ভয়ংকর সে পর্ব -১০+১১+১২+১৩

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১০
#M_Sonali

চাঁদনী রেডি হয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,

“চলুন আমি রেডি। আমাকে তাড়াতাড়ি আমার বাবার কাছে নিয়ে চলুন। আমি আর এখানে থাকতে চাই না।”

শ্রাবণ করুন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললো,

“এখন যাওয়া যাবে না। আর আধঘন্টা ঘন্টা পর নিয়ে যাব। এতক্ষণ আমার জন্য একটি কাজ করতে পারবে?”

ওর এমন কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেল চাঁদনী। মনে মনে ভাবল এই বুঝি তাকে মেরে ফেলবে শ্রাবণ। এতক্ষণ হয়তো মিথ্যে শান্তনা দিয়েছে তাকে। সে ভয়ে ভয়ে বলল,

“ক কি কাজ?”

“তেমন কিছু নয়। এই আধঘন্টা আমার সামনে বসে থেকে গল্প করবে। ঠিক আগের মত।”

ওর কথার উত্তরে চাঁদনী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ওর এসব কথায় যেমন ভয় পাচ্ছে তেমন খারাপও লাগছে। কিন্তু তবুও মনে সাহস নিয়ে বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি গল্প করবো।”

ওর থেকে সম্মতি পেতেই শ্রাবণ খপ করে ওর হাত ধরে বসলো। তারপর ওকে নিয়ে বাইরের রুমের সোফার উপর গিয়ে বসল। চাঁদনী কিছুটা ভয় পেলেও মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলো ওর সাথে। সোফার উপর বসে টেবিলের ওপর থেকে একটি আপেল নিয়ে ওর হাতে দিয়ে বলল,

“এটা খেয়ে নাও চাঁদপাখি। অনেকক্ষণ হলো কিছু খাওনি তুমি। আর আমার সাথে গল্প করো তোমার যা মন চায়।”

সে আপেলটা হাতে নিলো। কিন্তু খাবার সাহস পাচ্ছে না। তাই হাতে নিয়েই চুপচাপ বসে রইলো। ওকে আপেল হাতে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শ্রাবণ টেবিলের ওপর থেকে একটি ছুড়ি হাতে নিল। ওর হাতে ছুড়ি দেখতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল চাঁদনী চিৎকার দিয়ে কয়েকপা পিছিয়ে গেল সে। ও মনে মনে ভাবলো ওকে হয়তো খুন করার জন্য ছুড়িটা হাতে নিয়েছে সে। তার মনের কথা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে শ্রাবণ বলল,

“ভয় পেয়ো না এটা আমি এই আপেলটা কাটার জন্য নিয়েছিলাম। কাউকে মারতে হলে আমার ছুড়ির দরকার হয়না। আচ্ছা নাও তুমি নিজেই কেটে খাও।”

এবার কিছুটা সাহস ফিরে ফেলো চাঁদনী। গুটিগুটি পায়ে ওর পাশে এসে বসে হাত থেকে ছু-ড়িটা ছো মেরে কেড়ে নিল। ওর কান্ড দেখে মৃদু হাসলো শ্রাবণ। তারপর বলতে শুরু করলো,

“জানো চাঁদপাখি, তোমাকে এখানে তুলে নিয়ে আসার একটাই কারণ ছিল আমার কাছে। আর সেটা হল আমাবস্যার রাতে তোমাকে হত্যা করে তোমার রক্ত পান করে নিজের শক্তি চিরস্থায়ী করা। কিন্তু কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করিনি যে আমি কোন এক মানব কন্যার প্রেমে পড়ে যাব। আর সে হবে তুমি। যাকে আমি মেরে ফেলার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। অথচ দেখো তোমায় ভালোবেসে এতটাই ডুবে গেছি যে, এখন তোমাকে হত্যা করা তো দূর তোমার কথা কেউ মুখে আনলেও তাকে চিরতরে শেষ করে দিব। বিশ্বাস করো চাঁদ পাখি তোমাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। ভ্যাম্পায়ারদের কোন মন হয় না। তাদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় না। তাদের মাঝে কোন মায়া মমতা থাকেনা। অথচ জানিনা কিভাবে তুমি সেগুলো আমার মাঝে সৃষ্টি করেছ। আমি না চাইতেও তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গেছি। সবকিছু ভুলে শুধু তোমাকে চাই আমার। আর কিছু নয়। কিন্তু তুমি যেহেতু আমাকে ভয় পাচ্ছো। আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাইছো। আমি তোমায় মানা করবো না। কিন্তু,,,,!”

এতোটুকু বলতেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠল চাঁদনী। সাথে সাথে রক্তের তীব্র গন্ধ পৌঁছে গেল শ্রাবনের নাকে। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করলো। মুখের ফাঁক দিয়ে দুটো দাঁত বেরিয়ে এল। ভয়ঙ্কর চেহারার ভ্যাম্পায়ার রুপে ফিরে এলো সে। আপেল কাটতে গিয়ে বেখেয়ালে নিজের হাত কেটে ফেলেছে চাঁদনী। সেখান থেকেই গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। সেটার গন্ধেই হঠাৎ করে শ্রাবণের এত অধঃপতন। চাঁদনী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কান্না করতে করতে বলল,

“প্লিজ আমাকে মারবেন না। আমাকে যেতে দিন।আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আমাকে যেতে দিন। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে মারবেন না প্লিজ।”

ওকে ভয় পেতে দেখে শ্রাবণ শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“ভয় পেওনা চাঁদ পাখি। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। আসলে রক্তের গন্ধটা এত কাছ থেকে নাকে এসে লাগায় আমার আসল রূপটা সামনে চলে এসেছে। নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার গায়ে একটি আচরও পড়বে না। তোমার এক ফোঁটা রক্তের দাম আমার কাছে আমার জীবনের চাইতেও বেশি। ওই ঘরের ড্রয়ারে ওষুধের বক্স আছে। সেটা নিয়ে নিজের হাতটা ব্যান্ডেজ করে নাও। আমি এখানেই আছি।”

ওর কথা শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না চাঁদনী। দ্রুত হাতটা চেপে ধরে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল। ড্রয়ার থেকে ওষুধের বক্স বের করে নিজের হাতের কাটাস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে নিল। কিছুক্ষণ পরেই ওর রুমে ঢুকলো শ্রাবণ। এবার স্বাভাবিক রুপে ফিরে এসেছে সে। ওকে স্বাভাবিক রুপে দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো চাঁদনী।

