মন মহুয়ায় শূন্যতা পর্ব-০৫+৬

#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ৫
#Tasfiya_Nur

শিকদার বাড়ি পুরোটা ফাকা, বাড়িতে শুধু মহুয়া আর তার শ্বাশুড়ি ব্যতিত আর মানুষ নেই।একটু আগে আরমান মায়ের অনুমতি নিয়ে বউ আনতে গেছে।মহুয়া নিজের রুমে বিছানার উপর বসে ল্যাপটপে কিছু একটা ঘেটে যাচ্ছে।যখন দেখলো সে অসফল তখন বিছানার তোষকের নিচ থেকে এন্ড্রয়েড ফোন বের করে অনলাইনে লগ ইন করে।তারপর কল দেয় একজনের কাছে।কলটা অনবরত বেজে চললেও রিসিভ করছেনা ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটা। প্রায় সাতবারের মাথায় গিয়ে কলটা রিসিভ হয়।রিসিভ করতেই মহুয়া বলে উঠে,

‘পাসওয়ার্ড কেনো পাল্টিয়েছিস?থাপ্পড় খাবি তুই।কাল রাত অব্দি আমি সব দেখতে পেরেছি আর এখন তোর আইডিতে ঢুকতেই পারছিনা।হোয়াট দ্যা হেল?’

‘শান্ত হ মহুয়া,সব ঠিক আছে।আমার আইডিতে সমস্যা হয়েছিলো।তাই পাসওয়ার্ড পাল্টে সিকিউরিটি সিস্টেম স্ট্রং করেছি।আর আইডিতে যা খুশি হোক মেমোরি কার্ডে তো সব আছে।সো টেশশন করিস না।’

ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তির কথা শুনে মহুয়া থেমে যায়।তারপর মৃদু স্বরে বলে উঠে,

‘মেমোরি কার্ড নষ্ট হওয়ার ভয়ে আইডিতে রাখি আর তুই এভাবে ভয় পাইয়ে দিছিস।যাই হোক পেনড্রাইভ সহ আরও কিছু মেমোরিতে সব কপি কর।লোকটা বড্ড চালাক জানিস তো। সময় চলে আসছে লোকটাকে দমিয়ে ফেলার।অনেক অন্যায় সহ্য করেছি ইভেন এখনও করছি।আর সম্ভব না,ওর কথায় একটা মায়ের বুক খালি করেছি।জানিসই তো কথা না শুনলে আমার মায়ের বুক খালি করতো।কি কুলক্ষণে যে সেদিন নদীর ধারে ওসব দেখেছিলাম।জীবনটা এলেমেলো হয়ে গেলো ঐ একটা ঘটনায়। ভাগ্যিস তুই দূরে ছিলি নয়তো তোর ব্যাপারে জানলে আজ তোর কাছে সব সেফলি রাখতে পারতাম না।যাই হোক শুন আরফাজের খোজ লাগা।ভাইয়াকে বল শিখা আপুর কাছে যেতে।আপু আজও আরফাজের খোজ দিলোনা।আপু তো জানেনা তার ভাইকে মরণের মুখে ঠেলে দিতে বাধ্য ছিলাম আমি।এবার সব সত্যি উন্মোচন করে শিকদার বাড়ির মানুষগুলোকে সেফ করে আনন্দ ফিরিয়ে দিতে হবে।অনেক ভুল করেছি আমার স্বার্থে আর সম্ভব না।বাবা আসছে আজ সবাইকে নিয়ে।আমায় বাসায় নিয়ে যেতে পণ করে ছেড়েছে।সময় কম,সাথে আরও একটা কাজ কর শহরের দিকে বাসা খুজ এমন জায়গায় যেখানে ঐ মানুষটা কল্পনাও করতে পারবেনা বাবা মাকে সরিয়ে রাখতে পারি এমন কিছু।চাইনা ক্ষতি হোক আর।আমি আজ আবারও সেই সেইম জায়গায় যাবো, আরও স্ট্রং প্রুভ দরকার। দুলাভাইকে সব খোজ লাগাতে বল।এতদিন দুলাভাইকে আমার দোহায় দিয়ে থামিয়ে রেখেছিলাম, এবার তার বুদ্ধি অনুযায়ী সব করবো।রাখছি।

কথাগুলো বলা শেষেই মহুয়া কল কেটে দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পরে।ফোনের অপর পাশের মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে যায়।সংসার জীবন বড্ড কঠিন সেই কাজের কর্মী যে সব মেয়েই।মহুয়া কিছুক্ষণ বসে থেকে বাইরে বেরোয়। চারদিক খুজে দেখে নেয় বাড়িতে কে কে।শ্বাশুড়ি ছাড়া কাউকে দেখলোনা মহুয়া। সবাই বরযাত্রীর সাথে গিয়েছে।তার শ্বাশুড়ি নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে।মহুয়া দরজার সামনে দাড়িয়ে তা দেখে মিহি স্বরে জিগাসা করে উঠে,

‘আম্মা ঘুমায় গেছেন?’

