#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৪৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
আজ আকাশে মেঘ জমা। কোনো নক্ষত্রের নেই দেখা। সৈকত ছাদের বর্ডারে পা মেলে বসে নিচের দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে ওই মেঘভর্তি আকাশটার দিকেই নয়ন গেঁথে রেখেছিলো। ছয়তলা থেকে নিচে দেখে সবকিছুই ভীষণ ক্ষুদ্র লাগছিল। মুহূর্তে পিছন থেকে তার শার্টের কলার ধরে কেউ টান দিলো। সে বুঝতে পারলো না কী হলো? বোঝার আগেই সে নিচের পরে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখে ইকবাল দাঁড়ানো তার সামনে। সে ইকবালের এমন কান্ডে বিস্ময়ে কিছু বলতে নিবে এর আগেই ইকবাল তাকে লাথি মেরে বলল,
“শালারপুত তুই ওইখানে কী করতাসিলি? মরার শখ জাগছে না’কি তোর? এত শখ হইলে আমাকে কইতি আমিই লাথি ঘুষি মেরে মাইরা ফেলতাম তোরে একবারে।”
সৈকত ইকবালের কথার আগা মাথা কিছু বুঝল না।
সৈকত তার মা’কে নিয়ে আজ সোজা ইকবালের বাসায় এসেছে। এত রাতে অন্যকোথাও এর কথা তার মাথাতেও আসে নি। ঘরে এসে তাদের দেখে যেন ঘরে আয়োজন শুরু হয়েছে। যেন রাজা-বাদশা কেউ এসেছে তাদের ঘরে। অথচ সে যখন সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে তখন তার মনে কালো মেঘ জমেছিলো যে তারা এখন তাদের রাখতেও চাইবে না। আসলে তো তাদের অস্তিত্ব মাহমুদ সাহেব বাদে কিছুই না। যদি তারা তাদের রাখতে না চায় তাহলেও সে বিস্মিত হতো না। শুধু একরাত থাকতে চাইত। পকেটে পাঁচশো ত্রিশ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার পর সে তার মা’কে নিয়ে কোথায় যাবে তা তার মাথায় এলো না। ছোট থেকে মা’য়ের পরিবারের কাওকে সে দেখেও নি যে তাদের কাছে এই মুশকিল সময়ে ছুটে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ইকবালের বাবা একদম আনুগত্যের সুরে বলে,
“বাবা আমি তোমার বাবার বা তোমার পরিবারের যতটা সম্মান করি তার থেকে কোটি কোটি গুণ বেশি সম্মান করি তোমার। তুমি মাহমুদ স্যারের ছেলে থাকা বা না থাকায় আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে কখনো এইজন্য সম্মান বা আদর করি নি যে তুমি মাহমুদ স্যারের ছেলে বরংচ আমরা মাহমুদ সাহেবকে এইজন্য সম্মান করেছি যে তুমি তার ছেলে। টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না বাবা। আজ আমার সম্পূর্ণ পরিবার শুরু তোমার জন্য সুখে আছে। তুমি আজ আমাদের বাসায় থাকতে এসেছ এইটা আমাদের ভাগ্য। এইটা তোমার বাসা। তুমি সারাজীবন আমাদের সাথে থাকলেও আমরা তোমার দায় শোধ করতে পারব না।”
তার বাবার সমান একটি মানুষকে এইভাবে বলতে দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলো সৈকত৷ সে কিছু বলে নি আর। ইকবালের মা তার মা’কে আরও বলেন,
“আপা আপনাকে দেখার ইচ্ছা ছিলো আমার। এমন একটা ছেলেকে জন্ম দেওয়ার মতো মা’কে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিলো আমার। কিন্তু সামর্থের কারণে কখনো দেখা করি নি। আজ আপনারা আমাদের এই ছোট বাসাতে এসেছে এইটা আমাদের অনেক বড় ভাগ্য।”
বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না তিনি। ইকবালের মআ আর বোন তো এমন তড়িঘড়ি শুরু করে যেন বিয়ে চলছে। সে রান্না করা শুরু করলো বিরিয়ানি, মুরগির মাংস আর কত কী!
এইসব দেখে সৈকত বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে এসে পড়লো। ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো তার বড় ভাইয়ের তার কাছে হাত জোর করাটা আরেকবার ঝিনুকের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো। এই দুটো দৃশ্য মনে করতেই যেন বুকের ভেতর ছাড়খার হয়ে যাচ্ছিলো তার। দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল এই অনুভূতিটা সে। কিন্তু পারবে না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে তার প্রিয় দুটো মানুষের অসহায়তা। তাই একটু বসেছিলো ছাদের কোণে। এখানেও শান্তি নেই। ইকবালের এমন কান্ডে সে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সে উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত থেকে বালু ঝেরে নেয়।
ইকবাল আবারও বলল,
“বল শালা তুই মরতে গিয়েছিলি কোন দুঃখে। এতটুকু কথায় কেউ মরতে যায়? তোর মাথায়ও কেমন করে এলো এই ভাবনা। তোর কিছু হলে আমার, আন্টির আর ঝিনুকের…..”
