#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৭
#M_Sonali
বিছানার ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ একগুঁয়ে লাগছে চাঁদনীর। কিন্তু ভয়ে বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা সে। এবার সে ঘুরে শুয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ কোথাও আছে কিনা। ওকে পুরো রুমে দেখতে না পেয়ে হাফ ছেড়ে বাচে সে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে একটু উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে এখন দিনের বেলা নাকি রাত। কিন্তু কোন কিছুই বুঝতে পারে না। আন্দাজে ধরে নেয় হয়তো বিকেল হবে। অনেক ক্ষুধা লেগেছে তার। কিন্তু শ্রাবণের কাছে আবার খাবার চাওয়ার মত সাহস নেই তার। তাই চুপচাপ বসে ভাবতে থাকে কিভাবে এখান থেকে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে ও কোনরকম আশার আলো দেখতে পায় না সে। মৃত্যুর ভয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু জল। চাঁদনী দ্রুত সেটা মুছে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা মনে মনে ভাবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবারো জানালার কাছে চলে যায়। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে এখনো বটগাছ গুলোর সাথে অনেকগুলো বাদুড় রুপি ভ্যাম্পায়ার ঝুলে আছে। চাঁদনী মনে মনে বলে এই বাদুড় দের মাঝে একটা হয়তো শ্রাবণ ও হতে পারে। যে কিনা বাদুরের রূপ নিয়ে ওর ওপর নজর রাখছে! কথাটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। জানালার কাছ থেকে সরে এসে আবারও বিছানার উপর বসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শক্ত করে নেয়। মনে মনে চিন্তা করে তার বাবা সবসময় বলত, যে কোন বিপদ আসুক না কেন হাসি মুখে সেই বিপদের মোকাবেলা করতে।
মনোবল হারিয়ে নিজেকে অসহায় ভাবলে সবসময় বিপদে পিসে মরতে হয়। তাই নিজেকে শক্ত রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করতে হয়। কথাগুলো ভেবেই যেন মনের মাঝে এক আশার আলো দেখতে পেল চাঁদনী। কিন্তু কি করা যায় এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে? সেটাও তো ভাবতে হবে তাকে! সে আবারও ভাবতে লাগল তার বাবা তাকে আর কি বলেছিলেন। তখনই তার মনে পড়ে, তার বাবা তাকে বলেছিলো পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যেটা চাইলে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু জয় করা যায়। কথাটা মনে পরতেই যেন মুখে হাসি ফুটে উঠল চাঁদনীর। সে মনে মনে ঠিক করে নিল যেভাবেই হোক শ্রাবণের বুকে নিজের ভালবাসার দীপ জ্বালাবে। সেটা হয়তো সত্যি কারের ভালোবাসা হবে না। কিন্তু মিথ্যে ভালবাসার অভিনয় করেই তার থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
কথাগুলো ভেবে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো চাঁদনী। তারপর ওই রুম থেকে বেরিয়ে বাইরের রুমে আসতে আসতে শ্রাবনকে ডাকতে লাগল,
“শ্রাবণ আপনি কোথায়? আপনাকে কোথাও দেখছি না কেন? প্লিজ সামনে আসুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
কথাটা বলার সাথে সাথে কোথা থেকে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে এসে ওর সামনে হাজির হল শ্রাবণ। প্রথমে চাঁদনী কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও ওর কাছে এগিয়ে এল। ওকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,
“কি হয়েছে, এভাবে ডাকছো কেন আমায়?”
“কি হয়েছে আপনি জানেন না? বারবার আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে যান আপনি? আমার যে বড্ড ক্ষুধা লেগেছে সেটাও কি আপনাকে বলতে হবে? বিয়ে করে যখন এনেছেন তা হলে সবকিছুর দায়িত্ব পূরণ করুন। আমার জন্য তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে আসুন আমার বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”
ওর এমন কথা শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো শ্রাবন। মনে মনে ফিসফিস করে বলল,
“আমরা ভ্যাম্পায়ার হয়েও তো এত খাই না। যতটা এই মানুষগুলো খায়। এরা এক একটা রাক্ষসের চাইতেও বেশি খাদক মনে হচ্ছে।”
“কি হলো দাঁড়িয়ে থেকে কি ভাবছেন একমনে? আমাকে কিছু খাবার এনে দিবেন নাকি আমি সারারাত অভুক্ত থাকবো?”