মহুয়ার গলার স্বর পেয়ে নাজমা বেগম চোখ খুলে তাকায়।মহুয়ার মায়া মাখা স্নিগ্ধ মুখখানা দেখে তার ইচ্ছে করে আগের মতো আদর করতে।কিন্তু আরফাজের খুনি ভেবেই কিছু বলেন না তিনি।মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে উঠেন উনি,

‘কিছু দরকার?বলবা কিছু না কিছু লাগতো তোমার। লাগলে কও,আমার শরীরডা ভালা লাগতাছে না।শুইয়া থাকুম।’

‘না আম্মা আমার কিছু লাগতোনা।শুধু একখান কথা কইবার আছিলো।আমার আব্বায় মনে অয় আমারে
নিয়া যাইতে চাইবো আম্মা।আপনার পায়ে পড়ি আম্মা আমারে যাইতে দিয়েন না।নইলে আমার বিষ খাইয়া মরতে অইবো।আপনে দয়া কইরা আব্বারে মানা করবেন আম্মা।আমি বাকিটা জীবন এই বাড়ির দাসী বান্দী হইয়া কাটায় দিমু,তবুও যাইতে কইয়েন না।’

কথাটা মহুয়া ছুটে নিজের ঘরে চলে যায়। নাজমা বেগম সেখানেই বসে মহুয়ার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলেন।মাথায় তার একটাই চিন্তা ঘরপাক খাচ্ছে, “মেয়েটা তার ছেলেকে এত ভালোবাসলে ঝগড়া কেন করতো?কেন তার ছেলেকে বারবার বলতো মরে যাও, চলে যাও জীবন থেকে।”প্রশ্ন অনেক ফলাফল শূণ্য। নাজমা বেগম ভাবনা বাদ দিলেন।বেশি ভাবলেই উনার মাথা ব্যাথা করে।তাই গায়ে লেপ টেনে আবার শুয়ে পড়লো।
এদিকে মহুয়া নিজের ঘরে এসে আলমারি খুলে কালো বোরখা, হিজাব,নিকাব,হাত পায়ের মোজা বের করে পরে নেয়।গায়ের উপর কালো শাল জড়িয়ে নিয়ে বাটন ফোন ওফ করে বিছানায় ছুড়ে মারে।মহুয়া জানে তার ফোন ট্র্যাক করা আছে, তাই এন্ড্রয়েড একটা সেট কিনে এনেছে সে সবাইকে লুকিয়ে।সেটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার খুজে নিয়ে মেসেজ টাইপ করে।সেখানে লিখে,” সব ঠিকঠাক তো?আমি পনেরো মিনিটে পৌচাচ্ছি।ঘাটে স্পিড বোট রেখো।” মেসেজটা সেন্ড করতে সাথে রিপ্লাই আসলো সব ঠিক আছে। মহুয়া রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে বাড়ির পিছন দিকে যাবার জন্য তার রুমের গোপন দরজাটা ঘরে রাখা আলনা ধাক্কা মেরে সরায়।তারপর শালটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে ফোন আর টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পরে।খবর পেয়েছে সে তার জীবনের শান্তিবিনাশ কারীর আজ বিশাল বড় অর্ডার ঘাটে ভীরবে।সব অন্যায় কাজের শক্ত প্রমান যোগার করে আনবে সে আজ।এই পণ করে বেরিয়ে পরে মহুয়া।

💖💖
বিছানার উপর বউ সাজে বসে নিজের ফোন ঘাটছে জান্নাত।রাত প্রায় আটটা বাজতে চললো তবু কনের ডাক পড়লোনা বিয়ের আসরে।তার কাছে একটা কাজিনও নেই সব বাড়ির সামনের উঠোনে করা বিয়ের অনুষ্টানে শামিল হয়েছে। তোর্ষা সময় হবে যখন তখন এসে নিয়ে যাবে এই কথা বলে চলে গেছে বাইরে এখনও আসেনি।জান্নাত কিছুটা বিরক্ত অনুভব করছে।একেতো শীত তারমাঝে এই ভারী গহনা, সব মিলিয়ে জান্নাতে মেজাজ সপ্তম আকাশে।পারেনা ভাঙচুর শুরু করে তাই নিজেকে দমাতে ফোন নিয়ে বসেছে সে।ফোনে একনাগারে তার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে।কি ক্ষতি হতো একটু ভালোবাসলে বুঝে পেলোনা জান্নাত।এসবের মাঝেই জান্নাতকে নিতে আসলো তোর্ষা সহ ওর মামাতো বোনরা।তোর্ষাকে দেখে জান্নাত দাত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

‘আসলি কেন?একা করে রেখে গিয়েছিলি একাই থাকতাম। যা ভাগ এখান থেকে।’

‘দেখেছো বোন আমার বিয়ে না হতেই বরের জন্য পাগলামি শুরু করেছে।’

জান্নাতের কথা শুনে হেসে হেসে কথাটা বলে তোর্ষা।তোর্ষার সাথে বাকিগুলোও হেসে ফেলে।জান্নাত রাগে হাত মুঠোবন্দি করে তোর্ষার পানে ক্ষিপ্ত চাহনীতে তাকায়।তোর্ষা দমে যায় বোনের চাহনীতে।তাই সবাইকে তাড়া দিয়ে জান্নাতকে নিয়ে স্টেজের দিকে চলে যায়।স্টেজে নিয়ে গিয়ে আরমানের মুখোমুখি করা স্টেজে বসানো হয় জান্নাতকে। জান্নাত বসতেই জান্নাতের বাবা ইয়াকুব তালুকদার কাজী সাহেবকে বিয়ে পড়ানোর কথা বলেন।কাজী সাহেব সম্মতি পেয়ে আরমানের কাছে বসে নিয়ম অনুযায়ী সব কথা বলে কবুল বলতে বললে আরমান একদমে কবুল বলে দেয়।কাজী সাহেব আরমানের কবুল বলায় আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।সমস্বরে বাকি সবাই বলে।এরপর কাজী সাহেব জান্নাতের কাছে গিয়ে যথারীতি সব বলে কবুল বলতে বললে জান্নাত থম মেরে বসে রয়।তোর্ষা বোনের পাশেই বসে ছিলো, বোনকে নিশ্চুপ দেখে মৃদূু ধাক্কা দেয়।তাতে জান্নাত স্বাভাবিক হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবা,ভাই তারপর বোনকে দেখে চোখ বন্ধ করে কবুল বলে দেয়।জান্নাত কবুল বলছিলো না বলে আরমানের চিন্তা ধরে গিয়েছিলো যে, জোড় করে বিয়ে করলোনা তো সে।” জান্নাত কবুল বলতেই সেই চিন্তা ঝেড়ে সবার সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে দিলো।

