মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -১৩+১৪

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-১৩
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
“আপু, লাইট অফ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
বলতে বলতে প্রত্যাশা ঘরের লাইট জ্বেলে দিল। অন্ধকার ঘরটা মুহূর্তেই আলো ঝলমল করে উঠলো। প্রত্যাশা পেছন থেকে পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরলো।

“জানিস আপি, আমি আজ ভীষন খুশি। শুধু আমিই না, মা, বাবা সবাই খুব খুশি। সেদিনের পর থেকে বাবাকে তো কখনো হাসতেই দেখিনি। কিন্তু এখন বাবা হাসছে, আনন্দের হাসি। আর অভ্র ভাইয়াও মানুষটা খুব ভালো। তোর পাস্ট জেনেও নির্দ্বিধায় তোকে বিয়ে করতে চাইছে। আমি তো বিষ্মিত। এমন মানুষও হয়। আল্লাহ’র কাছে অনেক শোকরিয়া, যে এমন একজন মানুষকে তিনি আমার আপির ভাগ্যে মিলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। দেখবি, তুই খুব সুখী হবি আপি। অভ্র ভাইয়া তোকে অনেক সুখে রাখবে।”

এরমধ্যে পৃথুলার ফোন বেজে উঠল। প্রত্যাশা পৃথুলাকে ছেড়ে বলল,
“নিশ্চয়ই তোমার সাহেব তোমাকে ফোন করেছেন।”

বলতে বলতে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিল প্রত্যাশা। ফোনের স্ক্রিণে অভ্রর নাম দেখে স্মিত হেসে বলল,
“দেখলি তো আমি ঠিকই ধরেছিলাম। তোর উনি তোকে মিস করছেন। নে কথা বল।”
পৃথুলার হাতে মোবাইলটা দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল প্রত্যাশা।

“হ্যালো।”
ফোনের ওপাশ থেকে মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠটা শুনে বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে গেল অভ্রর। পৃথুলার কণ্ঠে মাদকতা আছে। পৃথুলার সাথে প্রথম কথা বলেই অভ্র আসক্ত হয়ে গেছে এই মাদকতায়। শুধু কণ্ঠে নয়, অভ্র আসক্ত হতে চায় পুরো পৃথুলাতে৷ এই আসক্তি কখনো যেন না কাটে!

কি দিয়ে কথা শুরু করবে ভেবে পেল না অভ্র। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“খেয়েছো?”
“হুম।”
“এখন কী করছো?”
“কিছু না।”
“আমি কি করছি জানতে চাইবে না?”
পৃথুলা জবাব দিল না। অভ্র নিজেই বলল,
“আমাদের এনগেইজমেন্টের ছবিগুলো দেখছি। এই ছবিগুলোই আজ আমার নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হবে।”
পৃথুলা এবারও কিছু বলল না। অভ্র নিজেই আবার বলল,
“আজ তোমাকে দারুণ লাগছিল। হোয়াইট কালার ড্রেসে একদম অপ্সরীর মত লাগছিল। আমার তো চোখ ফেরানোই দায় হয়ে গিয়েছিল।”
পৃথুলা নিশ্চুপ। ওর সাড়া না পেয়ে অভ্র বলল,
“পৃথা..”

পৃথুলা চমকে উঠল। বিভোর মাঝেমাঝেই পৃথুলাকে পৃথা বলে ডাকত। বিভোরের মুখে পৃথা ডাক শুনতে ভীষন ভালো লাগতো তার। বিভোর ছাড়া আর কেউ ওকে কখনো পৃথা ডাকেনি।

