মন পাড়ায় পর্ব ৫৫

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৫৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“কেন তুই ওকে ভালোবাসবি? আমি তোকে ভালোবাসি তা তোর চোখে পড়ে না? ছোট থেকে তোর সব যত্ন আমি করছি তুই ওকে কেন ভালোবাসবি? ওকে কেন বিয়ে করবি? অনেক সহ্য করেছি আর না। তুমি আমার হবি। শুধুই আমার। আমি আগামীকালই তোকে বিয়ে করবো।”
ঝিনুকের দম আটকে আসছিলো যেন। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে শুরু করল। সে তবুও বহু কষ্টে বলল,
“ভাইয়া তুমি পাগল হয়ে গেছ। আমি বোন হই তোমার।”
পরিশ ঝিনুকের গলা টিপে ধরেই তাকে ঘুরিয়ে ধাক্কা দিলো। ঝিনুক যেয়ে পড়লো মেঝেতে। পরিশ দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলল,
“কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হয় না?”
ঝিনুক পরিশকে শার্টের বোতাম খুলতে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মেঝেতে বসেই পিছাতে পিছাতে বলল,
“ভা…ভাইয়া আমরা আগামী…কাল কথা বলব। প্লিজ এখন আমাকে যেতে দেও। তুমি নেশায় আছ।”
পরিশ ঝিনুকের বাহু ধরে এক টানে তাকে উঠিয়ে বিছানার দিকে ধাক্কা দিলো আবারও।
ঝিনুক আবারও কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া দোহাই লাগে আমার কোনো ক্ষতি করো না প্লিজ। প্লিজ দূরে থাক। তোমার থেকে ভয় লাগছে আমার।”
পরিশ বিছানায় বসে আবার ঝিনুকের দুইগালে হাত রেখে বলল,
“তুই বুঝতে পারছিস না কেন সোনা? আমি তোকে কত ভালোবাসি, তুই বুঝিস না কেন? আমি তোর কোনো ক্ষতি করতে পারি বল? যদি তোর শরীর আমার লাগতো তাহলে তো আমি আগেই তোকে পেতে পারতাম। আমার তোকে লাগবে। আর তুই আমার থেকে ভয় পাচ্ছিস? তোর মানে আছে তোর যখন ছোট বেলায় ভয় লাগতো তুই আমার কাছে এসে পরতি। তোর কেন আমার থেকে ভয় লাগছে সোনা? তুই ভুলে গেছিস আমরা কত সুন্দর সময় কাটাতাম? এখনও কাটাবো। আমরা বিয়ে করে দূরে চলে যাব। বহু দূরে। সবার থেকে অনেক দূরে। তুই আমাকে বিয়ে করবি তো?”
ঝিনুক শুধু কাঁদছিলো ও কাঁপছিল ভয়ে। সে পারলো না উওর দিতে।
পরিশ ধমকের সুরে বলল,
“চুপ আছিস কেন বল। বলতে বলছি না? বল।”
ঝিনুক উঁচু স্বরে তার খালু ও খালাকে ডাকতে শুরু করে দিলো। পরিশ তার গাল চেপে ধরলো শক্ত করে। বলল,
“তাদের খাবারেও আমি ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি। যেমনটা তুই বাসে উঠার পর যে কোল্ড ড্রিংকস এ মিশিয়েছি সেভাবে। আর প্রভাকে ফোন দিয়ে বলেছি যে তুই এখানে আসছিস আমার সাথে। কাল মা বাবার ঘুম থেকে উঠার আগে তোকে নিয়ে আমি চলে যাব তারপর বিয়ে করে নিব আমরা। ঠিকাছে না? আমি তোকে অনেক খুশি রাখব। তোর মনে নেই আমি তোকে আগে কত সুখে রাখতাম। ওই সৈকত তোকে কষ্ট ছাড়া কী দিয়েছে?”
“কষ্ট তুমি দিয়েছ ভাইয়া। তুমি জানতে আমি সৈকতকে কত ভালোবাসি। সৈকত আমার সুখ ছিলো, আর তুমি আমার জীবনের সব সুখ ছিনিয়ে নিলে। শুধুমাত্র তোমার পাগলামোর জন্য।”
“তুই আমার ভালোবাসাকে পাগলামি বলছিস? হোক পাগলামি, তাও আমি তোকে বিয়ে করব।”
“আমি বিবাহিত ভাইয়া। ভুলে যেও না।”
দরজায় টোকা পরলো। বাহির থেকে ঝিনুকের খালুর কন্ঠ,
“পরিশ…..পরিশ তোর সাথে কে রে?”
পরিশকে ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাল। পরের মুহূর্তে তার মা’য়ের কন্ঠও ভেসে এলো।

