#মনের_গহীনে
১৪তম পর্ব
লেখনীতে: নাদিয়া হোসাইন
সকালে প্রাচুর্য আর প্রিয়র দেখা পেলো না। মোবাইলে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখলো সাতটা প্রিয় ম্যাসেজ দিয়েছে । সেখানে লিখা ছিলো,__ গুড মর্নিং । আমি হসপিটালে যাচ্ছি। মন খারাপ করো না, বিকেলে দেখা হবে।
ম্যাসেজটা পরে প্রাচুর্যের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্রিয় মানুষটার কাজ-কর্মের জবাবদিহির মধ্যেও এক ধরনের ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। এতে মনে এক ধরনের শান্তি অনুভব করা যায়, যে সে ভালো আছে।
সুনামগঞ্জ এসে সামায়ার দিন ভালোই যাচ্ছে। প্রাচুর্য আর প্রিয়র ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। সামায়ার নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়, ইহানকে পেয়ে । ছেলেটা সামায়ার সব দিকেরই খেয়াল রাখে। এরেঞ্জ ম্যারেজেও যে এতো ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা কল্পনার বাইরে ছিলো তার । মাঝে মাঝে বাবা-মা সন্তানের মঙ্গলের জন্যই নিজেরা বিয়ে ঠিক করে। সামায়া কখনোই সেই ভাবে তার বাবা – মায়ের কথার বিরোধীতা করেনি। এসবই ভাবছিলো তখন সামায়ার ফোনে প্রিয়র কল এলো। এতোদিন পর প্রিয়র কল দেখে তেমন কিছু মনে করলো না। বরং খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করলো।
হ্যালো! কেমন আছো সামায়া?
ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো, আর প্রাচুর্যের কি অবস্থা?
হুম, সব-ই ভালো। আমিও অনেক ভালোই আছি।
ভালো তো থাকবেন জানতাম-ই । দেখছেন, বলছিলাম না যে প্রাচুর্যকে একবার মনে যায়গা দিলে আপনি অনেক হ্যাপি থাকবেন।
প্রিয় স্লান হাসলো। নিজের পছন্দের মানুষটার মুখে এসব শুনতে কার-ই বা ভালো লাগে। কিন্তু প্রিয়র শুনতেই হবে এসব। সে যে সামায়ার সাথে কথা বলছে, এই তো অনেক। অনেকেই তো আছে যাদের তার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার মতো,কথা বলার মতো কোন সুযোগ-ই থাকে না। প্রিয় হুম বলে ফোনটা কেটে দিলো। একজন মানুষকে ভুলা তো সামান্য কোন ব্যাপার নয়। সেখানে প্রিয়-ই বা কি-করে পারবে এক নিমিষেই চার বছরের ভালোবাসা ভুলে যেতে। তার সব কিছু প্রাচুর্যকে ঘিরে থাকলেও মন তো সামায়ার কাছেই আছে । প্রিয় খুব দূর্ভাগা। এমন একজনকে ভালোবাসলো, যার জীবনের একটা বিন্দুতেও প্রিয়র কোন স্থান নেই। তার ভালোবাসার মানুষটা নিজে থেকেই বুঝে নিচ্ছে, প্রিয় অনেক ভালো আছে তার বোনের সাথে। প্রিয় প্রাচুর্যকে দোষারোপ করেছে না। প্রাচুর্য তো কিছুই জানে না। উল্টো সে মেয়েটাকে ঠকাচ্ছে। অবশ্য প্রিয় প্রাচুর্যকে আগে থেকেই ব্যাপারটা খোলসা করে বলে দিয়েছিলো। এতে তিনটি মানুষেরই কোন দোষ নেই। সব ভাগ্যের লীলাখেলা। এই লীলাখেলায় তিনজন কখনো জয়ী হতে পারবে না। একজনকে হাড়তেই হবে৷ আর সেই হেড়ে যাওয়া মানুষটার যায়গায় প্রিয় নিজেকে বসিয়ে নিয়েছে।
রাতে ডিনার করে এসে সবাই নিজেদের রুমে চলে এলো। প্রাচুর্যের এক অদ্ভুত ইচ্ছে যেগে উঠলো। তার মনের এই অদ্ভুত ইচ্ছেটা প্রিয়কে ঘিরে । সে জানে না, প্রিয় তার ইচ্ছেতে রাজি হবে কি না। প্রিয়কে কিছু না জিজ্ঞেস করেই সে বারান্দায় চলে গেলো। প্রাচুর্য আর প্রিয়র বারান্দার মাঝে এক হাত ব্যবধান। উপর দিয়ে কোন গ্রিল দেওয়া নেই। প্রাচুর্যের কাছে একটা ছোট ব্যাগ আছে, যাতে তার যাবতীয় জিনিসপত্র রাখা। সাবধানতা অবলম্বন করে চোরের মতো রেলিংয়ের উপর উঠে পরলো। দো,তলা থেকে এখন পরলে বাঁচার চান্স থাকলেও হাত, পা না ভাঙার সম্ভাবনা নেই। রেলিংয়ের উপর থেকে প্রিয়র বারান্দার রেলিং বেধ করে লাফ দিলো। ৷
প্রিয় কিছুক্ষন আগেই প্রাচুর্যের থেকে বিদায় নিয়ে পরতে বসছিলো। বারান্দায় কিছু পরার শব্দ পেতেই বারান্দায় এলো। প্রাচুর্য এখানে বসে আছে দেখে বেশ থতমত খেলো। প্রাচুর্যের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রাচুর্য খুশি মনে প্রিয়র হাত ধরে উঠে পরলো। প্রিয় নিজেকে কিছুটা শান্ত করে প্রাচুর্যকে বললো, __তুমি এতো রাতে এখানে কি কর। রাত বারোটা বাজে। কোন সেন্স আছে?
