#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা
চেনা কন্ঠস্বর শুনে ইশা চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। আদি আওয়াজ করে ডাকে,
‘ সিস্টার?
সিস্টার দৌড়ে আসে। বলে,
‘ ইয়েস স্যার। এটিই সেই শিশুটির কেবিন। আদিশা খানম পরী। ডটার অব রিক রেজওয়ান খান।
ইশা পিছু ফিরে তাকাল না সাদা এপ্রোন পরিহিত ডক্টরটিকে দেখতে । ওড়না দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে ফেলল। ঘোমটা নামিয়ে দিল। এককোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
আদি চুপিচাপি হেঁটে ছোট্ট মেয়েটির পাশে বসল। তারমধ্যেই রিপ চলে আসল। রিপকে দেখে আদি হাসল। দুইজনই স্কুল লাইফের খুব ভালো বন্ধু। সময়, পরিস্থিতি,প্রয়োজনে দুইজন দুদিকে চলে গিয়েছিল । আজ নতুন করে পরিচিত হলো। আদি হেসে বলল,
‘ রিপ তোর ভাইয়ের মেয়ে ঠিক তোর মতোই কিউট।
রিপ হাসল। বলল,
‘ যাহ শালা। কিউট মিউট পরে দেখিস। আগে ট্রিটমেন্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ করতো আমার মা টাকে। ভালো লাগছেনা কিছুই। বাসায় ফিরতে মন চাইছেনা। পুরো বাসা খালি খালি লাগছে।
আদি হাসল। গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে একবার তাকায়। বলে,
‘ তুই কি এখানেই থাকিস? আই মিন আমাদের এলাকায়।
‘ তো আর কোথায় থাকব?
‘ দেশে কবে ফিরেছিস?
‘ এই তো কিছুদিন আগে।
আদি পরীকে দেখে বলে,
‘ মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। সিড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছে। কেউ দেখিস নি?
রিপ চুপ থাকে। কিছুই বলেনা।
ইশা মুখে ওড়না গুজা অবস্থায় ডুকরে কেঁদে উঠে। নীরবে,নিঃশব্দে। ঘুমন্ত মেয়েটির চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে। ওড়না ভিজে যায়। ছোট্ট মেয়েটির পাশে বসে থাকা মানুষটির প্রতি আজ কেন জানি তার রাগ লাগছে। কি অদ্ভুত? সে তো রাগে না। তার তো রাগ লাগেনা? কিন্তু আজ কেন এত রাগ লাগছে। এই মানুষটিই সবকিছুর জন্য দায়ী। সবকিছুর।
রিপ ইশাকে বলে,
‘ ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ইশু?
ইশা হকচকিয়ে যায়। আদি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
‘ পেশেন্টের মা বাবা কোথায়?
রিপ বলে,
‘ দাভাই আর ভাবি বাইরে আছে। ভাবির শরীর খারাপ লাগছে বোধহয়। মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে সে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
আদি মাথা ঝাঁকিয়ে ইশাকে মিন করে বলে,
‘ ইনি পেশেন্টের কে?
রিপ বলে,
‘ সে ফুপী।
আদি ঠোঁট গোল করে বলে,
‘ ওহহহ। আমি আর ও কতকিছু ভেবেছিলাম।
ইশা হকচকিয়ে যায়। এই লোক তো দেখছি তাকে চিনে ফেলেছে।
রিপের হাতে সিস্টার প্রেশক্রিপশন ধরিয়ে দেয়। রিপ বেরিয়ে পড়ে।
আদি সিস্টারকে বলে,
সিস্টার এই বাচ্চাটাকে রিলিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
সিস্টার বেরিয়ে যায়।
আদি চুপচাপ তার হাতে থাকা ফাইল কিছুক্ষণ ঘেটে দাঁড়িয়ে পড়ে। এককোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকায়। ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে থাকে। ইশা আদির এভাবে তাকানো দেখে ভড়কে যায়। পিঠ করে দাঁড়ায়। আদি হাত নেড়ে বলে,
‘ মিস ইশা। আপনি এভাবে মুখে কাপড় দিয়ে রেখেছেন কেন? আপনি সেই বৃষ্টি, আমি চিনতে পেরেছি কিন্তু!
ইশা চমকে পিছু ফিরে তাকায়। বলে,
‘ কিসের বৃষ্টি?
আদি হাসে। দেখে মেয়েটার মুখ থেকে কাপড় সরে গিয়েছে। ফোলা ফোলা চোখ। যেভাবে কেঁদেছে নিজের মেয়ের জন্য ও কেউ এভাবে কাঁদবে বলে মনে হয়না। আদির হাসি পায় মেয়েটার ঝকঝক করা চোখ আর নাক দেখে। বলে,
‘ কিসের বৃষ্টি মানে? মন কেমনের বৃষ্টি!
তাই নয় কি?
ইশা চোখ মেঝেতে নামিয়ে রাখে। ত্যাড়া জবাব দেয়,
‘ আপনার সাথে আমি কথা বলতে ইচ্ছুক নই। যেতে পারেন। আদি আয়েশ করে বসে পড়ে বেডের উপর। পরীর পাশে। বলে, যদি না যাই?
ইশা কিছু বলেনা। অন্যদিকে মুখ করে তাকায়। আড়চোখে পরীর নড়াচড়া দেখে। আদি ও তাকায়। পরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ হাই প্রিন্সেস!
