায় রেখে আর্ধেক বেনি করে বাকিটা ছেড়ে দিলো।

রাত ড্রেসিং টেবিল থেকে চিকন রাবার নিয়ে এসে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে ধরলো,,

“” তোর সত্যি আদর চায়না?””

সন্ধ্যা রাবারটা নিলো। চুলে পেচ দিতে দিতে বলছে,,

“” চাইতো। কিন্তু অমন অসুখওয়ালা নয়। এদিকে এসো!””

সন্ধ্যার ইশারাতে রাত ওর পাশে বসলো। উৎসুক নয়নে সন্ধ্যার দ্বিতীয় বাক্য শোনার ইচ্ছে। সন্ধ্যা একটু পাশ কেটে গিয়ে রাতকে আরেকটু নিজের দিকে টানলো। পাশ থেকে একটা বালিশ শিথানে দিয়ে শুতে বললো। রাত বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়েছে। এখন সে তৃতীয় বাক্য শুনবে। সন্ধ্যাও রাতের ঠিক পাশেই শুয়ে পড়লো। তবে মাথা বিছানাতে ঠেকেনি। ডানহাতের কনুই ঠেকেছে। আর সেই হাতের তালু তার নিজের মাথায়। বা’হাতে রাতের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে সুর টেনে বললো,,

“”আ….দ….র,,,আ…দ….র,,,,আ….দ…র।””

রাত বাকা চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। ভ্রূজোড়া সমান্তরাল কেটে উপরনিচ হতেই সন্ধ্যা বললো,,

“”তুমি আমায় এমন আদর করতে পারো। আমার কোনো বাধা নেই। আমার বেশ লাগবে। দেখবে তুমি আদরী সুর শেষ করার আগেই আমি ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছি!””

রাত হতবাক। হতবিহ্বল হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। সুক্ষচোখে সন্ধ্যাকে পর্যবেক্ষণ করছে, আমি কি কোনো বাচ্চাকে বিয়ে করলাম? রাতের মনে চলা প্রশ্নের সাথে চোখের চঞ্চলতা সন্ধ্যার আপাদমস্তকজুরে। কড়া নজর ঘন হওয়ার আগেই রাত চোখ বুজে ফেললো। বন্ধচোখের বিবৃতিমুলক বাক্য,,

“” শুয়ে পড়।””
“” কেন?””

রাত চোখ মেললো। সন্ধ্যার প্রশ্নমূলক বাক্যের উত্তর দিবে কি দিবেনা ভাবছে। এতো ভেবে কি হবে? ভাবার কি এতো সময় আছে? রাত সন্ধ্যার ডান হাতটা হেচকা টান দিতেই সন্ধ্যার মাথা বিছানায় গিয়ে ঠেকলো। মাথায় কি একটু লাগলো? নাকি হঠাৎ কান্ডে কাত? সন্ধ্যা আবার মাথা তুলতে চাইলো কিন্তু পারলো কই? রাত আদেশি সুরে বললো,,

“” চোখ বন্ধ কর!””
“” কেন?””

সন্ধ্যার কেন শব্দটা যেন রাতকে বেশি পাগলামীতে পরিণত করছে। তার মনে হলো এই কেন শব্দটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী এবং কঠিন প্রশ্নের সাথে যুক্ত করা হয়। যার উত্তর দেওয়া জটিল।

সন্ধ্যা চোখ বন্ধ করার বদলে বড় বড় করে রাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব যেন এভাবে তাকালে রাত উত্তর দিতে বাধ্য। আর সে উত্তর না নিয়ে চোখের পলক ফেলবেনা। রাত সন্ধ্যার ভাবভঙ্গি টের পাচ্ছে। তবে আজ তাতে পাত্তা দিতে ইচ্ছে করছেনা। রাত নিজের বা’হাতটা দিয়ে সন্ধ্যার চোখ ঢাকলো।

