মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -০৭

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৭
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
প্রত্যাশা কিছু বলল না। চুপ করে রইল। পৃথুলা বলল,
“কী হলো? ফোনটা দে?”
প্রত্যাশা পৃথুলার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“তুই খুব বোকা রে আপি। তুই কি করে ভাবলি তুই ধর্ষিতা জেনেও তোর বয়ফ্রেন্ড তোকে গ্রহণ করবে? সে এসে তোর খোঁজ করবে? তুই ধর্ষিতা আপি। আর একজন ধর্ষিতা মেয়ের সাথে কেউ জেনেশুনে সম্পর্ক রাখবে না।”
পৃথুলা কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
“না না তুই ভুল ভাবছিস। বিভোর এমন ছেলেই না। বিভোর আমাকে অনেক ভালবাসে। ও কখনোই আমাকে ছাড়তে পারেনা। ও হয়তো জানেই না এসব।”
স্বগতোক্তি করে বলল পৃথুলা। প্রত্যাশা বলল,
“জানে।”
পৃথুলা চোখ তুলে তাকাল প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা বলল,
“তোকে হাসপাতালে ভর্তি করেই আমি পাগলের মত বিভোর ভাইয়াকে ফোন করেছিলাম। উনি প্রথমে ফোন রিসিভ করলেন না। অনেকবার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ করলেন।

“হ্যালো ভাইয়া..”
“বলো প্রত্যাশা।”
“ভাইয়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপ.. আপি রেপড হয়েছে।”
“জানি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“আপনি জানেন? অথচ এখনো আপিকে দেখতে এলেন না! আপির অবস্থা খুব একটা ভালো না। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন ভাইয়া।”
“আমি এসেই কি করব? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমি এসেই কোনো ঘটনা পাল্টাতে পারব?”
“ভাইয়া, আপনি এসব কি বলছেন? আপির এখন আপনাকে দরকার।”
“দেখ প্রত্যাশা, পৃথুলার সাথে যা হয়েছে সেটা ওর দূর্ভাগ্য। কিন্তু তার দায়ভার আমি কেন নেব? তোমার বোনের সাথে রিলেশন কন্টিনিউ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না৷ প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দিলেন।”

এইটুকু বলে প্রত্যাশা তাকালো বোনের দিকে। পৃথুলার চোখে অবিশ্বাসের ছায়া। সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না বিভোর এমন করতে পারে। বিভোর তাকে ভালবাসে, অনেক ভালবাসে। বিভোর তার পৃথুলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেনা, কখনো পারেনা।
“বিভোর কে ফোন দে।”
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বলল,
“তার মানে তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না, তাইতো?”
“বিভোরকে ফোন দে। আমি ওর সাথে কথা বলব।”
প্রত্যাশা আর কিছু বলল না। বিভোরের নাম্বারে ডায়াল করলো। পৃথুলা ছোঁ মেরে প্রত্যাশার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। কয়েকবার রিং বাজার পর বিভোর ফোন তুলল।
“বলো প্রত্যাশা।”
“বিভোর…বিভোর আমি পৃথুলা।”
ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না।
“বিভোর শুনতে পাচ্ছ?”
বিভোর বড় করে একটা দম নিল৷ তারপর একটানে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো পৃথুলা। তোমার রেপ হওয়ার ঘটনা আব্বু শুনেছে। তিনি কোনোদিনও মানবেন না এ সম্পর্কটা।”
“কিন্তু এতে আমার দোষটা কী বিভোর?”
“তোমার দোষ নেই। কিন্তু আব্বু তোমাকে কখনোই মেনে নেবে না।”
“আর তুমি? তুমি তো বলেছিলে, তোমার বাবা আমাকে মেনে নিক বা না নিক তুমি আমাকে ভালবাস, আমাকেই বিয়ে করবে। তাহলে এখন এ কখা বলছো কেন?”
“বোঝার চেষ্টা করো পৃথুলা। তখন ব্যাপারটা এক রকম ছিল। আর এখন পুরো উল্টো।”
“কেন? আমি ধর্ষিতা বলে? আসলে তোমার প্রবলেম টা তোমার বাবাকে নিয়ে নয়, প্রবলেম আমাকে নিয়ে। আমি ধর্ষিতা বলে তোমার আমাকে মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছে। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলো তো বিভোর, এই যে সবসময় এত ভালবাসি ভালবাসি বলতে, আদৌ কখনো ভালো বেসেছিলে আমায়?”