শ্রাবণ জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

“চলো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।”

কথাটি বলে ওর দিকে ফিরে তাকাল। তার পর মুহূর্তেই ভ্যাম্পায়ারের রূপ নিয়ে নিলো। পিছন থেকে দুটি পাখা বেরিয়ে এল তার। চাঁদনী কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। ওকে ভয় পেতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

“ভয় পেয়ো না আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতেই এই রুপ নিয়েছি। এদিকে আসো।”

কিন্তু চাঁদনী সাহস পেলো না। শেষে বাধ্য হয়েই সেকেন্ডের মধ্যে ওর কাছে চলে এলো। ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিজের ডানা দিয়ে ঢেকে নিলো। তারপরে চাঁদনীর মনে হতে লাগল সে যেন হাওয়ার বেগে কোথাও একটা ছুটে চলেছে। ভালো করে বোঝার জন্য ওর বুক থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো তারা যেন হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।

প্রায় ১৫ মিনিট এভাবে ওর বুকের মাঝে থেকে উড়ে আসার পর একটি শুনশান জায়গায় এসে ওকে নিয়ে নামলো শ্রাবণ। সেখানে নামতেই চাঁদনী চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকার কারণে জায়গাটা ঠিক কোথায় কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। ওকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলল,

“এটা সেই জায়গা। যেখানে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। তুমি এখন ঠিক সেখানেই আছো যেখান থেকে অজ্ঞান অবস্থায় কোলে তুলে নিয়েছিলাম আমি তোমায়। এখান থেকে কিছুটা হেঁটে গেলেই তোমার বাড়ি।”

কথাগুলো বলেই সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে তার চোখ থেকে একটি আলোকরশ্মি বেরিয়ে সামনের পথ টুকু একদম আলোকিত হয়ে গেল। চাঁদনী চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল ও ঠিক কথাই বলছে। সে এখন তার বাড়ির কাছের জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শ্রাবণের চোখ থেকে আলোকরশ্মি বেরোতে দেখে বেশ ভয় পায় সে। তাই দ্রুত বাড়ির দিকে দৌড়ে যেতে লাগল। তখন’ই শ্রাবণ আবার উড়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। তার হাতটা ধরে করুন গলায় বলল,

“চলে যাচ্ছ যাও চাঁদ পাখি। আমি তোমাকে আটকাবো না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখো তোমার হাতের এই পালকটা এক মিনিটের জন্য নিজের থেকে দুরে সরাবে না। বিশেষ করে অমাবস্যার আগে তো কখনোই না। কারণ এর আগে এটা সরালে তোমার জীবনে একটি অন্ধকার নেমে আসবে। তুমি কোনভাবেই নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বাঁচাতে পারবে না। কথাটা মনে রেখো।”

চাঁদনী মুখে কিছু বলল না। ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর আবার ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। তখন’ই পিছন থেকে করুন কন্ঠে বলে উঠল,

“আমি তোমাকে ভালোবাসি চাঁদ পাখি। সত্যিই অনেক বেশি ভালবাসি। কখনো যদি আমার কথা একটিবারের জন্য মনে হয়। যদি মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবাসো। তাহলে ফিরে এসো। আমি তোমার অপেক্ষা করব। একটিবার আমাকে স্মরণ করে দেখো। আমি যেখানেই থাকি ছুটে চলে আসবো তোমার কাছে। তোমাকে নিজের করতে। নিজের করে নিয়ে যেতে নিজের রাজ্যে।”

কথাটি বলেই পিছন থেকে উড়ে গেল শ্রাবণ। চাঁদনী পিছন ঘুরে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকাল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উৎফুল্ল মনে ছুটলো নিজের বাড়ির দিকে। আজ যেন নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে তার।

মাঝরাতের সময় দরজায় ঠাস ঠাস করে শব্দ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো রতন মিয়া ও তার মায়ের। দুজনেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে একে অপরের দিকে তাকালো। রতন মিয়ার মা ভয়ার্ত গলায় বললো,

“কি রে রতন এত রাতে কে এসেছে বলতো? আমার তো ভীষণ ভয় লাগছে। এমনিতেই এখানে মৃত্যুর মিছিল চলছে। কোন খারাপ কিছু আসেনি তো? তুই কিন্তু একদম দরজা খুলবি না বলে দিলুম।”

উনার কথার উত্তরে রতন মিয়া দরজার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

“কিন্তু কেউতো বিপদে পড়েও আসতে পারে মা। এভাবে দরজা না খুলে দাঁড়িয়ে থাকা কি ঠিক হবে? আর তাছাড়া আমাদের কাছে তো জামাই বাবাজির দেওয়া এটা আছেই। তাই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তুমি দাঁড়াও আমি দেখছি।”

কিন্তু না রতনের মা দৌড়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বলল,

“নারে বাবা না, খবরদার দরজা খুলিস না। এত রাতে আবার কে আসবে শুনি। তুই বরং আগে জিজ্ঞেস কর কে এসেছে। যদি সত্যিই কোনো মানুষ হয়ে থাকে। তাহলে না হয় দরজা খুলিস।”

উনার কথায় রতন মিয়া এবার চিৎকার করে বলতে লাগল,

“কে, কে আছে বাইরে? এত রাতে কে দরজা ধাক্কাচ্ছে?”

তখনই বাইরে থেকে চাঁদনীর কন্ঠ ভেসে এলো। সে বলে উঠলো,

“বাবা দরজা খুলো। আমি তোমার মেয়ে চাঁদনী।”

ওর কণ্ঠস্বর শুনতেই যেন কেঁপে উঠলেন রতন মিয়া। তিনি দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। সাথে সাথে চাঁদনী রুমের মধ্যে ঢুকে বাবা এবং দাদিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে দুজনেই বেশ ঘাবড়ে গেলেন। রতন মিয়া আগে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

“তুই এত রাতে কোথা থেকে আসলি মা? আর জামাই কোথায়। তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল। জামাইয়ের কিছু হয়নি তো?”

