মধুবালা পর্ব -০৪

#মধুবালা [০৪]
#ফারজানা_আক্তার

ছোঁয়ার পুরো গায়ে তেলাপোকা আর টিকটিকি দৌড়াদৌড়ি করতেছে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ছোঁয়াও পুরো রুমে ছুটাছুটি করছে। এদিকে ছোঁয়া এখনো খেয়াল করেনি চুলের অবস্থা। গায়ে তেলাপোকা আর টিকটিকির বাসা বেঁধেছে দেখে অন্যকিছুর প্রতি হুঁশ নেই। সবাই এসে দরজায় চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ছোঁয়া দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয়। এতো রাতে ছোঁয়ার এহেন অবস্থা দেখে সবাই ভরকে যায়। তাদের ঘরে এসব নেই তবে ছোঁয়ার গায়ে এতো তেলাপোকা আর টিকটিকি আসলো কোথায় থেকে। সবাই ব্যাস্ত হয়ে ছোঁয়ার শরীর থেকে সব পরিষ্কার করে দেয়। ছোঁয়া ভয়ের চো’টে ছুটাছুটি করতে করতে একটা কিছুও গা থেকে পরিষ্কার করেনি। বাড়ির সব ছোট সদস্য রা তো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করে ফেলছে আর তা দেখে ছোঁয়া রাগে ফুঁসছে।
সবাই আছে সবার ধ্যানে কিন্তু ছোঁয়ার সেজু চাচার মেয়ে সানিয়া আছে তার চিন্তায়। সে এক দৃষ্টিতে ছোঁয়ার চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ছোঁয়ার নজর যায় সানিয়ার দিকে আর বলে “কিরে সানু কি দেখছিস এভাবে। লিলি আপুদের সাথে তুইও মজা নে, হাসাহাসি কর কিছু মনে করবোনা আমি।”
ঠোঁট উল্টিয়ে ন্যাকা কান্না করে কথাগুলো বলে ছোঁয়া।
সানিয়া কোনোরকম নিজেকে সামলিয়ে কিছুটা মুখ টিপে হেঁসে বলে “ছোঁয়াপু তোমার স্বাদের চুলের এই অবস্থা কিভাবে?”
এবার ছোঁয়া পেঁছন থেকে সামনে এনে চুলে দৃষ্টি রেখে জোরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। অনেকগুলো সেন্টার ফ্রুটস লাগানো চুলে। চুল কা’টা ছাড়া উপায় নেই। ছোঁয়ার খুব ব্যাথা হচ্ছে বুকের ভেতর। অদ্ভুত রকম কষ্ট হচ্ছে। এবার আর ন্যাকা কান্না নয়। সত্যি সত্যি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে ছোঁয়া। সেলিনা পারভীন অনেক চেষ্টা করেও চুল থেকে সেন্টার ফ্রুটস ছাড়াতে পারছেনা। ছোঁয়ার কোমর সমান চুল ওর খুব স্বাদের। অনেক কষ্ট করে এই চুল লম্বা করেছে ছোঁয়া। চুলের যত্নে কোনো কমতি রাখেনি কখনো।
জায়েদা বেগম অনেক তেল একসাথে ঢেলে দিয়েছে চুলে তবুও কোনো কাজ হচ্ছে না। মান্নান মির্জা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি হয়তো বুঝতে পেরেছে এটা কার কাজ।
ছোঁয়ার সেজু চাচা জাফর মির্জা হঠাৎ বলে উঠেন “ছোঁয়া শুভ্র তোর রুমে কীভাবে প্রবেশ করেছে?”

উনার কথায় সবাই বড় বড় চোখ করে উনার দিকে তাকায়। ছোঁয়া আমতা আমতা করে। মান্নান মির্জাও একই প্রশ্ন করলে ছোঁয়া কাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করে “বেলকনি দিয়ে। কিন্তু আমি বেলকনির দরজায় ছিটকিনি দিয়েছিলাম, জানিনা ভাইয়া কিভাবে খুলেছে।”