বিভোর চুপ করে রইল। বাবা আর রাফসানের বলা কথাগুলো খুব ভাবাচ্ছিল বিভোরকে। অনেক ভেবে শেষমেশ পৃথুলাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল বিভোর। প্রত্যাশাকে কাট কাট গলায় জানিয়েছিল তার সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন পৃথুলার কণ্ঠটা কেমন যেন দুর্বল করে দিচ্ছে বিভোরকে। তার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। বিভোরের সাড়া না পেয়ে পৃথুলা বলল,
“কী হলো? চুপ কেন? বলো?”
বিভোর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জানি না৷ আমি তোমাকে ভালবাসি কীনা জানি না। কিন্তু এটা জানি, তুমি আমার অহংকারের কারণ ছিলে। সব ছেলেরা তোমার জন্য পাগল। আর সবার মধ্যে থেকে তুমি কেবল আমাকেই ভালবাসো। তোমার ভালবাসা একমাত্র আমি পেয়েছি। এটা ভেবে নিজেই নিজেকে নিয়ে গর্ব করতাম। তবে মিথ্যে বলব না পৃথা, তোমার প্রতি আমি সবসময় অদৃশ্য একটা টান অনুভব করি। আজও করছি। অবশ্য এটাকে ভালবাসা না বলে মোহও বলতে পারো৷ তবে ভালবাসা হোক কিংবা মোহ, তোমাকে আমি আমার জীবনে চেয়েছি, খুব করে চেয়েছি। কিন্তু তোমার সাথে যা হয়েছে, এরপর….”
বিভোরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পৃথুলা বলল,
“এরপর আর চাও না, তাইতো? কারণ, আমি ধর্ষিতা। সত্যিটা আমি বুঝে গেছি বিভোর। হয়তো বুঝতে খানিকটা দেরি করে ফেলেছি। তবে তুমি চিন্তা করো না বিভোর। এই ধর্ষিতা মেয়েটার ছায়াও কখনো তোমার জীবনে পড়বে না।”

কেন যেন হঠাৎ বিভোরের বুকটা ধ্বক করে উঠল। এক হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বলল,
“আমাকে একটু সময় দাও পৃথা। আমি এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে পারছি না। কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার।”
প্রত্তুত্যরে পৃথুলা কেবল বলল,
“ভালো থেক বিভোর। আল্লাহ যেন কোনোদিন আমাদের দেখা না করায়।”
ফোন কেটে দিয়ে অঝোড়ে কাঁদতে থাকে পৃথুলা। প্রত্যাশা মুখে ওড়না চেপে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।