বাবার কথায় ভীষণ অবাক হলো চাঁদনী। কারণ সে ভেবেছিল তাকে এখান থেকে যেভাবে নিয়ে গিয়েছে শ্রাবণ। তারপর থেকে তো আর এখানে কোন খবর দেশনি। তাই সে অনুযায়ী নিশ্চয়ই তার বাবা এবং তার দাদি তাকে নিয়ে অনেক টেনশনে আছে। হয়তো তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। কিন্তু বাবার কথায় তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। সে চোখের জল মুছে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তার বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এভাবে বলছ কেন বাবা? তোমার জামাই কি আমায় নিয়ে যাওয়ার পর এখানে এসেছিল?”

রতন মিয়া স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,

“আসবে না কেন, তোকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন সন্ধ্যায়’ই তো এখানে এসে ছিল। আর আসার সময় অনেক মিষ্টি এবং ফলমূলও নিয়ে এসেছিল। কিন্তু জানিস কোনভাবেই এখানে কিছু খেলো না ছেলেটা। ছেলেটা বড্ড ভালো। ওকে যখন তোর কথা জিজ্ঞেস করলাম বললো তুই অনেক ভালো আছিস। তুই নাকি ঘুমিয়েছিলি তাই নিয়ে আসেনি সাথে। আর চলে যাওয়ার আগে আমাদের এই দেখ এই পালকের মতো দেখতে জিনিসগুলো দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে এগুলো যতক্ষণ আমাদের কাছে থাকবে ততক্ষন আমাদের কোনো বিপদ হবে না। জানিস মা সত্যি করে এটা যখন থেকে পড়েছি। তখন থেকে এখানে আর কোনো বিপদ হচ্ছে না। আমরা অনেক শান্তিতে আছি। কিন্তু তুই এত রাতে একা কোথা থেকে এলি জামাই বা কোথায়?”

বাবার কথার উত্তরে শ্রাবণের ভ্যাম্পায়ার হওয়ার কথাটা বলতে গিয়েও আটকে গেল চাঁদনী। আর কিছু বলল না সে। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

“আসলে তোমাদের কথা অনেক বেশি মনে পড়ছিল বাবা। তাই এই মাঝরাতে জিৎ করেই চলে এসেছি। উনি আমাকে দরজার কাছে রেখে চলে গিয়েছেন। একটি জরুরী কাজ ছিল তো তাই।”
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১১
#M_Sonali

নিজের রুমে একা একা শুয়ে আছে চাঁদনী। কিন্তু কিছুতেই ঘুম ধরছেনা তার। সে এক নজরে তাকিয়ে আছে উপরে থাকা ফ্যানটার দিকে। সেটা কি সুন্দর ভন ভন করে ঘুরছে। আর ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে তাকে। কিন্তু তার মনটা এখন সেদিকে নেই। সে এখন অন্য সব ভাবনায় ব্যস্ত। কেন জানেনা শ্রাবণকে ছেড়ে আসার পর খারাপ লাগছে তার। বারবার ঘুরেফিরে শুধু ওর কথাই মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে আবারো ওর কাছে চলে যেতে। কিন্তু কে চায় নিজ ইচ্ছায় মৃত্যুর মুখে পা রাখতে। সে তো অনেক কষ্টে তার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। সে আর কখনোই সেখানে ফিরে যাবে না। কথাগুলো ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চাঁদনী। তারপরে ঘুমের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ঘুমটা যেন আজ কিছুতেই ধরা দিবে না তার চোখে।

চাঁদনী একবার এদিক একবার ওদিক এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তাই উঠে বসে পড়লো সে। বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল। বাইরে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন মধ্যরাত তাই বাইরে একদম নিরব নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার দূর-দূরান্ত থেকে ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। চাঁদনী অদূরে তাকিয়ে রইল এক পলকে। বারবার মন চাইলো শ্রাবণকে ডেকে নিয়ে এসে তার সাথে গল্প করতে। যদিও সে কখনোই এটা চায়না। এই কয়েকদিনের কথা ভুলে যেতে চায় মন থেকে। একটা ভ্যাম্পায়ার কে কখনোই নিজের জীবনের সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারে না সে। যে কিনা মানুষের রক্ত খেয়ে মানুষকে হত্যা করে বেঁচে থাকে।

কথাগুলো ভেবেই আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চাঁদনী। নিজের হাতে থাকা সেই পালকটি উঁচু করে মুখের সামনে ধরে তার ওপর আলতো করে আনমনে হাত বুলায়। বিড়বিড় করে বলে,

“ইস আপনি যদি কোনো সাধারণ মানুষ হতেন শ্রাবণ। যদি এমন রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার না হতেন। তাহলে আমাদের জীবনটা কতই না সুন্দর হতো। কতই না ভালোবাসায় ভরে থাকতো আমাদের জীবন। কিন্তু আপনি তো একজন মানুষের রক্ত খেকো ভ্যাম্পায়ার। আমি আপনাকে কিভাবে নিজের স্বামী বলে মেনে নিব? কখনোই সম্ভব নয়। আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন এটাই ভালো আমাদের জন্য।”

কথাগুলো বলে জানালা টা লাগিয়ে দিয়ে আবারো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল চাঁদনী। ওদিকে অন্ধকারে অদূরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে ছিল শ্রাবণ। ও যতগুলো কথা বলেছে ওই পালকটার কাছে সব কথা শুনতে পেয়েছে সে। কথাগুলো শুনে যেন বুকের মধ্যে হালকা ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। সে বুঝতে পেরেছে চাঁদনী তাকে কখনোই মেনে নেবে না। কখনো ভালবাসায় জড়িয়ে নিবানা ওকে। হয়তো এভাবে সারা জীবন দূরে থেকেই দেখতে হবে ওকে। আর জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে নির্মম ভালবাসার আগুনে। কথাগুলো ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।

তখনই সে পিছনে কারো উপস্থিতি টের পায়। পিছন দিকে ঘুরতেই দেখে দুজন ভ্যাম্পায়ার দাঁড়িয়ে আছে। যারা ওকে দেখতেই মাথা নিচু করে বলে ওঠে,

“ভ্যাম্পায়ার কিং আপনাকে শরণ করেছেন প্রিন্স।”

ওদের কথার উত্তরে শ্রাবণ ঝাঁঝালো গলায় বলল,

“তোরা এখানে কেন এসেছিস? দাদু আমাকে স্মরণ করে থাকলে আমি চলে যেতাম। তবে তোদের এখানে আসতে বলিনি। তোদের যেনো আশেপাশের এই এলাকায় কোথাও না দেখি। এলাকার কারো কোন ক্ষতি করতে চাইলে তোদের ব্যবস্থা আমি করব।”

কথাটি বলে মুহূর্তের মধ্যে ভ্যাম্পায়ারের রূপ নিয়ে উড়ে গেল শ্রাবণ। ওর পিছু পিছু ঐ ভ্যাম্পায়ার দুজনও উড়ে যেতে লাগলো।

উড়তে উড়তে জঙ্গলের মধ্যকার সেই কালো প্রাসাদটির সামনে এসে নামল শ্রাবণ। তারপর দ্রুত এগিয়ে গেল প্রাসাদের ভিতরে। ভিতরে যেতেই তার দাদু তাকে দেখতে পেয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“তুমি এসব কি করছ শ্রাবণ? তোমার কাছ থেকে আমি কখনোই এটা আশা করিনি। ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের ভবিষ্যৎ কিং হয়ে তুমি এমন টা কিভাবে করতে পারলে?”