” তুমি রুমে গিয়ে বসো। আমি তোমার জন্য এখনই খাবার নিয়ে আসছি।”
ওর কথা শুনে চাঁদনী চুপচাপ গিয়ে রুমের মধ্যে বসে পড়ল। সে রুম টাকে ভালভাবে তীক্ষ্ণ নজরে দেখে মনে মনে ভাবল,
“কিছুতো একটা আছে। যেটার উপায়ে আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু সেটা কি? আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে যেভাবেই হোক। সেটাও আমাবস্যার আগে।”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তার চোখ আটকে গেল হাতে বেঁধে রাখা সেই পালকটার দিকে। যেটা তার হাতে শ্রাবণ পড়িয়ে দিয়েছিলো। সে পালকটাকে অন্য হাত দিয়ে ধরে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। পাকলটা ভীষণ অদ্ভুত দেখতে। এটা আসলে কিসের পালক তা কোন ভাবেই বোঝা যাচ্ছে না। একদম ছোট এবং কালো কুচকুচে রঙের পালক টা। কিন্তু ভীষণ চিকচিকে। লাইটের আলোতে যেন চকমক করছে হাতে। যেন সোনাদানা লাগানো আছে তার সাথে। দূর থেকে দেখলে এমনটাই মনে হবে। খুবই সুন্দর এবং সফট সেটা।
চাঁদনী কি মনে করে নিজের হাত থেকে পালক টা খুলে অন্যহাতে ধরল। এপিঠ-ওপিঠ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আনমনেই পালকটা দুই হাতে ধরে দুদিক থেকে টান দিলো। সাথে সাথে সে খেয়াল করল বাইরে বট গাছে ঝুলে থাকা বাদুড়েরদল গুলো উড়ে এসে তার জানালার উপর পড়েছে। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ব্যাপারটা দেখে সে ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেল। পালকটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। তখন’ই তার মনে পড়ল শ্রাবণ তাকে বলেছিল, এটা যতক্ষণ তার সাথে আছে তার কোনো বিপদ হবে না। তবে কি হাত থেকে খুলে সে ভুল করেছে? কথাটা ভেবে তাড়াতাড়ি আবার পালক টা হাতে বেঁধে নিল। সাথে সাথে আবারো বাঁদুড়গুলো ওরে গাছের আগায় গিয়ে বসলো।
তখনই রুমের মাঝে এসে হাজির হলো শ্রাবণ। হাতে তার বিরিয়ানির প্যাকেট। কিন্তু তার মুখটা একদম লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রকম রেগে আছে সে। সে দৌড়ে এসে চাঁদনীর সামনে দাঁড়ালো। হাতের দিকে তাঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“তুমি এটা হাতে থেকে খুলে ছিলে কেন? তোমার কোন ধারনা আছে এটা খোলার পর তোমার সাথে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত? পাগল হয়েছ নাকি? আমি কতবার করে বলেছি এটা কোনোভাবেই হাত থেকে না খুলতে। এটা খুললেই তোমার বিপদ হবে কেন বোঝনা? তোমরা মানুষেরা এতটা বোকা কেন হও?”
চাঁদনী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ওর এমন ভয়ঙ্কর রাগি মুখটা দেখে যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। সে চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে বসে নিচ দিকে মাথা দিয়ে রাখলো। শ্রাবণ বুঝতে পারলো ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে গম্ভীর গলায় বলল,
“দ্বিতীয়বার এই ভুলটা যেন আর কখনো না হয়! এই নাও বিরিয়ানি। খেয়ে নিজের আত্মাকে শান্তি দাও। সাথে আমাকেও।”
কথাটা বলেই রুম থেকে অন্য রুমে চলে গেল সে। চাঁদনীর চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। চোখ থেকে জল টা মুছে নিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল। ছোটবেলা থেকেই ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না সে। আর টেনশন করলে তো আরো বেশি ক্ষুধা লাগে তার। খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আরেক রুমে গেল। দেখল শ্রাবণ চুপচাপ বসে আছে সোফার ওপর। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। চাঁদনী সোজা গিয়ে একদম গা ঘেষে বসলো তার। ওর এমন কান্ডে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল শ্রাবণ। ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চাঁদনী আচমকা ওর গালে একটি চুমু দিল। তারপর লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন? শুধু ধমকান আর বকা দেন। নিজের বউয়ের সাথে কেউ এরকম আচরণ করে? তাও আবার নতুন বউ।”
ওর এমন কথা এবং কাজে শ্রাবণ যেন আকাশ থেকে পড়লো। বলদ এর মত তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝে আসছেনা তার। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চাঁদনী আবারো বললো,
“দেখুন আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আবার বলছি। আমি কিন্তু স্বামীকে নিয়ে বিয়ের আগে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। স্বামীর সাথে প্রেম করবো সারাক্ষণ তার আদর ভালোবাসায় রাঙিয়ে থাকবো। কত চিন্তা করেছি এসব নিয়ে। অথচ আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সবকিছু ভেস্তে যাচ্ছে। আর চলবে না এসব। এখন থেকে আমাকে ভাল না বাসলে আপনার সাথে আর কথা বলব না। আজকেই বাবার বাড়ি চলে যাবো। এই বলে দিলাম। বলুন না আমায় ভালোবাসবেন তো?”
