মন দিয়েছে ধরা পর্ব -১২

#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ১২
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা

চা নাশতার টেবিলে নীরা একদম মাথা নামিয়ে ছিল। অন্যদিন সবার সাথে বকবক করে গেলেও আজ একদম চুপচাপ ছিল। অবশ্য রিপ তাতে বেশ খুশি। নীরার মুখের দিকে তাকাতেই ভুলবশত নীরাও তার দিকে তাকালো। চারচোখ চোখাচোখি হতেই নীরা জিভে কামড় দিয়ে ওখান থেকে সরে গেল। রিপ মুখে দেয়া পানি ভেতরে গলাধঃকরণ করতে না পেরে কেশে উঠলো খুকখুক করে। তালহা বেগম বিচলিত কন্ঠে বলল

ওমা কি হলো তোর আবার?

নীরা দৌড়ে এসে হাজির হলো রিপের পেছনে। তার চেহারায় লাজ ভয় । রিক বলল

আরেহ কিছু হয়নি তোর বরের।

তালহা বেগম ছেলের ছেলের মাথায় আলতো চাপড় দিতে দিতে বললেন

জোরে জোরে শ্বাস ফেলিস না।

রিপ আশ্বস্ত করলো

আমি ঠিক আছি মা।

নীরা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রান্না ঘরে চলে গেল। মুনা এসে বলল

এই শোন না। তোকে একটা কথা বলব বলব করে বলা হচ্ছে না। মা আমাকে বারবার করে বলে আমার মনে থাকে না।

বলো না কি বলবে?

মুনা কাপ প্লেটগুলো বেসিনে ধুঁতে ধুঁতে বলল

মা কাল বলছিল তোদের ব্যাপারে। বাড়িতে আরেকজন বাচ্চা এলে মন্দ হয় না। রিপ তোকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনা?

নীরার উদলা কপোল লজ্জায় রাঙা হলো।

দু’পাশে মাথা নাড়ালো সে। মুনা হাসলো। বলল

পাগলী! তুই তো বলেছিলি তোর এতগুলো বাচ্চা হবে। কখন হবে সেগুলো? মানুষ করার জন্য আমি তো আছি। তোর ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

নীরা চুপ করে রইলো। উন্মনা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বেসিনের স্বচ্ছ জলে।

তার আর এডভোকেট সাহেবের সম্পর্কটা যে আর দশটা দম্পতির মতো স্বাভাবিক না তা তো সবাই জানে তারপরও কি করে এসব আশা করো তারা? নীরার বড্ড খারাপ লাগে এই ভেবে স্বামীর নিখাঁদ ভালোবাসা তার কখনো পাওয়া হবে না। হয়ত ভালো থাকার জন্য নিজেকে বদলাবেন উনি কিন্তু নীরা যেরূপে তাকে চেয়েছিল তা সে জীবনেও পাবে না। খুবই সহজেই লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।

মুনা হাত মুছে এসে নীরার হাত ধরলো।

এই নীরু!

নীরা খানিকটা চমকে উত্তর দিল।

হু।

তোর সাথে রিপের সম্পর্কটা এখনো স্বাভাবিক হয়নি?

নীরা বুকে যাতনা রেখে কাষ্ঠ হাসে। বলে

কি বলো না তুমি। জেনেশুনে কি করে ওসব বলো আপা?

মুনা হাতটা শক্ত করে ধরে। আদেশীসুরে বলে

দেখ নীরু তোর কাছ থেকে ও সব লুকোলে তুই আরও বেশি কষ্ট পেতিস। তুই ওসব কিছুই ভাববি না। তুই ওর বর্তমান ওর ভবিষ্যৎ। তোকে ঘিরেই ওর বর্তমানটা চলবে, ভবিষ্যতটা গড়বে আর অতীতটা ধোঁয়াশা হবে। দেখ ইশুর মুখ থেকে শুনে আমরা জেনেছি এমনও কেউ একজন আছে যে ওই গর্দভটাকে ভালোবাসে। তাই ওকে বিয়ের জন্য বলেছি নাহলে কোনোদিন ওই সাহস হতো না আমাদের। একটা নিশ্চয়তা দরকার ছিল আমাদের যে ওর অতীত আছে জেনেও ওকে ছেড়ে যাবে না। এমন কেউ যদি ওর জীবনে আসতো যে ওর অতীত জেনে দূরে সরে যেত তাহলে কষ্ট আমাদের, ওর আর মেয়েটারও হতো।

নীরা ঠেস মারা গলায় বলে,

কষ্ট আমার হয় না।

এভাবে কেন বলছিস? তোকে কি করে বুঝাই বল। তুই ওর জীবনে না এলে ওর জীবনটা ওভাবেই থেমে থাকতো। তুই ওকে তো ভালোবাসতিস তাই না?

নীরা অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বলল

হ্যা সেটাই কাল হয়েছে।

মুনা তার গালে হাত রাখলো। বলল

তাহলে ফিরে এলি কেন ওর হাত এক্সিডেন্টের কথা শুনে। কাল যখন হয়েছে তখন নিজেকেও গুটিয়ে রাখ।

ওটাই তো পারছিনা। অদ্ভুত একটা মায়া আমাকে এই বাড়ির দিকে টেনে ধরে। আমি তো সংসার করব বলেই এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি তাই না?তোমার ভাই তো সারাক্ষণ বিরক্ত হয় আমার কথায় কাজে। আমি দেখেও না দেখার মতো হয়ে থাকি সেই আশায় সময় একদিন আমার হয়ে কথা বলবে। সুদিন আসবে একসময়।

মুনা ঝলমলে হাসলো। বলল

এইতো ঠিক লাইনে এসেছিস। দেখবি একদিন তুই ছাড়া বোকাটা পাগল পাগল হয়ে যাবে।

নীরা ওর মুখের দিকে চেয়েই রইলো নির্নিমেষ।
সে ছেড়ে গেলে পাগল পাগল হবে? ধরে রাখা অবস্থায় পাগলামি করবে না?