শ্রাবণের বুঝতে বাকি রইল না তার দাদু তাকে কি বলতে চাইছে। সে শান্তকণ্ঠে কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,

“আমি যেটা করেছি ঠিক করেছি। আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক অন্তত আপনি তো জানেন আমার মনের খবর। হ্যাঁ আমি ওই মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছি। হয়তো তাকে বিয়ে করার কারণেই তার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে আমার। এখন তাকে মেরে ফেলা তো দূর তার গায়ে একটি ফুলের আচরও লাগতে দিব না আমি। আপনি ভালভাবেই অবগত আছেন আমার জেদ সম্পর্কে।”

ওর কথার উত্তরে বেশ রাগান্বিত হলেন ওর দাদু। রাগী গলায় চিৎকার করে বললেন,

“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? বুঝতে পারছ এসব কি আবোল তাবোল বলছ তুমি? ভুলে গেছো নিজের বাবার পরিণতির কথা। ভুলে গেছো মানুষের সাথে একটি ভ্যাম্পায়ারের বিয়ে কখনোই সম্ভব নয়। এতে ওই মানুষটার সাথে সাথে ভ্যাম্পায়ারের জীবনটাও সংকটে পড়ে যায়। সেটা কি মনে করে দিতে হবে তোমাকে? তুমি কেন নিজের জীবন নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ। কেন বুঝতে পারছ না আমার বংশের প্রদীপ তুমি একাই। তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই যে ভবিষ্যতে এই রাজ্যের দায়িত্ব নেবে। তোমার কিছু হলে রাজ্য কে সামলাবে বল।”

“সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না দাদু। আমি নিজের দায়িত্ব বোধ ভালো করেই পালন করতে জানি। আমাকে কি করতে হবে সেটা আমার জানা আছে। আপনার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ ওই মেয়েটা বা ওর পরিবারের কারো কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। ওর পরিবারের কারো কিছু হলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।”

ওর এমন কথায় দাদুর মুখে বেশ চিন্তার ছাপ পড়ে গেল। সে চিন্তিত কন্ঠ বলে উঠল,

“কিন্তু তুমি কেন বুঝতে পারছ না, ওই মেয়েটির রক্ত যদি তুমি অমাবস্যার রাতে পান না করো তাহলে তুমি তোমার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। আর সেইসাথে হারিয়ে ফেলবে সকল ভ্যাম্পায়ার দের কন্ট্রোল করার শক্তিটুকুও। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। সব ভ্যাম্পায়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানুষের পৃথিবীতে চলে যাবে। আর সব মানুষের রক্ত চুষে মেরে ফেলবে। পৃথিবীতে কোন মানুষ থাকবে না। ধিরে ধিরে রক্ত চুষে সবাইকে শেষ করে ফেলবে ওরা। সেটা কতটা ভয়ানক হতে পারে তুমি জানো না।”

“আপনি চিন্তা করবেন না দাদু। আমার শক্তির কিচ্ছু হবে না। আমার শক্তি আমি ঠিক অর্জন করে ছাড়বো। সেজন্য আমি আলাদা প্ল্যান আগেই করে রেখেছি। তাই আপনি আর চিন্তা করে নিজের মাথা ঘামাবেন না। আমি এখন আসছি। আমাকে যেতে হবে। এখানে ভালো লাগেনা আমার।”

কথাটি বলে আর দাদুর কথার অপেক্ষা না করে দ্রুত সেখান থেকে ছুটে চলে গেল শ্রাবন। ওকে চলে যেতে দেখে দাদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে বললেন,

“তুমি যে ঠিক নিজের বাবার মত হয়েছো সেটা তোমার আচরণে বোঝা যায় শ্রাবণ। কিন্তু এটাই যে তোমার ধ্বংসের কারণ হবে। তুমি সেটা কেন বুঝতে পারছ না। নিজের বাবার মত নিজেও ভুল পথে পা বাড়াচ্ছো। নিজের সাথে সাথে ওই মেয়েটাকেও বিপদে ফেলে দিচ্ছো তুমি।”
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১২
#M_Sonali

সাত দিন পর,
সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। চারিদিকে আলো নিভে অন্ধকার নেমে আসছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। চাঁদনী জানালা খুলে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে বসে আছ চুপচাপ। চোখটা তার অদূর জঙ্গলে সিমাবদ্ধ। কেন জানে না ইদানিং কিচ্ছু ভালো লাগে না তার। সারাক্ষণ শ্রাবনের কথা মনে পড়ে মনটা আনচান করে। বারবার ইচ্ছে করে তার কাছে ছুটে যেতে। সে ভ্যাম্পায়ার হলেও তাকে মেনে নিতে। তাকে ভালোবাসতে। সে হয়তো তাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে তার থেকে দূরে সরে এসেছে। কিন্তু দূরে সরে এসে যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। না পারছে তার কাছে ফিরে যেতে, আর না পারছে তাকে ছাড়া একা থাকতে।

এদিকে ওর বাবা এবং দাদিও প্রতিদিন বারবার শ্রাবনের কথা জিজ্ঞেস করে করে মাথা খেয়ে ফেলছে তার। যদিও এখন অব্দি ওর সত্যিকার এর পরিচয় এর ব্যাপারে কিছুই বলেনি সে। চাঁদনী নিজের মনে গোপন করে রেখেছে। এ কয়েক দিনে ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে শ্রাবণ তার কোন ক্ষতি করবে না। সে হয়তো সত্যিই তাকে ভালবাসে। সে ভাম্পায়ার হলেও অনেক ভালো একজন ভ্যাম্পায়ার।

কথাগুলো ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চাঁদনী। মনে মনে ভাবে সে যদি শ্রাবনকে ডাকে তবে কি সে আসবে? কথাটা ভেবেই আবার মনকে সতর্ক করে সে। আগামীকাল ভরা আমাবস্যা। চাঁদনী চায় আমাবস্যা পার হলেই শ্রাবনের সাথে দেখা করতে। কে বলতে পারে আমাবস্যার আগে দেখা করলে যদি আবার সে তার ভ্যাম্পায়ার রূপ নিয়ে চাঁদনী কে মেরে ফেলে!

