মন পাড়ায় বিশেষ অন্তিম পর্ব

#মন_পাড়ায়
#বিশেষ/অন্তিম_পর্ব
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

৩১ ডিসেম্বর ২০২০,
জানালার কাঁচ ভেদে সকালের এক টুকরো মিষ্টি রোদ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো ঝিনুকের মুখখানি। সৈকত তাকিয়ে ছিলো সে ঘুমন্ত মিষ্টি মুখখানির দিকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি আছে ঠিকই তবে তা বেশ মলিন। আগের মতো আর হাসতে আর জানে না সে। কেন কে জানে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম বের হয় সৈকত।
রুম থেকে বেরিয়ে দেখে খালু সংবাদপত্র পড়ছে।
গতকাল গভীর রাতেই ঝিনুকের খালুর বাড়িতে আসা। কাজের কারণে সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া বের হওয়াও মুশকিল। কী করার? কিছু বলতেও পারে না, বহু কষ্টে চাকরিটা পেয়েছে সে।

খালু সৈকতকে দেখে বলে,
“আরে আমি কি দেখছি? আমার চশমার নাম্বার বেড়ে গেছে না’কি? সৈকত আর এত সকালে উঠলো?”
সৈকত হেসে যেয়ে বসে খালুর কাছে। সালাম দিয়ে বলে, “কাজের জন্য এখন উঠতে হয় খালু। তো কেমন আছেন খালু?
” আমি তো ভালোই তোমার খবর কী?”
“আলহামদুলিল্লাহ। সরি খালু আপনাকে এসে দেখতে পারি না। আপনাকে বলেছিলাম এসে আমাদের সাথে থাকেন। এখানে একা…..”
খালু সৈকতের কথা কেটে বলল,
“বাবা বুঝলে নিজের বাসায় শত কষ্ট হোক, নিজের বাড়ি নিজের কাছে স্বর্গ। এই বাড়িটা আমার পরিশ্রমের ফল। এই বাড়ির ছাদের তলে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণই আমার পরিশ্রমের কথা মনে পড়ে আর গর্ব হয় আমি নিজ থেকে এতকিছু করেছি। আর একা কোথায়? অর্ক একটা কাজের জন্য ছেলে দিয়ে গেছে। ও সারাক্ষণ আমার সাথে খেলে, পার্কে হাঁটতে যায়, রাতে আমি ওকে পড়াতে বসি। আমার মনে হয় ছোটবেলায় যে সময়গুলো প্রভা, ঝিনুক আর…… ওদের তিনজনের সাথে মিস করেছি তা পূরণ করছি। নাম মোবারক বুঝলে, ভীষণ ফাঁকিবাজি। কাজেও, পড়াতেও। আর অর্ক প্রতি সাপ্তাহে একবার করে এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটা করে দিয়ে যায়। আর তুমি তো মানুষকে বলেই গেছ যেন প্রতিদিন এসে আমরা সুস্থ কি’না তা খোঁজ নিয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ তোমার ও অর্কের মতো ছেলে পেয়ে ভাগ্যবান।”

“শুধু ছেলে পেয়ে? মেয়েগুলোর কথা এখন আর মাথায় নেই তাই না?”
প্রভা রুমে চা আনতে আনতে বলল। খালু বললেন,
“চা’য়ের তৃষ্ণা পেয়েছিলো খুব, ভালো হলো চা আনলি।”
“একদম পাবে না, একটু আগে কী বলেছিলে?”
“যা ফেঁসে গেলাম দেখি।”
প্রভা হেসে তার বাবাকে চা দিয়ে সৈকতকে বলল,
“সৈকত একটু আসো দেখি।”
“জি ভাবি।”
সৈকত গেল প্রভার পিছনে। প্রভা ডাইনিং রুমে যেয়ে বলে, “চা দেই?”
