ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ১৮

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পর্ব ১৮

মিমকে ওটিতে নেয়া হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। নীলিমা বসে বসে দুআ দরুদ পড়ছেন আবার মাঝেমাঝে ফুঁপিয়ে কেঁদেও উঠছেন। নিয়াজকে ওটির বাইরে এলোমেলো অগুছালো অবস্থায় পায়চারি করতে দেখা যাচ্ছে। হাজার বুঝিয়েও টেনশনটা মাথা থেকে নামাতে পারেনি ও। যে মেয়েটাকে ও বেশ কিছুক্ষণ আগেও সহ্য করতে পারছিলো না ঠিক কিছু সময়ের ব্যাবধানে ওই মেয়ের জন্য অকারণ দরদ উথলে পড়ার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ও খুঁজে পাচ্ছেনা। পুরোটাই কি মানবিক কারণে নাকি অন্য কিছু ওর মাথায় আসেনা। তাছাড়া যুক্তি দিয়ে সবসময় চলতে হবে এর ও কোন মানে নেই।

অবশ্য ডক্টরের বলা কথাগুলোও ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। ওয়াটার ব্রেক হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ পূর্বেই। অক্সিজেন লেস হয়ে বেবির অবস্থা খুব খারাপ। এই অবস্থায় বেবি ও মা দুজনের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ। বেবিটা কোনভাবে না বাচলে ডাক্তারের কিছু করার নাই। ইমিডিয়েট সি সেকশন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ফ্যামিলি ছাড়া একা একটা মেয়ের পক্ষে থাকাটা ঠিক কতোটা কষ্টকর সেটা একমাত্রই মিমই জানে। বাচ্চাটা না থাকলে মিম শেষ হয়ে যাবে। এই বেবিটাইতো ওর একমাত্র অবলম্বন ছিল। ওতো মরে যাবে। আল্লাহ এতোটা নিষ্ঠুর হইও না। মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়। সন্ধ্যেটা ভালোভাবেই ঝাঁকিয়ে বসেছে।নিয়াজ মসজিদে ছুটে যায়।

ওটির দরজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলিমার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছিলোনা।
সহসায় ওটির দরজা খুলে যায়, নীলিমা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। নার্স সহাস্যে বাচ্চাটা নীলিমার কোলে দিতে যায়।
কোথা থেকে হুট করে নিয়াজ এসে পড়ায় নার্স বাচ্চাটা নিয়াজের কোলেই দেয়। নিয়াজ ও ব্যাকুল হয়ে বাচ্চার মুখপানে তাকায়। ধবধবে ফর্সা গোলগাল ভুলাভালা চেহারার সাথে মাথাভর্তি চুল নিয়াজ একদম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।

“শোনোন, বাচ্চাটাকে আপনার কাছেই রাখুন। এত কোল চেঞ্জ করবেন না। আর বাকী সবাই কোলে নিতে চাইলে হাত ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করে তাতপর নিবেন কেমন। নাহলে ইনফেকশন হওয়ার চান্স থাকবে কেমন।”
নার্স এর কথায় নিয়াজের সম্বতি ফিরে পায় নিয়াজ।
” বাচ্চার মা কেমন আছে?”
নীলিমা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো।
” ভয়ের কিছু নেই আপাতত অবজারবেশন এ রাখা আছে। সেন্স ফিরলে কেবিনে শিফট করে দিব। আপনারা দেখে আসতে পারেন।”

নীলিমা আর নিয়াজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
নীলিমা কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে নিয়াজ বাইরে চলে আসে। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার হস্পিটালে ফিরে
আসে নিউ বর্ন বেবির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে করে।
নীলিমা বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন। নিয়াজের হুট করে এতোটা চেঞ্জ মায়ের চোখ এড়ায়নি।
নিয়াজ আবার বাচ্চাটাকে কোলে তুলে একদম বুকের মাঝে নিয়ে নেয়।
” আস্তে বাবা! ব্যাথা পাবেতো ছোট মানুষ। ”
নীলিমা মুচকি হেসে বলে উঠলেন।
” এরকম একটা মুহুর্ত আমারও হওয়ার কথা ছিল! কিন্তু নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর কেন? মা আমার বাচ্চাটাকে আমাকে দিয়েই দিত মেরে কেন ফেললো ও?
আমার অনাগত সন্তানকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ব্যার্থ বাবা! আমার অনাগত সন্তানের কাছে আমি ব্যার্থই হয়ে গেলাম। ও কি আমায় ক্ষমা করবে।”
নিয়াজ প্রচণ্ডভাবে ইমোশনাল হয়ে দুচোখ জুড়ে কান্নার লহর বয়ে যেতে লাগলো।
যখন বাচ্চাকে এবোরেশন করে রিদিতা অন্যকারো হাত ধরে পালিয়ে যায় তখনো নিয়াজকে এতোটা ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি নীলিমা। কখনো মায়ের সামনে নিজের অতীত তুলে নি নিয়াজ। সেই নিয়াজ যে শত আঘাতেও জর্জরিত হয়ে মুখে রা কাটতোনা সেই নিয়াজ আজ এতোদিন পর সন্তানের জন্য শোক করছে। নীলিমার ভেতরটা উথাল পাথাল করে দিতে লাগলো অজানা আশঙ্কা। মা ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
একটু পরেই বাচ্চাটা যখন গগনবিদারী কান্নার রোল তুললেন, নিয়াজ আর নীলিমা মুগ্ধ বিস্ময়ে ঠোট বাকিয়ে বাচ্চাটার কান্নার দৃশ্য দেখতে লাগলেন। নিজেদের শোক তখন মন্দিভুত হতে লাগলো।
সারারাত নিয়াজ বাচ্চাটাকে বুকের মাঝে রেখেই রাত পার করল। নীলিমাও বাধা দেয়নি। ছেলে যদি বাচ্চাটাকে দেখে নিজের শোক ভুলতে পারে তবে ক্ষতি কি?
——————
——————