কিছুক্ষণ পর জান্নাত আর আরমানকে পাশাপাশি বসিয়ে খাবার দেওয়া হলো এক টেবিলে। বিয়ের বাড়ির সবাইর প্রায় খাওয়া শেষ। শুধু বর-কনে বাকি ছিলো তাই তাদেরও খাবার দেওয়া হয় একসাথে বসিয়ে।আরমান জান্নাতের সাথে বসে খেতে পারবে বলে বেশ খুশি হয় মনে মনে।জান্নাত পরে গেছে অসস্তিতে লোকটার সান্নিধ্যে থাকতে তার ভালো লাগেনা। আফসোস তবুও সারাজীবন থাকতে হবে।জান্নাতের আশপাশে তার সব কাজিনরা বসে আছে,আবার অনেকে দাড়িয়ে আছে তাদের ঘিরে ধরে। তোর্ষা নিজে ওদের দুজনকে সব সার্ভ করে দেয়।আরমান সলজ্জ ভঙ্গিতে খেতে শুরু করে শতহোক নতুন জামাই সে । জান্নাত সেই সকালে হালকা খেয়েছিলো এরপর পেটে আর কিছু পরেনি তাই হালকা পাতলা সেও খেয়ে নেয়।আরমানের আগেই হাত ধূয়ে নেয় জান্নাত।তাই আরমানও হালকা খেয়েই হাত ধোয়।সবশেষে উঠে যায় খাওয়া হলে।তোর্ষা তাদের নিয়ে স্টেজে বসায় পাশাপাশি। সবাই জামাই দেখা পর্ব শুরু করে। এসব হতে হতে রাত সারে দশটা বেজে যায় প্রায়। আজমল তালুকদার তাড়া দেন বউ নিয়ে বাড়ি রওনা দিবেন বলে।
শুরু হয় জান্নাতের বিদায় পর্ব।বাকিসব মেয়েদের মতো জান্নাত কাদতে পারলোনা।ওকে জড়িয়ে ধর ওট মা,বাবা,ভাই,বোন, দাদী কাদতে থাকে। জান্নাত নিজেকে ওদের থেকে ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে।জান্নাতের এমন কান্ডে অবাক হয়।তবুও কেউ কিছু বলেনা।আরমান আর আজমল শিকদার সবার থেকে বিদায় নিয়ে একই গাড়িতে উঠে পরে।আরমানের দাদী বসে জান্নাতের একপাশে আরেকপাশে আরমান।আরমানের বাবা আরিফুল শিকদার জান্নাতের বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বাকিসব কে নিয়ে ভাড়া করে আনা বাসে উঠে পরে।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ৬
#Tasfiya_Nur

‘আচ্ছা শিখা,সমস্যা কি তোমার?এত ইনফরমেশন কই পাও এটা বলোনা,অথচ একটার পর একটা ইনফরমেশন দিয়েই যাচ্ছো!কাহিনী কি বলবা একটু দয়া করে!’

আরফাজ রাত দশটায় ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলো,তখন শিখা ড্রইং রুমে আসে টিভির সাউন্ডে।তাই সে এসব থামাতে নিজের ফোন রুম থেকে এনে আরফাজকে আরমানের বিয়ের ছবি দেখায় আরফাজকে।তখনই আরফাজ উক্ত কথাটা বলে।শিখা আরফাজের মেজাজ চড়া দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়।কারণ আরফাজ যত যাই হোক এতটা রাগে না কখনো।শিখা কিছুটা দম নিয়ে বলে,

‘বাড়িতে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ খোজ না রেখে উপায় কি বলো!তুমি চলে এসেছো এরপর তো বাবা-মা, ভাই-ভাবীর খোজ রাখতে হয় বলো!অন্যায় আমি করেছি না তারা করেছে এটা মনে রাখার মানে হয়না।কিন্তু তারা খোজ না রাখলেও আমার রাখতে হয়।সহিদা খালাকে তো ভুলোনি তাইনা?’

শিখার উত্তরে আরফাজ ‘থ’ মেরে বসে আছে।সহিদা খালা শিখাকে বলে, কিভাবে সম্ভব!সহিদা খালা তো ফোন ব্যবহার সম্পর্কে জানেনা।তাহলে কিভাবে?আরফাজের চোখমুখে বিস্ময়।শিখা আরফাজের অবস্থা দেখে আরফাজের মনোভাব বুঝতে পারে।তাই নিজেই আবার বলে উঠে,

‘যা ভাবছো ধরতে পেরেছি কিছুটা।উত্তর এটা তোমাকে নিয়ে আসার পর রিহান গ্রামে গিয়েছিলো নিজেদের ভিটেমাটি বিক্রি করার চিন্তা করে।গ্রামে গিয়েই সবার মুখে তোমার মৃত্যু নিয়ে কথার ঝড় উঠে।সবাই মহুয়াকে দোষ দিয়ে নাকি জেলে পাঠাতে চেয়েছে।কিন্তু তুমি যেহেতু সুইসাইড নোট লিখনি সাথে কাউকে কিছু বলোনি আর তোমার লাশ পাওয়া যায়নি, কি বোকার মতো কথা বলছি জীবিত মানুষের লাশ কই পাবে!’

শিখা এতটুকু বলে থামে।আরফাজ বোকার মতো তাকিয়ে আছে শিখার দিকে।সে তো এটা ভাবেনি সে মরলে মহুয়ার উপর দোষ পড়তে পারে।বাকি কথা জানার জন্য আরফাজ শিখাকে জিগাসা করে বসে,

‘তারপর কি হয়েছে শিখা?’

