মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব -৭+৮

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

কেক কাটার সময় সবাই একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে। রিমু কেক কেটে সবার আগে মীরা মাহিমাকে খাওয়ালো। মীরা মাহিমা কেকের একটু অংশ হাতে নিয়ে রিমুর মুখে মাখাল। তিন বান্ধবীর হাসির শব্দে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠেছে। মুবিন ভাইকেও পার্টিতে দেখা গেল। সকালে মুবিন ভাইও তাহলে রিমুর জন্যই গিফট কিনছিল। মাহিমা মীরার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বারবার ওর হাত ধরে টেনে দেখাচ্ছে।

“মীরা দেখ না, জায়িন ভাই কী হ্যান্ডসাম! শহরে থেকে এতটা হ্যান্ডসাম হয়ে এসেছে!”

মীরা তাকাতে গেলে প্রতি বারই জায়িন ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। ইশ, লোকটা কী ভাববে! রিমু মুখ ধুতে গেছে। মুবিন ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ হেসে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো মীরা?”

“ভালো। আপনি কেমন আছেন মুবিন ভাই?”

“ভালো। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“ভালো।”

“এ প্লাস আসবে তো?”

মীরা হেসে ফেলে বলল,

“এই কথাটা কিন্তু আজ সকালেও জিজ্ঞেস করেছেন মুবিন ভাই।”

মুবিন লজ্জিত মুখে হাসল। মীরা মাহিমাকে মুবিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

“মুবিন ভাই, ও আমার বড় ফুপুর মেয়ে। ওর নাম মাহিমা। আমরা একসাথে পড়ি।”

মুবিন মাহিমার দিকে তাকাল। মাহিমা মুবিনকে চেনে। এক এলাকায় বাড়ি। তাই সে অচেনা বলে ইতস্তত করল না। বা ফর্মালিটি করেও কথা বলল না। মাহিমা বলল,

“আমি আপনাকে চিনি। আপনার ভাইকেও চিনি। জায়িন ভাই আমার ভাইয়ার বন্ধু। আমি ছোট থাকতে ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়িতে যেত। এখন হয়তো উনি আমাদের চিনেন না। আপনি তো এলাকায় থেকেও চেনেন না। উনি না চেনাই স্বাভাবিক।”

মাহিমা এত সহজ ভাবে কথা বলছে দেখে মুবিনও সহজ হলো। ওর একটা কথা শুনে হাসি পেল। ওকে হাসতে দেখে মাহিমা বলল,

“হাসছেন কেন?”

“না, তুমি বললে না তুমি ছোট থাকতে ভাইয়া তোমাদের বাড়িতে যেত। ভাবছি তুমি এখন কতটা বড় হয়েছ।”

মাহিমা লজ্জা পেল। সে কি একটু বেশি কথা বলে ফেলেছে? মুবিনের সাথে মীরাও সহজ ভাবে কথা বলে। কারণ মুবিন ভাই তার ভাইয়ের মতো অমন গম্ভীর বদমেজাজি না। মীরা বলল,

“রিমু আপনার বোন হয় আমরা জানতামই না। আন্টি এলেন না কেন মুবিন ভাই?”

“আম্মুর কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। তাই আসেনি। ভাইয়াও আসতে চাচ্ছিল না। আম্মু জোর করে পাঠালো।”

ওরা তিনজন বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলতে বলতে তিনজনই হাসছে। জায়িন মুবিনকে খুঁজছিল। বলতে, খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে। মা বাড়িতে একা আছে। কিন্তু মুবিনকে মেয়ে দুইটার সাথে কথা বলতে দেখে এগোলো না। ওখানেই চোখ মুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে রইল। এত সময় ধরে কী কথা বলছে ওদের সাথে! এদিকে আসার নামই নিচ্ছে না। বিরক্তিতে জায়িনের কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। তার ভাইটা যে মেয়েদের সাথে খাতির জমাতে এত পারদর্শী তা তো জানা ছিল না।
পার্টি শেষে মীরা মাহিমা বের হওয়ার সময় গেটে মুবিনকে দেখতে পেল। মাহিমা মীরাকে খোঁচা দিয়ে বলল,

“এখনও যায়নি দেখেছিস। তোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে।”

চাপা গলায় মীরা ওকে শাসালো।

“চুপ কর।”

মুবিনের কাছাকাছি এসে দেখা গেল একটু সামনেই জায়িন দাঁড়িয়ে আছে। ফোন কানে কথা বলছে। মুবিন ওদের দেখে জিজ্ঞেস করল,

“একা যাবে তোমরা?”

