মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব -২৭+২৮+২৯

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৭
রেস্টুরেন্টের ছাদের প্রায় একপাশ রুদ্রিক নিয়ে নিয়েছে।বেশ খোলামেলা ছাদটা।হরেকরকমের বাহারি ফুল গাছের ছড়াছড়ি ছাদটায়। সেই গাছে কয়েকটায় ফুলও ফুটেছে।এতে যেন ছাদের সৌন্দর্য আরও দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে।দু টো ছোটো খাটো ওয়াটার ফলও আছে।সেখানে আবার ছোটো ছোটো মাছ ছাড়া হয়েছে।পাশেই আবার বড়ো একটা খাচায় নানান রঙের লাভ বার্ডসও আছে।ছাদের এদিক সেদিক চার পাঁচটা খরগোশকেও দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যাচ্ছে।রুদ্রিক আর অথৈয়ের সব ফ্রেন্ডরা একসাথে বসেছে একটা টেবিলে।বিশাল বড়ো টেবিলটা।মূলত রুদ্রিক এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বলে এই ব্যবস্থা করিয়েছে।এদিকে অথৈ খরশোশ দেখেই সেইগুলোর পেছনে লেগেছে। উদ্দেশ্য যে করেই হোক একটাকে ধরে আদর করবে।সাদা সাদা পশমযুক্ত ওই গা টা ছোঁয়ার জন্যে সে মরিয়া হয়ে গিয়েছে।রুদ্রিক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অথৈয়ের দিকে।মেয়েটা মাঝে মাঝে যে বাচ্চাদের মতো ব্যবহারগুলো করে তা রুদ্রিক বেশ উপভোগ করে।এই মেয়েটার যে আর কতো রূপ আছে কে জানে?রুদ্রিক যে আর কতোবার এই মেয়ের প্রেমে পরবে।রুদ্রিকের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
অথৈ খরগোশের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠেছে।কিন্তু একটাও ধরতে পারেনি। অথৈ মুখ ফুলিয়ে রুদ্রিকের পাশে ধপ করে বসে পরল।অথৈয়ের মুখ ফুলানো দেখে হাসল রুদ্রিক।দৌড়াদৌড়ি করার ফলে অথৈয়ের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।রুদ্রিক ট্যিশু দিয়ে অথৈয়ের ঘার্মাক্ত মুখশ্রীটা যত্নসহকারে মুছে দিল।এতোগুলো মানুষের সামনে রুদ্রিকের এহেন কান্ডে অথৈ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।মিনমিন করে বলে,’ কি করছেন?’

রুদ্রিক ভাবলেশহীনভাবে বলে,’ কি করছি?কিছুই করছি না।শুধু বউয়ের ঘর্মাক্ত মুখশ্রীটা মুছে দিলাম।আর এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।চুমু তো আর খাইনি।এতো লজ্জা পেও না।তোমার ওই লজ্জামাখা মুখশ্রী দেখলে কিন্তু সত্যি চুমুটুমু খেয়ে ফেলতে পারি।তখন আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’

ভয়ংকর লজ্জা পেয়ে অথৈ ঠিক কি বলবে ভাষা খুঁজে পেল না।এই লোকটার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই।আর মুখে লাগামও টানে না।কিসব বলে ফেলে।যা শুনে অথৈয়ের মন চায় একগ্লাস পানিতে ডুবে মরে যেতে।এইযে এখন মাত্র বলা লোকটার কথা শুনে অথৈয়ের কথা গলায় আটকে গিয়েছে।হৃদস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্র হয়ে গিয়েছে।গাল দুটো লজ্জায় ফুলফেপে উঠেছে।অথৈয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ।কোনোরকম হাত বাড়িয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।হঠাৎ কানের কাছে রুদ্রিকের ফিসফাস করা কণ্ঠ শুনতে পেল,’ চুমু খাব?বলেছিলাম লজ্জা পেতে নাহ।বেষামাল হয়ে যাচ্ছি আমি।’

অথৈ টানটান হয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলো।শরীর তার বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে।শ্বাস আটকে গিয়েছে তার।
_____________
ইহানের ঠোঁটের কোণে মুচঁকি হাসি।বোনটা যে তার এতোটা সুখে শান্তিতে থাকবে সেটা দেখেই তার প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
যাক,তার আর কোনো চিন্তা নেই।আজ রুদ্রিকের অথৈয়ের প্রতি কেয়ার দেখে ইহানের সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গিয়েছে।ইহান তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।কিন্তু হঠাৎ করে চোখ আটকে যায়।ঠিক তার বরাবর বসা অপরপ্রান্তের রিধির দিকে।গাঢ়ো লাল রঙের কামিজ সেটে মেয়েটাকে একদম বউ বউ লাগছে।সুন্দর লাগছে অনেক দেখতে।নজর ফিরাতে পারছে না সে।ইদানিং তার সাথে যে কি হচ্ছে সে বুঝতেই পারছে না।এই মেয়েটাকে নিয়ে মনের মাঝে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে তার।অদ্ভূত সব ইচ্ছে জাগে মনে।যার কোনো কূল কিনারা সে পাচ্ছে না।রিধির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কথাগুলো ভাবল ইহান।হঠাৎ তার কপাল জোড়া কুচকে এলো। আজকের রিধিকে তার অন্যরকম লাগছে।অন্যান্য দিন রিধির সাথে ওর দেখা হলে।বা ওরা কোনো কারনে একসাথে হলে।রিধি দু এক মিনিট বাদে বাদেই ইহানের দিকে তাকাতো।চোরা দৃষ্টিতে পরখ করে যেতো ওকে।ইহানের থেকে যতোই লুকোতে চেষ্টা করত মেয়েটা।ইহান তাকে দেখেই ফেলত।তবে ইহান কোনোদিন কিছু বলেনি।কিন্তু আজ একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না মেয়েটা।কি হয়েছে?সে তো কিছু করেনি রিধিকে।বা কোনো খারাপ কথাও বলেনি।তবে এমন কেন করছে ও?ভালো ভালো মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো ইহানের।কিন্তু রিধি তার দিকে তাকালেই কি বা না তাকালেই বা কি? তার কেন এতো কষ্ট লাগছে?বুকের বা পাশে এতো জ্বাপাপোড়া করছে।জানে না সে কিছুই জানে না।
____________
সিয়া বিরক্ত হয়ে বার বার অনিকের দিকে তাকাচ্ছে।এই ছেলের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বা মাথার তাড় ছিড়ে গিয়েছে বোধহয়।কিসব যে শুরু করে দিয়েছে।অনিক একেবারে সিয়ার গায়ের সাথে লেপ্টে বসেছে।এই নিয়ে সিয়া কয়েকবার বলেছে অনিককে সরে বসতে।কিন্তু সে সিয়ার কথা শুনেও না শোনার ভাণ ধরে একইভাবে বসে।এতোগুলো মানুষের সামনে অনিকের এমন কান্ডে সিয়ার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।সহ্য করতে না পেরে এইবার দাঁতে দাঁত চিপে বলে,’ কি সমস্যা এমন করছেন কেন?’

