ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ১৬

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ১৬

রোদেলা সামনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে.. এ যে নতুন রুপে হাসনাত.. ফর্মাল ড্রেস, ব্লু শার্ট আর ফরমাল পেন্ট.. চেহারা আর একটু গম্ভিরর্যতা বেড়েছে.. মুখে খোঁচা খোচা দাড়ি.. চোখে ব্লেক চশমা.. এইটার কারনে হয়তো আরো বেশি আকর্ষনীয় লাগছে তাকে.. চুলগুলো ভলিউম করা.. মনেই হচ্ছে না কোন ৩২ বছর বয়সের যুবক.. মনে হচ্ছে কোন ২৫ বছরের তরুন..রোদেলা আনমনে ভাবলো— কিরে বয়স না বেড়ে কি কমে গেল তার.. এতো স্মার্ট লাগছে কেন তাকে.. নাকি ইস্পা ভালো ভালো খাইয়েছে…
হঠাৎ ইস্পার নাম মনে পড়তেই মুহুর্তেই তার মন খারাপ হয় গেল…সাথে নিজের ওপর রাগও.. কতো বড় স্টুপিড তুই রোদেলা.. নিজেকে নিজেকে শোনাল সে.. তারপর নিজেকে সামলে নিল সে..
এই ছেলেটা হল কবরী ফুলের মতো.. দেখতে অনেক সুন্দর কবরী ফুল.. আর সুবাসে যে কাউকে মুগ্ধ করবে.. কিন্তু সে ফুলের গোড়ায় রয়েছে প্রাণঘাতী বিষ.. যার কোন অসুধ ও নেয়…ঠিক তেমনি এই হাসনাত হলো বাইরে সুন্দর কিন্তু ভিতরে সব বিষ.. এইসব ভাবতে ভাবতে ঘৃনায় চোখ সরিয়ে নিল রোদেলা…
হঠাৎ অদ্রি হাসতে হাসতে বলল– আসসালামুয়ালাইকোম স্যার…
হাসনাত মিষ্টি হেসে– ওয়ালাইকুম আস্সালাম..
রোদেলা অবাক হয়ে বলল– স্যা–র!!
হাসনাত মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল– হুম.. তোমাদের এ্যাকাউন্টিং স্যার…
রোদেলার চোখ যেন বড় বড় হয়ে গেল.. এই ছেলে কি বলে.. এখন কি সামনে থাকবে সবসময়.. এইসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে আবার হালকা ধমকাল সে.. কিরে রোদেলা.. অনলি স্যার…শুধু স্যার…
হঠাৎ হাসনাত রোদেলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল– হুম শুধুই স্যার…
রোদেলা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে পরপর কয়েকটা ঢুক গিলল সে…
হাসনাত ঠোট চেপে হেসে আবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল– ওকে.. স্টুডেন্টস তোমরা যাও.. আমি আসছি..
এইবলে সে হেসে চলে গেল অফিসের দিকে.. রোদেলা ঐখানেই স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে রইলো..
তামান্না আর অদ্রি রোদেলার দিকে অবাক হয়ে তাকালো.. এই জাসি কা রানীর এই রুপ কেন যেন তাদের অবাক লাগছে…তারা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই রোদেলা দুইটার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্লাসে ফিরে গেল.. দুইজন অবাক হয়ে তার যাওয়ার পানে তাকালো . শুধু শুধু কেন রাগ করছে ও?? অদ্রি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল..
তামান্নার কেন যেন দুই এ দুয়ে চার হচ্ছে.. সে কিছুই বলল না…তার আরো কিছু জানার দরকার..তাই সে মাথা দুপাশে দুলিয়ে বলল— জানি না…

ওরা চলে যাওয়ার পর হাসনাত দেওয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো.. মুখে তার তৃপ্তির হাসি.. রোদেলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলল– হু.. ঘৃনা করি… কচু করে.. আমি বোধহয় বুঝি না.. তারপর পকেট থেকে ঝুমকোচুড়ি জোড়া বের করে বলল– হু,,, বোকার সরদার আবার হিটলার রানী হয়েছে.. আমিও দেখবো হিটলার রানী কিভাবে এমন গোমড়ামুখো হয়ে থাকে।। এই বলে চুড়িগুলো আবার নিজের পকেটে পুরে নিল…তারপর পকেটে হাত গুজে ক্লাসের দিকে হাটা ধরলো..