ঝিনুক উঁচু স্বরে বলল,
“খালু….খালামণি দেখ না ভাইয়া কী পাগলামি শুরু করেছে। প্লিজ কিছু করো……”
পরিশ ঝিনুককে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো। তারপর অন্যহাত দিয়ে নিজের বিছানার তোশকের নিচ থেকে একটি ব্লেড বের করল। সে বলল,
“শুন সোনা কেউ আমাদের একসাথে বাঁচতে দিবে না। বিশেষ করে ওই সৈকত। একটা কাজ করি প্রথমে তোর হাতের রগ কেটে দেই তারপর আমারটা কাটব। আমরা দুইজন বিয়ে না করতে পারলে কী হয়েছে? মরে যাব একসাথে। চিন্তা করিস না বেশি কষ্ট লাগবে না। একসময় ভালো লাগবে। এই দেখ আমার হাতে কতগুলো দাগ।”
ঝিনুক ভয়ে আরও কাঁপতে শুরু করল। পরিশের হাতে দাগগুলো দেখে তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। এসব কী হলো তার ভাইয়ের সাথে? যে মানুষটা ছোট থেকে তাকে সব খারাপ জিনিস থেকে দূর রেখেছে, তাকে ভালো খারাপে পার্থক্য বুঝিছিয়েছে, নিজেকে কষ্ট দেওয়া কত খারাপ তা বুঝিয়েছে আজ তার সাথে কী হয়ে গেল এসব?
ভাবতে ভাবতেই হাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করল ঝিনুক। চোখের জলের কারণে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব। নিজের হাতের আঘাতটাও দেখতে পারছে না। কিন্তু শুনতে পেল দরজা খোলার শব্দ।

খালু ও খালামণি চাবি দিয়ে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো। তাদের দেখে পরিশ ছেড়ে দেয় ঝিনুককে। ঝিনুক তার রক্তমাখা হাত একপলক দেখে উঠে দৌড়ে গেল তার খালামণির কাছে। তার খালামণি তাকে জড়িয়ে ধরে পরিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই পাগল হয়ে গেছিস? কী করছিলি এইসব?”
পরিশ উঁচু স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। তোমরা আমাকে পাগল করে দিয়েছ। আমি কি চেয়েছিলাম সারাজীবনে ঝিনুককে ছাড়া? কিন্তু তোমরা আমাকে তাও দিলে না। আজ আমার আর ঝিনুকের এই অবস্থা শুধু তোমাদের কারণে।”
ঝিনুকের খালামণি কান্না করে দেয় তার ছেলের এই অবস্থা দেখে। কিন্তু তার খালুর মাথা গরম হয়ে যায় কথাগুলো শুনতেই। সে রুমের আশেপাশে তাকিয়ে টেবিলের নিচ থেকে একটা ব্যাট বের করে এবং সে ব্যাট দিয়ে মারতে শুরু করে পরিশকে। আর উঁচু স্বরে বলে,
“ঝিনুক তোর ছোট বোন প্রভার থেকেও কত ছোট আর তুই ওকে বিয়ে করবি? আমরা ওকে নিজের মেয়ের মতো বড় করছি। তোর লজ্জা লাগে না ওর সাথে বিয়ের কথা ভাবতেও? ওর বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তোর পাগলামি কমে নি?”
ঝিনুকের খালামণি ঝিনুককে ছেড়ে যেয়ে তার খালুকে আটকায়। খালু তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“সব তোমার দোষ। আমি সবসময় বলতাম ছেলেকে এত ভালোবাসা দেখিও না। যা চায় সব আগে দিয়ে হাজির করতে হয় না। এতে অভ্যাস হয়ে যায়। আজ এই ছেলের অবস্থা দেখেছ? আমি সারাজীবন ওদের থেকে দূরে থেকে পরিশ্রম করেছি যেন ওদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়। এই উজ্জ্বল ভবিষ্যত! সিগারেট, মদ, গাঁজা খেয়ে এক মেয়ের সাথে…..ছিঃ!”
বলতে বলতেই কেঁদে দিলেন খালু। দাঁড়াতে পারলেন না আর ঠিক মতো। তার হাত থেকে ব্যাট পড়ে গেল। সে পিছিয়ে যেয়ে টেবিলটা ধরলেন।
ঝিনুক দৌড়ে এসে তার খালুকে ধরলো।