সিয়ার এই কথাটুকু শোনার জন্যেই যেন মনে হয় অনিক অপেক্ষায় ছিলো।অনিক বলল,’ আবার আপনি করে বলছিস?এখন তুই কি চাচ্ছিস? তোর ওই সুন্দর ঠোঁটজোড়া দিয়ে যে আমায় বার বার আপনি বলে সম্বোধণ করছিস সেই ঠোঁটে আমি সবার সামনে চুমু খেয়ে বসি?চয়েজ ইজ ইয়্যোরস!’

সিয়া হা হয়ে গেল অনিকের কথায়।এই মাত্র এসব কি বলল অনিক তাকে?তাদের রিলেশন থাকাকালীন অবস্থাতেও তো অনিক এমন লাগামহীন কথাবার্তা বলেনি। তাহলে ইদানিং এই অনিকের কি হলো?আর কেনই বা এইভাবে হাত ধুয়ে ওর পিছনে পরেছে। সে তো বলেছিলো ওদের ব্রেকআপের দিন।অনিকের নাকি সিয়াকে পছন্দ হয় না।তার বিরক্ত লাগে সিয়াকে।তবে হঠাৎ কি এমন হলো যে অনিক এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে।ওর পিছনে লেগেই থাকে।তবে কি অনিক আবারও তার মোহ পরেছে?সেই মোহে পরেই আবারও অনিক তার কাছে আসতে চাইছে?একসময় মোহ কেটে গেলে আবারও তাকে আগের মতো ছুড়ে ফেলে দিবে?কিন্তু সিয়া তো তা চাইছে।অনিকের দেওয়া সেই প্রথম কষ্টের রেশ এখনও সে ভুলতে পারেনি।প্রতিরাতে তার জন্যে চোখের পানি ফেলে সে বালিশ ভেজায়।আবারও সেই কষ্ট সিয়া পেতে চায় না।প্রথমবারের কষ্টে তো কোনোরকম সে বেঁচে যাবে।দ্বিতীয়বার আবার সেই কষ্ট পেলে সিয়া এইবার বাঁচতে পারবে না। কোনোমতেই বাঁচতে পারবে না।তাই অনিককে থামাতে হবে।তাকে বোঝাতে হবে।এইভাবে ওর পিছনে পরে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।যে করেই হোক অনিককে থামাতে হবে।আর আগাতে দেওয়া যাবে না।
সিয়া উঠে দাঁড়ালো নিজের চেয়ার থেকে।তারপর সোজা হেটে গিয়ে ইহানের কাছে গেল।ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ ইহান তুই গিয়ে অনিকের পাশো বোস না গিয়ে।আমার ওইখানে আনকোম্ফোর্টেবাল ফিল হচ্ছে।প্লিজ ভাই যা না।’

ইহান সিয়ার এতো রিকুয়েস্ট ফেলতে পারল না।তাই উঠে গিয়ে বসল সিয়ার পাশে।আর সিয়া সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইহানের জায়গায় বসে পরল।এদিকে সিয়ার এমন কাজে অনিকের রাগে মাথা ফেটে যাবার জোগাঢ়।সাহস কিভাবে হলো এই মেয়ের ওর পাশ থেকে উঠে চলে যাবার?কিভাবে পারল এইভাবে উঠে চলে যেতে?অনিকের সান্নিধ্য কি ওর এতোটাই খারাপ লাগছিলো?কই আগে রিলেশনে থাকাকালীন তো এমন করত না।উলটো অনিকের সাথে আরও চিপকে থাকত।এখন কি তার স্পর্শটাও এই মেয়ের সহ্য হয় না।এতোটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে এই মেয়ের মধ্যে?অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।হঠাৎ করেই রাগটা পরে গেল তার।এটা ভেবেই যে দোষ তো তারই।কম অপমান করেনি ও সিয়াকে।তবে এতো সহজে কেন মেয়েটা মেনে নিবে?কঠিন শাস্তি পাওয়া দরকার তার।সেখানে তো এই মেয়ে তাকে কিছুই বলেনি।অনিকের নিজের প্রতি রাগ লাগছে।কেন সেদিন সিয়াকে ওভাবে অপমান করেছিলো সে? সিয়াকে ছেড়ে অন্য মেয়ের মোহে পরে গিয়েছিল সে।এই মেয়ের কথা শুনেই সেদিন সিয়ার সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলো।রাগে দুঃখে অনিকের মন চাচ্ছে এই সাততলা বিল্ডিংয়ের ছাঁদের উপর থেকে লাফ দিয়ে পরে মরে যেতে।হঠাৎ কাধে কারও হাতের ছোঁয়া পেয়ে সেদিকে তাকায় অনিক।অনিক তাকাতেই ইহান বলে উঠল,’ ধৈর্য ধর।ধৈর্য ধরলে মোয়া ফলে।মেয়েটাকে যে পরিমান কষ্ট তুই দিয়েছিস।তার কাছে এসব কিছু না।ইনফেক্ট সিয়া তো তোকে কিছু করেই নি।এমন কি কিছু বলেও নি।এখন একটাই উপায় বলব।নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা কর ওর অভিমান ভাঙাবার।যেই অভিমানের পাহাড় তুই নিজে সৃষ্ট করেছিস।তা ভালোবাসা দিয়ে ভেঙে ফেল।হাল ছাড়বি না কোনো।দরকার পরলে সারাজীবন চেষ্ট করবি।ভালোবাসলে তো মানুষ কতোকিছুই করে।তুইও হাল ছাড়িস না।’