টেবিল ল্যাম্পের আলো একবার অফ করে আবার অন করতে লাগলো সবুজ। ওর কান্ড দেখে যে কেউ মনে করবে ওর বেশ মজা নিয়ে খেলাটা খেলছে। অন্ধকার পরক্ষণেই আবার আলো। অন্ধকার হলেই অতীতরা সদলবলে ভীড় করতে থাকে ।
বর্তমানের আলোয় ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার শঙ্কিত হতে লাগলো ও। ও কি পারবে মিমকে ভুলতে? হয়তোবা সময় একসময় সব ভুলিয়ে দিবে । কিন্তু কিছু মধুর স্মৃতি সাথে একরাশ তিক্ত অভিঙ্গতা ওর একফালি হৃদয়কে মুহুর্তেই গভীর সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে গেলো।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ হাতড়ে না পাচ্ছে কোন তীরের সন্ধান। নাহ্ ও আর কিছু ভাবতে পাচ্ছেনা। নায়রার কথায় ঠিক। এই মুহুর্তে বাবা-মাকে ওর পাশে খুব করে দরকার। একা একা আর এ ব্যার্থ জীবন বয়ে বেড়াতে পারছেনা।

নায়রাকে প্রচন্ড উৎসুক দেখা যাচ্ছে। শেষমেশ সবুজ যে বিডিতে যেতে রাজী হয়েছে এটাই অনেক। ওরতো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।
এখন মিশন হচ্ছে ওর মা আর ভাইয়াকে আগে রাজী করাতে হবে। সবুজের পূর্বকের বিয়ের কথা শুনলে কি রিএক্ট করবে কে জানে?
তবে নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে রাজী ঠিক করিয়ে ফেলবে।
এরপর সবুজের ফ্যামিলির সাথে মেলামেশা করে ওনাদেরো হাত করে নিবে । কান টানলে এমনিতেই মাথা আসে। এরপর ফুলবাবু তূমি আমার! নায়রার শয়তানি হাসি পুরো ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
রুমে নক করার শব্দ হওয়ায় নায়রা কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেও পরক্ষণে ঠিক ডোর ওপেন করে সবুজকে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে।

” আমি কি ভুত না প্রেত! এইভাবে তাকাচ্ছ কেন?”

” নাহ্ মানে তুমি? এখন এই সময়?”

” কেন কোন অসুবিধেয় ফেললাম। তুমি কি বিজি?”

” আরে নাহ্। তুমি বসো বসো।”
সবুজ কাউচের উপর বসে পড়লো।
” নায়রা তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ করেছি। ”

” কি করেছো?”

“আমি দুটো ফ্লাইটের টিকিট বুক করেছি। তুমিতো আমার সাথে যেতে চেয়েছিলে তাই দুটো টিকিট বুক করেছি।”

নায়রা খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়।
” আচ্ছা ফ্লাইট কবে?
থ্যাংকস সবুজ।”
নায়রা সবুজের হাত ধরতে আসলে ও আস্তে করা হাতটা সরিয়ে দেয়।
” ইট’স ওকে নায়রা। দেখো তুমি আমাকে ফিরে যাওয়ার জন্য বুঝিয়েছিলে শুধু এই কারণেই আমি তোমাকে সাথে নিচ্ছি। এটার আবার অন্যকোন মানে বের করোনা কেমন!”
ফ্লোরের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে সবুজ কথাটা বললো।
নায়রা অপমানিত বোধ করলেও সবুজের সামনে হাসিটা ঝুলিয়েই রাখল।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here