“” আমি সবসময় তোর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার মন চাইতো তুই আমার ইচ্ছেতে চল। আমার মাঝে নিজেকে খুজে বেরা। কিন্তু তা কখনোই প্রকাশ পায়নি। তোর জেদ,ছেলেমানুষির কাছে আমার ভেতরে চলা সব ইচ্ছে,রাগ পরাজিত হয়েছে। সাথে আমি। দিনের শুরুটা আমার মতো শুরু করতে চাইলেও শেষটা করেছিস তোর মতো। আমার খারাপ লেগেছে,অভিমান হয়েছে। কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। তোর এই দুটো চোখের দিকে তাকালে আমি সব ভুলে যেতাম। কিন্তু এখন আমি ভুলতে চাইনা। আমার ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিতে চাই। আজ তুই আমার কাছে পরাজিত হবি। তোর ইচ্ছের হার হবে। পরাজিতের খাতায় আমার পাশে তোর নামটাও উঠবে।

সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,,

“” কিসের ইচ্ছে,কিসের পরাজয়? রাত ভাইয়া তুমি কি করতে চাচ্ছো?””
“” আর একবার ভাইয়া বলবি তো ঠাস করে চড় লাগিয়ে দিবো।””

রাতের প্রসস্ত হাতে সন্ধ্যার চোখসহ,উপর দিকের ভ্রূজোড়া এবং কপালের নিম্নাংশ ঢাকা পড়েছে। নিচের দিকে নাক এবং দুগালের এক তৃতীয়াংশও ঢাকা। রাতের উদবেগশূন্য ধমকে সন্ধ্যার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে ঢাকাংশে কিছুটা বিরক্তের ভাজ। সন্ধ্যার ঠোঁট কাঁপছে। কিছু বলবে, কিন্তু বলার সুযোগটা হারিয়েছে রাতের মহামারী দীর্ঘ চুমুবন্দীতে!

সন্ধ্যার দখল করা ঠোঁট ছেড়ে দিলো রাত। ওর চোখ থেকে হাত সরিয়ে উঠেও পরেছে। সন্ধ্যাকে কিছু বলতে না দিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিলো।

সন্ধ্যা রাগে-দুঃখে কেঁদেই দিবে এমন ভাব করে রইলো। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,,

“” তুমি আমার রাত ভাইয়া হতেই পারোনা। তুমি অন্য কেউ!””
“” ঠিক বলেছিস,আমি তোর রাত ভাইয়া নই। আমি তোর বিয়ে করা বর!””

রাত সন্ধ্যার পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরলো। সন্ধ্যা রাতের বাধন থেকে ছুটতে ছুটতে বললো,,

“” তুমি আমাকে ছুবেনা। আমি মানা করা সত্ত্বেও আমাকে অসুখওয়ালা আদর করেছো। আমি আবার অসুস্থ হয়ে গিয়েছি।””

রাত ঠোঁটটিপে হাঁসছে। সন্ধ্যার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,,

“” আজ সারারাত তুই অসুখে ভুগবি। আমি তোর অসুখ দেখবো। এতোদিন পালাবদলে দুজন রাত জেগেছি। আজ থেকে একসাথে জাগবো। আজকের এই জোসনা রাত হবে, আমার #ভালোবাসার রাত আর তোর অসুখওয়ালা আদরের রাত!””

~~

সন্ধ্যার ঘুম ভাঙলো সকাল আট”টায়। চোখের পাতা একটা আরেকটার সাথে আঠার মতো লেগে আছে। কিছুতেই খোলা যাচ্ছেনা। এদিকে রাতের ডাকাডাকিতে ঘুমানো অসহ্য।

“” এই সন্ধ্যা উঠনা। আমার তো অফিসে যেতে হবে।””
“” উহু!””

সন্ধ্যা ডানপাশ থেকে বা’পাশে ঘুরলো। বিরক্ত লাগলেও সে ঘুমাবে। তার ঘুম পাচ্ছে। দুনিয়া ভুলানো ঘুম।

“” বউ,সোনা বউ,আমার লক্ষী বউ,আমার সন্ধ্যামনি, উঠো।””

সন্ধ্যা চোখ মেললো। এমনি ঘাটতি ঘুমে চোখ লাল তার উপর রাগ এসে ভর করছে। সন্ধ্যা শোয়া থেকে চট করে উঠে বসলো। রাতকে ক্রোধভর্তি নয়নে জ্বলসে দিতে চাচ্ছে। সন্ধ্যার মতিগতি উর্ধ্বস্তরে বুঝতে পেরে রাত গলায় আদর এনে বললো,,

