#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৬
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
শনিবারের এক সন্ধ্যা। মাঝখানে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। রুবার মাধ্যমে অবশেষে জার্মানি এসে পৌঁছুতে পেরেছে লাবণী। আকাশ সমান বিষন্নতা আর একটা ভাঙা মন নিয়ে লাবণীর পা পড়ল জার্মানের মাটিতে। আশেপাশে অগণিত অপরিচিত মুখ। লাবণী ভীরু চোখে চারপাশ দেখছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং লঞ্জের দিকে এগোয় সে। এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক মানুষের সমাগম, অথচ লাবণীর প্রচন্ড একাবোধ হচ্ছে। চোখজোড়া ধীরে ধীরে মেঘবর্ণ ধারণ করছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে যেন! বুকের ভেতর থাকা যন্ত্রটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। একটা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিলো, ‘যদি কেউ না আসে তাকে নিতে? তবে কোথায় যাবে? এখানের ভাষাটাও তো সে জানে না!’
প্রশ্নখানা মাথার ভেতর হুটোপুটি করতে যতক্ষণ, লাবণীর চোখ ভেঙে বৃষ্টি নামতে সময় নিলো না। আশপাশ অগ্রাহ্য করে সে হু’হু করে কেঁদে উঠল।
ঠিক তখনই একটা কালো পাজেরো এসে থামলো লাবণীর সামনে। লাবণী চমকে দুই কদম পিছিয়ে যায়। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে টকটকে ফর্সা বর্ণের একজন সুদর্শন পুরুষ। চোখে রোদচশমা, ওভার কোট পরনে, মাথার চুলগুলো মাঝারি, বাদামী বর্ণের। সবচেয়ে নজর কাড়া জিনিস হলো গালের ডিম্পল। না হাসলেও ভাঁজ হয়ে থাকে। লাবণী মুহূর্তেই কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তার মন বলে উঠল, ‘ইনি নিশ্চয়ই কোনো নায়ক হবেন এই দেশের।’ বস্তুত তাকে দেখে এমনটিই ধারণা জন্মাবে প্রথম দেখায়। তবে সে একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছুই না মূলত! যুবকটি লাবণীর দিকে দৃষ্টি তাক করতেই লাবণী গুটিয়ে গেল। নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আঁটসাঁট ভঙ্গিমায় দাঁড়াল। যুবকটি ফোনের গ্যালারি খুঁজে একটি ছবি বের করে লাবণীর সঙ্গে মিলিয়ে শিউর হয়, ইনি-ই সে। যাকে পিক করতেই এসেছে ও।
খানিকটা অবাকও হয় সে। লাবণীর পরনের এই অদ্ভুত পোশাক সে এর আগে কখনো দেখেনি। জিনিসটা কী? কালো গাউন? একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সে লাবণীর দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে ধরে বলল,
-‘হ্যালো, ইয়া উন্ড মিস লাবণী?’
-‘জি?’
লাবণীর ঠোঁট ছিটকে বেরিয়ে আসে শব্দটি। পরমুহূর্তেই ঠোঁটে অদৃশ্য সেলোটেপ লাগিয়ে চুপ করে গেল। এই পর্যায়ে এক টানে চোখের রোদচশমা খুলে হাতে নেয় যুবকটি। পূর্বের চেয়েও অধিক বিস্ময়তা ঘিরে ধরল লাবণীকে। টকটকে গাঢ় খয়েরী বর্ণের চোখ এর আগে কখনো দেখেনি। হুট করে দেখলে যে কেউ ভয় পাবে,স্বাভাবিক। তবে লাবণী ভয় বা ঘাবড়ে গেল না। বরঞ্চ তার মনের ভেতর এক দলা কৌতূহল জমলো। অদ্ভুত এই যুবকটি কে? আর তার দিকেই কেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে?
লাবণী বাঙালি। সেই সঙ্গে কম শিক্ষিত একজন মানুষ। এসব তার সিভিতেই দেওয়া হয়েছিল। তার জার্মান ভাষা বোঝার কথা নয়। যুবকটি বলল,
-‘R u miss laboni? I’m max. I m here to pick u. Come inside the car laboni.’
