মন পাড়ায় পর্ব ৩৯+৪০

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩৯
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকত ভোর সাড়ে চারটায় বাস থেকে নামে। ঘুরতে থাকে এই নিঝুম শহরের গলিতে। এই নীরবতা তার বুকের ভেতরের কষ্টগুলো আরও গাঢ় করে তুলছে। তার মনে হচ্ছে তার বুকের উপর এক পাথর রাখা হয়েছে। অথচ তার এই নিরবতায় ভালো লাগছে। হোক তার কষ্টগুলো তীব্র ও বিস্তর। হয়তো এই কষ্টগুলোর সাহায্যেই ঝিনুক থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে সে। তার জীবনটাও আজব। আপন মানুষগুলোকে সে ঠিকই পায় কিন্তু তারা কখনো আপন হয় থাকে না।

সকাল সাতটার দিকে সৈকত ইকবালকে কল দিলো। প্রথমবার সে ধরলো না। দ্বিতীয়বার ধরেই একটা গালি দিয়ে বলল,
“তোর আর কোনো কাম নাই এত সকালে কে উঠায়? শালা এত সকালে তো আমার মাও স্কুলে যাওয়ার জন্য উঠাতো না। দিলি তো ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়ে। তুই জানোস আমি কত ঘুমপ্রিয় মানুষ?”
সৈকত শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা তাইলে ঘুমা।”
“এক মিনিট দাঁড়া। তুই এত সুন্দর ভাবে কথা বলতেছোস? কী হইছে তোর? আংকেলের সাথে কিছু হইছে না ঝিনুকের সাথে?”
সৈকত এমন মন উদাসের সকালেও হেসে দিলো ইকবালের ছটফটে কথার ধরণ দেখে। ইকবাল আবারও বলল,
“তুই এমনে হাসতেছোছ মানে কিছু হইসে৷ কই তুই আমি আসতেছি।”
“তোর গলির চায়ের টঙের সামনেই আছি।”
“পাঁচ মিনিট দেয়।”

পাঁচ মিনিট বলে এক মিনিটেই হাজির হলো ইকবাল। দৌড়ে আসার কারণে ভীষণ হাঁপাচ্ছে সে। সৈকত তাকে দেখে হেসে বলল,
“সারাজীবন পাঁচ মিনিট বলে পঞ্চাশ মিনিট লাগানো মানুষ আজ এক মিনিটে হাজির। নাইস ইম্প্রুভমেন্ট।”
“তুই এমনে হাসবি না। তওর এমন মলিন হাসি দেখলেই ভয় লাগে। কী কান্ড হইসে তা বল?”
সৈকত কিছু বলল না। ইকবাল সৈকতের সামনের বেঞ্চে বসে আবারও জিজ্ঞেস করল,
“আংকেল আন্টিকে আবার কিছু বলছে?”
সৈকত মাথা ডানে বামে নাড়লো।