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই কানের নিচে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সৈকত। আর বলে,
“তোকে এত ভবিষ্যতবাণী করতে বলে কে? শুধু শুধু বসে তারা দেখতাসিলাম মরতে যাই নাই। গাঁধার ঘরের গাঁধা। আমাকে কী এত নরম মনে হয় যে সুসাইড করে বসব? রামছাগল একটা।”
বলে আবারও যেয়ে আগের জায়গায় বসলো। তবে এইবার উল্টো ঘুরে।
ইকবালও তার পাশে এসে বসলো। সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তুই যদি কাঁদতে চাস আমার কাঁধ আছে তোর জন্য।”
“সে কাঁধ ধরেই ধাক্কা দিয়ে এইখান থেকে ফালায় দিব তোকে।”
ইকবাল হেসে তার হাত সরিয়ে বলল,
“তুই এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছিস অথচ তোর কন্ঠে বিষণ্ণতার আভাস স্পষ্ট পাচ্ছি।”
“আমার জীবন এমন কেন রে? সুখ আসে তবে হাওয়ার মতো। ছুঁয়ে চলে যায়।” আবার ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ আমার অস্তিত্বটাও মিশে গেল? কে আমি? আমার পরিচয়টা কী? যে পরিচয় ছিলো আজ তাও নেই।”
“তুই সৈকত। আর এটাই তোর অস্তিত্ব। এমন নয় যে তুই তোর বাপের নামে জীবন চালিয়েছিস তাই নয় কী? তোকে আশেপাশের লোকেরা মাহমুদ সাহেবের ছেলে বলে চিনে না। সৈকত বলে চিনে।”
“হুঁ।”
“তুই এমন কেন রে? সবাইকে নিয়ে ভাবিস অথচ দিনশেষে তোর প্রাপ্তির সংখ্যাটা সেই শূন্য। যে ভাইটার জন্য তুই এতকিছু করছি। সে আজ তোর মুখের উপর বলে দিলো তুই তার পর। জ্যোতির বাবা না’কি পলিটিক্স -এ? অর্থাৎ তোর পড়া শেষ হওয়ার পর তোর রিপোর্টার বা এডিটর হিসেবে চাকরি পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। তুই আমাকে কখনো বলিস নি কিন্তু আমিও এতটুকু জানি তুই সব ঝুঁকি নিয়ে শুধুমাত্র জ্যোতির সাথে জড়িয়েছিস যেন অর্ক ভাই আর প্রভা ভাবির জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারিস কিন্তু এতে তোর ভবিষ্যতে কত বড় ঝুঁকি আসছে তাও তুই জানতি। তুই এইসব বাদ দিয়ে ঝিনুক ভাবির সাথে সংসার করতে পারতি। কিন্তু না তুই উনাদের কথা ভেবেছিস। বিশেষ করে অর্ক ভাইয়ার। তুই যত যা বলিস তুই আর আমি দুইজনে জানিবতুই উনাকে কত ভালোবাসিস। তুই সবাইকে এত ভালোবাসিস। কিন্তু কেন? অবশেষে সে মানুষগুলোই তোকে কষ্ট দেয়।”
“সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে রে। আফসোস করছে। আমি নিশ্চিত কাঁদবেও। আমার ভাই সহজে কারও জন্য কাঁদে না জানিস? কিন্তু আমি তো জানি আজ সে কাঁদবে। তবে বলে ভুল করে নি। এতবছর যে মিথ্যা অন্ধকারে বাঁচছিলাম আজ সে মিথ্যা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলাম।”
ইকবাল কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল নীরাকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে। সে হাঁপিয়ে বলল,
“তোরা এইখানে কীসের প্রেম পিরীতি করোস?”
ইকবাল বলল,
“পিরীত করার মতো তো কাউকে পাই না। তুই এখন আইসোস না, আয় একটু প্রেম করি।”
“শালা লুইচ্চা।”
সৈকত হেসে দিলো দুইজনের কথোপকথন শুনে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“এখানে কী করিস?”
“এই লুইচ্চা থেকে তোর কাহিনী শুনে আসলাম শুনে ঘর থেকে যেমনে তেমনে পালায়া আসলাম তোকে সান্ত্বনা দিতে।”
“পালিয়ে আসছিস?”
“আরে কইস না। আব্বা আম্মা ঘুমাইছে। ছোট ভাইরে তিনশো টাকা ঘুষ দিয়ে আসলাম। কোক আনছি৷ চল আজ কোক পার্টি করব।”
নীরা কোক দুইজনকে দিয়ে নিযে একটা নিয়ে প্রথম প্রশ্নটা সৈকতের দিকে ছুঁড়ে মারলো,
“তুই আসলে ঝিনুককে তালাক দিবি?”