শিখা একটু হাসে,আরফাজ মুখে যত বলুক মহুয়ার জন্য তার অনুভূতি নেই, কিন্তু মনে মনে সে আগের মতোয় মহুয়াকে ভালোবাসে।সেই অনুভূতিটাই প্রকাশিত করে আরফাজকে নিজের পরিবারে ফিরিয়ে দিতে শিখা এসব বিষয়ে ইনফরমেশন যোগার করে আরফাজকে বলতে শুরু করছে।এতে আরফাজ নিজেই পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।এই আশায় শিখা এই একটা বছর পর আরফাজের সামনে নিজের ভিতরে চেপে রাখা সত্যি গুলো বলছে।মনে মনে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিখা আরফাজের আগ্রহ মিটাতে আবার বলে উঠে,

‘যথোপযুক্ত প্রমাণের অভাবে মহুয়াকে পুলিশে তো দেওয়া যায়নি কিন্তু শাস্তিস্বরুপ বাড়ির বউ থেকে কাজের ঝি হয়ে গেছে এটা বুঝেছি।রিহান গ্রাম থেকে ফিরলে ওর থেকে সব শুনে আমি নিজেই লুকিয়ে গ্রামে যাই।জানোয় তো সাইফুল শিকদার কতটা ঘৃণা করে আমায়।সামনে পেলে খুন করতেও ভাববেনা।গ্রামে গিয়ে সহিদা খালার সাথে যোগাযোগ করি।খালাকে টাকার বিনিময়ে তোমাদের বাড়ির সব খবর দিতে বলি।বাটন ফোন কিনে দিয়ে আসি।এরপর থেকে মহুয়ার বিগত এক বছরের সব খবর আমি জানতাম।আর এখন হয়তো প্রশ্ন জাগবে তোমায় কেনো বলিনি এসব।আমি চেয়েছি তুমি এই বিচ্ছেদের দহনে পুরে শক্ত হও।ব্যস তাতে আমি সফল বলেই এখন জানালাম।আমি মনে করি তোমার বাড়ি ফেরা উচিত।আর আরমানের বিয়ের পিকগুলো আমার মায়ের পেটের ভাই সাইফ শিকদার দিয়েছে।কিছুটা হলেও বোনের প্রতি মায়া কাজ করে হয়তো।তাই টুকটাক কথা হয় সপ্তাহ পরপর।আশা করি সব তোমার কনফিউশান দূর করতে পেরেছি। বাবাই জেগে আছে সাথে বাবইয়ের বাবাও।সারাদিন তোমাকে বিষন্ন দেখে জানালাম এসব।আরমানের বিয়ের ছবি দেখতে চাইলে ফোন থাকলো দেখে নাও।রুমে চলে যাও।’

শিখা কথাটা বলেই রুমে চলে যেতে পা বাড়ায়।আরফাজ কিছুক্ষণ একনজরে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে রুমে চলে যায়।শিখা ততক্ষণে রুমে গিয়ে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আরফাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলো।তার ছেলে আর ছেলের বাপ ঘুমিয়ে গেছে বিধায় সে দাড়িয়ে দেখছিলো আর।আরফাজ রুমে যেতেই দরজা আটকে দিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে মনে মনে বলে উঠে “মাফ করো আল্লাহ,আরফাজকে সব সত্যি বলতে পারলাম না।আমার সাথে যে মহুয়ার যোগাযোগ হয় সেটা আমি বলিনি ওকে।বললে কি করতো রাগের বশে সেটাও তো জানিনা।কারণ আরফাজ তো বলেই দিয়েছিলো মহুয়ার নাম ওর সামনে না তুলতে। তাই পারলাম না বলতে সবটা।কি করে বলবো আরফাজ তোমায় মহুয়া প্রতিদিন কল,মেসেজ দিয়ে জানতে চায় তোমার কথা।কিন্তু আমার ভাই যে ফেলনা নয় সেটা বুঝাতেও তোমার খোজ দেইনা ওকে।সেদিন রাতে যেদিন তুমি মরার চেষ্টা করলে মহুয়াই তোমার ফোন থেকে মেসেজ দিয়েছিলো যেন কাছে গিয়ে সাথে করে নিয়ে যাই।কারণ তোমার সাথে দেখা করবো বলে আমিও কল করতেছিলাম।ভাগ্যিস তখন মহুয়া জানিয়েছিলো তুমি নদীর ধার দিকে গেছো সুইসাইড করার উদ্দেশ্যে নয়তো কবরে রেখে আসতে হতো তোমায়।কিন্তু আজও জানলাম না তোমাদের মাঝের সমস্যা, যেজন্য মরতে অব্দি চাইলে তুমি।’
শিখার এসব ভাবনার মাঝেই রিহান শিখাকে ডেকে উঠে।শিখা রিহানকে জাগতে দেখে জিগাসা করে,

‘তোমাকে না ঘুমাতে দেখলাম!উঠলে কখন?’