অনিক ইহান কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল।তার ঠোঁটের কোণে হাসি।এতোক্ষনের খারাপ লাগা দূর হয়ে গিয়েছে।এখন ইহানের কথাগুলোও বাজছে। যে ভাবেই হোক সিয়াকে সে মানিয়েই ছাড়বে।হাল ছাড়বে না কোনো।
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৮
সময় বহমান।দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ।সবার জীবনের চলা গতি বেশ ভালোই।তবে ভালো কাটছে না ইহানের।তার মনটা আজকাল তার আয়ত্ত্বে নেই।মনটা যেন রিধির হয়ে গিয়েছে।নাহলে এই মন তাকে কেন বাধ্য করে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা রিধিকে নিয়ে ভাবতে?উঠতে,বসতে,খেতে,শুতে সবসময় শুধু রিধিই তার মাথায় ঘুরপাক খায়।কি করবে ইহান?কেন এমন হচ্ছে?এই প্রশ্নের উত্তরগুলো সে গত একসপ্তাহ যাবত খুঁজে চলেছে।কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি।মন মরা হয়ে ইহান বিছানায় উপুর হয়ে পরে আছে।সম্পূর্ণ মস্তিষ্কে তার রিধিই কিলবিল করছে।নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়ে মৃদ্যু আর্তনাদ করে উঠল ইহান।ঠিক তখনই রুমে ছেলের জন্যে কফি নিয়ে প্রবেশ করছিলেন মিনহা বেগম।ছেলের এমন অস্থির আর ছটফট আচড়ণ দেখে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন।কফির মগ টেবিলের রেখে।উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠেন,’ আব্বা?কি হয়েছে তোর?এমন করছিস কেন বাবা?’

বলতে বলতে তিনি ইহানের কাছে বসে পরলেন।তার সর্ব মুখশ্রীতে ছেলের জন্যে চিন্তার ছাপ।মায়ের চিন্তিত চেহারা দেখে ইহান নিজেকে খানিক দমিয়ে আনল।বলে উঠল,’ কিছু হয়নি মা।এমনিতেই ভালো লাগছে না।’
‘ কেমন লাগছে বল আমায়। আমি জানি তোর কিছু হয়েছে।আমি তো মা আমি সব বুঝি।তোরা মুখে না বললেও আমি বুঝে যাই।’

মায়ের কথায় হাসে ইহান।ঝলমলে সুন্দর হাসি।এগিয়ে এসে দপ করে মায়ের কোলে শুয়ে পরল।মিনহা বেগম ছেলের চুলে আদুরে স্পর্শ হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।ইহানের আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।সেভাবেই ধীর স্বরে বলে,
‘ মা আমি তোমাকে এখন কিছু বলব।আমার অস্থিরতার কারনগুলো বলব।তুমি শুধু আমায় কারনটা জানাবে কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে।’

মিনহা বেগম ইহানের চুল টেনে দিতে দিতে বলে,
‘ তুই বল।আমি যদি কোনো উপায় বলতে পারি।অবশ্যই আমি বলব।’

ইহান লম্বা শ্বাস ফেলল।এরপর বলতে শুরু করল,
‘ ইদানিং কি যেন হয়েছে মা।আমি তোমাকে সবটা ক্লিয়ার করেই বলছি।তুমি তো জানো অথৈ, রিধি,পিহু,প্রিয়ান,আহিদ ওরা ছোটো থেকেই একসাথে বড়ো হয়েছে।অথৈকে আমি যতোটা স্নেহ করি। আর ভালোবাসি ওদেরও ঠিক ততোটাই করি।কিন্তু ইদানিং আমার সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।রিধিকে আমি সেই ছোটো থেকেই দেখে আসছি।কিন্তু আগে কখনই এমন লাগেনি।তবে এখন রিধিকে নিয়ে আমি চব্বিশ ঘন্টা ভাবি।না ভাবতে চাইলেও আমার মন,আমার মস্তিষ্ককে যেন বাধ্য করে ওকে নিয়ে ভাবতে।তবে কি জানো ওকে নিয়ে ভাবতে আমার ভালোলাগে।মনের মাঝে আলাদা সুখ সুখ অনুভব হয়।ওকে নিয়ে ভাবলেই অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।আর জানক আগে মেয়েটা ঘনঘন আমাদের বাড়িতে আসত।আমার সাথে কথা বলত।কিন্তু রিধি এখন আর আসে না আর আমার সাথে কথা তো দূরে থাক।আমার দিকে তাকাও না।মেয়েটা কেমন যেন আমাকে ইগ্নোর করে।কিন্তু আমার কেন যেন ভালোলাগে না।একটুও ভালোলাগে না।ওর ইগ্নোরেন্স যেন আমার বুকের বা-পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়।অসহ্য লাগে সবকিছু।কি হয়েছে আমার মা?কেন হচ্ছে আমার সাথে এমন?আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।তুমি কোনো একটা উপায় বলো।’

একোনাগাড়ে মায়ের কাছে নিজের মনের কথাগুলো বলে যেন ইহান মনে শান্তি পেল।নিজের মাঝে লুকানো কথাগুলো ব্যক্ত করতে পেরে এখন বেশ ভালো লাগছে।কিন্তু মায়ের কোনো জবাব না পেয়ে ইহানের ভ্রু-কুচকে আসে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মিনহা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।ইহানের কুচকানো ভ্রু-জোড়া আরও কুচকে আসে।মায়ের কোল থেকে উঠে বসে পরল।বলল,’ কি হলো মা?তুমি হাসছ যে?আমি তোমাকে আমার এতো বড়ো একটা সমস্যার কথা বললাম।আর তুমি কিনা হাসছ?’

