মন দিয়েছে ধরা পর্ব -০৭

#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ৭
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা

সকালের চা নাশতার পর্ব সাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটছিল নীরা। রুমের দরজার সামনে যেতেই ভেতরে চোখ মেলতেই দেখতে পেল খাটে বসা ফর্মাল আউটফিটে এডভোকেট সাহেবকে। গায়ে সাদা শার্ট।
পাশেই আইরন করে রাখা কালো আইনি পোশাকটি। খাটে বসে নিমগ্ন হয়ে উনি জুতো পড়ছেন। নীরা ভেতরে পা রাখতে রাখতে রসিয়ে রসিয়ে বলল

আজ আপনার কেসের ফাইনাল সুনানি?

রিপ তার আগমনে চমকালো না। চোখ নত করে নিজের কাজে মগ্ন হয়ে জবাব দিল।

কি করে জানলে?

ওই আপনাকে বলতে শুনেছি এই।

ঠিক শুনেছ।

আপনি আজ পর্যন্ত কতটা কেস হেরেছেন?

এমন উদ্ভট প্রশ্নে কপালকুঞ্চিত হয়ে এল রিপের।

আমার জিত যদি আইনের হার হয় সেটা আমার জিত না। আমি সেই কেসকেই জেতা মনে করি যেখানে নায্য বিচার হয়।

নীরা মহাবিরক্তিকর স্বরে বলল

এত জ্ঞান দিতে কে বলেছে আপনাকে? সোজাসাপটা বললেই তো হয়।

নীরার সাথে অবান্তর, অযাচিত কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলো না রিপের। তার মাথা শীতল রাখাটা অতীব জরুরী এই মুহূর্তে। সে শান্তকন্ঠে ডাকলো

নীরা!

হুমম।

পানির কথা বলতে গিয়েও বললো না সে। এক গ্লাস পানি সে খেয়ে নিতে পারবে। শুধু শুধু অপরের উপর নিজের কাজের ভার চাপিয়ে দেয়াটা অনর্থক।
রিপকে চুপ থাকতে দেখে নীরা বলে উঠলো

কিছু বলবেন?

নাহ।

জুতো পড়া শেষে রিপ উঠে দাঁড়ালো। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে খেতে চোখা দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকালো। নীরা কটিতে হাত রেখে কুপিতস্বরে বলল

সমস্যা কি? ডেকে আবার চুপ করে আছেন।

নিজের হামবড়া স্বভাব বজায় রাখার পরিপ্রেক্ষিতেই রিপ হেসে উঠেনি তখন। নাহলে নীরাকে দেখে ভীষণ হাসি পেয়েছিল সেই মুহূর্তে।

বিছানার উপর থেকে কোর্টটা হাতের উপর ভাঁজ করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে এসিস্ট্যান্টের ফোন পেল সে। ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল সে। নীরা শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিয়ে তার পেছনে ছুটতে ছুটতে ডাকলো

এডভোকেট সাহেব! শুনুন শুনুন।

রিপ ফোনে কথা বলা বন্ধ রেখে তারদিকে দৃষ্টি ঘুরালো। নীরা আমতাআমতা করে বলল

ইয়ে মানে আসার সময় দুটো আইসক্রিম আনবেন। না আনলে কিন্তু জরিমানা ধার্য করা হবে। পাঁচশ টাকা নগদ হাতে হাতে দিতে হবে। হুমম।

রিপের কোনো কথায় আশা করেনি নীরা। রিপ ফোন মিউট করে জানতে চাইলো

যদি জরিমানাও না দিই?

তাহলে আপনাকে দিয়ে দেবেন। সিম্পল।

বলেই প্রাণখোলা হাসলো নীরা। রিপ তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে হেঁটে চলে গেল। নীরা আবারও হাসলো। আজ আইসক্রিম না আনলে খবর আছে।

_____________________

রিপকে ফিরতে দেখে নীরা ছাদে কাপড়গুলো শুঁকোতে দিয়ে ত্রস্তপায়ে ছুটে এল। তোয়ালে দিয়ে জলসিক্ত চুলগুলো মুছতে মুছতে জানতে চাইলো

আমার আইসক্রিম এনেছেন?

