ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ১৬

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১৬

• বৈশাখের খা খা করা হলদেটে রৌদ্র‍্যতাপে জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়ার পথে। মনে হচ্ছে সূর্য তার তীব্র প্রখরতা ছড়িয়ে সকলকে ভষ্ম করে দেয়ার অপেক্ষায়। প্রেগনেন্সির লাস্ট স্টেজে এতবড় পেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় ওর জন্য কষ্টকর সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একেরপর এক রিক্সা খুঁজতে খুঁজতে জান বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কেউ যে এই ভরদুপুর বেলায় মিশনারি রোডের দিকে যেতেই চাইছেনা।
হঠাৎই কানে শিষ বাজার শব্দ আসতেই মিম আচমকা পিছনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে।
অদূরে কয়েকটা বখাটে যুবক সদৃশ লোক ওর দিকে লুলোপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিম দৃষ্টি যথাসম্ভব অবনত রাখলো।
লোকগুলো ওর কাছে আসতেই একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলে উঠলো,
” দেখ পেট না ফুটবল। মনডা চায় উড়ায় দেই।”
অন্যজন বলে উঠলো,
” নারে, চেহারাসুরুততো দেহি মাশাল্লাহ, খালি বেগড়া বাজাইছে পেট..”
লোকগুলো আরো অনেককিছুই বেশ জোড়ে জোড়েই বলতে লাগছিলো, মিম তোয়াক্কা না করে দ্রুতপায়ে হাটা ধরলো। ভারী শরীরে দ্রুতপায়ে হাটতে ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারলে সবদিক থেকেই শান্তি। খুব হলেও স্কুলের মেইন রোড থেকে হেটে গেলে এই দশ কি পনেরমিনিটের পথ।
আস্তে আস্তে সূর্যের তেজ দ্বিগুন থেকে দ্বিগুনতর হতে লাগলো। ডিহাইড্রেট হয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগল মিম। আচমকা কিভাবে যেন গাড়ীর সামনে পড়ে যায়।
ড্রাইভার দ্রুত ব্রেক কষে ব্যালেন্স করে নেয়। গাড়ির ভেতর হাস্যোজ্বল মুখ করে বসে থাকা নিয়াজের মুখটা মুহুর্তেই আমষেটে হয়ে যায়। এই মুহুর্তে চরম বিরক্ত লাগছে, এমনিতেই অফিসের দরকারি ফাইল বাসায় রেখে একটা ঝামেলা বাজিয়েছেই তারউপর কোথা থেকে একটা উটকো ঝামেলা গাড়ীর সামনে পড়েছে। ধুর ভাল্লাগেনা!
নিয়াজের এই মুহুর্তে গাড়ী থেকে নামার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বেশ আয়েশ করে বসেই গান শুনছিল। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় আরকি!

” এই যে ম্যাডাম, আপনি কি চান্দে হাটতাছেন? লিসেন এইটা রাস্তা দেখেশুনে হাটতে হয়।”
নিয়াজ মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে গড়গড় করে কথাগুলো বলে দিলো।
মিমের কাছে গলাটা খুব চেনা লাগছে। ডান হাত
চোখের ঠিক উপড়ে কপালের কাছটায় রেখে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকায়। নিয়াজ ওদের বাড়ীওয়ালা আন্টির ছেলে। মিম বিন্দুমাত্র ও বিস্মিত হলোনা। উনার স্বভাবটাই এমন, কোন এক অদ্ভুত কারণে মিমকে দুচোখে দেখতে পারেনা। এই বাড়ীতে থাকা নিয়েও উনার চরম আপত্তি ছিল। কিন্তু উনার মা আর বাবার মিমকে খুব প্রছন্দ হয়েছিল তাই আর বাধাও দিতে পারেনি।
” ওহ, আপনি? তাইতো বলি মাঝপথে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য আর কেইবা থাকতে পারে। উঠুন, আর প্লিজ এইসব অসুস্থ হওয়ার নাটক টা একটু কমিয়ে করুন প্লিজ ওগুলো আবার আমার পোষায় না। ওগুলো আপনি বরং মায়ের সামনেই দেখিয়েই স্যামপ্যাথি কুড়োবেন কেমন!”
নিয়াজ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জোড়েজোড়েই কথাগুলো বললো। রাস্তার মানুষজন সব হা হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

একটা অসুস্থ মানুষকে কেউ এইভাবে কথা শুনাতে পারে! মিমের খুব কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা ও কি ওদের বাড়ীতে ফ্রি ফ্রি থাকে যে এতগুলা কথা শুনাবে। এইরকম বাজে স্বভাবের লোক ওর জীবনে দুটো দেখেনি। ইতর একটা।

” ওই হ্যালো উঠুন। দেখুন আল্লাহর দোহায় উঠুন আমার ভাই বাসায় যাওয়া খুব দরকার

আমার মা যদি জানতে পারে যে আমি আপনাকে রাস্তায় ফেলে এসেছি তাহলে আমার উপর দিয়া কি ঝড় যাবে বুঝতে পারছেনতো।”

