ভালোবাসা রং বদলায় পর্ব -২২

#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — #মাহমুদ
পর্ব — ২২
*
রূপার ফোনে একটা কল এল তার কলেজ বান্ধুবী লিমার থেকে। কল রিসিভ করে প্রথমে দুজন কুশল বিনিময় করল। এরপর যখন সে তার স্বামীর কথা জানতে চাই তখনি রূপা নিশ্চুপ হয়ে গেল। এরপর লিমা তার কাছ থেকে জোরপূর্বক সবকিছু শুনে নিলো। সবকিছু শুনে লিমা বলল,

-“এত অত্যাচারের পরেও তুই ওই পাষাণ ছেলেটার সাথে ঘর সংসার করিস, আমি ভেবেই অবাক হচ্ছি। তোর জায়গায় তো আমি থাকলে
কখনোই পারতাম না।”

রূপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-“এছাড়া যে আমার কোনো উপায় নেই টলরে। এটা যে আমার নিয়তির লেখন।”

রূপার এমন কথা শুনে রেগে গেল লিমা। বলল,

-“এটা কোনো কথা হলো রূপা? ছেলেটা তোকে বিনাকারণে মারধর করে। মারধর বললেও ভুল হবে। ও তোর প্রতি নির্যাতন করে। আমি বলি কী, তুই পুলিশ কেস কর। সমাজে স্ত্রীকে নির্যাতন করা আইনগত অপরাধ। ওরে যতদ্রুত পারিস পুলিশের হাতে ধরিয়ে দে। সে সাথে ওরে ডির্বোসও দিয়ে দিবি। এমন নরপশুদের সঙ্গে ঘর সংসার করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই না।”

রূপা চোখমুখ শক্ত করে বলল,

-“প্লিজ লিমা, এবার থাম! আমার এসব শুনতে একদমই ভালো লাগছে না।”

-“কেন রে? আমি ভুল কী বললাম? ছেলেটা অপরাধী। সে তোর উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচার চালিয়ে যায়। এরপরও তুই সবকিছু চুপচাপ মুখ বুজে সহ্য করবি? আর আমি তোর ফ্রেন্ড হয়ে চুপ থাকবো? কখনোই না। তোকে কিছুই করতে হবে না। যা করার আমিই করবো।”

-“উঁহু…. তুই এমন কিছুই করবি না।”

-“কেন? সমস্যা কী তোর? সারাজীবন কী ওই লোকটার লাঠি-ঝাটা খাওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছিস? শোন রূপা, আবেগ দিয়ে নয় বিবেগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। তুই যথেষ্ট সুন্দরী। তোর জন্য ছেলেরা লাইন দিয়ে অবধি দাড়ায়। আর সে কীনা তুই নিয়তির লেখন ভেবে সবকিছু মেনে নিবি? মেয়েদের জীবন কী এতই সস্তা? তোর জায়গায় যদি অন্যকেউ থাকতো তাহলে সে এতবেলা প্রতিবাদ করতো। তোর মত সহ্য করতো না। রূপা তুই আগে আংকেলের নাম্বারটা দে। আমি আংকেলকে ফোন করে সবকিছু জানাবো। তোকে আর ওই লোকটার সাথে আর একমুহূর্ত থাকতে দেবো না আমি। তাড়াতাড়ি গুছিয়ে রেডি হয়ে নে। আমি পুলিশদের সঙ্গে নিয়ে আসছি।”

-“লিমা প্লিজ! এমনটা করিস না। আমার পুরো কথাটা অন্তত শুনবি তো।”

-“কী শুনবো বলতো? আর কিছু শুনার বাকী আছে? একটা মানুষ কীভাবে এতটা কঠোর হতে পারে? আমি এটা ভেবেই অবাক হচ্ছি যে কেউ ফুটন্ত তেলের ভিতরে হাত চুবিয়ে দিতে পারে? কোনো শত্রুও এমনটা করতে পারবেনা। আর ধ্রুব….. ওকে তো আমি ছাড়বো না। পুলিশের হাতে ওকে ধরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। রাখ, আমি এসে কথা বলছি।”

রূপা তাড়াহুড়ো করে বলে,

-“শোন… শোন… প্লিজ ফোন রাখিস না। আমার কথাটা একটু শোন।”

-“কী বলবি বল?”

