#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ৮
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা
ঝুমঝুমিয়ে সন্ধ্যা নামলো। রিপ কবে ফিরবে সে আশায় নীরা বাড়ির একোণওকোণ ঘুরছিল। মুনা তার ঘুরাঘুরি দেখে বলল
তোর বর পালিয়েছে। দেখবি রাত করে ফিরবে।
নীরা বলল
বললেই হলো নাকি? আমি আর আধঘন্টা অপেক্ষা করব তারপর আমি বসবো না। নিজে নিজে চলে যাব। আম্মা বকলে বকুক।
রিপ এল তাও সাতটায়। হাতে আকাশী রঙের একটা প্যাকেট।
নীরা তখন বেশ ক্ষেপে গিয়েছে। রিপ ঘরে ঢুকে তার পাশাপাশি গিয়ে বসলো। পিনপতন নীরবতা ভেঙে দিয়ে বলল
একটা জায়গায় গিয়েছি। তুমি এখনো শাড়ি পাল্টাওনি কেন? এখনো জেদ ধরে বসে আছ?
নীরা রুদ্ধকন্ঠে বলল
আমার কোনোকিছুই আপনি পাত্তা দেন না। না ভালো কথা, না জরুরী কথা, না কোনো আবদার। আপনি কি রোবট?
আমি আবার কি করেছি?
নীরা বোরকা টেনে নিল। গায়ে দিতে যেতেই রিপ সেটি নিয়ে ফেললো। বিছানায় রাখা প্যাকেট থেকে একটা পলিথিন বের করলো। সেখানে রঙিন কিছু দেখা যাচ্ছে। নীরা চেয়ে রইলো। রিপ একটা কমলা আর একটা সবুজ রঙের আইসক্রিম বের করলো। সাথে একটা পাঁচশ টাকার নোট।
সব দেখিয়ে বলল
এবার বলো কি চাও তুমি? আইসক্রিম, জরিমানা? নাকি আমাকে?
চিরন্তন সত্য এটাই নীরা এই পুরো পৃথিবীতে শুধু তাকেই চেয়েছিল। অথচ সেটি তার বলা হলো না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো সে। জানতে ইচ্ছে হলো আপনাকে চাইলে কি পুরোটাই দিয়ে দেবেন? কিন্তু চাইলেই সব জিজ্ঞেস করা যায় না।
সে বোরকাটিকে বেছে নিল। বলল
আমি সত্যিই বাড়ি যাব। আমাকে দিয়ে আসুন।
রিপ এবার তাকে অবাক করে দিয়ে বলল,
আচ্ছা। আইসক্রিম দুটো খাও। তারপর বোরকা পড়ো। আমি মুখ হাত ধুঁয়ে শার্ট পাল্টাবো।
বলেই রিপ তার কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। নীরার চোখ ফুঁড়ে একফোঁটা জল গড়ালো। যার উপর রাগে অভিমানে সে বাড়ি ছাড়ছে সে নিজেই তাকে এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। ভারী অদ্ভুত তার জীবন!
আইসক্রিম দুটো সে মুনাকে দিয়ে এসেছে। মুনা ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। কে খাবে ওগুলো।
রিপ আসতেই নীরা বোরকা হাতে নিল।
অথচ তখনও মনে হলো রিপ তাকে আটকাবে। বলবে আরেকবার বোরকা নিলেই সেটিতে আগুন লাগিয়ে দেব। অথচ কিছুই বলল না।
নীরা বোরকা পড়ে বের হয়ে গেল। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর মুনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরুলো। রিপ এসে তার হাত কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে ফেললো। বলল
আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো কিন্তু বাড়িতে যাব না। তোমার বাবা আমাকে আবার থাকার জন্য অনুরোধ করবে। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের অনুরোধ ফেলতে পারিনা।
নীরা কিছু বলল না। তারা গাড়িতে উঠলো। পাশাপাশি বসলো অথচ কোনো কথা হলো না।
রিপ পথিমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে মিষ্টান্ন আর কিছু ফলমূল কিনলো। নীরার জন্য একটা আইসক্রিম বক্সও কিনে নিল সাথে। পানসুপারি আর নীরার এই কয়দিনের হাত খরচের জন্য তিন হাজার টাকা। নীরা হা না কিছু বললো না।
নীরার বাড়ি চলে আসলো। নীরা ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই রিপ বলল
তুমি যাও। তুমি বাড়ির দরজা পার হলে আমি চলে যাব।
নীরা একটা কথাও বললো না। রিপ ভারী আশ্চর্য হলো এই ভেবে মেয়েটা একবারও বললো না আপনিও আসুন।
____________________
জর্জ সালাউদ্দিন কাদেরের অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরলো রিপ। কালকের কেসটার হারা-জিত নিয়ে চিন্তায় ভুগছে সে। সে হেরে গেলে একটা দুঃস্থ মানুষের সাথে বড়ই অন্যায় হবে সমাজের তথাকথিত রাঘব বোয়ালরা পার পেয়ে যাবে। কেসটার এসপারওসোর হোক। নীরাকে সে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনবে।
তালহা বেগম এসে বলল
কি রে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি?
