#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৯
🌸
মীরা মুখ চেপে হাসতে লাগল। মাহিমা দায়সারা ভঙ্গিতে মীরার দিকে তাকালে মীরা বলল,
“তুই একটা পাগল।”
“এখন দেখবি জায়িন ভাইকে কীভাবে আমাদের প্রেমে পাগল করি।”
মীরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমাদের মানে?”
“তুই আমি মিলেই তো চ্যাটিং করব। তাহলে আমাদেরই বলা যায়।”
“মোটেও না। ওই জিরাফের সাথে প্রেম করার আমার কোন শখ নেই। তোর যত মন চায় তুই চ্যাটিং কর। তার থেকে বড় কথা, আগে তো রিপ্লাই দিক।”
“ও রিপ্লাই দিবে ওর ঘাড়ও দিবে। লাভ রিয়েক্টের বন্যা বইয়ে দিলে রিপ্লাই না দিয়ে যাবে কোথায়? কমেন্টে বাবু সোনা আর বিশ ত্রিশটা চুমার ইমোজি লিখলে গালি দেওয়ার জন্য হলেও তো ইনবক্সে আসবে!”
মাহিমার কথা শুনে মীরা হলরুম কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হঠাৎ ওর এমন হাসির শব্দ শুনে সবাই একযোগে ওর দিকে তাকিয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে বাবা চাচারা ওকে দেখছে। মামারা সবাই মীরাকে দেখছে বুঝতে পেরে মাহিমা মীরার হাতে চাপ দিয়ে ওকে চুপ করাতে চাইল। কিন্তু মীরার হাসি কিছুতেই থামলো না। বড় আব্বু বলল,
“কী হয়েছে ওদের? এভাবে হাসছে কেন?”
মীরার হাতে ফোন দেখে ছোট চাচ্চু বলল,
“পাগল মেয়ে মোবাইলে কিছু দেখে এভাবে হাসছে! এখনও বড় হলো না।”
মীরার বাবা বলল,
“মীরা, মাহিমা অনেক রাত হয়েছে মা। এবার ঘরে চলে যাও। আর ফোন বেশি চালিয়ো না কেমন।”
ওরা রুমে চলে এলো ঠিকই। কিন্তু ফোন চালাবে না বাবার এই কথাটা রাখতে পারলো না।
🌸
দু’বাড়িতেই একটু একটু করে বিয়ের আয়োজন এগিয়ে যাচ্ছে। মীরা মুবিনের কাছে পড়তে যাচ্ছে। আগে পড়া শেষ হলে আন্টির সাথে গল্প জুড়ে বসতো। এখন সোজা ইভা আপুদের ফ্ল্যাটে যায়। ইভার মা’র সাথেও মীরার ভীষণ খাতির জমেছে।
মীরা ইভার রুমে বসে ইভার সাথে গল্প করছিল। আন্টি একটা প্লেট হাতে রুমে ঢুকে। মীরা আন্টিকে দেখেই বলল,
“আমার এখন ক্ষিধে নেই আন্টি।”
“ক্ষিধে না থাকলে আর কী করার? তোমার নাকি কাবাব ভীষণ পছন্দ। তোমার জন্যই বানিয়েছিলাম। আচ্ছা ফ্রিজে রেখে দেই তাহলে।”
কাবাব! ঘ্রাণও তো সুন্দর আসছে। আন্টি চলে যেতে নিলে মীরা বলল,
“ক্ষিধে না থাকলেও পেটে জায়গা আছে আন্টি। দুই তিনটা খেতে পারব।”
ইভা হেসে ফেলল। সানজিদাও হাসলো। মেয়েটার মা নেই শুনেই হয়তো ওর উপর এত মায়া পড়ে গেছে। মুবিনের কাছে পড়তে এসে রোজ এখানে আসে। এরকম চঞ্চল মনখোলা মেয়েকে কে না পছন্দ করবে! ইভার বাবার সাথেও ওর ভাব জমে গেছে। মেয়েটা তাদের পর মনে করে না তাহলে তারা কেন ওকে আপন করে নিতে পারবে না। যতক্ষণ এখানে থাকে এটা যেন তার নিজেরই বাড়ি।
“আমি একা একা এসে কাবাব খেয়ে গেছি শুনলে মাহিমা আবির ভাই ওরা অনেক রাগ করবে। আমার সাথে কথাই বলবে না।”
সানজিদা বলল,
“তাহলে রাতে ওদেরকেও নিয়ে এসো?”
