#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৪২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
সৈকত হেসে বলল,
“নিশ্বাস ফেলে তো বলো।”
“আমার মাথা অর্ধেক শেষ এইসব শুনে। পেটে গুড়ুমুড়ু করছে সবটা জানার জন্য।”
ইকবাল বলল,
“আমরা যখন অনার্স ফাস্ট ইয়ারে ছিলাম তখন আমাদের এক বন্ধু সুসাইড করার চেষ্টা করে। বিষ খেয়েছিলো। যা কোনো কাজও করে নি। শালায় হুদাই টেনশন বাড়াইসে আর কিছু না।”
সৈকত একটু গলা খকখকানি দেয় ও ইকবাল তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“ও সরি। শালা টালা বাদ দেও। তারপর জানতে পারি অন্য এক ভার্সিটির একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে গিয়েছিল সে মেয়ের ডিমান্ড পূরণ করতে করতে নিজের বাইক বেঁচে দিয়েছে সাথে ওর মা’য়ের গলার স্বর্ণের চেইন চুরি করে মেয়েটাকে শপিং করিয়েছে। আর ওই মেয়ে ঠকবাজি করে ওর মতো আর কত আবালকে বোকা বানিয়েছে। এমনকি শুধু ও একা না, ওরা চার বান্ধবী এমন করে। কয়েকটা ছেলেদের সাথে রিলেশন করে যাদের মেয়েরা পাত্তা দেয় না। কয়টা ছেলে আছে যাদের মেয়ে পেলেই হইসে মেয়ে কেমন তা খোঁজ না নিয়েই পিছু পিছু ঘুরে৷ মেয়েগুলোও তাদের কাজ বের করে নেয় তারপর ছেড়ে দেয়। ওই গাঁধায় এইসব খোঁজ করে জানার পর মেয়ের কষ্টে ও মা বাবার ভয়ে সুসাইড করার চেষ্টা করেছে। তারপর এই মহান মানুষটায় মাথায় এত ফালতু বুদ্ধি আসে যে মেয়েগুলোর সামনে বোকা সেজে যেয়ে তাদের সাথে রিলেশন করা ও তাদের এই জ্ঞান দেওয়া তারা যা করছে তা একদম অনুচিত।”
সৈকত ইকবালের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“নিজেও তখন লাফাচ্ছিলেন এই প্লান শুনে। আর প্লান কাজও করেছে।”
“এর মধ্যে আমাদের কত কাহিনী করতে হইসে ভুলে গেছিস?”
অঞ্জলি জিজ্ঞেস করল,
“কী করতে হয়েছে?”
“মেয়েগুলো সাধারণত একে অপরকে ছেলেদের ছবি তেমন দেখায় না কারণ কয়দিন পর এমনিতেই ছেড়ে দিবে। এর মধ্যে এক মেয়ে আসলে সৈকতের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো আর বান্ধবীদের ছবি দেখায় দিলো। সব কাহিনী ওলট-পালট হলো। ওরা যখন আমাদের কনফ্রন্ট এলো তখন তাদের বুঝালাম আমরা। ওরা যে ছেলেদের সাথে এমন করেছে তাদের কাহিনীগুলো বললাম। তারা কতগুলো জীবন শেষ করল। এর মধ্যে অনেকে এমনও আছে যাদের পরিবার অনেক কষ্টে নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করে তাদের সাথে এমন করে দুইটা মেয়ে বুঝলেও আর দুইজন মোটেও মানছিলো। তারপর তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখিয়ে বললাম যে যদি এইসব বন্ধ না করে তাহলে স্যোশাল মিডিয়াতে এইসব ছেড়ে দিব এবং ওদের বাসায় ও ভার্সিটিতে জানিয়ে দিব এইসব। তারপর থেকে আর এমন কিছু করে নি।”
“কিন্তু এতকিছু না করে জানিয়ে দিলেই ভালো হতো। কী অসভ্য মেয়েগুলো!”
