মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -১২

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব -১২
.
পৃথুলা চোখ তুলে অভ্রর মুখের দিকে তাকাল। এই প্রথমবার পৃথুলা চাইলো অভ্রর মুখপানে। লম্বা, উজ্জল শ্যামলা, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী সুপুরুষ অভ্র৷ প্রশ্বস্ত ললাট, বাঁশির মত সুচালো নাক, ঘন ভ্রু যুগল, ঘন আঁখিপল্লবের নিচে টানা দুটো চোখ, পুরু ঠোঁটের অধিকারী অভ্রকে অনায়াসে সুদর্শনের দলে ফেলা যায়। কালো রঙের প্যান্ট, কালো শার্ট, তার উপরে কালো কোট পরে আছে সে। কালো স্যুটে মানিয়েছে বেশ।

অভ্র সুন্দর বটে, তবে বিভোরের চেয়ে বেশি নয়। পৃথুলার চোখে আজও পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরতম পুরুষ বিভোর। তার ভালবাসার মানুষটি। হ্যাঁ, ভালবাসার মানুষ। পৃথুলা আজও ভালবাসে বিভোরকে। বিভোর…. কেমন আছে সে? গত চারটি বছরে তার কি একবারও মনে পড়েনি তার পৃথার কথা?

বিভোরের কথা মনে আসতেই চোখের কোণ ভিজে ওঠে পৃথুলার। চোখের পানি আড়াল করতে অভ্রর দিক হতে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল পৃথুলা। পৃথুলার জবাব না পেয়ে অভ্র বলল,
“ইট’স ওকে। আপনার আপত্তি থাকলে বলতে হবে না। কোনো ব্যাপার না।”
পৃথুলা একটুখানি চুপ থাকল। তারপর বলতে শুরু করল চারবছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনটির কথা। পৃথুলার জন্য অভিশপ্তই বটে। যেটা তছনছ করে দিয়েছে পৃথুলার জীবনটা৷ এক অন্ধকার কুঠুরিতে ফেলে দিয়েছে পৃথুলাকে। যে অন্ধকার ভেদ করে পৃথুলা আজও দেখতে পারেনি এক চিলতে আলোর মুখ।

পৃথুলার মুখে সব শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অভ্র। তার মুখে ‘রা’ নেই। এই স্নিগ্ধ, মায়াবী মেয়েটাকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এটা ভাবতেই শিওরে উঠছে অভ্র।

“আপি…”
পৃথুলা, অভ্র পাশ ফিরে দেখল প্রত্যাশাকে।
“স্যরি। তোদের কথা এখনো শেষ হয়নি? আসলে নিচে তোদের ডাকছিল। অনেকক্ষন হয়ে গেল তো। আচ্ছা সমস্যা নাই। কথা শেষ হলে চলে আসিস।”
বলে আর দাঁড়ালো না প্রত্যাশা। নিচে নেমে গেল।
অভ্র পৃথুলার দিকে তাকাল৷ বলল,
“রেপিস্টের শাস্তি হয়নি?”
“হয়েছে। শাস্তিটা স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক দিয়েছেন।”
পৃথুলা একটু থেমে আবার বলল,
“সবই তো শুনলেন৷ এবার নিশ্চয়ই আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না। আপনি নিচে গিয়ে বারণ করে দেন বিয়ের ব্যাপারে।”

