ভালোবাসা রং বদলায় পর্ব -০৭

#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — মাহমুদ
পর্ব — ৭
.
বেশকিছুক্ষণ ধরে ড্রইংরুম জুড়ে পাইচারী করছে ধ্রুব। রূপার জন্য তার মনের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। সেই যে রূপাকে সকালে দেখেছিল, আর দেখা মেলেনি তার। সময় তো আর কম হয়নি। এতক্ষণে তো আসার কথা মেয়েটার। পরক্ষণে মন দমে গেল। মেয়েটা আসুক বা না আসুক তাতে ওর কী? ওর তো মেয়েটার সাথে কোনো লেনাদেনা নেই। কিছু কারণবশত মেয়েটাকে বিয়ে করেছে ও। সময় এলেই রূপাকে ছেড়ে দেবে সে। তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে সে কেন এত ভাবছে? তার মনে তো রূপার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে আজ কেন মেয়েটার কথা ভাবছে সে? রূপা কে? সে কে হয় ওর? কিছুই তো হয় না। তাহলে কেন ওকে এক ঝলক দেখবার জন্য মনটা আকুবাকু করছে।

হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। ধ্রুবের কানে কলিংবেলের শব্দটি পৌঁছাতেই ভাবনার জগত ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। কে এসেছে এসময়? রূপা নয় তো? রূপার কথা মনে পড়তেই একমুহুর্ত দাঁড়াল না ধ্রুব। তঘড়ঘড়ি করে সে হাটা ধরল দরজার দিকে। আবারও কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। তৎখানিক দরজার সামনে এসে পড়েছে। হাসিমুখে দরজাটা খুলে দিল সে। দরজার সামনে একটা ১০ বছরের ছেলেকে দেখতে পেল সে। রূপার বদৌলতে ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে মুখের ভঙ্গিটা পাল্টে গেল তার। ধ্রুব হতাশ হয়ে ছেলেটির কাছে জিজ্ঞেস করল,(লেখক মাহমুদ)
– ‘কী চাই তোর?’
– ‘ভাইয়া আসলে হইছে কী… ইয়া মানে… আমাগোর টিমে যে পোলাডা সব থেইকা বড়, হে জোরে বল মারতে গিয়া আপ্নেগোর বাড়িত বল আইসা পরসে। মুই সবার থেইকা ছোট হের লাইগা হেগুন আমারে পাঠাইসে। এহন যদি আমি বলডা না নিয়া যায় তাইলে ওরা সবাই আমারে মাইরা ফেইলবো। আপ্নে প্লিজ আমারে বলডা দিয়া দেন। বিশ্বাস করুন, আপ্নাগোর কিচ্ছু ভাংগে নাই। শুধু বল গিয়া বেলকোনিতে পরসে। আপনে যদি একটু……’
– ‘আচ্ছা আচ্ছা। সমস্যা নাই। আমি বল এনে দিচ্ছি।’

ধ্রুব বল আনতে গেল। কয়েক মিনিট পর বল হাতে নিয়ে এল। ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
– ‘এই নে বল।’
– ‘ভাইয়া আপনে খুব ভালা।’
– ‘উহু… তুই ভুল বলেছিস। আমি খারাপ। পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ কেউ যদি হয়ে থাকে, সে হচ্ছি আমি।’
– ‘ভুল কইসেন। আপনে খুব ভালা ভাইয়া। খুব ভালা।’
– ‘তুই এখন অনেক ছোট রে। এখন তোর এইটুকু মাথায় কিছুই ঢুকবে না। আচ্ছা শোন, তুই যেন কি বলছিলি? তোকে কে মারে? তার নামটা শুধু বল, ওর এমন হাল করব দ্বিতীয় বার তোর মারার সাহস পাবে না।’
ছেলেটা কিছু বলল না। ধ্রুব বলল,
– ‘কী রে বলিস না কেন?’
ছেলেটা চেপে গেল। এখন তার মুখ খুললেই বিপদ। সে জান ধ্রুবকে বললে, সেই ছেলেটার হাড্ডিগোড্ডা একটাও থাকবে না। পরে যখন ও একা থাকবে, তখন সুযোগ পেলেই ওই ছেলেটা ওকে মেরে ফেলবে।
– ‘কী হলো চুপ কেন?’
– ‘ভাইয়া আমার দেরী হইয়া যাইতেছে। আমি গেলাম তাইলে….’
– ‘ওই দাড়া…’
ছেলেটা দাঁড়াল না। এক দৌড়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ধ্রুব ওর এমন কান্ডে অবাক হলো। ওই ছেলেটার নামটা না বলে চলে গেল কেন ও? একটা ১০ বছরের বাচ্চা তো এমন হবে না। আর যদি হয়েও থাকে ছেলেটার নামটা তো অত্যন্ত বলতে পারত। এছাড়া ওরও নাম শোনা হল না। তার আগেই দৌড় দিল। সে যাইহোক, ধ্রুবের মনে এখন অন্য খেলা খেলছে। রূপা… ওর কথা মনে পড়তেই এক অদ্ভুত অনুভূতিন বিরাজ করল তার শরীরজুড়ে।(লেখক মাহমুদ)