“” ব্রেকফাস্টটা করে নে। তারপর আবার ঘুমাস। আমি পারসোনালি সবাইকে বলে যাবো। তোকে কেউ ডিস্টার্ব করবেনা। খাবার টেবিলে তুই না থাকলে আমার খেতে ইচ্ছে করেনা৷ আর আম্মুকে তো চিনিস,খালি মুখে আমাকে বেরোতে দিবেনা। তার উপর আমি চাকরীতে জয়েন করেছি কিছুদিন হলো। এখন তো চাইলেই ছুটি…””
“” এতোকিছুই যখন বুঝো তখন আমাকে ঘুমোতে দিলেনা কেন? আমি বলেছিলাম আমাকে জাগিয়ে রাখো?””

সন্ধ্যার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো রাত। সে এখন কিছু মনে করতে চায়না। কিছুনা! তাহলে তার চাকরী নট হয়ে যেতে পারে।

রাত সন্ধ্যার দিকে মিস্টি হাঁসি উপহার দিলো। গালে চুমু খেলো। চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ওর জামার টুকরোগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” এগুলো পড়ে নে। আম্মু যখন তখন চলে আসতে পারে।””
“” পারবোনা।””
“” কেন?””
“” রাতে বলবা খুলতে,দিনে বলবা পড়তে,আমাকে কি তুমি খোলা আর পরার চাকরী দিয়েছো? আমি বিয়ে করেছি চাকরী করার জন্য?””
“” তাহলে কিসের জন্য বিয়ে করেছিস?””

সন্ধ্যা মুখ বাকালো। ঠোঁট বাকিয়ে বললো,,

“” তোমাকে বলবো কেন?””
“” তাহলে কাকে বলবি?””
“” সেটাও তোমাকে বলবোনা৷””

রাত ঘড়ির দিকে তাকালো। কথাবার্তা এখানে ইতি টেনে তাড়া দিলো।

“” আচ্ছা বলিস না। নে এখন জলদি নিজেকে ঢাক। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।””

সন্ধ্যা রাতের দিকে তাকালো। গায়ে জড়ানো পাতলা চাদরটা ফেলে দিয়ে কোমড়ে হাত রাখলো। চোখদুটো সরু করে নাক ফুলিয়ে বললো,,

“” পারবোনা। পারবো না। পারবোনা। কাপড় তুমি খুলেছো তুমি পড়াবে।””
“” তোর কাপড় আমি কেন পড়াবো?””
“”তাহলে কি করবে? আমি বলেছিলাম খুলো? বলো,বলেছিলাম?””

রাত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,,

“” ঐ সময়ে মনে হয়েছিলো এটা আমার মৌলিক কাজ তাই করেছি।””

সন্ধ্যা রাতের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,

“” কাপড় খোলা যদি মৌলিক কাজ হয়,তাহলে পড়িয়ে দেওয়া যৌগিক কাজ।””
“” মৌলিক আর যৌগিক কি এক? কিসের সাথে কি তুলনা করলি?””
“” তুলনা যেহেতু করেছি অবশ্যই যুক্তি আছে।””
“” শুনি তোর যুক্তি!””
“” মৌলিক মানে এক,যার কোনো শাখা প্রশাখা নেই মানে শুধু তুমিই খুলতে পারবে। আর যৌগিক মানে মূলগাছের সাথেও অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে। অর্থাৎ আমি চাইলেই তুমি বাদে অন্য কাউকে দিয়েও পড়াতে পারবো। তুমি কি চাচ্ছো আমি অন্য কাউকে দিয়ে পরিয়ে নেই?””
“” অন্য কেউ মানে?””
“” দুরে যাওয়া লাগবেনা৷ তোমার বাসার পাশের বাসায় একটা শান্তশিষ্ট ছেলে আছে না? এই তো অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। বয়সের দিক দিয়ে পারফেক্ট ম্যাচ। আমি বললেই কিন্তু উনি…””

সন্ধ্যা ইচ্ছে করেই বাকি কথাটা গলায় আটকে রাখলো। রাতের মুখের অবয়বে পরিবর্তন আসছে। তারমানে সে বাকিটা বুঝে নিয়েছে। তাহলে তাকে কেন বাকিটা কষ্ট করে বলতে হবে?