কথাগুলো বলেই শ্রাবণের বুকের ওপর আলতো করে নিজের মাথাটা রাখলে চাঁদনী। রেখে যেনো আরেক দফা চমকে উঠল সে। সব সময় শ্রাবণের শরীর বরফের মত ঠান্ডা থাকে। বুকের উপর মাথা রাখার পর তার কোন হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেনা চাঁদনী। যেন কোন মৃত ব্যক্তির বুকে মাথা রেখেছে সে। তবুও চুপচাপ সেভাবেই হইল। ভয় না পেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। এদিকে শ্রাবণ যেন অবাক এর ওপর অবাক হচ্ছে। সেই সাথে ওর প্রতি প্রচন্ড পরিমাণ মায়া কাজ করছে তার। কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। ভ্যাম্পায়ারদের কোন মন থাকে না। না থাকে কোন ভালোবাসা। তারা কারো উপরে কখনো দুর্বল হয় না। তবে সে কেন এমন হচ্ছে? কেন বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছে একজন সাধারন মানুষের কাছে?
ও চাঁদনী কে নিজের থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু চাঁদনী নাছোড়বান্দার মতো ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা দিয়ে রইল। এবার যেনো শ্রাবন আরো বেশি দুর্বল হতে লাগলো ওর প্রতি। কেন জানি বারবার নিজের ভ্যাম্পায়ার রুপ কে হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে ইচ্ছা করলো তার। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এই মুহূর্তে তার রক্তের নেশা হচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে? কেন এই মেয়েটার প্রতি এত মায়া কাজ করছে তার? এটা তো হওয়ার কথা নয়! কথাগুলো ভেবে তার মাথা ঘুরে উঠলো। সে আবারও ফিরে তাকাল। দেখলো চাঁদনী আগের মতোই তার বুকের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। সে না চাওয়া সত্ত্বেও ডান হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর শান্ত গলায় বললো,
“কে বলেছে আমি তোমায় ভালবাসি না?”
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৮
#M_Sonali
“কে বলেছে আমি তোমায় ভালবাসি না?”
শ্রাবণের এমন কথায় ওর বুক থেকে নিজের মাথাটা তুলে ওর মুখের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে করুন গলায় বললো,
“ভালোই যদি বাসেন, তাহলে মারতে চান কেন আমায়?”
ওর এমন কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেল শ্রাবণ। হকচকিয়ে উঠে ভাঙা গলায় বলে উঠল,
“মারতে চাই মানে! কি বলছো তুমি এসব?”
