মন পাড়ায় পর্ব ৫৭+৫৮+শেষ

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৫৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

জীবনটাও ভীষণ অদ্ভুত। কার সম্পর্ক কখন পাল্টে যায় কেউ ধারণাও করতে পারে না। মুহূর্তে কেউ আপন হয়ে যায় আর কেউ পর।

রাতে প্রভা ও অর্ক হাস্পাতালে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। তাই সৈকত, ঝিনুক ও ঝিনুকের খালামণি বাসায় গেল। বাসায় ঢুকে ঝিনুকের খালামণি সৈকতকে বলল,
“বাবা তুমি যেয়ে একটু আরাম করো। গতরাতে অনেক জার্নি করেই এসেছ।”
ঝিনুক বলল,
“খালামণি কিছু রান্না করব?”
“না তুইও যেয়ে আরাম কর। তোর উপর কম তুফান যায় নি।”
সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কথাটা শুনে। তার সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়ে গেল। ঝিনুক কাওকে বাঁচানোর জন্যই মিথ্যে বলেছে।
অবশ্য সে মানুষটা কে তা জানার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। হঠাৎ এক রুম থেকে পরিশ বের হলো। তাকে দেখেই ঝিনুক চমকে উঠলো। ভয়ে পিছিয়ে গেল। সৈকতের পিছনে লুকিয়ে তার শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে।
সৈকত অনেকটা বিস্মিত হয় পরিশের মাতাল অবস্থা দেখে। সে ধারণা করতে পারছে ঝিনুকের সাথে পরিশ কিছু একটা করেছে। যা সে কখনো ভাবেও নি। সে জানতো পরিশ তাকে ও ঝিনুককে আলাদা করতে চায় কিন্তু এর মধ্যে সে ঝিনুকের ক্ষতি করতে পারে সে কখনো ভাবেও নি।

পরিশ এসে ঝিনুকের সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরে বলল,
“সরি সোনা কাল আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি। আমি ইচ্ছা করে দেই নি সত্যি। তোর কী অনেক বেশি ব্যাথা লেগেছে?”
পরিশের মা তাকে দেখে দৌড়ে এলো তার সামনে। তার হাত ধরে বলল,
“তোকে না বলেছি তুই বাসার বাহিরে যা। তুই এখানে কী করছিস? তুই আবার নেশা করেছিস? গতকালে ঘটনার পরও….”
পরিশ তার মা’য়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে ঝিনুককে বলল,
“দোষ তো তোরও আছে সোনা। তুই যদি আমার সাথে বিয়ে করতি তাহলে কী আমি এমনটা করতাম বল?” সে ঝিনুকের হাত ধরতে চাইলেই সৈকত তার হাত শক্ত করে ধরে ঝিনুক থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমার বউকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে এখানে খুন করে কবর দিয়ে দিব। তোর সাহস কীভাবে হয় ওকে কষ্ট দেওয়ার?”
পরিশ সৈকতের কলার ধরে বলে,
“কুত্তা, সব তোর দোষ। তুই আসছিস আমাদের মাঝে, নাহয় আমরা কখনো আলাদাই হতাম না।”
সৈকত পরিশের রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলতে যাবে আর পরিশের মা বলল,
“বাবা…বাবা ও নেশায় আছে। প্লিজ এমন কিছু করো না। মাফ করে দেও ওকে বাবা।”
সৈকত পরিশের মা’য়ের অসহায় দৃষ্টি দেখে থেমে গেল।
কিন্তু পরিশ ঠিকই সজোরে ঘুষি মেরে বসে সৈকতের মুখে। পরিশের মা তাকেও থামাল। লাভ হলো না। সে আরেকবার মারল সৈকতকে। পরিশের মা তাকে থামাতে গেলে তাকেও ধাক্কা দিলো।
পরিশের মা’য়ের চোখের জল দেখে সৈকত নিজেকে শান্ত রেখেছিলো বটে কিন্তু পরক্ষণেই এমন বেমানান দৃশ্য দেখে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে পরিশকে এমন এক ঘুষি দিলো যে সে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর সে রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তুই যে ঝিনুকের জন্য এতকিছু করছিস না সে ঝিনুককে তুই কখনো ভালোই বাসিস নি।”
পরিশ চিৎকার করে উঠে,
“তুই বেশি জানিস?”
“হ্যাঁ জানি। কারণ যে মানুষ তার জন্মদাত্রীকে ব্যাথা দিতে একবারও ভাবে না সে মানুষ অন্যকারও কথাও ভাবতে পারে না। আর আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে নিজ ইচ্ছায় ব্যাথা দিতে পারি না। কোনো ভাবেই না।”
সৈকত একই সুরে উওর দিলো।
তারপর পরিশের মা’কে মেঝের থেকে উঠিয়ে সোফায় বসালো। তার চোখের জল মুছে। দুইহাত ধরে বলল,
“খালামণি সকল মা তাদের সন্তানকে সব কষ্ট থেকে রক্ষা করতে চায়। মা’য়ের মনটাই যে এমন। নিজের থেকে বেশি সন্তানের জন্য ভাবে। কিন্তু যখন সে সন্তান নিজের জন্য, অন্যের জন্য এবং সমাজের জন্য ক্ষতি হয়ে দাঁড়ায় তখন সে মা’কেই তার সন্তানকে কষ্ট দিতে হয়। কখনো কখনো কষ্টতেও মুক্তি থাকে।”
বলেই সৈকত চলে গেল ঝিনুকের রুমের দিকে। ঝিনুক সে রুমে নীরব দর্শকের দায়িত্ব পালন করল শুধু।
.
.
একইদিন পরই প্রভা ও অর্ক রওনা দেয় তার বাসার উদ্দেশ্য। যেহেতু বিনু এবং অদিন সেখানে একা। কাজের খালা তাদের দেখে রাখলেও তাদের সামলাতে পারছে না। তারা এখনো সেদিন রাতের ঘটনা জানে না। কিন্তু পরিশের ড্রিংক ও ড্রাগস নেওয়ার কথা জেনেছে। তাকে রিহ্যাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রভার মা-বাবা।

