#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৩
তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে ঢুকতে গিয়েই জোরে সোরে ধাক্কা খেল সারিয়া। এক প্রকার পড়ে যেতে যেতেই কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত অরণ্যর হাত থেকে সমস্ত কাগজ পত্রগুলো নিচে পড়ে ছড়িয়ে গেলো। রাগে অরণ্যর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। নিচের দিকে তাকিয়েই এক কড়া ধমক দিয়ে বসলো
— চলাফেরা করার সময় চোখ কি বাড়িতে রেখে আসেন? যত্তসব।
আচমকা এমন ধমকের জন্য সারিয়া মোটেই প্রস্তুত ছিল না। বোকা চোখে তাকাল। ফোন পেয়েই বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে এসেছে সে। এক মুহুর্ত দেরি করেনি। যখন জানতে পারলো তার গল্প নাটকের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে তারপর থেকে খুশির কেনো অন্ত নেই তার। সেই নাটকের ডিরেক্টর আরেফিন অরণ্য সেটা শুনেই খুশি কয়েক গুন বেড়ে গেছে। তার সাথে দেখা করার জন্য তারা অপেক্ষা করছে অফিসে। তাতেই তার উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছে আর সে দিগ্বিদিক ভুলে ছুটতে শুরু করেছে। অফিসে ঢুকতেই যে এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে সেটা ভাবতে পারেনি। ভুলটা যেহেতু তার তাই আর কথা না বাড়িয়ে ভুল স্বীকার করে মৃদু স্বরে বলল
— সরি!
অরণ্য তখন নিচে ছড়িয়ে থাকা কাগজ গুলো এক জায়গায় জমা করতে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়েই আবার ধমকের সুরে বলল
— আই হেট দিস ওয়ার্ড। আর আপনি সরি বললেই কি এই সব কিছু উড়ে আমার হাতে চলে আসবে?
সারিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে বসে পড়লো। কয়েকটা কাগজ নিয়ে অরণ্যর দিকে এগিয়ে দিল ভয়ে ভয়ে। অরণ্য কাগজ গুলো হাতে না নিয়ে সারিয়ার মুখের দিকে তাকাল। দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটলো তার। চোখের কালো মনি চকচক করে উঠলো। উত্তেজনায় বেড়ে গেলো হৃদস্পন্দন। এতটা বেড়ে গিয়েছে তার মনে হচ্ছে সেই স্পন্দনের কারণে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। আর মাথাটাও ঘুরে উঠছে। কপালে ঘাম জমে গেলো বিন্দু বিন্দু। অরণ্যর স্থির দৃষ্টি দেখে সারিয়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। সরি শব্দটা আবারও মুখে চলে আসতেই সেটাকে দমিয়ে রাখলো। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— আমি খুবই দুঃখিত। খুব জরুরী কাজে যাচ্ছিলাম। তাই খেয়াল করিনি।
অরণ্য অস্থির ভাবে পলক ফেললো। স্বাভাবিক ভাবেই বলল
— জরুরি কাজে যাওয়ার আগেই প্রথম ইম্প্রেশন যদি খারাপ হয়ে যায় তাহলে এমন কাজের মানে কি।
সারিয়া কথাটা বুঝতে পারলো না। মৃদু স্বরে বলল
— জি?
বাকি কাগজ গুলো হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো অরণ্য। পেছন ফিরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
— ভেতরে আসো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সারিয়া। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আপনি থেকে তুমিতে চলে গেলো। ভদ্রতা বলে কিছু নেই নাকি? অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে। অরণ্য হেলদোল বুঝতে না পেরে পেছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বলল
— তোমার জন্য কি ইনভাইটেশন কার্ড ছাপাতে হবে? কি বলেছি শুনতে পাওনি?
সারিয়া অবাক হলো। তার মনে হলো দুনিয়ার সব থেকে অসভ্য লোকের সাথে দেখা হয়ে গেলো তার। লোকটার মধ্যে নূন্যতম ভদ্রতা বলতে কিছুই নেই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে গেলো ভেতরে। অরণ্য তার এমন আচরণে বিরক্ত হলো কিন্তু কিছু বলল না। সারিয়া ভেতরে ঢুকে রহিম সাহেব কে সালাম দিলো। তিনি হাস্যজ্বল চেহারায় ইশারা করে তাকে সোফায় বসতে বলল। সারিয়া সোফায় বসল। সামনের মানুষটা তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সেই দৃষ্টি যে খুব একটা সুবিধার না সেটা সারিয়া বুঝতে পারলো। তাই নিজের ওড়নাটা আরো টেনে মাথায় দিয়ে দিলো। কিন্তু তার খুব অসস্তি হচ্ছে। অরণ্য তার পাশের চেয়ারে বসলো। সীমান্ত স্মিত হেসে বলল
— কেমন আছেন সারিয়া?