তার খালু আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“আমি সৈকতের সাথে ঝিনুকের বিয়ে দিয়েছি। ঝিনুকের আগের বিয়ে আমি ও অর্কই ভাঙিয়েছিলাম। আমার সম্মান দায়ে লাগিয়েও। জানিস কেন? কারণ ওর মতো ছেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোটিতে একটা ও। একদিন শুধু ওর সাথে প্রভার বাসায় গিয়েছিলাম। জায়গায় জায়গায় এমন মানুষ আছে যারা ওর সম্মান করে। ওর থেকে দ্বিগুণ বয়সের লোকরাও, কারণ ও সে সম্মান কামিয়েছে। সৈকত সবাইকে ভালোবাসতে ও সম্মান করতে জানে আর তুই তো নিজের বোনের ডিভোর্স হওয়ার পর তাকেও বোঝা ভাবতি। তোর থেকে হাজারো বেশি তো প্রভার জন্য সৈকত করেছে। আরে তুই তো ওর জুতোর ধুলোর সমানও না।”
এরপর পরিশ এমন কিছু করল যা কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি। উঠে নিজের বাবার কলার ধরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“খবরদার ওই জানোয়ারের কথা আমার সামনে বলবেন না। আপনি কে আমার সাথে ওর তুলনা করার? আরেকবার আমার সাথে ওর তুলনা করলে আমি ভুলে যাব যে আপনি আমার কিছু হন।”
কতক্ষণ কেউ কিছু না বলতে পারলো আর না করতে পারলো। সবাই চমকে শুধু তাকিয়ে রইলো পরিশের দিকে। অবশেষে সে নিজেই ছাড়লো তার বাবাকে।

ঝিনুকের খালু কিছু না বলে বিস্মিত চেহেরায় রুম থেকে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ ঘামাতে শুধু করলেন, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো, তার হৃদয়পিণ্ডটায় ভীষণ ব্যাথা শুরু হলো, কেউ যেন চেপে ধরে রেখেছিলো তার হৃদপিণ্ডটা। সে ব্যাথা তার ঘাড় ও বাহু পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।

বাহির থেকে শব্দ আসায় ঝিনুক ও তার খালামণি দৌড়ে যায়৷ যেয়েই দেখে ঝিনুকের খালু মেঝেতে পড়ে আছে। সে তার বাম বাহু চেপে ধরে রেখেছে।
.
.
ঘুম আসছিলো না অর্কের। তার বারবার কয়েকঘন্টা আগের কথা মনে পড়ছিলো। বিনু তাকে বলছিল সে তাদের জীবন থেকে যেন চলে যায়। তার পরিবারের মাঝে যেন না আসে। কারণ সে তার বাবা না, কখনো হতে পারবে না। অবশেষে ফাতেমা জানাল, বিনয়ের মা স্কুলে যেয়ে না’কি বিনুর সাথে প্রায়ই কথা বলে। সম্ভবত তিনিই বিনুকে উল্টাপাল্টা বুঝায়। বিনু তো বাচ্চা, তাই কথাগুলো বিশ্বাসও করে নেয়।

তার অস্বস্তি লাগছিলো ভীষণ। এতমাস এতকিছু করার পরও সে বিনুর জীবনে বাবার জায়গাটা নিতে পারলো না! সে কী পারবে আসলে বিনু আর অদিনের বাবার জায়গা নিতে?