রিপ তার দিকে ফিরলো। কেমন অপ্রসন্ন, দুর্দশাগ্রস্ত দেখালো তাকে। নীরা ভড়কালো। ভাবলো থাক আর জানতে চাইবে না। নিশ্চয়ই মুড খারাপ। কিন্তু রিপ তাকে ছাড় দিল না। বলল

তুমি কি বাচ্চা? পরীও তো আমাকে এত আবদার করেনা নীরা। এমনিতেই মাথা খারাপ তারউপর আবার মাথা নষ্ট করতে এসেছ।

নীরার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার অবস্থা। ভয়ার্ত চোখে রিপের দিকে চেয়ে তোয়ালেটা দু’হাতে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। রিপ বেশ ক্লান্তস্বরে বলল

নীরা, তুমি একটু এখান থেকে যাবে প্লিজ?

বলতে দেরী নীরার যেতে দেরী না। যা যা এতদিন ধরে ভুলে থাকার চেষ্টায় সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেসব তাকে ঝোঁকের মতো আঁকড়ে ধরলো পুনরায়। কত কারণ সে মনে মনে খুঁজে নিয়ে বুঝে নিল। অতঃপর চুপটি করে একা একা অশ্রু বিসর্জন দিল। নিজের দস্যিমনকে বেশ করে জব্দ করে মনে মনে পণ করলো আজ থেকে সে কোনো আবদার করবে না। যে ভালোবাসেনা সে তার আবদার পূরণ করবে এটা ভাবাটাই নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তার সাথে কেন এমন হলো? তারই বা কি দোষ সে তো বাবাকে দেখে এসেছে মা কিছু চাইলে বাবা প্রাণটা ধার দিয়ে হলেও মায়ের সামনে তা হাজির করেছে। দুটো আইসক্রিমের জন্য কি প্রাণ ধার দিতে হতো? এমনও তো না যে নীরার খুব আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছিলো সে তো দেখতে চেয়েছিল তার আবদার কতটা প্রাধান্য পায় মানুষটার কাছে। পোষা প্রাণীদের উপরও মানুষের মায়া পড়ে যায়, আর সে তো মানুষ। একসাথে একঘরে থাকতে থাকতেও কি এটুকু মায়া তার উপর পড়েনি? পশুপাখির চাইতেও সে তুচ্ছ? সে আর থাকবে না এই বাড়িতে। কারো পথ চেয়ে থাকবে না।

খাওয়ার টেবিলে নীরাকে না দেখে খানিকটা অবাক হলেও রিপের চেহারায় সেটা প্রকাশ পেল না। মুনা খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল

নীরুকে ডাকিসনি?

কোথায় নীরা?

কোথায় মানে? ওকে তো দেখতে পাচ্ছি না আমিও। ঘরে নেই?

নাহ।

তালহা বেগম বলে উঠলেন

শোনো কথা! একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ হুট করে উদাও হয়ে গেল?

রিপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মনে করার চেষ্টা করলো সে ভুলকিছু করেছে কিনা। হ্যা মনে পড়েছে সে আইসক্রিমের নিয়ে আসেনি। আজব! এটার জন্য লুকিয়ে আছে?

সে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে গেল। সবখানে খুঁজে তারপর ছাদে গেল।
দেখতে পেল ছাদে জমানো সিমেন্টের ঢালায় বসে কোপিংয়ে মাথা রেখে চুপটি করে বসে মেঘলা আকাশ দেখছে নীরা । আকাশেরও কত দুঃখ অথচ সে দুঃখগুলো ঝেড়ে দিতে পারে। যা নীরা পারেনা।

রিপ ধীর পায়ে হেঁটে এল। নীরার পাশে গিয়ে বসতেই নীরা চোখ ঘুরিয়ে চাইলো তাকে। চুপচাপ নিবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়ার সময় রিপ বলল

চলো। সবাই অপেক্ষা করছে।

যাব না।

কেন যাবে না?

