মন যাকে চাই পর্ব ১০+১১

#মন_যাকে_চায়
#পর্ব_১০
#সুবর্ণা_আক্তার_জুথি✍️✍️

(প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি গল্প দিতে হবার জন্য)

“অনুভব ইশিতার জন্য একটা পুরো রেস্টুরেন্ট বুক করে নিয়েছে,আজকে তাদের টু মানথ এ্যনিভার্সারি সেলিব্রেট করার জন্য।”

যাকে কষ্ট দেবে বলে ভেবেছিল তাঁকেই ভালোবেসে ফেলেছে।ইশিতার ভালোবাসা অনুভবকে বাধ্য করেছে ইশিতা কে ভালোবাসতে।

“ইশিতার সরলতা অনুভব কে মুগ্ধ করেছে।”কিন্তু ইশিতা তো তাকে অনুভব ভেবে ভালোবাসে। তাই অনুরাগ চাই ইশিতা সত্যিটা জানুক।”

ইশিতা জানুক সে তার অনুভব নয় সে অনুরাগ। মিথ্যে পরিচয়ে নয় সঠিক পরিচয় দিয়ে অনুরাগ ইশিতার ভালোবাসা পেতে চাই।

অনুভব আসার আগেই ইশিতা রেডি হয়ে নিলো। হালকা সাজ সেজেছে ইশিতা তাতেই তাকে খুব সুন্দর লাগছে। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল।

টুং করে শব্দ করে এস এম এস আসলো ইশিতার ফোনে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অনুভবের এস এম এস——

“আর কত অপেক্ষা করাবে প্রেয়সী,
আমি তোমার পথ চেয়ে বসে আছি”
“দেখতে চাই তোমার ঐ মিষ্টি হাসি
বলতে চাই তোমাকে কতটা ভালবাসি”

দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
ইশিতা ভাবলো হয়তো অনুভব গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে তাই বাইরে বেরিয়ে গেল।

ঘরের বাইরে যেতেই ঈশানের কল আসে।কল রিসিভ করে ঈশিতা কথা বলছে।

ডায়না আড়ালে দাঁড়িয়ে ইশিতা কে দেখছে কিছুক্ষণ আগে রায়হান খান ফোন করে জানিয়েছে তারা বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। বাড়িতে এসে পড়লো বলে। “আজকের ধামাকার কথা ভেবে ডায়না পৈশাচিক আনন্দ পেলো।”

——————

অনুভব অনেক এক্সাইটেড হয়ে আছে। না জানি সত্যি জানার পর ইশিতা কিভাবে রিয়্যাক্ট করে?

ইশিতা যদি আমাকে ভুল বোঝে।যদি রাগ করে আমাকে দুরে সরিয়ে দেয় তাহলে কি করবো আমি?
“না না না না ইশিতা এরকম করতেই পারে না ওতো আমাকে খুব ভালোবাসে।”

ইশিতা ঠিক বুঝবে আমাকে। আমার ভালাবাসা বুঝবে। আজকের পর থেকে আর অনুভব নয় আমাকে অনুরাগ বলে ডাকবে।

তারপর মি.চৌধুরী আর মিসেস চৌধুরীর সাথে আমার বোঝাপড়া করতে হবে। আমাকে জানতে হবে কেন এতো দিন তারা আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে?

“অনুরাগ আজকে ইশিতার জন্য ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করেছে। চারপাশটা সাজানো হয়েছে ইশিতার ফেভরেট হোয়াইট রোজ দিয়ে।”

অনুরাগ ইশিতার পছন্দের খাবারের ওর্ডার দিয়েছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে। এতো দেরি করছে কেন ইশিতা অলরেডি আধা ঘন্টা লেট করে ফেলেছে।
নাহ্ আর ওয়েট করা যাবে না। তাই ভাবলো ইশিতা কে একবার কল করে দেখবে। ফোনটা হাতে নিতেই রুমের লাইট নিভে গেল। অনুরাগ হাসলো তারমানে ইশিতা চলে এসেছে।