আরেহ কত ঘর সংসার হয়ে যায় না প্রেম ভালোবাসা ছাড়া। বাচ্চা কাচ্চাও তো হয়ে যায়। তোদের একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে ওর মন দেখবি তোর উপর একদম গেঁড়ে বসবে।

নীরা মুখফুটে কিছু বলল না। কিন্তু নির্নিমিখ তাকিয়ে ভাবলো সে ভালোবাসাহীন ঘর বাঁধবে না। তার সন্তান ভালোবাসার প্রতীক হয়ে আসবে। ভালোবাসা মজবুত করতে আসবে।
ভালোবাসা শেখাতে নয়। সে হবে নীরার বুকের মাধ্যিখানের দোদুল্যমান একটি নিষ্পাপ ফুল যে ফুলের সুগন্ধে তাদের ঘর সুগন্ধে ভরে উঠবে। যার দিকে তাকালে নীরার মনে হবে তার কাছে ভালোবাসা আছে, ভালোবাসার পুষ্প আছে। যাকে দেখলে নীরার মনে হবে সে বাবা মায়ের আদরের পুতুল। যার কানে কোনোদিন বাবার অতীত আর মায়ের দীর্ঘশ্বাস যাবে না। সে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখতে আসবে। ভালোবাসার ঘর সাজাতে নয় বরং ভালোবাসা দিয়ে সাজানো ঘরেই তার আগমন ঘটবে।
এক আকাশসমান দুঃখগুলো ভুলে নীরা একটুখানি হাসে। আশায় ভাসে একদিন তার সুখের সংসার হবে। মানুষটা ঠিকই একদিন তাকে ডেকে বলবে ‘ নীরা তুমি আমার জীবনে কেন আরেকটু আগে এলেনা?

তার চোখের জলগুলো টুপটাপ ফ্লোরে গড়িয়ে পড়লো। মুনা কাঁধ ছুঁয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল

রিপ তোকে ডাকছে যাহ। এমা কাঁদছিস কেন পাগল? যা আমি আর এসব কখনো বলব না।

আমি আসি।

নীরা বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। ঘরে যেতেই দেখলো রিপ গলার ব্যান্ডেজটা খোলার চেষ্টা করছে।

একি! কি করছেন আপনি?

নীরাকে দেখে রিপ থেমে গেল। বলল

তুমি এভাবে পালিয়ে পালিয়ে থাকছো কেন?

কোথায়? আপনার ভুল হচ্ছে।

নীরা চোখ তুলে তাকালো না।

আমি শার্টটা পাল্টাতে চাইছি।

নীরা গিয়ে শার্টটা ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজের উপর দিয়ে খুলে নিল। শার্টটা ঢিলে হওয়ায় খুলতে সুবিধা হয়েছে। আজ রিপের ব্যান্ডেজ খোলা হবে তাই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। রিক এসে বলল

তোর হয়েছে?

হ্যা।

বেরোনোর আগে রিপ নীরাকে ডাকলো।

নীরা!

জ্বি।

তোমার জন্য কিছু আনতে হবে?

নীরা হাসলো। দু’পাশে মাথা নাড়ালো। রিপও তার সাথে হাসলো। এগিয়ে এসে বলল

তোমার জন্য দুটো আইসক্রিম আনবো। কমলা সবুজ।

নীরা তাকে থমকে দিয়ে বলল

আমার ফুল চাই।

আবার ফুল কেন?

ফুল গলে যায় না আইসক্রিমের মতো।

শুঁকিয়ে যায়।

কিন্তু গন্ধ থেকে যায়।

ঠিক আছে আনবো।

কিছুদূর গিয়ে আবারও ফিরে এল রিপ নীরার কাছে। বলল

কি রঙের ফুল?

সাদা রঙের।

বেলী ফুল?

বেলী বকুল যাইহোক।

আচ্ছা।

নীরা আবারও ডাকলো।

শুনুন।

হ্যা।

কিচ্ছু লাগবে না।

কিচ্ছু আনব না?

শুধু আপনাকে এনে দিলে হবে।

আমি তো আছিই তোমার সামনে।

কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না।

রিপ নম্রগলায় বলল

আচ্ছা তোমার মন খারাপ আমি বুঝতে পেরেছি। সত্যি করে বলো তো তোমার কি চায়?

নীরা কিছুক্ষণ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ধীরেধীরে রিপের কাছে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এল। ধরে আসা গলায় অশ্রুনামা চোখে তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট নেড়ে রিপের চোখ বরাবর চেয়ে শার্টের বোতাম ছুঁয়ে বলল

এরকম একটা বোতাম চাই যার সাথে চুলের মতো পেঁচিয়ে থাকলেও তার বিরক্ত আসবে না, রাগ হবে না।

বলতে বলতেই নীরা ঠোঁটভেঙে কাঁদলো। রিপ বাম হাতের অঙুলি দ্বারা তার গাল মুছে দিতে দিতে বলল

তোমাকে পুরো একটা শার্ট দিয়ে দেব। তুমি তাতে দুঃখও মুছে নিও।

চলমান……..

আমি কি চাই তা পাঠক জানে 😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here