ঘন্টাখানিক পর আবারও কলিং বেল এর শব্দ শোনা গেল। নিশ্চয় এবারও ওই ছেলেটা এসেছে। ভালোই হলো। এবার ছেলেটাকে যেতে দেবে না সে। সবকিছু ভালো করে শুনে তারপরে তাকে ছাড়বে। ছেলেটা প্রথমে আসল, তারপর বল চাইল, বলটা সাথে করে নিয়েও গেল, কিন্তু কোন ছেলে তাকে মারে শুনলে, তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। হয়তো ভয়ে বলতে পারেনি….. আবারও কলিং বেল এর শব্দে কনক নড়ল ধ্রুবের। আর দাঁড়াল না সে। চটজলদি দরজাটা খুলে দিল। অপ্রস্তুত ভাবে রূপাকে দেখতে পেল সে। ধ্রুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রূপার দিকে যেন কতকাল ওকে দেখেনি। এত মাস পর রূপাকে আজ খুটে খুটে দেখতে লাগল সে। আজ রূপাকে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। ধূসর কালারের শাড়ি পড়লে কাউকে এতটা সুন্দর দেখাতে পারে তা জানা ছিল না ধ্রুবের। আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রূপাকে।
– ‘কীরে আর কতক্ষণ এভাবে দাড় করিয়ে রাখবি?’
ধ্রুব অস্ফুট স্বরে বলল,
– ‘তোমরা….’
মা জবাবে বললেন,
– ‘হু…’
– ‘কী হয়েছে, তোমাদের এমন দেখাচ্ছে কেন?’
– ‘……………’
– ‘কী হলো বলো।’
– ‘…………….’
– ‘নিপা কোথায়? ওকে তো তোমরা আনতে গেছিলে। ওকে দেখছি না কেন?’
– ‘…………..’
– ‘মা, প্লিজ কিছু তো বলো। এভাবে চুপ করে থাকলে আমি কীভাবে বুঝবো ঘটনাটা কী? সবকিছু আমাকে খুলে বললেই তো আমি জানবো, তাই না?’
– ‘…………….’
– ‘এই রূপা, তুমি তো কিছু বলো। মা এমন চুপ করে আছে কেন? কী হয়েছে ওইখানে?’
– ‘…………….’
– ‘এইবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে। কেউ কিছু বলছো না কেন?’
ফারজানা বেগম মুখ খুললেন। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন,
– ‘নিপাকে আমাদের সাথে আসতে দেয়া হয়নি।’
– ‘কিন্তু কেন?’
– ‘ওর মা আসতে দেইনি। উনি বলেছেন, সে যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন তার কাছ থেকে নিপাকে কেউ নিতে পারবে না। নিপা নাকি তার সবকিছু। তাকে ছাড়া নাকি সে থাকতে পারবে না। আমি নিপাকে আনতে গেছি বলে, আমাকে পুলিশের হুমকি-টুমকিও দিয়েছেন। এতকিছুর পরেও ওকে আমাদের বাসায় আনাটা ঠিক হবে না। তাই আর আনি নাই।'(লেখক মাহমুদ)
– ‘কী বলছো এসব? উনি এসব বলেছেন? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না উনি এমন এমন কিছু বলতে পারেন।’
– ‘আমিও তো অবাক হয়ে গেছিলাম। সে যে কেমন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম আজ, তোকে বলে বুঝাতে পারবো না।’
রূপা বলল,
– ‘মা আমাকে ক্ষমা করবেন। আজ আমার জন্য…..’
– ‘আরে না না। তুই কেন ক্ষমা চাইছিস? এতে তো তোর কোনো হাত নাই। আর তাছাড়া আমি কিছু মনেও করি নাই। যা হবার হইছে। সে তো নিপার মা। তারও তো একটা মতামত থাকতে পারে, তাই না? সে তার মতামত জানাইছে, আর আমরাও তার মতামত শুনছি। ব্যস!’
– ‘মা কিন্তু….’
– ‘ব্যস ব্যস, আর কোনো কথা নয়। আমি এই বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। আর শোন মা, আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তো। গলাটা প্রচণ্ড শুকিয়ে গেছে।’