রোদেলা ক্লাসে বসে বসে নিজের হাতটা হাতের মাঝে দিয়ে মুচড়াচ্ছে.. তার রাগে পুরো শরীর কাঁপছে.. এই ছেলে আবার কেন আসলো তার জিবনে…
যতোই ভাবছে তাকে নিয়ে চিন্তা করবে না তাও বেহায়ার মতো তার চিন্তায় শুধু সে ই ঘোরাফেরা করছে..
হঠাৎ হাসনাত ক্লাসে প্রবেশ করলো.. সবাই দাঁড়ালো শুধু রোদেলা ছাড়া.. সে আপাতত হাসনাতকে মনে মনে বকা দিতে ব্যাস্ত.. হাসনাত কলমের ক্যাপটা রোদেলার দিকে ছোড়ে দিল.. রোদেলা সেইটা মূহুর্তেই ধরে ফেলল। হাসনাত ব্রু উচিয়ে তাকালো .. রোদেলা গম্ভির মুখ করে বলল—- আমার চোখ যেদিকেই থাকুক.. কিন্তু আমার কাছে আসা সকল বিপদজনক বস্তু আমি আগে থেকে দেখি.. এই বলে হাসনাতের দিকে স্হির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো..
হাসনাতের মন মূহুর্তেই খারাপ হয়ে গেল.. সে রোদেলাকে বসতে বলল তারপর নিজের পরিচয় দিল .সবার কাছে.
তামান্না হাসনাত শুনার সাথে সাথে রোদেলার দিকে তাকালো.. রোদেলা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো.. তামান্না তাড়াতাড়ি নিজের চোখ সরাতেই হাসনাতের দিকে চোখ পড়লো তার.. হাসনাত দুষ্টু হাসি দিয়ে চোখের ইশারা দেখালো রোদেলাকে।। তারপর নিজের দুই হাতের আন্গুল মিলিয়ে দেখালো.. তামান্নার হাসি চলে দিল.. সে যেই হেসে ওঠবে.. হাসনাত চোখ রাঙ্গিয়ে রোদেলাকে দেখালো.. তামান্না তাড়াতাড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করার অাপ্রন চেষ্টা করতে লাগলো.
রোদেলা ওর দিকে তাকিয়ে বলল– কিরে কি সমস্যা কি চলে??
তামান্না আমাতাআমাতা করতে করতে হাসনাত বলে ওঠলো— কি আর চলবে.. স্টুডেন্ট আর স্যার কি কথা ও বলতে পারবে না।।।
রোদেলা অবাক হয়ে তাকালো.. সে তো আস্তে বলেছে এই ছেলে কিভাবে শোনলো.. কানগুলো কি ঘোড়ার কান হয়ে গেল!!! হঠাৎ হাসনাত হেসে বলল– আমি লিপস রিডিং শিখেছিলাম.. চার বছর আগে… তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল– কারন স্টুডেন্টস শিখার কোন বয়স নেই।।
তোমরাও নিউ নিউ জিনিস শিখবে।।ওকে.. এইবলে সে রোদেলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো.. মেয়েরাতো ইয়েস স্যার বলে চিৎকার করে ওঠলো.. মনে হচ্ছে সব কয়টা এক্টিভ স্টুডেন্ট!!
রোদেলা চারপাশে চোখ বুলিয়ে রেগে দাতকটমটিয়ে মনে মনে ভাবলো— হু.. এতো রকম শিক্ষা দিয়ে হচ্ছিল না.. এখন তার আবার নিউ নলেজ লাগবে.. শেয়াল পন্ডিত একটা. এই বলে মুখ ভেঙ্চালো… তারপর সামনে তাকিয়ে দেখলো হাসনাত ব্রু উচিয়ে তাকিয়ে আছে.. সে মুখ অন্যদিকে ঘোরিয়ে আবার হাসনাতের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলল– স্যার,,, আপনি কি মাইন্ডরিডিটাও শিখেছেন নাকি??
হাসনাত পিছনদিকে লাফ দিয়ে টেবিলের ওপর বসতে বসতে বলল– নাহ্,, তবে ভাবছি শিখে ফেলবো.. ফিউচার বৌ যদি মনে মনে গালি দেয় তাহলে তো আর জবাব দিতে পারবো না.. এইবলে দাত দেখিয়ে হেসে দিল..
হাসনাতের গা জ্বালানো হাসি রোদেলার রাগকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে.. সে বিরবিরিয়ে বলল– এইটা ক্লাস,, কোন টুটপেস্টের এড না দেওয়া হচ্চে না এখানে…
তারপর হঠাৎ অদ্রি প্রশ্ন করে বসলো– স্যার আপনি আনমেরিড??
রোদেলা হাসনাতের দিকে স্হির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো.. হাসনাত সাবলীল হেসে– হুম.. পিওর সিন্গেল…
রোদেলার চোখ তার অনিচ্ছায় বড় বড় হয়ে গেল.. তামান্না সেইদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল– স্যার সিন্গেল তো বোঝালাম.. পিউর সিন্গেলটা কি??
হাসনাত হেসে– পিওর সিন্গেল হলো.. না বৌ আছে.. না কোন সময় গার্লফ্রেড ছিল..
রোদেলা তার কথাশুনে নাক সিটকে বিরবিরিয়ে বলল– মিথ্যাবাদী….
হাসনাত দেখেও কিছুই বলল না সে হেসে বলল– ওকে এইবার বইটা খোল আমি পড়াই কিছু…
হাসনাত সবাইকে টাস্ক করতে দিয়ে চেয়ারে বসে রোদেলার দিকে তাকালো… আর নিজের চিন্তার রাজ্যে ডুব দিল!!!