“জি ভাবি। চিনি কম।”
প্রভা রান্নাঘর থেকে সৈকতের জন্য চা এনে দিয়ে সৈকতের সামনের চেয়ারে বসে বলল, “বানিয়ে রেখেছিলাম। সৈকত একটা কথা বলি রাগ করবে না তো?”
“ভাবি আপনি আমার দ্বিতীয় মা’য়ের মতো। কিছু মনে করব কেন? নির্দ্বিধায় বলুন।”
“ঝিনুক আমায় বলল যে তোমার মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু আমার কেন যেন তা মনে হচ্ছে না। তুমি কি ঝিনুককে ক্ষমা করেছ সত্যিই?”
সৈকত চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“ভাবি আমি ওকে ক্ষমা করার কেউ না। এটা সত্যি যে ওর কিছু কথা আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছে, ওর অবুঝতার কারণে আমরা আলাদা হয়েছিলাম, ওর বিশ্বাস বারবার আঘাত হেনে দিয়েছে আমার বুকে কিন্তু ভুল শুধু ওর একার না, আমারও ছিলো। প্রথমবার যখন আমাদের সম্পর্ক ভাঙে তখন আমি চেষ্টা করার পর যখন পরাজিত হলাম সেখানেই থেমে গেলাম। আমার উচিত ছিলো ঝিনুককে আবারও বুঝানো। বারবার হেরে গেলে আবারও চেষ্টা করা। আমি তা করিনি। দ্বিতীয়বার যখন আমাদের বিয়ে হলো তখন আমি ওর বিশ্বাস জয় করার পরিবর্তে অন্য মেয়েদের হাত ধরে ওর সামনে ঘুরেছি। যার জন্য ওর অবিশ্বাস আরও গাঢ় হলো। আমার সবচেয়ে বড় দোষ হলো আমি কখনো কাউকে কিছু এক্সপ্লেইন করতে চাইতাম না। এখনো চাই না। সবসময়ই চাই সামনের জন নিজে বুঝুক। কিন্তু কখনো মাথায় এটা আসে নি যে আমি যদি কাউকে নিজের পক্ষ নাই বুঝাই সে বুঝবে কীভাবে? অহেতুক ভাব নিতে গিয়ে আমার ভাই ও ভালোবাসা দুটো থেকেই এত বছর দূর থাকতে হলো। আর এই দূরত্ব চাইতাম না।”
“তুমি ঝিনুককে জানাতে পারতে যে তুমি কেন জ্যোতির সাথে সম্পর্কে ছিলো।”
“আপনি ওকে কখনো আপনার ডিভোর্সের কথা জানাতে চান নি তাই……”
প্রভা সৈকতের কথা কেটে বলল,
“তখন কিছু মাসের মধ্যে ওর পরীক্ষা ছিলো তাই আমি চাই নি এ-সব জানিয়ে ওর পরীক্ষায় কোনো খারাপ প্রভাব পড়ুক। এরপর তো বিনয়ের মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুর পর ঝামেলা থেকে আমি ঝিনুককে দূরে রাখতে চাইতাম। ও যেকোনো জিনিস বেশি ভাবে এবং সে চিন্তার কারণে প্রেশার নিয়ে অসুস্থ হয়ে যায়। তাই ওকে কিছুই জানাই নি। কিন্তু তোমার তো প্রয়োজন ছিলো না নিজের সম্পর্কের ঝুঁকি রেখে এত কিছু করার।”