“সত্যি আসবো?”
সানজিদা হেসে বলল,
“মিথ্যা বলব কেন বোকা মেয়ে!”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আসব। আমাদের বাড়িতে আমরা রোজ রাতেই আড্ডা দিই। অনেক গল্প হয়, খাওয়াদাওয়া হয়। মাঝে মাঝে ভূতের মুভিও দেখি। ইভা আপু তুমি ভূতের মুভি পছন্দ করো?”
“ভীষণ।”
“কিন্তু আমার ভয় লাগে। আজ রাতে আমরা তোমাদের বাড়িতে মুভি দেখব।”
“তাহলে তো খুব মজা হবে।”
আন্টি চলে গেলে মীরা গলা খাটো করে বলল,
“ইভান ভাইকেও নিয়ে আসব?”
🌸
মীরা বাড়ি এসে এই খবর জানালে ভাইবোন সবাই হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিলেও বড়রা বাধ সাধলো। নিজের বাড়িটাকে পাগলাগারদ বানিয়ে রেখেছে ঠিক আছে। কিন্তু হবু বিয়াই বাড়ি গিয়ে এমন পাগলামির কোন মানে হয় না। ওরা কী ভাববে? এই জবাবে মীরা বলল,
“ওরা কিছুই ভাববে না। আঙ্কেল, আন্টি ভীষণ ভালো। আর ইভা আপু তো আমাদের পাগলামিই পছন্দ করে।”
তবুও বড়মা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। ছোট চাচীকে বলেও তেমন লাভ হলো না। আবির ভাইকে ধরলে হয়তো কাজ হতে পারে ভেবেই মীরা তনি আপুকে পটিয়ে আবির ভাইকে ডেকে নিল। মাহিমা তো যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়ানো। আবির এসে মামীকে তেল মারছে।
“ওরা যখন এত করে যেতে চাচ্ছে তাহলে এক কাজ করি। আমিও ওদের সাথে চলে যাই। ওদেরকে পাহারা দিয়ে রাখব যেন কোন ধরনের পাগলামি না করতে পারে।”
“তুই-ই তো পাগলের সর্দার বাবা। তোর হাতে ওদের ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকব!”
“দূর মামী, এভাবে বলো না তো। মামার বাড়ি এসে পাগলামি করি বলে কি মামাতো ভাইয়ের হবু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পাগলামি করব! ওইটুকু জ্ঞান তো আমাদেরও আছে।”
“না বাপ। তবুও আমি তোদের বিশ্বাস করতে পারছি না।”
বড় মামী কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিল না। যদি না ইভা নিজে কল করে কথা বলতো। সাথে ইভার মা-ও ওদেরকে পাঠানোর জন্য জোড়াজুড়ি করতে লাগলো।
“ইভার বাবা ছেলেমেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। ওরা কখন আসবে? তাড়াতাড়ি সবাইকে পাঠিয়ে দিন বেয়াইন।”
ছোট চাচী হবু বেয়াইনের আন্তরিকতা দেখে বলল,
“বিয়াই, বেয়াইনও পেয়েছেন ভাবী! দু’জনই মাটির মানুষ।”
“সবই আমার ছেলের ভাগ্য রে ছোটো।”
ইভান অফিসে ছিল। আজকের এই প্ল্যানের ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। যাবার আগে আবির ইভানকে কল করে জানিয়ে দিল।
“তোমার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। আণ্ডাবাচ্চারা মিলে আজ রাতে ভাবীর বাড়ি পার্টি দিবো। তোমার অফিস শেষ হলে ফেরার সময় আমাদের পিক করে নিও। অবশ্য না নিলেও সমস্যা নেই। ভাবীর সাথে দেখা করার আমি তো শুধু একটা অজুহাত বের করে দিচ্ছিলাম।”
ওরা সবাই ইভানের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে শুনে বড় মামা জোর করে আবিরের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিল। আবির নিতে না করলে মামা বললেন,
“ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস। লোকে যেন তোদের কিপ্টে বলতে না পারে। দোকানের সব মিষ্টি নিয়ে যাবি। সাথে পান সুপারিও নিস।”
“কিন্তু আমার কাছে টাকা আছে তো মামা।”
“আমার টাকাও তো তোর টাকাই।”
যাবার পথে বাজার থেকে ফলফলাদি, মিষ্টি, পান সুপারি কিনে নেওয়া হলো। গাড়ি থেকে নেমে সবার হাতে একটা করে প্যাকেট নিয়ে ওরা ইভাদের ফ্ল্যাটে ঢুকলো। ইভার বাবা মা এতকিছু দেখে আশ্চর্য হলো।
“একি কাণ্ড! পুরো বাজার নিয়ে এসেছ দেখছি। এসব কেন?”