বাসায় এসে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হয় অর্ক। বিনু থাকতে চাইছে না অর্কের সাথে। তার মনে হচ্ছে অর্ক তার মা’কে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার থেকে। এইসব যে বিনয়ের মা এই পিচ্চি মেয়েটাকে বুঝাচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারও। নাহয় এত শান্ত একটা মেয়ে এভাবে ব্যবহার করবে তা অকল্পনীয়।

ক্রোধ নিয়েই অর্ক বাড়ির বাহিরে এলো। ফোন বের করে কল দিলো বিনয়ের মা’কে। ওপাশ থেকে কিছু বলার পূর্বেই অর্ক বলল,
“নিজেকে ভীষণ চালাক মনে করেছেন তাই না?”
“মনে করার কি আছে বাবা? চালাক না হলে কী এত কিছু অর্জন করতে পারতাম?”
অর্ক তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আপনি মোটেও চালাক না খালা। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আপনার সংসার চালানোর টাকাটা আমি দিতাম। আপনার ছেলের যে চাকরিটা আছে না? যেটা আমি যোগাড় করে দিয়েছিলাম তা কাল সকালের মধ্যে চলে যাবে। আপনি আমার সংসারে অশান্তি করে সুখে থাকবেন? অসম্ভব।”
“তুমি….. ”
“হ্যাঁ আমি বিনুর বাবা ওর স্কুলেও আপনার যাওয়াও বন্ধ করিয়ে দিব। তখন কীভাবে দেখা করবেন বিনুর সাথে? ওর কান ভরবেন কীভাবে? আর আপনি অতিরিক্ত করলে পুলিশের কাছে যেতেও দ্বিধা করব না আমি। শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি, যদি আপনার এইসব ফাইজলামি বন্ধ না করেছেন তাহলে আপনার জন্য অনেক খারাপ হবে। এমন খারাপ যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমার পরিবার ও বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকবেন।”
ওপাশ থেকে কিছু বলতে নিলো বিনয়ের মা। সে শুনলো না। কল কেটে দিলো। এরপর গাড়িতে উঠে রওনা দিলো কোথাও।

ইকবালের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো অর্ক। কলিংবেল চাপ দিলো। দরজাটা খুলল ইকবালের বোন। সে কতক্ষণ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর সে বলল,
“স্যার আপনি! আমিও পাগল আপনাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসুন বাসায় আসুন।”
আবার উঁচু স্বরে বলল,
“মা দেখ কে এসেছে?”
অর্কের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি আবার বলল,
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনি আমাদের বাসায় এসেছেন।”
অর্ক মৃদু হেসে বলল,
“আরেকদিন বাসায় ঢুকবো, আজ নয়। আজ একটু জরুরী কাজে এসেছি। তোমার আন্টিকে একটু ডাক দেও।”
বলার সাথে সাথেই মেয়েটি দৌড়ে গেল। কিছু মুহূর্ত পর নিয়ে এলো সৈকতের মা’কে। সেও অর্ককে দেখে হতবাক। কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না অর্ক থেকে।
অর্কও কিছু বলল না। ফোনটা হাতে নিয়ে কাওকে কল দিলো শুধু,
“হ্যালো সৈকত…..”
“জি ভাইয়া বলো।”
“আমি আমাদের মা’কে আমার সাথে নিয়ে গেলাম। তোর সমস্যা আছে?”
কথাটা শুনতেই রোমা বেগম চমকে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় অর্কের দিকে। হঠাৎ করেই তার চোখদুটো সিক্ত হয়ে আসে।
ফোনের ওপাশ থেকে অনেকসময় কোনো শব্দ আসে না। এরপর বিস্মিত কন্ঠ ভেসে উঠে,
“তুমি আমাদের মা বলেছ!”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মা তুমি সেখানে নিয়ে যেতে চাও যেতে পারো। আমার তোমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া মানায়। তোমার আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়াটা বেমানান।”
সৈকতের কন্ঠে খুশি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
অর্ক রোমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মা, আপনার বাসায় যাওয়া যাক?”
রোমা বেগম ভেজা নয়নজোড়া নিয়েই প্রশস্ত হাসি দিলেন।

গাড়িতে উঠে বসলো দুইজন। অর্কের মনে পড়ে বিনুর কথা এবং তার সাথের স্মৃতিগুলো। অবশেষে মনে পড়লো প্রভার সেরাতের কথাটা। ভুল বলে নি প্রভা। সে কিছুমাস চেষ্টা করে এত ক্লান্ত হয়ে পড়লো আর মা তো এত বছর ধরে চেষ্টা করছে। তার কষ্টটাই কখনো দেখা হলো না। কিছু কষ্ট যতদিন নিজের উপর দিয়ে না যায় ততদিন অন্যের বেদনা বুঝা যায় না। আর কখনো কখনো বুঝতে দেরি হয়ে গেলে অনেক পাওনা হারিয়ে যায়।
গাড়িতে কেউ কোনো কথাই বলল না। এত বছরের অস্বস্তি তো আর একদিনে যায় না।

বাড়ি আসার পর দরজা খুলল প্রভা। তার শাশুড়ীকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তাকে ছেড়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি দিলো।