সাথে সাথে ইকবাল রাগান্বিত স্বরে বলল, “ঝিনুক ভাবি বড় কিছু বলেছে বা করে ফেলেছে? ওই পরিশের বাচ্চার জন্য না’কি অর্ণবের কথায়? আর তুই আবাল ঝিনুকের কথায় মন খারাপ করে বসে আছিস? ওর মধ্যে ম্যাচুরিটি কম জানিসই তো বাচ্চামি ভাব। তুই ওর কথায় মন খারাপ করতে যাস কেন?”
সৈকত মাথা নিচু করে ছিলো। সে মাথা নিচু রেখে ভেজা কাঁপানো কন্ঠস্বরে উওর দিলো,
“ও শুধু আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলে নি আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে। আমি কীভাবে মানতে পারব যে মেয়ে আমাকে জীবনের সৌন্দর্য দেখিয়েছে আজ সেই মেয়ের জন্য আমার নিজের জীবনটা বিষাক্ত করে তুলেছে।”
সৈকত আবার ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও বলেছে আমার ভালোবাসা না’কি ওর দেহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ও এই কথাটা বলার আগে একটুও ভাবে নি। আমি মানলাম ওর মধ্যে ম্যাচুরিটি কম আর বোকা একটু কিন্তু মানুষ কথা বলার আগে তো ভাবে। ভাবে সামনের মানুষটারও মন আছে। সে একটা সাধারণ কথাও মানুষের ভেতরটা শূন্য করে দিতে পারে এই কথাটাও ও ভাবে নি। আরে আমার যদি শুধু ওর দেহ ভোগ করতেই হতো তাহলে আমি আমাদের বিয়ের পর ওর সাথে জোর করতে পারতাম না? আমার তো ওর উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাই না? আমি শুধু ওকে চেয়েছি। ও দূর যাওয়ার পর কখনো ওর কাছে যায় নি দূর থেকেই ওকে চেয়েছি। ওর অজান্তে ওকে রক্ষা করেছি, ওর সকল আশা পূরণ করার চেষ্টা করেছি, দূর থেকে ওকে যতটা সুখে রাখা যায় ততটা চেষ্টা করেছি। আর ও অবশেষে বলল আমি নিজের লালসা পূরণের জন্য ভালোবাসার নাটক করছি!
কোথাও শুনেছিলাম যে ভালোবাসার মানুষটি যেতে চাইলে তাদের যেতে দিও, যদি তারা ফেরত আসে তাহলে সে তোমার ভাগ্যে লেখা থাকে তাহলে সে অবশ্যই ফেরত আসবে। ঝিনুক তো এসেছিলো রে কিন্তু ও আমার ভাগ্যেই নেই।”
ইকবাল উঠে যেয়ে সৈকতের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই দেবদাস হতে চাইলে হতে পারোস। কোনো পারু পাইলে তার বান্ধবীর সাথে শুধু আমার সেটিং করায় দিস।”
সৈকত ইকবালের পিঠে এক ঘুষি মেরে বলল, “আমি এইখানে তোর সাথে এত সিরিয়াস কথা বলছি আর তুই মজা নিতাছোস শয়তান?”
ইকবাল হেসে বলল, “আগে বল দেবদাস হওয়ার ট্রিট কবে দিবি। গতবারের মতো একটা বার্গারে ছাড়তেছি না। দশটা লুচি, বিফ চাপ তিন চারটা আর….”
সৈকত ইকবালকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কুত্তা যা তুই এইখান থেকে।”
ইকবাল হেসে আবার সৈকতে কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আচ্ছা রাগ করিস না আমি খাওয়ামু নে। এইবার খুশি।”
সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইকবালের দিকে। ইকবাল সৈকতের গাল টেনে বলল,
“বাবু একটু হেসে দেখাও।”
সৈকত সাথে সাথে আরও কয়টা মারলো ইকবালকে। তারপর নিজেই হেসে দিলো। হেসে রাগী কন্ঠে বলল,
“শালা আমি তোর কাছে একটু কষ্টের কথা কইতে আইসিলাম আর তুই কাহিনী শুধু করসোস। কী বলতাম তাও ভুলে গেছি।”
“যাক স্বাভাবিক হইসোস। এতক্ষণ তোর এই সেন্টিমার্কা সুন্দর কথা শুনে আমি অসুস্থ হইয়া যাইতাছিস যে আমার বন্ধু কোন দেশের এলিয়েন থেকে রিপ্লেস হয়ে গেছে।”
“গাঁধা ওইটা দেশ না গ্রহ হবে।”
“ওই যে লাউ সেই কদু।”

সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল,
“শর্টকাট পরিশ এসেছিলো আবার ঝিনুককে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝাইছে আর ও বুঝেও গেছে। গতকাল রাতে অনেক কাহিনী হইসে যা পরে বলব আপাতত আরেক সমস্যা আছে সামনে। ঝিনুক বলল ও আজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে না।”
“স্যারদের সাথে কথা বলে নিলেই হবে।”
“সমস্যা স্যার না। সমস্যা হচ্ছে জ্যোতি। জ্যোতি ও ঝিনুকের মধ্যে শর্ত লেগেছে নাচ নিয়ে। যে হারবে সে বিজয়ীর কথানুযায়ী একটা কাজ করবে এবং তুই জানিস জ্যোতি ঝিনুককে একদম পছন্দ করে না। তাই ও ছোট কোনো কাজ দিবে না। এই নিয়ে চিন্তা আছি।”
“আল্লাহ এখন কী করবি?”
“তুই আমাকে মারবি।”
ইকবাল চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“কী! কিন্তু কেন?”
“যেন জ্যোতিও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করতে পারে। আমি মাথায় নকল ব্যান্ডেজ লাগিয়ে যাব সাথে তোর মারার দাগ থাকবে। ও আমাকে আহত অবস্থায় দেখে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে না। আর খুশিও হয়ে যাবে কোনো এক ভাবে হলেও আমার সাথে সময় কাটাচ্ছে।”
“কিন্তু ও তো পরে জানবে যে ঝিনুকও আসে নি তখন তো সন্দেহ হবে যে তুই যা করেছিস ঝিনুকের জন্য করেছিস। ও আগের থেকে তোদের দুইজনের ব্যাপারে জানে। আর হতে পারে ঝিনুক ও তোর বিয়ের ব্যাপারেও আন্দাজ করতে পারছে।”
“আমি যতটুকু জানি বিয়েতে বাবার বিজনেস রিলেটেড কোনো ব্যক্তি আসে নি। আর জ্যোতির আব্বু এখন আমার বাবার সাথে কোনো যোগাযোগ করে না নূহার মৃত্যুর পর থেকে। আর বাবা নিজে বলেছে যে যতদিন আমার চাকরি না হয় ততদিন আমার বিয়ের খবর যেন বাহিরে না যায়। আর রইলো ঝিনুকের ব্যাপার সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। জ্যোতির সামনে তোকে ফোন দিয়ে বলব যে কোনো মূল্যেই হোক ঝিনুক যে প্রতিযোগিতায় আসতে না পারে। জ্যোতি উল্টো ভাববে আমি যা করছি ওর জন্য করছি।”