-“তুই যে ধ্রুবর কথাগুলো শুনলি সে ধ্রুব আর বর্তমান ধ্রুবর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তবে, তুই এই পর্যন্ত যা যা বলেছিস সব ঠিক ছিলো। আমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে হয়তো অনেক আগেই প্রতিবাদ করতো। কিন্তু আমি করিনি। কারণ, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। বাবা আমাদের দুই বোনের কথা চিন্তা করেই বিয়ে করে নিলেন। আমরাও তখন খুব খুশি ছিলাম নতুন একটা মা পাবো ভেবে। নতুন মায়ের সাথে একটা নতুন বোনও পেলাম। আমার থেকে তিন বছরের বড়। ভেবেছিলাম আমার তো কোনো বড় বোন নেই। যুথি আপুই আমাদের আপন বড় বোন। কিন্তু কেন জানি প্রথম দিন থেকেই সে আমাকে এবং নিপাকে পছন্দ করতো না। কেমন চোখে যেন আমাদের দিকে তাকাতো। এটা আর কারো চোখে এড়ালেও আমার চোখে এড়াতো না। কিন্তু প্রথম প্রথম নতুন মা আমাদেরকে খুব ভালোবাসতেন। আদর-যত্ন করতেন। একদিন যুথি আপু জেনেশুনে তরকারীর বাটি মেঝেতে ফেলে দেয়। এত জোরেশোরে ফেলায় যে তরকারির বাটি ছিটকে তরকারি নতুন মায়ের গায়ে গিয়ে পড়ে। নতুন মায়ের রাগে পুরো শরীর তখন গজগজ করছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘এই কাজটা কে করলো?’ তখনি যুথি সব দোষ আমার উপর চেপে দিলো। সেদিন থেকেই শুরু হলো মারধর এবং অত্যাচার। এরপর প্রতিনিয়ত ঝাটা-লাঠি খেতে খেতে এসবে এখন আমি অভ্যস্ত।”

-“আমি এসে সব শুনছি। এখন রাখ। পুলিশকে ফোন দিতে হবে।”

-“এই না না। আগে আমার কথাটা শোন। ধ্রুব এখন আর আগের ধ্রুব নেই রে। সে পালটে গেছে।”

-“ও তার মানে তুই বলতে চাইছিস ধ্রুব ব্যাটা এখন নির্দোষ, তাই তো?”

-“হু…..”

-“তুই আসলেই একটা বোকা। এজন্য আজ তোর এই অবস্থা।”

-“হুম, তুই ঠিক বলেছিস। আমি সত্যিই বোকা। এত বোকা কেন আমি বলতো? একটা মানুষ আমার পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছে তবুও আমি টের পায়নি।”

-“এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! কী বললি তুই? পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছে মানে?”

– “তোকে বলেছিলাম না, একটা ছেলে আমাকে রোজ রাস্তায় ডিস্টার্ব করতো। ওই যে যাকে আমি সবার সামনে চড় মেরেছিলাম।”

-“হ্যা হ্যা। ওর নাম যেন কী ছিলো? ও হ্যা সৈকত! ওর কথা বলছিস তো?”

-“হুম।”

-“ওই অসভ্য ছেলেটার কথা এখনও মনে রেখেছিস তুই? মানুষ এতটা খারাপ হয় কিভাবে? শুধুমাত্র থাপ্পড় মেরেছিলি বলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট করতে চেয়েছিল। পুলিশের কাছে কেস করলেও কিছুই হয়নি। কোনো বিচার হয়নি। আসলেই এই দেশে জানোয়ারে ভরে গেছে। এই দেশে কেউ কেউ কাউকে শিবির ভেবে হত্যা করছে। কিন্তু তার বিচার হচ্ছে না। আবার কেউ কাউকে ধর্ষণ করছে, তারও বিচার হচ্ছে না। আরে জীবনটা পুতুলখেলা নাকি? যাকে শিবির মনে হবে তাকেই পিটিয়ে হত্যা করবে৷ যাকেই ধর্ষণ করতে মন চাইবে তাকেই ধর্ষণ করবে৷ এরা কী মানুষ?”

রূপা আঢ়ষ্ঠ কন্ঠে বলল,

-“এরা হচ্ছে মানুষরূপী জানোয়ার।”

-“ঠিক বলেছিস। আসামীদের যদি বিচার হতো তাহলে অন্যরা সাহস পেতো না। এদের বিচার হয় না বলেই তো অন্যরা সাহস পায়। কারণ তারা জানে, এই দেশে কোনো প্রকার দোষ করে যদি মোটা অংকের টাকা দেখানো হয়, তাইলে সব গুণাহ মাফ। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপা। বলল,

-“হু….”

-“বাদ দে এসব। কারণ এসব নিয়ে ঘুটিয়ে কোনো লাভ নেই। এবার জলদি বল, সৈকত এর চ্যাপ্টার আবারও অন হবার কারণ কী?”