“কারণ ইশিতা আসার পর কি কি করতে হবে সবাই আগে থেকেই নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে অনুরাগ।”

“বড় একটা স্ক্রীনে ইশিতা আর অনুরাগের বিয়ের কিছু পিকচার দেখানো হচ্ছে, তারপর একে একে ইশিতার আরো অনেক গুলো পিকচার যেগুলো অনুরাগ লুকিয়ে লুকিয়ে তুলেছিল।”

ইশিতা অবাক হয়ে সব কিছু দেখছে আর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।

রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল এবার।

অনুরাগ নিজের ব্লেজার ঠিক করে নিল। তারপর ইশিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ইশিতার সামনে হাত বাড়ালো। কিন্তু ইশিতা কে দেখে অনুরাগ চমকে গেল।

কারণ ইশিতা কে অনেক বিদ্ধস্থ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার ওপর দিয়ে অনেক বড় ঝড় বয়ে গেছে।

কি হয়েছে ইশিতা তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ইশিতার খুব কাছে গিয়ে বলল।

“ইশিতা পিছিয়ে গেল আর বলল কি হওয়ার বাকি রেখেছো তুমি অনুরাগ?”

নিজের নামটা ইশিতার মুখে শুনে অনুরাগের পিলে চমকে উঠলো।
–আরে এমন অবাক হচ্ছো কেন এটাই তো নাম।
–ইশিতা তুমি?

কি আমি?
এটাই জানতে চাইছো তো তোমার নামটা আমি কি করে জানলাম।
“তাহলে শুনুন মি.অনুরাগ আমি শুধু আপনার নাম নয় আরো অনেক কিছু জেনে গেছি যেটা এতো দিন ধরে আমার কাছে থেকে লুকানো হয়েছে।”

আমার কথাটা একবার শোন ইশিতা।
ঈশিতার দু কাঁধে হাত রেখে বলল অনুরাগ।

“ইশিতা এবার চেঁচিয়ে বললো ডোন্ট টাচ মি,
মি. অনুরাগ।”

আপনার কোন অধিকার নেই আমাকে স্পর্শ করার। আপনি একটা খুনি। আপনি আমার অনুভব কে খুন করেছেন কাঁদতে কাঁদতে বলল ইশিতা।

“না না না না কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ইশিতা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আমি অনুভব কে খুন করিনি।”প্লিজ ইশিতা আমাকে ভুল বোঝ না।

ভুল তো আমি এতো দিন বুঝেছি কিন্তু আজকে আমার সামনে সবকিছু পরিষ্কার আমি আজকে বুঝতে পারছি কেন আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন।

আমার অনুভব কখনো আমার সাথে এমন আচরন করতে পারে না যাতে আমি কষ্ট পাই।

অনুরাগ এবার ইশিতা কে জড়িয়ে ধরে বললো আমাকে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলছি তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও।

ইশিতা অনুরাগ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে।
ইশিতার এমন আচরণে অনুরাগ হতবাক হয়ে গেল।

খবরদার আর কখনো আমার সামনে আসার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। “আমার ভাবতেই অবাক লাগছে অনুভবের ভাই হয়ে কি করে আপনার মন মানসিকতা এতোটা নিচ হতে পারে?”

কাঁদতে কাঁদতে ইশিতার হেঁচকি ওঠা শুরু হয়ে গেছে।
ইশিতা একবার আমার কথা শোন ইশিতা। পাগলের মতো আচরণ করছে অনুরাগ কারণ এক মূহুর্তে তার পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে।

ইশিতা বেরিয়ে যেতে চাইলে অনুরাগ তার হাত ধরে অনুরোধ করতে থাকে তাকে একটা সুযোগ দেয়ার জন্য।প্লিজ ইশিতা একবার আমার কথা শোন। এভাবে আমাকে একা ফেলে যেওনা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।