সৈকত মাথা নামিয়ে নেয়৷ বলে,
“আমি জানি ভাবি অনেক বড় ভুল করেছি কিন্তু আর কোনো উপায় ছিলো না ভাবি।”
“সত্য কখনো লুকায়িত থাকে না সৈকত। এক না এক সময় সামনে এসেই পড়ে। তোমার কি মনে হয় তোমার ভাইয়াকে তুমি নূহার মানসিক রোগের সম্পর্কে জানিয়েছ এবং সেখান থেকে অর্ক বিনয় ও নূহার সত্য জানতে পেড়এছে? উনি তোমায় বলতে মানা করেছিল তবুও আজ বলছি, বিনয় অর্কের জন্য কিছু চিঠি রেখে গেছে। সেখানে বিনয় তাদের করা পাপ স্বীকার করেছে। সাথে এটাও লিখেছে যে নূহা ওকে ধমক দিয়েছিল। কিন্তু বিনয়ের খুন কে করেছে বা নূহা কি স্ব-ইচ্ছায় ওর গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে না’কি তা এখনো সঠিক আমরা জানি না। কারণ যে দুটো মানুষ তা জানত সে দুটো মানুষই এই পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীর বুকে এমন কোটি কোটি রহস্য জমে থাকে। এর মধ্যে একটা রহস্য উদঘাটন করতে যেয়ে তুমি তো তোমার জীবন নষ্ট করতে পারো না।”
“চিঠিগুলো যদি না পেত? নিয়তির কেরামতির অপেক্ষা করে হাতে হাত রেখে তো বসে থাকতে পারতাম না ভাবি। ভাইয়া আপনাকে সারাজীবন দোষারোপ করতো, আপনাকে ভালোবেসেও আপনার থেকে দূরে থাকতো, আপনারা দুইজনে কষ্ট পেতেন।”
“তুমিও তো আরও দুইজনকে কষ্ট দিয়েছ। ঝিনুকের কথা তো মানলাম, ও প্রথমে অবুঝতায় তোমায় অবিশ্বাস করেছিলো তবুও অবশেষে তো তোমায় পেয়েও গেল। কিন্তু জ্যোতি? ও তো কিছু করে নি। এইসবের মাঝে ওকে টানলে কেন সৈকত? কারও মন নিয়ে খেলাটা যে পাপ। দুইজনকে খুশি দিতে যেয়ে ঝিনুক, জ্যোতি এবং নিজেকে কেন কষ্টে পুড়ালে?”
এই কথার প্রতিউওর দিতে সময় লাগলো সৈকতের। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি জানি ভাবি আমি জ্যোতির সাথে যা করেছি তা ভুল ছিলো। যার অপরাধবোধ আমার এখানো হয়। তবে এটা ভুল বললেন যে ওর কোনো দোষ ছিলো না। অপরাধীর অপরাধ লুকানোটাও অপরাধ। জ্যোতি জানত যে আপনি কিছু করেন নি তবুও ও চুপ রইলো যেন বিনা দোষে আপনি শাস্তি পান। এটা অপরাধ নয়?”
“মানলাম ও ভুল করেছে। কিন্তু ভুলের শাস্তি যে ভুল করেই করতে হবে এমনটা তো নয়। তাই না?”
সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জ্যোতির ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু হ্যাঁ আমি এটা জানি যে আমার ও ঝিনুকের সম্পর্কে মধ্যে আমরা দুইজনই অপরাধী এবং এর শাস্তি আমরা দুইজনই ভোগ করছি। হয়তো বাহির থেকে সব ভুলে স্বাভাবিক দেখাচ্ছি কিন্তু ভিতর থেকে আমরা দুইজনই জানি আমরা আমাদের এত সুন্দর সম্পর্কের হত্যা করেছি। আমাদের ভালোবাসার অপমান করেছি। দুইজনের একে অপরের প্রতি রাগ ও অভিমান দুটোই আছে। এতমাস আমি ওর থেকে দূরে ছিলাম ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য না, বরং যেন আমার ভিতরের অপরাধবোধটা শেষ করতে পারি এবং ওর সেরাতের কথাগুলো ভুলতে পারি। কিন্তু……”
“কিন্তু তা পারছ না তাইতো? তুমি জানো তোমার এবং ঝিনুকের জন্য তোমাদের সম্পর্ক মানিয়ে নেওয়াটা বেশ সহজ ছিলো। কারণ তোমরা একে অপরকে শুরু থেকে ভালোবাসতে এবং একে অপরের ছিলে প্রথম ভালোবাসা। কঠিন তো আমার ও অর্কের জন্য ছিলো, যেখানে আমরা দুইজন অন্যকাউকে ভালোবাসতাম। হয়তো অর্কের প্রথম ভালোবাসা আমি ছিলাম কিন্তু বিয়ের সময় তার মন পাড়ায় অন্যকেউও ছিলো। কিন্তু দেখ আমরা এখন কত সুখে আছি। কারণ কী জানো? কারণ আমরা পুরাতন সম্পর্কগুলোর থেকে বেরিয়ে এসে নতুনত্ব এনেছি আমাদের সম্পর্কে। তোমাদের পুরাতন যা ছিলো তা ভুলে নতুন করে একে অপরকে চিনতে শিখো, একে অপরকে নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে শিখ, নতুন ভাবে ভালোবাসতে শিখ।”

“এখানে ভালোবাসার স্কুল খোলা হলে আমিও শিক্ষার্থী হতে রাজি আছি।”
প্রভা পিছনে তাকিয়ে দেখে অর্ক আসছে। অর্ক টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
“বাই দ্যা ওয়ে কীসের জন্য এত জরুরী ক্লাস নেওয়া হচ্ছে?”
সৈকত সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। আর বলে,
“ভাবি তোমাকে বলে দিবে। আমি গেলাম।”
বলে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না সৈকত। দৌড়ে চলে যায়।
অর্ক বিস্মিত দৃষ্টিতে সৈকতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওর আবার কী হলো?”
প্রভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“যে ক্লাস নিয়েছি সে ক্লাসের পড়াটা বাস্তবে এপ্লাই করতে যাচ্ছে।”
“মানে!”
প্রভা না উওর দিয়ে হেসে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। অর্কও গেল তার পিছনে। রান্নাঘরে ঢুকতেই অর্ক প্রভাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। প্রভা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে,
“মানেটা না বুঝানোর জরিমানা হিসেবে একটা চুমু দিতে হবে।”
প্রভা অর্ককে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
“পাগল হয়ে গেলেন না’কি? বাসায় বাচ্চারা এবং বড়রা সবাই আছে। কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে?”
“আর কি ভাববে আর? ভাববে সকাল সকাল আমার বউটাকে আদর করে দিচ্ছি। আর আমি কি কাউকে ভয় পাই না’কি?”
“পাগল হবেন না অর্ক, ছাড়ুন তো।”
অর্ক প্রভাকে এক মুহূর্তের জন্য ছেড়ে আবার সামনে যেয়ে তাকে সামনের থেকে জড়িয়ে ধরলো। দুইহাত দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলো প্রভাকে। প্রভার কানের কাছে যেয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,
“তোমার আগামীকালের জন্মদিনে ও আমার প্রথম দর্শনে ভালোবাসার উপহারটা আমাকে এখনই দিয়ে দেও।”
প্রভা অনেক মানা করল কিন্তু অর্ক কিছুইতেই মানলো না। যখন প্রভার কাছাকাছি যাবে তখনই বিনু ও অদিনের কথা শুনতে পায় দুইজন সাথে সাথে অর্ক প্রভাকে ছেড়ে দ্রুত তার কাছ থেকে সরে যায়।

বিনু ও অদিন একত্রে প্রভাকে “মা” “মা” বলে ডাকতে ডাকতে পাকঘরে ঢুকে। পাকঘরে ঢুকেই বিনু প্রভাকে বলে,
“মা আমাদের পেটে ইঁদুর, বিড়াল, সব সবাই খেলে। খিদে পেয়েছে।”
এবং অদিন অর্ককে বলে,
“পাপা পাপা আমরা কাল ঘুরতে যাব তাই না?”