মীরা জবাব দিল,

“না। আবির ভাইয়া আমাদের নিতে আসবে।”

“ওহ। আমরাও চলে যেতাম। ভাইয়ার জরুরি কল এসেছে।”

মীরার মন খারাপ হলো। মুবিন ভাই তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে না। তার ভাইয়ের জরুরি কলের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। জায়িন ফোনে কথা বলা শেষ করে ওদের কাছে এলো। মীরা মাহিমাকে দেখবে আশা করেনি।

“কার সাথে যাবে তোমরা?”

লোকটা গম্ভীর গলায় কার উদ্দেশ্য প্রশ্নটা করেছে দুই বোন বুঝলো না। তাই দু’জনের কেউই উত্তর দিতে পারল না। ওদের এমন বোকার মতো চুপ করে থাকতে দেখে মুবিন পরিস্থিতি সহজ করে দিয়ে বলল,

“তোমার বন্ধু আসবে।”

জায়িন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে মুবিনের দিকে দেখলে মুবিন বলল,

“আবির ভাইয়া তোমার বন্ধু না? ওরা আবির ভাইয়ার বোন।”

মীরা মাহিমা দু’জনই জায়িনের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য ওর দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু জায়িন তেমন কোন এক্সপ্রেশনই দেখাল না। গম্ভীর গলাটা একটু যেন নরম হলো। দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমরা আবিরের বোন।”

মাহিমা মাথা নাড়ল। সে জানাল,

“আমি ভাইয়ার আপন বোন। ও আমাদের মামাতো বোন।”

“আচ্ছা।”

আবির যতক্ষণ এসে না পৌছুলো মীরা মাহিমাকে রেখে ওরাও গেল না। আবিরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। চারজন মানুষ বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুবিন জায়িনের অসুবিধা না হলেও মীরা মাহিমার পেটের ভেতর বুট বুট করতে লাগল। কথা না বলে এভাবে থাকা যায় নাকি। মীরা বারবার মাহিমাকে খোচাচ্ছে। মাহিমা কানে কানে বলল,

“দু’জনের একটা ফোনও নেই যে ভাইয়াকে কল করে তাড়াতাড়ি আসতে বলব।”

মীরাও নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,

“পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এবার বাড়িতে ফোনের কথা জানাতে হবে।”

“কিন্তু এখন কীভাবে সময় কাটাবো বোন? এই দু’জন অতিমানবের সাথে থাকার চেয়ে ভালো আমাদের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসুক। জন্তুজানোয়ার নয়তো গাছপালার সাথে বান্ধবী পেতে নিব।”

“আমার তো কথা বলতে না পেরে পেটের ভেতর কেমন লাগছে। মনে হচ্ছে কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরুতে না পেরে পেট ফেটে বেরুবার চেষ্টা করছে।”

“আল্লাহর কাছে দোয়া কর ভাইয়া যেন পাঁচ মিনিটের ভেতরে চলে আসে।”

ওরা ভাবছে ওরা কানাকানি করে কথা বলছে। দুই ভাই হয়তো শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওদের সব কথাই দুই ভাই শুনেছে। মুবিন চোখ বড় বড় করে মেয়ে দুইটাকে দেখছে। কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে রে বাবা! জায়িন এমন ভাবে ওদের দেখছে যেন ওরা চিরিয়াখানার রাখা আজব উদ্ভট কোন প্রাণী। বোনেদের দোয়ার ফেলে আবির সত্যিই পাঁচ মিনিটের ভেতরে চলে এসেছে। আবিরকে দেখে দুই বোন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে আবিরের খুশি দেখে কে। সে জায়িনের সাথে হাত মিলিয়ে, গলা জড়াজড়ি করে বলল,

“কতদিন পর ডাক্তার সাহেব!”

