ভালোবাসি বলেই তোমাকে প্রয়োজন পর্ব -০৪

#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৪

সামনা সামনি বসে আছে সারিয়ার বাবা আর অরণ্য। অরণ্য স্মিত হেসে বলল
— আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে মিস্টার সোবহান শিকদার। আপনার উত্তর টা পেলেই আমরা আমাদের গন্তব্যে রওনা দেবো।

সোবহান শিকদার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন। ফর্সা চেহারায় রাগ আর ভয় দুটোই স্পষ্ট। সারিয়া শান্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষণ হুংকার ছাড়তেন। কিন্তু এখন তিনি একদম নিশ্চুপ। কোন কারণে মনে হচ্ছে দাতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন। গম্ভীর গলায় মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন
— তোমরা ভেতরে যাও।

বাবার কথা শিরোধার্য মেনেই দুই মেয়ে এক মুহুর্ত দেরি করলো না। চলে গেলো ভেতরে। দরজা বন্ধ করে দিয়েই সারিয়া বিছানায় বসে পড়লো। দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল
— বাবা কোনদিনও মানবে না। অসম্ভব ব্যাপার।

সাথে সাথেই পিঠে দুম করে আওয়াজ হলো। চমকে তাকাল শারমিনের দিকে। সে রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— সব সময় অলুক্ষণে কথা না বললেই নয় তাই না? কেনো মানবে না বাবা? উনি কি তোকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবে নাকি? অযথা বাজে কথা।

বোনের এমন কথা শুনে সারিয়া আর কিছুই বলতে পারলো না। হতবাক হয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। সে তো কোন বাজে কথা বলেইনি উল্টা শারমিন নিজেই বাজে কথা বলে বসেছে। কিছুক্ষণ পর দরজায় শব্দ হতেই শারমিন দ্রুত দরজা খুলে দিলো। বাবাকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সারিয়া উঠে দাড়ালো। তার বাবা বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন
— তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। রেডি হয়ে নাও।

সারিয়া যেনো আকাশ থেকে পড়ল। বাবা তাকে নিজেই এই কথা বলছে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার। তবুও কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— জি বাবা?

সারিয়ার বাবা কঠিন চোখে তাকালেন। বললেন
— কি বলেছি শুনতে পাও নি? রেডি হয়ে নাও।

সারিয়া হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে শারমিন সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছে ব্যাগে। তার বাবা কথা শেষ করে চলে গেছে। সারিয়া এখনো দাড়িয়েই আছে। শারমিন সব গুছিয়ে দিয়ে বলল
— তোর জন্য কিন্তু দেরি হয়ে যাবে রিয়া। তাড়াতাড়ি কর।

সারিয়া কয়েকবার পলক ফেললো। সব কিছু মস্তিষ্কে ঢুকতেই বলল
— বাবা রাজি হয়ে গেলো আপু?

শারমিন আর কোন কথা বলল না। বিরক্ত হয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। অরণ্য অপেক্ষা করছিল সারিয়ার জন্য। সে আসতেই বলল
— চলো আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সারিয়া বিদায় নিয়ে চলে গেলো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেয়ালে ঝুলানো লেটার বক্সে চোখ গেলো সারিয়ার। এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলতেই একটা চিঠি বেরিয়ে এলো। যেখানে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ ফ্রম ভার্জিনিয়া ‘ । সারিয়া সেটা আনমনেই ব্যাগে ভরে নিলো। অরণ্য সেদিকে একবার আড় চোখে তাকাল। সারিয়া সেদিকে খেয়াল না করেই এগিয়ে গেলো। গাড়িতে ওঠার আগ মুহুর্তে অরণ্য তার হাতের কাগজ গুলো সারিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
— সাইন টা বাকি ছিলো। করে দাও।

সারিয়া কাগজগুলো হাতে নিয়ে বরাবরের মতো পড়তে লাগলো। কিছুদূর পড়তেই অরণ্য আচমকাই ধমকে উঠলো
— গতকাল এতো ভালো করে পড়েছ তবুও হয়নি। মুখস্ত করার জন্য দেয়া হয়নি তোমাকে। তাড়াতাড়ি সাইন করো।

সারিয়া বেশ বিরক্ত হলো। কথায় কথায় ধমক দেয় লোকটা। প্রচন্ড বাজে ব্যবহার। একরাশ বিরক্ত নিয়ে বলল
— আপনিই তো পড়তে বলেছিলেন। কাল পুরোটা পড়তে পারিনি তাই আজ পড়ে দেখছি।