মিম নিঃশ্বব্দে নিলজ্জের মত গাড়িতে উঠে যায়। এই মুহুর্তে ওর প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছে যেভাবেই হোক বাসায় যাওয়াটাই খুব জরুরী।
তাছাড়া একটা পাগল গোছের ইছিম এর সাথে তর্ক করে কি লাভ।
বাসায় ফিরে গায়ের উপর উড়নাটা ফ্লোরে ছুড়ে মেরে হাতমুখ ধুয়ে এসে সোজা বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে মিম। উঁহু না শুয়ে শান্তি পাচ্ছে না বসে। ইদানীং পেটটা প্রচন্ড টানটান লগে মনে হয় এক্ষুনি ছিঁড়ে যাবে।
মিমের চোখটা বোধ হয় খানিকটা লেগে এসেছিল। কিন্তু নীলিমা আন্টির চিৎকারে ও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।
” মিম, নিয়াজ নাকি তোর উপর গাড়ি তুলে দিয়েছিল?”
নীলিমা আন্টির কন্ঠে চরম উৎকন্ঠা। অবশ্য মিম এ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় কারণ নীলিমা আন্টির স্বভাবটাই এমন। ওর প্রতি অকারণ ব্যাকুলতা মিমকে মাঝেমাঝে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
” তোমাকে এসব কে বলেছে?
হাই তুলতে তুলতে মিম কথাটা বললো।
” কে আবার? নিয়াজইতো বলল।”
মিম অবাক হয়ে তাকায়।
” নিয়াজ ভাইয়া তোমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছে?”
” নাহ্ পাগল নাকি।”
মিম ” ওহ।” বলে চুপ করে গেল।

“সরাসরি এই কথাটা বলেনি। তবে বলেছে তুই নাকি ওর গাড়ির উপড়ে পড়েছিস। আমিতো জানি ও ইচ্ছে করে তোর উপর গাড়িটা তুলে দিছে। সত্যি করে বল ও কি তাই করেছে। দেখি মা কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস।”
কথাটা বলেই ওর গায়ে হাত দিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো।
মিমের খুব বিরক্ত লাগছে।
” ইশ্ আন্টি উনি কেন আমার সাথে এরকমটা করতে যাবেন।
আসলে আমার শরীর প্রচন্ড খারাপ লাগছিল তাল সামলাতে না পেরে গাড়ীর সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর নিয়াজ ভাইয়াইতো আমাকে গাড়িতে তুলে বাসায় নিয়াসলো।”

” তোকে আমি পই পই করে বলেছিনা এবার ম্যাটারনিটি লিভটা নিয়ে নেরে মা। না উনার এক কথা আর কয়েকদিন যাক তাহলে বেবির সাথে কয়েকটা দিন বেশী ফুলটাইম কাটানো যাবে। উনার চিন্তা দেখলে মনে হয় জীবনে উনি একাই মা হয়েছেন। লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম কালকেই ছুটির কথা বলবি। আজকে কতবড় বিপদ থেকে বেচে ফিরেছিস কোন হুশ আছে। এইরকম করে চললে আমও যাবে ছালাও যাবে।”
মিম মনে মনে ঠিক করে নেয় আন্টির কথাই রাইট ।।কালকেই ছুটির কথা বলবে। যেকোন মুহুর্তে লেবার পেইন উঠে যেতে পারে। এভাবে বোকামো করলে যেকোন সময় বিপদ ঘটতে পারে।
” কি হলো বেআক্কেলের মত কি ভাবছিস। নে খেয়ে না। কিছুতো খাস নাই। আর কত বাচ্চাকে কষ্ট দিবি।”
নীলিমা আন্টি মিমের দিকে খাবার এগিয়ে দেয়। আন্টি খাবার কখন নিয়াসছে মিম খেয়ালই করেনি। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। প্লেটের উপর পাবদা মাছের ঝোল। রুই মাছের পেটি। উফ্ মিম বিনাবাক্যবেয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগলো। পরম আবেশে নীলিমার চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো। কোন এক অদ্ভুত কারণে এই মেয়ের প্রতি ওর অকারণ ভালোবাসার কোন নাম ও দিতে পারেনা। থাকনা কিছু ভালোবাসা বেনামে তাতে কি এমন ক্ষতি হবে।
নীলিমা নিজের মাঝেই কিছুক্ষণ ডুবে থাকতে চাইছিলো কিন্তু নিয়াজের চিৎকার চেঁচামেচিতে সেটা আর সম্ভব হলোনা।
নীলিমা তড়িঘড়ি করে তিনতলার প্রথম সিড়ি পার হতেই নিয়াজের চোখে চোখ পড়ে যায়। ও এদিকেই আসছিলো..
” তোমার সমস্যা কি? এইভাবে আমাকে খেতে দিয়ে পানি নাই গ্লাস নাই, প্রয়োজনমত তরকারি নাই, প্লেটে ভাত নাই এইভাবে সব অগোছালো করে ফেলে রেখে তিনতলায় কি মা?
ওই মেয়ের সাথে তোমার এত আধিখ্যেতা কিসের? তুমি ওই মেয়েকে খাবার দিতে চলে এলে। আর আমার দিকে কোন খেয়ালই নেই।”
নিয়াজ প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়ে।

নীলিমা ছেলের কথা শুনে পুরা হতবিহ্বল হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠে,
” আস্তে কথা বল, মেয়েটা শুনলে কি ভাববে?
ছিঃ নিয়াজ!”
পরক্ষনেই কি যেন মনে করে পিছনে তাকাতেই নীলিমার সাথে মিমের চোখাচোখি হয়ে যায়।
নিয়াজ মিমকে দেখা সত্বেও ইচ্ছে করে চিল্লিয়ে আবার বলে উঠে,
” যত্তসব ফালতু মেয়ের কথা ভেবে খামোকা টাইম ওয়েস্ট করার কোন মানেই নেই। ওইটা বরং তুমিই করো। নিজের ঠিক নেই তারউপর কার না কার বাচ্চা পেটে নিয়া আলাদা
বাসায় উঠেছে এইগুলা কি তুমি বুঝোনা মা?”

নীলিমার ধৈর্য্যের বাধণ ভেঙ্গে যাচ্ছে কোন রকম ছেলেকে টানতে টানতে দুতলায় আসেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here