“”কেন সেইদিন রোদেলা কিছুই বলল না তাকে.. কেন এইভাবে চলে এলো.. কি বা দোষ ছিল তার যার শাস্তি হিসেবে সে ঘৃনা করছে আজো.. কখনো কি ভালোবাসে নি সে আমাকে…””
না চায়তেই হাসনাতের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো..হাতের ওল্টোপিঠে চোখের পানিগুলো মুছে নিল সে সবার চোখের আড়ালে।। সে চায়না কেউ জানুক তার কষ্টগুলো . সে নিজে নিজে ভাবলো এতো পানি কোথা থেকে আসে তার চোখে.. পাচ বছরেও কি শেষ হয় না.এই চোখের সমুদ্র..
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলে– দূর থেকে অনেক দেখেছি তোমার.. আজ অনেকটা কাছ থেকে দেখলাম তোমাকে.. অনেক বছর পর!! কিন্তু দেখ মনটা কতো অবুঝ.. সে যে আরো কাছে যেতে চায়.তোমার…

হঠাৎ ক্লাস শেষ হওয়ার বেল এ ঘোর কাটে তার.. সবাইকে বিদায় জানিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে.. রোদেলা অবাক চোখে তাকালো হাসনাতের দিকে.. তার চোখের পাপড়িগুলো ভেজা!!! হাসনাত কি কান্না করেছিল?? সে আনমনে ভাবে.. আবার পরক্ষনে নিজের বোকামির জন্য নিজের ই রাগ ওঠলো তার.. নাক ফুলিয়ে বিরবিরিয়ে বলল– এই ছেলে কাদতে জানে না কাদাতে জানে..এইসব বলতে বলতে সে ক্লাশে প্রবেশ করলো…

ক্লাশ শেষে রোদেলা আর তামান্না রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু কোন রিক্সা ই খালি পাচ্ছে না আর যাদের পাচ্ছে সেইসব রিক্সায় তাদের নিচ্ছে না.. রোদেলা রেগে বলল– ধ্যাত আজকে রিক্সাওয়ালা গুলো কি হলো এমন করছে কেন..তামান্না মাথা নেড়ে জানালো সে কিছুই জানে না..
হঠাৎ হাসনাত তাদের,সামনে পকেটে হাত গুজে দাড়ালো তারপর মিষ্টি হেসে বলল– তোমরা,চায়লে আমার সাথে আমার গাড়িতে যেতে পার.. তোমাদের টিচার,আমি।।। আমার,ও তো রেস্পনসিবল আছে তোমাদের প্রতি..
রোদেলা মুখ বাঁকিয়ে বলল– আমরা শিশুতে পড়িনা..আমরা এডাল্ড.. আমরা একাই যেতে পারবো.. আপনি আসতে পারেন…
হাসনাত তামান্নার দিকে ব্রু উঁচিয়ে তাকালো.. তামান্না মৃদু হেসে আবার স্বাভাবিক হয়ে বলল– ইয়ার কতো রোদ দেখ.. আর আমার টিউশনও আছে.. আর স্টুডেন্ট এর ও এক্সাম চল না.. আর আমরা তো যেচে হেল্প চায় নি ওনার কাছে. ওনি করছেন।।
রোদেলা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো তামান্নার দিকে তারপর পাশে রিক্সাওয়ালাকে বলল– চাচা,, আপনি তো বসে আছেন.. আমাদের দিয়ে আসেন না..
রিক্সাওয়ালা পান খাওয়া দাতে হেসে বলল– চাচি..চাচার লগে জান না.. আমি জিরাবার চায়….
রোদেলা চরম বিরক্তি নিয়ে হাসনাতের দিকে তাকালো.. আর হাসনাত ব্রু নাচিয়ে মৃদু হাসলো…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here