ভালোবাসিনী….
লেখিকা- রুবি আক্তার
পর্ব- ১
২০১৬ সালের ইন্টার অনলাইন ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তাই কলেজ ক্যাম্পাস শয়ে শয়ে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত। সবাই এসেছে ভর্তি হতে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই ভর্তি। অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরাও আসছে। তাছাড়া আছে অসুন্দর মেয়েরাও। আর ছেলেদের কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ কলেজ জীবনে পা রাখতে গিয়ে নিজেদের শাকিব খান ভাবতে শুরু করেছে তারা। যাদের বাইক আছে তাদের কথা তো আরো ভিন্ন। কলেজে ভাব নেওয়ার জন্য তাদের গেটআপের যে বিশাল পরিবর্তন। বাব্বাহ, নিজের কম্পিউটারের দোকানে বসে ভাবছি। আমরাও তো কলেজে পড়ি তাই না। এতো তো ভাব দেখাই নি আমরা। তবে এখন একটু দেখাই। কারণ শত হলেও বড় ভাই।
দোকানে অনেক ভীড় তাই ছোট একটা ভাইকে নিয়ে আসছি আর বড় ভাই তো আছেই। তাও সামলাতে পারছি না। বছরের এই সময়গুলো খুব ভালো আয় হয়। অনেক মেয়েরাই আসে মনে ধরে বাট বলা আর হয় না। কারণ মেয়েগুলো আগেই বুকিং হয়ে থাকে। রসায়নের ছাত্র আমি। তবে মেডিক্যাল এ চান্স পাইনি তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পড়াশোনা করছি। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ ভালোই ,অনেকেই বলে।
আসলেই কি তাই? আসলে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে আমার এসব প্রেম করার মতো সময় নাই। একমাত্র ছেলে আমি। বাবা নেই। তাই সংসারের সব দায়িত্ব আমার আর আমার বড় ভাইয়ের। তিনি বেশি শিক্ষিত না। আমি এই কম্পিউটারের কাজটা শিখিয়ে নিয়েছি। তাই আমরা এখন ভালোই আছি।
-‘ভাইয়া, ভাইয়া । আমাদের কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিন না। কালকেই শেষ ডেট। ভাইয়া, অনেক ভীড় সব কটা কম্পিউটারের দোকানে। প্লিজ ভাইয়া।’
দেখলাম একটা মেয়ে আমার কম্পিউটারের ডেস্ক এর উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কথাগুলো বলছে। আর তার পিছনে আরো তিনটা মেয়ে দাড়িয়ে। আমি কম্পিউটার বাঁচাতে তাড়াতাড়ি বললাম’আহা!কি করছেন একটু সরে দাঁড়ান তো। পড়ে যাবে তো আমার পিসিটা।’
-‘ওহ! সরি ভাইয়া। আসলে আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি তো অনেক কাজ আছে। তাই ভাইয়া যদি একটু আবেদনটা পূরণ করে দিতেন।’
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাদের ফরম পূরণ করতে লাগলাম। সেদিন অনেক ভীড় ছিল। দুই দিন আর কোনো প্রাইভেট পড়াতে পারবো না। কারণ এখানেই সময় দিতে হবে।
সেদিনের মতো কাজ শেষ করে বাড়ি গেলাম। আবার পরের দিন যখন খুললাম। তখন অনেক ভীড় হলো। কারণ শেষ ডেট আজকেই। এতো ভীড়ের মধ্যে একটা মেয়ে কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়লো। উফ্, এদের কি কোনো কমন সেন্স নাই । আমি মাথা ঠান্ডা করে বললাম,’দয়া করে সরে দাঁড়ান। কি করতে হবে? কালকেও একটা মেয়ে এমন করেছিল। আচ্ছা রাফি এরা কি পাইছে বলতো? বলে আমি মেয়েটার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। দেখলাম মেয়েটা লজ্জা পেয়ে পিছনে দাঁড়ানো বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
আমি আবার খেকিয়ে উঠে বললাম”কি লাগবে?”
তখন মেয়েটা বললো”
-‘ ভাইয়া, আসলে আমাদের অনেক গুলো কাগজ ফটোকপি করা লাগবে। যদি একটু করে দিতেন?’
“রাফি, ওনাদের কি কপি করা লাগবে দেখ তো?রাগে গজগজ করতে করতে বললাম।
তখন মেয়েটা তার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ দিয়ে বললো ” ভাইয়া ও কেনো? আপনি করে দিন না প্লিজ?”