“হ্যাঁ।” নির্দ্বিধায় উওর দিলো সৈকত।
“তোর মনে হয় তুই বা ঝিনুক কেউ সুখে থাকবি এই সিদ্ধান্তে।”
“ও তো এই সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নিয়েছে। আমি শুধু সিলটা মেরে আসলাম ওর সিদ্ধান্তে। এটা ওর আর আমার দুইজনের জন্যই ভালো। জীবনে শুধু ভালোবাসাটাই সব না, শান্তিটাই সব। কাউকে তুমি ভালোবাসো তোমার শান্তির জন্য। তার সাথে থেকে তুমি হাজারো কষ্ট পাও, সে কষ্টেও এক শান্তি থাকে। শান্তিটা হলো সে মানুষটা তোমার। যেদিন সে শান্তিটা অশান্তিতে পরিণত হয় তখন সে ভালোবাসাটাও তোমার দম আটকে দেয়ার মতো হয়ে যায়। আর যে অশান্তির সবচেয়ে বড় বিষয়বস্তু হলো অবিশ্বাস। কোনো সম্পর্কে ভালোবাসা না থেকেও যদি বিশ্বাসটুকু থাকে তাহলে তাতেও শান্তি থাকে। আমার দম আটকে আসে ঝিনুকের অবিশ্বাস সহ্য করে। বুকের ভেতরটা শূন্য লাগে। সহ্য হয় না। আর এখন তো আরও আমার জীবনে গ্রহণ করতে পারব না। কোথায় যাব, কী করব, কোথায় থাকব কিছু জানি না। এই অনিশ্চিত জীবনে ওকে জড়িয়ে ওর জীবনটাও অনিশ্চিত করতে চাই না।”
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি ঝরে পড়ার অবকাশ।
.
.
অর্ক বারান্দার এক কোণায় বসে আছে। নিজেকে নিস্তেজ লাগছে তার। এই নির্জন রাতে আকাশের মেঘগুলোকে দেখছে সে। আজ যেন তার জীবনটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। জীবনে থাকা প্রিয় মানুষগুলোকে যেন নতুন করে চিনতে পারলো সে আজ। এতটা বছর ধরে এক পট্টি লাগিয়ে রেখেছিলো যেন সে চোখে। এত কিছু হয়ে গেল তার জীবনে সে একটি বিষয়ও ধরতে পারলো না? এতটা অধম সে?
তার বাবা স্বীকার করেছে যে সে রোমা বেগমের গায়ে হাত তুলেছেন, তাকে বৈশ্যা পর্যন্ত বলেছেন। আর এতে তার বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই। আর সেই বাবার অন্ধের মতো ভক্ত ছিলো সে। বাবার প্রতিটি কথাই যেন সঠিক এবং তার বিরুদ্ধে সকল কথা বেঠিক। সে বাবার পাশ নিয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করলো। এতটা নির্বোধ সে নিজেই জানতো না। নির্বোধই তো, নাহয় তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তার সাথে এমন বেঈমানী করে? তার ফিয়ান্সে এমন বেঈমানী করতে পারতো? সে অন্ধবিশ্বাস করে পারতো তার প্রভাকে এতটা কষ্ট দিতে? এতকিছু চললো তার জীবনে অথচ কিছুই টের পেল না সে? কেমন মানুষ সে?
কাঁধে কারও স্পর্শ পাওয়ায় মুখ তুলে তাকায় অর্ক৷ প্রভার হাতে খাবারের প্লেট দেখতেই সে বলে,
“প্রভা ভালো লাগছে না।”
“এমন করেন না। সন্ধ্যা থেকে কিছু খান নি।”
“তোমার মনে হয় আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে? এত…. এতকিছু হয়ে গেল আজ এক রাতে। আমার এত রাগ কেন প্রভা? দেখো না আমি রাগে তোমার সাথে অন্যায় করলাম আর আজ সৈকতের সাথে।”
অর্ক নিজের দুইগালে পরপর তিনটা থাপ্পড় মেরে বলল,
“রাগে ভাবি না কেন আমি? কেন?”
প্রভা সাথে সাথে হাতের প্লেটটা রেখে অর্কের দুইগালে হাত রেখে বলল,
“যা হয়েছে তা আমরা তো আর পাল্টাতে পারব না। তবে সব ঠিক করার চেষ্টা করতে পারব। তাই না?”
ভেজা অর্কের কন্ঠ,
“কিছু ঠিক হবে না প্রভা। আমি সব নষ্ট করে দিয়েছি।”
প্রভা হাঁটু গেড়ে বসে অর্ককে জড়িয়ে ধরলো। তার মাথাটা কাঁধে রেখে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“পৃথিবীতে সব কিছুর কারণ থাকে একটা। নিশ্চয়ই আজকের দিনেরও বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে সম্ভবত।”
“আমি আমার আপন মানুষদের নতুন চেহেরা দেখলাম আজ আর সৈকত থেকে তার পরিচয়টাই ছিনিয়ে নিলাম। কী কারণ থাকতে পারে এর পিছনে?”
“যে অন্যের প্রতি আপনার ভুল ধারণা ভেঙেছে, সবার সত্য জানতে পেরেছেন। আর কে বলল সৈকতের পরিচয় হারিয়ে গেছে? নিজের পরিচয়টাই আসল পরিচয়। বাপ দাদার পরিচয়ে নিজেকে ঢেকে দিলে তা নিজের হয় না। এই’যে যেমন আপনি নিজে নিজের পরিচয় তৈরি করলেন তেমন সৈকতও করবে। আমার বিশ্বাস, ও শুধু নিজের জন্য না ওর স্বপ্নের জন্যও এক নতুন পরিচয় তৈরি করবে৷ যা ওর সাথে সাথে হাজারো মানুষের পরিচয় হবে।”
অর্ক মাথা তুলে তাকালো। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“স্বপ্ন?”