ভেতরে ঢুকার সময় অর্কের বাবা বের হচ্ছিল তার রুমের থেকে। তার স্ত্রী দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“শেষমেশ এসেই পরলে। তোমার ছেলে যেভাবে বের হয়েছিলো মনে হচ্ছিলো আর আসবেই না এ বাড়িতে।”
অর্ক মা’য়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি এনেছি। এটা তারও বাড়ি।”
অর্কের বাবা কোনো উওর দিলেন না। সোজা গেলেন ড্রইংরুমে। ভেতরে ঢুকে মৃদু হাসলেন। তার মনটাও হঠাৎ ভালো লাগছে। সোফায় বসে হাতের ফাইল খুলে দেখতে শুরু করলেন। তখনই ফোন এলো তার। ফোন কার তা না দেখেই রিসিভ করে কানের কাছে নিলেন। কাজে ব্যস্ত থেকেই বললেন,
“কে?”
“স্যার আমি নুরুলদীন।”
“হ্যাঁ বলো, কী কাজ?”
“স্যার ওই অঞ্জলির আর ভাদ্র বাবার বিয়ের কথাটা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৫৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

[আজ এডিট করার সময় পাই নি। ভুল থাকতে পারে অহরহ। দয়া করে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। আগামী কালের মাঝে এডিট করে নিব। ধন্যবাদ।]

“স্যার ওই অঞ্জলির আর ভাদ্র বাবার বিয়ের কথাটা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”
অর্কের বাবা বললেন,
“তোমার মেয়েকে পড়াশোনা করাও। শুনেছি পড়ায় নাকি খুব ভালো।”
অঞ্জলির বাবা আমতা-আমতা করে বলল,
“কিন্তু স্যার আপনি না বিয়ের কথা বলেছিলেন?”
“আমি তো বলেছিলাম এক ছেলের বাবা হয়ে। আমার ছেলের চিন্তা আমার জন্য সর্বোপরি। কিন্তু তুমি কী টাকার জন্য তোমার মেয়েকে আমার অসুস্থ ছেলের কাছে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছ?”
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। অর্কের বাবা নিজেই বললেন,
“এক কাজ করো, মেয়েটাকে পড়াও। তোমার তিন মেয়ের পড়ার খরচই আমি দিব। শর্ত হলো, ওরা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কাওকে বিয়ে দিতে পারবে না।”
সাথে সাথে অঞ্জলির বাবা আনন্দিত গলাতে বলল,
“সত্যি বলছেন স্যার? অনেক বড় দয়া করলেন স্যার। স্যার আমার ছেলেটার কথাও যদি ভেবে দেখতেন। ”
“তোমার ছেলের খরচ তোমার মেয়েরা দিবে।”
বলে কেটে দিলেন। আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
.
রাত তখন এগারোটা বাজে। ঝিনুক তার খালুর ও খালামণির রুমেই ছিলো। খালুকে আনা হয়েছে বেশি সময় হয় নি। সৈকতের সাথে এই পর্যন্ত হাজারোবার দেখা হলেও একবারও কথা হয় নি। সে লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না সৈকতকে। তাকে যে ছাড়ার কথা সৈকত বলছে, সে ব্যাপারেও কিছু বলতে পারছে না সে। খালুকে খাওয়ানো শেষে ঝিনুক প্রভাকে কল করার উদ্দেশ্যে ফোনটা হাতে নেয়। হাতে নিয়ে দেখে আগের থেকে প্রভার ছয়টা কল এসেছে। যা ফোন সাইলেন্ট থাকায় শোনা যায় নি। সাথে দুইটা মেসেজও আছে। প্রথম মেসেজ,
“কোথায় রে তুই? জরুরী কথা ছিলো।”
দ্বিতীয় মেসেজ আসে তিন মিনিট পরই,
“আচ্ছা শুন, অর্ক মা’কে বাসায় এনেছে। মা’য়ের সাথে কথা হওয়ার পর জানতে পারলাম সৈকত তোকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছে। এইজন্য নয় যে ও তোর সাথে রাগ। বরং এইজন্য যে ও ভাবছে ও ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে না’কি তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সোজা কথায় সৈকত ভাবছে ও তোকে ভালোভাবে রাখতে পারবে না কারণ ওর কাছে টাকা বেশি নেই। আর চাকরির গ্যারান্টি নেই। তুই ওর সাথে কথা বলে দেখ।”