ইশা দৌড়ে আসে। আদিকে ছুঁতে দেয় না। আদি এ প্রথমবার ছুঁতে গেল। পারল না। পরীর চোখের উপর হাত দিয়ে ঢেকে পরীকে কোলে নিয়ে নিল ইশা। পরী ইশার পিঠের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। পুরোটা সময় ধরে আদি হতভম্ব। ছুঁতে দিলনা কেন? বাচ্চাটাকে তার দিকে তাকাতে দিল না কেন?
ইশা কাঠ কাঠ জবাব দেয়।
‘ আপনি যেতে পারেন ডক্টর আদি চৌধুরী।
আদি অপমানবোধ করে। বলে,
‘ এক্সকিউজ মি!
ইশা ত্যাড়া জবাব দিয়ে বলে,
‘ আপনি বের না হলে আমি বের হয়ে যাব। আপনি বের হবেন নাকি আমি?
আদির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। লাল চোখে শাসিয়ে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে।
ইশা পরীকে নিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। এলোমেলো ভাবে কেঁদে দেয়। পরী তার ছোট ছোট আঙুল দিয়ে ইশার মুখে আঁকিবু্কি করে। ডাকে, ফিপি মিননি।
ইশার কান্না হাসি একাকার হয়। বলে,
‘ মিনি,,, মিনি আছে মা। বাসায় আছে। আমরা আর কিছুক্ষণ পর বাসায় চলে যাব।
পরী তার ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে তাকায় ইশার দিকে। ঠোঁট দেখিয়ে দেয়। কপালের ব্যান্ডেজ দেখিয়ে দেয়। নাক দেখিয়ে দেয়। তারপর বলে,
‘ উফফফ।
ইশা ও যেন ব্যাথা পেল। বলল, ব্যাথা পেয়েছে আমার মা?
পরী ঠোঁট বাঁকিয়ে মাথা নাড়ে। আঙুলে মোড়ানো ব্যান্ডেজ দেখিয়ে বলে, উফফফ।
গোলগাল ঠোঁট দুটো ফুলাতে দেখে ইশা হেসে দেয়। বলে,
‘ এইটা কি আমার মা?
পরী ইশার গালে গাল লাগিয়ে রাখে। অনেকক্ষণ পর ঠোঁট তার গালে একবার লাগায়। আরেকবার তুলে। ছন্দ মিলিয়ে ডাকে,
আমমমমা ।
আমমমমা।
আমমমমা।
ইশার চোখ বেয়ে উপচে পড়া খুশি ঝড়ে পড়ে। প্রত্যেকটা চোখের জল বলে দিচ্ছে এই জল কষ্টের নয় আনন্দের।
___________________
মুনা দৌড়ে আসল পরীর কাছে। পরীকে কেড়ে নেয় ইশার হাত থেকে। পরীকে এলোপাথাড়ি আদর করে বলে,
‘ সব আমার দোষ। আমার ভুলের কারণে ও এত ব্যাথা পেয়েছে। আমাকে ক্ষমা কর মা।
পরী মুনার দিকে তাকিয়ে থাকে। আঙুল দিয়ে মুনার নাকে টোকা দেয়। গাল লাগিয়ে বলে,
‘ মাম্মা, মিননি।
মুনা হাসে। পরীকে আদর দিয়ে বলে,
‘ মিননি বাসায়। এক্ষুণি যাব মিননির কাছে।
রিক দূরে দাঁড়িয়ে দেখে পরীকে। পরী দেখার সাথে সাথে ডেকে উঠে,
‘ পাপপা। মিননি।
রিক এগিয়ে আসে। মেয়েকে কোলে নেয়। শক্ত করে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। পরী ও মাথা ফেলে রাখে বাবার ঘাড়ে। বলে,
‘ পাপপা মিননি।
রিক পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে,আমরা যাব তো মিননির কাছে। মিনি তো তোমার উপর রেগে আছে। তুমি মিননিকে মেরেছ! মিনি তোমার সাথে কথা বলবে না।
পরী চেপে ধরে রিককে। রিকের শার্টের কলার টেনে ধরে জোরে। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। রিক কান্না থামানোর জন্য বলে ,
‘ না,না পাপা মজা করেছি। মিননি কথা বলবে তোমার সাথে। মিননি ভালো। পরী ও ভালো। গুড গার্ল।
পরী কান্না থামায়। রিকের মুখে হাত দিয়ে টোকা দিতে দিতে মুখ লাগায়। আদর করে ডাকে,
‘ পাপপপা।
রিক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরীকে। এমনভাবে ধরেছে যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে। তার শক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ আজ কেন জানি খেয়াল করল তার দুচোখ হঠাৎ করে ভিজে উঠছে। পরী তার মেয়ে। তার ভবিষ্যৎ। তার রাজকন্যা। তার অংশ। কারো নয়।
দূরে দাঁড়িয়ে ইশা হাসে ও আবার কাঁদে ও। হঠাৎ তার মনে হলো পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যে মধ্যে বাবা মেয়ের ভালোবাসার দৃশ্যটি ও একটি। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য!
সবাই এগিয়ে যায়। পিছু পিছু ধীরে ধীরে হাঁটে ইশা। কত ভাবনা তার মাথায়?
রাগ মাথায় আদি কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। সোজা আজ বাড়ি ফিরবে। সিস্টার দৌড়ে আসে। বলে,
‘ স্যার আর ও পেশেন্ট বাকি আছে। আপনি বাসায় চলে যাচ্ছেন?