“ঠিকই তো বলছি। যদি নাই মারতে চান তাহলে এমন ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছেন কেন? আপনি জানেন বিয়ের আগে আমি কত স্বপ্ন দেখতাম। যে বিয়ের পর স্বামীর সাথে ইচ্ছামত ঘুরবো। কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় তিন দিন হতে চলল। অথচ আপনি আমাকে নিয়ে একটুও কোথাও ঘুরতে গেলেন না। আপনি একদম পঁচা। আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”
কথাগুলো বলে অভিমানের ভান করে অন্যদিকে ঘুরে বসল চাঁদনী। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল শ্রাবণ যেন তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে রাজি হয়। যেভাবেই হোক এই বাড়ি থেকে বেরোতে হবে তাকে।
কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও শ্রাবণের কাছ থেকে কোনরকম উত্তর এলো না। এতে বেশ নিরাশ হলো চাঁদনী। সে এবার পিছন দিকে ঘুরে তাকালো। কিন্তু আজব তার পাশে কেউ নেই। তার পাশে কেন পুরো রুমে কেউ নেই। এবার কিছুটা ভয় কাজ করতে লাগল তার মনে। সে কি কিছু ভুল বললো? যদি শ্রাবণ তার কোন ক্ষতি করে বসে? কথাটা ভেবেই একটি শুকনো ঢোক গিললো সে। উঠে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকতে লাগল,
“এই যে শুনছেন, কোথায় গেলেন আপনি? আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
কিন্তু না কোথাও থেকে শ্রাবণের কোন সারা পেলো না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে এ রুম ও রুম খুঁজে নিরাশ হয়ে বেডরুমে গিয়ে বিছানার ওপর বসে পরলো সে। মনে মনে বাবার কথা ভেবে ভীষণ রকম কান্না পেতে লাগল তার। সে মনে মনে বলতে লাগলো,
“বাবা তোমার সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। এ বন্দি জীবন থেকে আমি কখনোই বের হতে পারবো না। এখান থেকে হয়তো আমার রক্তহীন লাসটাই শুধু বের হবে। কোন ভুল করে থাকলে তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা। দাদি তোমাকেও বড্ড মিস করছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওনা তোমরা প্লিজ।”
কথা গুলো মনে মনে বলে চোখের জল ফেলতে লাগল সে। তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো। সে দ্রুত সে দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো শ্রাবণ মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত দুটো পেছনে রাখা। সে উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই শ্রাবণ পিছন থেকে নিজের হাতটা সামনে এনে একটি বক্স ওর হাতে দিয়ে বলল,
“এই নাও এর মধ্যে যেটা আছে সেটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। আর মন খারাপ করে থাকতে হবে না তোমার।”
মুহূর্তেই যেন কান্নাটা হাসিতে পরিণত হতো চাঁদনীর। এখান থেকে বের হতে পারবে যেনে চোখের জল হারিয়ে গিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। সে দ্রুত বক্স টা হাতে নিয়ে সেটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বক্সটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসলো অনেক সুন্দর একদম কালো কুচকুচে রঙের একটি গাউন জামা। তবে জামাটার গলাটা অনেক লম্বা এবং বড়।
চাঁদনী জামাটা নিজের গায়ের সাথে ধরে করুন গলায় বলল,
“জামার গলাটা তো অনেক বড়। এটা আমি পড়বো কিভাবে? গলার জন্য তো অনেক নিচে নেমে আসবে এটা!”
ওর কথা শুনে শ্রাবণ মৃদু হেসে দিয়ে বলল,
“এত চিন্তা করছো কেন? এটা পড়ার পর তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখবে না। তাই এত চিন্তা করার কোনো কারণ নেই বুঝেছ। এখন তাড়াতাড়ি এটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। আর হ্যাঁ তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু এই বক্স টার মধ্যেই আছে। সেগুলো নিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমি অন্য রুমে গিয়ে বসছি।”
কথাটি বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে। চাঁদনী এখান থেকে বের হওয়ার আনন্দে আর কোন কিছু চিন্তা না করে দ্রুত জামাটা পড়ে রেডি হতে লাগলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়াতেই ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। একনজরে ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওকে দেখতে এতটা সুন্দর লাগছে যেন কোন প্রিন্সেস দাঁড়িয়ে আছে। কালো কুচকুচে রঙের জামাটা ওর ফর্সা শরীরে যেন একদম ফুটে উঠেছে। জামার গলা বড় হওয়ার কারণে গলার অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ওর ফর্সা গলাটা দেখে বারবার রক্তের নেশা হতে লাগল শ্রাবনের। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে চাঁদনীর রুপের নেশায় পাগল হলো সে। তারপর একপা দুপা করে ওর কাছে এগিয়ে এলো। আচমকাই নিজের অজান্তে ওর কপালে চুমু দিয়ে বসলো শ্রাবণ। তারপর আবেগি গলায় বললো,
“তোমার মত সুন্দরী নারী আমি এর আগে কখনো দেখিনি চাঁদ পাখি।”
ওর এমন কথা এবং কাজে চাঁদনী যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেল ওর স্বামী একজন ভ্যাম্পায়ার। সেও আবেগি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল,
“আপনার মত এমন সুদর্শন পুরুষও আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমি আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু,,,!”