স্পষ্ট অ্যাক্সসেন্টে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করল ম্যাক্স। নিজের পরিচয় দিয়ে লাবণীকে ইশারা করল গাড়ির দিকে। ইংরেজি কথা না বুঝতে পারলেও তাকে যে গাড়িতে বসতে বলা হয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল লাবণী। আড়ষ্টতা বজায় রেখেই সে এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে। লাবণীর থেকে কোনোপ্রকার প্রত্যুত্তর না পেয়ে ম্যাক্স অবাক হয়। অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
-‘Strange!’
পরক্ষণেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে।
★
পিচঢালা পথের দু’পাশে শারি শারি পাইন গাছ। লাবণীর নিকট অদ্ভুত ঠেকে। এর আগে এরকম গাছ সে কখনো দেখেনি। তারচেয়েও বেশি অদ্ভুত লাগে রাস্তায় কোনোপ্রকার জ্যাম নেই দেখে। আশেপাশে বারবার উশখুশ করে তাকাতে তাকাতে মনের অজান্তেই সে বলে উঠল,
-‘আরে, আপনাদের এখানে জ্যাম হয় না? মানুষ তো তাহলে সত্যি বলে দেখছি। বিদেশি জ্যামই হয় না, কত সুন্দর। আর আমাদের দেশে পাঁচ মিনিট যেতে যেতে জ্যাম লাগে। হুহ!’
প্রাণোচ্ছল কিশোরীর ন্যায় বকবক করতে লাগল লাবণী। তার একটি কথাও বুঝতে পারছে না ম্যাক্স। তবুও লাবণীকে আঁটকালো না। কথা বলতে দিলো নিজের মতো করে। কয়েক সেকেন্ড পর নিজের হুশ ফিরে এলে চুপসে গেল লাবণী। সেই সঙ্গে মেদুর রঙের লজ্জা পেয়ে বসে গাল দুটোতে। ঈষৎ রাঙা হয়ে উঠে সে। চোখ সরিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
-‘আমিও না পাগল! কেমন বকবক করছি। আপনি কী রাগ করলেন?’
ম্যাক্সের প্রত্যুত্তর নেই। বেচারা তো বোঝেইনি কিছু। সে ড্রাইভ করে চলেছে নিজের মতোন করে। বোকা লাবণী নিশ্চুপ ম্যাক্সকে দেখে ভাবল, তার এই বকবকের জন্য নিশ্চয়ই রাগ করেছে সে। বিদেশের মানুষ অনেক নিয়মকানুন মেনে চলে। বেশি কথা পছন্দ করে না। আর সে প্রথমদিন এসেই বকবক করে চলেছে!
মনে মনে কষে কয়েকটা বকা দিলো নিজেই নিজেকে। আঁড়চোখে ম্যাক্সের দিকে তাকাতেই ম্যাক্স বলে উঠল স্পষ্ট ইংলিশে,
-‘What happened lady? Why you are staring at me?’
পূর্বের ন্যায় এবারও লাবণী কিছুই বুঝতে পারে না। তার ঠোঁট ছিটকে বেরিয়ে এলো,
-‘অ্যাহ!’
জবাব শুনে হাসিতে ভেঙে পড়ল ম্যাক্স। গালের ভাঁজ গভীর হলো। সুন্দর ডিম্পল পড়ে। লাবণী সরু চোখ করে তাকাল।
ম্যাক্স বলছে,
-‘you are so strange and weird, really..I never saw a girl like u laboni.’
ইংরেজিতে ‘Laboni’ উচ্চারণ করলেও বাংলায় তা শোনা গেল অনেকটা ‘ল্যাবণী’ আকারে। যা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল লাবণী। পিটপিট করে কয়েকটা পলক ফেলে সে বাচ্চাদের মতো আহত সুর নিয়ে বলে উঠে,
-‘ল্যাবণী কী? আমি লাবণী। লা-বো-ণীইই…বুঝেছেন?’