অরণ্য ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল
— আজ কি পড়তে বলেছি? কাল বলেছিলাম কাল চলে গেছে। আজ আর পড়তে হবে না। সাইন করো তাড়াতাড়ি।

সারিয়া বিরক্তিকর অভিব্যক্তি নিয়ে সাইন করে দিলো। সাইন শেষ করতেই অরণ্য প্রশস্ত হাসলো। হাত থেকে কাগজ গুলো নিয়ে মিষ্টি হেসে বললো
— গাড়িতে ওঠো।

সারিয়া গাড়ির পিছনের দিকে দরজা খুলতেই অরণ্য বলল
— সামনে বসো।

সারিয়া পেছন ফিরে তাকাল। অরণ্য স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দরজা খুলে অপেক্ষা করছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সামনে গিয়েই বসলো। অরণ্য মৃদু হেসে গাড়িতে বসে পড়লো। গাড়ি চলতে শুরু করল। সারিয়া জিজ্ঞেস করলো
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?

অরণ্য স্মিত হেসে বলল
— হানিমুনে।

শব্দটা কানে যেতেই সারিয়া স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো নীরবে। বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই চিৎকার করে বলে উঠলো
— কি বললেন?

আচমকা এমন চিৎকারে অরণ্য চমকে উঠলো। বলল
— এভাবে কেউ চিৎকার করে। আমি ড্রাইভ করছি। তোমার চিৎকারে ভয় পেয়ে যদি এখন এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো। তাহলে কি হতো?

সারিয়া প্রচন্ড ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল। নাক ফুলিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
— চিৎকার করে বেশ করেছি। একটু আগে কি বললেন?

— কি বললাম?

অরণ্যর এমন হেয়ালি কথা শুনে সারিয়া আরো রেগে গেলো। জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলল
— আমরা কোথায় যাচ্ছি? হানিমুনে?

অরণ্য শান্ত হয়ে গেলো। সামনে তাকিয়ে বলল
— বলেছি নাকি?

সারিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সে আবারও বলল
— হয়তো ভুলে বলে ফেলেছি। আমি এরকম অনেক কথাই বলি। আমার সব কথা ধরার প্রয়োজন নেই। ধরতে গেলে নিজেকে পাগল মনে হবে তোমার। বুঝতে পেরেছো মিসেস সারিয়া।

সারিয়া হতবাক চোখে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— মিসেস না মিস।

— ওহ! সরি।

— আই হেট দিস ওয়ার্ড।

সারিয়ার কথা শুনে অরণ্য বিস্মিত চোখে তাকাল। দৃষ্টির বিস্ময় টা কেটে যেতেই রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল
— আমাকে কপি করছো? এতে কিন্তু তোমার ক্ষতি। এভাবে প্রতিটা কথা মাথায় রাখলে এক সময় মনে ধরে বসবে। তখন কি হবে ভেবেছো?

সারিয়া রাগী চোখে তাকাল। লোকটা ভীষন অসভ্য। ক্ষণে ক্ষণে অসহ্য হয়ে উঠছে।

————–
সারি বেঁধে দাড়িয়ে আছে অনেক টিলা। তাদের বুক চিরে চায়ের গাছের ফাঁকে ফাঁকে সরু রাস্তা বেরিয়ে গেছে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুমন্ত সারিয়ার মাথাটা এদিক সেদিক নড়েচড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এতক্ষণে তাদের লাউয়াছড়া পৌঁছে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু রাস্তায় গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবার কারণে দেরি হয়ে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে শিরশির করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। সারিয়া ঘুমের মাঝেই ঠান্ডায় কেপে উঠলো। অরণ্য সেটা খেয়াল করতেই এক পাশে গাড়িটা দাড় করালো। এখানের আবহাওয়া অদ্ভুত। দিনের বেলা রোদের তাপ প্রচুর হয়। কিন্তু সন্ধ্যা পেরোতেই পাহাড়ি হাওয়ায় কেপে উঠে চারপাশ। ঠান্ডা কমানোর জন্য গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তার মনে হলো সারিয়া গরম কাপড় আনেনি। কারণ সে প্রথমবার সিলেটে এসেছে। আর এখানের আবহাওয়া সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই। এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে অরণ্যর। উত্তেজনায় তাকে প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছুই জানায় নি। একটা হতাশ শ্বাস ছাড়লো সে। পিছনে তাকিয়ে দেখলো তার ভারী জ্যাকেট পড়ে আছে। সেটা দিয়েই সারিয়া কে ঢেকে দিলো। উষ্ণতা পেয়েই সারিয়া নড়েচড়ে আরো ভালো করে ঘুমিয়ে পড়ল। অরণ্য তৃপ্ত হাসলো। আবারও গাড়ি চালাতে শুরু করলো সে।