দিন তিনেক পর হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় নিয়ে আসা হয় পৃথুলাকে। ঘটনাটা ধর্ষণ পর্যন্ত থেমে থাকলেই পারত। কিন্তু থামেনি। রাস্তাঘাটে লোকজন পৃথুলার পরিবারের কাউকে দেখলে এমনভাবে তাকায় যেন জোকার দেখছে। এলাকার মানুষের টিটকিরি, কটু কথা হজম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পৃথুলাকে বাসায় আনার পর এলাকার লোকজন তাকে দেখতে আসে৷ কেউ কেউ মেয়েটার জন্য আফসোস করে, কেউ আবার দুটো বাজে কথা শুনিয়ে দিয়ে যায়। কেউবা ধর্ষনের জন্য পরোক্ষভাবে পৃথুলাকেই দায়ী করে।
.
ছাদের রেলিং এ হাত রেখে অদূরে তাকিয়ে আছে বিভোর। তার মনের মধ্যে চিন্তাগুলো জটলা পাকাচ্ছে। দোটানার মধ্যে পড়ে আছে সে। বিভোর এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তার ভেতরটা দুটো সত্তায় ভাগ হয়ে গেছে। একজন বলছে, যা হয়েছে তাতে পৃথুলার কোনো দোষ নেই। কাজেই পৃথুলার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার মানেই হয় না। সাথে সাথে অন্য সত্তা বলে উঠছে, অসম্ভব। একটা ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করলে তার ইজ্জত কোথায় থাকবে! তার সব ফ্রেন্ডদের গার্লফ্রেন্ডের চাইতে তার গার্লফ্রেণ্ড অনেক বেশি সুন্দরী। এ কারণে বন্ধুমহলে আলাদা একটা দাপট ছিল তার। প্রেমিকার দিক দিয়ে বিচার করলে সবচেয়ে উঁচু অবস্থান ছিল বিভোরের। কিন্তু পৃথুলা রেপ হবার পর ওর সাথে সম্পর্ক রাখলে, ওকে বিয়ে করলে বন্ধুদের কাছে ও ছোট হবে। বন্ধুরা হয়তো মজাও উড়াবে ব্যাপারটা নিয়ে। তাছাড়া, সমাজে তার, তার বাবার আলাদা একটা সম্মান আছে। পৃথুলাকে বিয়ে করলে সেই সম্মানটা থাকবে না। লোকে তাকে বলবে ধর্ষিতার হাজব্যান্ড।

উফ! কান গরম হয়ে আসছে বিভোরের। এমনিতেই এই দুইদিন একেকজন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘কিরে, পৃথুলা রেপ হয়েছে নাকি?’ আরেকজন বলছে, ‘কি শুনলাম! তোর গার্লফ্রেন্ড সত্যি রেপ হয়েছে? কিভাবে হলো?’
এসব শুনে শুনে কান গরম হয়ে গেছে বিভোরের। পৃথুলার সাথে সম্পর্ক রাখলে এ নিয়ে অনেক কথা শুনতে হবে। তাহলে? কি করবে ভেবেই কূল পাচ্ছে না বিভোর।

“বিভোর…”
আসাদ হকের ডাকে ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলো বিভোর। তাকাল বাবার দিকে। আসাদ হক ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন। দাঁড়ালেন ছেলের পাশে। কয়েক সেকেণ্ড বিভোরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমাকে এভাবে দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না বিভোর। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতন করো না, ভালোমতন দুটো কথাও বলো না। তেমন একটা বাহিরেও বের হচ্ছো না। সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাক। এরকম অস্বাভাবিক আচরণ তোমাকে মানায় না বিভোর। তুমি যদি চাও তাহলে আমি নিজের সম্মানের কথা না ভেবে ওই মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দেব। কারণ, আমার কাছে তোমার ভালো থাকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবু এমন মনমরা হয়ে থেক না। নিজেকে স্বাভাবিক করো।”
বিভোর বাবার দিকে তাকাল। বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না কি করব! আমি ব্যাপারটা নিয়ে পুরোপুরি কনফিউজড আব্বু।”
“পৃথুলা মেয়েটাকে প্রথমেই আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু তোমার জেদের কাছে হার মেনে আমি মেনে নিয়েছি ওকে। কিন্তু পরে যেটা ঘটল…! জীবনে অনেক মেয়েই আসবে যাবে বিভোর। তুমি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তোমার জন্য মেয়ের অভাব একদমই হবে না। তাহলে রেপড একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিজের প্রেস্টিজ খোয়াবে কোন দুঃখে? আই থিংক তুমি অতোটা বোকা নও।”
“কিন্তু আমিতো পৃথুলাকে ভুলতে পারছি না আব্বু। বারবার ওর স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।”
“পড়বেই তো। সারাক্ষণ চুপচাপ একা একা বসে থাক। আমি চাই কাল থেকে তুমি অফিসে জয়েন করবে। আমার সাথে ব্যবসার হাল ধরবে। কাজের মধ্যে থাকলে ওই মেয়েটার কথা মনে পড়বে না। যা হয়েছে ভুলে যাও। ধরে নাও পৃৃথুলা নামে তুমি কাউকে চিনোই না।”
বিভোর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আই উইল ট্রাই।”
.
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here