‘আপনি যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, তখন উঠেছি।আমি তো ঘুমাইনি।ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে চোখ বুজে আসছিলো।কিন্তু আপনার দরজা লাগানোর শব্দে জেগে উঠেছি।কিন্তু আপনি এতটাই গভীর চিন্তায় ছিলেন যে আমার উপস্থিতি আপনার খেয়াল নেই। ‘

‘ঢং বাদ দাও রিহান।চলো ঘুমানো যাক।ভালো লাগে না আর এইসব কাহিনী।সেসব নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়।এবার যদি আরফাজ ফিরে তো ভালো।’

রিহান শিখার উত্তর শুনে কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে পরে।শিখা গিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পরে।

💗💗
‘রিঠি মহুয়া কোনখানে?নতুন বউ আইছে বরণের সময় বাড়ির বউ থাকন লাগতোনা নাকি?যা মহুয়াকে ডাক দে।’

মায়ের এমন কথায় রেগে যায় রিঠি।সবসময় এত অন্যায়ের পরও মহুয়াকে কেনো ডাকা হয় আজব।নাজমা বেগমের কথা শুনে তার বড় ভাই বউ বলে উঠে,

‘ঐ অলক্ষি মাইয়ারে ডাকনের কি দরকার নাজু?তুই বরণ করবি।এমনিতেই কত রাত হইয়া গেছে।’

তার কথার সাথে তাল মিলায় বাড়ির বাকিরা
রাতের এগারোটায় অবশেষে একা হতে পেরে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে জান্নাত।এতক্ষণ বরণ করে দুনিয়ার রিচুয়াল মেনে বাসর ঘরে তার ননদ সহ আরমানের আরও কিছু কাজিনরা তাকে আরমানের রুমে বসিয়ে গেছে।বাধ সাধে আরমান, সে বাড়ির সকলের উপস্থিতিতে নতুন জীবন শুরু করবে।তার কথার সাথে সম্মতি প্রকাশ করে তার দাদী।তাই বাধ্য হয়ে রিঠি যায় মহুয়ার রুমের দিকে।জান্নাত নিশ্চুপ হয়ে বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে ওদের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।আরমান বারকয়েক সেটা খেয়াল করে সেও নিশ্চুপ হয়ে যায়।বিয়ের আসরে আসার পর থেকেই সে দেখছে জান্নাত মনমরা।তবে কি সে বিয়েতে রাজী ছিলোনা!এই কথাটা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে আরমানকে।
একটুের রিঠি এসে ওর মাকে বলে উঠে,

‘মা ভাবীর রুমের দরজা বন্ধ। ডাকলাম জবাব নাই। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। তুমি বরণ করোতো।রাত কত হয়ছে খেয়াল আছে!’

রিঠির কথায় সবাই সম্মতি দেয়।আরমানের দাদা আদেশ দেয় জান্নাতকে বরণ করতে।তার কথায় নাজমা বেগম মিষ্টি মুখ করিয়ে জান্নাতকে বাড়ির উঠোনে ডান পা রেখে প্রবেশ করতে বলে।জান্নাতও কথামতো তাই করে।এরপর বাড়ির যেখানে যা যা আছে সব দেখানো হয় জান্নাতকে।সম্পর্কে কে কি হয় সেটাও বুঝিয়ে দেয়।এতকিছুর ভীরেও জান্নাত ভাবছে মহুয়ার কথা।”কে এই মেয়েটা! যার জন্য এত কথা উঠলো, তাকেই দেখা গেলোনা। অদ্ভুত!”
আনমনে এসব ভাবার মাঝে জান্নাতকে ওর শ্বাশুড়ি খাবার টেবিলে নিয়ে যায়।তারপর হালকা পাতলা খাবার খাইয়ে দেন নিজ হাতে।এটা শিকদার বাড়ির নিয়ম একপ্রকার।এর মাধ্যমে পুত্রবধু যেন শ্বাশুড়িকে মা ভাবতে পারে আর শ্বাশুড়ি তার ছেলের বউকে মেয়ের মতো আগলে রাখতে পারে সেই মায়ার বন্ধন তৈরি যেন হয়,সেজন্যে এই নিয়ম শিকদার বংশে পরম্পরায় হয়ে আসছে।জান্নাতও মায়া ভরা চাহনীতে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।কত যত্ন নিয়ে খাওয়াচ্ছে তাকে।তার মাও তো এভাবে খাওয়াতো।তবে আজ কেনো এত দূরত্ব। খেতে এসব ভাবছিলো জান্নাত। খাওয়ানো শেষ হলে নাজমা বেগম ছেলের বউকে পানি খাইয়ে আচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন।তারপর জান্নাতকে দাড় করিয়ে বলে উঠে,

‘শ্বাশুড়ি না মা ভাববা।যখন যা লাগবো আরমানকে বলবা।ওরে না বলতে পারলে আমারে বলবা।পর ভাইবো না কহনও।হইতে পারি গ্রামের মুর্খ বেডি,কিন্তু সব মুর্খ বেডিই তার সন্তানের পরথম শিক্ষা দেয়।’

জান্নাত কান্নামাখা দৃষ্টিতে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।সে চিন্তায় ছিলো তার শ্বাশুড়ি তার মা হতে পারবে তো।এতক্ষণে সেই চিন্তা তার দূর হলো।মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার।জড়িয়ে ধরে শ্বাশুড়িকে। এই দৃশ্য দূর থেকে আরমানও দেখে।বাড়ির বাকি সব মানুষেরও মুখে হাসি।

