ভালোবাসার মানুষটার কাছে যখন শুনেছিলাম ___সে আমার বোনকে ভালোবাসে। তখন নিজের বোনের জন্য তিন বছর আগে ছেড়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম আর কখনোই দেখা হবে না। তাকে আজ আকষ্মিক দেখবো ভাবি নি।
ডক্টর দেখিয়ে হসপিটাল থেকে বেড় হচ্ছিলাম আর তখনি প্রিয় ভাইয়াকে দেখতে পারলাম।মানুষটাকে তিন বছর পর দেখে মন্দ লাগছে না, কিন্তু বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা ঠিকই করছে। মানুষটা যে ঠিক আগের মতো আছে তা বলা যাবে না। মুখে কিছু দাড়ি রয়েছে আর প্রাপ্তবয়স্কের কিছুটা ভাব এসেছে। আমি জানিনা সে আমায় দেখেছে কি-না, কিন্তু আমি চাই যেনো না দেখুক৷ ভাবলাম অন্য গেইট দিয়ে বেড় হবো তাই আবার পিছনের দিকে হাটা দিলাম, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না৷
এই ‘প্রাচুর্য’ দাড়াও বলছি।
প্রিয় প্রাচুর্যকে দেখে নিলো আর সেই সাথে দৌড়ে প্রাচুর্যের পিছনে গিয়ে তাকে ডাক দিলো। প্রাচুর্যের হাত প্রায় কাঁপা শুরু করে দিলো। তার মন বলছিলো দৌড়ে চলে আসতে__কিন্তু এভাবে কারন ছাড়া দৌড়ালে তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে না পিছনে থাকা মানুষটি৷ নিজেকে কিছুটা ঠিক করে পিছনে তাকালো প্রাচুর্য।
আরে তোমার সাথে এতো গুলো বছর বাদে দেখা হলো আর তুমি কিনা আমায় দেখেও উল্টো দিকে হাটা ধরলে। তোমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার কাম্য নয় আমার প্রাচুর্য।
আসলে __ প্রাচুর্য কি বলবে বুঝতে পারছে না তাই থেমে গেলো। পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে বললো__আসলে কি জানেন, আমি ভেবেছিলাম আমার ফোনটা ডক্টরের চেম্বারে ফেলে এসেছি। আমি তো আপনাকে দেখে আপনার দিকেই এগিয়ে আসছিলাম কিন্তু তখনি মনে হলো ফোনের কথা। এখন বলুন আমার কি ফোন আনাটা জরুরি না? তারপরও তো আপনার সাথে দেখা হতে পারেতো।
প্রাচুর্য অতিরিক্ত ঘাবড়ে গিয়ে কথাগুলো খুব দ্রুতই বলে ফেললো। প্রাচুর্য যখন কিছু ভেবে পায় না, তখন খুব দ্রুত কথা বলে যেনো অপর পাশের ব্যক্তি কনফিউজড হয়ে যায়। প্রিয় প্রাচুর্যের দিকে ভ্রু বাকিয়ে তাকালো __ তা দেখে প্রাচুর্য কিছুটা বোকা শোকা ভাবে প্রিয়ের দিকে তাকালো যেনো এক্ষুনি কেঁদে দেবে।
‘প্রাচুর্য’ আই থিংকড তোমার হাতে যে ফোনটা আছে, সেটাই তোমার। প্রাচুর্য নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ফোনটা ওর হাতেই আছে।কি বলতে কি বলেছে ও নিজেই জানে না। ইস.. যদি অন্য কিছু বলতো তাহলেও ঠিক মানিয়ে নেয়া যেতো।
ওহ তাই তো। আসলে কি বলুন তো, জানেনই তো আমার ফার্স্ট লাভ আমার মোবাইল, তাই সারাক্ষণই ভাবি এটা আমার কাছে আছে নাকি।
তাই বলো!তুমি তো আমায় আগে ‘আপনি’বলে সম্মোধন করতে না। আর এতোক্ষণ ধরে আপনি আপনি করছো, আবার তোতলাচ্ছোও।
প্রাচুর্য কিছুক্ষণ প্রিয়র দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে কিছুটা ভালোলাগা কাজ করছে এই ভেবেই যে,তার ভালোবাসার মানুষটা এখনো তাকে মনে রেখেছে ___ ইয়ে.. মানে.. ব্যাপারটা হচ্ছে গিয়ে, অনেকদিন পর দেখা। যদি রাগ করেন তাই আর কি, ভদ্রতা বলে তো কিছু আছে তাই না।
প্রিয় কিছুটা হেসে বললো,__তো হসপিটালে আসলে কেনো, কিছু কি হয়েছে?