ইকবাল তার ভ্রু কপালে তুলে বলল,
“তোর মাথায় এইসব আসে কোথা থেকে?”
“আয় এবার একটু কাজ কর।”
ইকবাল নিচের থেকে একটা পাথর নিয়ে সামনে যেয়ে দাঁড়ালো সৈকতের আর জিজ্ঞেস করল,
“ঝিনুক তোকে গতরাতে এতটা কষ্ট দিয়েছে অথচ তুই এখনো ওর চিন্তা করছিস? ওর জন্য নিজ ইচ্ছায় আহত হওয়ার দরকার কী? জ্যোতি যদি ঝিনুককে কোনো কষ্ট দেয়ও তবুও ওর এইটা যোগ্য নিজের বোকামিগুলো তো বুঝবে।”
“কারণ আমি যখন ওকে ভালোবেসেছিলাম তখন নিজেকে ওয়াদা করেছিলাম। ওর সব কষ্টগুলো আমি নিজের ভাগে নিব আর সুখটুকু ওকে দিয়ে দিব।”
.
.
জ্যোতি আয়নার সামনে বসে আছে। দুইজন তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। এমনই এক সময় একটা ছেলে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“মেডাম সৈকত ভাই আসছে।”
জ্যোতি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। একগাল হেসে বলল,
“সৈকত এসেছে?”
“জ্বি।
জ্যোতি অনেকটা খুশি হয়ে দৌড়ে যেতে নিলো বাহিরের দিকে। আবার থেমে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
” একমিনিট ও আমার বয়ফ্রেন্ড তুমি জানো। তোমার সাহস কীভাবে হয় ওকে ভাই টাই বলার। স্যার বলা উচিত এইটা শিখানো হয় নি?”
ছেলেটা আমতা-আমতা করে বলল,
“সৈকত ভাই না মানে স্যারই বলেছিলো।”
“নিজের জায়গা মনে রাখবে এর পর থেকে, নাহয় ভালো হবে না। নতুন এসেছ তাই ছেড়ে দিলাম। আমি রাগ কেমন সেটা বাড়ির সব কাজের লোক থেকে জেনে নিও।”
বলেই একরাশ অহংকার নিয়ে চলে গেল সে।

ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে সৈকত বসে আছে সোজায়। তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা ও মুখে দাগ। সে দৌড়ে গেল সৈকতের কাছে। তার পাশে বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“তোমার এই অবস্থা কেন?”
“বাহ তোমাকে দেখি অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে সবার চোখ তোমার উপরই থাকবে।”
“উফফ এইসব বলার সময় এখন? তোমার এই অবস্থা কেন এবং কে করেছে?”
“সকালে মারামারি হয়েছিল এক ছোট ভাইয়ের মামলায়। বাসায় এই অবস্থায় গেলে বাবা তামাশা করতো তাই তোমার কাছে এসেছি। তোমার এইখানে কিছুক্ষণ থাকলে কী সমস্যা হবে? আসলে শরীর প্রচন্ড খারাপ লাগছে। মাথা তজেকে রক্ত পরেছে প্রচুর।”
“বলো কি তুমি রেস্ট নেও। আমি আছি তোমার সাথে।”
“কিন্তু তোমার নাচ আছে তো। আর আমি চাই না তুই কারো থেকে পরাজিত হও।”
“আমার কাছে তুমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ যা হবে পরে দেখা যাবে।”
“একদম না। আমার জন্য তুমি……”
জ্যোতি সৈকতের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলল,
“আর কোনো কথা না।”
সৈকত হেসে জ্যোতি হাত সরিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি তো তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারি না তাই না। আইডিয়া।”
“কী?”
জ্যোতি প্রশ্ন করল। সৈকত বলল,
“তুমি না অংশগ্রহণ করতে পারলে ঝিনুকও পারবে না।”
সৈকত ফোনটা নিয়ে ইকবালকে ফোন দিয়ে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বলল। এরপর জ্যোতিকে বের খুশি দেখা গেল। জ্যোতি সবাইকে নিজের রুম থেকে বের করে সৈকতকে নিয়ে গেল। তার সাথে ঘেঁষে বসলো। সৈকত সাধারণত জ্যোতির সাথে পাব্লিকপ্লেস ছাড়া দেখা করে না। একবার এসেছিলো কিন্তু জ্যোতি এমন এক কান্ড করল যা সে কখনো ভাবতেও পারে নি। জ্যোতি তার ড্রেস সৈকতের সামনেই খুলতে শুরু করল। সৈকত হতদম্ব হয়ে ছিলো শুধু। তার অনেক মেয়ে বান্ধবী আছে কিন্তু কখনো কারো এমন ব্যবহার সে দেখে নি। সেদিন কোনো একভাবে সেখান থেকে বের হলো সৈকত আর আজ এলো৷ জ্যোতি কিছু করতে যাবে এর আগেই সে বলল,
“জান আমার সম্পূর্ণ শরীর ভীষণ ব্যাথা করছে প্লিজ ধরো না। ধরলেই ব্যাথা লাগে।”
জ্যোতি চিন্তিত সুরে বলল,
“আচ্ছা তুমি বসো আমি স্যুপ আনতে বলছি কাওকে আর ডাক্তারকে ডাকছি।”
“ডাক্তারকে দেখি এসেছি। এই দেখ ব্যান্ডেজ।”
“আচ্ছা তাহলে স্যুপ আনতে বলি।”
.
.
অর্ক সকাল থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে প্রভাকে খুঁজছে। কোথাও পেল না ঘরে। ঘরে কেউ উঠে নি। বোধহয় আজ জলদিই উঠে গেল সে।