হ্যাঁ আছে। কতো কষ্ট করে এখানে আসলাম। অনলি ফর ইয়্যু।
এতো কষ্ট করার দরকার ছিলো না। এখন বলো কেন আসছো।
প্রাচুর্য তার ব্যাগ থেকে প্রিয়র কালকের কিনে দেওয়া চুড়িটা প্রিয়র দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,পরিয়ে দাও। এখন আমার সাজতে মন চাচ্ছিলো। চুরি যেহেতু তুমি কিনে দিছো। পরিয়েও তুমিই দিবা।
প্রিয় নিজের রাগটা দমিয়ে রাখলো। প্রাচুর্যের থেকে চুড়ি গুলো নিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে। প্রাচুর্য এক দৃষ্টিতে প্রিয়কে দেখে যাচ্ছে। পরানো শেষে প্রাচুর্যের উদ্যেশ্যে বললো, __ শুনো প্রাচুর্য! নিজের জীবনের থেকে কাউকে বেশি ভালোবাসা ঠিক না। মানুষ অনেক স্বার্থপর। এখন আমি আছি তোমার সাথে, কাল না-ও তো থাকতে পারি। আই থিংক তুমি আমার কথা গুলো আজ মনোযোগ দিয়ে শুনবে।
প্রাচুর্য মাথা নাড়ালো।
সাপোজ, আমি আজ তোমার সাথে আছি। কাল তোমাকে আমার একটুও ভালো লাগছে না। তোমায় ছেড়ে চলে গেলাম। তখন কিন্তু নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। আমি বলতে চাইছি না, তুমি আমাকে ভালোবেসো না। আমি জাষ্ট এই বলছি, নিজের দিকটাও ভেবে দেখো। এখন যদি তুমি বারান্দা থেকে নিচে পরে যেতে, আমি কিন্তু একদমি তোমায় পরে আর বিয়ে করতাম না। প্রিয় শেষের কথাটা হেঁসে মজা করে বললো।
প্রাচুর্য প্রিয়র কথা শুনে কেঁদে দিলো। প্রিয় বিষ্ময়কর ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ও তো প্রাচুর্যের ভালোর জন্যই এগুলা বলছিলো। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
বাচ্ছা, আমি তো মজা করে বলছি। তোমার ভালোর জন্য-ই বলছি। এখন যদি পরে যেতে, তখন কি ভালো হতো বলো?
প্রাচুর্য কান্নারত স্বরে বললো, তাই বলে এটা বলতে পারলেন আপনি। আমার সব পাগলামি তো আপনার জন্য-ই। আর আপনি এটা বলছেন। আমি থাকবো না আপনাদের বাসায়। কাল-ই চলে যাবো।
সরি বললামই তো। তাও কান্না থামাও প্লিজ৷ দেখো যা বলবে, তা-ই করবো। তাও কান্না থামাও। মেয়ে মানুষের কান্না দেখা উত্তম পুরুষদের শোভা পায় না। তুমি কি চাও, আমি উত্তম পুরুষ থেকে নাম পুরুষ হয়ে যাই।
প্রিয়র কথায় প্রাচুর্য কান্না থামিয়ে দিলো।প্রিয়কে বললো,__নাহ চাই না। কান্না থামালাম। আপনি বলছেন, যা চাই তা করবেন। তো এখন আমাকে বাইরে নিয়ে যাবেন। যদি না জান আবার কাঁদবো।
এখন কীভাবে বাইরে নিয়ে যাব বলো। বাসার কেউ দেখে ফেললে আমি শেষ।
কেউ দেখবে না। সবাই ঘুমাচ্ছে। আমরা চুপি চুপি যাব আর চলে আসবো। দেখছেন, আজকে আকাশে পুরো চাঁদ উঠছে। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো, আপনার সাথে একটা রাত রাস্তায় ঘুরবো ওই চাঁদকে দেখিয়ে।
প্রিয় কিছু বললো না। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে প্রাচুর্যকে নিয়ে রুমের দরজা দিয়ে বেড় হয়ে এলো। নিচে সিকিওরিটি গার্ডকে কীভাবে সামলাবে ভেবে পেলো না। অনেক ভেবে প্রিয় সিকিওরিটি গার্ডকে সিগারেট বেড় করে দিয়াশলাই দিতে বললো। সিকিউরিটি গার্ড বাদল এবাসায় অনেক বছর ধরে আছে। সে স্মোক করে না, তাই প্রিয়কে গেটের সামনে দাড় করিয়ে তার রুমে চলে গেলো দিয়াশলাই আনতে। বাদল যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচুর্য আর প্রিয় এক দৌড়ে বাসা থেকে বেড় হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর বাদল এসে কাউকে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো। কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলো। আশে পাশে এতোক্ষণ প্রিয়কে খুজলো। খুজে না পেয়ে আবার নিজের যায়গায় এসে বসে রইলো।
প্রাচুর্য প্রিয়র এহেন কান্ডে হেঁসে যাচ্ছে। প্রিয় রাগে প্রাচুর্যের উদ্যেশ্যে বললো, __হাঁইসা লাভ কি বলো। তোমার জন্য যে আর কতো কি করতে হবে, আল্লাহ মালুম!
অনেক কিছুই করতে হবে। আমি আপনাকে এতো ভালোবাসি৷ আর আমার ইচ্ছে গুলা পূরণ করা তো আমার দায়িত্ব।
প্রিয় স্লান হাসলো। ইদানিং সে স্লান হাসি ছাড়া অন্য সব হাসি দিতে প্রায় ভুলেই গেছে। নিরবতাই তার কাছে এখন শ্রেষ্ঠ!
চলবে,