আদি উত্তর দেয়না। বলে,
‘ আমি চলে যাচ্ছি না। আমি ছুটি নিয়েছি।
সিস্টারকে কোনোকিছু বলতে না দিয়ে আদি গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে আসে। মাথায় রাগ চেপে বসে আবার ও। ওই মেয়েটিকে দেখে। যথাসম্ভব সে রাগ চেপে রাখে। ইশা ভড়কে পিছু টলে। সাইড দেয় আদিকে।
আদি দাঁড়িয়ে পড়ে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ইশার দিকে। ইশা ঢোক গিলে। বলে,
‘ কি,?
আদি চোয়াল শক্ত করে শুধু তাকায়। কিছু বলেনা। বলার প্রয়োজন মনে করেনা।
ইশা তার এভাবে তাকানো দেখে বলে,
‘ বুঝতে পারছেন না কি বলবেন? হুমকি দেবেন নাকি ধমক দিবেন?
আদি তারপর ও চুপ থেকে চেয়ে থাকে। ইশা তারপর আবার হাসে। বলে,
‘ ডক্টর আদি চৌধুরী আপনি কি জানেন আপনাকে কেউ পড়তে জানেনা?
আদি এবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
বলে,
জানি, আমি এতেই ইনজয় ফিল করি। আমাকে কেউ পড়ুক সেটা আমি লাইক করিনা।
ইশা ঠোঁট চেপে আবার ও হাসে। বলে,
‘ আপনি নিজেকে ও পড়তে জানেন না মিঃ চৌধুরী।
আদি এবার দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে বলে,
‘ আচ্ছা?
ইশা বলে, জ্বী।
আদি আচমকা ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। ইশা চমকায়। আদি গলার আওয়াজ নিচু করে জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনি পারেন?
ইশা পিছু হাটে। আমতাআমতা করে বলে,
‘ আমি কিভাবে পারব? পারিনা আমি।
আদির রাগ যেন কোথায় উঁবে যায়। সে হেসে উঠে। বলে,
‘ ইউ টু মাচ লায়ার। তবে এই মিথ্যে বলার শাস্তিটা ও আছে। খুব শীঘ্রই পাবেন। আমি দেব। নিজ হাতে।
ইশা অন্যরকম ভাবে বলে,
‘ যদি বলি পারি। তারপরে ও কি শাস্তি দেবেন?
আদি যেন এবার চুপ হয়ে যায়। চিন্তায় পড়ে যায়। উল্টো প্রশ্ন করে বসে,
‘ সত্যি পারেন?
ইশা মজা করে বলে,
‘ খুববববব।
আদি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ইশার দিকে। কথা ঘুরিয়ে বলে,
‘ আপনার নাম বৃষ্টি হলে ভালো হতো।
ইশা হাসে। বলে,
কেউ একজন আমাকে সেই নামে ডাকে। আপনি ডাকবেন না প্লিজ।
আদি ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায়। বলে,
‘ ওহহহ। ভালো। ভালো। ক্যারি অন।
আপনাকে আমি কোনো নামেই ডাকব না। প্রয়োজন মনে করছি না।
ইশা দুষ্টুমির ছলে বলে,
‘ আচ্ছা। তাহলে অনামিকা ডাকুন। কারণ যার নাম নেই তার নামই তো অনামিকা।
আদি চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
‘ কিছুক্ষণ আগের মিসবিহেভ আমি ভুলিনি কিন্তু?
ইশা ও তাল মিলিয়ে বলে,
‘ আমি ও ভুলিনি।
আদির রাগ উঠলে ও সে ভান ধরে তার একদম রাগ নেই। বলে,
‘এটুকুনি একটা মেয়ে , এত মুখে মুখে কথা বলেন কেন?
ইশা বলে,
‘ এটুকুনি মেয়েটাই অনেক কিছু পারে। যেমন ধরুন, আপনার চাইতে ও বড় বড় ডক্টরের মতো বড় বড় রোগ সেড়ে ফেলতে পারে। মাত্র কয়েক দেখায় আপনার মতো একজন ডক্টরকে প্রেমে ও ফেলে দিতে পারে। সেই প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ও ফেলতে পারে। আর এমনভাবে মারে যে সেই বেচারা এমন ভান ধরে যে সে বেঁচে আছে। আসলে তো তা নয়। সে অলরেডি মৃত। আপনার মতো। অ্যাম আই রাইট মিঃ চৌধুরী?
আদি পকেটে হাত পুরে দাঁড়ায়। চোখমুখ উঁচিয়ে বলে,
‘ কথাগুলো কি আপনি বলেছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক।
ইশা গলা কাত করে একপাশে। বলে,
‘ আচ্ছা?
আদি মাথা নাড়ায়। বলে,
‘ আদি এসব প্রেমে ট্রেমে কখনোই পড়েনা। মরা তো বহুদূর। আপনি যে ডক্টরের কথা বলছেন ওনি বোধহয় সফট হার্টের একজন। তাই পড়ে ও। মরে ও। আমি তেমনটা নয়। আমাকে তার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না।
ইশার মনে হলো শেষের কথাটায় কিছুটা রাগ মেশানো ছিল। তার হাসি পেল। বলল,
‘ অনেক আগেই গুলানো হয়ে গেছে। আর সেই গুলানো জল খাওয়া ও হয়ে গেছে। এবার শুধু,,,,,
আদি ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘কি?
ইশা গলা কেটে ফেলার মত করে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, ফিনিশ।
আদি আওয়াজ করে হেসে উঠে। বলে,
‘ আপনার ডক্টরের সাথে মিট করতে চায়। কিছু সাজেশন দিতে হবে। বেচারার জন্য সত্যিই আফসোস হচ্ছে। ইশশশ।
ইশা ঠোঁট কামড়ে হাসে। এগোতে এগোতে বলে,
‘ আমার ও কষ্ট হয়েছিল। এখন হয়না। কষ্ট দিতে ভালোই লাগে।
‘ আচ্ছা?