রাতের মুখে কঠিনতার ছাপ। হাতটাও কি কঠিনের ছোয়া পড়েছে। সন্ধ্যার জামার পেছনের চেইন এমন করে জোর দিয়ে টান দিলো যে সন্ধ্যার অনিচ্ছা কন্ঠটা আহ! করে উঠলো।

রাত চলে যেতে নিলে সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে উঠে বললো,,

“” বর চলে যাচ্ছে কেন? আমি কি যেতে বলেছি?””

সন্ধ্যা বিছানার কিনারে গিয়ে রাতের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,,

“” বউ গোসল করবে।””

রাত সন্ধ্যাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। মুখে কিছু বলছেনা। বলবেও না। এমন পাজি মেয়ের সাথে কথা না বলে থাকাই উত্তম। সন্ধ্যা গলা ছাড়ার আগে কঠিন স্বরে বললো,,

“” নেক্সট টাইম থেকে যোগিক এন্ড মৌলিক দুটো কাজই যদি তোমাকে দিয়ে সম্ভব হয় তাহলেই আমার কাপড়ে হাত দিবে অন্যথায়,আমি পড়তেও পারবোনা,খুলতেও পারবোনা। কি করতে পারবো ওটা তুমি বুঝে নাও।!

~~

রাত অফিস ছেড়ে বাসায় এসেছে ঘন্টাখানিক। আসার পর থেকে পুরোবাড়ি ঘুরঘুর করছে। ফ্রেশ হয়নি,জামা পাল্টায়নি। এমন কি ডেইলি রুটিনের লেবুপানিটাও খায়নি। সন্ধ্যা কয়েকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও কোনো কারণ বের করতে পারলোনা৷ বিরক্ত হয়ে শ্বাশুড়ির রুমে ঢুকলো। মুখে গটগট বিড়বিড় নিয়েই বললো,,

“” তোমার ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছে,মামিমা। সরকারি হসপিটালে পাঠাবে নাকি বেসরকারী?””

তিয়ামতী সন্ধ্যার কথার ধাচ বুঝতে না পেরে রিদের দিকে তাকালো। উনি কি কিছু বুঝেছেন?””

সন্ধ্যা পায়ে পায়ে রিদানের সামনে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আফসোসের সুর টেনে বললো,,

“”তোমাকে দেখলেই আমার মামিমার উপর হিংসে হয়।””

রিদান সন্ধ্যার কথায় অবাক হলোনা। কারণ এটা সন্ধ্যার নতুন কথা না। রিদান সামনে আসলেই সন্ধ্যা এ কথাটা আগে বলবে তারপর অন্য কথা শুরু করবে। এবার ও তাই হলো। সন্ধ্যা বরবর করে রাতের অদ্ভুতকান্ডের কথা বলে দুজনের মাঝখানে শুয়ে পড়লো।

“” মামিমা, আমি আজ এখানেই শুবো। তোমার ছেলের সাথে থাকলে আমাকেই আগে মেন্টাল হসপিটাল যেতে হবে।””

~~

ডিনারেও রাতকে না পেয়ে বেশ চিন্তিত রিদান। ছেলেটার হঠাৎ কি হলো? সে কি একবার আলোচনায় বসবে?

রিদানের ভাবনার মাঝেই রাত এসে হাজির। চেয়ার টেনে খেতে বসেছে। বাবার চোখে চোখ পড়তেই রাত মুখ খুললো,,,

“” অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য সিলেট যেতে হবে,বাবা তাই একটু মন খারাপ ছিলো। আম্মুকে ছাড়া কখনো তো দুরে থাকা হয়নি তাই মনটা কেমন করে উঠছিলো। দোটানায় ভুগছিলাম চাকরী ছেড়ে দিবো নাকি মায়ার সুতো কাটবো।””
“” তা কি ঠিক করলে?””