মিনহা বেগম এইবার স্বজোড়েই হাসছেন।হাসতে হাসতে তার চোখের কোণে পানি চলে এসেছে।মায়ের এমন হাসি দেখে মুখ ফোলালো ইহান বাচ্চাদের মতো।পরক্ষণে মায়ের এমন প্রাণখোলা হাসিতে ওর ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল।সময় নিয়ে মিনহা বেগম হাসি থামালেন।উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের হাতে কফির মগ ধরিয়ে দিলেন তিনি।মুচঁকি হেসে বলেন,’ তুই রিধিকে ভালোবেসে ফেলেছিস।এইটাই আমার জবাব আপাততো।আমার ছেলে প্রেমে পরেছে।এইবার বাকিটা তুই নিজেই বুঝে নেহ।আমি জানি আমার ছেলে বুদ্ধিমান আছে। এখন আসি আমি।’

মিনহা বেগম খুশি মনে চলে গেলেন।তিনি অনেক খুশি।এমনিতেও সে আর তার স্বামী ভেবেই রেখেছিলেন রিধিকেই তাদের একমাত্র ছেলের বউ করে আনবেন।আর এখন তো তার ছেলে রিধিকে ভালোইবেসে ফেলেছে।তাদের আর কোনো চিন্তা নেই।রিধির পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে।ওদের বাগদানটা যতো দ্রুত সম্ভব সেরে ফেললেই ভালো হবে।ভেবেই তিনি মুচঁকি হেসে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
————-
এদিকে ইহান তব্দা মেরে বসে আছে।তার মা একটু আগে তাকে এসব কি বলে গেল?তার বিষয়টা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।সত্যিই কি ও ভালোবাসে রিধিকে?কিন্তু কিভাবে সম্ভব?ইহান আনমনা হয়ে অনেকক্ষণ নিজের মনে কি কি যেন ভাবল।সময় নিয়ে ভাবার পর হঠাৎ তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত কর হেসে বলে,’ ভালোবাসি।হ্যা আমি রিধিকে ভালোবাসি।আমি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছি।থ্যাংক ইউ মা।ইউ আর দ্যা বেস্ট মা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

ইহান খুশিতে নাঁচতে নাঁচতে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেস হতে।
______________
বাইক পার্ক করে মাত্রই ভার্সিটিতে প্রবেশ করল রুদ্রিক।হঠাৎ ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজন।রুদ্রিক ব্যক্তিটিকে দেখার পর পর ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসল রাগে।শক্ত চোখে চেয়ে রইলো ব্যক্তিটির দিকে।রাগে ব্যক্তিটির পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পা বাড়াল সে।এখন এখানে কোনো ঝামেলা সে চায় না আপাততো।কিন্তু তা আর হতে দিলো না। ব্যক্তিটি আবারও এসে দাঁড়ালো রুদ্রিকের সামনে।রুদ্রিক এইবার রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল।বলল,’ কি সমস্যা?তোকে না বলেছি আমার সামনে আসবি নাহ? শান্তিতে থাকতে বুঝি তোর ভালো লাগে না রিয়ান।’

রিয়ান হাসল।বলে উঠল,’ অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয় না।তাই শান্তি পাচ্ছিলাম না এইজন্যেই আসলাম তোর কাছে।আর এটা কেমন ব্যবহার রুদ্রিক?আমি না তোর বড়ো ভাই?বড়ো ভাইকে কেউ তুই করে বলে?’

রুদ্রিক দাঁতে দাঁত চিপে বলে,’ তুই আমার আপন ভাই না।ফুপাতো ভাই।আর এমনিতে তোকে আমি কোনোরকমই কোনো ভাই মানি না।তাই এইসব ফাউল কথাবার্তা আমার সামনে বলবি নাহ।’

রিয়ান এগিয়ে আসল খানিক।ধীর স্বরে বলে,’ তুই আমায় ভাই না মানলে কি হবে?আমি তো মানি।তাই তো তোর সব খবরাখবর রাখি আমি।এইযে তুই লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিস সেটাও জানি আমি।’

রুদ্রিক কিছুই বলল না।সে ভীষণ বিরক্ত রিয়ানের উপর।তার ফুপুর ছেলের ছেলে,মেয়ে দুটোর একটাও তার দেখতে মন চায় না।জেনি আগে ভালো ছিলো।তাই তো রুদ্রিক টুকটাক ওর সাথে মিশত।কিন্তু এই রিয়ান জেনিকে বাজে পথে নিয়ে গিয়েছে। একেবারে নিজের মতো বানিয়েছে বোনটাকে।যাই হোক রুদ্রিক অহেতুক তর্কে জড়াতে চায় না রিয়ানের।তাই চলে যেতে নিলো।কিন্ত রিয়ানের হঠাৎ একটা কথায় থেমে গেলো ওর পা জোড়া।

‘ ফার্স্ট ইয়ার,ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট।নাম জাফ্রিন অথৈ। তোর বউ,কি? ঠিক বলছি নাহ?যাই বলিস বউ পেয়েছিস একটা সেরা।রূপেরও যেমন আগুন আছে,কথাও তেমন আগুন।হটনেসে একেবারে ঠাসা ঠাসা।আমার কিন্তু হেব্বি লেগেছে। ফিগারটাও জোস।’