আবির ইভার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“আমাদের ভাবীর জন্য।”
শুধু মাহা বাদে রুশমিও এসেছে আজ। কোনোভাবেই ওকে বাড়িতে রেখে আসা গেল না। ইভা ছোট্ট ননদিনীকে কোলে নিয়ে আদর করছে। রুশমিও আবির ভাইয়ার শেখানো মতো তোতলা কন্ঠে ইভাকে ভাবী ডাকছে। সানজিদা ছেলেমেয়েদের জন্য নাস্তা নিয়ে এলো। সবার জন্যই কাবাব বানিয়েছে সে। সবাই নাস্তাই এমনভাবে ঠাসাঠাসি করে খেলো যে আর রাতের খাবারের জায়গা নেই পেটে। ইভার বাবা বুদ্ধি দিল, চলো সবাই ছাঁদে চলে যাই। খোলা আকাশের নিচে বসে চাঁদ তারা দেখতে দেখতে শীতল বাতাসে গল্প জমে যাবে। পাটি মাদুর নিয়ে ওরা ছাঁদের দিকে ছুটলো। ইভা দেখলো ওদের সাথে মিশে বাবারও যেন আজ বয়স কমে গেছে। ওদের স্পেশালিটিই এখানে। সবাইকে কেমন মন খুলে বাঁচতে শেখায়।
মীরা মাদুর বগলে ছাঁদে পা দিয়েই আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হওয়া গলায় বলল,
“ওয়াও! আজকের চাঁদ এত বড় কেন? কত আলো দিচ্ছে। আজ কি পূর্ণিমা?”
হামিদ সাহেব জবাব দিলেন।
“মনে হয়।”
মাহিমা ছাঁদে পাটি বিছাতে বিছাতে বলল,
“হুমায়ূন আহমেদের অনেক বইয়ে পড়েছি, খোলা মাঠের মাঝে বসে নাকি পূর্ণিমা দেখার আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।”
মীরা বলল,
“উনি তো আরও কতকিছু লিখেছেন। জঙ্গলে গিয়ে জোছনা দেখা। বালিতে বুক পর্যন্ত গর্ত করে নিজেকে মাটিচাপা দিয়ে জোছনা দেখা।”
“আমি একদিন সমুদ্রে গিয়ে জোছনা দেখব।”
“আমাকেও সাথে নিয়ে যাস। একসাথে দেখব।”
“ঠিক আছে।”
ওদের কথার মাঝে হামিদ সাহেব বলে উঠলেন,
“আমাকেও কি তোমাদের সাথে নেয়া যাবে মেয়েরা?”