রাতের সাড়ে এগারোটায় রিঠি সহ আরমানের মামাতো বোনেরা জান্নাতকে আরমানের রুমে বসিয়ে দিয়ে যায়।সারাদিন পরে একা হতে পেরে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে জান্নাত।সারাদিন কোলাহল আর এই ভারী শাড়ি গহনা তার উপর শীতের শাল, সবমিলিয়ে অবস্থা জগাখিচুরি। তাই রুমে একা হতেই সে গহনা খুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখে।তারপর ফুলের সাজানোর বিছানার দিকে নজর দেয়।তার প্রিয় গোলাপ আর রজনীগন্ধার মিশ্রনে বিছানাটা সাজানো।সবদেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে জান্নাত। কি এমব ক্ষতি হতো যদি সে যাকে ভালোবেসেছিলো সেও একটু তাকে ভালোবাসতো।তবে তো এভাবে অন্য কারোর হতে হতোনা। রুমের দরজার সামনে হইচই শুনতে পেয়ে এসব লথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জান্নাত। আরমানের কাজিনরা দরজা আটকে দাড়িয়ে আছে টাকা নেওয়ার জন্য। বাসর ঘর সাজানোর টাকা তুলবে তারা।কিন্তু ওরা যা চাইছে আরমান তা দেবেনা। এটা নিয়েই তর্ক চলছে।জান্নাত কান ফেলে এসবই শুনতে পায়।অবশেষে পনেরো মিনিট পর আরমান রুমে প্রবেশ করে।
জান্নাত তখন দরজার কাছাকাছিই প্রায় দাড়িয়ে ছিলো।সম্ভবত বাসর ঘরে নতুন বউ বিছানায় বসে বরের জন্য অপেক্ষা করে।কিন্তু জান্নাতকে তার ব্যতিক্রম দেখে অবাক হয় আরমান।জান্নাত ভাবলেশহীন ভাবে আরমানকে আরও অবাক করে জিগাসা করে বসে,

‘মহুয়া মেয়েটা কে?আপনার ভাইয়ের স্ত্রী কি?আর বাড়ির বড়রা ওভাবে কথাই বা কেনো শুনাচ্ছিলো তাকে?আর আপনার বড় ভাই ই বা কোথায়।একবারও তো তাকে দেখলাম না!’

চলবে?

(আসসালামু আলাইকুম,ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। বাসায় পারিবারিক কিছু সমস্যা চলে।এজন্য রেগুলার দিতে পারছিনা সরি। সম্ভব হলে রাতে আরও একটা পার্ট দেবো।১৪৪০+ওয়ার্ড)

‘আচ্ছা শিখা,সমস্যা কি তোমার?এত ইনফরমেশন কই পাও এটা বলোনা,অথচ একটার পর একটা ইনফরমেশন দিয়েই যাচ্ছো!কাহিনী কি বলবা একটু দয়া করে!’

আরফাজ রাত দশটায় ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলো,তখন শিখা ড্রইং রুমে আসে টিভির সাউন্ডে।তাই সে এসব থামাতে নিজের ফোন রুম থেকে এনে আরফাজকে আরমানের বিয়ের ছবি দেখায় আরফাজকে।তখনই আরফাজ উক্ত কথাটা বলে।শিখা আরফাজের মেজাজ চড়া দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়।কারণ আরফাজ যত যাই হোক এতটা রাগে না কখনো।শিখা কিছুটা দম নিয়ে বলে,

‘বাড়িতে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ খোজ না রেখে উপায় কি বলো!তুমি চলে এসেছো এরপর তো বাবা-মা, ভাই-ভাবীর খোজ রাখতে হয় বলো!অন্যায় আমি করেছি না তারা করেছে এটা মনে রাখার মানে হয়না।কিন্তু তারা খোজ না রাখলেও আমার রাখতে হয়।সহিদা খালাকে তো ভুলোনি তাইনা?’

শিখার উত্তরে আরফাজ ‘থ’ মেরে বসে আছে।সহিদা খালা শিখাকে বলে, কিভাবে সম্ভব!সহিদা খালা তো ফোন ব্যবহার সম্পর্কে জানেনা।তাহলে কিভাবে?আরফাজের চোখমুখে বিস্ময়।শিখা আরফাজের অবস্থা দেখে আরফাজের মনোভাব বুঝতে পারে।তাই নিজেই আবার বলে উঠে,

‘যা ভাবছো ধরতে পেরেছি কিছুটা।উত্তর এটা তোমাকে নিয়ে আসার পর রিহান গ্রামে গিয়েছিলো নিজেদের ভিটেমাটি বিক্রি করার চিন্তা করে।গ্রামে গিয়েই সবার মুখে তোমার মৃত্যু নিয়ে কথার ঝড় উঠে।সবাই মহুয়াকে দোষ দিয়ে নাকি জেলে পাঠাতে চেয়েছে।কিন্তু তুমি যেহেতু সুইসাইড নোট লিখনি সাথে কাউকে কিছু বলোনি আর তোমার লাশ পাওয়া যায়নি, কি বোকার মতো কথা বলছি জীবিত মানুষের লাশ কই পাবে!’

শিখা এতটুকু বলে থামে।আরফাজ বোকার মতো তাকিয়ে আছে শিখার দিকে।সে তো এটা ভাবেনি সে মরলে মহুয়ার উপর দোষ পড়তে পারে।বাকি কথা জানার জন্য আরফাজ শিখাকে জিগাসা করে বসে,

‘তারপর কি হয়েছে শিখা?’

শিখা একটু হাসে,আরফাজ মুখে যত বলুক মহুয়ার জন্য তার অনুভূতি নেই, কিন্তু মনে মনে সে আগের মতোয় মহুয়াকে ভালোবাসে।সেই অনুভূতিটাই প্রকাশিত করে আরফাজকে নিজের পরিবারে ফিরিয়ে দিতে শিখা এসব বিষয়ে ইনফরমেশন যোগার করে আরফাজকে বলতে শুরু করছে।এতে আরফাজ নিজেই পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।এই আশায় শিখা এই একটা বছর পর আরফাজের সামনে নিজের ভিতরে চেপে রাখা সত্যি গুলো বলছে।মনে মনে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিখা আরফাজের আগ্রহ মিটাতে আবার বলে উঠে,