ওদের বাড়িতে যাইনি আমি।
এ কি কথা! যাসনি মানে? তুই ওদের নতুন জামাই। মেয়েটাকে এভাবে ছেড়ে এলি? কি মনে করবে ওরা?
কিছু মনে করবেনা মা। উনাদের মেয়ে বুঝিয়ে বলবে।
রিপ হেঁটে ঘরে চলে গেল। ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে। তার ঘর এমন অগোছালো থাকে না। আজ নীরা অগোছালো করে দিয়ে গেছে। বিছানায় পড়ে আছে ছাদের শুকনো কাপড়চোপড়ের স্তূপ। সব নীরার কাপড়চোপড়। সে শাড়ি, পেটিকোট,ব্লাউজ কুড়িয়ে নিল। ভাঁজ করে রেখে দিল ওয়ারড্রবে। দেখতে পেল ড্রেসিং টেবিলে রাখা চিরুনিতে নীরার
চুল লেগে রয়েছে। মেয়েটা এত অমনোযোগী ছিল আজ! ফ্লোরে একটা চুড়ি। হয়ত নতুন চুড়ি পড়েছিল! তাও এমন কেউ করে? সারাঘরে নীরার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একেকটা জিনিস খুঁজে পেল রিপ শুধু নীরাকেই পেল না।
______________
শাড়ি পাল্টে সেলোয়ার-কামিজ গায়ে দিল নীরা। আসার পর থেকে নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। মা জেঠিরা হাজারটা প্রশ্ন করছে। বাড়িতে ফুপুও এসেছে। উনি চেয়েছিলেন আজ ভাইঝি জামাইয়ের সাথে বসে ভালোমন্দ দুটো কথা বলবেন। সেটা হলো না বিধায় উনি নীরাকে বকেছেন এই বলে কেমন মেয়ে তুই গাট্টিভরে নাশতাটাশতা নিয়ে এলি আর জামাইটাকে আসতে বললি না। নীরা কিচ্ছু বলেনি। মা কিছু আঁচ করতে পারলেও মুখ ফুটে কিছু বললেন না। সবার সাথে তিনিও বলে গেলেন মেয়ের দোষ।
নীরার বাবা নওফুজ শিকদার বাড়ি ফিরে শুনতে পেলেন উনার রাজকন্যা বাড়ি এসেছে। খুশিমনে মেয়ের ঘরের দিকে যেতে যেতে ডাকলেন
আরেহ আমার নীরা মা এসেছে। কই রে তুই। বাবার বাড়িতে এসে কেউ এভাবে লুকিয়ে থাকে।
বাবার গলা শুনে নীরা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বাবার বুকে ঢেউয়ের মতো আঁছড়ে পড়লো কেঁদে উঠে ডাকলো
বাবাহ।
মেয়ের ডাকে বাবা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মাথার চুলে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললে
আরেহ আমার মা কেন কাঁদছে? তুই আসবি সেটা বাবাকে একবার বলবি না? আর তোর সাহেব কোথায়?
আসেনি।
ওমা। কেন আসেনি?
আমি আসতে বলিনি।
কেন বলিসনি?
শুরুতেই বলে দিয়েছে আমি তোমাদের বাড়িতে যাব না। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো। আমি জোর করতাম?
দাঁড়া আমি ফোন করি। আজ ছেড়ে কথা বলব ব্যাটাকে। আমার মাকে কষ্ট দেয়?
নীরা বলল
নাহ ফোন দেবে না। কোনো দরকার নেই। তুমি যদি ফোন দাও আমি তোমার সাথে একটা কথাও বলব না বাবা।
আরেহ আরেহ এভাবে বলতে নেই নীরা মা।
বলব।
কিছু হয়েছে কি?
নীরার বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। বলল
আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। নইলে আমি চলে যাব।
বাবা হেসে উঠে মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে বললেন
আমার পাগল মেয়ে। আচ্ছা ফোন করলে বলিস কাল যেন আসে। আমার একটামাত্র মেয়ের জামাই সে। এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার? আজ না হোক কাল তো আমি বলবই। যাইহোক এবার বল, তুমি কেমন আছিস?
নীরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল
খুব ভালো।
আমি তোকে ভালো ছেলের হাতেই দিয়েছি। খারাপ থাকার প্রশ্নই উঠে না। এবার বল কি কারণে তুই কষ্ট পেয়েছিস? যার জন্য এভাবে কাঁদছিস? আমি বিয়ের দিন তাকে বলেছিলাম তোকে কাঁদালে প্রত্যেকটা চোখের পানির হিসেব নেব আমি। ভালো ছেলেটা তোকে কাঁদিয়েছে?