এতোটুকু বলেই থেমে গেল চাঁদনী। তারপর মাথা নিচু করে ফেলল সে। বুকের মাঝে ব্যথা করতে শুরু করল তার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মনে মনে বার বার ভাবছে, আজ শ্রাবণ যদি একজন সাধারন মানুষ হতো। ওর ভালবাসার স্বামী হতো। তাহলে কতই না সুন্দর হতো ওর জীবনটা। কিন্তু এ যে ওর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য ওর সাথে এতো নাটক করছে। এসব ভেবেই যেন চোখে জল চলে আসলো চাঁদনীর। কিন্তু এই মুহুর্তে সে কাঁদতে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
” কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে দেখতেই থাকবেন। নাকি ঘুরতে নিয়ে যাবেন?”
ওর কথায় ধ্যান ভাঙলো শ্রাবণের। মুচকি হেসে আচমকাই ওকে কোলে তুলে নিল। চাঁদনী অবাক হয়ে বলল,
“এটা কি করছেন? আমাকে কোলে নিলেন কেন আপনি?”
“তুমি না বললে ঘুরতে যাবে! তাই তো কোলে নিলাম তোমায়। এখন এত কথা না বলে চোখটা বন্ধ করো।”
ওর কথার উত্তরে চাঁদনী আরো বড় বড় করে ওর দিকে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“চোখ বন্ধ করবো কেন? কি করবেন আপনি?”
শ্রাবণ কিছু বলল না। মুচকি হেসে ওর চোখের দিকে বড় বড় করে তাকালো। সাথে সাথে ওর চোখ থেকে একটি নীল আলোকরশ্মি বেরিয়ে চাঁদনীর চোখে গিয়ে পরলো। ঘুমে ঢুলে পরলো চাঁদনী। তখনই মুহূর্তের মধ্যে শ্রাবণের পিঠের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে এলো বিশাল লম্বা লম্বা দুটি কালো রঙের ডানা। সেই ডানাগুলোর পালকগুলো যেন একদম চিকচিক করছে। ঠিক যেমন পালক চাঁদনীর হাতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
শ্রাবণ নিজের ডানা ঝাপটিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই চাঁদনী কে নিয়ে উড়াল দিয়ে কোথাও একটা চলে গেল।
,
,
,
গায়ে ঠান্ডা বাতাস এবং নাকে অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ পাওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল চাঁদনীর। চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো সে এখনও শ্রাবনের কোলের মধ্যেই রয়েছে। সাথে সাথে সে আশেপাশে ঘুরে তাকাল। দেখল বিশাল বড় এক পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে আছে তারা। সে ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত শ্রাবণের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলল,
“ওমাগো, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন। এখান থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলবেন নাকি?”
ওর কথা শুনে মুচকি হাসলো শ্রাবণ। কোল থেকে আস্তে করে নিচে নামিয়ে দিল। চাঁদনী চারপাশে তাকিয়ে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল পাহাড়ের চূড়া হলেও জায়গাটা অনেক চওড়া। অসম্ভব সুন্দর জায়গাটা। আকাশের মেঘ গুলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।
চারিপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা রকম ফুলের গাছ। সেই ফুলগুলো সে আগে কখনোই দেখেনি। অসম্ভব সুন্দর ফুলের ঘ্রাণটাও যেন বাতাসের তালে তালে তার নাকে বারি খেয়ে যাচ্ছে। যার সুবাসে ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে তার মন। মুহূর্তেই সে সব কিছু ভুলে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই এক খন্ড মেঘ এসে তার হাত ভিজিয়ে দিল। এতটা সুন্দর জায়গা সে এর আগে কখনো দেখেনি। তার মনে হচ্ছে সে যেন জীবিত অবস্থাতেই স্বর্গে চলে এসেছে।
চাঁদনী এবার ব্যাকুল হয়ে এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। একটি ফুল গাছের কাছে গিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগল। তার ঘ্রাণ নিতে লাগল। বারবার আকাশের মেঘগুলো ছুয়ে দিয়ে হাত ভেজাতে লাগল। তার এমন আনন্দ দেখে চোখ জুড়িয়ে উপভোগ করছিল শ্রাবণ। সেও যেন মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে গিয়েছে। চাঁদনীকে সে কেন নিয়ে এসেছে সে ব্যপারে।