‘যথোপযুক্ত প্রমাণের অভাবে মহুয়াকে পুলিশে তো দেওয়া যায়নি কিন্তু শাস্তিস্বরুপ বাড়ির বউ থেকে কাজের ঝি হয়ে গেছে এটা বুঝেছি।রিহান গ্রাম থেকে ফিরলে ওর থেকে সব শুনে আমি নিজেই লুকিয়ে গ্রামে যাই।জানোয় তো সাইফুল শিকদার কতটা ঘৃণা করে আমায়।সামনে পেলে খুন করতেও ভাববেনা।গ্রামে গিয়ে সহিদা খালার সাথে যোগাযোগ করি।খালাকে টাকার বিনিময়ে তোমাদের বাড়ির সব খবর দিতে বলি।বাটন ফোন কিনে দিয়ে আসি।এরপর থেকে মহুয়ার বিগত এক বছরের সব খবর আমি জানতাম।আর এখন হয়তো প্রশ্ন জাগবে তোমায় কেনো বলিনি এসব।আমি চেয়েছি তুমি এই বিচ্ছেদের দহনে পুরে শক্ত হও।ব্যস তাতে আমি সফল বলেই এখন জানালাম।আমি মনে করি তোমার বাড়ি ফেরা উচিত।আর আরমানের বিয়ের পিকগুলো আমার মায়ের পেটের ভাই সাইফ শিকদার দিয়েছে।কিছুটা হলেও বোনের প্রতি মায়া কাজ করে হয়তো।তাই টুকটাক কথা হয় সপ্তাহ পরপর।আশা করি সব তোমার কনফিউশান দূর করতে পেরেছি। বাবাই জেগে আছে সাথে বাবইয়ের বাবাও।সারাদিন তোমাকে বিষন্ন দেখে জানালাম এসব।আরমানের বিয়ের ছবি দেখতে চাইলে ফোন থাকলো দেখে নাও।রুমে চলে যাও।’

শিখা কথাটা বলেই রুমে চলে যেতে পা বাড়ায়।আরফাজ কিছুক্ষণ একনজরে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে রুমে চলে যায়।শিখা ততক্ষণে রুমে গিয়ে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আরফাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলো।তার ছেলে আর ছেলের বাপ ঘুমিয়ে গেছে বিধায় সে দাড়িয়ে দেখছিলো আর।আরফাজ রুমে যেতেই দরজা আটকে দিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে মনে মনে বলে উঠে “মাফ করো আল্লাহ,আরফাজকে সব সত্যি বলতে পারলাম না।আমার সাথে যে মহুয়ার যোগাযোগ হয় সেটা আমি বলিনি ওকে।বললে কি করতো রাগের বশে সেটাও তো জানিনা।কারণ আরফাজ তো বলেই দিয়েছিলো মহুয়ার নাম ওর সামনে না তুলতে। তাই পারলাম না বলতে সবটা।কি করে বলবো আরফাজ তোমায় মহুয়া প্রতিদিন কল,মেসেজ দিয়ে জানতে চায় তোমার কথা।কিন্তু আমার ভাই যে ফেলনা নয় সেটা বুঝাতেও তোমার খোজ দেইনা ওকে।সেদিন রাতে যেদিন তুমি মরার চেষ্টা করলে মহুয়াই তোমার ফোন থেকে মেসেজ দিয়েছিলো যেন কাছে গিয়ে সাথে করে নিয়ে যাই।কারণ তোমার সাথে দেখা করবো বলে আমিও কল করতেছিলাম।ভাগ্যিস তখন মহুয়া জানিয়েছিলো তুমি নদীর ধার দিকে গেছো সুইসাইড করার উদ্দেশ্যে নয়তো কবরে রেখে আসতে হতো তোমায়।কিন্তু আজও জানলাম না তোমাদের মাঝের সমস্যা, যেজন্য মরতে অব্দি চাইলে তুমি।’
শিখার এসব ভাবনার মাঝেই রিহান শিখাকে ডেকে উঠে।শিখা রিহানকে জাগতে দেখে জিগাসা করে,

‘তোমাকে না ঘুমাতে দেখলাম!উঠলে কখন?’

‘আপনি যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, তখন উঠেছি।আমি তো ঘুমাইনি।ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে চোখ বুজে আসছিলো।কিন্তু আপনার দরজা লাগানোর শব্দে জেগে উঠেছি।কিন্তু আপনি এতটাই গভীর চিন্তায় ছিলেন যে আমার উপস্থিতি আপনার খেয়াল নেই। ‘

‘ঢং বাদ দাও রিহান।চলো ঘুমানো যাক।ভালো লাগে না আর এইসব কাহিনী।সেসব নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়।এবার যদি আরফাজ ফিরে তো ভালো।’

রিহান শিখার উত্তর শুনে কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে পরে।শিখা গিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পরে।

💗💗
‘রিঠি মহুয়া কোনখানে?নতুন বউ আইছে বরণের সময় বাড়ির বউ থাকন লাগতোনা নাকি?যা মহুয়াকে ডাক দে।’

মায়ের এমন কথায় রেগে যায় রিঠি।সবসময় এত অন্যায়ের পরও মহুয়াকে কেনো ডাকা হয় আজব।নাজমা বেগমের কথা শুনে তার বড় ভাই বউ বলে উঠে,

‘ঐ অলক্ষি মাইয়ারে ডাকনের কি দরকার নাজু?তুই বরণ করবি।এমনিতেই কত রাত হইয়া গেছে।’

তার কথার সাথে তাল মিলায় বাড়ির বাকিরা
রাতের এগারোটায় অবশেষে একা হতে পেরে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে জান্নাত।এতক্ষণ বরণ করে দুনিয়ার রিচুয়াল মেনে বাসর ঘরে তার ননদ সহ আরমানের আরও কিছু কাজিনরা তাকে আরমানের রুমে বসিয়ে গেছে।বাধ সাধে আরমান, সে বাড়ির সকলের উপস্থিতিতে নতুন জীবন শুরু করবে।তার কথার সাথে সম্মতি প্রকাশ করে তার দাদী।তাই বাধ্য হয়ে রিঠি যায় মহুয়ার রুমের দিকে।জান্নাত নিশ্চুপ হয়ে বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে ওদের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।আরমান বারকয়েক সেটা খেয়াল করে সেও নিশ্চুপ হয়ে যায়।বিয়ের আসরে আসার পর থেকেই সে দেখছে জান্নাত মনমরা।তবে কি সে বিয়েতে রাজী ছিলোনা!এই কথাটা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে আরমানকে।
একটুের রিঠি এসে ওর মাকে বলে উঠে,

‘মা ভাবীর রুমের দরজা বন্ধ। ডাকলাম জবাব নাই। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। তুমি বরণ করোতো।রাত কত হয়ছে খেয়াল আছে!’