বারান্দার এক কোণায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব। রাগে তার পুরো শরীর গজগজ করছে। আজ রূপার জন্য তার মা সবার সামনে অপমানিত হয়েছে। শুধুমাত্র ওই মেয়েটার জন্য। ওকে ধ্রুব কোনোমতে ছাড়বে না। নিজের উপরই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। খুব বেশিই সে ভেবে ফেলেছে মেয়েটাকে নিয়ে। তার মনে রূপার জন্য কোনো অস্তিত্ব আগেও ছিলো না এবং আজও নেই। অনেক দিনই হয়েছে রূপাকে কিছু বলছে না সে। ভেবেছিল মেয়েটা সবকিছু যেহেতু মুখ বুজে সহ্য করছে, সেহেতু কী দরকার তাকে তীরে তীরে এতটা কষ্ট দেবার? আর রূপার সাথে সে এতদিন থেকেছে। কিন্তু কখনো ওর মধ্যে অন্য রূপার অস্তিত্ব খুজে পায়নি সে। তবে ধ্রুব বুঝে ফেলেছে। রূপা নাটক করছে। অনেক বড় নাটক সাজিয়েছে সে ধ্রুবকে তার জালে ফাঁসানোর জন্য। রূপা চাই ধ্রুব যেন তার এই নাটকীয় গর্তে পা দেয়। যাতে তার সাজানো নাটকটা সাকসেসফুল হয়। কিন্তু ধ্রুব তো এতটা গাধা নয়। শুধুমাত্র বাবার জন্য কোনো মেয়ে এত অত্যাচার সহ্য করবে বলে মনে হয় না। নিশ্চিত এখানেও কোনো ঘাবলা আছে।

হঠাৎ নিলুর ডাকে হুশ ফিরলো ধ্রুবের। সে পিছন ঘুরে তাকাল। বলল,
– ‘হুম… বল।’
– ‘ভাইয়া মা তোকে ডাকছে..’
– ‘তুই যা আমি আসছি।’
– ‘ওকে। তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু।’
নিলু চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পর ধ্রুবও চলে গেল তার মায়ের রুমের দিকে। দরজার সামনে যেতেই রূপাকেও দেখতে পেল সে। ফারজানা রূপার সাথে কথা বলছিলেন। আচমকা তার চোখ গেল দরজার দিকে। বললেন,
– ‘কী রে ওইখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আয়।’
– ‘হু…’
ঘরে প্রবেশ করলো ধ্রুব। বললো,
– ‘কেন ডেকেছো মা? কোনো জরুরি কিছু?’
– ‘হ্যা। তোদের দুজনের সাথেই আমার কিছু কথা বলার আছে।’
– ‘কী কথা মা?’
– ‘তোদের বিয়ে হয়েছে ৩ মাস চলতেছে। কিন্তু তোদের রিসিপশন এখনও হয় নাই। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না? তাই আমি ভাবছি তোদের রিসিপশন সামনে মাসেই করবো। আমার একটা মাত্র ছেলে বলে কথা। অবশ্যই ধুমধাম করেই করবো।’
ফারজানার কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ধ্রুব। বললো,
– ‘কী দরকার মা? এসব করে শুধু শুধু টাকা নষ্ট! তাছাড়া আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় সবাই’ই জানে। খালি খালি এসব করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর এমনিতে আমার হাতে এখন আর তেমন সময় নাই। কাজের চাপ আগের থেকে বেশি বেড়ে গেছে। আর অফিস থেকে ছুটি নেয়াও আর সম্ভব না। এজন্য বলছি কোনো রিসিপশন-টিসিপশন করার দরকার নাই। আমি কোনদিন সময় পাইলে তখন এ ব্যাপারে ভেবে দেখব।’
রূপা বলল,
– ‘মা যখন কথাটা বলেছেন নিশ্চয় ভেবে চিন্তে বলেছেন।’
ধ্রুব চোখ রাঙিয়ে তাকাল রূপার দিকে। ভয়ে রূপা মাথা নিচু করে নিল। ফারজানা এবার বললেন,
– ‘বাদ দে তো। ওর কাছে তো আমার কোন কথারই মূল্য নেই। আমি ওর কে হই যে আমার কথা শুনবে?’
– ‘মা প্লিজ, এবার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করো না তো। আমার সত্যিই সময় নেই। বিলিভ মি! ‘
ফারজানা অভিমানী স্বরে বললেন,(লেখক মাহমুদ)
– ‘রূপা ওকে বলে দে, আমার সাথে কথা না বলতে। আপাতত আমি এখন কারো কথা শুনতে চাই না।’
– ‘মা, এমন ছেলেমানুষি করছো কেন? একটু তো আমার দিক দিয়ে বুঝার চেষ্টা করো। আমার হাতে সত্যিই….’
– ‘আমার এখন কিছুই বুঝার বাকী নেই।’
ধ্রুব ফারজানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মায়ের দুহাত নিজের হাতের সাথে মুঠু বুদ্ধ করে নিল। বলল,
– ‘মা, রাগ করেছো আমার উপর? সত্যিই আমার সময় নেই। কিন্তু তুমি যখন বলছো আমাদের রিসিপশন সামনের মাসে হবে, তার মানে হবে।’