প্রাচুর্য ভাবছে প্রিয়কে কি সত্যিটা বলা ঠিক হবে, না ঠিক হবে না। কিন্তু মিথ্যেও সে বলতে পারবে না তাই প্রসঙ্গ পাল্টে দেওয়ার জন্য বললো___ এসেছিলাম এমনিই। আপনি কি করছেন এখানে?
আমি এই হসপিটালের মেডিকেল কলেজে থার্ড ইয়ারে আছি, কিছুদিন পর ফোর্থ ইয়ারে উঠবো।
বাহ তাহলে আপনি হাফ ডাক্তার হয়ে গেলেন। প্রাচুর্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলো প্রিয়কে কি কথাটা বলা ঠিক হবে। ঠিক না হলেও তার জানতে ইচ্ছে করছে। তাই বলেই ফেললো ___ সামায়ার সাথে কি কন্ট্রাক্ট হয় আপনার?
প্রিয় কিছুক্ষণ প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো__হ্যাঁ হয়, কিন্তু তেমন ভাবে না। বাদ দাও সেসব কথা।আমাদের বাসায় সে যে গেলে আর আসলে না কেনো?
প্রাচুর্য খেয়াল করলো প্রিয়র মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। তাই আর কথা বাড়ালো না।
আসলে, বাসা থেকে এখন খুব একটা বেড় হতে দেয় না । তার উপর পড়াশোনার অনেক চাপ। ফুপি তো আমাকে দেখলেই ইমোশনাল হয়ে পারে, তাই আপনাদের বাসায় গিয়ে উনাকে কষ্ট দিতে মন চায় না।
প্রাচুর্য, আই থিংকড তুমি অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছো। আগে কিন্তু এমন ছিলে না।
প্রাচুর্য আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো। প্রাচুর্যের উত্তর না পেয়ে আবার বললো__এখান থেকে কিন্তু আমাদের বাসা ত্রিশ মিনিটের পথ।আজ এতো কাছ থেকে তুমি চলে এসেছো শুনলে কিন্তু কাকিমা খুব কষ্ট পাবে। তাই এখন তোমায় আমার সাথে বাসায় যেতে হবে।
প্রাচুর্য ঘাবড়ে গেলো আরো । তার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না প্রিয়র সাথে। নিজেকে খুব কষ্টে সামলাচ্ছে, এরপর যে কিছু হবে না তা তার অজানা।__প্রিয় ভাইয়া আপনি তো জানেন, আমার বাসায় এটা নিয়ে অনেক সমস্যা আর আজ আব্বু আমাকে আগে বাসায় যেতে বলেছে। তাই বুঝতেই পারছেন। প্লিজ আপনি একটু বুঝার চেষ্টা করুন। আমি যে এইদিকে আসছিলাম সেটা প্লিজ একটু গোপন রাখুন।আমি কথা দিচ্ছি কয়েকদিনের মধ্যে আপনাদের বাসায় যাবো।
প্রিয় বুঝতে পারলো প্রাচুর্য কোন একটা বিষয় নিয়ে ডিস্টার্ব ফিল করছে তাই আর জোর করলো না, আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলো।
প্রাচুর্যকে প্রিয় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো, কিন্তু আজ দেখে কেনো জানি কথা বলতে ইচ্ছে হলো। প্রিয়ের মনে হয় প্রাচুর্যের মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে রয়েছে। আর সে জন্যই মেয়েটাকে তার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে।
প্রাচুর্যের সেদিনের পর থেকে মোটেও ভালো লাগছে না।একটা মানুষকে এতো স্বল্প সময়ে কীভাবে ভালোবাসা যায়, যার জন্য তিনটা বছর ধরে ভালোবাসার দহনে জ্বলছে।ভালোবাসা শব্দটা যেমন দীর্ঘ, তেমনি এর বিরহটাও দীর্ঘ-ই হয়।
বিকালের দিকে প্রাচুর্য ঠিক করলো মধ্য বাড্ডা যাবে, সায়নির বাসায়। সায়নি হলো প্রাচুর্যের বেস্ট ফ্রেন্ড। মন খারাপের সময় বেস্ট ফ্রেন্ডরা অনেকটা ওষুধের মতো কাজ করে। প্রাচুর্য রেডি হয়ে রুম থেকে বেড় হলো।
ড্রইংরুম দিয়ে যখন প্রাচুর্য বাইরে যাবে, ঠিক তখনি দেখতে পেলো প্রাচুর্যের ছোট চাচা সোহাগ সালেহ ও তার মেয়ে সামায়া বসে আছে। প্রাচুর্য জানতো না আজ তারা এখানে আসবে। সামায়া প্রাচুর্যকে দেখেই দৌড়িয়ে এসে জরিয়ে ধরলো প্রাচুর্যকে।
আহ সামু ছাড় পরে যাবো।
ছাড়বো কেন?ইস.. ছয় মাস পর দেখা হলো, আর তুই ছেড়ে দিতে বলছিস।
আচ্ছা পরে ধরিস। এখন বল কেমন আছিস। আর তোরা আসলি কবে?