অভ্র আর কিছু বলল না। বিনা বাক্যব্যয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে। তারপর কিছু না বলে ছাদ থেকে নেমে যাবার জন্য উদ্যত হলো। পরক্ষনেই কি যেন মনে করে সিড়ি গোড়া থেকে ফিরে এসে আবার পৃথুলার সম্মুখে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে পৃথুলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটা আমার ভিজিটিং কার্ড। রেখে দিন।”
পৃথুলা কার্ডটা নিল না। অভ্র নিজেই পৃথুলার হাতে কার্ডটা দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। পৃথুলা কার্ড হাতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষন পর মাহিমা বেগম ছাদে এলেন। এসেই পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরলেন। পৃথুলার মুখটা দুহাতে আজলা করে ধরে বললেন,
-“এতদিনে আল্লাহ আমার মেয়েটার দিকে মুখ তুলে চাইলেন৷ অশেষ শোকরিয়া তার কাছে।”
পৃথুলা মাথামুন্ডু কিছু বুঝল না। মাহিমা বেগম ওর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন,
-“ছেলের তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। উনারা চাইছেন আগামিকালই এনগেইজমেন্ট সেরে ফেলতে। আমরা আপত্তি করিনি।”
পৃথুলা হতভম্ব হয়ে মায়ের মুখপানে তাকিয়ে রইল। মাহিমা বেগমের চোখে মুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। কতদিন পর মানুষটার মুখে এমন খুশীর ছাপ দেখতে পাচ্ছে।
কিন্তু কথা হলো, অভ্র বিয়েতে রাজি হলো কেন? জেনেশুনে কেউ একজন ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে কেন?

অভ্রর দেওয়া ভিজিটিং কার্ড থেকে অভ্রর ফোন নাম্বারটা নিজের মোবাইলে টুকে নিল পৃথুলা। তারপর কল লাগালো। বার কয়েক রিং বাজার পর ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করল অভ্র।
-“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
পৃথুলা চুপ। ফোনের ওপাশ থেকে সাড়া না পেয়ে অভ্র বলল,
-“কে বলছেন প্লিজ?”
-“আমি, পৃথুলা।”
অভ্র অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“তুমি আমাকে ফোন করেছো! কি সৌভাগ্য আমার!”
পৃথুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছেন!”
অভ্র মৃদু হেসে বলল,
-“প্রথমত, তুমি বয়সে আমার চাইতে কমপক্ষে ৫/৬ বছরের ছোট হবে। দ্বিতীয়ত, কয়েকদিনের মধ্যে তুমি আমার বউ হবে! বউকে ‘আপনি’ সম্বোদন বেখাপ্পা, বেমানান লাগে না?”
পৃথুলা হতভম্ব অভ্রর কথায়। এখনো কিছুই হলো না আর লোকটা তাকে ইতিমধ্যে বউ বানিয়ে দিল। পৃথুলা নিজেকে সামলে বলল,
-“আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন কেন?”
-“তুমি এটা জানার জন্য ফোন করেছো?”
-“দেখুন, জেনেশুনে নিজের লাইফটা নষ্ট করবেন না। আপনি অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করেন৷ অযথা আমার মত একজন ধর্ষিতাকে…।”
-“হ্যাঁ। আমি সব জেনেশুনেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। ইনফ্যাক্ট, তোমার পাস্ট জানার এক মিনিট আগেও আমি তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীন ছিলাম৷ কিন্তু সবটা জানার পরেই আমি ডিসিশন ফাইনাল করলাম, বিয়ে আমি তোমাকেই করব।”
-“কেন? সিমপ্যাথি দেখাতে বিয়ে করছেন আমাকে?”
-“কি যা তা বলছো পৃথুলা!”
-“ঠিকই বলছি। নয়তো আপনার আমাকে বিয়ে করার কোনো কারণ নেই। শুনুন, আমি ধর্ষিতা, কিন্তু তাই বলে কারো করুণার পাত্র হতে পারব না।”
এ পর্যায়ে অভ্র রেগে গেল। ধমকের সুরে বলল,
-“শাট আপ। তুমি বারবার নিজেকে ধর্ষিতা ধর্ষিতা বলে জাহির করছো কেন? তুমি কি ইচ্ছে করেই ধর্ষনের শিকার হয়েছো! বারবার তুমি নিজেই নিজেকে ছোট করছো। তুমি নিজেই যদি নিজেকে রেসপেক্ট করতে না পারো তবে অন্যরা করবে কিভাবে? নিজেকে ছোট না ভেবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখো মেয়ে। এনিওয়ে, রাখছি এখন। কাল দেখা হচ্ছে। বাই।”
অভ্রর মেজাজটাই গরম হয়ে গেল। তাই রেগেমেগে কল কেটে দিল। পৃথুলা চেয়ে রইল ফোনের স্ক্রিণে, অভ্রর নাম্বারের দিকে।