‘ জ্বী।
ইশা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। আদি ভ্রু কুঞ্চন করে তাকায়। কিছু একটা ভেবে সে ও উঠে পড়ে। ইশাকে চেপে বসতে দেখে সে আর ও আয়েশ করে বসে। বলে,
‘এত বড় স্পেস দেওয়ার জন্য থ্যাংকস।
ইশা আদির দিকে তাকায়না। মুখ অন্যদিকে করে রাখে। এ লোকটা চাইছেটা কি? হুট করে তার মনে হলো এই লোকটা একসময় তাকে ছাড়া পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার দেখত। আজ তাকে ছাড়া সে পৃথিবীটা রঙিন দেখে। একসময় মিষ্টি মেয়েটি তার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল অথচ আজ এতটা কাছাকাছি থেকে ও কতটা দূরে। আজ তার খুব করে মনে হচ্ছে,সে ডক্টরের প্রিয়জন নয়, প্রয়োজন হয়েছিল। সে ভালোবাসলে ও ডক্টর তাকে ভালোবাসেনি। ক্ষণিকের মোহে আটকা পড়েছিল। তার রোগটিই তাকে মিষ্টির প্রতি দুর্বল করে দিয়েছে। নয়ত কিছু নয়। এই ভালোবাসা নামক শব্দটা যায় না মিষ্টি আদির সাথে। আজ তার খুব অনুশোচনা হয় সে কেন বিয়ে করতে গেল ডক্টরকে?
সে কেন ভালোবাসতে গেল ডক্টরকে?
সে কি এর চাইতে ও ভালো কিছু ডিজার্ভ করত না। রিপদাকে কি বলবে সে? রিপদাকে কি করে মুখ দেখাবে? রিপদার বিশ্বাস ভরসায় সে এমনভাবে আঘাত করেছে যে আঘাত সামলানোর শক্তি রিপদার নেই। কি হবে? এই কি হবে শব্দটা ক্ষণে ক্ষণে তাকে কাঁপিয়ে তুলছে। সে খেয়াল করল তার হাত খপ করে ধরল কেউ। আবার ছেড়ে দিল। বলল,
‘ সাবধানে বসুন। পড়ে গেলে তো আমার দোষ দেবে সবাই। বলবে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি।
ইশা হাত সরিয়ে আবার হাতটার দিকে তাকায়। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।
পুরো রাস্তা দুজনের নীরবতায় কেটে গেল। কি আশ্চর্য! কিছুক্ষণ আগেই যে দুজনের বকবকানিতে মানুষ বিরক্ত হচ্ছিল তারা পুরোটা সময় কেন এত নিশ্চুপ?
খান বাড়ির সামনেই রিকশা থামাতেই ইশা নেমে পড়ে তাড়াতাড়ি। রিকশার শিকের সাথে ওড়না লেগে যায়। তাড়াহুড়ো করার দরুন সে ওড়না এক টান দেয়। ওড়না ছিড়ে যায়। আদি পুরোটা সময় নীরব হয়ে দেখল। যখনি কিছু বলতে যাবে তখনি ইশা রোষাগ্নি হয়ে বলল,
‘ সময় পাল্টেছে। তিন বছর আগের সেই আপনি পাল্টেছেন। তাই আমি ও নিজেকে না পাল্টে রাখতে পারিনি। আমি ও পাল্টেছি। সবকিছু পাল্টেছে। আর আপনাদের মতো বিশাল ভূসম্পত্তির অধিকারী তথা চৌধুরী বাড়ির ছেলেদের পক্ষে কোনোকিছুই অসম্ভব না। তারা সবকিছু করতে পারে। একজনকে ঘরের বউ সাজিয়ে রাখতে পারে। অন্যজনকে রক্ষিতা বানিয়ে রাখতে পারে। মিঃ আফি চৌধুরী যার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। আমি এই ধরণের লোকগুলোকে আর একফোঁটা ও বিশ্বাস করিনা। আপনার সাথে এতটুকু রাস্তা এলাম। বিশ্বাস করুন আমার একটু ও ভালো লাগেনি। দমবন্ধ লেগেছে পুরোটা পথ। নেক্সট টাইম থেকে আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন। কে জানে কখন আপনাকে আমার ফাঁদে ফেলে দিই?
আদি অবাকের উপর অবাক হলো। বিস্ময় চরম পর্যায়ে পৌছাল। মেয়েটি যদি খেয়াল করত তাহলে বুঝতে পারত তার চোখজোড়ায় অসংখ্য রাগ,ক্রোধ,বিদ্বেষ ঝড়ে পড়ছে। ইশা বেশ অনুরোধের সুরে বলে,
‘ আমাকে প্লিজ এড়িয়ে চলবেন। কারণ আমি পারব না। প্লিজ।
অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ইশা ডুকে যায় গেইটের ভেতর। একটিবার ও তাকাল না পিছু। শুধু তার কানে ভেসে আসে,
‘ আপনি কেন পারবেন না মিস ইশা?