“অর্ক এসে অদিনকে কোলে তুলে বলে,
” ইয়েস মাই প্রিন্স। আমরা আগামীকাল সবাই থিম পার্কে যাব।”
“দাদু-দাদী, নানা, ছোট মা, তারপর চাচ্চু… আর আর বাডি সবাই যাব না?”
“হ্যাঁ সবাই যাবে।”
অদিন ‘ইয়েএ’ করে চিৎকার করে অর্কের গলা জড়িয়ে ধরে।

অন্যদিকে,
সৈকত দ্রুত রুমে যেয়ে ঝিনুককে ডাক দেয় কিন্তু ঝিনুক ঘুম থেকে উঠে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে৷ সৈকত না পেরে ঝিনুককে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলে,
“জলদি ঘুম থেকে উঠো।”
ঝিনুক আধো বোঝা চোখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বল,
“কী হলো?”
“জলদি উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নেও।”
“গতকাল না আমরা এলাম, কোথায় যাচ্ছি?”
সৈকত ঝিনুকের দিকে চোখ টিপ মেরে বলল,
“আবারও নতুন করে নতুনভাবে প্রেম করতে এবং একে অপরের মন পাড়ায় নতুন করে জায়গা গড়তে।”
#মন_পাড়ায়
#বিশেষ/অন্তিম
#মধ্যাংশ
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকত ঝিনুকের দিকে চোখ টিপ মেরে বলল,
“আবারও নতুন করে নতুনভাবে প্রেম করতে এবং একে অপরের মন পাড়ায় নতুন করে জায়গা গড়তে।”
ঝিনুক কথাটা ঠিক ধরতে পারলো বলে মনে হলো না। সে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রয় সৈকতের দিকে।
সৈকত আলমারি থেকে ব্যাগ বের করছিলো। ঝিনুকের কোনো কথা না শুনে সে পিছনে ফিরে। ঝিনুকের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে সে এক লাফে উঠে যায় বিছানার উপর। ঝিনুকের মুখোমুখি হয়ে বলে,
“আমাদের সম্পর্ক আগেই অনেক বিগড়ে গেছে। পুরনো ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টায় অনেক সময় নষ্ট করেছি আমরা। চলো না আবার সব নতুন করে শুরু করি।”
“কিন্তু কীভাবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তোমার বোঝা লাগবে না। তুমি ফ্রেশ হও আমি আসছি, আমরা এক্ষুনি বের হব।”
“কিন্তু আপির জন্মদিন যে?”
“ভাবিই আইডিয়া দিয়েছে। এখন বেশি কথা বলো না তো, উঠো।”
ঝিনুক কিছুই বুঝল না। তবুও উঠে গেল বাথরুমে রেডি হতে।

সৈকত বের হতেই দেখে তার বাবা, মা, খালু, অর্ক, ভাদ্র ভাইয়া, বাচ্চারা সবাই নাস্তা করতে টেবিলে বসেছে। বাবাকে দেখে একটুখানি অস্বস্তি লাগলো তার। এতমাসে তাদের হাতে গোণা কয়বার দেখা হয়েছে কিন্তু কথা একবারও হয় নি।

সৈকত অর্ককে বলল,
“ভাইয়া আমি এবং ঝিনুক একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
“বাহিরে? বাহিরে কোথায়?”
“ঢাকার বাহিরে।”
“কাল তো আমরা ফ্যান্টাসি কিনডম যাব। তুইও না এইজন্য আসলি? এতমাস পর সবাই একসাথে হব আর তুই হঠাৎ এমন শুরু করলি?”
ভাদ্রও বলতে শুরু করল,
“হ্যাঁ তুই কোথাও যাচ্ছিস না। কোথাও না। ভাবি বার্থডে না? আমরা এত্তগুলা মজা করব সবাই মিলে।”
অদিন ও বিনুও জেদ শুরু করল।
অর্কের বাবা এসব শুনে বিরক্তির সুরে বললেন,
“একজন না থাকলে কী ঝড় আসবে না’কি? যে থাকার থাকুক যে যাবার যাক। এত হৈ-হুল্লোড়ের কী আছে?”