ঘাড় ঘুরিয়ে নিষ্পলক তাকায় ম্যাক্স। তার চোখের ভাষা-ই বলছে সে কিছুই বোঝেনি। লাবণী মনঃক্ষুণ্ন হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে,
-‘লাবণীরে, তোর কপালে অনেক হ্যাপা আছে। এই ছেলে তো তোর ভাষার কিছুই বোঝে না। আর তুইও তো উনার ভাষার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিস না। ধুরো!’
-‘are you okay?’ ম্যাক্স বলল। লাবণী বুঝল না তবুও ঘাড় নাড়ায় আনমনে। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে একটা সহজ সমাধান ও পেয়ে গেল। তার চোখজোড়া ঝলমল করে উঠে। বিদ্যুৎ বেগে ম্যাক্সের দিকে ফিরে তাকাল সে। হাত ইশারায় ম্যাক্সকে বোঝালো কিছু একটা। ম্যাক্স বুঝল না। সে কপাল কুঁচকে লাবণীর অদ্ভুত আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে। লাবণী হাল ছাড়ল না। পুনরায় কী বলতে চাইছে তা বোঝানোর চেষ্টা চালালে ম্যাক্স বুঝল। একটা বড় ভার মাথার উপর থেকে সরে গেল। লাবণীর ইশারা অনুযায়ী গাড়ির জানালা খুলে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে দক্ষিণের আওলা বাতাস তাদেরকে দখলে নিয়ে নেয়। লাবণীর বেশ লাগে। বিশুদ্ধ বাতাস বুক ভরে টেনে নিতে গিয়ে সে উপলব্ধি করল, যে কষ্টটা এতক্ষণ বুক চেপে ছিল, সেটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। মন কামড়ে রাখা জঘন্য ব্যথাটা আর নেই। তবে কী মাজহাবের দেওয়া কষ্টগুলো এতদ্রুতই ভুলে গেল লাবণী?
কক্ষনো না। মাজহাব যা করেছে তার জন্য ক্ষমা নয়, শাস্তি প্রয়োজন। সেই শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা লাবণীর না থাকলেও তাকে ক্ষমা করার মতো উদার মানসিকতাও তার নেই। বরং প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে মাজহাবের দেওয়া আঘাত গুলো তাকে শক্ত করে তুলেছে। শক্ত হতে বাধ্য করেছে। মাজহাবকে আর ভালোবাসা দিয়ে নয়, ঘৃণার সহিত মনে করবে লাবণী। মাজহাব তার জীবন থেকে পুরোপুরি ভাবে ডিলিট না হলে তার মন থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে গেছে। এখন লাবণীর পথ আলাদা। সে পথের লোকগুলোও আলাদা। এদেরকে নিয়েই নতুন ভাবে জীবন সাজানোর চেষ্টা করবে লাবণী। বাকিটা বিধাতার উপর তুলে দিয়েছে সে।
-‘What do you think?’
ম্যাক্স প্রশ্ন ছোঁড়ে। লাবণী বুঝে উঠতে না পেরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলো। তার চোখের সঙ্গে নিজের চোখজোড়া মিলিয়ে নিয়ে ম্যাক্স ধীরে ধীরে বলে উঠল,
-‘Oh, you can’t speak english, don’t you?’
পুনরায় অসহায় চোখ মেলে চেয়ে রইলো লাবণী। কী বলছে ম্যাক্স? একটি ভাষাও যে বোধগম্য হচ্ছে না তার নিকট! নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে হয়। কেন জীবনে একদমই পড়াশোনা শিখলো না? পরক্ষণেই উত্তর আসে, তার তো পেটে দেওয়ার মতো ভাতই জোটেনি ছোটবেলায়,স্কুল জুটবে কোথা থেকে? বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস লাবণীকে ভাবুক করে তোলে। সে ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। নিষ্পলক চেয়ে রয় দূর আকাশের পানে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আকাশটা সুবিশাল। মাজহাব এবং সে- দু’জন দু’টি দেশে থাকলেও আছে কিন্তু একই আকাশের নিচে!