ছোটাছুটি করতে করতে আচমকা পাহাড়ের একদম কিনারায় চলে গেল চাঁদনী। আর বেখেয়ালে পা ফসকে পড়ে গেল পাহাড়ের নীচে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই শ্রাবণের যেন প্রাণ পাখিটা উড়ে যেতে চাইলো। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের ভ্যাম্পায়ার রূপে এসে লাফ দিলো পাহাড় থেকে। আর মুহূর্তের মাঝে চাঁদনীকে গিয়ে ধরে ফেলল। ওকে কোলে নিয়ে উঠে এলো পাহাড়ের চূড়ায়। এই প্রথম ওকে ভ্যাম্পায়ার রুপে দেখছে চাঁদনী। কোল থেকে নামিয়ে দিতেই সে ভয়ে ওর থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে লাগল। শ্রাবণের চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হাতের নখগুলো হয়ে গেছে লম্বা লম্বা। মুখের মধ্যে সরু দুটি দাঁত বেড়িয়ে এসেছে। পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে বিশাল লম্বা দুটি কালো কুচকুচে রঙের ডানা। সেই ডানার সাথে চিকচিক করতে থাকা পালকগুলো বাতাসে উড়ছে।
চাঁদনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
সাথে সাথে শ্রাবণ দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মানুষ রুপে ফিরে এলো। ওকে জড়িয়ে ধরেই চিৎকার করে বলল,
“ভয় পেওনা চাঁদপাখি। আমি তোমার কিচ্ছু হতে দিব না। তুমি এই পাথর মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছ। তোমার শরীরে কোনো আচর পরতে দিব না আমি। তোমাকে বিপদে ফেলার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। রক্ত খেয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন থেকে তোমার সকল বিপদে ঢাল হয়ে দাড়াবো আমি। তুমি আমার প্রাণ পাখি। তোমার কিছু হলে আমি নিজেও মরে যাব। আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি চাঁদনী। কিন্তু আমার এই ভালবাসা’ই যে তোমার সব চাইতে বড় বিপদের কারণ হবে।”
,
,#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৯
#M_Sonali
চাঁদনী কে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে ওকে বিছানার উপর শুইয়ে দিলো শ্রাবণ। পাশে বসে কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। আজকে যেন একটু বেশিই মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে। হয়তো নিজের ভালোবাসা টা পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে বলেই এত বেশি মায়াবী লাগছে তাকে। নয়তো এতদিন হয়তো সেভাবে ওর দিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি তার। তাই ওর এই মায়াময় চেহারাটা নজরে আসেনি। শ্রাবনের যেন ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে। জীবনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ওর জীবনটা ধন্য করে দিতে।
মুহূর্তে নিজের ভ্যাম্পায়ার হওয়ার কথাটা মনে পরতেই মুখটা শুকনো হয়ে যায় শ্রাবনের। মনে মনে ভাবে, চাঁদনী তাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল। সে কি মেনে নিবে ওকে? ওকে কি ভালবাসবে সে? কথাগুলো ভেবে সে মনে মনে ঠিক করে চাঁদনীর স্মৃতিশক্তি ভুলিয়ে দেবে সে। সে যেন কোনোভাবেই মনে করতে না পারে শ্রাবণ একটি ভ্যাম্পায়ার। কথাগুলো ভেবে ওর মাথায় হাত রাখতে গিয়ে ও হাতটা সরিয়ে নিল সে। মনে মনে ভাবলো সে এই কাজটা করলে চাঁদনীর সত্যিকারের ভালবাসা কখনোই পাবে না।
কিন্তু সেতো চায় তার মতো করে চাঁদনীও তাকে একইভাবে ভালোবাসুক। তাই কথাগুলো ভেবে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইল। তখনই ওর কানে কোন একটা কথা ভেসে এলো। সে এদিক ওদিক ফিরে তাকিয়ে দ্রুত উড়াল দিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে কোথাও যেন চলে গেল।
,
,
,
বন-জঙ্গল পিরিয়ে বিশাল এক প্রাসাদের সামনে গিয়ে নামল শ্রাবণ। সে এখন পুরোপুরি ভ্যাম্পায়ারের রূপে আছে। অসম্ভব হিংস্র এবং ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে তাকে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল প্রাসাদের ভেতর দিকে। আশেপাশে থাকা সকল ভ্যাম্পায়ার গুলো তাকে দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সামনে এগিয়ে যেতেই একটি ভ্যাম্পায়ার রূপী বৃদ্ধ লোক বসে থাকা অবস্থাতেই বলে উঠলো,
“ওখানেই দাঁড়াও। আর সামনে এগিয়ে আসবে না।”
উনার কথার উত্তরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরল শ্রাবণ। সন্দেহের দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকালো। লোকটি এবার কিছুটা গর্জে ওঠে বলে উঠলো,
“কি করছো তুমি শ্রাবণ? আমি সৈন্যদের কাছে কি শুনছি এসব?”