রাত হাঁসলো। ভাত মুখে নিয়ে নিসংকোচে বললো,,

“” তখন ভরসার হাত ছিলোনা৷ এখন আছে। তাই থেমে থাকার কোনো মানেই হয়না। তাছাড়া এতোদিন আমি কারো দায়িত্ব ছিলাম কিন্তু এখন আমার দায়িত্ব আমার কাধে।””

ছেলের ইঙ্গিত দেওয়া কথা রিদানের ঠোঁটেও হাঁসি ফুটে উঠেছে। ছেলেটা তার অল্প বয়সেও পাকা। শুধু মাঝে মাঝে বয়সটা উকিঝুকি দিয়ে পাগলামিতে মাতিয়ে তুলে।

~~

“” তুই সত্যি যাবিনা?””
“” না।””
“” আমাকে ছাড়া থাকতে তোর কষ্ট হবেনা?””
“” না।””
“” আমাকে যদি দেখতে ইচ্ছে হয়?””
“” হবেনা।””
“” যদি ছুতে ইচ্ছে হয়?””
“” হবেনা।””

সন্ধ্যার ভাবনাহীন উত্তরগুলো রাতের বুকে কাঁটা হয়ে বিধলো। যে মেয়ে একরাতের জন্য বাড়ির বাইরে গিয়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছিলো সে মেয়ে বলে কিনা তিনদিন তিনরাত তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে। একটুও কষ্ট হবেনা৷ অথচ তার সামান্যতম মন খারাপও যেন না হয় তাই কত কি করে দুজনের জন্য দুটো টিকিট কেটেছে। ওর ছোটবেলার শখ পুরন করবে বলে ট্রেনের টিকিট কেটেছে। তাছাড়া বিয়ের বয়স একমাসে পৌছিয়েছে দুরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। বিয়েটা যেমন হুট করে হলো,চাকরীটাও তো হুট করেই। চাইলেই তো ছুটি নিয়ে হানিমুনে যেতে পারবেনা। তবে কাজের ফাঁকেই হানিমুনের ছোট্ট একটা পর্ব চুকিয়ে নিতে চেয়েছিলো রাত। কিছু ছোটখাটো সারপ্রাইজ দিয়ে সন্ধ্যার চোখে,মুখে হাঁসির ঝলক ফুটিয়ে তুলার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সন্ধ্যার বিপরীতমুখি উত্তরে রাত হতাশ এবং আহত। অনেকটা বারা ভাতে ছাই ফেলার মতো।

সন্ধ্যা রাতের সাজ শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাত তখনো দাড়িয়ে। মুখে বিষন্ন।

“” কখন যাবে?””

সন্ধ্যার প্রশ্নে রাত বেশ আবেগ আর আশাসহিত উত্তর দিলো,,,

“” কাল সকালে। যাবি? আমি তোর সবকিছু গুছিয়ে নিবো?””
“” তারমানে আজ রাতটাই কষ্টে কাটাতে হবে। কাল থেকে পুরো তিনদিন আমি আয়েশে কাটাবো। ইচ্ছেমতো ঘুমাবো,হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাবো। উফ! ভাবতেই আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে।””

সন্ধ্যার দিক থেকে এমন উত্তরে রাতের আশাগুলো আবার হতাহত। তাহলে কি ও আমাকে নিয়ে বিরক্ত? যা হচ্ছে সব অনিচ্ছাতে? আমার জোরের উপর? রাতের ভাবনার মাঝে সন্ধ্যা বলে উঠলো,,

“” লাইট নিবিয়ে দাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।””

~~
সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে রাত। সন্ধ্যাকে ছাড়া তিনটে রাত কাটাবে ভাবলেই গলা চেপে ধরা কষ্ট হচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবেনা। দরকার হলে এমন চাকরী সে করবেনা। কিন্তু পরক্ষণেই সন্ধ্যার বলা কথাগুলোর কথা মনে হলে ইচ্ছে হচ্ছে তার যাওয়া উচিত। সে তো সবসময় চেয়েছিলো সন্ধ্যা ভালো থাক,সুখে থাক। সেই সুযোগটা কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা যাবেনা। সারাজীবন তো এই সুখটা দিতে পারবেনা৷ তিনটা রাতই না হয় দেওয়া যাক।