অবশেষে ছাদে যেয়ে দেখা পায় প্রভার। চারপাশে আবছা আলো ছিলো। কেউ ছিলো না এই স্নিগ্ধ প্রভাতটা উপভোগের জন্য।
প্রভার ছোট পুকুরটির সিঁড়িতে বসে ছিলো। তাকে এই সকালটা মতোই দেখাচ্ছে স্নিগ্ধ ও কোমল। প্রভা দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“আমার মন বলছিল আপনি আসবেন।”
“কীভাবে?”
“মন তো তাই।”
অর্ক প্রভার পাশে যেয়ে বসলো। বলল,
“আমার অপেক্ষা করছিলে?”
প্রভা মৃদু হাসলো। উওর দিলো না। সেখান থেকে দাঁড়ালো যেয়ে পাশের জায়গাতেই। দেখতে থাকল সে বিশাল কমলা আকাশের চিত্রময় দৃশ্যকে।

“তোমার কী মনে হয় কীজন্য খুঁজছিলাম আমি তোমায়?”
অর্কের প্রশ্ন শুনে প্রভা উওর দিলো,
“জানি না তো।”
অর্ক পাশে এসে দাঁড়ালো তার। তার কাঁধ ধরে তাকে নিজের দিকে করে দুইহাত নিজের হাত নিলো। আর দুই হাঁটু গেড়ে বসলো।
প্রভা নির্বাক। কী হচ্ছে তার ধারণাটাও সে করতে পারছে না।

অর্ক বলল,
“আমি জানি আমি জানা অজানায় তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কখনো কথায় তো কখনো কাজে।”
“এইসব কথা তুলছেন কেন?”
“এখন কথা বলো না প্রভা। শুনো শুধু। কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেছি যখন তোমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলেছি। আমি জানি অন্য দশটা মেয়ের মতো তোমার মনে শত স্বপ্ন, শত আশা ও হাজারো সুখ ছিলো না। কারণ আমাদের সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক ছিলো না। কিন্তু তোমার প্রতি আমার যতই রাগ থাকুক না কেন কোনো মেয়ের চরিত্রের উপর প্রশ্ন তোলার পূর্বে আমার একশোবার ভাবা উচিত ছিলো। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রভা। আমি তোমাকে তখন না চিনে তোমার চরিত্রে উপর প্রশ্ন করেছি আজ তোমায় চেনার পর আমার নিজের বিবেকের উপর প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করছে।”
প্রভা অর্কের হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলল,
“আপনার হঠাৎ করে এই সকাল সকাল কী যে হলো। এইসব কথা ভুলে যান।”
বলেই প্রভা মিষ্টি হেসে অর্কের চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে শুয়ে করল।
প্রভার সে মিষ্টি হাসিতে সে সকালটা আরও স্নিগ্ধ লাগছিলো। অর্ক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো সে মুখটার দিকে। নিজের চুলে বুলিয়ে দেওয়া প্রভার হাত ধরে নিলো।
হঠাৎ এমনটা হওয়ায় চমকে তাকায় প্রভা৷ অর্কের চোখজোড়ায় তার চোখদুটো আটকায়। মুহূর্তে তার বুকের ভেতর এক তুফান বয়ে যায়।
অর্ক তার হাত ছেড়ে চুলের খোঁপা খুলে দেয়। সে বাঁধা দেয় না। তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কানের পিছনে হাত রাখে। সে বাঁধা দেয় না।
অর্কের নেশাভরা চাহনি দেখে তার নিশ্বাসটা ভারী হয়ে আসছে যেন। সে বুঝতে পারছে না কী হতে যাচ্ছে।