ভালো লাগছিলো না তার কিছুই তাই ঘুমন্ত প্রভার দিকে তাকিয়ে রইলো মৃদু আলোয়। অনেকটা শান্তি লাগছিলো তার। সে প্রভার কোমরে হাত রেখে নিজের কাছে একটা টেনে নিলো। এমনটা করায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো প্রভার। সে নড়ে-চড়ে ঘুমঘুম চোখে তাকাল একবার অর্কের দিকে। আবার অর্কের বুকে মুখ গুঁজে বলল,
“ঘুমান নি এখনো?”
“সরি তোমাকে জাগিয়ে দিলাম।”
“উঁহু, সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি ঘুমান নি কেন? কী ভাবছেন?”
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভাবছি এতমাস হয়ে গেল। এত চেষ্টা করলাম অথচ বিনুর জীবনে বাবার কমতি পূরণ করতে পারলাম না। কখনো ওর বাবা হতে পারলাম না।”
“আপনি তো শুধু কয়েকমাস ধরে চেষ্টা করছেন। চিন্তা করুন মা তো এতবছর ধরে চেষ্টা করেও আপনার মুখ থেকে একটিবার মা ডাক শুনতে পেল না।”
কথাটা শুনতেই অর্ক চমকে উঠে। কিন্তু কিছু বলে না। কিছু সময় পর ফোন বেজে উঠে। প্রভা আবারও তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তার ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটলো।

অর্ক উঠে প্রভার ফোন হাতে নিয়ে দেখে ঝিনুকের ফোন। এত রাতে ঝিনুকের ফোন দেখে সে অবাক না হয়ে পারে না। সাথে সাথে ফোন ধরে কানে নিতেই ঝিনুক বলে উঠে,
“আপু তোমরা জলদি আসো।”
অর্ক ঝিনুকের কান্নামাখা কন্ঠ শুনে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে ঝিনুক?”
“দুলাভাই….দুলাভাই খালুকে আমরা হাস্পাতালে নিয়ে যাচ্ছি। খালু হার্ট অ্যাটাক করেছে।”
কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইল অর্ক। তারপর বলল,
“আমরা এক্ষুণি বের হচ্ছি।”
অর্ক প্রভাকে সাথে সাথে কিছু বলল না। প্রথমে সৈকতকে ফোন দিয়ে আসতে বলল। তারপর প্রভাকে বলল খারাপ কিছু হয়েছে তাই যেতে হবে। রাস্তায় সৈকতকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রভাকে সবটা জানায়। তার বাবার এই অবস্থা শুনে প্রভা সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

হাস্পাতালে যেতেও সময় লাগে ভীষণ। ভোর হয়ে আসে। প্রভা প্রথমে যেয়ে তার মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে ঝিনুকের কাছে যেয়ে বসলো। তার মুখটা সম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে। সে যেয়ে ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। তখনই তার চোখ গেল ঝিনুকের ওড়নায়৷ লাল হয়ে আছে তার ওড়নার একপাশ।
প্রভা আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তোর ওড়নায় রক্ত কেন?”
অর্ক ও সৈকত কথা বলছিলো প্রভাদের বাসার প্রতিবেশীদের সাথে। তারাই এনেছিল প্রভার বাবাকে হাস্পাতালে। প্রভার আতঙ্কভরা কন্ঠে এমন কথা শুনে দ্রুত গেল সেদিকে।
ঝিনুক সৈকতকে দেখে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সৈকতও তাকিয়ে ছিলো ঝিনুকের দিকে। দুই চোখ জোড়া ডুবে ছিলো একে অপরের মধ্যে। শব্দবিহীন কথোপকথন ছিলো কী? কে জানে?

ঝিনুকের চোখে ছিলো হাজারো প্রশ্ন। সৈকত কী তার প্রতি অবিশ্বাস ও তাকে দেওয়া আঘাতের জন্য কখনো ক্ষমা করবে?
আর সৈকতের হৃদয়ে একটিই প্রশ্ন, তার অনিশ্চিত জীবনে কী ঝিনুককে সে আরেকবার আনতে পারবে?

এক সময় এমন আসবে যে একে অপরের সাথে কথা বলতেও হাজারো দ্বিধা ঘিরে বসবে দুইজনকে, তা কে জানতো?

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here