“সৈকতের স্বপ্ন আছে যে সে অসহায় মানুষদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখাবে এবং একদিন এই সমাজ থেকে অন্যায় শেষ হয়ে যাবে।”
অর্ক গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলো আর বলল,
“অনেক বড় হয়ে গেছে আমার ভাইটা।”
প্রভা হেসে অর্কের নাক টেনে বলল,
“আর আপনি ছোট। অদিন খাবারের সময় এভাবে কাঁদে।”
অর্ক সাথে সাথে প্রভার কোমর জড়িয়ে ধরে। খুব কাছে টেনে নিয়ে এক কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“তুমি আজ আমার পাশে না থাকলে বোধহয় আমি নিশ্বাস বন্ধ করে মারাই যেতাম প্রভা।”
কথাটা শুনতেই প্রভার বুক কেঁপে উঠলো। এই কথাটা যে সে ভাবতেও পারে না।
প্রভা আর কিছু বলল না।
অর্ক অন্যহাত দিয়ে প্রভার হাতটা শক্ত করে ধরলো। যেন একটু ছাড় দিলেই পালিয়ে যাবে তার প্রভা নামক পাখিটা।
ঝুম বৃষ্টির আগমন ঘটল। ভিজিয়ে দিলো বারান্দার দুতো নর-নারীকে৷ অথচ তারা কেউ-ই নড়লো না।
.
.
এক সাপ্তাহ পর,
প্রভা তার মা’কে কল দিলো। ঝিনুককে সে বাসায় পাঠানোর চিন্তা আছে তার৷ ঝিনুক আজকাল তার রুম থেকেও বের হয় না তেমন। না ভার্সিটিতে যায়, না ঠিক মতো খায়। রাতে ওর রুমে যেয়ে উঁকি মারলো যেমন দেখে বসে আছে তেমন ফজরের নামাজেরও পরও দেখে জেগে আছে। কথা বলতে গেলে কথাও বলে না মেয়েটা। সংসারটা করতে না চেয়েও কখন যে ভালোবাসার মায়াজালে ফেঁসে গেল হয়তো নিজেই জানে না মেয়েটা।
অন্যদিকে সৈকতকে কত না বুঝালো প্রভা। কত দোহাই দিলো। তবুও সে এলো না। আর প্রভার মনের মধ্যে এই দুশ্চিন্তাও ভর করল যে সে আর আসবে না। কোনোমতেই আসবে না। কিন্তু অর্ককে এই কথা বলা যাবে না, নাহয় আরও অপরাধবোধ হবে তার। ভেতর দিয়ে আরও ভেঙে পরবে। এতকিছুর মধ্যে প্রভা অর্ককে জিজ্ঞেসও করে নি রাহানের কথাটা। বিনয় তার সাথে এইজন্য বিয়ে করেছে কারণ অর্ক ভালোবাসতো তাকে? কীভাবে? প্রশ্নটা সরাসরি না করতে পারায় বুকের ভেতর খুঁতখুঁত লেগেই আছে।
মা কল ধরতে সময় নিলো। কিন্তু কল ধরার সাথে সাথেই বলল,
“তোকেই কল দিতাম প্রভা।”
“কী হয়েছে মা?”
“আগে তুই বল। তুই কেন কল দিলি?”
“মা, ঝিনুককে ক’দিনের জন্য তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেই? কেমন যেন হয়ে গেছে, না কথা বলে থেকে মতো আর না……”
মা প্রভাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমিও এইজন্য কল দিয়েছিলাম। সৈকত আমাদের কল দিয়ে সব জানাল। আর ডিভোর্সের কথাও বলল।”
“ডিভোর্স!” আঁতকে উঠা কন্ঠে বলল প্রভা।
“হ্যাঁ ডিভোর্স। পরিশ তো আমায় বলেছিলো যে সৈকতের চরিত্র ভালো না। এখন দেখি ওর মা’য়েরও চরিত্রে দাগ আছে। গাছে বিষ ভরা তার ফল কী অমৃত হবে?”
“মা প্লিজ এ-সব বলো না। আমরা এখনো সম্পূর্ণ কাহিনী জানি না।”
“সে যাই হোক। ব্যাপারটা খারাপ হয় নি। সৈকতের তালাকের পর-ই আমি ঝিনুক ও পরিশের বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
এইবার বিস্ময়ের শেষ সীমানায় প্রভা। আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে সে বলল,
“মা তুমি কী বলছে নিজে বুঝতে পারছ? ঝিনুক আমাদের বোন।”
“আপন বোন তো না। রক্তের সম্পর্ক তো নেই পরিশের সাথে। তাহলে আর কী? দেখ প্রভা তোর আর তোর বাবার কারণে আমার দুইটা বাচ্চার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। ঝিনুকের গায়ে এখন ডিভোর্সির সিল লেগে যাবে আর পরিশ নেশায় জড়িয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। আমি মানা করেছিলাম আগেই ঝিনুকের বিয়ে না দিতে। আমার কথা শুনে কে?”
“ভাইয়া নেশায় জড়িয়েছে?”