অর্ক একটু ঝুঁকে চোখ দুটো বন্ধ করে প্রভার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। আবার উঠে প্রভার মুখটা যাচাই করে নিলো। প্রভার মুখে রাগ নেই। প্রথমে ছিলো বিস্ময় আর এখন আছে লজ্জামাখা হাসি। সে লজ্জা দেখে অর্ক যেন মাতোয়ারা হয়ে গেল। প্রভার দিকে এগোতেই প্রভা তার ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলল,
“আমরা ছাদে আছি। কেউ এইসব দেখলে খারাপ ভাববে।”
অর্ক সাথে সাথে তাকে কোলে তুলে নিলো। প্রভা বলল,
“নিচে নামান। কেউ দেখে ফেলবে।”
অর্ক মানলো না। সে প্রভাকে নিয়ে সে পুকুরপাড়ে যেয়ে সিঁড়িতে প্রভাকে বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখল।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৪০
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অর্ক মানলো না। সে প্রভাকে নিয়ে সে পুকুরপাড়ে যেয়ে সিঁড়িতে প্রভাকে বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখল।
প্রভা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছেন?”
অর্ক প্রভার হাত নিজের চুলে হাত রেখে বলল,
“আমি যখন ছোট ছিলাম আমার মা প্রায়ই আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতো। আমি আমার চুলে কখনো কাওকে হাত লাগাতে দেই নি মা ছাড়া। কিন্তু তুমি আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলে অনেক শান্তি লাগে। মনে হয় আমার সব চিন্তা মুহূর্তে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।”
প্রভা মৃদু হেসে অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। প্রভা বলল,
“আপনাকে একটা কথা বলি?”
“তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
“আপনি তখন ছোট ছিলেন বুঝলাম কিন্তু আজ তো আর ছোট নেই তাহলে কেন মা’কে আপন করে নেন না?”
অর্ক অনেকটা সময় চুপ থাকল। এক হাত দিয়ে প্রভার লম্বা চুল দিয়ে খেলতে শুরু করল আর বলল,
“আমি আমার মা’য়ের জায়গা অন্যকাওকে দিতে চাই নি।”
“আমরা কখনো মন পাড়ায় কারও জায়গা অন্য কাওকে দিতে পারি না। সবার জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করতে হয়।”
অর্ক থেমে গেল। প্রভার দিকে তাকাতেই তার চোখে চোখ পড়লো। সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মন পাড়ায় স্বামীর জায়গাটা কী তুমি এখনো আমাকে দেও নি? কারণ সে জায়গার দাবিদার তো অন্যকেউ ছিলো।”
“আপনাকে বিনয়ের জায়গা আমি কখনো দেই নি।”
কথাটা শুনতেই অর্ক প্রভার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। বুকের ভেতরে প্রচন্ড ব্যাথার আভাস পেল সে। অন্যপাশে ফিরে শুয়ে তার পায়ের নুপুর ছুঁয়ে বলল,
“তোমার থেকে এতটা আশা করাটাও ভুল আমার। অবশেষে এইটা তোমার জন্য জোরপূর্বেক বিয়েই তো।”
প্রভা এক মুহূর্তের জন্য হাত বুলানো বন্ধ করে তার চোখে হাত রেখে বলল,
“আপনাকে কখনো ওর জায়গা দিলে বিশ্বাস করতে পারতাম না যে। মন পাড়ায় কাওকে অন্যকারো স্থান দিলে তাকে আগের মানুষটার ভালোবাসা, সম্মান, বিশ্বাস সবটা দিতে হয়। আমি আপনাকে ওর জায়গা দিলে না আপনাকে আর সম্মান করতে পারতাম আর না বিশ্বাস। কারণ বিশ্বাস একবার ভাঙলে তা জোড়া দেওয়া ভীষণ কষ্টকর। শুধু ওই মানুষটার উপর বিশ্বাস হারায় তা না। সম্পূর্ণ সম্পর্কের উপর বিশ্বাস হারিয়ে যায়। হোক তা বিবাহ, ভালোবাসা, বন্ধুর বা অন্যকিছু। ভালোবাসা হারানোটা থেকে বিশ্বাস হারানোটা বেশি কষ্টকর। কিন্তু পরে ভাবলাম পৃথিবীর সকল মানুষ ভিন্ন। ভিন্ন তাদের মন। তাই বিশ্বাস ভাঙলে মানুষের উপর বিশ্বাস উঠানো উচিত সম্পর্কের উপর নয়।”
অর্ক আলতো করে প্রভার হাতের উপর হাত রাখলো। হাতটা চোখ থেকে সরিয়ে প্রভার দিকে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলো আর প্রভা তার ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলল,
“দয়া করে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”
অর্ক হাসলো একটুখানি। সুখ ও দুঃখের মিশ্রণের সে হাসি। প্রভা তাকে সম্মান ও বিশ্বাসটাই দিতে পারলো শুধু ভালোবাসাটারই কমতি রয়ে গেল। হয়তো এই কমতি সারাটা জীবন রয়ে যাবে।
.
.
সৈকতের সামনে অনেকগুলো ছবি। জ্যোতি একটা বড়সড় বাক্স আনিয়েছিল। বাক্সে অনেকগুলো ছবির এলবাম আর কিছু ছবি আঁকা কাগজ।