পৃথুলার সাড়াশব্দ পেল না অভ্র। কেবল নিঃশ্বাসের শব্দটুকু ছাড়া।
“পৃথা শুনতে পাচ্ছো?”
পৃৃথুলার কান্না পাচ্ছে ভীষন। বিভোরের কথা মনে পড়লেই ওর কান্না পায়। ঢোক গিলে কান্না আটকাল পৃথুলা। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।
বলল,
“হুম বলুন।”
“কি ব্যাপার! আমি একা একাই বকবক করে যাচ্ছি। তুমি কিছু বলছ না যে?”
পৃথুলার এবার বিরক্ত লাগছে। কানের কাছে অভ্রর এইসব প্যানপ্যানানি ওর ভালো লাগছে না একদমই। তাই বলল,
“আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোব।”
“আগে বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়ো। কাল কথা হবে। শুভরাত্রি।”
পৃথুলা ফোন কেটে দিল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার জানালার সাথে হেলান দিয়ে বাহিরে তাকালো।
.
দেখতে দেখতে দুটো দিন চলে গেল। এ দুদিনে বেশ কয়েকবার অভ্রর সাথে ফোনে কথা হয়েছে পৃথুলার। পৃথুলা নিজে থেকে কিছু বলেনি। অভ্রর কথার প্রত্তুত্যরে হু হা জবাব দিয়েছে৷ অভ্রর মায়ের সাথেও দুবার কথা হয়েছে। মহিলা খুবই ভদ্র এবং মিষ্টভাষী। অভ্রর বাবা কয়েকবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। অভ্ররা দু ভাই আর এক বোন। অভ্র, উৎস আর অর্থি। অভ্র সবার বড়। উৎস এবার মাস্টার্সে পড়ে, ইকনোমিক্স নিয়ে। আর অর্থি পড়ে ইন্টারমিডিয়েটে, সেকেণ্ড ইয়ারে।

এনগেইজমেন্টে দু ভাইবোনের কেউই থাকতে পারেনি। অর্থির কলেজে এক্সাম ছিল। আর উৎস’র কি একটা কাজ ছিল। উৎস’র সাথে কথা হয়নি পৃথুলার। তবে অর্থির সাথে এ দুদিনে অনেকবারই কথা হয়েছে। বলতে গেলে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায়ই ফোন করে মেয়েটা। ফোন দিয়েই ভাবি ভাবি করে পৃথুলার কান ঝালাপালা করে দেয়। তারপরেও পৃথুলার অর্থির সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। ভীষন মিষ্টভাষী অর্থি মেয়েটা।
.
বাড়িজুড়ে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। পৃথুলাদের ছোট্ট দু’তলা বাড়িটা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন রঙ বেরঙের আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে। বাসাভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে।
পৃথুলাকে একটা গাঁঢ় লাল রঙের বেনারসী শাড়ি পরানো হয়েছে। সাথে স্বর্ণ ও হীরের গহনা। ওর নিতম্ব সমান চুলগুলো খোঁপা করে তার উপর ফুলের গাজরা দিয়ে দিয়েছে।

পৃথুলা মেকআপ নিতে চায়নি। মেকআপ ওর কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। চোখে কাজল, কপালে টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, পৃথুলার কাছে সাজ বলতে কেবল এটুকুই৷ তাও সবসময় না। বিভোর যখন সাজার জন্য খুব জোরাজুরি করত কেবল তখনই সাজত। কিন্তু আজ ওর বারণ কেউ শুনলো না। বিয়ের কনে বলে কথা! না চাইতেও হেভি মেকআপ নিতে হলো পৃথুলাকে।

একটু পরেই গুঞ্জন শুরু হলো ‘বর এসেছে।’ খানিক বাদেই একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে দৌড়ে এসে পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরে টুপ করে গালে একখানা চুমু খেল। পৃথুলা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
মেয়েটি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
“ওহ ভাবি, ইউ আর ঠু মাচ বিউটিফুল। ছবির চাইতে বাস্তবে তুমি অনেক অনেক বেশি কিউট।”