নীরা পুনরায় তাকালো তার দিকে। নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে। তেলতেলে মসৃণ মুখে বেদনার ছাপ। নাকের অগ্রভাগ ফুলছে কমছে। তারপরও ঘটা করে বলা দরকার সে কেন যাবে না।

আমি বাড়িতে যাব। সবার জন্য মন খারাপ লাগছে।

নীরার কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছে। রিপ ঠিকই বুঝলো মন খারাপ অন্য কারণে। তারপরও সে আশ্বাস দিল আজ বিকেলে দিয়ে আসবো।

নীরা তার দিকে আর তাকালো না। শুধু বলল

দিয়ে আসতে হবে না। বাড়ির সবাইকে বললে হবে।

ঠিক আছে। এখন চলো।

____________________

নীরা তার ব্যাগপ্যাক গুছিয় নিল। বাপের বাড়ি যাচ্ছে তাই একটা সুন্দর শাড়ি পড়েছে। বিয়ের চতুর্থ দিনের শাড়ি। ছাইরঙা। মুনা বলেছিল এই শাড়ি তোর গায়ে এত মানিয়েছে নীরু চোখ ফেরানো দায় অথচ কেউ একজন ফিরেও তাকায়না এই দুঃখে নীরা মুখে কিছু দিতে ভুলে যায়, চুলে তেল দিতে ভুলে যায়। অথচ সে নাকি সুন্দর!

রিপ রুমের ভেতর পা রেখে বলল

এতক্ষণ কেউ দরজা বন্ধ করে রাখে নীরা।

তৎক্ষনাৎ তার কপাল ভাঁজ হলো। নীরা তার উল্টোদিকে ফিরে শাড়ি ভরছে ব্যাগে। তাকে বেশ শান্ত দেখালেও রিপ অশান্ত মনে জিজ্ঞেস করলো

কি হচ্ছে এসব?

বাড়িতে যাচ্ছি।

আজকে যাওয়া হবে না নীরা।

নীরা তার দিকে ফিরে জানতে চাইলো

কেন যাওয়া হবে না?

কারণ আমি নিয়ে যেতে পারব না। আমার কাজ আছে। একদিন সময় নিয়েছি আদালতে। কালকেই ফাইনাল সুনানি। আমার মনোযোগ সরে যাচ্ছে নীরা।

আপনি আপনার কাজ নিয়ে মজে থাকুন। আমি কি আমার বাপের বাড়ি চিনিনা? আরো ভালোই হচ্ছে আপনার জন্য। কেউ প্যানপ্যান করছেনা। ভালোমতো শান্তিমতো কাজ করতে পারবেন না।

রিপ জলদগম্ভীর চোখে চেয়ে রইলো শুধু। এই পাগল মেয়েটাকে কিছু বুঝাতে ইচ্ছে করলো না। হুটহাট রাগ কোথাথেকে আসে এত?

আপনি আম্মা আব্বাকে বলে আসুন।

আমি পারব না।

আমি পারব।

নীরা শাড়ির আঁচল টেনে গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

_______

পরীও নেই তুইও চলে যাচ্ছিস। বাড়িটা তো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। হুট করে বাড়ি যাওয়ার তাল উঠেছে কেন?

নীরা মুনার কথার উত্তর দিল না। তালহা বেগম বললেন

বাচ্চা মেয়ে। যাও যখন সবার জন্য মন পুড়ছে। তাড়াতাড়ি চলে এসো আবার। বেশিদিন থেকো না। রিপ কোথায়? এই রিপ।

রিপ পায়ে হেঁটে এল। বলল

কি হয়েছে?

তোর শ্বশুরবাড়ির জন্য ভালো মিষ্টি-টিস্টি যা লাগে নিয়ে যাস। মনে করে পানসুপারি নিয়ে যাবি। বউয়ের জেঠি যা পান খায়। বাপরে বাপ।

রিপ নীরার দিকে তাকালো। সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। আজব মহিলা!

নীরা তার দিকে তাকালো না। রিপ রাগসমেত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here