রিয়ান কথাটা শেষ করতে দেরি।রুদ্রিক শক্তপোক্ত হাতের জোড়ালো ঘুষি একেবারে ওর নাক বরাবর এসে পরেছে।রিয়ান পরতে পরতে নিজেকে সামলে নিলো।দুহাতে নাক চেপে ধরল সে।বেশ জোড়েসোড়েই মেরেছে রুদ্রিক।মাথাটা ভণভণ করে ঘুরছে।হাতে তরল জাতীয় কিছু আভাস পেতে হাতটা চোখের সামনে এনে ধরল রিয়ান।ঝাপ্সা দৃষ্টিজোড়া সময় নিয়ে স্পষ্ট হতেই বুঝতে পারল।রুদ্রিকের ঘুষির প্রখরতায় তার নাক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।
এদিকে অথৈকে নিয়ে বলা রিয়ানের বাজে কথাগুলো শুনে রাগে রুদ্রিকের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।তেড়ে গিয়ে রিয়ানের কলার চেপে ধরল।ভয়ংকর রাগিস্বরে বলে উঠল,’ আমার বউয়ের দিকে বাজে নজরে তাকালে তোর ওই চোখজোড়া আমি আগুনে জ্বালিয়ে দিবো।আমার অথৈয়ের থেকে একশ হাত দূরে থাকবি।নয়তো তোকে মেরে মাটিতে পুতে ফেলব।কাক পক্ষিও টের পাবে না।’

রিয়ানকে প্রায় একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ফেলে রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেল রুদ্রিক।রুদ্রিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রিয়ান শয়তানি হাসি দিলো।বলে,’ নজর তো আমার বহু আগেই পরেছে।আমিও দেখি তুই ঠিক কিভাবে তোর বউকে প্রটেক্ট করিস।শুধু তোর বউকে নিয়ে কিছু কথা বলায় আমার গায়ে হাত তুললি।একদিন গোটা তোর বউটাই আমার কাছে থাকবে।ঠিক এতোটাই কাছে।যতোটা কাছে থাকলে তুই রুদ্রিক।তোর বুক কেঁপে উঠবে।এর প্রতিশোধ তো আমি নিবোই।’

__________
রুদ্রিক কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না।তীব্র রাগে মন চাচ্ছে ওই রিয়ানকে এখনই মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। তবে বোধহয় একটু শান্তি পাবে। রুদ্রিককে এতোটা রাগতে দেখে নীল বলে উঠল,’ কি হয়েছে তোর?এমন রেগে আছিস কেন?’

রুদ্রিক রাগে সজোড়ে ওর বাইকে একটা থাবা মারল।এতে বিকট শব্দ হলো।চমকে গেল ওরা।অনিক দ্রুত এসে রুদ্রিকের হাত ধরল।চিন্তিত স্বরে বলে,’ সালা কি করছিস?কার না কার উপর রেগে নিজেকে আঘাত করছিস কেন?’

রুদ্রিক হাত ছাড়িয়ে নিলো অনিকের কাছ থেকে।দু হাতে মাথার চুলগুলো খামছে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,’ ওই কুত্তার*** সাহস কিভাবে হলো আমার অথৈকে নিয়ে বাজে কথা বলার।ওর জিভ টেনে ছিড়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।কিন্তু আমি তা করতে পারছি না।আই’ম ফিলিং সো হ্যাল্পল্যাস।কেন ওকেই আমার কাজিন হতে হলো?শুধু মাত্র দাদুর কারনে আমি নিজেকে দমিয়ে রেখেছি।নাহলে আমি ওকে সেখানেই জিন্দা কবর দিয়ে ফেলতাম।তবে এটাই ফার্স্ট আর এটাই লাস্ট। সেকেন্ড টাইম ওকে আমি ছাড়ব না।সবকিছু ভুলে যাবো আমি।ওকে খুন করে তবেই শান্ত হবো।’

ইহান রুদ্রিকের কাধে হাত রাখল।শান্ত স্বরে বলে,’ রিলেক্স রুদ্রিক।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নে।কি হয়েছে আমাদের খুলে বল।’

রুদ্রিক জোড়েজোড়ে নিশ্বাস নিলো।তারপর একে একে সবটা খুলে বলল ওদের।সব শুনে ইহানেরও রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।কিন্তু ও কিছু বলল না।কারন রুদ্রিক বলল তো ওই শয়তানটাকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে।তবে দ্বিতীয়বার এমন কিছু শুনলে রুদ্রিকের আগে ইহান নিজে গিয়েই ওই রিয়ানকে কুপিয়ে মেরে আসবে।

এদিকে সব বলা শেষে।রুদ্রিক রাগে চোয়াল শক্ত বলে উঠে,’ অথৈ ইজ মাইন।ওকে আমি আমার সবটা দিয়ে প্রটেক্ট করব। আর ওই জানোয়ারটাকে তো দেখে নিবো।আমার অথৈয়ের দিকে হাত বাড়ানোর কথা স্বপ্নেও পরিকল্পনা করলে।ওর সেই হাত আমি ভেঙে দিবো। বাস্তবে করবে তো দূরে থাক।তুই চিন্তা করিস না ইহান।’

ইহান হালকা হাসল রুদ্রিকের কথায়।বলে,’ আমি জানি সেটা রুদ্রিক।এইজন্যেই তো আমার বোনটাকে বিনাবাক্যে তোর হাতে তুলে দিয়েছি। ‘

