ভালো তোকে বাসতেই হবে পর্ব ৩৫

#ভালো তোকে বাসতেই হবে ❤️
#পরিধি রহমান বিথি🍁
#পর্ব-৩৫

ডক্টর চোখের ইশারায় নার্সকে বাঁধা দিতে বারন করল।রাত ভাইয়া আমাকে নিয়ে কেবিনের বাইরে এলেন। বাড়ির সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখেও কারো মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। আমাকে রাত ভাইয়া কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন আর কারো কোনো পাত্তাই নেই। উল্টো আমি নিজেই অবাক,,

❤️
তবে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কেবিনের বাইরেই একদল মানুষ বসা। যারা আমাদের দিকে দৌড়ে আসলো। আম্মু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,,

,,”বাবা ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?সব ঠিক আছে তো?? আবার কোনো অঘটন,,??(আর বলার আগেই আম্মু শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।)

ভালো আন্টি আম্মুর কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

,,”ভাবী প্লীজ এভাবে ভেঙে পড়বেন না । মিষ্টি মার কিছু হবে না।”

রাত ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে বললেন,,,

,,”হ্যাঁ আন্টি আপনি প্লিজ কাঁদবেন না।ওর কিছু হয়নি । ডক্টর বলল অন্যকোন সমস্যা আছে কিনা তা দেখার জন্য সিটি স্ক্যান করতে হবে ‌।তাই নিচে ল্যাবে যাচ্ছি টেস্ট করাতে।”

রাত ভাইয়ার কথায় মোটামুটি বিশ্বাস করেছেন।একটু ভরসা পেয়েছেন।তাই কান্নার বেগ কমেছে‌।আর নাক টেনে টেনে চোখের জল মুচ্ছেন। আম্মুর জন্য খুব খারাপ লাগছে। বলতে গেলে শুধু আম্মু না এখানে উপস্থিত সবার জন্যই আমার খারাপ লাগছে।সবার মধ্যে একরাশ ক্লান্তি ভর করে আছে। হয়তো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া ও করে নি।চোখ ঠিকমতো জিরান পায় নি বহুদিন। খুব অস্থির একটা পরিবেশ।রাত ভাইয়া আর দাড়ালেন না।হাঁটা দিলেন।


সিটি স্ক্যান করা শেষ।রাত ভাইয়া আবার আমায় কোলে তুলে নিয়ে রওনা হলেন কেবিনের দিকে।সিটি স্ক্যান করতে আমাদের পাঁচ তলা থেকে নিচ তলায় যেতে হয়েছে। যদিও সিড়ি ভাঙতে হয়নি। সেদিকে অশান্তি ভোগ করতে হয়নি ‌। তবে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। একটা পা ভাঙ্গা ল্যাংরা ‌মেয়েকে একটা বডিবিল্ডার যুবক কোলে নিয়ে একদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।আর পিছনে পিছনে স্যালাইনের ব্যাগ হাতে লেজ দৌড়াচ্ছে (জেরিন)‌। আমি হাসি চেপে কোলে বসে আছি। যেকোনো সময় এই হাসি একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ রুপে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এই অবস্থায় হাসলে ব্যাপারটা ঠিক কেমন হবে না?তাই হাসিকে লাথি মেরে বেশ একটা রোগী রোগী মুখ করে কোলে চেপে আছি।রাত ভাইয়া আমাকে নিয়ে বেড়ে শুয়ে দিলেন। জেরিন এসে স্যালাইনটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে দিল। ডক্টর ও এসেছেন তবে এটা আগের ডক্টর না‌।ছোট ডক্টর যাকে বলে ডিউটি ডক্টর। এবার চেক করতে এসেছেন। সবকিছু দেখে আরো কিছু ওষুধ প্রেশক্রিপশনের পাতায় যুক্ত করে গেলেন। আমার বাম পা টা ভেঙ্গেছে তাই সেই পা টা ঝুলিয়ে দিয়ে গেলেন।কি অদ্ভুত!! জেরিন মুখ টিপে হাসছে।রাত ভাইয়া ও ডক্টরের সাথে বাইরে গেলেন। হয়তো আমার সামনে কথা বলতে ভরসা পাচ্ছেন না নাকি ভয় পাচ্ছেন কে জানে?? ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে উঠলাম। জেরিন এসে আমায় আধশোয়া করে দিল। আমি একটা ধমক দিয়ে বললাম,,

,,”কি রে জেরি ?? তুই এতো হাসছিস কেন ?? হাঁসের মাংস খেয়ে এসেছিস নাকি??”