সারিয়া চোখ পিটপিট করে তাকালো। বলল
— জি ভালো।
অরণ্য কর্কশ কন্ঠে বলল
— আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে স্যার। কাজের কথা সেরে ফেলা যাক।
সারিয়ার চোখে মুখে বিরক্তির প্রকাশ ঘটলো। অরণ্যর এমন আচরণ সে কোনোভাবেই যে মেনে নিতে পারছে না। প্রথম দেখায় কেউ এমন আচরণ করে। সীমান্ত বলল
— তুমি কথা বলে সব ঠিক করে নাও অরণ্য। তার সব সমস্যার কথা শুনবে। সে কি চায় সেভাবেই সব ঠিক করবে।
অরণ্য সরু চোখে সীমান্তের দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল
— মনে হচ্ছে নাটক না বিয়ে করতে যাচ্ছে।
সীমান্ত দূরে বসে থাকায় সেটা শুনতে পেলো না কিন্তু সারিয়া ঠিকই শুনতে পেলো। সাথে সাথেই ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। অরণ্য সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে কঠিন ভাবে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
— তোমার কি কোন ডিমান্ড আছে? থাকলে এখনি বলে দাও। পরে কিন্তু সেসব নিয়ে কথা বলে লাভ হবে না।
সারিয়ার কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। দৃষ্টিতে বিরক্ত তার। অরণ্যর কথা বলার ধরন ভীষন অড। তবুও সবার সামনে সারিয়া কিছু বলল না। ভদ্রতা বজায় রেখে বলল
— আমার কোন ডিমান্ড নেই।
আরো আনুষঙ্গিক কিছু কথা শেষ করে অরণ্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সারিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। বলল
— এটা পড়ে সাইন করে দাও। আমাদের কিছু রুলস রেগুলেশন আছে। সেটা ফলো করতেই এটাতে সাইন করতে হবে।
সারিয়া কাগজটা হতে নিয়ে চোখ বুলাতে শুরু করলো। কিছুদূর পড়তেই সীমান্ত বলল
— আমাদের নাটকের জন্য কোন প্লেস সিলেক্ট করেছো অরণ্য?
— লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।
অরণ্যর কথা শুনে সীমান্ত বড় বড় চোখে তাকাল। বলল
— জঙ্গলে? এটা তো রোমান্টিক নাটক। জঙ্গলে বিষয়টা কেমন হয়ে গেলো না?
অরণ্য সেটার তোয়াক্কা না করেই বলল
— একটু ভিন্ন ধর্মী কিছু করতে চাই। জঙ্গলে গা ছমছমে পরিবেশে রোমাঞ্চ টা কেমন জমে সেটাই দেখার পালা এবার।
সীমান্ত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্মিত হাসলো। কারণ অরণ্যর সিদ্ধান্তের উপরে তার অগাধ বিশ্বাস। এখন পর্যন্ত তার কোন কিছুই বিফলে যায় নি। তাই সে এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথাই বলতে চায় না। বেশ কিছুক্ষণ নিরব পরিবেশ বিরাজ করলো সেখানে। তারপর সীমান্ত সারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি চাই মিস সারিয়া আমাদের সাথে যাক। যেহেতু লেখাটা ওনার তাই উনি থাকলে খুব ভালো হবে।
সারিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। সে তো তার লেখা তাদেরকে দিয়েই দিচ্ছে। সেখানে তার কি কাজ। অরণ্যর চোখে মুখে তীব্র রাগের ছাপ। শ্বাস ফুলছে তার। দাতে দাঁত চেপে বসে আছে। সীমান্তের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করতেই দেখলো সে সারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তার হাসি। অরণ্যর মনে হলো টেবিলে পড়ে থাকা ফুলদানি টা তুলে সীমান্তের মাথায় মেরে দিলে তবেই রাগটা কমবে। হাত মুঠো করে ধরে কঠিন গলায় বলল
— ওর তো ওখানে কোন কাজ নেই স্যার। অযথা একজন মেয়েকে নিয়ে জঙ্গলে যাওয়া রিস্ক হয়ে যায়। আমি সেই রিস্ক টা নিতে চাচ্ছি না।
— আমরা তো শুধু ওকেই নিয়ে যাচ্ছি না। আরো মেয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথেই থাকবে সে। তাদের খেয়াল রাখতে পারলে সারিয়ার ও কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া ওর জন্য আমি আলাদা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করবো।