পৃথুলা বুঝল এটাই অর্থি, অভ্রর বোন। অর্থি ভীষণ প্রাণচঞ্চল ও চটপটে একটা মেয়ে। চেহারা অনেকটা অভ্রর চেহারার আদলে গড়া। দুজনের গায়ের রঙও এক, উজ্জল শ্যামলা বর্ণের। শ্যামলা হলেও দু ভাইবোনের মুখে সীমাহীন মায়া। আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মায়া যেন কালো আর শ্যামলা মানুষের মধ্যেই ঢেলে দিয়েছেন।

প্রত্যাশা বলল,
“শুধুই কি ভাবির সাথে কথা বলবে? আমাদের সাথে কথা বলবে না?”
অর্থি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি কে?”
“তোমার ভাইয়ের একমাত্র শ্যালিকা।”
“ও মাই গড! তাহলে তো আমরা বেয়ান। আসো হাগ করি।”

বলেই অর্থি পৃথুলাকে ছেড়ে প্রত্যাশাকে জড়িয়ে ধরল।
প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
“কী নাম তোমার?”
“অর্থি। তোমার?”
“প্রত্যাশা।”
“প্রত্যাশা, বাহ্ দারুন নাম তো। পৃথুলা-প্রত্যাশা দুটো নামই সুন্দর। তোমরা দেখতে যেমন কিউট তোমাদের নামগুলোও তেমন কিউট।”
“তুমিও তো অনেক কিউট।”
অর্থি মুখ কালো করে বলল,
“আমি তো কালো।”
“কালো কোথায়! তুমি তো শ্যামলা, উজ্জ্বল শ্যামলা।”
“ওই একই হলো। তোমাদের মত অতো ফর্সা তো না।”
প্রত্যাশা কিছু বলার আগে পৃথুলা বলল,
“ফর্সা দিয়ে কি করবে! ফর্সা হলেই সুন্দর হলো! তুমি জানো তোমার মুখে কত মায়া আছে! তুমিতো মায়াবতী। সুন্দরী মেয়েরা রূপবতী হলেও মায়াবতী হয় না একদমই৷ তুমি এমনিতেই কিউট! আর তোমার মুখের এই মায়াটা তোমাকে আরো কিউট বানিয়ে দিয়েছে।”
অর্থি দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তাহলে তো অভ্র ভাইয়াও অনেক কিউট, তাইনা ভাবি?”

পৃথুলা থতমত খেয়ে গেল৷ অর্থিটা ইন্টার পড়ুয়া ছাত্রী হলেও ওর কথাগুলো একদম বাচ্চাদের মত। মেয়েটা দেখতেও বাচ্চা বাচ্চা। পৃথুলার জবাব না পেয়ে অর্থি আবারও একই প্রশ্ন করল। এবার প্রত্যাশা জবাব দিল।
“কিউট মানে! অনেক কিউট। আমার দুলাভাইয়ের মত হ্যাণ্ডসাম ছেলে আর আছে নাকি! তোমরা দুজনেই অনেক সুন্দর।”
অর্থি দু’হাতে প্রত্যাশার গাল টিপে দিয়ে বলল,
“তুমিও অনেএএএক কিউট। পৃথুলা ভাবিকে বড় ভাইয়ের বউ বানিয়েছি। তোমাকে ছোট ভাইয়ার বউ বানাব। কেমন?”
তারপরেই জিভ কেটে বলল,
“এইরে, আমি একাই ভাবির সাথে দেখা করতে আসছি। দাঁড়াও উৎস ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসি।”

বলে ঝটপট রুম থেকে বেরিয়ে গেল অর্থি।
প্রত্যাশা হেসে পৃথুলাকে বলল,
“আপি, এই বকবকানি ম্যাডাম তো সারাক্ষন বকবক করে করে তোর কান ঝালাপালা করে দেবে।”
দু মিনিটের মাথায়ই একটা ছেলের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো অর্থি। আর বলতে লাগল,
“ছবি পরে তুলবি। আগে ভাবির সাথে দেখা করবি। আমাদের ভাবিটা কি কিউট দেখ।”