জায়িন হাসলো। মীরা অবাক হয়ে লোকটার হাসি দেখল। এই লোক হাসতেও জানে! তার সাথে দেখা হওয়ার এতগুলো দিনের মাঝে মীরা আজই প্রথম জায়িনকে হাসতে দেখল। আর এতটা প্রাণখোলা ভাবে কথা বলতে দেখল। মাহিমা মীরাকে চিমটি কেটে বলল,

“জায়িন ভাইয়ার হাসি কী সুন্দর, না?”

মীরাও মাথা নেড়ে সায় দিল।

“হুম।”

জায়িন আবিরের হালচাল জিজ্ঞেস করল,

“তোর কী খবর?”

“খবর ভালোই। কিন্তু আফসোস তোর মতো ডাক্তার হচ্ছি না।”

“আর্মিই বা কম কিসে!”

জায়িন রহস্যময় হাসলো। আবির চোখ বাঁকিয়ে তাকাল। জায়িন পাল্টা হাসলো।

“তুই জানিস কীভাবে?”

“লেকচারার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে আর্মি যেতে চাচ্ছিস কার জন্য এটাও জানি।”

আবির সত্যিই অবাক হলো। তারপর হেসে বলল,

“তুই আমার খবরও রাখিস তাহলে?”

“এলাকা ছেড়েছি। দেশ ছাড়িনি।”

“বাড়িতে এলেও তো দেখা করিস না শালা।”

“বাড়িতে এলেও খুব কম থাকা হয়। দু-এক দিনের বেশি থাকাই যায় না। সবার খবর কি?”

“একেক জন একেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। তেমনভাবে কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। এবার কতদিন আছিস?”

“আছি কয়দিন।”

“আমাদের বাড়িতে কবে যাবি? নাকি বলবি সময় নেই। বুঝি বুঝি ব্যস্ত মানুষ তুমি।”

“যাব সময় করে।”

অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুই বন্ধু দুনিয়া ভুলে আলাপে মগ্ন হয়ে গেল। এদিকে দুই বোন যে দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা বানিয়ে ফেলছে এটা কেউ খেয়াল করছে না। আবির আরও অনেকটা সময় জায়িনের সাথে কথা বলল। কথা বলার একপর্যায়ে গিয়ে আবির জানতে চাইল,

“গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড বানিয়েছিস? নাকি শালা পড়তে পড়তেই জীবন যৌবন শেষ করে ফেলছিস।”

মীরা মাহিমা দু’জনই এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছোট ভাইয়ের সামনে এসব কথা ওঠায় জায়িন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইল। সে সামান্য হেসে বলল,

“কাল দেখা হচ্ছে। সবাইকে জানিয়ে দিস।”

“ঠিক আছে।”

ধ্যাত! আসল কথাটাই জানা হলো না। চালাক বেটা ওদের সামনে বলেনি। মীরা শাড়ির কুঁচি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“তোর রাস্তা ক্লিয়ার কি-না বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে? আচ্ছা তোর কি মনে হয়? এত বড় একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে না? তুই তো উনার হাঁটুর বয়সীও হবি না।”

এতক্ষণে আবির বন্ধুর সাথে দুই বোনকে পরিচয় করিয়ে দিল।

“ওদেরকে তো তুই চিনিসই। দুইটাই আমার বোন। একটা মা’র পেটের। আরেকটা মামীর পেটের। মীরা তো মুবিনের কাছেই প্রাইভেট পড়ে। তোদের বাড়িতে দেখিসনি কখনও?”