সীমান্তের কণ্ঠে তীব্র জেদের আভাস। সে কোনভাবেই সারিয়া কে রেখে যাবে না। তাকে সাথে নিতে যা করতে হয় করবে। কোন আপত্তি নেই। অরণ্য গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। সীমান্ত গম্ভীর মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। যার অর্থ সে তার কথা বলে দিয়েছে। এটা আর কোন ভাবেই পরিবর্তন হবে না। সারিয়া এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল তাদের কথা। এবার সে মুখ খুলে বলল
— আমি কোথাও যেতে চাই না। আমার সেখানে কোন কাজ নেই। আর তাছাড়াও বাবা কোনভাবে এটা মেনে নেবেন না। বাড়ির বাইরে থাকাটা উনি পছন্দ করেন না।
— কাজ আছে কিনা সেটা আপনার থেকে আমরা ভালো বুঝি মিস সারিয়া। আপনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
সীমান্তের কণ্ঠ বেশ গম্ভীর শোনালো। সারিয়া ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে। অরণ্য দুই হাত মুঠো করে বেশ ভাবনায় ডুবে আছে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। সারিয়া কাগজ গুলোতে এখনো সাইন করেনি। সে টেবিলের উপরে রেখে দিয়েছে। অরণ্য সেই কাগজ গুলো হাতে নিয়ে মনযোগ দিয়ে পড়ছে। নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা। বেশ কিছুক্ষণ ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে সারিয়ার দিকে তাকাল। সারিয়া অস্থির ভাবে এক হাত আরেক হাতে চেপে ধরে আছে। অরণ্য বাঁকা হাসলো। সীমান্তের দিকে তাকাল। সে প্রকাশনীর ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ব্যস্ত। অরণ্য কাগজ গুলো হাতে ঝাপটে ধরে বলল
— স্যার আমার মনে হয় সারিয়া কে তার বাসায় কথা বলার সময়টা দেয়া উচিৎ।
সীমান্ত কোন উত্তর দেয়ার আগেই সারিয়া বলল
— আমার বাড়ির কেউ রাজি হবে না।
অরণ্য কাগজের দিকে তাকিয়েই স্মিত হেসে বলল
— রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আপনি ভাববেন না স্যার। নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি আছি তো।
সীমান্ত খুব খুশি হলো। সারিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরণ্য কিভাবে তার বাসায় ম্যানেজ করবে। এই লোকটার মাথায় সমস্যা আছে নিশ্চিত। নাহলে এমন কথা বলতো না। অরণ্য মৃদু হেসে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো
— মিস সারিয়া আপনি বাসায় যান। আমি কাল সকালেই পৌঁছে যাবো আপনার বাবার সাথে দেখা করতে।
সারিয়া হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে। সারিয়া অরণ্যর দিকে তাকাতেই তার বাঁকা হাসি ভাবিয়ে তুললো তাকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে সীমান্তের দিকে তাকাল। তার অদ্ভুত চাহুনী কেমন যেনো ঠেকলো সারিয়ার কাছে। সারিয়া বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো। সারিয়া চলে যেতেই সীমান্ত অরণ্য কে বলল
— তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো। সত্যিই অনেক উপকার করলে।
অরণ্য বাঁকা হাসলো। বাইরে বেরিয়ে এসে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। ওপাশে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই অরণ্য প্রশস্ত হেসে বলল
— সব কিছু রেডি করে রাখো। কাল সকালেই আমার লাগবে।
ওপাশের লোকটা বলল
— এতো তাড়াতাড়ি? কিন্তু…।
— আমার হাতে সময় খুব কম।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো অরণ্য। প্রশস্ত হেসে বলল
— ওয়েলকাম টু ইউর নিউ লাইফ রিয়া পাখি।
চলবে…..