জেরিন অদ্ভুত চোখে আমার পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এলো।মিচকে টাইপ একটা হাসি দিল‌। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ও বাজে কিছু ভাবছে। হঠাৎ অবাক সুরে বলতে লাগলো,,

,,,”ওরে আমার সোনু রে,,!! আগে শুনেছিলাম প্রত্যন্ত গ্রামে রয়েছে ঝুলন্ত পায়খানা,আজ তো দেখছি হাসপাতালে আছে ঝুলন্ত পা।”(বলেই হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে পড়ল)

আমি রাগী রাগী লুকে জেরিনের দিকে তাকালাম।চটে গিয়ে বললাম,,

,,”তুই আমার এতো সুন্দর পা টাকে পায়খানা,,,এএএয়ো,,,(বলতে গিয়েই কেমন একটা গা গুলোচ্ছে।আসলে আমাদের বাংলা ভাষার একটা বিশেষ মাধুর্য রয়েছে আর এইখানে সেই মাধুর্যই ফুটে উঠেনি। উল্টো মনে হচ্ছে পায়খানার সুগন্ধের নিচে তা বিলিন হয়ে গেছে। কারন টয়লেটে বাংলা অর্থ হচ্ছে শৌচাগার। গ্রামীণ লোকেরা শৌচাগার বলা কে কষ্টসাধ্য মনে করে বানিয়ে দিল পায়খানা। তাই মাধুর্যময় বাংলায় লেখা পায়খানা বা শৌচাগার এখন টয়লেট বলেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সভ্য শ্রেণীর লোক) ,,মানে টয়লেটের সাথে আমার পায়ের তুলনা করছিস??দাঁড়া একটু ভালো হতে দে।এই পা দিয়ে একটা কিক মেরে তোর ঝুলন্ত পায়খানার ব্যান্ড বাজিয়ে দেয়।”

জেরিন মুখের বত্রিশটা দাঁত বের করে হি হি হি করে হাসছে। আমি বহুত বিরক্ত। আবার চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকালাম। দাঁতে দাঁত কেটে কটকট করতে করতে বলছি,,

,,” ইচ্ছে হচ্ছে এখনই তোকে লাথি মেরে গুনে গুনে সামনের ১০টা দাঁত ফেলে দেই। হমমম,,,,!!”

জেরিন দু পা পিছিয়ে গেল।হাসি থামিয়ে অবাক গলায় বলল,,

,,”কেন রে? আমার দশটা দাঁত ফেলবি কেন??(মুচকি হাসি দিয়ে বলল),, আমার বাকি বাইশটা দাঁত কী ক্ষতি করেছে তোর??,, যে তোর এই মহামূল্যবান লাথির আঘাতে প্রান ত্যাগ থেকে তুই তাদের বঞ্চিত করছিস??(বলেই রুম কাঁপিয়ে হাসছে জেরিন)

আমি ও ওর কথা শুনে হাসছি‌। সকল কঠিন সময়গুলোতে বান্ধবীকে কাছে পাওয়া ও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলেদের কাছে নিছকই এটা দুধ ভাত। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে না। মেয়েদের একটা সময় এক এক জায়গা বিয়ে করে চলে যেতে হয়। তাই অনেক খবর তারা সঠিক সময় পায় না আর পেলেও সাংসারিক না না ঝামেলায় তখন সঠিক জায়গায় উপস্থিত ও হতে পারে না। কিন্তু সেই জায়গায় থেকে আমি খুব ভাগ্যবতী যে বান্ধবীকেই ভাবী রুপে পাব।যে দুঃসময়ে দাঁত কেলিয়ে এইসব টয়লেট টাইপস কথা বলে মনে ভোলাবে। আমি ও হাসছি। মাথার চিনচিনে ব্যাথাটা এখন আর নেই।তাই বেশ ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে।কত ইচ্ছে ছিল জেরিনের বাসদের গল্প শুনবো। আমরা যে এতো বিরক্ত করলাম তার কি কি প্রভাব পড়ল??তা শুনব বেশ আয়েশ করে। তা আর হলো কই?? এখন সময় থাকলেও হাসপাতালে বাসরের গল্প ,,হাউ চিপ,,!! হঠাৎ মনে হলো বেশ একটা চাপ।এটা শরীরের অস্থির চাপ। চোখগুলো ও যেন দু ফোঁটা জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি ইন্দ্রিয় জলের স্পর্শ চাইছে। কিন্তু আমার পা ভেঙ্গেছে তো ওয়াশরুমে যাব কিভাবে??(মনে মনে বিরবির করছি)