রিঠির কথায় সবাই সম্মতি দেয়।আরমানের দাদা আদেশ দেয় জান্নাতকে বরণ করতে।তার কথায় নাজমা বেগম মিষ্টি মুখ করিয়ে জান্নাতকে বাড়ির উঠোনে ডান পা রেখে প্রবেশ করতে বলে।জান্নাতও কথামতো তাই করে।এরপর বাড়ির যেখানে যা যা আছে সব দেখানো হয় জান্নাতকে।সম্পর্কে কে কি হয় সেটাও বুঝিয়ে দেয়।এতকিছুর ভীরেও জান্নাত ভাবছে মহুয়ার কথা।”কে এই মেয়েটা! যার জন্য এত কথা উঠলো, তাকেই দেখা গেলোনা। অদ্ভুত!”
আনমনে এসব ভাবার মাঝে জান্নাতকে ওর শ্বাশুড়ি খাবার টেবিলে নিয়ে যায়।তারপর হালকা পাতলা খাবার খাইয়ে দেন নিজ হাতে।এটা শিকদার বাড়ির নিয়ম একপ্রকার।এর মাধ্যমে পুত্রবধু যেন শ্বাশুড়িকে মা ভাবতে পারে আর শ্বাশুড়ি তার ছেলের বউকে মেয়ের মতো আগলে রাখতে পারে সেই মায়ার বন্ধন তৈরি যেন হয়,সেজন্যে এই নিয়ম শিকদার বংশে পরম্পরায় হয়ে আসছে।জান্নাতও মায়া ভরা চাহনীতে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।কত যত্ন নিয়ে খাওয়াচ্ছে তাকে।তার মাও তো এভাবে খাওয়াতো।তবে আজ কেনো এত দূরত্ব। খেতে এসব ভাবছিলো জান্নাত। খাওয়ানো শেষ হলে নাজমা বেগম ছেলের বউকে পানি খাইয়ে আচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন।তারপর জান্নাতকে দাড় করিয়ে বলে উঠে,

‘শ্বাশুড়ি না মা ভাববা।যখন যা লাগবো আরমানকে বলবা।ওরে না বলতে পারলে আমারে বলবা।পর ভাইবো না কহনও।হইতে পারি গ্রামের মুর্খ বেডি,কিন্তু সব মুর্খ বেডিই তার সন্তানের পরথম শিক্ষা দেয়।’

জান্নাত কান্নামাখা দৃষ্টিতে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।সে চিন্তায় ছিলো তার শ্বাশুড়ি তার মা হতে পারবে তো।এতক্ষণে সেই চিন্তা তার দূর হলো।মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার।জড়িয়ে ধরে শ্বাশুড়িকে। এই দৃশ্য দূর থেকে আরমানও দেখে।বাড়ির বাকি সব মানুষেরও মুখে হাসি।

রাতের সাড়ে এগারোটায় রিঠি সহ আরমানের মামাতো বোনেরা জান্নাতকে আরমানের রুমে বসিয়ে দিয়ে যায়।সারাদিন পরে একা হতে পেরে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে জান্নাত।সারাদিন কোলাহল আর এই ভারী শাড়ি গহনা তার উপর শীতের শাল, সবমিলিয়ে অবস্থা জগাখিচুরি। তাই রুমে একা হতেই সে গহনা খুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখে।তারপর ফুলের সাজানোর বিছানার দিকে নজর দেয়।তার প্রিয় গোলাপ আর রজনীগন্ধার মিশ্রনে বিছানাটা সাজানো।সবদেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে জান্নাত। কি এমব ক্ষতি হতো যদি সে যাকে ভালোবেসেছিলো সেও একটু তাকে ভালোবাসতো।তবে তো এভাবে অন্য কারোর হতে হতোনা। রুমের দরজার সামনে হইচই শুনতে পেয়ে এসব লথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জান্নাত। আরমানের কাজিনরা দরজা আটকে দাড়িয়ে আছে টাকা নেওয়ার জন্য। বাসর ঘর সাজানোর টাকা তুলবে তারা।কিন্তু ওরা যা চাইছে আরমান তা দেবেনা। এটা নিয়েই তর্ক চলছে।জান্নাত কান ফেলে এসবই শুনতে পায়।অবশেষে পনেরো মিনিট পর আরমান রুমে প্রবেশ করে।
জান্নাত তখন দরজার কাছাকাছিই প্রায় দাড়িয়ে ছিলো।সম্ভবত বাসর ঘরে নতুন বউ বিছানায় বসে বরের জন্য অপেক্ষা করে।কিন্তু জান্নাতকে তার ব্যতিক্রম দেখে অবাক হয় আরমান।জান্নাত ভাবলেশহীন ভাবে আরমানকে আরও অবাক করে জিগাসা করে বসে,

‘মহুয়া মেয়েটা কে?আপনার ভাইয়ের স্ত্রী কি?আর বাড়ির বড়রা ওভাবে কথাই বা কেনো শুনাচ্ছিলো তাকে?আর আপনার বড় ভাই ই বা কোথায়।একবারও তো তাকে দেখলাম না!’

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here