-‘You need to learn english as soos as possible. Otherwise it will be difficult to live here.’
আপন মনে বলে চলে ম্যাক্স। লাবণী শুনলো, বোঝার চেষ্টা করল না। দূর আকাশে তাকিয়ে জীবনের লেনাদেনা গুলো হিসেব কষতে বসল। এবং একসময় গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল নিজের অজান্তেই।
বাড়ির অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। আর বিশ মিনিট বড়জোর। শহর থেকে বেশ দূরেই থাকে ম্যাক্স এবং তার পরিবার। যদিও তার বাবা-মা ভিন্ন জগতেই থাকে বেশিরভাগ সময়। ম্যাক্স এবং তার জুলিয়া-ই তাদের বাংলো বাড়িতে থেকে আসছে ছোট কাল থেকে। ঘরের কাজগুলো করার জন্য আগে যাকে রাখা হয়েছিল, কিছু কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আরেকজনের খোঁজ লাগায় তারা। এই শহরের প্রায় সবারই একটা অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া রয়েছে তাদের প্রতি। তাদের আলাদা থাকা, একটু নিরিবিলি জায়গায় থাকা এবং অদ্ভুত আচরণ, আশেপাশের সবাইকে আগ্রহী করে তুলেছে। সেই জন্য জার্মান থেকে নয়, অন্য দেশ থেকেই কাউকে কাজের লোক হিসেবে আনার পায়তারা করে এরা। যাতে করে সে কাজের লোক হিসেবেই থাকে এবং এরচেয়ে বেশি একবিন্দু নাক না গলায় তাদের কাজ নিয়ে। তাদেরকে নিয়ে। খুঁজতে খুঁজতে গণ্ডগ্রামের যুবতী মেয়েটিকে মনে ধরে গেলে নিয়ে আসতেও দেড়ি করে না। সেই মেয়েটিই লাবণী। যাকে ওদের ভাষায় ‘ল্যাবণী’ বলে সম্বোধন করা হয়!
গাড়ি থামিয়ে লাবণীকে বার কয়েক ডাকলেও বোকা মেয়ের সাড়া নেই। গত কয়েকদিনের স্ট্রেস, রাত জাগা, অতিরিক্ত টেনশন এবং কান্নার দরুন চোখটা ভালো ভাবেই লেগে এসেছে যেন। একবার জেগে ‘হুঁ, আরেকটু ঘুমাতে দিন’ বলে পুনরায় নিদ্রায় তলিয়ে গেছে লাবণী। তার বলা কথা গুলো ম্যাক্স না বুঝলেও লাবণীর চোখের গভীর ঘুম বুঝতে অসুবিধে হলো না। অগত্যা লাবণীকে টেনে বাহিরে বের করে আনে সে। লাবণী চমকে জেগে উঠে।
-‘কী করছেন, কী করছেন আপনি!’
বলতে বলতেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করল সে। ম্যাক্স চোখের পলকে লাবণীকে পাজাকোলে তুলে নিয়েছে। লাবণীর চিৎকার এবার আর্তনাদে বদলে গেল।
-‘নামান, নামান আমাকে। আ..আমি কিন্তু চেঁচাবো। এই ছিল আপনার মনে? এই জন্যেই অন্যদেশ থেকে মেয়ে নিয়ে আসেন যাতে করে কেউ কিছু না জানতে পারে। আর যেমন খুশি তেমন আচরণ করতে পারেন, তাই না? দেখু…’
-‘Shut up lady!! Will you keep quite please?’
জোরেসোরেই ধমক মেরে উঠে ম্যাক্স। নিজের লাল চোখজোড়া আরও লাল হয়ে উঠল। সেই চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি আঁটকে যায় লাবণীর। একটি শব্দও আর উচ্চারণ করতে পারল না সে। কেমন সম্মোহনের মতো লাগল। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে উঠে। নিরবে চোখের কোল ঘেঁষে কয়েকটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
(চলবে)
[