আমি কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে কম্পিউটারে ফরম ফিলাপ করতে লাগলাম।
ফরমফিল আপ শেষ হয়েছে। তাই আমিও একটু গা ছাড়া ভাব নিয়ে কলেজে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারি ক্লাস করি। দুই দিন এমনি চলতে থাকে। তিন দিনের দিন দোকানে গিয়ে শুনি একটা মেয়ে নাকি প্রতিদিন এসে বলে” আচ্ছা ঐ ভাইয়াটা কই?” তিনবার চারবার এসে নাকি একই কথা জিজ্ঞেস করে। আসলে এখন ভাবতে বসলাম কোন মেয়ে? আমাকে কেন খুঁজে? আমার ভাই আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। আহা!আমি নিরীহ একটা ছেলে আমাকেই যদি এখন এই দৃষ্টি দেখতে হয়। তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম মেয়েটা কে আমি বের করেই ছাড়বো। তাই সেদিন আর দোকান ছেড়ে গেলাম না। তিন নাম্বার কম্পিউটার এর টেবিলে বসে মাথা নিচু করে বসে রইলাম যাতে হুট করে আমাকে না দেখে। তো যথা রীতি এগারোটা বাজতে লাগলো। কিন্তু কারো দেখা নেই। আমি এবার ভাইয়াকে উঠে গিয়ে বললাম “দেখলে তো…? খালি খালি আমার উপর সন্দেহ।” আর ঠিক তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম..
-‘ভাইয়া, কেমন আছেন?”
ভাইয়া আমার সামনে আমি ভিতরের দিকে মুখ করা। তাই আগে দেখতে পেলাম না। ভাইয়া আমার দিকে এবার ব্যঙ্গ ভরা হাসি দিয়ে নিজের টেবিলে গিয়ে বসলো। আমি মনে মনে মেয়েটার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছি। আবার সেই কথা..
“ভাইয়া কেমন আছেন? এতো দিন কোথায় ছিলেন?” আহারে আমার বইন রে! নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। তারপর হাসি মুখে ঘুরে তাকালাম। যা দেখলাম তা নিজের সৌভাগ্য বলবো না দুর্ভাগ্য বলবো বুঝতে পারছি না। একটা ছোটখাটো মেয়ে দাড়িয়ে আছে। টিংটিং এ শুকনা। আর গায়ের রং বেশ ভালোই কালো। কিন্তু হাসিটা সুন্দর। দাঁত গুলো ঝকঝকে সাদা। কিন্তু দাঁতে মজলে তো হবে না। আমাকে জানতে হবে এই মেয়ে আমার পিছনে লাগছে কেনো?
-“ভাইয়া, আপনাকে দুইদিন ধরে খুঁজছি। কই ছিলেন?”
অবাঞ্ছিত প্রশ্ন। কি উত্তর দিবো। আমার লাইফ আমি কোথায় ছিলাম তা আমি একটা অপরিচিত মেয়েকে কেনো বলবো? তো মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বললাম” শুনেছি একটা মেয়ে নাকি খুঁজতে আসতো। তাইলে তুমি! তা কিসের জন্য খোঁজ আমাকে?” মনে মনে খালি চাচ্ছি যেন মেয়েটা এখন চলে যায়। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে দোকানে ঢুকে একটা টুলে বসে পড়লো। আমি তো অবাক! কি হচ্ছে?
-“ভাইয়া, জানেন এই কলেজে ভর্তি হওয়া আমার একটা স্বপ্ন ছিল। নদীর ওপারে থাকি। তাই আস্তে দেরি হয়। ভাইয়া, আপনি কিসে পড়েন?” এত্তো গুলা কথা বলে সে আমার মুখের দিকে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকলো।
আমিও তার দিকে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে ভাবছি আসলে এই মেয়েটা কি চায়? সামান্য পরিচয় টুকু হলো না। অভার স্মার্ট এসব মেয়েদের দেখলে গা আমার রিরি করে। কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না এ আসলে কোন টাইপের মেয়ে?
.
.
.