ছাড়ো আমাকে ছাড়ো বলছি। রাগে চিৎকার করে বললো ইশিতা। খবরদার আমার ওপর স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবে না। আমি খুব শীঘ্রই তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেব।

না ইশিতা এমন কথা বলো না আমাকে ছেড়ে যেওনা আমি শেষ হয়ে যাবো ইশিতা।
ইশিতা চলে গেল।

অনুরাগ কাঁদতে কাঁদতে ইশিতার পিছুপিছু ছুটলো।সে কিছুতেই ইশিতা কে হারাতে পারবে না। ইশিতা তাকে ভুল বুঝেছে।তার ভুল ভাঙ্গাতে হবে।

——❤️——-

“তেরি মেরি,মেরি তেরি প্রেম কাহানি হে মুশকিল দোলাভজো মে এ বায়ানা হো পায়ে।”

“এক ল্যাড়কা এক ল্যাড়কি কি এ কাহানি নেয়নি ,দোলাভজো মে এ বায়ানা হো পায়ে।”

“তেরি মেরি,মেরি তেরি প্রেম কাহানি হে মুশকিল দোলাভজো মে এ বায়ানা হো পায়ে।”

এক দুজেছে তুলা যাব এক দুজেকে লিয়ে বানে।
“তেরি মেরি,মেরি তেরি প্রেম কাহানি হে মুশকিল দোলাভজো মে এ বায়ানা হো পায়ে।”

“সাথে দিন বিত রায়ে সারি রাত জাগায়ে ,বাস ইয়াদ তুমহারা লম্হা লম্হা তার পায়ে।”

“তেরি মেরি,মেরি তেরি প্রেম কাহানি হে মুশকিল দোলাভজো মে এ বায়ানা হো পায়ে।”

——❤️——-

অনুরাগ বাইরে গিয়ে দেখলো ইশিতা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। দ্রুত ইশিতা কে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে শুয়ে দিয়ে।

খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে হসপিটালে পৌঁছে গেল।

অনুরাগ বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।ডক্টর ইশিতার চেকআপ করছে। অনুরাগ ইশিতার বাড়িতে খবর দিয়েছে আর লিজা কে জানিয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে সবাই হসপিটালে পৌঁছে গেল। “তাদের মধ্যে রায়হান খানকে দেখে অনুরাগ প্রথমে বেশ অবাক হলো আর এটা বুঝতে পেরে গেল ইশিতা কিকরে সবকিছু জেনে গেছে।”
অনুরাগ তাকে দেখে রাগে ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।

হোক না সে পালক বাবা তাই বলে ছেলের এতো বড় ক্ষতি করবে?

শায়লা হক কাঁদছে লিজা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, তাহেরা চৌধুরী আর রাশেদা চৌধুরী আসতে পারে নি।
আর অনুভবের মৃত্যুর খবর শুনে খুবই শোকাহত হয়ে পড়েছে। আর শিলা খানের মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না তাই আসেনি।

আনিসুল হক মেয়ের এই অবস্থা দেখে ভেঙে পড়লেন। রাজীব চৌধুরী তাদের অনুরাগের সত্যিটা বলে দিয়েছেন।তারা সবাই অনুরাগের ওপর এমনকি রাজীব চৌধুরীর পুরো পরিবারের ওপর রেগে আছে।

“রায়হান খান বললো তুই এখনো আমাদের ওপর রাগ করে থাকবি অনুরাগ?”
তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাই না তুমি আমার জীবনের চরম ক্ষতি করেছ।

বিশ্বাস কর অনুরাগ আমাদের কোন দোষ নেই ডায়না আমাদের ইমার্জেন্সি আসতে বলেছে। আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না।

দোষ তো তোমাদের একটা নয়। রায়হান খান মাথা নিচু করে নিলেন।

ডক্টরকে বেরিয়ে আসতে দেখে সবাই এগিয়ে আসলো।
আরে সবার চোখ মুখের অবস্থা এমন কেন?
মিষ্টি মুখ করাতে হবে বন্ধু। রাজীব চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে ডক্টর সাজ্জাদ হোসেন বললেন।

সবার ভেতরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।

আমার বৌমার কি হয়েছে বন্ধু। (রাজীব চৌধুরী)
আংকেল প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন আমার ইশিতার কি হয়েছে?