-“সৈকত ধ্রুবর খুব ক্লোজড ফ্রেন্ড।”

-“তো?”

-“ও ধ্রুবর কাছে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে যে আমি নাকি তার বাবা-ভাইকে ট্রাকের চালোককে ঘুষ খাইয়ে মেরে ফেলেছি। তোর কী বিশ্বাস হয়, আমি কাউকে খুন করতে পারবো, অথবা খুন করানোর জন্য ট্রাক ভাড়া করবো? তুই-ই বল।”

-“কখনোই না। তুই তো ওর বাবা ও ভাইকে কখনো দেখিসইনি। তাইলে তো খুন করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।”

-“সেদিন সৈকতের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ও কী বলেছে জানিস? ধ্রুবকে ডির্বোস দিয়ে ওকে বিয়ে করতে।”

-“ওয়াট! ওই ছেলেটার সমস্যা কী রে? এখনো তোর পিছু লেগে আছে? ওরে শায়েস্তা করতে হবে। আমি একটা কাজ করছি। দুজনের জন্যেই পুলিশ ডেকে আনছি। তারপর বুঝবে ঠ্যালা!”

-“দুজনের জন্য বলতে উনার জন্যেও?”

-“ উনি আবার কে? ও, ওই পাষাণ লোকটার কথা বলছিস?”

-“এমনভাবে বলিস না প্লিজ। উনার জায়গায় আমিও থাকলে ঠিক একই কাজ করতাম। যার জীবনের সবথেকে প্রিয় জিনিসগুলো হারিয়ে যায়, সেই কষ্ট তারা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আর তুই না একটু আগে বলছিলি খুনী, আসামীদের শাস্তি না দিলে অন্যরা খুন করতে সাহস পায়৷ এজন্য ধ্রুব আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছে। কিন্তু অন্যভাবে। পুলিশের হাতে আমাকে ধরিয়ে দিলে তো, ক’দিন পরেই বাবা আমাকে যেভাবেই হোক ছাড়িয়ে নিয়ে আসতো। আর আমি কোনো শাস্তি পেতাম না। হয়তো এটা ভেবেই ধ্রুব আমাকে বিয়ে করেছে তীরে তীরে শাস্তি দেবার জন্য।”

বলেই থামলো রূপা। লিমা বলল,

-“তাই বলে অন্যের কথা শুনে তোকে মারবে? এটা কোন ধরনের যুক্তি? ওর তো উচিত ছিলো ভালোভাবে পরখ করে খোঁজখবর নেয়া। খোঁজখবর না নিয়ে শিওর না হয়ে একটা মেয়ের গায়ে কিভাবে হাত দিতে পারলো সে? ও কী দুধের শিশু নাকি? কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা এটা বুঝার কী কোনো ক্ষমতা নেই তার।”

রূপা শান্ত গলায় বলল,

-“যা হবার হয়ে গেছে। উনি আমার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। যদিও সামনাসামনি বলেনি। আমি সেদিন ঘুমানোর ভান ধরেছিলাম। উনি হয়তো ভেবেছেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তাই উনি বিনা দ্বিধায় কাঙ্ক্ষিত কথাটি বলে ফেললেন।”

-“কী কথা?”

রূপা একে একে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথা বলল। শেষের লাইনগুলো বলতে বলতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। সে প্রেগন্যান্ট সেটাও জানালো লিমাকে। সবকিছু শুনে লিমা অবাক হয়ে বলল,

-“তার মানে তুইও ধ্রুবকে ভালোবাসিস?”

-“হু…..”

– “আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এমন কিছুই ঘটাবি। আর তুই প্রেগন্যান্ট! আমাকে আগে জানালি না কেন?”

-“সরি রে।”

-“তুই খুশি তো?”

-“হু, খুউউউব!”

-“ভাবলাম, ধ্রুবকে জেলের ভাত খাওয়াবো। তা আর হলো কই?”

রূপা হাঁসল। লিমা বলল,

-“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলছে। হাঁসি থামিয়ে এবার আমার কথা শোন।”

-“কী”

-“ধ্রুবকে এতো তাড়াতাড়ি ক্ষমা করে দেয়া ঠিক হবে না। ও তোকে কম কষ্ট দেয়নি। তুই একটা কাজ করবি। ওকে সবসময় এড়িয়ে চলবি। ধ্রুব যদি তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে তাহলে না শোনার ভান করে সেখান থেকে কেটে পড়বি। দেখবি তখন সে জ্বলবে, পুড়বে, লুচির মতো ফুলবে!”

রূপা বলল,

-“এমনটা না করলে হয় না? শুধু শুধু উনাকে কষ্ট দেয়াটা কী ঠিক হবে?”