হঠাৎ দরজায় টোকা পরার শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে চাঁদনীর। সে গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করে,

“কে”

বাইরে থেকে মৃদু গলায় আওয়াজ আসে,

“কিরে চাঁদনী বুড়ি এ অসময় দরজা লাগিয়ে ঘরের মধ্যে একা একা বসে কি করছিস শুনি। দরজাটা খোল। তোর সাথে আমার কথা আছে।”

দাদির কন্ঠ শুনতেই আর দেরি করেনা চাঁদনী। দ্রুত উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। ওর দাদি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“এই হলো তোদের মত মেয়েদের নিয়ে একটি জ্বালা। নিশ্চয়ই বরের সাথে রাগারাগি করে এসেছিস। না মানলেও আমি সেটা একশ পার্সেন্ট বুঝতে পেরেছি। তাই তো সারাক্ষণ এত একা একা অন্যমনস্ক থাকিস। আর জামাইটাও একদিনে একটি বারের জন্যও এলো না।”

দাদির কথায় বেশ রাগ হয় চাঁদনির। নিজেকে সংযত রেখে গম্ভির গলায় বলে,

“দাদি যেটা জানো না সেটা নিয়ে আবোল তাবোল কথা বলবে না তো। আমি ওনার সাথে কোন রাগারাগি করে আসেনি।”

“তাই যদি হবে তাহলে সারাক্ষণ এমন অন্যমনষ্ক হয়ে বসে থাকিস কেন? আর জামাই কেন আসেনা? সেই কবে এসেছিস, এখন পর্যন্ত একটিবার তো খোঁজ নেওয়ার জন্য আসলোনা সে। আশেপাশের মানুষ কত খারাপ ভাবে দেখছে তা কি বুঝতে পারছিস?”

“দেখো দাদী আমি আশেপাশের মানুষের খাইওনা পরিও না। তাই তাদের কথা শোনার সময় নেই আমার। তুমি অন্তত এভাবে বলে আমাকে কষ্ট দিও না।”

ওর কথার উত্তরে দাদি এবার মুচকি হাসলেন। ওকে হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানার উপর বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“শুনরে চাঁদনীবুড়ি আমি তোর উপর কোন উল্টাপাল্টা কথা বলছি না। বরং তোকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, মেয়েদের বিয়ের পর তার স্বামী হয় তার সবকিছু। সেই কবে এসেছিস তুই। এখন পর্যন্ত জামাই একবারও তোর খোঁজ খবর নিল না। তাই একটু চিন্তা হচ্ছে আমাদের। তা ছাড়া কিছুই না। জানিস তো স্বামীর স্ত্রীর সংসারে সবচাইতে বেশি দরকার হয় ভালবাসা ও বিশ্বাসের। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যদি বিশ্বাস না থাকে তাহলে তাদের ভালোবাসা টেকে না। তাই ভয় হয় তোদের মাঝে আবার এমন কিছু হয়নি তো। যার কারণে ঝগড়া একেবারে চলে এসেছিস!”

চাঁদনী এবার কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“তেমন কিছুই হয়নি দাদি। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না। এখন যাও তো আমি একটু ঘুমাবো। কিছু ভালো লাগছেনা। খাবার সময় হলে ডেকো।”

ওর কথার উত্তরে দাদি আর কিছু বলেন না। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যান। চাঁদনী গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানার উপর এসে বসে। মনে মনে চিন্তা করে, তার শ্রাবণের সাথে কথা বলা উচিত। সত্যি যদি শ্রাবণ তাকে ভালোবাসে তাহলে অবশ্যই সব সত্যি কথা খুলে বলবে তাকে। কেন সে অমাবস্যার রাতে রক্ত খাওয়ার জন্য তাকে নিয়ে গিয়েছিল।

কথাগুলো মনে মনে ভেবে সে ঠিক করে নেয় আজ রাতেই যে ভাবেই হোক শ্রাবণকে ডেকে তার সাথে কথা বলবে সে।
,
,
,
রাত ১২:৫৫ মিনিট,
চুপি চুপি দরজা খুলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে চাঁদনী। অন্ধকারে বেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে আসে বাসা থেকে। তারপর হাতে থাকা পালকটা স্পর্শ করে শ্রাবনকে স্মরণ করতে থাকে। মুহূর্তে যেন ঝড়ের বেগে কোথা থেকে ছুটে এসে তার সামনে দাঁড়ায় কেউ। অন্ধকারেও তার চোখ দুটো একদম লাল লাইট এর মতো জ্বলজ্বল করছে। তাকে এভাবে সামনে দেখে বেশ কিছুটা ভরকে যায় চাঁদনী। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“আপনি এসেছেন? এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন ভাবতেও পারিনি।”

সামনে থাকা ব্যাক্তি কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বেশ কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে ব্যক্তিটা,

“তোমার হাতের এই পালক টা খুলে দূরে ফেলে দাও চাঁদনী।”

ওর এমন কথায় কিছুটা আশ্চর্য হয় চাঁদনী। যে সারাক্ষণ এটা নিজের কাছে রাখতে বলেছিলো। সেই লোকটাই এখন তার হাতের পালকটা খুলে ফেলতে বলছে? তার গলাটাও কেমন কর্কশ লাগছে। এভাবে তো কখনও শ্রাবণ তার সাথে কথা বলেনি। কথাটা ভেবে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় চাঁদনী। তখনই লোকটা আবারো বলে ওঠে,

“কি হলো আমার কথা বুঝতে পারোনি? তোমার হাতের এই পালক টা খুলে ফেলে দাও। তারপরে তোমাকে আমি সবকিছু বলব।”

চাঁদনী কি করবে ভেবে পায়না। সে নিজের হাতে থাকা পালকটায় হাত বুলাতে থাকে। তখনই পালকটা কেমন জ্বলজ্বল করে ওঠে।