সৈকত তার বাবার দিকে তাকাল। ঠিকই তো সে তো তার বাবার আপন কেউ না। সে থাকলে বা না থাকলে কি আসে যায়?
প্রভা বলল, “মা ও বাবা আমাদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে বাড়িতে। ঝিনুক ও সৈকত এলে আমরা সবাই একসাথে সময় কাটাতে পারব। ওদের যেতে দেও।”
অর্ক বলল, “কিন্তু তোমার জন্মদিন?”
“আমার ও অর্কের সম্পর্ক ঠিক করতে যেয়ে আজ ওদের সম্পর্কের এই অবস্থা। ঝিনুক ও সৈকত ওদের সম্পর্কের নতুন সূচনা করলে আমার জন্য তা জন্মদিনের সবচেয়ে বেশি সুন্দর উপহার হবে।”
কথাটা শুনে অর্কসহ সবাই প্রভার দিকে তাকাল।
বাবা আবারও বললে,
“অর্ক ওদের যেতে দে। আমাদের সাথে ওদের থাকা না থাকাটা একই।”
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে উঠে সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমরা এক্ষুনি আসছি।
অর্ক সৈকতকে নিয়ে একটু ছাদে এলো। বলল,
“সঠিক করে বল তো কী হয়েছে?”
“বিশেষ কিছুই ভাইয়া। ভাবির সাথে কিছু সময় পূর্বে কথা হলো না? ভাবি আমাকে বুঝালো যে আমাদের দুইজনের সম্পর্ক এমনভাবে বিগড়ে গেছে যে তা নতুনভাবে শুরু করার প্রয়োজন।”
“তাহলে কীভাবে শুরু করছিস নতুন সম্পর্কটা?”
“আমি চিন্তা করলাম যেখানে আমাদের প্রথম ভালোবাসা হয়েছিলো সেখানে। কাপ্তাইলেক, রাঙামাটি।”
অর্ক মুখ বানিয়ে সৈকতের মাথায় টোকা দিলো।
সৈকত মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে বলল,
“মারলে কেন ভাইয়া?”
“গাঁধা প্রভা সম্পর্কে নতুনত্ব এর কথা বলেছে। আগে যেখানে প্রেমে পড়েছিলি সেখানে যেয়ে আবার প্রেমে পড়তে বলে নি। মানে তুই ওখানে যাবি আর ওকে ভালোবেসে ফেলবি নতুন করে? আর আমার আর তোর সম্পর্কেও তো ভেজাল গেছে, আমি কী তোকে আবার মোড়ায় টোড়ায় ছোট করে কোলে নিয়েছি? না’কি প্রভাকে আবার সে প্রথম দেখার ভালোবাসার মতো লেকের পাশে দাঁড় করিয়ে ভালোবেসেছি। এমন হয় নাকি? ভালোবাসা কখন, কীভাবে হবে কে বলতে পারে বল? ভালোবাসা মিষ্টি হাওয়ার দোলার মতো, কখন কাকে ছুঁয়ে যায় মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না। আর তুই ওকে কীভাবে ঝিনুককে আবার ভালোবাসতে পারবি? তুই কী ওকে কখনো ভালোবাসা বন্ধ করেছিস?”
“তাহলে কী করব ভাইয়া? অন্যকিছু তো মাথায় আসছে না।”
অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে তাকে ছাদের বর্ডারের কাছে নিয়ে গেল। বলল,
“সেটা তো মাথায় আসছে না। তুইও ভাব, আমিও ভাবি।”
অর্কের চোখ গেল হঠাৎ পাশের ফুলের টবের দিকে। সেখান থেকে একটি ফুল ছিঁড়ে সৈকতের হাতে দিয়ে বলল,
“যেয়ে জিজ্ঞেস কর তোকে বিয়ে করবে কি’না?”