উনার কথার উত্তরে শ্রাবন তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন উত্তর দেয় না। লোকটি এবার নিজের জায়গা থেকে উঠে ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“ওই মেয়েটিকে তুমি ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আমার সৈন্যরা দেখেছে তুমি ওর সাথে এমন আচরণ করছো যেন ও সত্যিই তোমার বউ। তুমিও কি তোমার বাবার মতো একই ভুল করতে যাচ্ছ নাকি? তুমি জানো এর ফলাফল কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে? আর তাছাড়া ওই মেয়েটি আমাদের শক্তির উৎস। সেটা কি ভুলে যাচ্ছো তুমি?”
উনার কথার কোনো রকম উত্তর দেয় না শ্রাবণ। রাগে দাঁত কটমট করে কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
“আপনি কি এই কথাগুলো বলার জন্য আমাকে এখানে ডেকেছেন? অন্য কোন দরকার থাকলে বলতে পারেন। আমাকে দ্রুত ফিরতে হবে।”
এবার লোকটি বেশ রেগে যায়। ওর সামনে এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলে,
“তুমি কি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার কে হই? ভুলে যেও না তোমার গুরুজন বলতে একমাত্র আমি আছি। তাই আমার সাথে কথা বলতে অবশ্যই সংযত ভাবে কথা বলবে। তোমাকে আমি এ কথাগুলো বলার জন্যই ডেকেছিলাম। সাবধান করতে দিচ্ছি নিজের বাবার মত ভুল তুমিও করো না। এর জন্য অনেক দাম দিতে হবে তোমায়। ভুলে যেও না তুমি এই ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের হবু রাজা। সব চাইতে শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান ভ্যাম্পায়ার।”
“আমি কোন কিছুই ভুলিনি। আর নিজের যথাযথ দায়িত্ব পালন করবো আমি। কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে।”
কথাটি বলেই লোকটিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে উড়াল দিয়ে চলে গেল শ্রাবণ। ওর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে রাগে দাঁত কটমট করতে লাগল লোকটি। লোকটি আর কেউ নয়, সে হোলো শ্রাবণের দাদা। সে ভাল করেই জানে নিজের নাতির রাগ সম্পর্কে। তারা যত কিছুই করুক না কেন সে যদি একবার কিছু একটা মনস্থির করে নেয়, তাকে সেই জায়গা থেকে সরানো কঠিন। তাই তিনি ভীষণ চিন্তায় আছেন। শ্রাবণ আবার এমন কিছু করে না বসে যার জন্য তাকে অনেক বেশি পস্তাতে হয়। তার বাবার মত।
,
,
ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে চাঁদনী। চারপাশে তাকিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখে আশেপাশে কেউ নেই। সে দ্রুত উঠে বিছানায় বসে। শ্রাবণের ভ্যাম্পায়ার রুপটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভয়ে তার শীরদাড়া বেয়ে শীতল শ্রোত বয়ে যায়। এতদিন সাহস করে ওর সাথে কথা বললেও, আজকে ওর আসল রূপ দেখার পরে সব সাহস যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। আর একবার ওই রুপে ওকে সামনি দেখলে হয়ত হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবে সে। মৃত্যু ভয়ে যেন মনটা একদম ব্যাকুল হয়ে আছে চাঁদনীর। সে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। এখান থেকে পালানোর মত যে কোন রাস্তা নেই। সেটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছে চাঁদনী। তাই বসে বসে কান্না করতে লাগল সে। আর বলতে লাগল,
“বাবা দাদি তোমরা কোথায়? আমাকে বাঁচাও। এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ। ঐ রাক্ষসটা আমায় মেরে ফেলবে। আমি বাঁচতে চাই।”
এতোটুকু বলতেই শ্রাবণ এসে সামনে দাঁড়ায় তার। এবার যেন অন্তরাত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা গুলো তার। সে দ্রুত পিছনে যেতে যেতে খাটের সাথে একদম আটকে গেল। পাশে থাকা বালিশটা হাতে নিয়ে নিজের সামনে ধরে কান্না করতে করতে বলল,