সবাই চোখ তুলে তাকালো ওদের দিকে। উৎস’র পরনে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা। চুলগুলো ব্রাশ করা। গায়ের রঙ অভ্র আর অর্থির মত না। উৎস হয়েছে তার মায়ের মত। আঞ্জুমানের মত ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ উৎস’র। উৎস’র একটা বাঁকা দাঁত আছে৷ ওই দাঁতটার কারণে ওকে আরো বেশি কিউট লাগে।
.#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-১৪
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
উৎস পৃথুলাকে দেখে একটা হাসি দিল।
বলল,
“সত্যিই তো। ভাবি তো আসলেই অনেক সুন্দরী। ইশ্ ভাইয়ার আগে যদি ভাবির দেখা পেতাম, তবে আমিই তাকে বিয়ে করে ফেলতাম। ইশ্ কেন যে আগে দেখা হলো না।”
শেষটুকু আফসোসের সঙ্গে বলল উৎস। তারপরেই ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিল পৃথুলার।
অর্থি বলল,
“সমস্যা নাই। তোর জন্যও আমি অলরেডি মেয়ে পছন্দ করছি। ভাবীর পাশে প্রত্যাশা আপুকে দেখ, সুন্দর না? পছন্দ হইছে?”

উৎস প্রত্যাশার দিকে তাকালো। এতক্ষন সে খেয়ালই করেনি প্রত্যাশাকে। প্রত্যাশার দিকে তাকাতেই উৎস’র ভ্রু’দ্বয় কুঁচকে গেল। প্রত্যাশা উৎস’র দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। উৎস কয়েক সেকেণ্ড প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“এই ঝগড়াটে রানী কটকটি এইখানে কী করে?”
প্রত্যাশা ফণা তোলা সাপের মত করে বলল,
“আমাদের বাড়িতে আমি থাকব না তো কি আপনার মত জল্লাদ থাকবে?”
“তার মানে তুমি ভাবির বোন? ও মাই গড! আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, আমার ভাবির মত এত মিষ্টি, লক্ষী একটা মেয়ের বোন এরকম কটকটি মার্কা মেয়ে হইলো ক্যামনে?”
“আমিও ভেবে অবাক হচ্ছি, অভ্র ভাইয়ার মত এমন ভদ্র আর অর্থির মত মিষ্টি মেয়ের ভাই এমন ইবলিশ মার্কা হইলো ক্যামনে? অর্থি, এই ত্যাঁদড়টা নিশ্চয়ই তোমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ভাই। ঠিক বলছি না?”

অর্থি কিছু বলল না। বলা ভালো, বলার মত কিছু খুঁজেই পেল না সে।
উৎস ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই অর্থি, তুই এই ডাইনিটাকে পছন্দ করেছিস আমার জন্য! ছেহ! এই পৃথিবীর সব মেয়ে যদি মরে যায়, আর এই একটা মাত্র মেয়ে যদি থাকে তবুও আমি এর মত ডাইনির দিকে ফিরে তাকাব না।”
প্রত্যাশাও সমানতালে বলল,
“ও হ্যালো, নিজেকে কি ভাবেন হ্যাঁ? আয়নায় মুখ দেখছেন? ক্যাঙারুর মতোন দেখতে৷ যত্তসব।”

ওদের ঝগড়া শুনে সবাই হতভম্ব। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। ওরা কাউকে পরোয়া করছে না। নিজেদের মত ঝগড়া করে যাচ্ছে। যেন এখানে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই৷ অর্থি বোকার মত একবার উৎস’র দিকে তাকাচ্ছে একবার প্রত্যাশার দিকে তাকাচ্ছে।