মা’য়ের গলাটা ভিজে গেল। বলল,
“গভীর রাতে বাসায় ফিরে, সকালে উঠলেই দেখি চোখ লাল ও ফোলা। কেমন বিদঘুটে আচরণ করে বুঝাতে পারব না। ওইদিন ওর রুম পরিষ্কার করতে যেয়ে তিনটা মদের বোতল আর কয়টা প্যাকেট পেয়েছি। সাদা রঙের লবণের মতো কিছু।”
এ-সব শুনেই যেন মাথাটা ঝিম মেরে উঠে প্রভার।তার আপন সবার সাথে এই কী হচ্ছে?
সে বহু কষ্টে বলল,
“মা আমি আপাতত রাখি। আর সইতে পারছি না।”
“তুই শুনেই এই অবস্থা আর আমি নিজের চোখে নিজের ছেলেকে মরতে দেখি দিনদিন আমার কী অবস্থা হয় ভাব এবার৷ আর ঝিনুকের জন্য আগে তাও হাজারো সম্পর্ক আসতো কিন্তু তালাকের পর আর আসবে না ভালো সম্পর্ক। কে করবে ওকে বিয়ে? এর থেকে পরিশ ভালো না?”
প্রভা আর কথা শুনলো না। কলটা কেটে দিলো। তার মনে হচ্ছে তার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনে কী এক মুহূর্তের জন্যও সুখটা অনুভব করতে পারবে না সে? অর্ককে জীবনে পেয়েও সে প্রাপ্তির সুখটুকু সে পাচ্ছে না।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৪৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
সকাল ১১.১০ বাজে। অর্ক স্কুলের মাঠের এক কোণায় দাঁড়ানো। এক পকেটে হাত রেখে ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে মাঠে ছেলেদের দৌড়াদৌড়ি করতে ও খেলতে। আর স্মৃতির সাগরে উথাল-পাথাল খাচ্ছে হাজারো মুহূর্ত। এভাবে তারাও একসময় বাঁচত এই স্বাধীন দিনগুলো। যখন না কোনো চিন্তা থাকতো আর না এই স্বার্থপর পৃথিবীর পরিচয়।
টিফিন টাইম শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজল। অর্ক অপেক্ষা করছিলো এই সময়েরই। মাঠ খালি হওয়ার পর সে একটি গাছের নিচে যেয়ে বসল। যন্ত্রপাতি নিয়ে মাটি খুড়িয়ে বের করল একটি টিনের বাক্স। অনেকটা সময় লাগলো এতে তবুও ব্যর্থ হয় নি।
ছয়দিন আগে সে রাগে গিয়েছিলো বিনয়দের বাসায় তার প্রশ্নগুলোর উত্তর নিতে। সেদিন ঘরে ফাতেমা ছাড়া কেউ ছিলো না। তার উপরই রাগই বর্ষণ হয় অর্কের। সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোদের আমি এতটা আপন মনে করলাম আর তোরা আমার জীবনটা নিয়ে এভাবে খেললি? আর তোর মা? উনাকে তো আমি কত আপন মনে করেছি আর উনি কী করল? আমি জানতাম উনি আমার সুবিধা নিয়ে উনার কাজগুলো করাচ্ছে। তবুও আমি কখনো কিছু বলি নি কিন্তু উনি আমাকে প্রভার ব্যাপারে মিথ্যা বলে যে প্রভার জীবন নষ্ট করাতে চাইলো তা আমি কোনোমতে সহ্য করতে পারব না।”
ফাতেমা এতক্ষণ ধরে অর্ককে চুপ করাতে চাইছে। কিন্তু অর্কের চুপ করার নাম নেই। অর্কের যখন কথা শেষ হলো তখন সে অর্ককে বলল,
“ভাইয়া দয়া করে বাহিরে আসো, তোমাকে আমি সব বলছি।”
বাহিরে আসার পর ফাতেমা দরজা লাগিয়ে বলল,
“ভাইয়া ভেতরে ঘুমাচ্ছে। মা নেই বলে ভাইয়াকে রেখে গেছে বাসায়। অর্ক ভাইয়া বিশ্বাস করো, আমি কত চেয়েছি তোমাকে বলতে যে প্রভা ভাবি কোনো দোষ নেই কিন্তু কখনোই সুযোগ পাই নি। মা আমার থেকে ফোন নিয়ে গেছে, আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেয় না আর টেলিফোনের লাইনও কেটে দিয়েছে। মা সবসময় চোখে চোখে রাখে আমায়। গতকাল উনার মামা মারা গেছে তাই গ্রামে গেছে।”
কপাল কুঁচকে গেল অর্কের। সে বলল,
“তুই ভার্সিটিতে যাস। সেখান থেকেও তো যোগাযোগ করতে পারতি।”
“আমি ভার্সিটিতে যাই না ভাইয়া। ভর্তি হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু মা পড়াশোনা বন্ধ করিয়ে দিয়েছে।”
অর্ক বিস্মিত সুরে বলল,
“আমি তো কয়দিন আগেও বেতন….. ”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ফাতেমা থামিয়ে দিলো। অর্ককে সে বলল,
“মা কখনো ভার্সিটিতে টাকা দেয় নি। তুমি আমাকে নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে এনেছিলেন এই যে ঘরে বসে মা আপনাকে যে গালাগালি করেছে যে সে টাকাগুলো হাতিয়ে নিতে পারে নি। আমি কয়েকবার তোমার সাথে ও প্রভা ভাবির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি মা’য়ের ফোন দিয়ে৷ মা যখনই দেখেছে অনেক মেরেছে আমাকে। একবার যখন তোমাকে কল দিয়ে পেলাম না তারপর ভাবিকে কল দিলাম কথা বলার মাঝে মা ফোন নিয়ে ভাবিকে কী বিশ্রী গালি-গালাজ করলো তা বলতেও ঘৃণা লাগে। এরপর আমাকে মারলো সে হিসাব আলাদা। তাতে আফসোস নেই। আফসোস এইটা যে বিনয় ভাইয়ার বলা শেষ কথাটা তোমার কাছে পৌঁছাতে পারলাম না আমি।”
“শেষ কথা? কী সে শেষ কথা?”