“প্লিজ আমাকে মারবেন না। আমাকে আমার বাবার কাছে যেতে দিন। আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন এখানে আমাকে মেরে ফেলতে নিয়ে এসেছেন। আপনি একটা রাক্ষস। আপনি কোন মানুষ নন। খুব ভয়ংকর আপনি। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। প্লিজ আমাকে আমার বাবার কাছে যেতে দিন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল চাঁদনী। ওর কান্না যেন শ্রাবণের বুকে গিয়ে বিধল। বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো তার। সে এক পা সামনে এগিয়ে আসতেই চাঁদনী আবারও চিৎকার করে বললো,
“প্লিজ আর সামনে এগোবেন না। আপনি আমাকে রক্ত চুষে মেরে ফেলতে চান তাইতো? আমি আপনার সবকিছু বুঝে গেছি। প্লিজ আমাকে মারবেন না। আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। কথা দিচ্ছি আমাকে বাবার কাছে যেতে দিলে আমি আপনার কথা কাউকে বলব না। আমি একদম চুপ করে লক্ষী মেয়ের মত ঘরে বসে থাকব। আমাকে ছেড়ে দিন। আমার বড্ড ভয় করছে এখানে। আমি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাব এখানে থাকলে।”
কথাগুলো বলে আবারও ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠল চাঁদনী। এবার আর শ্রাবণ চুপ থাকতে পারলো না। দ্রুত ওর কাছে এগিয়ে এলো। ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বলতে লাগল,
“এভাবে ভয় পাচ্ছ কেন তুমি আমায় দেখে? আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি চাঁদপাখি। তুমি কেন বুঝতে পারছনা তোমার কোন ক্ষতি করলে এতদিন এখানে এত যত্নে রাখতাম না।”
“না আপনি মিথ্যা বলছেন আমি জানি। আপনি সবকিছু বানিয়ে বলছেন। আপনি আমায় ভালবাসেন না। কোনো রাক্ষস ভ্যাম্পায়ার কখনো কোনো মানুষকে ভালবাসতে পারে না। বরং আমাবস্যা রাতে আপনি আমাকে খুন করবেন বলে এত যত্নে রেখেছেন। আমি ছোটবেলা অনেক ভূত-প্রেতের এবং ভ্যাম্পায়ারের গল্প পড়েছি। আমি জানি তারা এমনটাই করে। আপনি আমাকে অমাবস্যার রাতে মেরে ফেলবেন তাই না? প্লিজ আমাকে মারবেন না। আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। দেখুন আমার মত এমন সাদাসিধে মেয়েকে মেরে আপনি কি লাভ পাবেন? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।”
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ আর কিছু বলল না। সে বুঝতে পারছে চাঁদনী ওকে দেখে অসম্ভব ভয় পাচ্ছে। এখন ওকে কোনো কিছু বুঝিয়ে লাভ হবেনা। তাই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল সে। এবার উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমি রাতেই তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। কথা দিচ্ছি তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তবে একটা কথা মনে রেখো আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি চাঁদপাখি। কখনো যদি আমার জন্য তোমার মনে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। তখন আমাকে স্মরণ করো। আমি তোমার কাছে পৌঁছে যাব। আর হ্যা তোমার হাতে থাকা ওই পালকটা কখনোই হারিও না। বা নিজের থেকে দূরে সরাইও না। ওটা তোমায় রক্ষা করবে সব বিপদ থেকে।”
কথাগুলো বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে অন্য রুমে চলে গেল। চাঁদনী ওর কথায় যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলো। কিন্তু বুকের মধ্যে কার ভয়টা যেন এখনও কাটেনি। সে জড়োসড়ো হয়ে বালিশ নিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল বাড়িতে যাওয়ার জন্য। প্রায় আধঘণ্টা পর শ্রাবণ ফিরে এলো ওর রুমে। অন্য দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমার আগের কাপড় গুলো পড়ে রেডি হয়ে নাও। তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসব।”
কথাটি বলতে দেরি চাঁদনী বিছানা থেকে উঠতে দেরি হয়নি। সে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে ফেলল। তারপর তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে হোচট খেয়ে পরে যেতে নিলো। তখনই শ্রাবণ মুহুর্তের মাঝে দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেললো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,