প্রত্যাশার কাজিন জারিন বলল,
“প্রত্যাশা থামবি? কখন থেকে ঝগড়া করে যাচ্ছিস৷ উনি আমাদের মেহমান। মেহমানদের সাথে এমন করতে হয়!”
উৎস জারিনের সাথে তাল মেলাল। বলল,
“ঠিক বলেছেন৷ এই মেয়ে ভদ্রতার ‘ভ’ ও জানে না। গেস্টদের সাথে কেউ এমন বিহেভ করে!”
প্রত্যাশা চোখ রাঙিয়ে উৎস’র দিকে তাকালো। তারপর তাকাল জারিনের দিকে। বলল,
“শুধু আমাকেই দেখছিস? এই অসভ্য ছেলেটা যে তখন থেকে আমার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছে সেটা দেখছিস না?”
এবার পৃথুলা মুখ খুলল।
“আহ প্রত্যাশা! কি শুরু করলি!”

প্রত্যাশা বোনের ধমকে চুপ মেরে গেল।
অর্থি বলল,
“ভাইয়া কি হয়েছে তোদের মধ্যে? তোরা আগে থেকেই দুজন দুজনকে চিনিস?”
উৎস বলল,
“চিনব না আর! এই কটকটি রানী সেদিন রেস্টুরেন্টে আমাকে জুস দিয়ে গোসল করাইছে। তার উপর স্যরি না বলে উল্টো ঝগড়া শুরু করলো।”
“বাজে কথা বলবেন না৷ আমি মোটেও আপনার গায়ে জুস ফেলিনি৷ ওটা একটা এক্সিডেন্ট। আমি দুষ্টামি করে আমার বান্ধবীর গায়ে জুস ফেলছিলাম৷ কোথা থেকে আপনি সামনে এসে পড়লেন আর জুসটা আপনার গায়ে পড়ল। আর আমি তো বলেছিলাম আমি বুঝতে পারিনি৷ কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন ই না। শুরু করলেন ঝগড়া। তো আপনি আমার সাথে ঝগড়া করলে আমি কি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব?”
উৎস কিছুক্ষন নিরব থেকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। যা হবার হয়ে গেছে। ওসব কাটাকাটি৷ নাও উই আর ফ্রেণ্ডস?”
বলে হাত বাড়িয়ে দিল প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“আমার বয়েই গেছে আপনার মত ঝগড়ুইট্টার সাথে বন্ধুত্ব করতে। যত্তসব।”
প্রত্যাশা রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। উৎস করুণ মুখ করে তাকিয়ে রইল।

পৃথুলাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে সোফায় বসানো হলো। তার উল্টোদিকের সোফায় বর সেজে বসে আছে অভ্র। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে মৃদু হাসির রেখা। কাজী বিয়ে পরানো শুরু করলেন। আর পৃথুলা হারিয়ে গেল পুরনো স্মৃতিতে।

পৃথুলার বান্ধবী তিষামের ইন্টারমিডিয়েটে থাকাকালীনই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তিষামের অনুরোধে বিভোরও গিয়েছিল বিয়েতে। কাজী যখন তিষামের বরকে কবুল বলতে বললেন, তখন বিভোর পৃথুলার কানে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ইশ্ কবে সেই মাহেন্দ্রক্ষন আসবে বলোতো, যেদিন কবুল বলে তোমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেব।’

বিভোরের কথা শুনে পৃথুলা লাজুক হেসেছিল সেদিন। আজ সে কথা মনে পড়তেই নোনাজলে ওর চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো। সেই এত চেনা মানুষটা এক মুহূর্তেই পাল্টে গেল৷ রঙ পাল্টাতে মানুষ গিরিগিটিকেও হার মানাতে পারে।

অবশেষে তিন কবুলের মধ্য দিয়ে অভ্র-পৃথুলা বাঁধা পড়ল এক পবিত্র বন্ধনে, বিয়ের বন্ধনে।
আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে এবার কনে বিদায়ের পালা। পুরো বাড়িতে যেন কান্নার রোল পড়েছে। মেয়ের বিদায় বেলায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে মাহিমা বেগমের। তার কলিজাটা চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। আনিসুল ইসলাম পৃথুলার হাতটা অভ্রর হাতে রাখলেন৷ কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু কান্নার জন্য বলতে পারছিলেন না। তার গলা কাঁপছে, শরীর টলছে। তবুও ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
“আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। তুমি আমার মেয়েটা কে দেখে রেখ।”
আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার।