পরদিন দু পরিবারের অল্প কয়েকজন কাছের আত্মীয়ের উপস্থিতিতে ঘরোয়াভাবে অভ্র-পৃথুলার এনগেইজমেন্টের অনুষ্ঠান শেষ হলো। পুরো সময়টা অভ্র মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল পৃথুলার দিকে। পৃথুলাও দু একবার তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। দুদিন পর বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো।
.
জানালার গ্রিলের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে পৃথুলা। বাহিরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দুলে চলছে গাছের পাতাগুলো। এখন বৈশাখমাস চলছে। বসন্তকে বিদায় জানিয়ে সদ্যই প্রকৃতিতে আগমন ঘটল আবহমান বাংলার প্রথম ঋতু গ্রীষ্মের। গ্রীষ্মকালীন প্রকৃতির সাথে নিজের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পায় পৃথুলা। গ্রীষ্মকাল প্রকৃতিকে শুষ্ক, রুক্ষ, আড়ষ্ট, নির্জীব করে দেয়। প্রকৃতি হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ। তবে গ্রীষ্মের রুক্ষতা, আড়ষ্টতা কাটিয়ে বর্ষা ঋতুর আগমনে প্রকৃতি আবার নতুন সাজে সজ্জিত হবে। প্রাণহীন প্রকৃতি ফিরে পাবে তার সজীবতা। কিন্তু পৃথুলা! তার জীবনে কখনো কি বর্ষার আগমন ঘটবে? তার মরুভূমির ন্যায় শুষ্ক জীবনে কি কখনো বৃষ্টি নামবে? আবার সজীব, সতেজ হবে তার জীবনটা? এর একটাই উত্তর, ‘হয়তো’।

রূপোর থালার মত একটা সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে জ্যোৎস্না পড়ছে এই ধরণীতে৷ সেই জ্যোৎস্না জানালার কাচ ভেদ করে পৃথুলার শরীরে আছড়ে পড়ছে। করিয়ে দিচ্ছে জ্যোৎস্না স্নান।

পৃথুলা তার হাতের দিতে তাকালো৷ তার ডান হাতের অনামিকায় অভ্রর পরানো হীরের আংটি টা চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এই আঙুলে বিভোরের পরানে আংটি থাকার কথার ছিল। কিন্তু….
পৃথুলার বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আচ্ছা বিভোর কি বিয়ে করে ফেলেছে? তার কথা কি একবারও মনে পড়ে না বিভোরের? বিভোরের কি মনে পড়ে না দুজনের একসাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা? শুধুমাত্র একটা ঘটনা পৃথুলার প্রতি তার সব ভালবাসা মুছে দিয়েছে? আদৌ কি ভালবাসত বিভোর তাকে? এই চারবছরে একবারের জন্যও বিভোর তার খোঁজ নিল না। নেবেই বা কেন? সে তো ধর্ষিতা। ধর্ষিতা রা তো এই সমাজের অভিশাপ। বিভোর কেন যেচে তার ঘারে অভিশাপ চাপিয়ে নেবে?

ভাবতেই দু চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ল পৃথুলার। পৃথুলা জানেনা তার সাথে কি হতে চলেছে। জীবনটা কোনদিকে মোড় নিতে চলেছে কে জানে! গত চার বছরে জীবন তাকে অনেক কিছু দেখিয়েছে, শিখিয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে অনেক নোংরা কথা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো সুইসাইড করে সবকষ্ট থেকে মুক্তি নিয়ে নিতে। কিন্তু সাহস হয়নি নিজের জীবন দেওয়ার। অতটা সাহসী হতে পারেনি পৃথুলা, পারবেও না কোনোদিন।
.
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here