ইশা দৌড়ে ডুকে পড়ে বাড়িতে। সামনাসামনি হয় তালহা বেগমের। তার কোলে কান্নারত পরী। কাঁদছে রিক তাকে তালহার কোলে দিয়ে দেওয়ায়। ইশা ব্যাগ সোফায় রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পরীর দিকে। হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় পরীকে। পরী তার কোলে ঝাপ দিয়ে কেঁদেকেটে বলে,
‘ ফিপফি পাপপা। পাপপা।
ইশা পরীকে চেপে ধরে তার বুকে। বলে,
পাপা আসবে।
পরী তারপর ও কেঁদে যায়। পানিতে টুইটুম্বুর চোখজোড়া আড়াল করতে ইশা পরীকে নিয়ে তার ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। পরী ইশার চুল বেশ জোরে টেনে ধরে।
সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে, পাপপা।
ইশা এবার ডুকরে কেঁদে দেয়। পরীকে নিজের বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলে,
সবাই আঘাত করে আমায়। তুই ও ছাড়লি না। তুই ও সবার মত স্বার্থপর।
রিপ দৌড়ে আসে পরীর কান্নার আওয়াজ শুনে। কোলে তুলে বলে,
‘ এক্ষুণি হসপিটাল থেকে এল। আর তুই ওঁকে কাঁদাচ্ছিস ইশু?
ইশা চোখ মুছে বলে,সবার চোখের জলের মূল্য আছে। শুধু আমার নেই রিপুদা। কারো কাছে নেই।
রিপ পরীকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। অবাক হয়ে বলে,
‘ এসব কি বলছিস ইশু? এই তুই কি কাঁদছিলি?
ইশা অন্যদিকে মুখ করে বলে,
‘ না কাঁদছিনা। আমার কাঁদা বারণ। কে বলেছে আমি কাঁদছি?
_____________________________
অনেকদিন পর ভাইয়ের সাথে আড্ডায় বসেছে আদি। তার দাভাইয়ের আচার ব্যবহার স্বভাব চরিত্র সব তার বিপরীত বলে জানে সে। কিন্তু আজ তার হুট করে মনে হচ্ছে তার দাভাইয়ের মতো হওয়া উচিত তার। তেমনটা হলে কেউ তাকে অত কথা শোনাতে পারত না। পারবে না। যেমনটা আজকাল ওঁকে শুনতে হচ্ছে। সহ্য ও করে নিতে হচ্ছে। আফি বেজায় খুশি ভাইকে তার সাথে তাল মিলাতে দেখে। দুই তিনবার খেলায় হেরে গিয়েছে আদি। আফি হেসে বলে,
‘ আদি এসবে প্র্যাকটিস থাকা লাগে ভাই। তুই তো এসব ছুঁয়ে ও দেখিস না। পারবি কেমনে?
আদি তেজ নিয়ে বলে,
‘ আদি সব পারে। এটা ও পারবে।
কিন্তু আদি নিজেই তার কথা মিথ্যে প্রমাণ করল। পরপর অনেকবার হেরে গেল আফির কাছে। আফি হেসে কুটিকুটি। আদি ও হাসে। হেসে বলে,
‘ দেখবে কাল আমি তোমাকে ঠিকই হারাব। আজ আমার মাথা ঠিক নেই। তাই পারছিনা।
আফি আদির দিকে বোতল এগিয়ে দেয়। বলে,
‘ এক চুমুক খা। জিতে যেতে সাহায্য করবে।
আদি চোখ তুলে তাকায় আফির দিকে। বলে,
‘ আমি মদ খাইনা দাভাই।
আফি হাসল। বলল,
‘ তাহলে হেরে যেতে থাক।
আদি চুপচাপ জুয়া খেলায় মনোযোগ দেয়। কিন্তু সে টোটালি মন বসাতে পারছেনা। শেষমেশ আফির জিত হলো। আফি হো হো করে হেসে পুরো ঘর মাথায় করল। আদি চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পর মদের বোতলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে
‘ আমি ট্রাই করি একবার।
আফি হেসে এগিয়ে দেয় বোতল। আদি এক ঢোকে অর্ধেকটা শেষ করে। বলে,
‘ এবার আমি জিতব দাভাই।
আফি হেসে বলে, ‘ তাহলে খেলা যাক।
খেলা মাঝপথে। আদির মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। সে আগের মতো ও একদম পারছেনা খেলা করে উঠতে। মাথা চেপে ধরেছে একহাতে। বোতলটা কেড়ে নিল আফির হাত থেকে। মাঝপথে খেলা রেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। টালমাটাল ভাবে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। আলিয়া আদিকে নিজের রুমে না দেখে আফির রুমের দিকে এগোয়। আদি বলে ডেকে ডেকে এগোতেই আদি তার সামনাসামনি এসে পড়ে। হাতের মদের বোতলটি আড়াল করে ফেলে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আলিয়া বেগম জোরে আওয়াজ করে বলে,
‘ হাতে কি আদি? আমার দিকে তাকাও।
আদি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আলিয়ার চিৎকারে আজিজ ও চলে আসে। বলে, কি হয়েছে? এত চিৎকার চেঁচামেচি কেন?
আদি মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের বোতলটি সবার সামনে দৃশ্যমান করে এক ঢোকে সব খেয়ে নিয়ে বোতলটি দূরে ছুড়ে ফেলে। বলে,
‘ এত চেঁচামেচির কি আছে। দাভাই তো রোজ খাই। আমি আজ খেলাম। এবার থেকে রোজ খাব।
সপাটে চড় বসায় আলিয়া আদির গালে। আজিজ চেঁচিয়ে বলে,
‘ কি করছ লিয়া। গায়ে হাত তুলছ কেন?
আলিয়া ফোঁপাতে থাকে রাগে। বলে,
‘ তুমি নিজেই সবাইকে মদ না খাওয়ার জন্য জ্ঞান দিয়ে বেড়াও। আর তুমিই মদ খেয়ে বেড়াচ্ছ?