ভোরের আলো ফুটতেই রাত বেরিয়ে পড়লো। একদলা কষ্ট বুক ছেড়ে চোখ দিয়ে নামছে। ট্রেনের টিকিট ছেড়ে দিয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাড়ালো। নতুন টিকিট কেটে বাসে চড়েছে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝেছে সবে তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো,,,

“” হ্যা,বাবা। বলো।””

রিদানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিয়ামতী ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,,

“” সন্ধ্যা রুমের দুয়ার টেনে দিয়েছে। কখন থেকে ডাকছি। দরজা খুলছেইনা। তোর সাথে কি ওর কোনো কথা হয়েছে? ভেতর থেকে সাড়াশব্দও নেই।””

মায়ের কথায় রাতের বুকে শীতল ঝড় বয়ে উঠলো। তবুও মুখ ছেড়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,,

“” ওর হয়তো এখনো ঘুম ভাঙেনি আম্মু। একটু পরেই উঠবে। চিন্তা করো নাতো। ও এখন ওর ভালোটা বুঝতে পারে।””

রাত নিজের কথাটা শেষ করে ফোনটা কেটে দিলো। শরীরে ভাপসা গরমরা চেপে বসছে। অসস্থি লাগছে। রাত জানালাটা খুলে দিতেই আবার ফোনের রিংটোন। কানে ফোন ধরতেই সন্ধ্যা ফেকফেকিয়ে কান্নাজুরে দিলো।
আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসা এই কান্নাটা কেন করে সন্ধ্যা? তাও যখন আমি দুরে থাকি ঠিক তখন। ও কি এটা বুঝেনা আমার বুকের ভেতর তখন কেমন ঝড় উঠে। ইচ্ছে হয় বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যেতে।

~~

দরজা খুলে তিয়ামতী অবাক।

“” রাত তুই? এই সময়? এতক্ষণে তো তোর সিলেট পৌছে যাওয়ার কথা।””

মায়ের কথার উত্তর দেওয়ার জন্য সময়টুকু পেলোনা রাত। মনের ঝড় সামলাতে এখন তার সন্ধ্যার প্রয়োজন। ছুটে নিজের রুমে পৌছুতেই রাত হকচকিত। রুম পুরো ফাঁকা।

পেছনে মায়ের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বললো,,

“” আম্মু, সন্ধ্যা কোথায়?””
“” ও তো কিছুক্ষণ আগে নাস্তা করে ছাদে গেলো।””

রাত বড় বড় পা ফেলে সিড়ির ধাপ কেটে উপরে উঠছে। পেছনে তিয়ামতীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে রিদান কানে ফিসফিস করে বললো,,

“” সন্ধ্যাকে দেখলে আমারও সন্ধ্যার মতো রাতের উপর হিংসে হয়।””

তিয়ামতী কিছুই বুঝেনি এমন মুখ করতেই রিদান উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। বাপ-ছেলের কর্মাকান্ডগুলো এই বয়সে এসেও তার মাথায় জট পাকিয়ে দেয়। কবে যে সে খুলতে পারবে!

~~
সন্ধ্যা ছাদের রেলিং ধরে প্রকৃতির দৃশ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আর গুনগুন করে আপনমনে গান গেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত শব্দে সন্ধ্যা শিউরে উঠলো। গালে হাত দিয়ে চোখের পানি ফেলছে। সামনে রাতের বিধ্বস্ত চেহারা।

“” কেন কাঁদছিলি? আমাকে কি তোর খেলনা মনে হয়? যখন মনে চায় খেলবি। খেলা শেষে ছুড়ে মারবি?””

সন্ধ্যার হালকা ফুপিয়ে উঠতেই রাত আবার ধমকে উঠলো।

“” চুপ করে আছিস কেন? বল কেন কাঁদছিলি?””
“” কখন কাঁদলাম?””