না বাবা। আমার ভাগ্য খারাপ। আমার ভাগ্যই আমাকে কাঁদাচ্ছে।
তাহলে নিয়তির উপর ভরসা রাখ। এই ভাগ্যই একদিন তোকে হাসাবে। তুই এতই হাসবি যে কাঁদতে ভুলে যাবি।
______________
আদালতের গুমোট পরিবেশ থেকে ছাড়া পেতেই একমুহূর্তের জন্য ফোঁস করে শ্বাস ফেললো রিপ। মক্কেলের মেয়েটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে রিপকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল
স্যার আপনার ভালো হোক। আমরা আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকব।
রিপ সান্ত্বনা দিয়ে বলল
বাড়ি যান। আপনার বাবার যত্ন নেবেন।
বিপক্ষীয় দলের উকিল এসে হাতে হাত মিলালেন। বললেন
কনগ্রেস! আমাদের ডিফেন্স লয়ারের আরও একটা জয়।
জয়টা আমাদের সবার। আপনি কিন্তু আপনার মক্কেলের উপর অন্ধবিশ্বাস রেখেছিলেন প্রসিকিউটর সাহেব। এটা মোটেও আশা করিনি আমি।
প্রসিকিউটর লজ্জাজনক হাসলো।
এসিস্ট্যান্ট সজল রিপের পেছনে এসে ফিসফিস করে বলল
স্যার সামনের রাস্তা দিয়ে বেরুতে পারব না। গুটিকয়েক সাংবাদিকদের ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম।
ওসব থাকবেই। আপাতত উটকো ঝামেলায় পড়তে চাই না। আমরা পেছনের রাস্তা দিয়ে যাব। চলো। তুমি কিছু খেয়েছ?
জ্বি না স্যার। আপনার সাথে খাব। কোর্টে আজ আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল আরেকটুর জন্য। অথচ আপনি কত শান্ত ছিলেন। আপনার কাছ থেকে আমি রোজ শিখি।
কথা ঠিক বলেছ। সে যাইহোক চলো কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাক।
স্যার আপনার জিত উপলক্ষে বিলটা আজ আমি দেব।
রিপ হাসলো। সজলের পিঠ চাপড়ে বলল
পাগল ছেলে।
সজল যেতে যেতে বলল
স্যার আজকে আমাদের ম্যাডামের মতো একজনকে দেখেছিলাম মনে হলো ফুচকার দোকানের ওখানে। হয়ত ভুল দেখেছি।
রিপ মাথা নাড়ালো। বলল
ঠিকই দেখেছ হয়ত।
***
রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে সজলের সাথে কথা বলতে বলতে গাড়িতে গিয়ে উঠলো রিপ। সজল গাড়ি ঘুরিয়ে বলল
স্যার মা আপনাকে কাল যেতে বলেছে। খুব খুশি হবে আপনি গেলে । অনেক অজুহাত দেখিয়েছেন।
তুমি তো জানো এই কেসটা নিয়ে আমি এতটাই টেনশনে ছিলাম অন্য কোথাও মনোযোগ দিতে পারিনি। এবার যাব।
সজল হেসে বলল
ম্যাডামকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে। ম্যাডামকে মায়ের খুব মনে ধরেছে আপনাদের বাড়িতে দেখে।
রিপ বলল
হুমম।
বলতে বলতে তাদের গাড়ি জ্যামে পড়লো। রিপ জানালার কাঁচ নামিয়ে থুতু ফেলার সময় অচিন্তনীয় একটা দৃশ্য দেখলো।
রাস্তার পাশে ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীরা। পড়নে সেলোয়ার-কামিজ, মাথায় উড়না জড়ানো। মাক্সটা নামানো। হাতের তালুতে ফুচকার বাটি। পাশেই নওফুজ শিকদার। মেয়ে বাবাকে জোর করে ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে দুজনেই হাসছে।
সজল বলে উঠলো
আরেহ ম্যাডাম তো এখানে।
রিপ বলে উঠলো
তা তোমার কি মনে হয় তোমার ম্যাডামের সাথে আমাদেরও ওখানে যোগ দেয়া উচিত।
সজল লজ্জা পেয়ে হাসলো। গাড়ি ছেড়ে দিল। নীরা ততক্ষণে রিপকে দেখে ফেলেছে। সে আরও দু চারটা ফুচকা মুখে পুরতে পুরতে মুখ বেঁকিয়ে দিল। বিষয়টা রিপ বুঝে উঠতে পারলো না। নীরা তো তাকে তো দেখেনি। তাহলে মুখ বাঁকালো আবার কাকে?
চলবে……..
🙂🙂🙂🙂🙂🙂