দ্বিতীয় মেসেজ পড়ার সাথে সাথে মাথায় রক্ত চড়ে যায় ঝিনুকের। সে খালামণির দিকে তাকিয়ে বলে,
“খালামণি তুমি একটু খালুকে দেখ আমি আসছি।”
বলেই বের হয়ে পড়লো নিজের রুমের উদ্দেশ্যে।
সৈকত ঘুমিয়ে ছিলো। এই দুইদিন ধরে সেই খেয়াল রাখছিল ঝিনুকের খালুর। তাই ভীষণ ক্লান্ত সে। হাস্পাতাল থেকে আসার পরপরই ঘুমিয়ে পড়ে।
ঝিনুক এক দুই না ভেবে ঘুমন্ত সৈকতকে ডেকে তুলে।
সৈকত চোখ খুলে ঘুম ঘুম কন্ঠেই বলল,
“কী হলো?”
“কী সমস্যা তোমার?”
“আমার সমস্যা? তুমি আমাকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠিয়েছ। আমার কী সমস্যা হবে?”
বলেই আবার চোখ বন্ধ করতেই ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠে,
“এই খাবরদার ঘুমাবি না উঠ।”
ঝিনুকের ধমক শুনতেই সৈকত বড় বড় চোখ করে তাকাল। উঠে বসে বলল,
“তোমার হঠাৎ কী হলো?”
“উঠে দাঁড়া।”
নির্বাক সৈকত। কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক বিছানায় চড়ে এক কোমরে হাত রেখে বলল,
“তুই টাকার জন্য আমাকে ছাড়তে চেয়েছিলি? আমি তোকে একবারও বলেছি কম টাকায় আমি চলতে পারব না?”
সৈকত থতমত খেয়ে গেল ঝিনুকের কথা শুনে। এই মেয়ে তাকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠিয়ে এইসব কি বলতে শুরু করল?
ঝিনুক আবারও বলল,
“মুখে কী ফেভিকল লাগায় রাখিছিস? উওর দে।”
সৈকত গলা পরিষ্কার করে বলল,
“না।”
“তাইলে তুই আমাকে না বলে ডিসাইড করলি কেন?”
“তোমার পড়াশোনায় সমস্যা হতে পারতো। আর আমার নিজের চলার টাকা নেই তোমাকে সুখে কীভাবে রাখতাম? আর আমি ভেবেছিলাম যদি চাকরি না পাইলে তাহলে তালাকের কথা বলব। চাকরি পেয়ে গেলে তো দিব।”
“আমি তোকে ভালোবাসছিলাম তোর টাকা দেখে না বিয়ে করছি তোর টাকা দেখে। আর এখানে আমি ভাবছি আমার কান্ডে যে আমার ভুলের কারণে জনাব রাগ করে এ-সব বলছে। কিন্তু না, সে তো ভাবছে আমি এমন মেয়ে যে টাকা থাকলে থাকব, নাইলে চলে যাব।”
“তুমি জানো ঝিনুক আমি তোমায় নিয়ে এমনটা কখনো ভাবতে পারি না।”
“তোর সাহস কত উঁচু স্বরে কথা বলিস। আওয়াজ নিচে। আর শুন, আরেকবার তালাকের কথা মুখেও আনলে আমি….আমি কিছু একটাবকরব যা একদম ভালো হবে না। বুঝছ?”
এক নিশ্বাসে সবটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঝিনুক।
সৈকত বলল,
“আমি সময় হলে তোমার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতামই। আর এটা সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্তই হতো। এখানে এত হাইপার হওয়ার কিছু ছিলো না।”
ঝিনুক বিছানায় বসে পড়লো। হাঁটু গেড়ে, হাঁটুর উপর মুখ রেখে উদাসীন কন্ঠে বলল,
“জানো সৈকত, যখন আমি সত্যিটা জানতে পাই তখনও আমি বুঝিছিলাম পরিশ ভাইয়ার বন্ধু মিথ্যা বলেছে। পরিশ ভাইয়া কখনো এমন করতে পারে বা ভাবতে পারে আমি সারা জীবনেও ভাবি নি। সত্যি বলতে আমি ভাইয়াকে তোমার থেকে বেশি ভালোবেসেছি হয়তো তাই তাকেই বিশ্বাস করেছি। বলতে গেলে অন্ধবিশ্বাস করেছি। অবশ্যই তা ভাই হিসেবে। পরিবার হিসেবে। ছোট থেকে ভাইয়া আর খালামণিই আমার খেয়াল রেখে এসেছে। যত্ন নিয়ে এসেছে। জানো একবার না আমি ফুটবল খেলতে গিয়ে গাড়ির সামনে এসে গেছিলাম ভুলে, ভাইয়া নিজের জীবনের চিন্তা না করে আমাকে বাঁচিয়েছিল। জীবনের প্রতিটি মোড়ে জীবন নিয়ে শিক্ষা দিয়েছিল। আমি আজ বেঁচে আছি তাও উনার জন্য। ওদিন যখন ভাইয়া আমার হাত কাটছিলো তখন আমার হাতের থেকে বেশি উনার হাতে এতগুলো ক্ষত দেখে কষ্ট লাগছিলো। আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি যে ভাইয়া আমাকে এই নজরে দেখে। ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। আমার সম্পূর্ণ অতীতটাই তো ভাইয়ার সাথে ছিলো। এখনের পর থেকে সে অতীত মনে করতেও বুকে তীব্র বেদনার আগমন ঘটবে৷”
ঝিনুকের গাল দুটো ভিজে গেছে নোনাজলে। সে মুখ তুলে তাকায় সৈকতের দিকে। আবারও বলল,
“ছোট থেকে বাবা-মা হারানোর বেদনা সহ্য করে এসেছি, তারপর তোমাকে হারানোর, এখন ভাইয়াকে হারানোর। প্লিজ আবারও তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলো না। আমি বাঁচব না। আমি এতটা সাহসী নই। তুমি যখন থেকে তালাকের কথা বলেছ তখন থেকে আমি তোমাকে হারানোর বেদনা ও ভয় দুইটাই অনুভব করছি। হয়তো এই শরীর ঠিকই বেঁচে থাকবে কিন্তু এই মন নয়। দয়া করে এমন কথা বলো না। আমি তোমাকে বুঝাতেও পারব না আমার অনুভূতি কী ছিলো!”
সৈকত ঝিনুকের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিছানার অপরপাশে বসলো। বলল,
“আমি বুঝি ঝিনুক। আমি বুঝি৷ তুমি যখন সেদিন আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো সেদিন থেকে আমিও এই একই বেদনাদায়ক ভয় অনুভব করছি।”
সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেদিনের পর থেকে আগের মতো কিছুই হবে না ঝিনুক। আমাদের সম্পর্ক আর আগের মতো হওয়া সম্ভব না। না আগের মতো ভালোবাসা হবে, আর না কাছে আসা। আমি আর চেষ্টা করতে পারব না ঝিনুক। এই সম্পর্কে চেষ্টা করতে করতে এবং ব্যর্থ হতে হতে আমি চেষ্টা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।”
“এবার নাহয় আমি করব।”
সৈকত ঝিনুকের কথা শুনে তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে চলে গেল।
ঝিনুক তাকিয়েই রইলো তার যাওয়ার দিকে। আর ভাবতে শুরু করল। চেষ্টা তো তাকেই করতেই হবে। কিন্তু এই চেষ্টা কী কখনো সফল হবে? এতকিছুর পর কি সে ফেরত পাবে তার সৈকতকে?
.
.
.
পাঁচ মাস পর,
সৈকত ও ঝিনুক এক রুমের একটা বাসা নিয়েছিলো চারমাস আগে। দুইজনেই টিউশনি করিয়ে নিজেদের জীবন চালাত। সৈকত দুইমাস হলো চাকরি পেয়েছে একটা। ঝিনুক এখনো নিজে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালায়।
সৈকতের মা প্রতিদিন তাদের রান্না করা খাবার দিয়ে যায় এবং শুক্রবার সারাদিন তারা দুইজন চলে যায় তাদের ‘স্বপ্নপুরী’ বাড়িতে। সবার সাথে দিন কাটাতে। সে বাড়িতেও কিছু জিনিস বদলেছে। ভাদ্র ভাইয়ার খেলার সাথী বদলে হয়েছে বিনু এবং অদিন। বাবা এখনো আগের মতো থাকলেও তার তিন ছেলের মা’কে ভুলেও কিছু বলার সাহস করেন না। অদিন ও বিনু সে বাড়িটা এবং তাদের লোকদেরকে নিজেদের ভাবতে শুরু করেছে। আজকাল প্রভা না থাকলেও তারা কাঁদে না।
ও হ্যাঁ, প্রভারও জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। কলেজ শেষের প্রায় নয় বছর পর ভার্সিটিতে যেতে শুরু করেছে ঝিনুকদের ভার্সিটিতেই। প্রথম প্রথম ভার্সিটি এবং ঘর দুটো সামলাতে ভীষণ সমস্যা হলেও অর্ক সবটাই সামলে নিলো।