অভ্র আনিসুল ইসলামের পা ছুঁয়ে সালাম করল। বলল,
“রাখব বাবা। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
পৃথুলা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বাবার বুকে, তারপর মা, তারপর বোন।

সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথুলা রওনা হলো তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। একে একে সবগুলো গাড়ি পৃথুলাদের বাড়ি ছাড়ল, এগিয়ে চলল অভ্রদের বাসার দিকে।

পৃথুলা কাঁদছে। অভ্র পকেট থেকে টিস্যু বের করে পৃথুলার চোখ মুছে দিল। তারপর পৃথুলার মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখল। পৃথুলা সাথে সাথে সরে গিয়ে জানালার সাথে মাথা ঠেকাল৷ অভ্র পৃথুলার হাত ধরলো। পৃথুলা হাত সরিয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না। অভ্র খুব শক্ত করে পৃথুলার হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে চেপে রাখল।

পৃথুলাদের বাসার থেকে অভ্রদের বাসা প্রায় দেড়ঘণ্টার পথ। ওরা যখন অভ্রদের বাসায় পৌঁছালো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। বধূবরণের সমস্ত আনুষাঙ্গিক কাজ সেরে অর্থিসহ ওর কয়েকজন কাজিন পৃথুলাকে নিয়ে গেল অভ্রর বেডরুমে।

রুমে ঢুকতেই গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস এসে ঠেকল নাকে। ধবধবে সাদা বেডশিটের উপরে গাঁঢ় খয়েরী রঙের গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। পৃথুলাকে নিয়ে বিছানায় বসানো হলো। ওর ট্রলিটা এনে রুমের একপাশে রাখা হলো।

মিনিট পাঁচেক পর উৎস একজন বৃদ্ধাকে ধরে রুমে নিয়ে এলো। বৃদ্ধা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“কই গো, আমার নাতবউ কই?”
উৎস বলল,
“এইতো নিয়ে এসেছি তোমাকে তোমার নাতবউ এর কাছে। এবার মন ভরে দেখ।”
অর্থি উঠে বৃদ্ধাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। পৃথুলাকে বলল,
“ভাবি, এই হচ্ছে আমাদের বাড়ির মোস্ট ইম্পর্টেন্ট মেম্বার। আমার দাদী দিলারা বেগম৷ দাদী জার্নি করতে পারে না বলে তোমাদের বাসায় যেতে পারেনি। তবে বুড়ি হলে কি হবে, উনার ঝাঁজ কিন্তু বেশি।”
বৃদ্ধা বললেন,
“হইছে হইছে এ্যালা সর৷ আমি আমার নাতবউ এর মুখখানা দেইখ্যা লই।”

পৃথুলা সালাম করল বৃদ্ধাকে৷ বৃদ্ধা পৃথুলার মুখটা দুহাতে আঁজলা করে ধরে বললেন,
“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। আমার অভ্রের বউডা তো এ্যাক্কারে পরীগো মতন।”
এরপর উৎস’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার ছোডো নাতবউ ও কিন্তু এমন ডক সোন্দর হওন লাগব, কইয়া দিলাম।”
উৎস পেছন থেকে দিলারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার জন্য তো তুমিই আছো সুইটহার্ট। ঘরে এই সুন্দরীকে রেখে বাইরে সুন্দরীদের খুঁজতে যাব কোন দুঃখে?”
দিলারা বেগম মুখ ঝামটা মেরে বললেন,
“হইছে হইছে ঢং মারাইস না। বউ পাইলে আর এই বুড়িডারে মনে থাকবো না।”
“কি যে বলো ডার্লিং! তোমাকে কি কখনো ভুলতে পারি!”
.
চলবে_____
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here