জায়িন আড়চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে হালকা করে জবাব দিল,

“দেখেছি।”

“মুবিন নাকি ভীষণ ভালো পড়ায়। মীরার কাছে ছোট ভাইয়ের অনেক সুনাম শুনেছি। পরীক্ষায় পাস করলে মাহিও পড়তে যাবে।”

জায়িন তার ভাইয়ের দিকে একবার তাকাল। আবির বলে যাচ্ছে,

“মীরা হায়ার ম্যাথে পাস করে গেলে মুবিনকে পুরষ্কার দেব। কী বলিস মীরা? হায়ার ম্যাথকে ও যমের মতো ভয় পেত। মুবিন ভাইয়ের কৃপায় সেই ভয় কিছুটা দূর হয়েছে।

নিজের প্রসংশা শুনে মুবিন খানিকটা লজ্জা পেল। লজ্জায় দৃষ্টি নত হলো। মীরা মনে মনে আবির ভাইয়ের উপর বিরক্ত। আবির ভাই এত কথা বলছে কেন? বন্ধু বলেই কি সব কথা উনাকে বলে দিতে হবে। কথা বলতে বলতে হেঁটে হেঁটে ওরা অনেকটা চলে এসেছে। এখান থেকে ওদের পথ ভিন্ন। যাবার আগেও আবির কয়েকবার মনে করিয়ে দিল,

“কাল কিন্তু দেখা হচ্ছে।”

জায়িন তার ভীষণ দামী হাসিটা আবার হেসে বলল,

“মনে আছে।”

এই হাসির উপর মীরা মাহিমা দু’জনই একটু গলে গেল। বেশি না কিন্তু। যে লোক খুব অল্প হাসে তার হাসি এত সুন্দর হবে কেন? সুন্দর জিনিসের কদরই করতে জানে না।
বাড়ি ফিরে রুমে এসে শাড়ি খুলতে খুলতে মাহিমা বলল,

“মুবিন ভাই কিউট। কিন্তু জায়িন ভাই হ্যান্ডসাম।”

“তোর সাথে ভালো মানাবে। পারলে তাড়াতাড়ি করে পটিয়ে নে।”

চলবে_#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸

রিমুর জন্মদিন থেকে এসে পরের দিনই মীরা মাহিমা ছোট চাচ্চুকে নিয়ে সিলেট বড় ফুপুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চাচ্চু ওদের রেখে চলে আসবে। ওরা অনেকদিন থাকবে। বড় ফুপু দুই ভাইঝি, বোনঝিকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কী রেখে ওদের কী খাওয়াবে। বড় ফুপুকে এত ব্যস্ত হতে দেখে মীরা বলল,

“ফুপু এবার কিন্তু অনেকদিন থাকব। এক দিনে সব খাইয়ে ফেলতে হবে না। রয়েসয়ে অনেক দিনে খাব।”

“খালামনি প্রিয়া আপু কখন আসবে। প্রিয়া আপুকে নিয়ে ঘুরতে যাব। আমাদের কিন্তু সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।”

“ঠিক আছে দেখিস।”

এক রাত থেকে চাচ্চু ওদের রেখে চলে এলো। সিলেট ঘুরাঘুরি করার ওদের একমাত্র সাথী প্রিয়া আপু। প্রিয়া আপুর সব চেনা থাকায় সে দুই বোনকে খুব সুন্দর করে অর্ধেকটা সিলেটই ঘুরিয়ে দেখিয়ে ফেলল। পনেরো দিন ফুপুর বাড়ি থাকার পরই নিজের বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগলো। এখানে আসার জন্য দু’জন যতটা পাগল ছিল। যাওয়ার জন্যও ঠিক তেমন পাগল হয়ে গেল। শেষে কোনোভাবেই ওদের বোঝাতে না পেরে বড় ফুপু বলল,

“আর একটা সপ্তাহ থাক। প্রিয়ার পরীক্ষা শেষ হলে আমরাও যাব।”

দু’জন সমস্বরে জিজ্ঞেস করেছে,

“সত্যি যাবে তো?”