ছোট ঘর হলেও তার খারাপ লাগে না ঝিনুকের, বরং শান্তি লাগে। সৈকত যতক্ষণ ঘরে থাকে তার পাশে থাকে। তবে কমতিটা এতটুকুই তার কাছে থাকে না। তার পাশে বসলেও আগের মতো হাতটা ধরে না। তার সাথে কথা বললেও আগের মতো নেশাভরা তাকায় না। তার পাশে ঘুমালেও তার দিকে ফিরেও চায় না। মাঝেমধ্যে ভীষণ কষ্ট হয়। তীব্র যন্ত্রণা করে বুকের মাঝারে তবুও নিজেকে সামলে নেয়। সে তো জানে, আজকের এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় দায়ী সে।

রাত ১১.২৫ বাজে। আজ সে সন্ধ্যার টিউশনি ছেড়ে বাসায় এসেছিলো নিজের হাতে সব রান্না করবে বলে। ছোট একটা কেকও বানিয়েছে। তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী যে আজ!
অথচ সৈকতের আজই কোথাও ইন্টারভিউ এর জন্য যেতে হলো। সে বলেছিলো নয়টার মধ্যে এসে পরবে। এগারোটা পেরিয়ে গেল তবুও এলো না।

রুমের একপাশের জানালার কাছে ছোট একটি তোশক দিয়ে সোফার মতো করেছে। এখানে বসে প্রায় রাতে খাবার শেষে কিছুক্ষণ বসে ঝিনুক ও সৈকত। আজ একা বসে ছিলো ঝিনুক। এত রাতে হয়ে গেল অথচ সৈকত এলো না।
কলিংবেল বাজতেই দ্রুত যেয়ে দরজা খুলল ঝিনুক। সৈকত ভেতর ঢুকতেই বলল,
“ঝিনুক একটু খাবার দিতে পারবে? ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।”
ঝিনুক সাথে সাথে যেয়ে খাবার নিয়ে নিলো। সৈকত ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসলো আর বলল,
“বাহ! আজ মা এতকিছু রান্না করে দিয়েছে যে?”
“আমি রান্না করেছি।”
“কেন? আজ বিশেষ কিছু না’কি?”
কথাটা শুনার সাথে সাথে ঝিনুক উঠে দাঁড়ালো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে কতক্ষণ সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, আজ কীসের বিশেষ দিন? আমি তো শুধু শুধু সকাল থেকে বাহিরের কাজ সেরে সন্ধ্যায় এসে আবার বাসায় খাঁটছি। খাবার শেষে নিজে রান্নাঘরে সব রেখে আসবা।”
বলে রাগেই বিছানায় উঠে পিঠ করে শুয়ে পড়লো। সৈকত ওদিকে বলল,
“রান্না এমনি মজা হয়েছে।”
ঝিনুক উওর দিলো না। রাগে তার শরীর জ্বলছে। সৈকতের মনে থাকবে না কীভাবে তাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা? অর্ক ভাইয়া কত সুন্দর মতো আপুকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে গেল। আর এই লোকটা? মনে কতগুলো বকা দিলো ঝিনুক সৈকতকে। সে শুনতে পেল সৈকত রান্নাঘরে খাবারের প্লেট রাখছে। তবুও উঠলো না।