-“তোকে এত ভাবতে হবে না। যা বলেছি তাই করবি। নাইলে কিন্তু তোর সাথে আর কথা বলবো না বলে দিলাম।”

-“এমনভাবে বলছিস কেন? আচ্ছা যাহ্, তুই যা বলেছিস তাই হবে। কিন্তু আমারও একটা কথা রাখতে হবে তোকে। সৈকতের ভালোমানুষির মুখোশ সবার সামনে টেনে ছিড়তে তোকে সাহায্য করতে হবে। থাকবী তো পাশে?”

-“অবশ্যই।”
.
-“এই চাঁদময় জোৎস্না রাতে, তুমি আমি এই তারাভরা আসমানের নিচে দাঁড়িয়ে৷ নেই কোনো মানুষের যাতায়াত আর নেই কোনো মানুষের কোলাহল। শুধু আছি তুমি-আমি আর আমাদের সন্তান।”

লিমার সাথে কথা শেষ করেই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে রূপা একান্ত সময় কাটানোর জন্য। হঠাৎ পিছন থেকে কারো দৃঢ় কন্ঠ ভেসে এল রূপার কানে। কন্ঠটা বেশ চেনা চেনা মনে হলো তার কাছে। তৎখানিক ঠোঁটে ফুঁটে উঠেছে তার। মনে মনে ‘ধ্রুব’ নামটি স্মরণ করে পিছন ঘুরে তাকালো সে। সেই মায়াবীভরা এক জোড়া চোখের মাঝে ডুবে যেতে লাগল দৃঢ়ভাবে। এই এক জোড়া চোখ যেন তাকে টনিকের মত টানতে থাকে ধ্রুবের দিকে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় ধ্রুবের বুকে মাথা পেতে দিতে পারলে জীবনের সব সুখ যেন তাকেই ঘীরে রাখবে। অপরদিকে ধ্রুবরও একই অবস্থা। মাঝে মধ্যে তার মনে হয়, এই নেশাগ্রস্ত চোখে নিশ্চয় কোনো জাদুর ছোয়া আছে৷ নাইলে কারো চোখ এমন মায়াবী হয়?

-“আপনি!”

একটি কোকিলাকন্ঠার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই ধ্যান ভেঙে গেল ধ্রুবর। সেকথার উত্তর না দিয়ে সে মুঁচকি হাঁসলো শুধু। কিছুক্ষণ শীতল চাহনিতে রূপার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এরপর ধীর পায়ে এগুতে এগুতে রূপার ঠিক কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো ধ্রুব। তৎখানিক তারা একেঅপরের চাউনির গভীরতা মাফতে শুরু করে দিয়েছে নিখুঁতভাবে। হালকা বাতাসের মাঝেও রূপার চুলগুলো যেন খেলা করছে। একবার তার চোখ ঢেকে দিচ্ছে, তো একবার তার কপালের দিকে উপচে পড়ছে। এতে রূপা বেশ বিরক্তিও হচ্ছে দেখে ধ্রুব চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে কানে গুজে দিলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হালকা কেশে ধ্রুব বলে উঠল,

-“এতরাতে একা ছাদে কী করছো?”

রূপা ধ্রুবর থেকে কিছুটা দূরে সরে ছাদের রেলিং ধরে চাঁদের দিকে নিবিড়ভাবে তাকালো। বলল,

-“চাঁদ দেখছি।”

-“চাঁদ?”

-“হু…”

-“বেশ তো! আমিও চাঁদ দেখতে এসেছি। জানো, জোৎস্না রাত আমার খুব প্রিয়। আগে যখনি সময় পেতাম ছাদে উঠে আগেই অপার্থিব চাঁদময় জোৎস্না দেখতে আসতাম। এতে আমার মনটাও বেশ ফুরফুরে থাকতো। তবে, চাঁদ দেখতে বললে ভুল হবে। কারণ চাঁদ দেখতে আসলেও চাঁদের দিকে কখনোই নজর যেতো না আমার। ওই যে চাঁদের পাশেই শুকতারাটা দেখছো না? ওই উজ্জ্বলিত শুকতারার দিকেই বরাবরই নজর যেতো। আর চোখটা ভিজে উঠতো অনবরত। বলো তো কেন?”

রূপা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল ধ্রুবর দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“কেন?”