আদি কারো কথা শোনেনা। সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ধপ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। আফি বেরিয়ে আসে হাসতে হাসতে। বলে,
‘ আবার আমার দোষ দিওনা মা। আমি কিছুই করিনি কিন্তু। আদি নিজেই এসেছে আমার কাছে।
আলিয়া রক্তিম চোখে চেয়ে থাকে আফির দিকে বলে, বাড়িতে তোমার একটা ছেলে ও আছে আফি। তোমার সেদিকে খেয়াল নেই? ও কি শিখবে তোমার কাছ থেকে?
আফি হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে,
‘ যা দেখছে তাই শিখবে।
আলিয়া বেগম তেড়ে যাওয়ার আগেই আজিজ চৌধুরী আটকায় তাকে। বলে, শান্ত হও লিয়া। আমরা সকালে আদির সাথে কথা বলব। চলো।
আফি হো হো করে হাসতে নিজের রুমে চলে যায়।
____________________________
এলোমেলো হয়ে বিছানা থেকে উঠেই বাজতে থাকা ফোনটি হাতে নেয় আদি। ফোন ধরে বলে,
‘ কে?
ওপাশ থেকে আইমি বলে,
‘ কে মানে? কি হয়েছে আদি? কখন থেকে ফোন করছি। তুমি ফোন তুলছ না কেন?
আদি খানিকক্ষণ পর তার উত্তরটা দেয়। বলে,
‘ ঘুমাচ্ছি।
আইমির রাগ লাগে। বলে,
‘ ফোন দিয়ে যাচ্ছি সেই কখন থেকে। আমি টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম।
আদি হাসে। বলে,
আদির জন্য তুমি কেন টেনশন করছ? কে তুমি?
আইমি অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে বলে,
‘ আদি ড্রিংক করেছ?
আদি মাথা চেপে ধরে উঠে বসে। বলে,
‘ হ্যা করেছি। তুমি করবে?
আইমি রেগে ফোনটা কেটে দেয়। কেটে দেওয়ার আগে বলে,
‘ হেইট ইউ আদি।
আদি ফোন রেখে হো হো করে হাসে। বলে,
‘ ইমি রাগ করেছে ?
কিছুক্ষণ পর আবার কল আসে তার ফোনে। আদি ফোন রিসিভ করে আবার কানে দেয়। বলে, ইমি আর করব না। আর খাব না।
আইমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
‘ তুমি কেন ড্রিংক করেছ আদি। তুমি তো এমন না। নিশ্চয় আফি ভাইয়া দিয়েছে। তাই না?
আদি বলে,
‘ না,আমি ইচ্ছে করে খেয়েছি। আমার ভালো লাগছে।
আইমির প্রচন্ড রাগ হয়। বলে,
‘ আমার ঘেন্না হচ্ছে আদি।
আদি চুপ থাকে। বলে,
‘ তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আমি ও তোমায় ঘৃণা করব। তুমি আমায় ভালোবাসলে আমি ও তোমায় ভালোবাসব। তুমি দূরে চলে গেলে আমি ও দূরে চলে যাব। ইমি তুমি চলে যাবে?
ফোনের ওপাশ থেকে শুধু ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসে। কিছুক্ষণ পর ফোন আপনাআপনি কেটে যায়।
আদি ভার ভার মাথা নিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। চোখ ছোট ছোট করে তাকায় বেডের উপর সাজানো পুতুলটার দিকে। পুতুলটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে বোধহয়। আদি এগিয়ে যায় বিছানার দিকে আবার। বালিশের নিচে পড়ে থাকা লাল বেনারসিটি টেনে বের করে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অপলক। শাড়ির ভাঁজ খুলে ধীরে ধীরে । তার রাখা কাগজটি হাতে নেয়। কাগজটির লেখাগুলো ঠিক ওই আলব্যামের পাতায় পাওয়া লেখাটার মতো। মিষ্টি মেয়েটা কত চালাক? কাগজটি মেলে ধরে সে। কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখেনি চিঠিটা। কারো নাম উল্লেখ করেনি। শুধু লিখেছে,
আলব্যামের পাতায় থাকা সব চিরকুট ফেলে দেবেন। আর এই নাম্বারে ফোন দিয়ে আমাকে জানাবেন। আমি অপেক্ষায় থাকব।
ইতি মিষ্টি।
আদি ফোন নাম্বারটা দেখে হাসে।
________________________
মিনু ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ইশা ফোন তুলে। বলে, কেমন আছ মিনুমা।
মিনু বলে,
‘ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
ইশা জবাব দেয়।
‘ ভালো আছি। বাড়ির সবাই কেমন আছে?
‘ ভালো আছে।
খানিকক্ষণ পর মিনু নিজ থেকে বলে
‘তোর ডক্টর ও ভালো আছে।
ইশা নিঃশব্দে হাসে। বলে,
‘ জানি। ভালো রেখেছি আমি তাকে। থাকার কথা।
‘ কতটা ভালো রেখেছিস?
‘ যতটা ভালো থাকলে মিষ্টিকে ভুলে থাকা যায়। আমি তো তার কাছে স্ত্রীর অধিকার নিয়ে ফিরে যাইনা। সে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। আমি ও দিয়েছি। আমি ও ভালো আছি। সে ও ভালো আছে।
মিনু চুপ থেকে শোনে ইশার কথা। বলে,
‘ সে কেমন আছে?
ইশা চমকায়। বলে,
‘ কে মিনুমা? কার কথা বলছ?
মিনু কন্ঠে সামান্য রাগ এনে বলে,
‘ তুই ভালো করে জানিস আমি কার কথা বলছি। মিথ্যে বলার চেষ্টা করবি না। নিজেকে খুব নির্দোষ মনে করিস তাই না?