“কিন্তু মেয়েগুলোর যে জীবন নষ্ট হয়ে যেত। তার কী?”
সৈকত প্রশ্ন করলো। অঞ্জলি বলল,
“এমন মানুষদের কথাও ভাবতে নেই।”
“অঞ্জলি এখন ওরা কেউ-ই আর এমন কিছু করে না। সবাই নিজে পরিশ্রম করে নিজের খরচ উঠায়। তারা যাদের সাথে অন্যায় করেছে গতবছর তারা নিজে যেয়ে ক্ষমা চাইছে এবং কিছু অংশ হলেও তাদের টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি তাদের একবার সুযোগ না দেওয়া হতো তাহলে তারা বুঝতে পারতো নিজের দোষ?”
“হঠাৎ এমন পরিবর্তন কীভাবে হলো?”
“ওদের মধ্যে এক বান্ধবী গতবছর মারা গেছে৷”
কথাটা শোনার পর অঞ্জলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করল,
“আর মোহিনীর কী? আপনার সাথে ওর একবছরের রিলেশন ছিলো। তারপর খবর পাওয়া যায় ও প্রেগন্যান্ট আর ওর খোঁজ পাওয়া যায় নি।”
“প্রথমত আমাদের সম্পর্ক কখনোই ছিলো না। ও আমার অনেক ভালো বান্ধবী। মোহিনী এখন লন্ডনে নিজের বাচ্চার সাথে আছে। এমনকি এখনও আমার সাথে ওর প্রতি সাপ্তাহে কথা হয়। যেহেতু এইটা মোহিনীর ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই আমি ওর কাহিনীটা বলতে পারছি না কিন্তু এতটুকু বলব ওর এখন নিজের বাচ্চার সাথে ভালো আছে।”
“মানে বাচ্চাটা আপনার না? আর আপনাদের সম্পর্ক না থাকলে সবাই বলে কেন ওর সাথে আপনার সম্পর্ক ছিলো?”
“মানুষের কাজই হলো একটা যে কোনো কথাকে বাড়িয়ে চাড়িয়ে বিশাল বড় করা। আমাদের মাঝে শুরু থেকেই শুধু বন্ধুত্ব ছিলো। আসলে এই ভার্সিটিতে মোহিনী আমাকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলতো না। এইজন্য সবাই আমাদের সম্পর্ক ভেবে বসে আছে। আর অবশ্যই বাচ্চাটা আমার না। আমি তোমার বান্ধবী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে এক ফোঁটা রোমেন্সও করি নি।”
অঞ্জলি একটু অস্বস্তিকর হাসি নিয়ে বলল,
“শেষের কথাটা না বললেও চলতো। আচ্ছা ভাইয়া আপনি ও ঝিনুক তো একে অপরকে অনেক ভালোবাসতেন তাহলে এত সমস্যা কেন আপনাদের মাঝে?”
“কোনো সম্পর্ক টিকে থাকতে হলে তার প্রথম স্তম্ভ ভালোবাসা না বিশ্বাস হতে হয়। যদি কেউ বিশ্বাস করতে না শিখে বা কেউ বিশ্বাস বজায় রাখতে না শিখে তাহলে সে সম্পর্ক টিকে না।”
“ঝিনুক ভাবে আপনি ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কিন্তু এমন ভাবার কোনো কারণ তো আছে। হঠাৎ করে তো একদিনে কারও মাথায় এইসব খেয়াল এসে পড়ে না। কোনো কিছু বা কেউ এর পিছনে থাকে। তাই না?”
“হ্যাঁ, আর আমাদের সম্পর্কে সে মানুষটা ছিলো পরিশ।”
অঞ্জলি বিস্মিত সুরে বলল,
“ঝিনুকের ভাই?”