সাথে সাথে ওর সামনে থাকা ভ্যাম্পায়ার রুপি লোকটা কয়েক পা পিছিয়ে যায়। জোরে জোরে হাফাতে হাফাতে রাগি গলায় বলে,

“তোকে বললাম না ওটা খুলে দূরে ফেলে দিতে।”

ওর এমন কর্কশ কন্ঠে তুই তুই করে বলা কথাটা শুনে চাঁদনী এবার বুঝতে পারে যে, এটা শ্রাবণ নয়। অন্য কেউ। সে বুঝতে পারে এই পালকটার জন্যই ভ্যাম্পায়ারটা তার কোন ক্ষতি করতে পারছে না। সে এবার ভয়ে শুকনো ঢোক গেলে। পালকটাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে। কোনোভাবেই সে নিজেই কাছ থেকে ছাড়বে না। সে যেনো নিজ ইচ্ছায় বিপদে পড়ার জন্য এখানে এসেছে। কিন্তু শ্রাবণ কেন আসছে না এখনো? সে তো কখন থেকে শ্রাবনকে স্মরণ করছে। তবে কি সে মিথ্যে বলেছিল? সে কি আর আসবে না তার কাছে? রাগ করে দূরে সরে গেছে।

চাঁদনী কে পালকটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্যাম্পায়ার টা যেন আরো বেশি রেগে যায়। সে গর্জন করে বলে ওঠে,

“কিরে কথা শুনতে পাচ্ছিস না? ওটা খুলে দূরে ফেলে দে। নইলে এখানেই শেষ করে ফেলব তোকে। পুরো গ্রাম কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ফেলব। প্রতিটা মানুষের রক্ত চুষে মেরে ফেলবো। সবার ভালো চাস তো ওইটা খুলে ফেলে দে।”

ওর এমন গর্জনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় সে। কয়েক পা পিছিয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে যায় তার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে বাসা থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। আশেপাশে কোন জনমানবের চিহ্ন টুকুও নেই। কোথাও কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। একদম অন্ধকার। আজ কোন লাইট নিয়েও আসেনি সাথে করে। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। ভ্যাম্পায়ারের কথামত নিজের হাতে থাকা পালককা দূরে ফেলে দিবে! নাকি সেটা আঁকড়ে ধরে থাকবে এটা নিয়ে দোটানায় মধ্যে আছে সে।

ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবার ভ্যাম্পায়ারটা ওর কাছে দুপা এগিয়ে আসে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“জানিস না আমি কতটা ভয়ংকর। আমার কথা শুনবে না তো? তাহলে দেখ তোর গ্রামটা কে আমি কিভাবে শেষ করি।”

কথাটি বলেই চোখ দিয়ে আগুন বের করতে নিলো সে। সাথে সাথে চাঁদনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনি গ্রামের কারো কোন ক্ষতি করবেন না। আমি এটা খুলে ফেলছি। কারো কোন ক্ষতি করবেন না প্লিজ।”

ওর কথায় থেমে গেল ভ্যাম্পায়ারটা। তার মুখে ক্রু হাসি ফুটে উঠল। চাঁদনী কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাতে থাকা পালকটা খুলে ফেললো। তারপর সেটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল দূরে ফেলে দিবে কি দিবেনা। ওকে চুপ করে ওটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে থেকে ভ্যাম্পায়ারটা বলে উঠলো,

“কিরে ওঠার চেহারা দেখতে বলিনি, দূরে ছুঁড়ে ফেলে দে ওটা।”

চাঁদনী ভয় পেয়ে পালকটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১৩
#M_Sonali

চাঁদনী ভয়ে হাত থেকে পালকটা দূরে ফেলে দিল।

ওটা দূরে ফেলতেই সামনে থাকা ভ্যাম্পায়ার লোকটার চোখ যেন চিকচিক করে উঠল। সে ছুটে এলো চাঁদনীর দিকে। চাঁদনী ভয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে সেখানেই বসে পড়ল। কিন্তু মুহূর্তের ওর মনে হলো ওর সামনে দিয়ে খুব দ্রুতগতিতে কিছু একটা ছুটে চলে গেল। সাথে সাথে চোখ খুলে সামনে তাকালো সে। দেখল তার আশেপাশে বা সামনে কেউ নেই। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালো। পাশে পড়ে থাকা পালকটির দিকে তাকিয়ে দেখল সেটাও নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

সে এবার নিজের প্রাণ বাঁচাতে সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দৌড়াতে শুরু করলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও অন্ধকারে কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই জানেনা সে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তারওপর হাতে কোন টচ লাইট নাই। কোন দিকে আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। অন্ধকারে ভয়ে কোন দিকে দৌড়াচ্ছে তার অজানা।

বেশ কিছুক্ষন দৌড়ানোর পর কিছু একটার সাথে হোচট খেয়ে নিচে মুখ থুবরে পড়ে যেতে নিল চাঁদনি। সাথে সাথে অনুভব করল সে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আছে। মুহূর্তে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কারণ সে বুঝতে পেরেছে এটা কার বাহুডোর। সে দেরি না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো লোকটাকে। আনন্দে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। লোকটি কিছুই বলল না। আচমকাই ওকে কোলে তুলে নিয়ে উড়াল দিল।

প্রায় ১০ মিনিট উড়ে আসার পর চাঁদনীকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো লোকটি। সে এবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। দেখল সে আগের পাহাড়ের চূড়ার সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে শ্রাবণ তাকে এর আগেও নিয়ে এসেছিল। নিজের চোখ মুছে নিয়ে সামনের দিকে ফিরে তাকাল সে। দেখল শ্রাবণের চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। ভীষণ রাগী এবং ভয়ানক দেখতে লাগছে তাকে। কিন্তু কেন জানে না এই মুহূর্তে ওকে দেখে মোটেও ভয় হচ্ছে না চাঁদনীর। ওর কাছে দু পা এগিয়ে গেল সে। অভিমানী কন্ঠে বলল,

“এত দেরি করলেন কেন আপনি? আর ওই লোকটা কে ছিলো? আমাকে মারতে’ই বা চাইছিল কেন? আপনি কোথা থেকে উড়ে এসে বাঁচালেন আমায়? আপনি জানেন আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। উনি যদি আমাকে মেরে ফেলতো তখন কি হতো? আপনি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন না?”

একনাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে থামল চাঁদনী। কিন্তু শ্রাবণ তার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিল না। তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ার একদম কিনারে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। পিছন থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড পরিমানে রেগে আছে সে। নিজেকে শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে। চাঁদনী একটি শুকনা ঢোক গিললো। মনে মনে উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে লাগলো। “সে কি ভুল করে ফেলল এভাবে শ্রাবনকে খুঁজতে গিয়ে? নইলে ওর সাথে কথা বলছে না কেন? এটা সত্যিই শ্রাবণ তো?”

কথাগুলো ভেবে যেন মাথা ঘুরতে শুরু করলো তার। তখনই শ্রাবন নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করে ওর দিকে ঘুরে তাকালো। কর্কশ গলায় বলল,

“এই মেয়ে তোমার মাথায় কি বুদ্ধি বলতে কিছু নেই? নাকি তোমরা মানুষেরা এমন বোকা’ই হও?”

ওর এমন কথায় মুহূর্তে রাগ উঠে গেল চাঁদনীর। সে কোথায় ভেবেছিল ওকে দেখে শ্রাবণ ওকে জড়িয়ে ধরবে। কত রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলবে। নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবে। তা নয় প্রথমেই এভাবে ধমকের সুরে কথা বলছে! চাঁদনী ওর কাছে এগিয়ে এলো। কোমরে হাত দিয়ে রাগী গলায় বললো,

“কেনো কি এমন করেছি আমি? যে আপনার আমাকে বোকা বলে মনে হচ্ছে। আর আমরা মানুষেরা বোকা হই। তো আপনারা ভ্যাম্পায়ারেরা কি হন শুনি?”

ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ ভ্রু কুচকালো। ওর আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে ওর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“তো বোকা নয় তো কি? তোমাকে কে বলেছিল বাসা থেকে বেরিয়ে আবারো সেই জঙ্গলের মধ্যে এসে আমাকে ডাকতে? ঠিক সময়মতো আমি না আসলে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যেতো তোমার কোন ধারনা আছে? ওই ভ্যাম্পায়ারটা তো তোমাকে আজকে মেরেই ফেলত। তুমি জানোনা তোমার চারিপাশে বিপদে আছে। এত কেন বোকা তুমি?”

“দেখুন আপনি শুধু শুধু আমাকে বকছেন। আমি কিন্তু মোটেও বোকা নই। আর তাছাড়া আমি তো ওখানে সেধে সেধে যাইনী। আপনি’ই তো আমাকে বলেছিলেন আপনার কথা মনে পড়লে আপনাকে স্মরণ করলে চলে আসবেন। তো আমি যদি নিজের ঘরের মধ্যে দরজা জানলা লাগিয়ে রেখে আপনাকে ডাকে আপনি বুঝি সেখানে চলে আসতেন? কখনোই আসতেন না। তাইতো বাধ্য হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আপনাকে ডেকেছি। আমি কি জানতাম না কি যে আপনি না এসে ওই বজ্জাত বাঁদরমুখো ভ্যাম্পায়ারটা চলে আসবে! কিন্তু আপনি এত দেরি করে আসলেন কেন বলেন তো? আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন নাকি এতদিন শুধু শুধু আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।”

ওর কথার উত্তরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শ্রাবণ। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,

“তুমি শুধু বোকাই নও তার চাইতে বেশি বাঁচাল। বড্ড বেশি কথা বল তুমি।”

কথাটি বলেই সেখান থেকে একটু সরে যেতে চাইলো শ্রাবণ। সাথে সাথে ওর হাত ধরে ফেলল চাঁদনী। রাগী গলায় বলল,

“ওই কি বললেন আপনি? আমি বাচাল? আমিতো আপনার সাথে সেভাবে কথাই বলিনি। এখনি বিরক্ত হয়ে গেলেন! এই আপনার ভালবাসা? আমাকে নিয়ে বাসায় রেখে আসুন লাগবেনা আপনার বউ হয়ে থাকা। আমি এমনি ভালো আছি। ভুল হয়েছে আপনাকে ডেকে।”

কথাগুলো বলেই গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালো চাঁদনী। ওর কথা এবং কাণ্ডে বেশ হাসি পেল শ্রাবণের। সে এবার পিছন থেকে চাঁদনীর কোমর জড়িয়ে ধরল। আচমকা ওর ঠাণ্ডা গায়ের স্পর্শে কেঁপে উঠলো চাঁদনী। কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেল সে। শ্রাবণ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“ভালোবাসি বলেই তো তোমার ডাকে সব কিছু ফেলে এতদূর ছুটে এসেছি। কিন্তু তুমি কি জানো তোমার সামনে ওই ভ্যাম্পায়ার টা কে দেখে কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কত বড় ক্ষতি করতে পারত তোমার সে। তার কোন ধারনা আছে? আমি একটি জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই এতবার আমাকে ডাকা সত্ত্বেও আসতে দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার তো বোঝা উচিত ছিল, যে তোমার চারিপাশে বিপদ। এ মুহূর্তে একা একা জঙ্গলে আসা মোটেও উচিত হয়নি তোমার।”

ওর এমন কথায় এবার কিছুটা নরম হলো চাঁদনী। সেও মৃদু গলায় বলল,

“হ্যাঁ আপনি হয়তো ঠিকই বলছেন। আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু এ কথাগুলো প্রথমে বললে কি হত? শুধু শুধু এতগুলো বকা দেওয়ার কি দরকার ছিল। এমনিতেই আমি বড্ড ভয় পেয়েছি। তার ওপর আপনি বকা দিয়ে আরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছিলেন।”

ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ এবার ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ঘোরালো। দুগালে হাত রেখে কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বললো,

“আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোন ভয় নেই চাঁদপাখি। কিন্তু তবুও সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করে চলবে। তুমি যার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছো তার কারণে তোমার সারাজীবন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আমাকে ভালোবাসার পরিণাম যে তোমার জন্য অনেক ভয়াবহ চাঁদপাখি। তবে কথা দিচ্ছি আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোনরকম ক্ষতি হতে দিব না। সব সময় নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখব তোমাকে।”