“না গেলেও তোদের চাচা/মামা এসে নিয়ে যাবে।”

মীরা আপত্তি জানিয়ে বলল,

“না না। তুমিও যাবে বড় ফুপ্পি। কতদিন আমাদের বাসায় যাও না।”

“ঠিক আছে যাব।”

এক সপ্তাহ পর ফুপু আর প্রিয়া আপুকে নিয়েই ওরা বাড়ি ফিরল। মাহিমা দীর্ঘ দিন নিজের বাড়ি থেকে দূরে থেকে আর মামার বাড়ি থাকতে চাইল না। সে সবার জোড়াজুড়ি অমান্য করেই বাড়ি চলে গেল। বোন বাড়িতে না থাকায় আবির বুঝেছে মাহিমাকে ছাড়া বাড়ি এতটা খালি খালি লাগে। এদিকে মীরাকে ছাড়া ওদের বাড়িও খা খা করছিল। রুশমি বোনদের জন্য প্রতিদিনই নাকি কেঁদেছে। বাড়ি এসে মীরা বাবাকে পেল। বায়েজিদ সাহেব অনেকদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বললেন,

“আমার মা-টা এতদিন ফুপুর বাড়িতে ছিল! বাবাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়নি মা?”

মীরা অভিমানে বুজে আসা গলায় বলল,

“তুমি কি বাড়িতে থাকো বাবা? আমাকে কি তুমি সময় দাও? তোমার বিজনেসই তো তোমার কাছে সব।”

“আমি তো এসব তোমার জন্যই করছি মা। আমার সবকিছু তোমার জন্য। তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে না পারলে আমি যে একজনের কাছে হেরে যাব মা।”

“বাবা আমার টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কিচ্ছু চাই না। আমি তোমাকে কাছে চাই। তোমার ভালোবাসা চাই। চাচ্চুরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তো আমার বাবা।”

মীরার মা টাকাপয়সার জন্যই চলে গিয়েছিল। তার পর থেকেই বায়েজিদ সাহেবের টাকা কামানের জেদ মাথায় চেপে বসল। তিনি এখন দুই হাতে টাকা কামাচ্ছেন। উনার এক মেয়ে সারাজীবন বসে খেয়েও শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারলেন না মেয়েকে টাকার সুখ দিতে গিয়ে ভালোবাসা দিতে ভুলে যাচ্ছেন।

🌸

বাড়ি ফেরার তিনদিন পরই ছোট চাচীর পেইন উঠল। তখন বাড়িতে বাবা, চাচারা কেউ ছিল না। ব্যথায় ছোট চাচীর কান্না দেখে মীরাও কাঁদতে লাগল। বড় মা মীরাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তিনি বারবার স্বামীকে কল করে যাচ্ছেন। অবশেষে আবিরকে কলে পাওয়া গেল। ছোট মামীর কথা শুনে আবির বাড়ি পৌঁছুতে পাঁচ মিনিটও সময় নিল না। এর আগেও ছোট মামীর দুইটা বাচ্চা মারা গেছে। এবার তেমন কিছু হলে ছোট মামী সহ্য করতে পারবে না। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে আবির গাড়ি করে মামীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মীরা পুরো পথ ছোট চাচীর হাত ধরে কেঁদেছ। ছোট চাচীকে সান্ত্বনা দিয়েছে।

“তোমার কিছু হবে না ছোট চাচী। বাবুরও কিছু হবে না। তুমি দেখো।”

“মীরা আমার বাবুটার যেন কিছু না হয় রে।”

“কিছু হবে না। তুমি দেখো কিচ্ছু হবে না। আমার আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি। আল্লাহ আমার কথা শুনবেন।”

রাত এগারোটায় পুরো পরিবার হাসপাতালে এসে জড়ো হলো। সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে কাঁদছে। মীরা মাহিমাকে জড়িয়ে ধরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে পরিবারের প্রতিটা মানুষ ভয়ে আতঙ্কে অপারেশন রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার যেন কোন খারাপ খবর শুনতে না হয়। এগারোটা চুয়ান্ন মিনিটে ছোট মামীর ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছে। মেয়ের কান্নায় হাসপাতালে সবাই তাদের ক্যাবিনের সামনে চলে এসেছে। ডাক্তার বের হয়ে জানাল।
মেয়ে এবং মেয়ের মা দু’জনই সুস্থ আছে। অবশেষে ভয় কেটে গিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটলো। ইভান চোখ মুছে বলল,

“আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি।”

তনি আপু তার মা’কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমি আমার বোনকে দেখব মা। ও কার মতো হয়েছে?”