সামায়া প্রাচুর্যকে ছেড়ে দিলো।
আজই এলাম। আম্মু আর সামস ভাইয়া উপরে আছে। এটুকু বলে সামায়া লজ্জায় মাথা নিঁচু করে ফেললো।
তখন পাশ থেকে সোহাগ সালেহ বললো,__সে কিরে তুই জানিস না, সামনের সপ্তাহে সামায়ার এনগেজমেন্ট। তাই তো সুনামগঞ্জ থেকে এক মাসের জন্য এখানে এলাম।
প্রাচুর্য কিছুটা বিষ্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে সবার দিকে তাকালো। বুকের ভেতরটায় আবারো এক অজানা ব্যাথা দেখা দিলো।
ওহ সরি আমি জানতাম না।কংগ্রেস সামু।
সামায়া প্রাচুর্যের কথায় মুচকি হাসি দিলো, কিন্তু কোন জবাব দিলো না।
প্রাচুর্যের আর বাইরে যাওয়া হলো না। মাথা ব্যাথার অজুহাত দিয়ে রুমে এসে পরলো।
আজ কেনো এমন হচ্ছে আমার।আমি তো জানতামই এমন হবে আমার সাথে। কিন্তু তিনদিন আগেই তো আমার সাথে প্রিয় ভাইয়ার দেখা হলো। সে তো আমাকে বললো না যে, তার আর সামায়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। উলটো সামায়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। হয়তো আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করেনি৷
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না প্রাচুর্য। পরিস্থিতি চিন্তা করে নিজেকে যে স্বাভাবিক রাখতেই হবে৷ ক’জনই বা পারে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে। আমিও নাহয় আমার না পাওয়ার মধ্যে তাকে ভালোবেসে গেলাম।
পরদিন সকালে প্রাচুর্যের ঘুম ভাংলো অনেক শোরগোল শুনে। ঘুম থেকে কোন মতে উঠেই বাইরে চলে এলো কি হচ্ছে দেখার জন্যে।
প্রাচুর্য দেখতে পেলো তার এক মাত্র ফুপি মিসেস.শান্তা আর প্রাচুর্যের বাবা সুবহান সালেন দু’জন দু’জনকে জরিয়ে ধরে কেদে যাচ্ছে। প্রাচুর্যের কাছে ব্যাপারটা যেনো একটা স্বপ্নের মতো। তার ফুপি শান্তা এবাড়িতে প্রায় তেরো বছর যাবত আসেনি। আর আজ শুধু সে এবাড়িতেই আসেনি বরং তার বাবা, যার সাথে কি-না এতো বছর কোন যোগাযোগই ছিল না তাকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে।
প্রাচুর্যকে দেখে তার বাবা সুবহান শান্তাকে ছেড়ে এগিয়ে আসলেন। এমন সময় প্রাচুর্য দরজার একটু সামনে প্রিয়কে দেখতে পেলো। কি হচ্ছে প্রাচুর্য কিছুই বুঝতে পারছে না।
#মনের_গহীনে
১ম পর্ব
লেখনীতে: –নাদিয়া হোসাইন