ওর কথায় মৃদু হাসল চাঁদনী। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

“সে বিশ্বাস আমার আছে বলেই তো এই মাঝরাতে আপনি ভ্যাম্পায়ার সেটা জানা সত্ত্বেও নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এতদূর ছুটে এসে ছিলাম। আমিও যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি শ্রাবণ। সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই। আপনার বউ হয়ে। আপনি ভ্যাম্পায়ার তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি। কারণ আপনি আমার #ভয়ংকর_সে।”

ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ আর কিছু বলল না। ওকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। চাঁদনীও তাকে জড়িয়ে ধরল। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। একটু পর শ্রাবন ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে পাশে একটি উঁচু পাথরের উপর গিয়ে বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

“জানো চাঁদ পাখি, এই কয়েকদিন তুমি আমাকে না ডাকলেও আমি সারাক্ষণ তোমার উপর নজর রেখেছি। প্রতিটা রাতে তুমি যখন জানালা খুলে বসে থাকতে। আমি দূর থেকে তোমাকে নয়ন ভরে দেখেছি। আর সব সময় অপেক্ষা করেছি কখন তুমি আমাকে ডাকবে। নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবে। কিন্তু তুমি এমন একটি সময় আমাকে ডাকলে যখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে ছিলাম।”

কথাগুলো বলেই আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে তাকালো শ্রাবণ। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল,

“কিন্তু আজকে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন শ্রাবণ? যে আসতে এত দেরী হলো! আপনার তো এত সময় লাগে না কোথাও যেতে!”

শ্রাবণ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মনে মনে কিছু একটা ভেবে গম্ভির গলায় বলল,

“সেটা তোমাকে পরে বলব। এখন কার এই সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে চাই না। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা বলছি তোমায়। আগামীকাল ঘোর অমাবস্যা। এই রাতে ভুল করেও তুমি বা তোমার পরিবারের কেউ বাসা থেকে বের হবে না। দ্বিতীয়ত তোমাদের দরজায় যদি কেউ রাতের বেলা কড়া নাড়ে। তোমাদের আত্মীয় বা পরিচিত কেউ। তবুও দরজা খুলবে না। ভুলেও যদি দরজা খোলো তাহলে তোমাদের বিপদ কেউ আটকাতে পারবে না।”

“কিন্তু আপনি এমন কেন বলছেন শ্রাবণ? আপনি তো বলেছেন আপনি আমাকে কিছু করবেন না। তাহলে আর কোন বিপদ আছে আমাদের?”

“আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না বলেই তোমাদের চারিপাশে বিপদ লুকিয়ে আছে চাঁদ পাখি। যদি আমি তোমার রক্ত চুষে তোমাকে মেরে ফেলতাম, তাহলে তোমার পরিবারের কোনো বিপদ হত না। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণেই তোমার চারিপাশে বিপদের ছড়াছড়ি লেগে গেছে। তাই ভুল করেও আগামীকাল সন্ধ্যার পর থেকে আর দরজা জানালা কিছু খুলবেনা। শত প্রয়োজন হলেও ঘরের মধ্যেই থাকবে। আর হ্যাঁ তোমাদের তিনজনের হাতে যে পালকগুলো দেওয়া আছে। সেগুলো নিজের থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে সরাবে না। তাহলে বিপদ হবে। তোমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কারণ অমাবস্যার রাতে বিপদে পরলে আমিও তোমাদের সাহায্য করতে আসতে পারবো না।”

ওর কথার উত্তরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো চাঁদনী। তারপর কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। দুজনের মাঝে এখন নিরাবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। দুজনের দৃষ্টি আকাশের দিকে সীমাবদ্ধ। বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবন বলে উঠলো,

“একটু পরেই সূর্য উঠব চাঁদ পাখি। আর দেরি করা চলবে না। চলো তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। আর আমি যে কথাগুলো বললাম সেগুলো কিন্তু ভুলে যেও না।”

ওর কথার উত্তরে করুন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল চাঁদনী। তারপর আবেগী গলায় বলল,

“আবার আমাদের কবে দেখা হবে শ্রাবণ? আপনি কি আর আমাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন না?”

শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,

“যদি বেঁচে থাকি তাহলে খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে চাঁদ পাখি। আর যদি না থাকি তাহলে তোমার সকল বিপদ শেষ করে দিয়েই মরে যাবো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো। আমি তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। যে ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করে শেষ করতে পারবো না। প্লিজ আর কোন প্রশ্ন করোনা। এখন চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। সূর্য উঠলে আমি আর থাকতে পারব না।”

ওর কথা শুনে চাঁদনীর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। চুপচাপ উঠে এসে শ্রাবণের পাশে দাঁড়ালো। শ্রাবণ এবার ওর দিকে ঘুরে শক্ত করে ওকে বুকে জড়িয়ে নিল। মুহুর্তেই তার পিছন দিয়ে লম্বা দুটি ডানা বেরিয়ে এলো। ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলল বাড়ির উদ্দেশ্যে। দশ পনেরো মিনিটের মাঝে পৌঁছে গেল তার বাড়ির সামনে। আস্তে করে নিচে নামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলো তাকে। কপালে চুমু দিয়ে বললো,

“সাবধানে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। আর কোনো ভুল করো না চাঁদপাখি। তোমার মাঝে যে আমার জানটাই লুকিয়ে আছে।”

ওর কথার উত্তরে চাঁদনী কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। বোঝাই যাচ্ছে তার মনটা ভীষণ খারাপ। শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর নিজের ডানা থেকে টান মেরে একটি পালক ছিঁড়ে নিল। সেটা চাঁদনীর হাতে দিয়ে বলল,

“এটা নিজের হাতে শক্ত করে বেঁধে নিও। আমি জানি তোমার হাতের পালকটা তুমি হারিয়ে ফেলেছ। তাই এটা বেধে নিও। এটা কোনোভাবেই নিজের থেকে দূরে সরাবে না। আর আমার প্রতিটা কথা মনে রেখো। দয়া করে আর কোনো ভুল করো না চাঁদপাখি। আমি এবার আসি সূর্য উঠার সময় হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটি বলেই ডানা ঝাপটে উড়ে গেল শ্রাবণ। চাঁদনী সেখানে কিছুক্ষণ পালক টা হাতে নিয়ে ওর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। বুক চিরে বেরিয়ে এল একটি দীর্ঘশ্বাস। কেন যেন বারবার মনে হতে লাগল শ্রাবনকে সে আর কখনো ফিরে পাবে না। এটাই হয়তো তাদের শেষ দেখা ছিলো।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here