ইশা অসহায় জিজ্ঞেস করে,
‘ তুমি এভাবে কেন বলছ মিনুমা? আমার দোষটা কোথায়?
মিনুর সোজা জবাব,
‘ তোর দোষ তুই তাকে ছেড়ে গিয়েছিস। তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিস। তুই নিজের দোষে নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস। তুই একটিবার ভেবে দেখ,তুই ঠিক কতটা অসহায়। কেউ নেই তোর। তুই নিজের অস্তিত্বটাকে ও বিক্রি করে দিলি। তুই নিঃস্ব।
চেপে রাখা কষ্ট, আড়াল করে রাখা যন্ত্রণাগুলো, আজ আবার হঠাৎ করে ফুঁসে উঠল ইশার। সে তাকাল আশেপাশে। সত্যিই সে একা। ভীষণ একা। দূর থেকে একটা ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। কান্নার আওয়াজটি শোনে ফোনের ওপাশে থাকা মিনু। বলে,
‘ তুই এত কাছে থেকে ও শুনতে পারছিস না? অথচ দেখ আমি শুনতে পাচ্ছি। সে তোকে ডাকছে। তার মাকে ডাকছে। কি করে তুই তাকে দূরে ঠেলে দিতে পারলিরে ইশা মা। দেখ কিভাবে সে মায়ের বুক খুঁজছে। কিভাবে মায়ের আদর খুঁজছে। কিভাবে মাকে ডাকছে। মায়েরা তো সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তুই কিভাবে সহ্য করছিস? তোর কি একটু ও কষ্ট হচ্ছে না? এতটা নির্দয় কি করে হতে পারলি তুই? একটিবার শোনার চেষ্টা কর। একটিবার বুঝার চেষ্টা কর সে তোকে ডাকছে। তার মাকে ডাকছে। তুই তার মা ইশা।
ইশা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,
‘ মিনুমা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব। আমাকে মামি ডাকছে বোধহয়।
মিনু ফোন রেখে দেয়। বলে,
‘আমি পারিনি চিরকুট গুলো ফেলে দিতে। আমি তোর লিখে পাঠানো কাগজটি আদি বাবার রুমে রেখে এসেছি। এটুকু অন্যায় আমি করলাম। আমাকে তুই ক্ষমা কর। আমি তোকে এ বাড়ির বউ হিসেবে চায়। যেকরেই হোক চায়।
ইশা ফোন রেখে দিয়ে বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়। চোখ বেয়ে আজ সে জল গড়াতে দিচ্ছে না। তারপর গড়িয়ে চলছে। কি আশ্চর্য! চোখের জলগুলো এত বেহায়া হয় কেন? দিনশেষে সব দোষ তার ঘাড়ে কেন? সে কেন বারবার দোষী হয়? তার অবস্থা কেউ কেন বোঝার চেষ্টা করেনা। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তার হঠাৎ ঘুম লেগে আসে। সে পাড়ি জমাতে পা দেয় ঘুমের রাজ্যে। হঠাৎ আচমকা ফোনকলের আওয়াজে আবার তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বুক ধড়ফড় করে উঠে। বুকে হাত দিয়ে সে ঘনঘন শ্বাস নেয়। দ্রুতগতিতে ফোন রিসিভ করে ফোন কানে দেয়। বলে,
‘ হ্যালো ।
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। ভেসে আসে সুপরিচিত নিঃশ্বাসের শব্দ। ভেসে আসে মৃদুমধুর শ্বাসপ্রশ্বাসের ঢেউ। ভেসে আসে খুব সুন্দর একটি ডাক,
‘ মিষ্টি………….
সাথে সাথে সাদা সাদা ফোঁটা ফোঁটা জলের নহর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এবার সরাসরি। কতগুলো দিন পর সে এই ডাকটি শুনল। কতগুলো মাস। কতগুলো মুহূর্ত পর। কত প্রতীক্ষার পর। কত অপেক্ষার পর। আর একটিবার কেন সে ডাকটি ভেসে আসছেনা। কেন ডক্টর আবার ও মিষ্টি বলে ডেকে উঠছে না?
উত্তেজনায় মেয়েটির পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এই ডাকটিতে নিশ্চয় কিছু একটা আছে। যদি আর ও একবার ডাকত?
চলবে#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
মৃদুমৃদু নেশায় টলতে থাকা আদি পুতুলটির উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বিছানায়। লাল বেনারসিটি এক হাতের মুঠোয়। ফোনের ওপাশের মেয়েটি পুরোটা সময় থাকে নীরব। শুধু শুনতে পায় ছেলেটির অস্ফুটভাবে বলা দু একটা শব্দ। কানে বাজে যা অবিরত।
‘মিষ্টি……..
ইশা ফোন কানে চেপে বসে থাকে আর ও একটিবার মিষ্টি ডাকটি শোনার অপেক্ষায়। একপাশে কাত করে শোয়। চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ায় কানের কাছে। মিষ্টি করে হেসে সে উচ্চারণ করে,
‘ ডক্টর?
কি আশ্চর্য ওপাশ থেকে শুধু ভেসে আসে নিঃশ্বাসের শব্দ। ইশা হেসে উঠে। ডক্টর ঘুমিয়ে পড়েছে?