“পরিশ ঝিনুককে বিয়ে করতে চায়। পরিশ শুধু চায় ঝিনুক শুধু ওর হয়ে থাকবে।”
অঞ্জলি চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“ছিঃ এইসব কী বলেন ভাইয়া? ঠিকাছে মানলাম দুইজন আপন ভাইবোন না আর কাজিনদের মাঝে বিয়েটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু ঝিনুকের কাছে প্রভা আপু ও পরিশ ভাইয়া নিজের আপন ভাইবোনদের মতো। সবাই একসাথে বড় হয়েছে।”
“ঐটাই তো, শুধু ঝিনুকের দিক থেকে। আর রইলো আমাদের সম্পর্ক ভাঙ্গার কথা। আমি শুধু আমার দিকটাই বলতে পারব। ছোট করে বললে, একদিন পরিশ আমাকে ও ঝিনুককে একসাথে দেখে এবং আমাকে ভীষণ মারে। তারপর ঝিনুক না’কি পরিশকে অনেক অনুরোধ করে যেন আমাদের সম্পর্ক রাখতে দেয় এবং পরিশ মেনেও যায়। আমরা দুইজন ভীষণ অবাক হলাম বটে কিন্তু খুশিও ছিলাম। একমাস পর ঝিনুক এসে বলে ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে না। ও বুঝে আমি ওর সাথে খেলছি, ওকে ভালোবাসি না আরও কত কি! আমি ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি অনেক মাস ধরে, কোনো লাভ নেই। ও অন্ধবিশ্বাস করে পরিশকে। তারপর দূর থেকেই ওর খেয়াল রাখা শুরু করি। এতে ঝিনুকের বান্ধবী মিথিলা আমার সাহায্য করে। আমি সবসময়ই চাইতাম ও আমার হোক বা না হোক শুধু সুখে থাক। ভেবেছিলাম ও আমার ভাগ্যে নেই। কিন্তু ভাগ্য অন্য কিছুই চাইতো। ঝিনুক আমার ভাগ্যে লেখা থেকেও যে নেই।”
“ভাইয়া হার মানবেন না। ঝিনুককে আমি যেয়ে সব বলছি। ওকে বোঝাচ্ছি।”
কথাটা বলে অঞ্জলি যেতে নিলেই ইকবাল তার সামনে এসে দাঁড়ায় ও বলে,
“ঝিনুককে কিছু বলতে পারবে না।”
অঞ্জলি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু কেন?”
সৈকত তার পিছন থেকে উত্তর দিলো,
“কারণ আমরা চাই না আমাদের এত বছরের চেষ্টা পানিতে ভেসে যাক। ঝিনুক রাগে থাকলে ও কী করে নিজেও বুঝে না। ও অন্যকারো দিক বুঝতে চায় না। ওর যদি মনে হয় ও যেয়ে জ্যোতির সাথে ঝগড়া করলে সব ঠিক হয়ে যাবে তাহলে ও তাই করবে। কারো কথা বুঝতে চাইবে না। ওর কাছে ও নিজে যা বুঝে তাই ঠিক। ও ভুলেও জ্যোতির সামনে কিছু বলে দিলে সব ভেস্তে যাবে। আর আমরা এখনো শিউর না সে সাইক্রিয়াটস্টের কাছে গেলে কোনো প্রমাণ পাব না’কি? না পেলে আবার জ্যোতিকে প্রয়োজন হবে আমাদের।”
“আপনার অতীতের কথাগুলো তো বলুন।”
সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে পিছনে ঘুরে তাকাল। বর্ডারে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলল,
“ওকে আগেই সব বলেছি কিন্তু ও বিশ্বাস করে নি। জানো অঞ্জলি, আমার না মাঝেমধ্যে ওর মন পাড়ায় ঢুকে দেখতে ইচ্ছে হয়। ও মন পাড়ায় কী আসলে আমার অস্তিত্ব আছে?”