সেদিনের মতো মেয়েটার জ্বালাতন আর সহ্য করতে হয়নি। ভাগ্য ভালো ছিল। কারণ দোকানে অনেক গুলো লোক এসে পড়ায় তাও মেয়েটা অনেকক্ষণ কোনো কারণ ছাড়াই আমার দোকানে বসে ছিল। পড়ে দেখলাম মোবাইলে কার সাথে কথা বলে যেনো উঠে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলো” ভাইয়া, কালকে আবার দেখা হবে। প্লিজ থাকবেন।”
কথাটা কেমন যেন লাগলো। আমি আর ভাবলাম না। কাজে মন দিলাম।
ঠিক পরেরদিন আবার এসে হাজির। দোকানে ছিলাম না। ভাইয়া ফোন দিয়ে আনলো। বললো” তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা শেষ করো। দোকানে প্রতিদিন নাটক দেখতে ইচ্ছে করে না।”
“আমারো কি করে!” মনে মনে বললাম।
মেয়েটা এসেই সেই টুলে বসে পড়লো। ওর সাথে আজকে আরো তিনটা মেয়ে এসেছে দুইটা বোরকা পরা আর একটা বোরকা ছাড়া। বোরকা পরা একটা মেয়ে অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে। কারণ তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পায়ের উপরের অংশ অনেক ফর্সা। চোখ দুটো ও অনেক সুন্দর। আমার ভিতরে কেমন করে উঠলো। তাই আজকে আর বেশি কর্কশ গলায় কথা না বলে অনেকটা মোলায়েম গলায় কথা বললাম। আমি জানতে চাইলাম তারা কি চায়? সেই পিচ্চি কালো মেয়েটা বললো” ভাইয়া, আপনি কি কম্পিউটার শেখান? আমরা কম্পিউটার শিখবো।”
আমি আসলে কম্পিউটার শিখাই না। কিন্তু ঐ বোরখা পড়া মেয়েটার জন্য একটু ভাব নিয়ে বললাম” তেমন ভাবে শিখাই না। তবে তোমরা চাইলে লিখাতে পারি।” সেই মেয়েটার দিকে চেয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আবার পিচ্চি এর দিকে ফিরলাম। তখন পিচ্চি মেয়েটা বললো” আসলে ভাইয়া, আমরা তিনজন শিখবো। আমি, ও আর ও।” হাত দিয়ে বোরখা পড়া আরেকটা মেয়ে আর বোরখা ছাড়া সেই মেয়েটাকে নির্দেশ করলো। মানে যার জন্য আমি এতো নরম হলাম সেই শিখবে না। আমি হতাশা ঢাকতে পারলাম না। নিরাশ গলায় বললাম” তোমার ঐ বান্ধবী শিখবে না।” পিচ্চি বললো” না ভাইয়া, ওর তো শেখা আছে তাই আর শিখবেনা।”
আমার পোড়া কপাল। কিন্তু একটা আশায় আমি ওদের শেখাতে রাজি হলাম। যদি সেই সূত্রে ওর সাথে আমার মনটা লাগাতে পারি। তা বললাম “তোমাদের নাম তো জানি না”।
পিচ্চি বললো” তাইতো, আপনার নামও তো জানি না। আমি শিউলি। ও(বোরখা পড়া ১) সীমা। ও(বোরখা ২)যুথি। আর ও (বোরখা ছাড়া) হেনা। তাইলে ভাইয়া কালকে থেকে শিখতে আসি?”
যুথি নামটা শুনে মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার। আহ্! কি সুন্দর নাম। আমি ঘোরের মধ্যে থেকেই বললাম,” আচ্ছা,কালকে থেকেই। আমার নাম অয়ন।” যুথির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। মেয়েটা নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে পা নাড়াচাড়া করছে। মনে হয় অস্বস্তি বোধ করছে। আমার ঘোরটা কেটে গেল শিউলির কথায়। আরে এই পিচ্চি কি কথাই যে বলতে পারে। বলছে” যুথি বান্ধবী দুলাভাই আসলো না তো এখনো। কখন আসবে?” কথাটা শুনে দেখলাম হেনা আর সীমা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। ওরা বলছে” নতুন বিয়ে হলে যা হয় আর কি। পিচ্চি এখনো টুলে বসে আছে। যুথির তাহলে বিয়ে হয়ে গেছে। আমার কপাল কি চিরকাল এমন ফাঁকি থাকবে। হায়রে! মেজাজ গেল বিগরে । রাফিকে প্রচন্ড একটা ধমক দিয়ে বললাম” কিরে আজকে দোকান ঝাড়ু দেস নাই। কি ধুলা।” ধপ করে শিউলির পাশের বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমার দ্বারা প্রেম হবেনা।
(চলবে)