“ভাইয়া আমাকে কল দিয়ে বলেছিলো যে তার কিছু হলে আপনাকে বলতে আপনার জন্য কিছু রেখে গিয়েছে সে।”
“কোথায়?”
ফাতেমা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“তা বলে নি। শুধু বলেছে তুমি ভাবলেই পেয়ে যাবে।”
অর্ককে চিন্তিত দেখালো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সে ফাতেমার মাথায় হাত রেখে বলল,
“তুই চিন্তা করিস না, তোকে সামনে আমি পড়াবো। আজকের কথা তোর পরিবারে কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ক’দিনের মধ্যে সব সত্যি বের করে আমি তোকে সাথে নিয়ে যাব। আমাদের বাসায় আমার বোনের মতো থেকে পড়াশোনা করবি।”
বিস্ময়ে ফাতেমার চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে। পরের মুহূর্তে তার চোখে জল এসে পড়ে। সে বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“বিনয় ভাইয়া, মা আর আমার পুরো পরিবার তোমার আর প্রভা ভাবির সাথে এতকিছু করার পরও এমন বলছেন?”
“তারা করেছে তুই না। তোদের আমি নিজের ভাই বোনের মতোই ভাবতাম ছোট থেকে।”
“ভাইয়া জানো তুমি যে কারণেই বিয়ে করো না কেন ভাবিকে আমি জানতাম তুমি তাকে বেশিদিন কষ্ট দিতে পারবে না। এই বাসায় অনেক সহ্য করেছে ভাবি। তাকে খুশিতে রেখেছ তো?”
“চেষ্টা করছি।”
“ভাইয়া প্লিজ একটা অনুরোধ৷ ভাবির পড়াশোনার অনেক ইচ্ছা ছিলো যা আর কখনো হলো না। আমি জানি অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু তবুও কী ভাবির পড়াশোনার কথা একবার চিন্তা করে দেখতে পারো?”
অর্ক হেসে বলল,
“প্রায় পনেরোদিন আগেই ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এপ্লাই করেছি। একটু ঝামেলা হচ্ছে কিন্তু ওকে পড়াশোনা করাব। ওর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ থাকতে দিব না। কিছুতেই না।”
কথাটা শুনে ফাতের ঠোঁটে এক সসন্তুষ্টির হাসি এঁকে এলো।
সে টিনের বাক্স থেকে মাটি ঝেরে এক কোণায় বেঞ্চে বসলো অর্ক। এতদিন সে বুঝে এসেছিলো প্রভার কথাই বলেছিলো বিনয়। ওরে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছিলো তার জন্য। অথচ গতরাতেই বিনয়কে এক চিঠি লিখতে যেয়ে তার মনে পড়লো এই চিঠির বাক্সতেও হয়তো কিছু রাখা। পকেট থেকে একটি চাবি বের করে অর্ক তালার কাছে নিয়েই দুই হাত আপনা-আপনি অবশ হয়ে গেল৷ শরীরটা অবশ লাগছে অর্কের। নিশ্বাসটা আটকে আসছে। সবকিছু সহ্য করা যায়, আপন মানুষগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা না।
.
.
সৈকত নতুন একটা চাকরির জন্য জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়ে এলো। গত সাপ্তাহে দুইটা চাকরির আবেদন করেছিলো বিশেষ কোনো লাভ হয় নি। তাই বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছে সে। সন্ধ্যায় চা-নাস্তা করার পর আবার বাহিরে যাওয়ার কথা। পরীক্ষার জন্য ফ্রম ফিলাপ করতে হবে জলদিই। তাই একটা চাকরি ভীষণ প্রয়োজন। সৈকত ও ইকবাল তার রুমে এই বিষয়ে কথা বলছিলো তখনই সৈকতের মা রুমে প্রবেশ করল। আর বলল,
“তোমাদের বিশেষ কোনো কথা চলছে?”