রাতে রূপা শোয়ার জন্য নিচে বিছানা মেলছিল। এমন সময় ধ্রুব রুমে প্রবেশ করাতে বেশ অবাক হলো সে। ধ্রুব রুমে প্রবেশ করার সময় রূপার দিকে একটি বারও তাকাল না। ধীর পায়ে গিয়ে সে সোফার পড়ে বসল। সোফার পাশেই তার ফোন ছিল। ফোনটা সেখান থেকে তুলে নিল। এরপর ফোন টিপাটিপি করতে লাগল। রূপা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিল। একমুহূর্তে সে ভেবেছিল ধ্রুব তাকে কিছু বলবে। কিন্তু যখন দেখল ধ্রুব কিছু বলছে না, তখন বেশ স্বস্তি পেল সে। অপরদিকে ধ্রুবের মনে রাগের জোয়ার ভেসে উঠেছে আবারও। রূপাকে মারতে পারলেই যেন তার রাগটা কমতো! কিন্তু সেটা করতে পারছে না সে। ইদানীং রূপাকে মারার কথা ভাবতেই পারছে না সে। যখনি ভাবে রূপাকে সে মারবে, কিন্তু পরমুহূর্তে মনটা দমে যায়। কেন জানি, মেয়েটার প্রতি তার অদ্ভুত জন্মেছে। তাকে চাইলেই কিছু বলতে পারে না সে। তার মায়াভরা মুখের দিকে তাকালেই সব রাগ পানি হয়ে যায়। তবে এমনটা হলে তো চলবে না। রূপাকে সে বিয়ে করেছে প্রতিশোধ নেবার জন্য। আর তার প্রথম লক্ষ্যে হল রূপার জীবনটাকে নরকের থেকেও কষ্টদায়ক করে দেয়া।

ধ্রুব কথাগুলো ভাবছিল আর হাতে একটা ধারালা ছুরি নিয়ে নড়াচড়া করে দেখছিল। রূপা এতক্ষণে ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। এখন এই ছুরিটা দিয়ে তার গলাটা নামিয়ে দিলে কেমন হয়? যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ধ্রুব ছুরিটা ঠিক রূপার গলা বরাবর ধরল। কিন্তু কেন যেন কিছু করতে পারলো না সে। হাত যেন তার নড়ছেই না। কিন্তু কেন? এখনই তো তার সুযোগ। তবুও কেন পারছে না সে? কিসের এত দ্বীধা?

চলবে,,,,,,,,,,,,

লেখকের অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here