এই প্রথম সৈকতের কাছে জ্যোতিকে অসহ্য লাগছে না। জ্যোতি সবসময়ই এমন ভাবে থাকে যা সৈকতের অপছন্দ।

জ্যোতিকে প্রথমে যখন সে দেখেছিল তখন তাকে ভীষণ অহংকারী ও জেদি মেয়ে মনে হয়েছিল। সে ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে। কারণ প্রথম দেখাও কাওকে চেনাটা জটিল। কিন্তু আফসোস তার ধারণা সঠিক হলো। জ্যোতি এমনই। কিন্তু এই প্রথম যখন সে তার ও নূহার ছোটবেলার গল্পগুলো শোনাচ্ছিল তখন প্রথম তার জ্যোতিকে সাধারণ মেয়ের মনে হলো। যে নিজেও অতীতের কিছু স্মৃতি মনে করে মন থেকে হাসতে জানে। খুশি হতে জানে বাচ্চা মেয়েদের মতো।

জ্যোতি বলল,
“জানো আমি ও নূহা আপু আগে বিকেলে ছাদে যেয়ে লাইটের নিচে বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে ছবি আঁকতাম। পুতুল দিয়ে খেলতাম। এই দেখো এখন আমার কাছে বর পুতুল ও কন্যা পুতুল আছে। আমি সবসময় বর পুতুলের মা হতাম আর আপু কন্যা পুতুলের।”
সৈকত হেসে বলল,
“তুমি নূহা আপুকে অনেক ভালোবাসতে তাই না?”
“অনেক। আপু আমার কাছে মা’য়ের মতো ছিলো। ছোট থেকে আমাকে দেখে রাখতো, আমাকে ভালোবাসতো, আমার যত্ন নিতো। এমনকি এই পৃথিবীতে আমার রাগ শান্ত করার কারো ক্ষমতা থাকলে শুধু আপুর ছিলো। আমার আপু বেস্ট।”
জ্যোতি তার ও নূহার ছবিটি দেখে বলল।
সৈকত মৃদু হাসলো জ্যোতির কথা শুনে। তার নিজেরও তার ও অর্কের ছোট বেলায় কাটানো সময়ও মনে পড়ে গেল।

সৈকত বিছানায় থাকা সব ছবি দেখছিলো। এমনই এক কাগজ খুলে দেখলো একটা হাস্পাতালেরর কাগজ। ছবির মাঝে এমন কিছু পেয়ে সে অবাক হলো। পড়তে যাবে তখনই জ্যোতি সে কাজগটা তার হাত থেকে টান দিয়ে নিয়ে নিলো। এমনটা হওয়ায় সৈকত অবাক হয় বেশ। সে জিজ্ঞেস করে,
“এইটা কীসের কাগজ?”
জ্যোতি আমতা-আমতা করে বলল,
“এম-এমনি কিছু না। ভুলে বোধহয় এসে পরেছে।”
বলেই সেই ছবিটা বাক্সে এক এলবামে ভরে রাখলো।

সৈকতের চোখ ছিলো সে এলবামের দিকেই। কাগজটা নিশ্চয়ই জরুরী কিছু, নাহয় জ্যোতি এইভাবে তার হাত থেকে কখনো ছিনিয়ে নিতো না।
.
.
ঝিনুক, প্রভা ও অর্ক দুপুরেই বাসায় এসে পৌঁছে গেছে। ঝিনুক সারাদিন রুম থেকে বের হয় নি। মধ্যরাত পর্যন্ত দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলো সবসময়ের মতো। সৈকত এলো না সে রাতে। সকালে মা’য়ের কাছে জানতে পারে সৈকত রাতে বাসায় আসে নি।