সদ্যোজাত শিশুটি পিটপিট করে তাকিয়ে তার পরিবারের মানুষ গুলোকে দেখছে। মেয়েটার ঠোঁট লাল টকটকে। মীরা অবাক হয়ে দেখছে। এই মেয়ে এত সুন্দর হয়েছে কেন? কাগজের মতো সাদা। মাহিমা বাবুকে ছুয়ে দিয়ে বলল,

“কী নরম! তুলোর মতো তুলতুলে। মীরা ছুঁয়ে দেখল। এত নরম কেন?”

মীরাও ছুঁয়ে দেখল। সত্যিই। মীরার মেয়েটাকে হাওয়াই মিঠায়ের মতো লাগছে। এর নাম কি দিবে? মিঠাই? না। মীরা সুন্দর একটা নাম ভেবে রেখেছে। রুশমিও বাবুর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। বাবু তার হাত ধরতে চাইলে খুশিতে চিৎকার করে উঠছে। মেয়েটা চিকন চিকন হাত নাড়িয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলোকে দেখছে। আবির বিস্মিত চোখে বলল,

“আরে এত তো দেখি আমাদের দ্বিতীয় মীরা। মামী তুমি আরেকটা মীরার মা হয়েছ। দুইটা মীরা আমাদের।”

ভাইয়ের কথা শুনে মাহিমা মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেলে বলল,

“এটা কি আমার বোন না? তাহলে আমার মতো দেখতে হয়নি কেন? মীরার মতো হয়েছে পাঁজি মেয়ে।”

ইভান মাহিমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“আরে আবির কী ছাতা বুঝে। আমার কাছে তো বাবুকে তোর মতোই লাগছে। দেখ চোখ দু’টো পুরো তোর চোখের মতো।”

তনি ঘোষণা করল,

“বাবু যার মতোই দেখতে হোক। কিন্তু এই মেয়ের নাম আমি রাখব। এটা বড় বোনের অধিকার।”

মীরা মনে মনে কষ্ট পেল। সে তো একটা নাম ঠিক করে রেখেছিল। প্রিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“এহ আসছে আমার বড় বোন! তোর বড় আমি। বাবুর নাম রাখার অধিকার একমাত্র আমার। তোরা বাচ্চা পোলাপান নাম রাখার কী বুঝিস রে।”

বাড়িতে ছোট্ট অতিথি আসায় সবাই কত খুশি। মেয়েটা ওদের জীবনে নতুন খুশি নিয়ে এসেছে। ছোট চাচ্চু প্রথম বার মেয়েকে কোলে নিয়ে সবার সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। প্রিয়া, তনি, মীরা মাহিমা চাচ্চুকে শান্ত করতে এলে ওদের জড়িয়ে ধরেও কাঁদল। রুশমি চাচুর কান্না দেখে ভয় পেয়ে মায়ের কোল জড়িয়ে থাকল। এ যেন কান্নাকাটির প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। কে কার থেকে বেশি কাঁদতে পারে। চাচী কাঁদে, চাচা কাঁদে। দামড়া দামড়া ভাই গুলোও কতক্ষণ কেঁদেছে। মীরা আর মাহিমার কান্না তো কেউ গোনায় ধরে না। কারণ ওরা কারণে অকারণে কাঁদতেই থাকে।
দুই দিন পর বাবুকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এই বাড়ি সবসময় হৈচৈ হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে থাকত। কিন্তু বাবু বাড়ি আসার পর যেন সেই খুশি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মাহিমা আবির বাড়ি যাওয়ার নামই নিচ্ছে না। ছোট ফুপুও চলে এসেছে। ভাইঝিকে রেখে তিনি কোথাও যাবেন না।
বাবুর উছিলায় অনেকদিন তনি আপু, আবির ভাইয়ার ভার্সিটি, ইভান ভাইয়ের অফিস সবই বন্ধ ছিল। মীরাদের ঘোরাঘুরিও আটকে আছে। পরীক্ষার পর কক্সবাজার যাবার প্ল্যান ছিল। কই কেউ তো কক্সবাজার এর নামই নিচ্ছে না। অনেকদিন বাড়ি থেকে বের হয়নি। মীরা ভাবল আজ বিকেলে সুমনা আন্টির সাথে দেখা করে আসবে। পরীক্ষার পর থেকে দেখা হয় না। আন্টি তো সারাক্ষণ বাড়িতে একা থাকে। মীরা বের হওয়ার সময় বড় মা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল।

“বোন হয়েছে। ওদেরকে মিষ্টি মুখ করাবি না?”