অঞ্জলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভাইয়া প্রতিটি মানুষ যেমন ভিন্ন হয় তেমনি তাদের ভালোবাসার ধরণটাও হয় ভিন্ন।”
“বিশ্বাস না থাকলে সে সম্পর্কে ভালোবাসা থাকে?”
“থাকে তবে সে সম্পর্কটা থাকে দুর্বল। অবিশ্বাস থাকুক বা অন্ধবিশ্বাস দুটোই যে কোনো সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।”
সৈকত আবার ফিরে তাকালো অঞ্জলির দিকে। জোরপূর্বক হেসে বলল,
“থাক এ-সব বাদ দেও। তোমার বান্ধবী কোথায়?”
“ওকে স্যার ডেকেছে গতকাল না আসার কারণ জানতে।”
.
.
“আমি অসুস্থ ছিলাম স্যার।”
ঝিনুক বসে আছে প্রফেসর আব্দুল মতিনের সামনে। তাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান উনি। স্যারের মুখে সন্দেহ স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। উনার ধারণা ঝিনুক মিথ্যা বলছে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তা সত্য নয় যে। অসুস্থতা কী শুধুই শারীরিক হয়? মনের অসুখ হয় না? শুধু পার্থক্য হলো মনের অসুখ কোনো পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। তা শুধু মন পাড়াতেই থেকে যায়।
প্রফেসর মতিন বললেন,
“আমাদের জানানো উচিত ছিলো না তোমার? তুমি ও জ্যোতি দুইজনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে বলে দেখাই দেও নি। আমরা প্রধান অতিথির সামনে কত লজ্জিত হয়েছি জানো?”
ঝিনুক মাথা নিচু করে মুখটা মলিন করে বলল,
“সরি স্যার। আর কখনো হবে না।”
প্রফেসর মতিন কিছুক্ষণ ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে বলল,
“আচ্ছা যাও আর…. নিজের খেয়াল রেখো।”
“জি।”
ঝিনুক চেয়ার থেকে উঠে সামনে যেতেই আবার ডাক দিলো প্রফেসর মতিন। ঝিনুক পিছনে তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মা বাবার নাম কী?”
ঝিনুক অনেকটা অবাক হলো প্রশ্নটা শুনে। সে জিজ্ঞেস করে, “কেন স্যার?”
“তোমাকে দেখে কারও কথা মনে পড়ে গেছে।”
ঝিনুক অনেকটা দ্বিধাবোধ করে বলল,
“আমার মা বাবা কেউ-ই নেই স্যার। আমার খালু ও খালামণি আমার গার্জিয়ান।”
“ওহ সরি, আচ্ছা তুমি যাও।”
ঝিনুক রুম থেকে বের হয়ে অঞ্জলিকে কল দিলো। আর অঞ্জলি ছাদে আসতে বলল তাকে। ছাদে যেয়ে সৈকতকে দেখে অঞ্জলিকে রাগান্বিত স্বরে বলল,
“আমাকে এইখানে ডাকার কী প্রয়োজন ছিলো?”
“তুই না সৈকত ভাইয়া কীভাবে ব্যাথা পেয়েছে তা জানতে চাইতি?”
ঝিনুক চোখ রাঙিয়ে তাকাল অঞ্জলির দিকে৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি কখন জানতে চাইলাম? ওর সাথে যা ইচ্ছা তা হোক আমার কী?” বলে একটু ভাব নিয়ে তাকাল সৈকতের দিকে।
সৈকত তাকিয়ে ছিলো অন্যদিকে। তার আসার পর থেকে একবারও তার দিকে তাকায় নি। সৈকত উঠে ইকবালকে বলল,
“চল ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আবার অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি চিন্তা করো না বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। প্রয়োজনে আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব।”
“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
সৈকত মৃদু হেসে চলে গেল।
সৈকত যাওয়ার পর ঝিনুক অঞ্জলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুই ওকে তোর বিয়ের কথা কখন বললি?”