জেরিন উঠে এসে অস্থির গলায় বলল,,

,,”কিরে একা একা বিরবির ককরছিস কেন? মাথায় আঘাত পেয়ে পাগল হয়ে গেলি নাকি??নাকি তোকে আবার বোবা ভুতে ধরল??”(বলেই বাঁকা হাসি দিল)

আমি বিরক্তির সঙ্গে বললাম,,

,,”ইডিয়ট,, পাগল হয়ে যাব কেন?? পাগল ছাড়া বুঝি কেউ একা একা কথা বলে না?? (একটু থেমে করুন গলায় বললাম)দোস্ত আমি ওয়াশরুমে যাব!!(এমন ভাবে বলছি যেন মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের কোনো শিশু আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বায়না করছে)

সঙ্গে সঙ্গে রুমে রাত ভাইয়া ঢুকলেন। আমরাও আমাদের কথা বন্ধ করে মুখ কাচুমাচু করে বসে আছি।রাত ভাইয়া হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছেন তাই আড়চোখে চেয়ে আমাদের দিকে সন্দেহের নজরে তাকালেন।মনে হচ্ছে আমার ওয়াশরুমে যাওয়ার বায়না শুনে এক্ষুনি তেরে আসবে আমার গলা টিপতে ‌।তারপর কর্কশ গলায় ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন,,

,,”কি ব্যাপার এখানে কি নিয়ে এতো আলোচনা করা হচ্ছে??সময়,,,??”

আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাসি দিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম,,

,,”ননা না।কি কি কিছু না। আই আমরা তো এমনিই কথা বলছিলাম।”

রাত ভাইয়ার সন্দেহ এখন সত্যিতে রুপান্তরিত হলো। কিন্তু উনি আর কিছু বললেন না।আর কিছু জিজ্ঞেস ও করলেন না পা নামিয়ে সোজা আমায় কোলে তুলে নিলেন । একদম ওয়াশরুমে গিয়েই নামালেন। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে । উনি না বলতেও এতো কিছু বুঝতে পারেন কিভাবে?? জেরিন কে বলল,,

,,”তোমাদের হয়ে গেলে আমাকে ডাক দিও কেমন??”

জেরি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।

ওয়াশ রুমে কাজ শেষ।একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নিলাম। বেশ ভালো লাগছে। রাত ভাইয়া আবার এসে আমায় কোলো তুলে নিলেন। জেরিন বাইরে গেছে অপূর্ব ভাইয়া ডাকছিল বলে।উনি আমায় বেডে শুয়ে দিয়ে আমার পায়ের পজিশন ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি অবাক চোখে রাত ভাইয়াকে দেখছি। খুব ভালো লাগছে।না চাইতেও মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,,

,,”আপনি আমার না বলা কথাগুলো এতো সহজে বুঝে যান কিভাবে?”

রাত ভাইয়া ধীর গতিতে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মুখে সামনে এসে থমথমে গলায় বললেন,,

,,”তুমি আমার প্রানের চেয়ে ও প্রিয় ।আর যে জিনিস মানুষের অতি প্রিয় ,, তাদের কিছু বলে দিতে হয় না।সেই জিনিসের বা ব্যাক্তি সব কথা সে অনুভব করতে পারে।তাই তোমার না বলা হাজার ও কথা আমি অনুভব করতে পারি।(রাত ভাইয়া বলেই আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলেন।)

আমি ঘোর লাগা চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম । ওনার ভালোবাসার পরিমাণ অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তাও আমি পারছি না। শুধু খুশিতে দু চোখে কোন থেকে খুশীর ধারা বইতে লাগলো,,,

,,,,চলবে!!❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here