সৈকত বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় অর্কের দিকে। অর্ক সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে বলে,
“আমার ও প্রভার বিয়ে যেভাবেই হোক না কেন প্রভা এট লিস্ট জানতো আমাদের বিয়ে হচ্ছে কিন্তু ঝিনুক তো তাও জানতো না। একটা মেয়ে তার বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন সাজায়, প্রভা সে স্বপ্নগুলো অনুভব করে এসেছে। হয়তো আমার সাথে না অন্যকারো সাথে তবুও করেছে, ঝিনুক তো তাও করতে পারে নি। আজ ওর সব স্বপ্ন পূরণ হবে। বিয়ে থেকে সুন্দর এবং পবিত্র কোনো সম্পর্ক হয় না। তাই আজ তোর ও ঝিনুকের বিয়ে। হয়তো শরিয়ত হিসেবে তোদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে তবে সে দিনগুলো বাঁচা হয় নি। বিয়ের জন্য প্রথম দুই পরিবার দেখা করা, রিং পরানো, হলুদ, মেহেদী তোরা কিছুই অনুভব করলি না। তাই আজ সব হবে শুরু থেকে।”
সৈকতের চক্ষু কপালে। সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
“একদিনে?”
অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে ভাব নিয়ে বলল,
“অর্ক থাকতে কিসের চিন্তা? একদিনে শুরু থেকে তোদের বিয়ে করে দেখাব। তুই যেয়ে শুধু আমার প্রিয় শালীকাকে বিয়ের জন্য মানিয়ে নিয়ে আয়।”
“কিন্তু ভাইয়া…..”
“বেশি কথা বলবি না এক্ষুণি যা। তোর বড় ভাইয়ের আদেশ অমান্য করাটা বারণ।”
সৈকত হেসে বলল,
“যো হুকুম বড় ভাই।”

ঝিনুকের মেজাজটা ভীষণ গরম লাগছিলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে এমন পাগলামি করে? এইসব শুধু সৈকত দ্বারাই সম্ভব। আগামীকাল প্রভা আপুর জন্মদিন, সবাই থাকবে শুধু তারা ছাড়া। এটা কোনো কথা?
সে বিড়বিড় করে সৈকতকে কতগুলো বকা দিচ্ছিল এবং ব্যাগ গোছাচ্ছিল।
হঠ্যাৎ পিছন থেকে তার ডাক পড়ল,
“ঝিনুক……”
সৈকতের কন্ঠ। এ কন্ঠ চেনার জন্য তার পিছনে ঘুরে তো সৈকতের চেহারা দেখার প্রয়োজন নেই। তাই সে না ঘুরেই বলল,
“আসছি, একটু সময় তো দিবে। সকাল সকাল এ-সব পাগলামি পাও কোথায় একটু জানিও তো।”
“একটু পিছনে তো ফিরে দেখ।”
ঝিনুক বিরক্তির সুরে বলল,
“আর কী দেখব…..”
পিছনে ফিরেই সে চমকে এবং থমকে গেল। সৈকত হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে মেঝেতে। তার হাতে একটি লাল রঙের গোলাপ।
ঝিনুক বিস্মিত। কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে সে মোটেও ধারণা করতে পারছে না। সে জিজ্ঞেস করে,
“এইসব কী করছ?”
“আমি জানি আমাদের সম্পর্কটা সবসময়ই ভীষণ সুন্দর ছিলো। কিন্তু এর ভিত্তি ছিলো দুর্বল। আমি জানি না এই কমতিটা কোথায় রয়ে গেল! জানতেও চাই না। আমি চাই সবকিছু নতুন করে শুরু করতে, তাও নতুনভাবে। ঝিনুক, বিয়ে করবে আমাকে?”