ভার্সিটিতে যেয়ে অঞ্জলি, অর্ণব ও সাবেকের সাথে ক্যান্টিনে দেখা হয়। অঞ্জলি থেকে বিবরণসহ শুনলো কি হয়েছে সে রাতে। সবটা শুনে ঝিনুক বলল,
“তুই চিন্তা করিস না আমি আন্টির সাথে কথা বলব।”
“মা কারো কথা শুনছে না।”
” তোদের বাসায় গেলেই আন্টি যে আদর করে আমায় আমার মনে হয় আমার কথা শুনবে।”
অঞ্জলি একটু চিন্তা করে বলে,
“তা অবশ্য ঠিক। আমার অন্যকোনো বান্ধবীকে কখনো মা পাত্তাই দেয় আর আর তোর সাথে যে সুন্দরভাবে কথা বলে, নাস্তা দেয় আর গল্প করে। হ্যাঁ দোস্ত তুই মায়ের সাথে কথা বলিস।”
অঞ্জলি আবার সাবেকের দিকে তাকাল। তার কপালে এক ফোঁটাও সংশয় নেই। সে মন মতো খেয়েই যাচ্ছে। অঞ্জলি রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তোমার কিছু আসে যায় না তাই না? আমার বিয়ে হোক আর যাই হোক।”
সাবেক মুখে খাবার নিয়েই অবাক হয়ে তাকাল অঞ্জলির দিকে। অস্পষ্ট ভাষায় বলল,
“কী হইসে?”
“কী হয়েছে মানে? এইখানে এত গম্ভীর বিষয়ে কথা বলছি আর তুমি খাচ্ছো?”
“কান দিয়ে তো শুনছি। দেখো অঞ্জলি দুনিয়া একদিকে খাওয়া একদিকে। রাগ, জেদ, চিন্তার সাথে খাওয়েনের সম্পর্ক নাই। মানুষ বাঁচেই তো খাওয়ার জন্য। আর চিন্তায় আরও বেশি খেতে হয়। নেও তুমিও খাও।”
অঞ্জলি উঠে দাঁড়ালো। আগের মতোই রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তুমি তোমার খাবার নিয়েই থাকো। লাগবে না আমাকে। বিয়ের সম্বন্ধ আসছে না? আমি বিয়েটা করেই ফেলি।”
বলেই অঞ্জলি উঠে গেল। বেরিয়ে পড়লো রাগে। সাবেক অবাক হয়ে ঝিনুক ও অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কী করলাম? আমি ওর পিছে যাই।”
নিজের সমুচা হাতে নিয়ে সেও গেল অঞ্জলির পিছনে।
অর্নব হেসে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই ছেলে সারাজীবনে ঠিক হবে না।”
ঝিনুককে দেখতেই তার ঠোঁটের কোণের হাসি উড়ে গেল। ঝিনুকের মুখটা ভীষণ মলিন দেখাচ্ছে। ভালো মতো দেখলে বুঝা যাচ্ছে তার চোখের আশেপাশে লাল হয়ে ফুলে আছে। সে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কান্না করেছ?”
ঝিনুক অর্ণবের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। বলল,
“আমি কেন কাঁদব?”
“তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“বেশি ভাবছেন। আসুন অঞ্জলির কাছে যাই।”
ঝিনুক তার ব্যাগ নিয়ে উঠে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল। অর্ণবও তার পিছু নিলো। আবারও জিজ্ঞেস করল,
“তোমার কিছু তো হয়েছে। বলো কে কী করেছে?”
“বললাম তো কিছু না।”
“ওই সৈকত আবারও কিছু করেছে?”
“সব কিছুর মাঝে ওর নাম আনার প্রয়োজনটা কী?”
অর্ণব ঝিনুকের হাত ধরে নিলো। ঝিনুকও থেমে গেল। পিছনে তাকিয়ে অর্ণবের দিকে তাকাতেই অর্ণব আবারও জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে বলো ঝিনুক কী হয়েছে? এভাবে মলিন মুখ করে রেখ না।”
ঝিনুক কিছু বলার পূর্বেই ইকবাল বলল,
“ক্যান্টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে জুনিয়ারের সাথে এইসব মানায় না।”
ঝিনুক পাশে তাকিয়ে দেখল ইকবাল ও সৈকত দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। সৈকতকে দেখে সে এবার মুখ ফিরিয়ে নিজের হাত অর্ণবের হাতে দেখল। সাথে সাথে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
অর্ণব একবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল ঝিনুকের দিকে আবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলো আর সৈকত ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাদ দে এইটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। একটু জায়গা দেওয়া যাবে? আমরা ভিতরে যাব।”
কথাটা শুনে ঝিনুক অবাক হয়ে তাকাল সৈকতের দিকে।
অর্ণব সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ঝিনুকের সাথে কিছু করেছিস? ওর মন খারাপ কেন?”
সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ও তো তোমার ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড। এইটা তোমার জানা উচিত আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আমি ওর কেউ হই না তাই নিজেদের ব্যাপারে আমাকে টানার প্রয়োজন নেই।”
ঝিনুক সৈকতের কথা শুনে আপনা-আপনি হা হয়ে গেল। কীভাবে এমন কথা বলতে পারে ও? নিজের স্ত্রীকে এমন ভাবে অপরিচিত এর মতো বলে কেউ?
ঝিনুক আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। চলে গেল।