ইকবাল সাথে সাথে উঠে জায়গাটা ছেড়ে বলল,
“না না আন্টি আসেন। এইখানে বসুন।”
রোমা বেগম সেখানে বসলেন। আর ইকবাল সামনে একটি মোড়া নিয়ে বসলো। রোমা বেগম তার হাত থেকে একটি স্বর্ণের চুড়ি খুলে সৈকতের হাতে রেখে বলল,
“এইটা বিক্রি করে তোর আর ইকবালের পরীক্ষার ব্যবস্থা কর।”
ইকবাল সাথে সাথে বলে উঠে,
“ছিঃ ছিঃ আন্টি কী বলেন এইসব? এই বছর পরীক্ষা দিতে না পারলে আগামী বছর চেষ্টা করব। তবুও আপনার চুড়ি বিক্রি করতে পারব না।”
সৈকত চুড়িটা মা’য়ের হাতে আবার পরিয়ে বলল,
“ইকবাল ঠিক বলেছে মা। আমরা এত বড় হওয়ার পরও নিজের মা’য়ের গয়না বিক্রি করে নিজেদের প্রয়োজন মিটাতে পারি না। এছাড়াও এইটা তোমার স্বামীর দেওয়া গয়না। আমি আর উনার কোনো দয়া চাই না।”
“এটা উনার না আমার মা’য়ের দেওয়া স্মৃতি। উনি উনার শেষ আমানত আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।”
সৈকতের মুখে একটু সংশয় দেখা গেল কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
রোমা বেগম নিজ থেকেই বললেন,
“আমি জানি তুই ভাবছিস এত বছরেও তো আমার পরিবার আমার খোঁজ নেয় নি, তোকে কখনো দেখাও করাই নি তোর নানুর বাড়ির কারও সাথে কিন্তু কেন তাই তো?”
“না মা এমন কিছু না।”
“তুই না বললেও তোর চেহেরা দেখে বুঝা যাচ্ছে। আর আমি এটাও জানি যে তোর মনে হাজারো প্রশ্ন তোর আসল বাবাকে নিয়ে। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করছিস না কারণ তুই আমাকে কষ্ট দিতে চাস না।”
সৈকত মাথাটা নামিয়ে নিলো। এইটা সত্যি যে সে জিজ্ঞেস করতে চায় তার আসল বাবা কে? কোথায় সে? তার কাছে নেই কেন? তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো কেন? আর কেনই-বা সে জানতো না তার আসল পরিচয়? কিন্তু এইসব জিজ্ঞেস করে মা’কে লজ্জিত করার কথা ভাবতেও পারে না সে।
রোমা বেগম নিজ থেকেই বলতে শুরু করলেন,
“তখন আমার বয়স ছিলো পনেরো। চট্টগ্রামে থাকতাম আমরা। আমাদের বাড়িওয়ালার এক ভাতিজা প্রায়ই বাসায় ঘুরতে আসতো। আমাদের বাসায়ও আসতো মাঝেমধ্যে, ছাদে দেখা হতো প্রায়ই। এক দেড়বছর এমন চলতে থাকে। একটি ছেলেটা বলে ও আমাকে পছন্দ করে। আমিও পছন্দ করতাম বিধায় হ্যাঁ বলে দেই। একমাস পরই হঠাৎ আমার ডাক পড়ে। আমি তখন রুমে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম। ভাই এক শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল আমি যেন দ্রুত এটা পরে ড্রইংরুমে আসি কারণ আমার বিয়ে। আমি মানা করায় আমাকে মেরে হলেও জোর করে বিয়ে পরানো হয়। দেখি আমার স্বামীর বয়স আমার দ্বিগুণ। তার দুইটা ছেলে আছে। বড় ছেলের বয়সই দশ বা এগারো বছর তখন। আর ছোট ছেলেটা একটু অসুস্থ। আমি এতটুকু বয়সে বিয়ের কথাই ভাবতে পারছিলাম না এর উপর এত বড় দায়িত্ব! এর উপর অর্ক তো আমারকে ওর মা মানতেই চাইছিলো না। আমি দিনদিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম৷ দুইবার আত্নহত্যার চেষ্টা করি। এর মাঝেই ওই ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করি। ও বলে বিয়ের সব গায়না নিয়ে যেন ওর কাছে পালিয়ে যাই। আমিও গাঁধার মতো তাই করি। যাওয়ার পর আমি ওর সাথে আবারও বিয়ে করি। চারমাস পর দেখি ওর আর খোঁজ নেই। আরও দুইমাস চলে যায় ও আর আসে না। এদিকে বাড়ির মালিক নানাভাবে দুর্ব্যবহার করে আমার সাথে। এর মধ্যে আমি ছিলাম তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়ি ওকে খুঁজতে। যেয়ে শুনি ওর বিয়ে হয়েছে একমাস আগে। ও আমাকে চিনতেই বারণ করে দিলো। বিয়ের কাগজটাও ছিলো নকল। আমার পরিবারের কাছে গেলাম কিন্তু ভাইয়া বলে দিলো কেউ আমার মতো নষ্টা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতেও রাজি না। আমি এত বড় লজ্জা নিয়ে সে বাসায় ফেরত যেতেও রাজি ছিলাম না। আমি বসে ছিলাম দরজায়। আমাকে বাসার বাহিরে ফালিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় ভাইয়া। তারপর তোর দাদী আসে বাসায়। পাশের বাড়ির এক আন্টি যে আমাদের বিয়ে ঠিক করেছিলো তোর দাদীমা’কে। উনি এসে আমাকে নিয়ে যান। অর্কের বাবা আমাকে মানতে না চাইলেও তার মা’য়ের কথা ফেলতে পারে নি। এরপর তুই এসেছিস এই পৃথিবীতে। তোকে নিয়ে বাহিরে কোনো কথা না হলেও বাসায় অনেক ঝগড়া হয়েছিলো। অর্কের খালামণিরা চাইতো যেন তোকে এতিমখানায় দিয়ে আসি। কিন্তু অর্ক পরিষ্কার মানা করে দেয় আর এটাও সবাইকে জানায় যে কেউ যেন ভুলেও উচ্চারণ না করে এইসব ঘটনা তোর সামনে। তখন অর্ক তেরো বছরের ছিলো।এতটুকু বয়সেই ছেলেটা আমার আর তোর দুইজনের জীবন বাঁচিয়েছে, নাহয় আমি কোথায় যেতাম তোকে নিয়ে? কীভাবে লালন-পালন করতাম?”