সাফাত ব্যথিত নজরে রুদ্রিকের দিকে তাকিয়ে।কিন্তু ঠোঁটের কোণে তার মুচঁকি হাসি।রুদ্রিকের কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়া প্রতিবার ‘ আমার অথৈ।’ শব্দ দুটো বড্ড পীড়া দিচ্ছে ওকে। বুকের বা-পাশটা অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে।আচ্ছা, এক তরফা ভালোবাসায় কি এতোটাই যন্ত্রণা থাকে?কেন যে সে ভালোবাসতে গেল।ভালোবাসায় এতো কষ্ট থাকলে কখনই ভালোবাসত না সাফাত অথৈকে। কিন্তু মনকে কি বেঁধে রাখা যায়? মন তো যখন তখন যাকে তাকে হঠাৎই ভালোবেসে ফেলে।এখানে কারও কোনো হাত থাকে না।সাফাত চোখ বুজল।লম্বা শ্বাস ফেলল।পর পর ওর বদ্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল রুদ্রিক আর অথৈয়ের হাস্যজ্জ্বল একসাথে দাঁড়ানো একটা মুহূর্ত। যা কল্পনা করে সাফাতের ঠোঁটের কোণেও চমৎকার হাসি ফুটে উঠল।আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাল সাফাত।তার প্রিয় দুটি মানুষ যদি একে অপরের সাথে থেকে,একে অপরকে ভালোবেসে সুখে থাকে।তাহলে সে নিজেও সুখী।সবকিছু পেয়ে গেলেই যে সে সর্বসুখী এমনটা ভাবা বোকামি।মাঝে মাঝে কিছু ত্যাগ করলেও সুখী।হওয়া যায়।আর সেই ত্যাগে যদি তারই প্রিয় মানুষ দুটি সুখী হয়।তাহলে তো কোনো কথাই নাই।তাহলে এই সুখের থেকে বড়ো সুখ আর কিছু হতেই পারে না।আর তাই সাফাত নিজেও সুখী।অনেক সুখী।
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৯
ভার্সিটির পিছনের সেই নদীর পাড়ে এসে বসে আছে অথৈ প্রায় দশমিনিট যাবত।কিন্তু রুদ্রিকের কোনো খবর নেই।অথৈ বসে বসে অপেক্ষা করছে।কারন মাঝে মাঝেই রুদ্রিক এরকম পাঁচ দশ মিনিট দেরি করে আসে।অথৈ আনমনে রুদ্রিককে নিয়ে ভাবছে।তার সবসময় রুদ্রিককে নিয়ে ভাবতে ভালোলাগে।লোকটা যেন তার সবটা গ্রাস করে নিয়েছে।চব্বিশ ঘন্টা যেন মন মস্তিষ্কে এই লোকটারই বসবাস।মুচঁকি হেসে ঘড়ির দিকে তাকালো অথৈ। পনেরো হুয়ে গিয়েছে।এখনও আসছে না কেন লোকটা?বিরক্ত হয়ে অথৈ মোবাইল অন করে রুদ্রিককে কল দিতে যাবে ঠিক তখনই ওর মোবাইলে একটা মেসেজ আছে।আর মেসেজটা রুদ্রিকই করেছে।অথৈ চট জলদি মেসেজটা ওপেন করল।

‘I’m waiting in my car. Come quickly. I need you badly.’

মেসেজটা পড়ে অথৈয়ের বুক কেঁপে উঠল।কি হলো লোকটার?কোনো বিপদ হলো না তো?নানান চিন্তা নিয়ে অথৈ ছুট লাগালো রুদ্রিকের কাছে যাওয়ার জন্যে।রুদ্রিকের গাড়িটা কার পার্কিং সাইটে অন্যসব পার্ক করা গাড়িগুলোর থেকে বেশ দূরে।সে বাইক নিয়েই এসেছিলো।সকালের ওই ঘটনার পর ওর বাড়ির একজন ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছিলো।আর সে আসতেই ওর বাইকটা তাকে দিয়ে দিয়েছিলো।কারন তার প্লানিং অথৈ নিয়ে দূরে কোথাও যেতে।একান্ত কিছু সময় কাটাতে।নিরিবিলি কোন জায়গায়।আর তার মন মেজাজ ভালো না এমনিতেই।বাইক চালানোর মতো মুডও ওর নেই।এতে রিস্ক হয়ে যেতে পারে।আর অথৈকে নিয়ে কোনোপ্রকার রিস্ক রুদ্রিক নিবে না।

অন্যদিকে অথৈ পার্কিং এরিয়ায় এসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।সে মূলত রুদ্রিকের গাড়ি চিনে না।সবসময় রুদ্রিককে বাইক নিয়েই আসতে দেখেছে।কিন্তু আজ হঠাৎ লোকটার কি হলো কে জানে?গাড়ি দিয়ে কি করবে এই লোক? এর মধ্যে ওর ফোনে আবারও মেসেজ আসে।

‘Look to your right side. There is a gray car. I am in that car.’

মেসেজটা পড়ে অথৈ সেই কথামতো ওর ডানদিকে তাকালো।সেখানে একটা ধূসর রঙের গাড়ি আছে।অথৈ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেই গাড়ির দিকে।গাড়ির কাছে আসতেই গাড়ির দরজা খুলে গেলো।অথৈ ভীতরে উঁকি দিয়ে দেখে রুদ্রিক কপালের উপর হাত রেখে ড্রায়ভিং সিটে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে।রুদ্রিককে এমন অবস্থায় দেখে অথৈয়ের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিলো।হঠাৎ রুদ্রিকের গম্ভীর স্বর ভেসে আসল,

‘ what are you looking for?just get in the car quickly.’

অথৈ হকচকিয়ে গেল।তারপর তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে ঢুকে বসে পরল।অথৈ গাড়িতে এসে বসতেই রুদ্রিক কপালের উপর থেকে হাত সরালো।তারপর সোজা হয়ে বসে একেবারে অথৈয়ের দিকে ঘুরে বসল।রুদ্রিকের চোখের দিকে তাকাতেই অথৈয়ের বুকটা ধ্বক করে উঠল।কারন রুদ্রিকের চোখজোড়া অসম্ভব লাল হয়ে আছে।অথৈ ঘাবড়ে গেলো।চটজলদি হাত ছোঁয়ালো রুদ্রিকের গালে।উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,’ কি হয়েছে আপনার?এমন দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?’

রুদ্রিকের কোনো জবাব নেই। সে এক দৃষ্টিতে অথৈকে দেখছে।রুদ্রিকের কোনো জবাব না পেয়ে অথৈ আবারও বলে উঠে,’ কি হয়েছে?কিছু বলছেন না কেন?মাথা ব্যথা করছে আপনার?বেশি খারাপ …..!’