“আরে রিল্যাক্স অনুভব!”
তুমি বাবা হচ্ছো।
“হোয়াট…?”বিষ্ময়ে বলল অনুরাগ।
ইয়েস সি ইজ প্রেগন্যান্ট।

সবাই খুব খুশি হলো। বিশেষ করে অনুরাগ।
আনিসুল হক বললেন আমার ইশিতা মা এবার নিজেই মা হবে।
ডক্টর প্লিজ আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে চাই।

ওকে,একে একে গিয়ে দেখা করে আসুন।

আনিসুল হক সবার প্রথমে যেতে চাইলে ডক্টর বাধা দিয়ে বলল আমার মনে হয় সর্বপ্রথম অনুভবের ভেতরে যাওয়া টা ঠিক হবে।

—————-

রোগী দেখা শেষ করে নিজের কেবিনে এসে চোখ বন্ধ করে নিল দিশা।
দরজায় নক করে তড়িঘড়ি করে ভেতরে আসলো একজন নার্স।

ম্যাডাম ৪০নং টেবিলের রোগী রেসপন্স করছে।
“রিয়েলি….?”

হ্যা ম্যাডাম তাড়াতাড়ি চলুন।

এই যে শুনতে পাচ্ছেন?নাম কি আপনার? আপনার বাড়ি কোথায়?দিশা বললো।

ম্যাডাম উনি তো কিছুই বলছে না।

বলবে অবশ্যই বলবে গত দুমাস ধরে আমি আপ্রান চেষ্টা করছি উনার জ্ঞান ফেরানোর। আজকে আমি আশার আলো দেখতে পেয়েছি।আমার বিশ্বাস উনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।

না জানি উনার পরিবারের লোকজনের কি অবস্থা।যে অবস্থায় আমি উনাকে পেয়েছি তাতে তো ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি। এখন উনি সুস্থ হলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। তারপর এই অচেনা কে তার আপনজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো।

কথাটা বলতে দিশার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই দুই মাসে সে অচেনা মানুষটার মায়ায় পড়েছে। অচেনা এই মানুষটা দিশার অবসরের বন্ধু।

অবসরে দিশা এই ঘরে আসে নিজের মতো করে গল্প করে। এই কাজটা তার বেশ ভালো লাগে।

একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে একজন বন্ধু পেয়েছে সে।যে তার মনের কথা গুলো চুপচাপ শুয়ে শুয়ে শোনে।

দিশা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় ভাগ্যের জোরে ডক্টর হতে পেরেছে।অল্প সময়ের মধ্যে অনেক সুনাম অর্জন করেছে।

অচেনা রোগী কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে দিশা কান পেতে শুনার চেষ্টা করছে।


।#মন_যাকে_চায়
#পর্ব_১১
#সুবর্ণা_আক্তার_জুথি

“তুমি শুনেছ ইশিতা ডক্টর আংকেল কি বলেছেন?”

আমরা মা-বাবা হতে চলেছি। আমার যে কি খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারছি না। আমার মনে নেই কবে আমরা এতোটা ঘনিষ্ঠ হয়েছি। তবে বিশ্বাস কর ইশিতা আমি অনেক খুশি।ইশিতার পাশে বসে দু হাত ধরে বললো অনুরাগ।
“অনুরাগ কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক আনন্দিত।”

খনিকের জন্য হলেও ইশিতা অনুরাগের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সবকিছু মনে পড়তেই ইশিতা অনুরাগের কাছে থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “এই বাচ্চা শুধু মাত্র আমার।”

আমার অনাগত সন্তানের ওপর তোমার কোন অধিকার নেই।” আমি চাইনা কোন ঠগবাজের ছায়া আমার সন্তানের ওপর পড়ুক।”