লাউয়াছড়া বনের ভেতর যখন তারা প্রবেশ করলো তখন রাত ১০ টা। সারিয়া ঘুমে মগ্ন। অরণ্য সারাদিন ড্রাইভ করায় অনেক ক্লান্ত। বনের ভেতরে একটা রিসোর্ট আছে সেখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো টিম ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে। অরণ্য রিসোর্ট এর কিছু আগেই গাড়ি থামালো। চোখে মুখে ভাবনার ছাপ তার। সীমান্ত কেনো সারিয়াকে এখানে এনেছে সেটা বুঝতে তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও এরকম অনেকবার হয়েছে। যাকেই তার ভালোলাগে সে এভাবেই কাজের অজুহাত দেখিয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে সময় কাটানোর জন্য সাথে নিয়ে আসতে বাধ্য করে। আর না বুঝেই সবাই সীমান্তের ফাঁদে পা দেয়। এবার সে প্রথমে আটকাতে চেষ্টা করলেও পরে বুঝে গিয়েছিল যে সীমান্ত সারিয়া কে যে কোন উপায়ে সাথে এনেই ছাড়বে। যদি অরণ্য খুব আপত্তি করতো তাহলে দেখা যেত তাকেই এই প্রজেক্ট থেকে বাদ দিয়ে দিতো। তাই সে কোনো উপায় না দেখে কৌশলে সারিয়া কে সাথে আনে। আর তার সব সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে রাখে আগে থেকেই। যাতে সীমান্ত কেনো ভাবেই সারিয়ার সাথে খারাপ কিছু করতে না পারে। আর সারিয়ার ঘরটাও ঠিক তার পাশেই ঠিক করে রেখেছে। যাতে সব সময় খেয়াল রাখতে পারে। সারিয়া চোখ খুললো। আশে পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো গভীর জঙ্গলে সে। চিৎকার করে উঠলো। পাশ ফিরে তাকাতেই অরণ্যর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভয় আরো বাড়িয়ে দিলো। ভীষন উত্তেজিত হয়ে পড়লো সে। ভয়ে গা ঘেমে যাচ্ছে তার। শুকনো ঢোক গিলে বলল
— আমাকে এখানে কেনো এনেছেন? কি উদ্দেশ্য আপনার?

অরণ্যর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
— আমার উদ্দেশ্য যেটাই হোক সবটাই বৈধ। আর একটা কথা স্পষ্ট শুনে রাখো। এখানে তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। কারো উপরেই ভরসা করবে না। মনে রাখবে আমি ছাড়া এখানে সবাই তোমার শত্রু।

সারিয়া সন্দিহান চোখে তাকাল। বলল
— আমি তো আপনাকেও চিনি না। তাহলে আপনার উপরে কেনো ভরসা করবো? আপনিও তো তাদের মতো হতে পারেন?

অরণ্য বাঁকা হেসে বলল
— এতটা রাস্তা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে এলে। একবারও মনে হলো না একটা অপরিচিত ছেলের সাথে একা একা যাচ্ছো। বিপদ হতে পারে তো।

সারিয়া হতবাক দৃষ্টিতে তাকাল। এর উত্তরে তার ঠিক কি বলা উচিত মস্তিষ্ক শত ভেবেও উত্তর খুঁজে পেলো না। কারণ সত্যিই তার একবারও মনে হয়নি ছেলেটার কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আচরণ যেমনই হোক বাজে কোন কাজ সে করতে পারে সেটা যেনো সারিয়া ভাবতেই পারছে না। ওর ভাবনার মাঝেই অরণ্য গাড়ি থেকে নেমে গেছে। সব জিনিস পত্র বের করে নিয়ে সারিয়া কে গাড়ি থেকে বের হতে বলল। সারিয়া বের হয়ে দাড়িয়ে গেলো এক পাশে। তার ঠান্ডা লাগছে খুব। ওড়নাটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিল। কিন্তু কোন ভাবেই কাজ হচ্ছে না। অরণ্য জ্যাকেট টা বের করে সারিয়ার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল
— মনুষত্ব , রক্তের সম্পর্কের উপরেও এমন কিছু সম্পর্ক থাকে যা একদম অন্তর থেকে আসে। নিজের অজান্তেই সেই সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা মানুষটা আপন হয়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের গভীরতা মাপা সবার জন্য সহজ না। সম্পর্কের গভীরতা মাপতে শেখ প্রিয়। অনুভব করতে শেখো কাছের মানুষের অনুভূতিটা। তাহলেই দেখবে জীবনটা সুন্দর। অতিশয় সুখের।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here