#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন
পর্ব— ১
“”ব্যাগের ড্রেসগুলো আবার বের করলে মেরে ভর্তা বানিয়ে দিব তোরে” এই বলতে বলতে আম্মু ব্যাগের চেনটা জোরে বন্ধ করে রান্নাঘরের দিকে প্রস্হান করলো ।। আর আমি সেইখানেই গালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম.. এইটা কোন কথা!! হাত না দিলে জানব কিভাবে যে কি কি ড্রেস নিয়েছে.. আর বিয়েতে যে সব কাজিনগুলো ড্রেস নিয়ে কম্পিটিশন দিবে সেইখানেই বা আমি সুন্দর লাগবো কিভাবে.. এইসব ভাবতে ভাবতে ব্যাগের চেইনটা হালকা খুলে দিলাম.. তারপর একটা একটা দেখতে গিয়ে সব ড্রেসগুলো উপচে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো.. আমি কিছুখন সেদিকে তাকিয়ে ডোন্টকেয়ার মনোভাব নিয়ে আবার নিজের ড্রেস দেখায় মনোযোগ দিলাম!! সাত দিনের সাতটা ড্রেস তো লাগবেই.. আর তিন চারটা আরো বেশি অতিরিক্ত!!
যখন আমি এইসব চিন্তায় মগ্ন তখন কাকের মতো কেউ চেঁচিয়ে ওঠে বলল– রোদেলা ভর্তা মোটেও মজাদার হবে না..
আমি মুখ ভেঙ্গিয়ে সেদিকে তাকালাম। যদিও না তাকালেও বুঝতাম আসলে ব্যাক্তিটা কে.. এ হল আমার পন্ডিত ছোট বোন মনিরা..
আর আমি সবচেয়ে লক্ষি!! রোদেলা.. যদিও এই কথা কেউ মানতে চায় না। কিন্তু সত্যি কথা যে কেউ মানে না তাও আমার জানা!! আমার অবশ্য আরো তিনটা বোন আছে.. বড় আপু মেঘলা. আমি মেজ আর আমার ছোট দুই ইবিলিশ বোন!!
আমি মুনিরার দিকে না তাকিয়েই বললাম— তুমি এইখানে তো তোমার সারগেদ কোথায়??
মুনিরা ধুপ করে বসে পড়লো!! আমি জানি সে এখন কি বলবে তাও কিছু বুঝি নি ভাবে বললাম— কি সমস্যা?? সানিরা কই??
মুনিরা আমারে চোখ দিয়ে ইশারা করতে করতে ব্যাগের বাকি ড্রেসগুলো গুছানো শুরু করলো!!
আর আমি সামনের তাকাতেই হতাশা যেন আমাকেই ঝেকে বসলো.. এই মেয়ের ফিউচার নিয়ে সন্ধিহান আমি.. আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা রকম করে সাজছে সে কোন লুকে বেশি মানায় তাকে.. মুচকি হাসিতে নাকি ডাইনির মতো তাকিয়ে..!!!! এর নাম মেকআপ বক্স হলে হয়তো বেশি মানাতো..এইসব ভাবতে ভাবতে আমি তার পিছনে গিয়ে মাথায় একটা গাট্টু মারলাম.. ফলসরুপ পুরো আইলানার তার চোখ জুড়ে মাখামাখি!!! সে তীব্র চিৎকারে ফেটে পড়লো আর আমি ভো দৌড়.. নিজের রুমে কুলুপ এটে বসে আছি আর সাথেসাথে আম্মুর রেডিও শুরু ..
আম্মু চিৎকার করে বলতে লাগলো- তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার.. আমি দরজাটা হালকা ফাক করে বললাম— অন্ধকার হবে বলেই তো ভাবলাম ভবিষ্যতে একটা এনার্জি বাল্ব লাগিয়ে নিব আর অন্ধকার লাগবে না..
আম্মু তেড়ে “” তবে রে”” বলতেই আমি আবার দরজা লাগিয়ে দিলাম…
কিছুখন পরে বেরিয়ে দেখলাম চারিদিকে শান্তি বিরাজ করছে. হয়তো আম্মুর রাগ ও পড়ে গেছে. আমার আম্মু কি আর আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারে.. এইসব ভাবতে ভাবতে মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আমি আম্মুর রুমের দিকে প্রস্থান করলাম..