“তোর আসার আগে।”
“তোকে যে কাজে পাঠিয়েছিলাম তা করেছিস? ও কীভাবে ব্যাথা পেল?”
“ভাইয়ার সাথে যা ইচ্ছা তা হোক তোর কী?”
বলেই অঞ্জলি সামনে এগোতে নিলো আর ঝিনুক তার হাত ধরে ফেলল। বলল,
“মাইর খাবি তুই। বল কীভাবে হয়েছে?”
অঞ্জলি ঝিনুকের গাল টেনে বলল,
“সুইটহার্ট তোমার জামাই তুমি জিজ্ঞেস করো। আমি পারব না।”
আর হাত ছাড়িয়ে চলে গেল।
.
.
প্রভা ড্রইংরুমের সোফায় বসে বিনু, অদিন ও ভাদ্রের সাথে সৈকতকে খেলতে দেখছিলো। কিন্তু বারবার তার চোখ যাচ্ছে দেয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে। রাত এগারোটা বেজে গেছে কিন্তু অর্ক আসছে না অথচ প্রতিদিন নয়টায় সে বাসায় এসে পড়ে। ফোনও ধরছে না। তার পাশে তার শাশুড়ি মা এসে বসলো। সে প্রভা’কে বলল,
“চিন্তা করো না অর্ক এসে পড়বে। ওর বাবা বলেছিল আজ অর্কের আসতে দেরি হবে। জরুরী কাজ আছে।”
প্রভার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। অর্কও তো তাকে একবার ফোন করে বলতে পারতো। সে মুখ মলিন করে বলল,
“আমি জানতাম না।”
“আরে মন খারাপ করছ কেন? অর্কের বাবা বলেছিল তোমাকে জানাতে আমি ভুলেই গেছিলাম জানাতে।”
প্রভা মিষ্টি হেসে তাকাল মা’য়ের দিকে। বলল,
“আমি ঠিকাছি মা। চিন্তা করবেন না। এতটুকু কথার জন্য বাহানা করতে হবে না। আমি জানি অর্ক বলে নি।। আচ্ছা মা, সৈকত কী সবসময়ই ভাদ্র ভাইয়ার খেয়াল রাখে এইভাবে?”
“হ্যাঁ, তিন ভাই-ই একে অপরকে অনেক ভালোবাসে। ভাদ্র অর্ক থেকে সৈকতের বেশি কাছের কারণ অর্ক বিদেশে ছিলো অনেক বছর আর কাজে সবসময়ই ব্যস্ত থাকে। আর ব্যস্ত থাকাটাও স্বাভাবিক, সম্পূর্ণ কোম্পানির সব সিদ্ধান্ত ওরই নিতে হয় এবং মাশাল্লাহ কাজের কোনো সিদ্ধান্ত ও ভুল নেয় না। আজ কোম্পানিটা এত সুন্দর ভাবে গড়ে উঠেছে সবটাই অর্কের জন্য।”
প্রভা বেশ খুশি ও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মা’য়ের দিকে। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে অনেক গর্বিত অর্ককে নিয়ে। প্রভা জিজ্ঞেস করল,
“আপনি অর্ককে নিয়ে অনেক গর্বিত তাই না?”
“অবশ্যই এত কম বয়সে সফলতার এই পর্যায়ে গিয়েছে। কোন মা গর্বিত বোধ করবে না?”
কথাটা শুনে প্রভার ঠোঁটের হাসি আরও প্রশস্ত হলো। সে বলল,
“মা আমি যেয়ে বিনু ও অদিনকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। রাত হয়ে এসেছে। আর সৈকতকে বলি ভাদ্র ভাইয়াকেও নিজের রুমে নিয়ে যেতে, তারও ঘুমের সময় হয়েছে।”
মা সম্মতি দিলেন প্রভার কথায়।
আরও আধাঘণ্টা পর এলো অর্ক এলো। অর্ক দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রভা অভিযোগের সুরে বলল,
“আপনি ফোন ধরেন নি কেন?”