মীরা মাহিমা দু’জন একসাথে উনার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
“আমাদেরকেই তো নিয়ে যাওয়ার মানুষ নেই। আপনি আমাদের সাথে গেলে আর কাউকে লাগবে না।”
ওরা এসেছে। কিন্তু বাকিরা আসছে না। মাহিমা আবিরকে ডাকতেই নিচ্ছিল তার আগেই ছাঁদে আবিরের গলা শোনা গেল।
“কামচোর ম্যেলুক! একটা পাটি আর মাদুর হাতে ড্যাংড্যাং করে চলে এলি। বাকি জিনিস কে আনবে?”
তনি, আবির ছাঁদে এসে হাত থেকে বাকি জিনিস গুলো নামিয়ে রাখলো। ইভা এখনও আসেনি।
“ইভা আপু কই?”
“আসছে।”
“আমি গিয়ে ইভা আপুকে সাহায্য করি।”
মীরা ইভাকে নিয়ে আসতে ছুটছিল। ছাঁদের দরজার কাছে এসে সিঁড়িতে পা দিয়েই কারো সাথে ধাক্কা খেল। মানুষটার হাত থেকে ফোন নিচে পড়ে গেল। কার সাথে ধাক্কা খেয়েছে এটা দেখার সময় পেলো না মীরা। ঝুঁকে নিচে থেকে ফোন তুলে নিয়ে বলতে লাগল,
“সরি সরি। আমি একদম দেখিনি। না দেখেই…
সামনে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখে মীরার কথা বন্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। জায়িন ভাই এখানে কোথায় থেকে এসেছে? বিকেলেই তো পড়ে গিয়েছে। তখন তো জায়িন ভাই বাড়িতে ছিল না। মীরা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল বড়সড় একটা ফাটল ধরেছে। মীরা আঁতকে উঠে জায়িনের দিকে তাকাল। ভয়ে ঢোঁক গিলে মিনমিনে গলায় বলল,
“স্ক্রিন ফেটে গেছে। আমি ইচ্ছে করে করিনি। সত্যি বলছি। আপনি চাইলে আমি গ্..
জায়িন মীরার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিল। এবং মীরাকে কিছুই না বলে ওকে অবাক করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে ছাঁদে চলে গেল। মীরা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
” এটা কী হলো! জায়িন ভাই কিছুই বলল না! একটু রাগও করলো না। ইশ, বেচারার ফোনের গ্লাস ফাটিয়ে ফেলেছি। দুনিয়ার সব অঘটন আমাকে ও জায়িন ভাইকে ঘিরেই হতে হবে!”
জায়িন সন্ধ্যার একটু পরেই বাড়ি এসেছে। জার্নি করে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে রুমে শুয়েছিল। এই আড্ডাতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না। এমনকি জায়িন জানতোও না খালামনিদের ওখানে ওরা এসেছে। একটু আগে গিয়ে খালামনি এখানে আসার জন্য জোড়াজুড়ি করতে লাগলো। জায়িন আসবেই না। মুবিনকে পাঠিয়ে দিল। কিন্তু মা-ও জোর করায় আসতে হলো।
এই আড্ডায় জায়িনকে পাওয়া একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। বন্ধুকে পেয়ে আবিরের খুশি দেখে কে? মীরাই এতক্ষণ সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড ছিল। কিন্তু একটু আগের ঘটনার পর পুরোপুরি চুপসে গেছে। জায়িন সামনে থাকায় এখন তো মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না।
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
২০
🌸
কথায় আছে না, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। মীরারও হয়েছে সেই দশা। সে কী করেছে তা তো তার মনে মনে জানাই।
মীরাকে এরকম চুপটি মেরে যেতে দেখে মাহিমা ওকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে রে? ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছিস কেন?”
“দুনিয়ার সকল অঘটন আমার সাথেই ঘটতে হবে কেন বল তো?”
মাহিমা ঠিক বুঝতে পারল না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“আবার কোন অঘটন ঘটেছে?”