আম্মু আমার কালকে যে ড্রেস পড়বো সেইটা আলনায় বিলিয়ে দিচ্ছে।। আমি তার পাশে বসে বসে আপেল খেতে লাগলাম.. আমার দিকে না তাকিয়ে বলল– তুই তো আবার আলমারি থেকে বের করা ড্রেস পড়তে পারিস না কোন জার্নিতে তাই রাতে বের করে রাখলাম.. কাল সকাল ৭ টাই রেডি হয়ে নিবি.. না হয় তোকে রেখে চলে যাব.. আর যদি গাড়িতে বমি করিস কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে চলে যাব আমি.. আমি ফিক করে হেসে দিলাম.. আর আম্মু হতাশাজনক দৃষ্টি নিয়ে বলল– আমি কোন হাসির কথা বলি নি রোদেলা.. আর নানুরবাড়ি গেলে লক্ষি হয়ে থাকবি..অন্যবারের মতো তামাশা চায়না আমি.. তোর সমান মেয়ের বিয়ে সহ হয়ে যাচ্ছে.. আর তুই এখনো কোন কাজ ও পারিস না…
আম্মুর কথা শুনে মনে হলো আমার মাথার ওপর বড় সড় কোন বাশ দিয়ে মারা হয়েছে।।। মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি.. আম্মুর সাথে আর তর্কে না জড়িয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম.. ঘুৃম ঠিকমতো না হলে আমার আবার মাথাব্যাথা করে তাই…
সকালে সুন্দর স্বপ্ন দেখছি আমার হিরোর সাথে!! যার সামনে গেলে আমার ধুকপুকনি বেড়ে যায়.. কখনো যাকে বলা হয়নি.. তাকে কতোটা ভালোবাসি আমি… আমি আমার হিরোর পাশে গিয়ে দাড়িয়েছি আমার হাতটা তার মুঠোই আর আমি লজ্জায় মাথাটা নিচু করছি..হঠাৎ করো ধাক্কায় নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করলাম..
— আম্মু ভূমিকম্পে কি আমার বিছানাটা উড়ে গেল…
পাশের হাসি শব্দ শুনে সেইদিকে তাকালাম.. আর যা দেখলাম মেজাজ সপ্তমে…
—- মুনিরা.. বলে কিছুখন দৌড়ানোর পর আম্মুর গর্জনে আমি সেইখানেই দাড়িয়ে পড়লাম…
আম্মু নাস্তা বাড়তে বাড়তে বলল– তোরে নিয়ে কি করব.. দেখ ৬.৪৫ বাজে.. সানিয়া দেখ.. ৬ টাই ওঠে পড়েছে..
আমি চোখ বড়বড় করে সেই দিকে তাকালাম.. আয়নার সামনে দাড়িয়ে সাজছে আমার গুনবতি বোন. ক্লাস টেনে পড়ে কিন্তু দেখলে মনে হয় সে ভার্সিটি শেষ করেছে.. আমাকে দেখে হালকা লাজুক চোখে হেসে বলল– আসলে সেইখানে হাসনাত ভাইয়া ও থাকবে.. ইষা আপু আর জিবন ভাইয়ার বিয়ে বলে কথা.. ওনারা তো ঢাকা থেকে আসতেই হবে..
আমার মাথায় এইবার শুধু বাশ না বাঁশঝাড়টায় পুরো পড়লো. আমি চোখ সরু করে বললাম— ওনি আসলে তোর কি..
সে নিজের মুখে ব্লাসারটা ঘসতে ঘসতে লজ্জায় কুকড়ে বলল– আরে.. তুমি দেখি কিছুই বোঝ না.. সে তো আমার উনি হবে আর তোমাদের সে..
আমি কন্ফিউস্ট মুখ নিয়ে হ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে বললাম — এই উনি আর সে কি জিনিস.।
মুনিরা এসে কিটকিটিয়ে হেসে বলল– টিউবলাইটরা এইসব বুঝে না.. তুৃমি যাও গিয়ে নিজের বুমির পলিথিন আর ঔষুধ টা খাও গা.. তোমার দৌড় অতটুকুই..সানিয়াও তার কথায় সায় দিয়ে হাতে কাচের চুরিগুলো পড়ে পরম আবেশে দোল খেতে লাগলো..আর আমি মুখে তিতু খেয়েছিমতো নিজের রুমে এসে ড্রেস পড়তে পড়তে ভাবলাম এইবার নানুর বাড়িতে গিয়ে কলাবাগানে যেতেই হবে.. ফাসিটা সেইখানেই খাবো আমি.. না হয় ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়ে আমাকে টিউবলাইট ডাকে.. এইসব ভাবতে ভাবতে গোলাপী রংয়ের ত্রীপিসটা পড়ে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম আর চোখে হালকা কাজল দিলাম তাও আবার ল্যাপ্টে গেল।। আজব মুনিরা আর সানিয়াকে কতো সুন্দর লাগছে কতো সুন্দর করে সেজেছে তারা .. আর আমি একটু সাজলাম আমাকে কেন এমন শ্যাউলাগাছের পেত্নীর মতো লাগছে… এইসব ভাবতে ভাবতে যেই হিজাব পড়বো দেখি সানিয়া গলার একপাশে ওড়নাটা ঝুলিয়ে কুঁকড়া চুলগুলোকে হাওয়ায় ভাসিয়ে গুনগুনিয়ে গাইছে— প্রেম কি বুঝি নি..