রোমা বেগম কথাগুলো বলে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। এখনও তার হাত-পা কাঁপছে অতীতের সে ভয়ানক দিনগুলোর কথা মনে করে। সে সৈকতের দিকে তাকিয়ে দেখল সে মাথা নিচু করে বসে আছে। বিশেষ পরিবর্তন নেই তার ভাব-ভঙ্গিতে। সে আবারও বলল,
“তোর বাবা যাই করুক না কেন অন্তত আমাদের একটা ঠিকানা দিয়েছে থাকার জন্য। তোকে এত ভালো জায়গায় পড়াশোনা করিয়েছে। তোর সব আবদার পূরণ করেছে।”
“আর তোমার সাথে জানোয়ারদের মতো আচরণ করেছে।”
“উনার রাগটা একটু বেশিই। রাগে কী বলে ফেলেন নিজেও জানেন না। আর ওদিন যে কথায় রাগ করলি উনি ভুল তো বলে নি।”
চকিতে সৈকত তাকাল তার মা’য়ের দিকে। রোমা বেগম আবারও বললেন,
“কোনো স্ত্রী বিয়ের পর স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে গেলে তাকে……”
“মা প্লিজ আমার সামনে এইসব বলবে না।”
“সব সম্পর্কে একজন ভুল থাকবে আর একজন সঠিক থাকবে এমন কিছুর প্রয়োজন নেই। আমাদের সম্পর্কে আমাদের দুইজনের ভুল ছিলো। উনার প্রচুর রাগ আছে আমার উপর। ঘৃণা আসে তার আমার উপর। যেমন তোরও এমন তোর মা’য়ের উপর রাগ উঠছে। জীবনে প্রথমবার রাগ উঠছে।”
সৈকত মাথা নিচু করেই বলল,
“এমন কিছু না মা। মা তুমি তাকে কখনো ভালোবাসতে পেড়েছ?”
“সব জায়গায় ভালোবাসা থাকার প্রয়োজন পড়ে না। একবার ধাক্কা খেয়ে দ্বিতীয়বার এই ভুলটা করার সাহস ছিলো না। এইবার তুই নিজেকে দায়ী করতে থাকবি যে তোর জন্য আমি এতটা বছর তার সাথে সংসার করেছি আর নিজেকে অপরাধী ভাববি। তবে বলে দেই এমন কিছু নয়, স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোনো ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক। কিন্তু একসময় সংসার করতে করতে একসময় মায়ায় জড়িয়ে যায় দুটো মানুষ। উনার সাথেও আমি মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। এখনও প্রতি মুহূর্তে চিন্তা করি কী করছে উনি? ঠিকাছে তো? ঠিক ভাবে খাচ্ছে? ঠিক ভাবে ঔষধ নিচ্ছে?”
সৈকত এই বিষয়ের মাঝেই রোমা বেগমকে বলে দিলো,
“মা আমি ঝিনুককে তালাক দিচ্ছি।”
বলেই তাকাল মা’য়ের দিকে। ভেবেছিল মা বকতে শুরু করবে অথচ সে হাসছে। সে মৃদু হেসে বলল,
“এই’যে একটু আগে বললাম সংসারে ভালোবাসা না থাকলেও সংসার করা যায়। অথচ তুই ওকে এত বছর ধরে ভালোবাসিস কিন্তু সংসার করতে চাচ্ছিস না। কী আজব মন মানুষের! পৃথিবীতে কতজন ভালোবাসা না পেয়ে ভিতরে পুড়ে আর কতজন ভালোবাসা পেয়েও তার এত অবহেলা করে। তোর কী মনে হয় বাবা তুই একবার ঝিনুককে হারালে আবার পাবি?”
সৈকত হতদম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার মা’য়ের দিকে। বলল,
“মা তুমি কীভাবে জানো যে আমি ঝিনুককে আগের থেকেই ভালোবাসি?”
তাচ্ছিল্য হাসলো মা। বলল,
“তোর কী মনে হয় তোর ঝিনুকের সাথে বিয়েটা এমনিতেই হয়ে গেছে? হঠাৎ বিয়ের দিন ছেলেপক্ষ বিয়ে ক্যান্সেল করেছে আর আমরা তোকে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি? এইসব অর্ক করেছে।”
সৈকত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো তার মা’য়ের দিকে। শেষের কথাটা সে মোটেও আশা করে নি।
চলবে……
[