“পরে বলব।”
“নাটক। পুরো কথা বলবি না তাহলে শুনিয়েছিস কেন হারামি? অর্ধেক বলে এখন পেটের ভেতর সুরসুরি লাগিয়ে দিয়েছিস।”
আড্ডাতে মুবিনও এসেছে। সবাই নানান কথা বললেও তার দৃষ্টি এক দিকেই আটকে আছে।
আবির তনি পাশাপাশি বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখছে। মাঝে মাঝে নিজেরা কিছু বলে লজ্জা পাচ্ছে। হঠাৎ করেই আবার ঝগড়া লেগে যাচ্ছে। জায়িনের সম্পূর্ণ মনোযোগ তার ফোনে। সে এমনভাবে ফোনে কিছু দেখছে যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য এর মধ্যে আছে।
ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে হামিদ সাহেব বেশিক্ষণ থাকতে চাইলেন না। তিনি চলে যেতে নিলে মীরা মাহিমা উনাকে যেতে দিল না।
“রুমে গিয়ে কী করবেন? এখানে আমাদের সাথে থাকুন।”
“হ্যাঁ। এখন আমরা একটা গেম খেলব।”
মাহিমা সবার দৃষ্টি আর্কষণ করলো। সবাই মিলে কোন গেল খেললে কেমন হবে? অবশ্যই মজা হবে। আবির বলল,
“কী গেম খেলবি?”
“তোমরা যা খেলবে।”
তনি প্রস্তাব দিল,
“ট্রুথ ডেয়ার খেলি।”
আবির তনির কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“দূর এসব বাচ্চা পোলাপানের খেলা।”
“এখানে আমরা সবাই বাচ্চাই। তুমি বুড়ো হয়ে গেলে চলে যেতে পারো। বাচ্চাদের মাঝে বসে আছো কেন?”
ওরা আবার ঝগড়া লেগে যাচ্ছে দেখে হামিদ সাহেব পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা। আমি বুড়ো মানুষ। আমাকে দিয়ে গেম টেম খেলা হবে না। আমি বরং তোমাদের সাথে গল্প করি।”
মুবিন বলল,
“কী গল্প করবেন খালু?”
“তোমরা বরং এক এক করে নিজেদের স্বপ্নের কথা বলো। ভবিষ্যত নিয়ে কে কী ভেবে রেখেছ।”
মীরা হাত তুলে জোরে বলে উঠল,
“আমি সবার আগে বলব। আমারটা আগে শুনুন।”
হামিদ সাহেব হাসলেন। আবির বলল,
“অ্যাহ! তোর স্বপ্ন আমরা সবাই জানি। আমি বলে দিচ্ছি তোর স্বপ্ন কী।”
“না। আবির ভাই! তুমি সবসময় এমন করো কেন?”
মীরা রাগ করছে দেখে ইভা সবার আগে মীরাকেই বলতে সুযোগ দিল।
“আচ্ছা, মীরা সবার আগে বলবে।”
“আমার স্বপ্ন আমি আকাশ ছোঁব। শুভ্র মেঘেদের সাথে ভেসে বেড়াব। ওদের সাথে গল্প করব। আমি পাইলট হবো।”
মীরা চোখ বন্ধ করে তার স্বপ্নকে সত্যি হতে কল্পনা করছে। তার ঠোঁটের কোণে একটুকরো সুখের হাসি দেখা যাচ্ছে। জায়িন ফোন থেকে চোখ তুলে মীরার দিকে তাকাল। হামিদ সাহেব বাহবা দিয়ে বললেন,
“বাহ! সুন্দর স্বপ্ন। দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমার সহায় হোন। স্বপ্ন সত্যি করে সবার মুখে হাসি ফোটাও। বাকিদেরটা?”
মাহিমা এক সেকেন্ডও সময় নিল না। নিজের স্বপ্নের কথা বলতে লাগল।
“আমার স্বপ্ন আমি দেশবিদেশ ঘুরবো। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য নিজের চোখে দেখব। অনেকগুলো দেশ ঘুরবো। অনেক মানুষদের সাথে মিশবো। এটাই আমার একমাত্র স্বপ্ন।”
“বাহ! এটাও সুন্দর একটা স্বপ্ন।”
জায়িনের স্বপ্নের কথা নতুন করে বলতে হয়নি। কারণ সে অলরেডি তার স্বপ্নের পথে হাঁটছে। আবির নিজের বেলায় বলতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে গেল। ওকে এত ভেবে উত্তর দিতে দেখে সবাই হাসলো। কিছুক্ষণ ভেবে আবির বলল,
“আর্মিতে জয়েন করব।”
জায়িন চোখ বাঁকিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর ভুল সংশোধন করে দিয়ে বলল,
“তুই তো লেকচারার হওয়ার কথা বলতি। হঠাৎ করে স্বপ্ন পরিবর্তনের কারণ কী?”