সেদিনের রাতটা তোমার কাছে ভুল হতে পারে কিন্তু আমার কাছে তা ছিল না। আমার জন্য সেদিনের রাতটা ছিল ভালোবাসার। তুমি আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমাকে ঠকিয়েছ।

আমি শুধু মাত্র অনুভব কে ভালোবাসি। সেদিন ও আমি তোমাকে অনুভব ভেবেছিলাম।

না ইশিতা তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে ঠকাই নি। আর আমাদের মধ্যে যা কিছু হয়েছে তার কোন কিছুই ভুল ছিল না।

তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার মনে অন্য রকম ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল।
“কিন্তু আমি তখন আমার অনুভুতি গুলোকে প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চেয়েছিলাম।”

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারিনি।

তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজেও কষ্ট পেয়েছি। তোমার ভালোবাসা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে ভালোবাসতে।

আমি তোমাকে আর কোন কষ্ট দেবো না। কারণ আমি আর আগের অনুরাগ নেই। তোমার ভালোবাসা আমাকে বদলে দিয়েছে।

আর এখন তো আমাদের বেবি আসতে চলেছে।সে কি চাইবে বল তার বাবা মা এভাবে ঝগড়া করুক।তার চেয়ে বরং আমরা সবকিছু ভুলে আমার নতুন করে শুরু করি।

বন্ধ করো তোমার অভিনয়। আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি তোমার থেকে মুক্তি পেতে চাই। আমিই আমার সন্তানের জন্য যথেষ্ট।

আর তাছাড়া তুমি তো আমাকে ভালো বাসোনা। তুমি তোমার ডায়নার কাছে ফিরে যাও।

আর কখনো আমার সামনে আসবে না তুমি। কথা গুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ইশিতার। কান্না গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।সে আসলেই কি চায় অনুরাগ তার থেকে দূরে সরে যাক?
নাকি মনের কোন কোনে এখনও অনুরাগের জন্য জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে।

ইশিতার চেঁচামেচি শুনে আনিসুল হক একপ্রকার জোর করেই ভেতরে চলে আসলেন।

অনুরাগের কলার চেপে ধরে বললেন খবরদার আমার মেয়েকে বিরক্ত করার চেষ্টা করবে না। তাহলে কিন্তু আমার হাত উঠে যাবে।
আমি এক্ষুনি ইশিতা কে আমার সাথে নিয়ে যাবো।

এবার রাজীব চৌধুরী আর শায়লা হক আসলেন। রাজীব চৌধুরী এসে আনিসুল হকের থেকে অনুরাগ কে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো কার গায়ে হাত তুলছেন আপনি যে আপনার মেয়ের প্রান বাঁচিয়েছে।

আনিসুল হক বললেন আমি কোন কথা শুনতে চাই না ইশিতা আমাদের সাথে যাবে।

রাজীব চৌধুরী বললেন ইশিতা এখনও আইনত অনুরাগের স্ত্রী।
তাই ইশিতার ওপর অনুরাগের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আর তাছাড়া ইশিতার ও তো কিছু বলার থাকতে পারে।

অনুরাগ অসহায় ভাবে ইশিতার দিকে তাকালো তার উওরের অপেক্ষায়।

ইশিতা কিছু বলার আগেই ডক্টর এসে সবাইকে বাইরে বের করে দিল।

ইশিতা বসে আছে তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।

——————–

“ইশিতা কোথায় তুমি? আমার ইশিতা কোথায়? আমি ইশিতার কাছে যাবো।”

আরে আরে কি করছেন আপনি শান্ত হোন।দিশা বললো।

আমি ইশিতার কাছে যাবো ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যাবেন কিন্তু তার আগে আপনার নাম ঠিকানা বলুন।

অনুভব নিজের মাথা চেপে ধরে বললো আমার নাম আমার নাম অনুভব তারপর অনেক চেষ্টা করেও নিজের ঠিকানা বলতে পারলো না।

আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে।
ওকে রিল্যাক্স মি.অনুভব। এতো প্রেসার নিতে হবে না। ধীরে ধীরে মনে করার চেষ্টা করুন।
“তবুও অনুভব একপ্রকার পাগলামী শুরু করে দিয়েছে তাই বাধ্য হয়ে দিশা অনুভব কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল।”

অনুভব কে সুস্থ হতে দেখে দিশার খুব ভালো লাগলো কিন্তু কোথাও যেন একটা কষ্ট অনুভুত হচ্ছে।

“হয়ত এটা ভেবে যে, অনুভব পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তো নিজের আপনজনদের কাছে ফিরে যাবে।”আর আরেকটা কথা দিশাকে খুব করে ভাবাচ্ছে ইশিতা কে?
অনুভবের সাথে ইশিতার কি সম্পর্ক হতে পারে।

অনুভবের যখন সবকিছু মনে পড়ে যাবে তখন তো দিশা তাকে চোখের দেখাটাও আর দেখতে পাবেনা। প্রতিদিন সবার প্রথমে এসে অনুভবের চেহারা দেখাটা দিশার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দিশা অন্য রোগী দেখায় মনোযোগ দিলো।

সময় বয়ে চলেছে দেখতে দেখতে আরো একটা মাস কেটে গেছে অনুভব এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ হয়ে গেছে। নিজের ঠিকানা বলতে পেরেছে। তবে অনুভবের আরো দু-একটা ট্রিটমেন্ট বাকি আছে। আর এই ট্রিটমেন্টের জন্য একজন স্পেশালিস্ট ডক্টর আসবেন।

দিশা নিজেই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। সে চাই অনুভবকে একদম সুস্থ করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

এই একমাসে দিশা আর অনুভবের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। অনুভব তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দিশার সাথে গল্প করে বিশেষ করে ইশিতার কথা বেশি বেশি বলে।

দিশা অনেক বার জানতে চেয়েছে ইশিতার সাথে তার কি সম্পর্ক? কিন্তু অনুভবের উওর ছিল এখন বলবে না সামনাসামনি দেখা হলে পরিচয় করিয়ে দেবে।

—————

আর এদিকে অনুরাগ পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। সেদিন হসপিটালে থেকে ফিরে ইশিতা তার বাবার বাড়িতে চলে গেছে।
অনুরাগ অনেক চেষ্টা করেছিল ইশিতা কে আটকানোর। কিন্তু ডক্টরের কথা শুনে ইশিতা কে জোর করে নি।

“ডক্টরের মতে ইশিতার মানসিক অবস্থা ভালো নয় তাই তাকে নিজের মতো করে থাকতে দিতে।”

ইশিতা চলে যাবার পর অনুরাগ গেছিল তাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ইশিতা অনুরাগের সাথে দেখা করে নি। আনিসুল হক অনুরাগ কে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। শায়লা হক তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কারণ তার মতে অনুরাগের কোন দোষ নেই সে শুধু মাত্র পরিস্থিতির স্বীকার।

অনুরাগের মা তাহেরা বেগম এতো বছর পর জানতে পেরেছেন তার আরও একটা ছেলে আছে সে একদিকে অনেক খুশি আর আরেকদিকে অনুভব কে হারানোর শোকে কাতর হয়ে গেছে।

অনুরাগ প্রায় তার মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদে। তাহেরা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলের কষ্ট কিছুতেই তিনি সহ্য করতে পারছেন না।

তাহেরা বেগম রাজীব চৌধুরীর ওপর ভীষণ রেগে গেছিলেন।একে তো তার যে আরেকটা ছেলে আছে সেই কথাটা এতো দিন তার থেকে গোপন করেছে আর অনুভবের মৃত্যুর খবরটা তাকে বলেনি।

পরে রাজীব চৌধুরী সবাইকে সেদিনের ঘটনা খুলে বললো তাহেরা বেগম আর শিলার ভেলিভারি ডেট একদিনেই ছিল।