ধ্রুব এবার শীতল দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

-“আমার বাবা ভাইয়ের জন্য।”

এ কথা শুনে রূপা অবাক হলো না। কারণ সে সেদিন রাতে ধ্রুবর সবকথা শুনে ফেলেছিল। সেদিন রূপা জেগেছিল। ধ্রুবর সব কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুনেছে সে। ধ্রুব যখন কান্নাভেজা কন্ঠে বলেছিল, ‘এই হাতটা যখন ধরেছি ছাড়বো আর কখনো। এতদিন তো আমার থেকে কষ্ট পেয়েছ। এবার থেকে শুধু ভালোবাসা পাবে ভালোবাসা।’ তখন কথাগুলো শুনে নিজের অজান্তেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল রূপার। সেদিন সবকিছুই যেন স্বপ্নের মত লাগছিল তার কাছে। বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে ধ্রুবর মনে তার কোনো অস্তিত্ব আছে৷ রূপার শুধু মনে হচ্ছিলো এটা একটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাবে। কিন্তু যখন ধ্রুব তাকে তার বুকের সঙ্গে পরম আয়েশে জাপটে ধরেছিল তখনই সে বুঝতে পেরেছিল এটা স্বপ্ন না বাস্তব। সে মুহূর্তে বুকের ভেতরটা যেনো কার্পন দিয়ে উঠেছিল তার। ধ্রুব তাকে কারণেঅকারণে মারধর করতো। যেটা ছিলো অন্যায়। রূপা একমুহূর্তে ভেবে ফেলেছিল, সে সত্যিটা জানার পর এই সংসারটা ত্যাগ করবে। এমন দূরে কোথাও চলে যাবে যে তার ছায়াও খুঁজে পাবেনা কেউ। এই অন্যায়টা মানা যে বড় দায়। কিন্তু পরোক্ষণে তার মনটা দমে গেল। ধ্রুবর প্রতি এক আলাদা টান অনুভব করতে লাগলো সে। ধ্রবকে যে এখন ছাড়বার কথাও চিন্তা করতে পারেনা সে।

হঠাৎ বলে উঠল,

-“কী ভাবছো এত?”

ভাবনার জগত ছেড়ে বেরিয়ে এল রূপা। বলল,

-“কিছুনা।”

ধ্রুব ‘ও’ বলে রূপার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল,

-“নিজের অজান্তেই তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি রূপা। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

কথাগুলো বলতে বলতেই রূপার একটা হাত নিজের আয়েত্তে নিয়ে নিলো সে। শীতল চাহনিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওরা। পরোক্ষণে রূপার লিমার কথাগুলো মনে পড়তেই চটজলদি হাতটা সরিয়ে নিলো রূপা। ছাদ থেকে নিচে নামার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে ধ্রুব তার কাঙ্ক্ষিত কথাটি বলে ফেলল এক নিশ্বাসে।

-“পিছনের সবকিছু ভুলে আমরা সামনের দিকে এগুলে কেমন হয়? আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। দায়ে পড়ে বিয়েটা করেছো। এরপরই তো প্রতিনিয়ত আমার থেকে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাওনি। সবকিছু ভুলে কী আমাকে একটিবার সুযোগ দেয়া যায় না? আমি কথা দিচ্ছি, আমার থেকে যতটাই না তুমি কষ্ট পেয়েছো তার থেকে বেশি কিছু পাবে আমার থেকে। সেটা কী জানো?”

বলতেই বলতেই ধ্রুব রূপার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল,

-“কখন এবং কিভাবে বলতে পারবো না। কিন্তু নিজের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি রূপা। সবকিছু ভুলে আমাকে তোমার মনে একটি বারের জন্য জায়গা দিবে? বলো, দিবে?”

রূপা পাথর হয়ে গেছে। হ্যা-না কিছুই বললো না সে। মন চাইছে হ্যা সূচক বাক্যটি বলতে। কিন্তু ওই যে লিমাকে কথা দিয়ে ফেলেছে সে। এমন একটা দিনেরও সম্মুখীন হতে হবে ভাবতে পারেনি রূপা। এখন কী করবে সে?

-“প্লিজ কিছু তো বলো।”

রূপা কিছু বলল না। এখানে আর একমুহূর্ত দাঁড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব। সে আর না দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে গেল। অপরদিকে আহত চোখে রূপার যাওয়া প্রাণে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। রূপার কাছ থেকে কী সে কখনোই ক্ষমা পাবে না?

চলবে

(বিঃদ্রঃ আমি দুঃখীত। ব্যস্ততার ভিড়ে গল্প দিতে দেরি হয়েছে। আপনাদেরকে অপেক্ষা করাতে আমার একদমই ভালো লাগেনা। এতদিন সবাইকে অপেক্ষা করানোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখীত। ধর্য্য ধরে আমার গল্পের আশায় অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here