আবির চোখ পাকিয়ে জায়িনের দিকে তাকাল। শালা তাকে সবার সামনে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। বন্ধু হওয়ার দায়িত্বটা খুব সুন্দর করে পালন করছে। হালকা করে বাঁশ দিয়ে দিল।
হামিদ সাহেব বললেন,
“তাই নাকি? তুমি লেকচারার হতে পছন্দ করো। তাহলে আর্মি কেন?”
“আমার স্বপ্নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে আমার জীবনে পেতেই এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সে আমার জীবনে না থাকলে আমার কোন স্বপ্নই রঙিন থাকবে না।”
কথা শেষ করে আবির সবার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হাসলো। তনি টলমল চোখে এক ধ্যানে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা মাহিমা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল,
“ওউউউউ! কী কিউট! আবির ভাই তনি আপুকে কত ভালোবাসে দেখেছিস? ইশশ, তনি আপু কত ভাগ্যবতী!”
বন্ধুর ভালোবাসা দেখে জায়িন মনে মনে হাসলো। সত্যিই ভালোবাসার জন্য মানুষ কতকিছু করতে পারে। ভালোবাসায় সব ত্যাগ স্বীকার করা যায়। এজন্যই মনে হয় ভালোবাসা এত সুন্দর। ঘুরেফিরে মুবিনের কাছে এলে মুবিন নিজের স্বপ্নের কথা বলতে ইতস্তত করছে। জায়িন ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
“বল।”
হয়তো কেউ জানে না। জায়িন জানে শুধু। মুবিন গানবাজনা পছন্দ করলেও বাবা তাতে পারমিশন দেননি। মুবিনের কোন কথা না শুনে ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাধ্য করলো। মুবিনও বাবার অবাধ্য না হয়ে নিজের ভালোলাগার জিনিস ছেড়ে দিল। গানবাজনার নাম নিলেও বাবা রেগে যায়। এসবে কোন ভবিষ্যত নেই বলে মুবিনকে চুপ করিয়ে দেয়। মুবিন জানালো সে একসময় সিঙ্গার হতে চাইতো। কিন্তু এখন তার স্বপ্ন বদলে গেছে। ইভা এটা শুনে সত্যিই অবাক হলো। কারণ সে মনে করত, মুবিনকে ওরা খুব ভালো করে জানে। আসলে এটা সত্য না। মুবিন ভাই গান গাইতে জানে! মাহিমা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আপনি গান গাইতে জানেন মুবিন ভাই? সত্যি!”
“আমাদেরকে একটা গান শোনাবেন মুবিন ভাই। প্লিজ!”
মীরা গান শোনানোর অনুরোধ করে বসলো। আবির তনি ওরাও আবদার করতে লাগলো। এতগুলো মানুষের আবদার ফেলতে পারবে না ভেবে মুবিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মুবিন অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো। জায়িন বলল,
“খালি গলায় গান সুন্দর হবে না। মুবিনের একটা গিটারও আছে।”
মুবিন আশ্চর্য হচ্ছে। ভাইয়া তাকে বাধা না দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে নাকি! কেন? ভাইয়া জানে না বাবা তার গান গাওয়া পছন্দ করে না। খুশি এবং আগ্রহের সংমিশ্রণে মীরা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“মুবিন ভাই আপনার যেতে হবে না। আমাকে বলুন গিটার কোথায় রাখা আছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”
মুবিন বললে মীরা দৌড় লাগালো। পেছন থেকে ইভা সাবধান করে বলল,
“আস্তে যাও। পড়ে ব্যথা পাবে মীরা।”
🌸
মীরা মুবিন ভাইয়ের ঘরে গিটার খুঁজছে। মুবিন ভাই তো বলেছিস ওয়ারড্রবের সবার নিচের ড্রয়ারে আছে। কই? এখানে তো জামাকাপড় ছাড়া কিছু নেই। গিটার তো আর ছোটখাটো জিনিস না যে তার চোখে পড়বে না। এত বড় জিনিস খুঁজে পাবে না! এটা কেমন কথা? দরজার কাছে শব্দ হলে মীরা মনে করল আন্টি এসেছে। সে দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“তুমি জানো মুবিন ভাই গিটার কোথায় রেখেছে?”