ঝিনুক কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় সৈকতের দিকে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ যেন বের হচ্ছে না। তার ঠোঁটের কোণে আলতো করে হাসি এঁকে এলো শুধু।
সৈকত আবার বলল,
“এত কি ভাবছ? আমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে হ্যাঁ বলতে কী সমস্যা?”
মুহূর্তে ঝিনুকের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রাপোজ করতে যেয়ে কেউ এভাবে কথা বলে? যাও বিয়ে করব না তোমাকে।”
সৈকত সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“মানে কী?”
“মানে যা শুনেছ তাই। প্রাপোজ করে মানুষ অনুরোধের সুরে। সে আসছে আমাকে আদেশ দিতে।”
“একমাস আগে তো ঠিকই কত সুন্দর মিষ্টি মেয়ের মতো আগেপিছে ঘুরতে সম্পর্ক আগের মতো করার জন্য। এখন করতে না করতেই তোমার আসল রূপ দেখাতে শুরু করে দিছো?”
ঝিনুক চোখ দুটো ছোট ছোট করে হা করে তাকায় সৈকতের দিকে। বলে,
“তোমার মানে আমি মিষ্টি না?”
“তেঁতুল থেকেও তিতো তুমি।”
ঝিনুক রাগে সৈকতের কলার ধরে বলল,
“দেখ মাথায় চড়াইছি মাসে এই না যে মাথায় চড়ে নাচবি। জামাই আসোস জামাইয়ের মতো থাকবি। অর্ক ভাইয়াকে দেখছিস প্রভা আপুর সাথে কত সুন্দর ব্যবহার করে আর তুই….অভদ্র একটা।”
“কে অভদ্রতা করতেছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। আর অর্ক ভাইয়ার মতো সুন্দর মতো ব্যবহারও করব আগে প্রভা ভাবির মতো হয়ে দেখাও। ভাবিকে দেখছ কত সুইট ভাবে কথা বে আর তুমি এখন গুন্ডামী করতেছ।”
“শুরু কে করছে?”
সৈকত উওর না দিয়ে ঝিনুকের কোমর জড়িয়ে তাকে নিজের একদম কাছে টেনে নিলো।
হঠাৎ সৈকত এমনটা করায় ঝিনুক একটু অবাক হলো বটে। সে অবাক চাহনিতে তাকায় সৈকতের দিলে। সৈকত আলতো করে ঝিনুক কপাল থেকে গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার তোমাকে এইভাবে পছন্দ। তোমাকে মিষ্টি অথবা উদাসী হলে মানায় না। আমি তোমার এ তুমিটাকেই ভালোবাসি।”
ঝিনুকের নিশ্বাস দিশেহারা হলো। তার মন পাড়ায় অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। কিছুটা পুরাতন চেনা অনুভূতি সাথে নতুন কিছু অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো৷ এবং তার কন্ঠ হলো নম্র,
“আমারও তোমার এই তুমিটাকে ভীষণ মনে পড়েছে।”
সৈকত একহাত দিয়ে ঝিনুকের খোঁপা বাঁধা চুলে গোলাপটা গুঁজে দিয়ে নিজে একটুখানি ঝুঁকে ঝিনুকের মুখোমুখি হলো। নেশাভরা কন্ঠে বলল,
“আর আমি তোমার এই তুমি থাকতে চাই এবং তোমাকেই ভালোবাসতে চাই।”
বলতে সৈকত ঝিনুকের ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। আরও শক্ত করে তার কোমর আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে নিলো।
ঝিনুক সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নেয়। অনুভব করে সৈকতের প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি স্পর্শ। ডুবে যায় সৈকতের গভীর চুমুর অনুভবে।
এমন নয় যে এই প্রথম এই অনুভূতি হয়েছে তবুও এবার নতুন কিছু ছিলো। হয়তো অপেক্ষার অবসানের কিছু নতুন সুখ।

চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here