পায়ে হঠাৎ কারও ছোঁয়া পেয়েই লাফ দিয়ে উঠে বসলো। দেখল সৈকত তার পা’য়ে পায়েল পরাচ্ছে। আজ কতগুলো মাস পর সৈকত নিজে স্পর্শ করলো তাকে।
সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মনে ছিলো?”
“প্রথম বেতন দিয়েই কিনে রেখেছিলাম। তোমার ও মা’য়ের জন্য একসাথে কিনছিলাম। আজ দিব বলে আগে দেখাই নি।”
ঝিনুকের চোখ দুটো খুশির জলে সিক্ত হয়ে এলো। সে উৎসুক সুরে বলল,
“আমি কেক বানিয়েছি, তুমি জানালার কাছে বসো আমি নিয়ে আসছি। এসে আরেকটা খুশির খবর দিব।”
“কী খবর?”
“প্রভা আপুকে নিয়ে।”
.
.
অর্ক রুমে ঢুকতেই চমকে গেল। সম্পূর্ণ রুম সাদা এবং হলুদ লাভ সেপ বেলুনে ভর্তি। রুমের বাতি বন্ধ অথচ জ্বলন্ত দিয়ার মৃদু আলোয় সবটা দেখা যাচ্ছে। রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে প্রভা। তার সামনের টেবিলে একটা কেক রাখা। তাকে দেখে অর্ক হেসে রুমের লাইট জ্বালালো এবং প্রভার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“বিবাহবার্ষিকীর স্যারপ্রাইজ এটা ছিলো?”
অথচ প্রভার সামনে যেতেই সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। তার মনে হলো সে তার পা নাড়াতেই পারছে না। না কিছু বলতে পারছে। সে কেকের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রভার দিকে তাকাল। প্রভা কেকের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে হেসে বলল,
“আপনার স্যারপ্রাইজ এটা। আবারও বাবা হওয়ার শুভেচ্ছা রইলো।”
অর্কের মুখে চিন্তার ভাবটা ফুটে উঠতেই প্রভার ঠোঁটের কোণ থেকেও হাসি উঠে গেল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। প্রভা বুঝেছিলো বেশ খুশি হবে অর্ক। কিন্তু তার চিন্তিত ভাব দেখে তারই চিন্তা শুরু হলো।
প্রভা জিজ্ঞেস করল,
“আপনি খুশি হন নি?”
অর্ক যেয়ে বসলো বিছানায়। সে চিন্তিত সুরে বলল,
“চিন্তা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমি বিনুর বাবার জায়গাই নিতে পারলাম না, নতুন বাচ্চা আসার পর যদি বিনু ও অদিনের প্রতি যদি আমার ভালোবাসা ও আদর কমে যায়।”
কথাটা শুনেই হাসলো প্রভা। অর্কের পাশে যেয়ে তার হাতটা হাতে নিয়ে কাঁধে মাথা রাখল। তারপর বলল,
“যেখানে আপনি প্রথমবার বাবার অনুভূতি অনুভব করার সময় খুশি হওয়ার পূর্বে ওদের কথা ভাবছেন, সেখানে আপনার মনে হয় নতুন কেউ এলেই ওদের প্রতি আপনার ভালোবাসা কমে যাবে?”
“আমি সর্বপ্রথম বিনু এবং অদিনের বাবা প্রভা। এটা তো প্রথমবার না।”
“কিন্তু অনুভূতির তো প্রথমবার। প্রথমবার আপনি আপনার সন্তানকে জন্ম হওয়ার পূর্বে তাকে বাড়তে দেখবেন, তাকে অনুভব করতে পারবেন, তার জন্য অপেক্ষা করবেন, জন্ম হওয়ার পর তাকে কোলে নিবেন, তার কান্নায় রাতভর জাগবেন, তার প্রথম হাঁটা দেখবেন, তার প্রথম কথা শুনবেন। আরও কত কি!”
“লোভ লাগিও না প্রভা।”
প্রভা হেসে বলল,
“আমার বিশ্বাস আছে, নতুন কেউ আসার পরও আপনার ভালোবাসা বিনু ও অদিনের প্রতি বিন্দুমাত্র কমবে না। উল্টো আপনাদের বন্ডিং স্ট্রং হবে।”
“তা কীভাবে?”
“বিনু ও অদিন নতুন বাবুর কথা শুনে গতকাল থেকে লাফাচ্ছে। আর বলছে বাবু আসলে সারাদিন ওর সাথে খেলবে। বিনু এখন আপনার থেকে দূরে থাকে তখন তো পারবে না।”
অর্ক কিছু চিন্তা করে বড় এক হাসি এঁকে আনলো ঠোঁটের কোণে। তারপর প্রভার উন্মুক্ত পেটে হাত রাখলো। আবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে কান পেতে রাখলো। প্রভা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছেন?”
“ও নড়ছে না কেন?”
কথাটা শুনে প্রভা আরও বিস্ময়ে চলে গেল। তারপর ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
“সবে দুইমাস। এত জলদি বাচ্চা নড়াচড়া করে না।”
অর্ক সোজা বসে একপাশ হতে প্রভার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবুর আসতে দেরি হলে বাবুর মা’কে আদর করতে হবে।”
প্রভা লজ্জা পেয়ে বলল,
“প্রথমে কেক কেটে নেই?”
“কেক থেকে তুমি বেশি মিষ্টি।”
“রিতা আপনার কথা শুনলে ওর চশমাটা ঠিক করে বলতো, ‘ছিঃ আজকালকার ছেলেরাও না মেয়েদের পটানোর জন্য কত মাখন লাগায়। পড়াশোনা না করে সারাক্ষণ এইসব ডায়লগই ভাবে।”
অর্ক কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“এই রিতা কে?”
“আমাদের ভার্সিটির। ওই আমাকে সব পড়ার ছবি দেয় যেহেতু আমার প্রতিদিন ক্লাস করা হয় না।”
“ভালো কথা, ক্লাসে কি কেউ তোমাকে জ্বালায় না’কি?”