সৈকত অর্ণবের পাশে দিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল,
“সবাইকে তুই ডাকতে নেই এইটা আমি ক্লাস ফোরে থাকতে শিখেছিলাম আর তোমারও শেখা উচিত। ভার্সিটি থেকে কয়দিন পর গ্রাজুয়েট করবে এখানো ভদ্রতা না শিখলে কবে শিখবে?”
বলেই চলে গেল ক্যান্টিনের ভেতর।
.
.
“বাবা বইলো না কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আমার ছেলেটা থাকলে নিজের মা’কে কখনো এত কষ্ট হতে দিতো না। তোমার সামনে এভাবে হাত পেতে রাখতে হতো না।”
“খালা এমন ভাবছেন কেন? আপনিই তো বলতেন আমি ও বিনয় আপনার কাছে একরকম।”
অর্ক বিনয়ের মা’কে বলল।

প্রতি সাপ্তাহের মতো আজও বিনয়ের বাসার সবাইকে দেখতে এসেছে সে। যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়েই বিনয়ের মা এইসব বলতে শুরু করল। বিনয়ের মা আরও বললেন,
“বাবা আমার মনাকে একটু কাজ ধরায় দেও না। ও কামানো শুরু করলে চিন্তাটা যেত। তখন তোমাকেও এত জ্বলাতাম না।”
“খালা ওকে একটা কাজে ঢুকিয়েছিলাম আপনি জানেন। কিন্তু ও সেখানে ভালো মতো কাজই করে নি দেখেই বের করে দিয়েছে।”
“বাবা তোমার কোম্পানিতে একটু চাকরি দেও না। তোমার অধীনে থাকলে কোনো চিন্তাই হতো না।”
মলিন কন্ঠে বলল বিনয়ের মা। অর্ক বলল,
“আমাদের কোম্পানির সকল নিয়োগের দেওয়াটা বাবার হাতে। আর ওর পড়াশোনাও এতটা না যে আমি আপনার আবদারের অনুযায়ী ওকে সে পজিশনে কাজ দিব। বাবা কাজে ব্যক্তিগত ব্যাপার আনা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে।।”
হঠাৎ করে বিনয়ের মা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
“হায়রে বাবা আজ বিনয় থাকলে মনারও একটা ব্যবস্থা করে দিত। আমার সব ছেলে-মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল শুধু ওই একটা মেয়ের কারণে। কোনো মুহূর্তে ওকে বিয়ে করিয়ে আনছিলাম। হায় আমার কপাল ফুঁটে গেছিলো।”
বলেই নিজের কপালে মারতে থাকলেন তিনি।অর্কের একটি অস্বস্তিকর লাগছিল। বাসার সামনে চারজন দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। সে বিনয়ের মা’কে থামিয়ে বলল,
“আন্টি সবাই দেখছে। খারাপ ভাববে। আর বিনয় নেই তো কী হয়েছে? আমি আছি আপনাদের খেয়াল রাখার জন্য চিন্তা করবেন না।”
“তুমি আছো দেখেই তো তাও বেঁচে আছি বাবা। নাইলে কোন মা নিজের ছেলের লাশ চোখের সামনে দেখে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যে আমার বাচ্চাটারে মারলো তার কোনো শাস্তি হয় নি মনে করেই বুকটা পোড়ে শুধু। বাবা তুমি আমাকে ওয়াদা করছিলে ন্যায় করবে, ওকে শাস্তি দিবে। নিজের ওয়াদা মনে আছে তো বাবা? ও তোমার কাছ থেকে তোমার দুইটা আপন মানুষকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কতগুলো পরিবার শেষ করে দিলো মেয়েটা তাও নিজে সুখে আছে। তুমি ওকে শাস্তি দিও বাবা, শাস্তি দিও।”
অর্ক কিছুক্ষণ চুপ থেকে কঠিন কন্ঠে বলল,
“আমার নিজের ওয়াদা মনে আছে খালা।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here