কোনো উপায় না পেয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো ছোঁয়ার চুলা কাঁ’টা’র। ছোঁয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো আরো।
********
আজ ছোঁয়া স্কার্প পরেছে। ছোঁয়া ওর বাবার থেকে টাকা নিয়েছে। সে কিছুতেই আর শুভ্রর সাথে ওর গাড়িতে যাবেনা। শুভ্রর আব্বু বেলাল মির্জা রাতেই ওর জন্য আরেকটা গাড়ি কিনে এনেছেন। ছোঁয়ার রাগে গা জ্ব’লে যাচ্ছে। শুভ্র আর লিলি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলো ছোঁয়ার। শুভ্রর মুখে আজ বিশ্ব জয়ের হাসি। হঠাৎ শুভ্র খেয়াল করলো ছোঁয়া ওর গাড়ি পাশ কাটিয়ে বাড়ির গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো। এবার শুভ্রর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে রাগে পরিবর্তন হলো। লিলিকে রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই লিলিও ফুসফুস করে বলে দিলো “তুমি যা করেছো মোটেও ভালো করোনি ভাইয়া। মেয়েটা ওর চুলকে অনেক ভালোবাসে। খুব যত্ন করে ও ওর চুলগুলোকে কিন্তু তোমার জন্য আজ ওকে ওর স্বাদের চুলগুলো কা’ট’তে হয়েছে। বেচারির চুল কোমর থেকে পিটে উঠে এসেছে।”
এসব কথায় শুভ্র মোটেও মাথা ঘামালো না। ও তো ইচ্ছে করেই করছে এমনটা। শুভ্র চেয়েছে ছোঁয়া যেনো মানুষকে লম্বা সিল্কি চুল দেখিয়ে মুগ্ধ করতে না পারে তাই এমন ব্যবস্থা। শুভ্র দাঁত কিড়মিড় করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটের বাহিরে এসে দেখে ছোঁয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। শুভ্রও তেঁ’জ দেখিয়ে ছোঁয়ার সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। ছোঁয়া ছলছল নয়নে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ক্লাস শুরু হবে ঠিক এমন সময় দৌড়ে ক্লাসরুমে ঢুকে ছোঁয়া। লিলি ছোঁয়াকে হাঁপাতে দেখে পানির বোতল এগিয়ে দেয় ওর দিকে। ছোঁয়া ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নেয়।
********
এভাবে কে’টে গেলো কয়েকদিন। ছোঁয়া মান্নান মির্জাকে বলে ওর একটা নিজের গাড়ি লাগবে। মান্নান মির্জা মেয়ের আবদার পূরণ করবে বলে আস্তা দেয় মেয়েকে। কিন্তু ভয় পাই এটা শুনলে যে বেলাল মির্জা খুব রাগারাগি করবে। চিন্তায় পরে গেলেন মান্নান মির্জা। সেলিনা পারভীন রাগে গজগজ করতে করতে বলেন “আমার দুটো মেয়ে। একটা এখনো ক্লাস টেনে পরে। আর আমার বড় মেয়ে ছোঁয়া। আমার মেয়েদের শখ আহ্লাদ আমাদেরকেই পূরণ করতে হবে। আপনি যদি আপনার বড় ভাইয়ের ভয়ে আমার মেয়ের ইচ্ছে টা পূরণ না করেন তবে আমি চলে যাবো যেদিকে চোখ যায় আমার মেয়ে দুটোকে নিয়ে। আপনার বড় ভাই গতকালও তার ছেলের জন্য গাড়ি কিনেছেন, কই আমরা তো তখন কেউ কিছু বলিনি তবে আমরা কিনলে কেনো উনি অমত করবেন? আপনিও তো পারিবারিক বিজনেসে বড় ভাইয়ের মতো যুক্ত আছেন তবে আপনার ইনকামে আপনার মেয়ের জন্য আপনি কিছু করলে সেখানে আপনার ভাই বাঁধা দেওয়ার কে? অনেক সহ্য করেছি, আর না। আমার মেয়েটাকে সবকিছুতেই ছোট করে রাখেন আপনি। আজকে আমার মেয়েটার অনেক কষ্ট হয়েছে কলেজে যেতে। এভাবে যাওয়া আসার অভ্যাস আছে নাকি ওর? আজ কলেজ থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে আমার মেয়েটা। তখন যেনো পাঁজর ভা’ঙা কষ্টে বুকটা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছিলো আমার।”

মান্নান মির্জা চুপ হয়ে স্ত্রীর অভিযোগ মাখা সব কথা শুনলেন। চিন্তা করলো আগামীকালই ছোঁয়াকে সাথে নিয়ে গিয়ে ওর জন্য একটা গাড়ি নিবে ওরই পছন্দে। মেয়েটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে।
*******
আজ ছোঁয়া নতুন গাড়ি নিয়ে কলেজে এসেছে। গাঢ় নীল রংয়ের একটা কার কিনে দিয়েছেন ওকে মান্নান মির্জা। খুশিতে যেনো পা মাটিতে রাখতে পারছেনা ছোঁয়া। গাতকালই কিনেছে এই গাড়ি। শুভ্রর খুব বেশি রাগ হচ্ছে। রাগের মাথায় শুভ্র ছোঁয়াকে কিছু বলার জন্য এগিয়ে গেলে লিলি বাঁধা দেয় ওকে। লিলিও শুভ্রকে বলে দেয় আজ থেকে ও ছোঁয়ার সাথে যাওয়া আশা করবে ওর গাড়িতে। এবার শুভ্রর রাগের পরিমান দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কলেজে না আসলে যে শুভ্র তার প্রেয়সীর মুখটা কাজে যাওয়ার সময় দর্শন করে যেতে পারবেনা। ছোঁয়া আজ শুভ্রকে দেখেও পাত্তা দিলোনা। শুভ্রর সামনেই একটা ছেলে ফ্রেন্ডের হাত ধরে ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। শুভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
*******
এরপর কেটে গেলো কয়েকটা দিন। শুভ্র অফিসের জন্য বের হয়ে গেলে ছোঁয়া বের হয় রুম থেকে কলেজ যাওয়ার জন্য। এর আগে সে দরজা বন্ধ করে ঘরে চুপটি হয়ে বসে থাকে যাতে শুভ্রর সাথে ওর দেখা না হয়। মির্জা বাড়ির সবাই সকালের নাস্তা নিজের রুমে করেন, দুপুরেও খাওয়ার সময় শুধু মহিলারা থাকে। শুধু রাতে সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়ার টেবিলে। এই কয়দিন শুধু রাতে খাওয়ার সময় একটুখানি দেখা হয়েছে ছোঁয়া শুভ্রর। ছোঁয়া ইচ্ছে করেই শুভ্রর থেকে নিজেকে আঁড়াল করে রেখেছে সেদিনের ঘটনার পর থেকে। ছোঁয়া ওর চুল আর খান্দানী বালা জোড়ার প্রতি খুব সিরিয়াস। ছোঁয়া জানে শুভ্র ওকে কখনোই বিয়ে করবেনা তবুও ওর বেহাইয়া মনটা বালা জোড়া চাই খুব করে।