মীরা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুবিন ভাইদের বাড়িতে চলে এলো। এতদিনে তার একবারও মুবিন ভাইয়ের কথা মনে পড়েনি।
কলিংবেল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আন্টি ফোন কানে নিয়ে দরজা খুলে দিয়েই বকাঝকা শুরু করে দিল।

“তোর কি ধৈর্য বলতে কিছু নেই মীরা? মানুষকে আসার সময় তো দিবি।”

“আমি ধৈর্যহীন একটা মানুষ। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দেয়নি।”

“এতদিন কোথায় ছিলি? পরীক্ষা দিয়ে আন্টি ভুলে গেলি?”

“বড় ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার ছোট বোন হয়েছে আন্টি। মিষ্টি এনেছি। বাবুটা যে কী সুন্দর হয়েছে তুমি যদি দেখতে। একদম তুলোর মতো নরম। আমার ওকে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

“তোর ছোট কাকীর বাবু হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?”

“মেয়ে। আবির ভাইয়া কী বলে জানো, বাবুটা নাকি পুরোপুরি আমার মতো দেখতে হয়েছে। আবির ভাই ওকে দ্বিতীয় মীরা ডাকে। মাহিমা হিংসে করে বলে ইভান ভাই বলে বাবু নাকি ওর মতো হয়েছে। কিন্তু আমি দেখেছি বাবু আমার মতোই হয়েছে।”

মীরা একনাগাড়ে বকবক করেই যাচ্ছে। সুমনাও হাঁ করে শুনছিল। হঠাৎ ফোনের ভেতর থেকে কেউ একজন মা বলে ডেকে উঠায় সুমনার মনে হলো জায়িন কলে ছিল। এখনও আছে। ছেলে হয়তো রেগে গেছে ভেবে সুমনা জিভ কামড়ে বলল,

“মীরা মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ওর চাচীর মেয়ে হয়েছে। ওসবই বলছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম তুই যে কলে আছিস।”

“হু।”

“তুই কি এই মাসে বাড়িতে আসবি না।”

“জানি না। দেখি। পড়ার ভীষণ চাপ যাচ্ছে।”

“যতই পড়ার চাপ থাকুক বাবা। তুই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস। দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস দেখেছিস?”

“মা আমি রাখি। পরে কথা বলব।”

“শোন, জায়িন…

কল কেটে দিয়েছে। মীরা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

” কার সাথে কথা বলছিলে আন্টি?”

“জায়িনের সাথে। খাওয়াদাওয়ার কথা বললেই কল কেটে দেয়। নিজের প্রতি একদম খেয়াল নেই। এই ছেলেকে নিয়ে যে আমি কী করব? হোস্টেলের খাবার ভালো না লাগলেও কিছু বলবে না। দিনের পর দিন পানির মতো ডাল খেয়ে খেয়ে ছেলেটা আমার শুকিয়ে গেছে।”

কে শুকিয়ে গেছে? জায়িন ভাই! হাহ্, আন্টির কি চোখের পাওয়ার কম। ওরকম বডি বিল্ডার ছেলেকে বলছে শুকিয়ে গেছে। আন্টি তুমি যাকে শুকিয়ে যাওয়া বলো, তোমার ছেলে ওটাকে ডায়েট বলে। আবাইত্তার মতো খেলে কি আর সিক্স প্যাক থাকবে। তুমি ওসব বুঝতে না। কারণ মায়েদের কাছে তার হাতির মতো ছেলেকেও চিকনই মনে হয়। মোটাকে খাইয়ে খাইয়ে ফাটিয়ে ফেলতে চায়।

চলবে_

এইযে দুইটা গল্প একদিনে দিলাম। তবুও আপনারা সাইলেন্ট থাকবেন। সুন্দর সুন্দর কয়টা কমেন্ট করলে কী হয়😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here