সন্ধ্যা নিজের কথার শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসাতেই আরেকটা চড় পড়লো গালে।

সন্ধ্যা এবার দুগালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। রাত কিছু বলতে চেয়েও বললোনা৷ অন্যদিকে মুখ করে দাড়িয়ে রইলো। সন্ধ্যা চোখের পানি মুছে নিয়ে রাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

“” আমার তোমাকে ছুতে ইচ্ছে করছিলো তাই কেঁদেছিলাম!””

রাত সন্ধ্যাকে নিজের সামনে এনে দাড় করালো। আবার থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই সন্ধ্যা চেচিয়ে উঠলো,,

“”আমি কিন্তু রাতে তোমাকে ছুতে দিবোনা।””

রাত সন্ধ্যাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।

“” তোর ইচ্ছের পরোয়া করে কে?””
“” নিকৃষ্ট লিচু বর!””
“” আর কত জ্বালাবি বল তো?””
“” যতদিননা তুমি ছাই হচ্ছো।””

রাত সন্ধ্যাকে নিজের বুক থেকে সরালো। সন্দেহদৃষ্টি ছুড়ে বললো,,

“” আমার চাকরীটা খাওয়ার জন্য এগুলো করেছিস তাইনা?””
“” জানিনা।””
“” আবার চড় খাবি?””
“” আমার তোমাকে সবসময় আমার কাছে চাই। তুমি যখন চলে যাও তখন আমার খুব কষ্ট হয়,হিংসে হয়। মনে হয় তোমার অফিস তোমার দ্বিতীয় বউ।””
“” অফিস আমার বউ?””
“” তা নয় তো কি? সারাদিন তো তার কাছেই থাকো। শুধু রাতের বেলা আমার কাছে।””

রাত সন্ধ্যার কপাল,গাল গলায় হাত বুলিয়ে বললো,,

“” শরীর তো ঠিক আছে তাহলে কি মাথাটা গেছে?””

সন্ধ্যা মুখ কুঁচকিয়ে বললো,,

“” রাত ভাইয়া!””
“” আবার ভাইয়া?””
“” হুম,যতদিননা আমি ছয় কাপড় খুলছি ততদিন তুমি ভাইয়া! ভাইয়া!! রাত ভাইয়া!!!””
“” আমি কি ছয় কাপড় পড়ি যে তুই ছয় কাপড় খুলবি?””
“” যেদিন পড়বা সেদিনই খুলবো! তুমি ভাইয়া শব্দ মুছার অপেক্ষায় থাকো আর আমি ছয় কাপড় খোলার অপেক্ষায়!””

~~

রাত দশটা। সকলেই নিজের পেট শান্তিতে খাবার চিবুচ্ছে। কেউ কেউ মনের শান্তিতে গল্প জুরে দিয়েছে। পরিপুর্ণ সংসারে সকলের দিকে একবার চোখ বুলালো রিদান। তিয়ামতীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রাতের দিকে তাকালো। খাবারের এক অংশ মুখে পুরেছে সে। রিদান গলা পরিষ্কার করে ছেলের উদ্দশ্যে বললো,,

“”হঠাৎ করে যদি শুনিস তোর বোন আসতে চাইছে পৃথিবীতে,তাহলে কি তোর কোনো আপত্তি হবে?””

বাবার এমন প্রশ্নে রাত থতমত। মুখের দানা পেটে ঢোকার আগেই গলায় ঠেকেছে। বিষম খেয়ে কাঁশি উঠে গেলো। সন্ধ্যা তাড়াহুড়োয় রাতের মুখে পানি ধরলো। রাত চুমুক দিয়ে গলর দানা পেটে পাঠাতেই সন্ধ্যার আবেগে আপ্লুত ধ্বনি,,

“” আমার কোনো আপত্তি নেই। ননদ আর মেয়ে আমি একসাথে পালবো। দুজনকে দুকোলে বয়ে বড় করবো। মামা আমার ননদ কবে আসবে? তাহলে আমার মেয়েকে ইনভাইট পাঠাতাম!””

রাতের থমকে যাওয়া বিষমটা শরীর কাঁপিয়ে দ্বিতীয় দফায় আক্রমন। চোখে বিস্ময়, গলায় কাশি নিয়ে একবার বাবা তো আরেকবার বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here