“আসতে না আসতেই এত তদন্ত শুরু করে দিলে?”
“তদন্ত করব কেন? এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
“সৈকত কোথায় জানো?”
“ভাদ্র ভাইয়ার রুমে বা ওর রুমে। রাতের খাবার দেই?”
“খেয়ে এসেছি আমি। আমি সৈকতের সাথে কথা বলে আসছি।”
“এত রাতে? এতক্ষণ কাজ করে এসেছেন একটু বিশ্রাম করে নিন।”
“সব কিছুতে কথা বলার এত প্রয়োজন কেন তোমার?”
কাঠখোট্টা গলায় বলে অর্ক সেখান থেকে চলে গেল।
প্রভার একটু মন খারাপ হলো। এতক্ষণ ধরে সে অর্কের অপেক্ষা করছিলো। খাবারও খায় নি অর্কের সাথে খাবে বলে। অথচ অর্ক তার সাথে এমন রূক্ষভাবে কথা বলে গেল। ভীষণ অভিমান হলো তার। সাথে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করল। বহু কষ্টে চোখে আসা অশ্রু আটকে রাখল। খাবারের টেবিলের কাছে যেয়ে খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে দিলো।
অন্যদিকে ঝিনুক রুমে বসে তার সামনে বই নিয়ে বসে ছিলো। কিন্তু তার চোখ ছিলো দরজার দিকে। সৈকত দরজা দিয়ে ঢুকতেই সে তার চোখ স্থির করল বইয়ের দিকে।
সৈকত দরজা লাগিয়ে আলমারি থেকে একটি চাদর ও বিছানা থেকে একটি বালিশ নিয়ে মেঝেতে রাখল।
ঝিনুক অনেকটা অবাক হয় সৈকতকে এমনটা করতে দেখে। সে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছ?”
সৈকত ঝিনুকের দিকে না তাকিয়েই কঠিন গলায় উওর দিলো,
“ঘুমাব তাই প্রিপারেশন নিচ্ছি।”
“কিন্তু এতদিন তো বিছানায় ঘুমাতে।”
সৈকত ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে উওর দিলো,
“এতদিন তো জানতাম না আমার ছোঁয়াতে তোমার ঘৃণা লাগে।”
ঝিনুক সৈকতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে নিলো আর দরজায় টোকা পরলো। ঝিনুক গভীর নিশ্বাস ফেলে ভেজা কন্ঠে বলল,
“বালিশ ও চাদর বিছানায় রাখো। কেউ তোমাকে মেঝেতে বিছানা করতে দেখলে হাজারো প্রশ্ন করবে।”
“তাহলে তালাকের সময় কী উওর দিবে সবাইকে?”
ঝিনুক উওর দিলো না। একপলক সৈকতকে দেখে উঠে গেল। দরজা খুলে দেখে অর্ক এসেছে। অর্ক বলল,
“ঝিনুক আমার সৈকতের সাথে একটু জরুরি কথা আছে। তোমার সমস্যা না হলে কথা বলতে পারি?”
“জ্বি দুলাভাইয়া। আমি বাহির থেকে আসছি।”
ঝিনুক যাওয়ার পর অর্ক দরজা লাগিয়ে দিলো। সৈকত চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“আমি কিন্তু আপনার বাবার সাথে কয়দিনে কোনো কথাও বলি নি।”
“বাবাকে নিয়ে কোনো কথা বলতে আসি নি।”
“তাহলে আপনার আমার সাথে আবার কী কথা থাকতে পারে? এই ঘরের সব জরুরী সিদ্ধান্তই তো আপনি ও আপনার বাবাই মিলে নেন।”
অর্ক গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল,
“সৈকত আমি তোর সাথে প্রভার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
চলবে……
[