বাকিটুক আর বলতে পারল না অথৈ। তার আগেই রুদ্রিক অথৈয়ের বাহু ধরে টেনে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে আসে।নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওকে।এদিকে রুদ্রিকের এমন কান্ডে চমকে যায় অথৈ। পরক্ষণে রুদ্রিকের এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরার কারনে হাশফাশ করে উঠে।এতো জোড়ে চেপে ধরায় সে শ্বাস নিতে পারছে না।অথৈ বহু কষ্টে রুদ্রিকের পিঠে আলতো করে দু হাত রাখে।আটকে আসা স্বরে বলে,’ রু..রুদ্রিক! একটু আস্তে ধ..ধরুন।শ্বাস নিতে পারছি না আমি।’

অথৈয়ের কথায় রুদ্রিক একটু ঢিলে করে ওর হাতের বাঁধন। তবে অতোটাও না।এভাবে কিছু সময় থেকে ছেড়ে দেয় অথৈকে।রুদ্রিকের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে অথৈ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগল। বুকে হাত চেপে শ্বাস নিতে নিতে অথৈ বলে,’ এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে?যেভাবে চেপে ধরেছিলেন মনে হচ্ছিলো আমার হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে গুড়ো হয়ে যাচ্ছিলো।আর একটু হলে আমি উপরে চলে যেতাম।’

রুদ্রিক গাড়ি স্টার্ট করতে করতে অথৈয়ের কথার জবাবে বলে,’ অভ্যাস করে নেও।কারন ভবিষ্যতেও আমি এইভাবেই জড়িয়ে ধরব।আর যখন আমার কাছে একেবারে নিয়ে আসব।তখন তো কোনো টাইম টেবিল মেইনটেইন করব না।চব্বিশ ঘন্টাই তোমাকে আমার সাথে লেপ্টে থাকতে হবে।’

অথৈয়ের গাল,কান গরম হয়ে উঠল রুদ্রিকের এহেন কথায়।দুগালে হাত চেপে ধরল অথৈ। মিনমিন স্বরে বলে,’ অসভ্য লোক।যতোসব বেঁফাস কথাবার্তা তার।এদিকে আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম।আর সে আছে শুধু অসভ্য কথাবার্তা বলার ধান্দায়।’

রুদ্রিক আচমকা অথৈয়ের কাছে চলে আসল।এতে অথৈ চমকে গিয়ে গাড়ির জানালার সাথে মিশে গেল।বলে উঠল,’ ক…কি করছেন?’

রুদ্রিক অতি সাবধানে অথৈয়ের সিট বেল্ট বেঁধে দিলো।তারপর সরে আসল অথৈয়ের কাছ থেকে।ভ্রু-কুচকে অথৈয়ের উদ্দেশ্যে বলে,’ মাথায় শুধু আমাকে নিয়ে এসব উল্টাপাল্টা ভাবতে থাকো তাই নাহ?’

পরক্ষণে চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠে ওর।বলে,’ অবশ্য তুমি চাইলে এতোক্ষণে তুমি যা কল্পনা করছিলে।তা আমি এখন করতে পারি।আই হেভ নো প্রবলেম।’

অথৈয়ের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল রুদ্রিকের কথায়।এই লোক তো গিরগিটির থেকেও বেশি নিজের রূপ বদলায়।
অথৈ সোজা হয়ে বসল।তারপর মুখ ফুলিয়ে বলে,’ আমি কোনো কিছুই ভাবছি না।আপনার ভীতরেই সব সমস্যা।আমাকে শুধু শুধু দোষ দিবেন না।মাথায় শুধু তার অসভ্য চিন্তা ভাবনা ঘুরে শুধু।’

অথৈয়ের মুখ ফোলানো দেখে রুদ্রিক নিঃশব্দে হাসে।এই মেয়েটা তার আশেপাশে থাকলেই তার সকল দুশ্চিন্তা, সকল ক্লান্তি,মন খারাপ নিঃশেষ হয়ে যায়।চারদিকে শুধু ভালোলাগার প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে থাকে।মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলেই মনে হয় যেন সে পৃথিবীর সকল সুখ পেয়ে গিয়েছে ও।

এদিকে রুদ্রিকের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠা সেই হাসি দেখে অথৈর ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল।একটু আগে কি হয়েছিলো লোকটার সে জানে না।কিন্তু রুদ্রিকের ওমন রূপ দেখে তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠেছিলো।তবে এখন ভালো লাগছে।এইযে লোকটার ঠোঁটে হাসি। এটা দেখে যে অথৈয়ের কি যে শান্তি লাগছে তা ও নিজেই শুধু জানে।
ড্রায়ভিংয়ের মাঝেই হঠাৎ রুদ্রিক হাত বাড়িয়ে দিলো অথৈয়ের দিকে।অথৈ হেসে বিনাবাক্যে রুদ্রিকের হাতে হাত রাখল।রুদ্রিক অথৈয়ের হাত নিজের হাতের মাঝে শক্ত করে ধরল।এইভাবেই পুরোটা পথ পারি দিলো তারা।রুদ্রিক গাড়ি থামালো একটা নির্জন রাস্তায়।রাস্তার দুধারে শুধু বড়ো বড়ো করে মেহগনির গাছের বাগান।রুদ্রিক নেমে আসল।তারপর ঘুরে গিয়ে অথৈকেও নামতে সাহায্য করল নামতে।অথৈ শুধু চারদিকে তাকাচ্ছে।এরকম জায়গা যে আছে অথৈ জানত না।রুদ্রিক অথৈয়ের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে,’ চলো আমার সাথে।’

অথৈ কোনো প্রশ্ন করল না।হাটতে লাগল রুদ্রিকের সাথে।রুদ্রিক অথৈকে নিয়ে বামপাশের জঙলে নেমে পরল।এরকম বাগানে প্রবেশ করতে অথৈয়ের মনে প্রশ্নেরা উঁকিঝুকি দিতে থাকে।এই বাগানের ভীতর দিয়ে এই লোক যাচ্ছেটা কোথায়?মনের কৌতুহল দমাতে না পেরে অথৈ প্রশ্ন করে বসে,’ কোথায় যাচ্ছেন আপনি?এমন জঙলের মাঝে যাচ্ছেন কেন?’

রুদ্রিক হাটতে হাটতেই গম্ভীর গলায় বলে,’ কেন ভয় লাগছে আমার সাথে যেতে?তোমাকে নিয়ে গিয়ে গভীর জঙলে কিছু উল্টাপাল্টা করে। তোমাকে মেরে ফেলি। এমন কিছুর ভয় পাচ্ছ?’