সন্ধ্যায় ছোঁয়া পরতে বসেছে। এমন সময় ওর দরজায় কটকট শব্দ হয়। ছোঁয়া ভেবেছে ওর ছোট বোনেরা এসেছে হয়তো কিন্তু দরজা খুলেই ছোঁয়া ভীষণ ভাবে অবাক হলো। চোখ লাল করে শুভ্র ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া শুভ্রকে দেখে দরজা বন্ধ করতে যাবে তার আগেই শুভ্র ছোঁয়াকে ধা’ক্কা দিয়ে রুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ছোঁয়া ভরকে যায় খুব। ছোঁয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই শুভ্র ওর গালে ঠা’স করে থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয়। ছোঁয়া তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে যায়। ছোঁয়ার বন্ধু ওর হাতের যে স্থানে ধরেছে সেই স্থানে শুভ্র জোরে চেপে ধরে বলে “অন্য ছেলেদের সাথে ঘষাঘষি করতে খুব ভালো লাগে তোর নাহ? আর আমি ছুঁলেই তোর ব্যাথা করে তাইনা? আচ্ছা ছেলেটা কি শুধু হাত ধরেছে নাকি শরীরের অন্য স্থানেও ছুঁয়ে দেখেছে?”

“শুভ্র ভাইয়া বেশি বেশি বলে ফেলতেছো কিন্তু তুমি। ছাড়ো ব্যাথা লাগে আমার? কোন অধিকারে তুমি আমার গায়ে হাত তুললে হ্যাঁ? আমার বাবা মা-ও আমার গায়ে কখনো ফুলের টুকা পর্যন্ত দিয়ে দেখেনি। সবাইকে বলে দিবো তুমি আমার সাথে এমন জা’নো’য়া’রে’র মতো আচরণ করতেছো সেটা।”

“বললাম তো আমি ছুঁলেই তোর ব্যাথা করে আর অন্য ছেলেরা ছুঁলে আদর আদর লাগে খুব তাইনা?

বল সবাইকে বল। আমি পরোয়া করিনা কারো। আমি বলবো তুই আবারও আমার কানের কাছে এসে বিয়ের কথা বলে বলে ঘ্যান ঘ্যান করতেছিলি তাই রেগে গিয়ে থা’প্প’ড় দিয়েছি আমি। আমি কি কম নাকি তোর থেকে। তুই বাঘিনী হলে আমি বাঘ।”

ছোঁয়া এবার চুপসে যায়। কারণ ছোঁয়া এমনটা অনেকবার করেছে তাই সবাই শুভ্রর কথায়-ই বিশ্বাস করবে। কিন্তু ছোঁয়া বুঝতে পারছেনা হঠাৎ শুভ্রর হলো কি? কেনো এমন অদ্ভুত আচরণ করতেছে শুভ্র? ছোঁয়া নাহয় বালা জোড়ার জন্য শুভ্রকে পছন্দ করে কিছুটা কিন্তু শুভ্র এমন জেলাস ফিল করার তো কোনো কারণ নেই। তবে কি শুভ্র নিজের অজান্তে ছোঁয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে?

ছোঁয়া থা’প্প’ড় খাওয়া গালে হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বলে “শুভ্র ভাইয়া তুমি কি জে’লা’স ফিল করছো আমি আমার ফ্রেন্ড রকির হাত ধরেছি বলে?”

কথাটা শুনেই শুভ্রর মাথা আরো বেশি গ’র’ম হয়ে যায়। শুভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে র’ক্ত’ব’র্ণ চেহারা করে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায়। ছোঁয়া ভয়ে পিছিয়ে যায় আর শুকনো ঢুক গিলে। হঠাৎ শুভ্র তে’ড়ে গিয়ে ছোঁয়াকে______

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here