“প্রথম কয়দিন কেউ বুঝতেই পারে নি যে আমি ওদের থেকে এত বড় পরে যখন বুঝতে পারলো আন্টি ডাকা আরও অটপটে কিছু কথা বলতে শুরু করেছিলো। ঝিনুকের সাথে এই নিয়ে কথা হয়েছিলো, মেয়েটা এসে ক্লাসে যা করল তা দেখে আমিই অবাক।”
“ও’মা ও আবার কী করেছে?”
“সিনিয়র হয়ে কয়েকটা ক্লাসমেটের সাথে এসে সে ছেলেমেয়েদের ভাষণ দিয়েছে সাথে ওয়ার্নিংও। এখন আর কিন্তু বলে না। কিন্তু ওর কান্ডে আমি যে লজ্জা পেয়েছি, আমার ছোট বোন এখন আমার সিনিয়র। ভাবতেও লজ্জা লাগে। আপনি জোর না করলে আমি কখনোই যেতাম না ভার্সিটিতে।”
“আর আপনার স্বপ্নের কী হতো মেডাম?”
“শিক্ষক হওয়ার? সে তো আমি এখনও। জানেন মা সবচেয়ে বড় এবং প্রথম শিক্ষক হয়।”
“মা বলেছিলো সেদিন মনে আছে। কিন্তু আমি চাই তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হোক।”
কথাটা শুনতেই মন খারাপ হয়ে গেল প্রভার। সে অর্কের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। তার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা যে অর্ককে ভালোবাসার।
.
.
“আমি চাচা হবো আবার?”
সৈকত কেক খেতে খেতে অবাক কন্ঠে বলল। ঝিনুক উওর দিলো,
“হ্যাঁ আজ অর্ক ভাইয়াকে বলবে।”
“দাঁড়াও কল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
ঝিনুক সাথে সাথে সৈকতের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,
“একদম না। তারা একসাথে সময় কাটাচ্ছে। খবরদার নষ্ট করবে না।”
“আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। কেকটা অনেক মজা হয়েছে।”
“এখন গিফট দেও।”
“পায়েল না দিলাম?”
“আরেকটা গিফট লাগবে। যা দিতেই হবে।”
সৈকত বেখেয়ালি ভাবেই বলল, “কী লাগবে বলো?”
“আমারও বাবু লাগবে।”
কথাটা শুনতেই সৈকত খাওয়ার মাঝেই কাশতে শুরু করল। ঝিনুক দৌড়ে যেয়ে পানি নিয়ে এলো সৈকতের জন্য। সৈকত এক ঢোক পানি খেয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
তোমার কী লাগবে?”
“বাবু লাগবে। মানে বাচ্চা।”
“ভাবির বেবি হলে ওর সাথে খেলবে। আর অদিন তো আছেই।”
“আমি আমার বেবির কথা বলছি। মানে আমাদের বেবি।”
সৈকত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি নিজেই তো বাচ্চা। তুমি বাচ্চা দিয়ে কী করবে? পাগলী একটা!”
সৈকত যেতে নিলেই ঝিনুক তার হাত উঠে এক টানে তাকে বসালো। তারপর বলল,
“আমার বেবি লাগবে, লাগবে, লাগবে।”
“ঝিনুক ফাইজলামি কর না তো।”
“আমি সিরিয়াস।”
“তুমি বাচ্চা দিয়ে কী করবে? নিজের ক্যারিয়ার আগে বানাও তারপর দেখব যে……”
কথার মাঝেই ঝিনুক সৈকতের কথার মাঝেই বলল,
“এট লিস্ট তুমি আমার দিকে ধ্যান তো দিবে। একটু হলেও আগের মতো ভালোবাসবে।”
কথাটা শুনতেই চমকে যায় সৈকত। চকিতে তাকায় ঝিনুকের দিকে। হঠাৎ তার ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো ঝিনুকের এমন কথা শুনে।
সৈকত আজ এত মাস পর ঝিনুকের সে গভীর নয়নে নয়ন স্থির করে বলল,
“আমি তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি ঝিনুক।”
“আমি তাহলে টের পাই না কেন? তুমি আমার দিকে আগের মতো দেখো না, আগের মতো কথা বলো না, আগের মতো…..”
এখানেই থেমে গেল ঝিনুক। তার চোখ ও কন্ঠ দুটোই ভেজা। সৈকত জিজ্ঞেস করল,
“আগের মতো কী ঝিনুক?”
“আগের মতো লুইচ্চামি করো না।”
সৈকত হেসে দিলো। ঝিনুক বলল,
“আমি জানি আমি সেদিন অনেক ভুল কথা বলেছি। কিন্তু তুমি কী জানো না আমি বোকা। তবুও কেন আমায় এভাবে শাস্তি দেও? ঠিকাছে দেও শাস্তি। কিন্তু অন্যভাবে দেও না। এভাবে আমার হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন করো না।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ঝিনুকের গালে হাত রাখল। বলল,
“তোমার প্রতি আমার মন পাড়ায় ভালোবাসা এক বিন্দুও কমে নি ঝিনুক। কমতেই পারে না। আমার শুধু ভয় করে তোমাকে কাছে টানলে যদি তুমি আরও দূরে চলে যাও! আর তোমার শাস্তি? এই শাস্তি তো আমার, তোমার থেকে দূরে থাকতে থাকতে যে আমার মন পাড়াটা শূন্য হয়ে যায়।”
ঝিনুক সৈকতের কাছে এলো। হাঁটু গেড়ে সৈকতের সামনে বসে তার এক হাত নিজের কোমরে রাখলো। আর নিজে সৈকতের কাঁধে হাত আবদ্ধ করে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“তাহলে থাকো কেন? কেন এই মন পাড়ায় তুফান বয়ে আনো? ভালোবাসো না আবার আগের মতো।”