রুদ্রিকের এমন কথা শুনে অথৈ আচমকা তার চলন্ত পা জোড়া থামিয়ে দেয়।অথৈয়ের হাত ধরে হাটছিলো রুদ্রিক।অথৈ থেমে যাওয়ায় তাকেও থামতে হয়।পিছনে ফিরে তাকাতেই রুদ্রিক থমকে যায়। অথৈয়ের চোখজোড়া ছলছল করছে।রুদ্রিক যে এমন একটা কথা এইভাবে তাকে বলবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি।সে তো এমনেই জানতে চেয়েছিলো যে তারা কোথায় যাচ্ছে।রুদ্রিক তা উলটো বুঝল।কিসব বলে বসল।যা অথৈ স্বপ্নেও কখনও ভাববে না।অথৈ অনেক কষ্ট পেয়েছে।এতোদিনে রুদ্রিক তাকে এই চিনল?কই সে তো রুদ্রিককে নিয়ে এসব ভাবে না।ও তো চোখ বন্ধ করে লোকটাকে বিশ্বাস করে।নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে।অথৈ অনেক কষ্ট পেয়েছে রুদ্রিকের এমন কথায়।অথৈয়ের চোখ থেকে একফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।যা দেখে রুদ্রিক অস্থির হয়ে উঠে।অথৈ কাছে এসে ওর গালে দু হাতে আলতো করে স্পর্শ করল।ব্যাকুল কণ্ঠে বলে,’ কি হয়েছে অথৈ? কাঁদছ কেন?হাটতে নিয়ে কি ব্যথা পেয়েছ?’

অথৈ ঝটকা মেরে রুদ্রিকের হাত দুটো সরিয়ে দিলো।এতে অবাক হয়ে যায় রুদ্রিক।অথৈ সেদিকে পাত্তা দিলো না।
ও চোখের পানিটুক মুছে নিলো।তারপর বিনাবাক্যে উলটো দিকে পা বাড়ালো চলে যাবার জন্যে।এতে যেন ঘাবড়ে গেল রুদ্রিক।দৌড়ে গিয়ে অথৈয়ের বাহু আকঁড়ে ধরল।এতে যেন অথৈ আরও ক্ষেপে গেল।রাগি চোখে তাকাল রুদ্রিকের দিকে।রাগি গলায় বলে,’ আমার হাত ছাড়ুন।’
‘ কিন্তু কে কি হয়েছে?’
‘ আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।’
‘ আরে কারনটা তো বলবে আমায়?’

অথৈ রুদ্রিকের হাত সরিয়ে দিলো ওর বাহু থেকে।পর পর চেঁচিয়ে উঠে,’ আপনি কিভাবে পারলেন ওমন জঘন্য কথাগুলো বলতে।আমাকে নিয়ে এসবই ভাবেন আপনি।এতোদিনে এই চিনলেন আমায়?আপনি ভাবলেন কিভাবে আপনি আমাকে এখানে এনেছেন তাই আমি ওইসব চিন্তা ভাবনা করব।আরেহ আপনি যদি আপনার সাথে আমাকে জাগান্নামেও নিয়ে যেতেন তাও আমি আপনার সাথে চোখ বন্ধ করে চলে যেতাম।আমি তো শুধু এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।আর আপনি আমাকে নিয়ে কিসব ভেবে নিলেন।আর এক মিনিটও আমি আপনার সাথে থাকব না।আমি এক্ষুণি বাড়ি চলে যাবো।’

কথাগুলো বলে শেষ করে অথৈ হনহনিয়ে হাটা ধরল। সে চলে যাবে।এদিকে রুদ্রিক নিজেই হতভম্ব হয়ে পরেছে।ও নিজেও ওইভাবে মিন করে কথাগুলো বলেনি।যে অথৈ কষ্ট পাবে।সে এমনিতেই মজা করে বলে ফেলেছে।কিন্তু অথৈ যে এতোটা কষ্ট পাবে যে ও কেঁদে দিবে।এটা ভাবেনি।নাহ,মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে।রুদ্রিক দৌড়ে চলে গেল অথৈয়ের কাছে।কোনোকিছু না বলে অথৈকে পিছন দিক থেকেই পাঁজাকোলে তুলে নেয়।আচমকা রুদ্রিক এমন করায় অথৈ ভয়ে মৃদ্যু চিৎকার করে উঠে।পর পর বুঝতে পারে এটা রুদ্রিকের কাজ।সাথে সাথে রুদ্রিকের কোলে ছটফট শুরু করে দেয়।চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়,’ নামান আমাকে।নামা বলছি অসভ্য লোক।আমায় একদম স্পর্শ করবেন না।’

রুদ্রিকের কোনো ভাবান্তার নেই।সে একমনে অথৈকে কোলে নিয়ে হেটে যাচ্ছে।এদিকে ছটফট করে,চিল্লাপাল্লা করে অথৈ ক্লান্ত হয়ে চুপ করে রইলো রুদ্রিকের কোলে।এই বজ্জাত লোক যে তাকে আর কোল থেকে নামাবে না সে ভালোই বুঝতে পেরেছে।তবে ওর নিজেরও বেশ ভালো লাগছে রুদ্রিকের কোলে উঠে।এই প্রথমবার লোকটা ওকে কোলে তুলেছে। অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।অথৈ আনমনে আরও লেপ্টে গেল।রুদ্রিকের প্রসস্ত বুকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো।রুদ্রিকের উষ্ণতায় নিজেকে সপে দিতে চাইছে যেমন।রুদ্রিক হাসল অথৈয়ের কান্ডে।মেয়েটা তার সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতেই পারে না।সেটা সে নিজেও জানে না।এভাবে অনেকটা পথ হাটার পর রুদ্রিক জঙলের মাঝে হঠাৎ থেমে গেল।পর পর অথৈকে থামিয়ে দিলো।রুদ্রিকের কোল থেকে নেমে অথৈ সামনে তাকাতেই ওর চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে যায়।চোখে মুখে অবাকের রেশ তার।

#চলবে___________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here