আমি মুখ ভেঙ্গিয়ে বললাম— সবই তো বুঝ কোনটা বুজনি.. সে আমার সামনে এসে তার সেই গা জ্বালানো হাসি দিয়ে গায়ে পার্ফিউম লাগাতে লাগলো..
আমি ঠোটে পিংক লিপিস্টিক দিতে দিতে বললাম— কিরে হিজাব পড়বি না??
সে ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে বলল– নাহ্… উনি খোলা চুল বেশি পছন্দ করে..
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম.. ভাগ্য ভালো সত্যি সত্যি পড়ি নাই। নয়তো লুলা হয়ে গেলে কেই বা আমাকে বিয়ে করতো.. এইসব ভাবতে ভাবতে জিঙ্গেস করলাম তোর উনি আর কি কি পছন্দ করেন??
সে আয়েশ করে বসলো তারপর পা নাচাতে নাচাতে বলল– এইযে আমি যা পড়েছি তা.. ঝুমকো, পায়ে নুপুর,, খোলা চুল এইবলতে বলতে.. আবার আচমকা “” ভালোবাসবো ভাসবোরে বন্ধু”‘ গায়তে গায়তে বেরিয়ে গেল.. আর আমার ফ্লোরে গড়াগড়ি করে কান্না করতে ইচ্ছে হলো.. যাকে আমি দুবছর ধরে গোপনে মনের কোনে জায়গা দিয়ে রেখেছি এই মেয়ে তাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে.. আমি কি করতাম… এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের চুলটা ছেড়ে ওর বলা ঝুমকো আর নুপুরটা পড়ে নিলাম.. মাথায় কাপড়টা টেনে মাইক্রোতে বসে পড়লাম..
মাইক্রো দেখলেই আমার বমি পায়.. কিন্তু জিনিস পএ অনেক বেশি.. বিয়েটা আমার মামাতো বোনের সাথে আমার খালাতো ভাইয়ের.. তাই আমার নানুর বাড়িতেই যাচ্ছি আমরা.. চারদিন পর ওর বিয়ে.. নানা বলেছে সবাইকে তাড়াতাড়ি যেতে তাই যাওয়া..আর হাসনাত ভাইয়া হলো আমার নানুর ভাইয়ের নাতি.. যাকে নিয়ে আমিও সানিয়ার মতো স্বপ্ন দেখি.. তবে ওর মতো দিবাস্বপ্ন না.. সত্যি সত্যি ভালোবেসে স্বপ্ন..
গাড়িতে বমি না আসার জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম আমি.. হঠাৎ মুনিরা টেনে বসিয়ে দিয়ে বলল– এই আপু, আপু দেখনা কর্ণফুলী নদীটা কতো সুন্দর লাগছে… পানির টলোমলো শব্দ,, বড় বড় লঞ্চ আর ইস্টিমার..
আমি রাগী মুখ করে বললাম— এই কালো পানি দেখার জন্য কাচা ঘুমটা ভাঙ্গালি আমার..
সে মুখ বাঁকিয়ে বলল– ভালোর জামানা নাই.. ভাবলাম জানালার পাশে যখন বসেছ প্রকৃতি দেখার জন্য বসেছ.. কিন্তু না মেডাম ঘুৃমানোর জন্য বসেছে…
আম্মু ধমকি দিয়ে বলল– এই,, ওকে বিরক্ত করিও না.. ঘুৃমাতে দাও নয়তো ওর বমি আসবে..
সানিয়া ফিক করে হেসে বলল– এইবার যদি বমি করে হাসনাত ভাইয়া অনেক পচাবে ওরে.. গত বার চ্যালেঞ্জ করছিল সে আর বমি করবে না… এইবলে দুই ফাজিল একটা অন্যটার ওপর গড়াগড়ি করে হাসতে লাগলো..
আমি মুড অফ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম.. ঠিক এইজন্যই আমি চায়না আজকে আমি বমি করি…মুখ বাকিয়ে ভাবলাম। আর এই পটিয়াটা দেখছি শেষ ই হয়না.. আমি আবার হেলান দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লাম..
হঠাৎ মাথাটা ঘোরে ওঠলো.. দেখলাম গাড়িটা নানুর বাড়ির গলি দিয়ে ডুকছে.. এই অল্প জায়গা যেন অনেক বেশি মনে হচ্ছে গাড়ি থামার সাথে সাথে আমি দরজা খুলে বের হয়ে ঐখানেই দাড়িয়ে সামনের জনের ওপর বমি করে দিল.. বমি শেষে চোখ তোলে তাকিয়ে দেখলাম ব্লেক কালার পান্জাবী!! আমি ধিরে ধিরে চোখ ওপরে তুলতে রাগী রাগী দুইটি চোখে চোখ পড়লো আমার..
চলবে
(গল্পটা অনেক রোমান্টিক। প্রথমে বোঝা না গেলেও কয়েক পার্ট পড়লে বুঝতে পারবেন)