“আগের মতো কিছুই হয় না ঝিনুক। জীবনের প্রত্যেকটি মোড়ে মানুষ পাল্টায়, সম্পর্ক পাল্টায়, ভালোবাসা পাল্টায় অথবা ভালোবাসার ধরণ পাল্টায়। আমি তো আর আগের মতো নেই। স্বাধীন জীবন ও দায়িত্বের জীবনে পার্থক্য আছে।”
ঝিনুক চোখ খুলে সৈকতের চোখে চোখ ডোবাল। আর বলল,
“আমার চোখে তাকালে না তোমার নেশা ধরে যেত এখন আর সে নেশা নেই আমার চোখে?”
সৈকত অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সে নেশাভরা চাহনির দিকে। তারপর চুমু খেলে সে নেশাভরা নয়নের পাতায়। বলল,
“ভেবে নিও একবার এই নেশায় ডুবে গেলে সহজে এই নেশা শেষ হবে না।”
“যেমন আমি চাই শেষ হোক।”
সৈকত ঝিনুককে আরও কাছে টেনে নিলো। তার সামনে আনা চুলগুলো আঙুল দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।”
শব্দটা শুনতেই এক উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল ঝিনুকের বুকেতে।
“আর একবছর পরও বাসবে?”
সৈকত ঝিনুককে ঘুরিয়ে তার পিঠটা নিজের বুকে ঠেকাল। ঝিনুকের দুই হাতের আঙ্গুলে আঙুলে তার আঙুল ডুবিয়ে ঝিনুকের কাঁধে মাথা রাখলো। বলল,
“যত বছর বাঁঁচব তোমায় ভালোবাসব।”
“আশি বছর পরও?”
“তখন আমাদের নাতি-নাতনীদের বিয়ের সময় আরেকবার বিয়ে করব। ওকে?”
ঝিনুক হেসে বলল,
“আচ্ছা পাঁচ বছর পর?”
“পাঁচবছর পর! পাঁঁচবছর পর আমাদের একটা রাজকন্যা হবে….”
“রাজকুমার হলে?”
“দুইটাই হতে পারে। তুমি ও আমি মিলে ঘর সামলাবো, ওদের সামলাব। প্রতি শুক্রবারে যাব আমাদের ‘স্বপ্নপুরীতে’। ওরা ওদের ভাই বোনদের দেখে অনেক খুশি হবে। বাবা হয়তো তখন আমাকে আপন ভাববে। মা হয়তো নিজের জন্য কথা বলতে শিখবে। দাদী ততদিন ফুফুর কাছ থেকে এসে পরবে। আমাদের সাথে থাকবে। পরিশ হয়তো সুস্থ হয়ে রিহ্যাব থেকে বের হবে, জ্যোতি নিজের জন্য ভালো কাওকে খুঁজে পাবে, অঞ্জলি বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিবে। ওর বিয়ে হবে সাবেরের সাথে। সাবের তখনও খাই খাই করবে। অর্ণব হয়তো মোহিনীকে ওর বাচ্চাসহ আপন করে নিবে অথবা অনু কারও সাথে জীবনে এগিয়ে যাবে। ইকবাল অন্তত একটা মেয়ে পটাতে পারবে এবং আমার সাথেই কাজ করবে। নীরা একটু মেয়েলীসুলভ আচরণ করবে, নিহিন আমেরিকা সেটেল হয়ে যাবে। আমাদের দেশের অবস্থা অনেক উন্নত হবে এবং অপরাধ কম হবে। মানুষের মনে বিশৃঙ্খলার জায়গায় ভালোবাসা বাড়বে। ভবিষ্যত তো কল্পনাই কেবলমাত্র। কখন কার সাথে কি হবে কে জানে।”
“তবে আমি এতটুকু জানি আমার মন পাড়ায় তখনও তুমি রবে।”
সৈকত ঝিনুকের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে আলতো করে তার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। আর ঠোঁটটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আর আমার মন পাড়ায় তুমি।”
.
.
৩১ ডিসেম্বর ২০২০,
রাত ১২ বাজে প্রায়। আকাশে তারাবাজি দেখা যায় না তেমন। নীরব জায়গা যে তাই। শহরের কোলাহল থেকে দূর নিস্তব্ধ রাতে পুকুর পাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক ও প্রভা। অর্ক প্রভার কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল,
“শুভ জন্মদিন বসন্তিকা।”
প্রভার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে এলো। সে বলল,
“আপনার কীভাবে মনে ছিলো এই জায়গাটার কথা?”
“এই জায়গার কথা কীভাবে ভুলি আমি? আবার তোমার মোহে জড়িয়েছিলাম এই জায়গাতেই।”
প্রভা মৃদু হেসে অর্কের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“এটা আমার জন্মদিনের সেরা উপহার। আমার পছন্দের জায়গায় আপনি আমার পাশে।”
প্রভার মনে পড়লো এক বছর আগে সে অর্কের জায়গায় তার পাশে চাইতো বিনয়কে অথচ আজ তার জীবন এই অর্ককে ঘিরেই। যেন অন্যকেউ মানানসই ছিলোই না। তবুও কেন এই মনটা বারবার চেয়েও মানুষটার প্রতি ভালোবাসার তুফান আনতে পারে না। কেন?
অর্ক বলল,
“তোমার উপহার বসন্তে পাবে, বসন্তিকা।”
প্রভা হেসে বলল,
“জানি।”
“আরেকটা কথা জানো?”
অর্ক প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল। প্রভা জিজ্ঞেস করল,
“কী?”
“ভালোবাসি।”
মুহূর্তে প্রভার মন পাড়ায় উঠলো এক তুফান। ভালোবাসার তুফান। মায়ানগরীর সাথে ভালোবাসানগরীটাও লিখিত হয়ে গেল এই মানুষটার নামে।
কখনো হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও কেউ মন পাড়া দখল করতে পারে না। আবার কখনো না চাওয়া সত্ত্বেও মন পাড়াটা লিখিত হয়ে যায় কারও নামে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here