তাদের কে একই হসপিটালে ভর্তি করা হয়। তাহেরা জমজ সন্তানের জন্ম দেয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে শিলা মৃত্যু সন্তানের জন্ম দেয়।

পরপর তিন টা মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে শিলা অসুস্থ হয়ে গেছিল তখন নিজের বোনকে বাঁচানোর জন্য বুকে পাথর রেখে রাজীব চৌধুরী এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

সবকিছু জানার পর তাহেরা বেগম রাজীব চৌধুরী কে মাফ করে দেন।অনুরাগ ও তার পালক বাবা মা আর নিজের মা বাবার সাথে সব ঝামেলা মিটিয়ে নেয়।

রায়হান খান আর শিলা খান কিছুদিন আগে ফিরে গেছে।ইশিতার ভেলিভারির সময় আবার আসবে।

নাছোড়বান্দা ডায়না এখনো এখানে পড়ে আছে। সেদিনের ঘটনা জানতে পেরে অনুরাগ ডায়নাকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করে এমনকি গায়ে হাত তুলতে গেছিল।

ডায়না অনুরাগের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল তার ভুলের জন্য। কিন্তু সে মনে মনে শপথ করেছে সে একা ফিরবে না অনুরাগ কে সাথে নিয়েই ফিরবে। ছোট থেকেই ভীষণ জেদি সে।মা বাবার আদরের দুলালী হলে যা হয় আর কি।

ডায়নার এখানে থাকা না থাকা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

অনুরাগ প্রতিদিন যায় ইশিতা কে একটা নজর দেখার জন্য। কিন্তু আনিসুল হক তাকে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেয়।ইশিতা কে অনেক বার ফোনে ট্রাই করেছে অনুরাগ কিন্তু ইশিতা তার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে।

রোজ রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে অনুরাগ যদি ইশিতা একবার বারান্দায় আসে। তাকে দেখে মনে শান্তি পেতে চাই অনুরাগ। ইশিতা ঠিকই লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখে কিন্তু অনুরাগের সামনে আসে না।সে নিজেই দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়েছে।

আজকে আকাশে অনেক মেঘ করেছে। ইশিতা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে তার। সেদিন রাতে ও বৃষ্টি হয়েছিল। ছোট্ট একটা টেবিলের নিচে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল।পরে অবশ্য ইশিতা দেখেছিল অনুরাগ বেশি ভিজে গেছিল।যদিও তার বৃষ্টিতে ভিজতে মোটেও ভালো লাগে না।

কথা গুলো মনের স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে বারবার।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে জানালার গ্রিল দিয়ে বাইরে হাত বের করে বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করলো ইশিতা। বৃষ্টি তার বরাবরই পছন্দ।এমনই এক বৃষ্টিমুখর দিনে দেখা হয়েছিল অনুভবের সাথে।

মেয়ের গর্জনের শব্দে ইশিতা কেঁপে উঠলো বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ইশিতার দৃষ্টি গেল নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকা মানুষটার ওপর।

আলোর ঝলকানিতে ইশিতা স্পষ্ট দেখতে পেল অনুরাগ বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে।

ইশিতার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছে অনুরাগ। আসলেই কি সে আমাকে ভালোবাসে?

ইশিতা অস্থির হয়ে উঠলো সে কিছুতেই অনুরাগ কে
এই অবস্থায় দেখতে পারছেনা। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না বারান্দায় গিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে বললো তুমি ফিরে যাও অনুরাগ।এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছো ?

বাড়ি ফিরে যাও।

না ইশিতা তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আমি কোথাও যাবো না।

এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।

পাগলামী করো না অনুরাগ ফিরে যাও।

আমি তোমার জন্য কবে থেকেই পাগল হয়ে গেছি। তাই তুমি আজকে এই পাগলের ভালোবাসা দেখবে।

মনের সাথে যুদ্ধ করে ইশিতা একটা ছাতা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই আনিসুল হক পথ আটকে দাঁড়ালো।




।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here