জায়িনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মীরা তাকে তুমি ডাকছে! পরক্ষণে মীরা ওর ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বলল,
“আন্টি একটু খুঁজে দাও না।”
জায়িন ঘরের ভেতর এসে মীরার পেছনে দাঁড়াল। আন্টি এসেছে কিন্তু কথা বলছে না কেন? মীরা বসে থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে জায়িনকে দেখে ঝট উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। বরং দাঁড়াত গিয়ে একটুর জন্য জায়িনের সাথে ধাক্কা খেলো না। জায়িন এক কদম পেছনে সরে গেছে। মীরা এখানে জায়িন ভাইকে দেখে দুই সেকেন্ডের জন্য চুপ করে গেলেও একটু পরেই বলল,
“গিটার পাচ্ছি না।”
জায়িন পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমার ঘরে আছে।”
“আপনার ঘরে? কিন্তু মুবিন ভাই তো বলেছিল উনার ঘরে। গিটারের কি পা আছে? আপনার ঘরে গেল কীভাবে?”
জায়িন মীরার কথা যেন কানেই নিল না। মীরাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এই ঘর থেকে যাওয়া ধরলো। মীরাও জায়িনের পেছন পেছন যাচ্ছে।
“মুবিন ভাই তো বলেছে এই ঘরে। তাহলে আপনার ঘরে কীভাবে গেল? কে নিয়েছে?”
জায়িন নিজের ঘরে এসে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মীরা বকবক করেই যাচ্ছে। জায়িন ওর কথা শুনলেও কোন উত্তর দিচ্ছে না। গিটার বের করে ফিরে দাঁড়াল। মীরা কিছু বলতেই যাচ্ছিল, জায়িনের শীতল দৃষ্টির সামনে চুপ করে গেল। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা মুবিন ভাই না। এটা জায়িন ভাই। তিনি নিজেও কথা বলতে পছন্দ করেন না। এবং অন্যরা কথা বলুক এটাও তার পছন্দ না। মীরা ঠোঁট কামড়ে ফিরতি পথ ধরলো। দরজা পর্যন্ত চলে এলে পেছন থেকে জায়িনের গলা শোনা গেল।
“যে সময় ও ব্রেইন এসব বাজে কাজের পেছনে ব্যয় করছো, সেই সময়টুকু আর সামান্য মনোযোগ পড়াশোনার প্রতি দিলে এতদিনে হায়ার ম্যাথের সাথে শত্রুতা দূর হয়ে গিয়ে বন্ধুত্ব হয়ে যেত।”
মীরা দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে তাকালো। চোখ উল্টে জায়িনকে দেখছে। জায়িন ভাই কিসের কথা বলছে? কেনই বা বলছে? মীরা কিছুই বুঝতে পারল না। এসব বাজে কাজ মানে? ইভা আপুদের বাড়িতে এসে আড্ডা দেওয়া? নাকি মুবিন ভাইকে গান গাইতে বলা? সবার সাথে একদিন একটু আড্ডা দেওয়া, মজা করা কি বাজে কাজ? উনার কাছে সবই বাজে কাজ। সময় নষ্ট করা মনে হয়। মীরা হুহ্ বলে মুখ মোচড় দিয়ে চলে গেল। জায়িন সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো।
চলবে…
চলবে_