পরক্ষণে তার মনে হয় ডক্টর তো প্রত্যেকটা রাতে আইমির সাথে কথা বলে এভাবেই ঘুমোয়। এ আর নতুন কি? হয়ত আজ ও ঠিক সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তো এমনিতেই ফুরিয়ে আসছে। এভাবেই না হয় কিছুক্ষণ ডক্টরের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে আলাপ করা যাক।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজে ও জানেনা। যখনি তার ঘুম ছুটে গেল তখন ফজরের আযান ভেসে আসছে। পাশে পড়ে থাকা ফোন দেখে সে ধড়ফড় করে উঠে। ফোনের স্ক্রিন জলে উঠতেই দেখে এখনো কানেক্ট। অজ্ঞাত বশত সে ফোন কানে দেওয়া মাত্রই উচ্চারণ করে,
‘ ডক্টর?
সাথে সাথে ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি ঘুম ঘুম কন্ঠে ভেসে আসে একটি শব্দ আবার।
‘ মিষ্টি…..
চোখের জলের সাথে হাসিটা বিস্তৃত হয় ইশার। সে আর কোনোকিছুই বলতে পারেনা। তার আকাশকুসুম কল্পনায় জল ঢেলে দেয় পুরুষালী কন্ঠে ভেসে আসা আর ও একটি কথা।
‘ কে আপনি?
ইশা মুখের বিস্তৃত হাসি ধীরে ধীরে নিভুনিভু হয়ে যায়। হাত কেঁপে উঠে তার। গলা ধরে আসে তার। কি হচ্ছে তা ভেবে উঠতে, বুঝে উঠতে সময় লাগে। যখনি তার বোধগম্য হয় আপনাআপনি তার ফোন হাত থেকে খসে পড়ে।
আদি সেভাবেই বলে যায়,
‘ কে আপনি? কথা বলুন। কে হন আপনি আমার?
ইশা হাত দিয়ে ফোনটি চেপে ধরে। যাতে আওয়াজ না আসে। কিন্তু চাপ পড়ায় ফোনটি লাউড স্পিকার হয়ে যায়। ভেসে আসে আবার ও সেই কন্ঠের আওয়াজ।
‘ আনসার মি। কে আপনি? কার কাছে আপনি চিঠি পাঠিয়েছেন। চৌধুরী বাড়ির সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
খাঁচায় থাকা মিনি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ডেকে উঠে,
‘ আদি। আদি। মিস ইউ। মিস ইউ।
ইশা সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়। এলোমেলো সুরে কেঁদে বলে, স্টপ মিনি। তুমি আমার এত বড় ক্ষতি কেন করছ?
ফোন কেটে যাওয়ায় আদির মেজাজ চটে যায়। সে স্পষ্ট মিনির ডাক শুনতে পেয়েছে। তার মানে এই মেয়েটির কাছে মিনি আছে। এই মেয়েটিই মিষ্টি। কিন্তু কে সে? কেন সে লুকিয়ে থাকে?
এতসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সে আবার ফোন দেয় সেই নাম্বারে। শেষমেশ বিজি দেখায় সেই নাম্বার। আদি মাথা চেপে ধরে জোরে। কাল রাতের কথা মনে হতেই তার নিজের উপর রাগ লাগল। মাথা ভার ভার লাগল। তার সব রাগ, ক্রোধ গিয়ে পড়ল ওই মেয়েটার উপর। মেয়েটার নাম কি যেন? ও হ্যা ওই ইশা নামের মেয়েটির উপর। মেয়েটির সাহস কত? তাকে অত বড় বড় কথা শুনিয়ে দিল। নিজেকে কি মনে করে সে? আদিকে যে পড়তে আসে সে নিজেকে ও পড়তে ভুলে যায়। মেয়েটি কি তা জানেনা? না জেনে, না বুজে মেয়েটি কেন বারবার তাকে হেয় করছে। কেন আদিকে পড়ার চেষ্টা করছে? কেন এমন ভাব নিচ্ছে যেন সে আদিকে পড়ে ফেলেছে। যেখানে আইমিই আদিকে পড়তে জানেনা সেখানে ওই মেয়েটি কি করে পারবে? মেয়েটি ভুল। মেয়েটি আদিকে পড়তেই জানেনা, কিন্তু তারপর ও কেন আদির ভয় হচ্ছে?
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আদি ঠিক যেভাবে মাথায় দু হাত চেপে বসেছিল ঠিক সেভাবেই আছে। কোনো নড়চড় নেই। যখনি পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রেহান,রাইনার গলার আওয়াজ ভেসে আসছে তখনি তার হুশ ফিরল। নিজের বিছানার এই অবস্থা দেখে সে ভড়কে গেল। পুতুলটিকে নিজের জায়গায় রেখে দিল। লাল শাড়িটিকে বালিশের নিচে চাপা দিল। ছোট্ট কাগজটি একবার দেখে নেয়। চাপা উত্তেজনা নিয়ে আলব্যামটি ঝাড়তে থাকে। যতই ঝাড়তে থাকে, একের পর এক পড়তে থাকে কাগজের টুকরো। পড়ে একটি শুকনো বকুল ফুলের মালা আর কয়েকটি শুকনো বকুল ফুল।
বিস্ময় চোখে আদি শুধু চেয়ে থাকে সেই টুকরো টুকরো কাগজগুলো, বকুল ফুল আর মালাটির দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতে সে তুলে নেয় একেকটি কাগজের টুকরো। তুলে নেয় সেই বকুল ফুলের মালা। শাড়িতে লেগে থাকা সুবাস বকুল ফুলগুলো থেকে ভেসে আসছে। চোখ বন্ধ করে হতাশ ভঙ্গিতে সে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
পরক্ষণে চোখ আটকে যায় তার আলব্যামের পাতায় তার কাঁধে মাথা রাখা হাসিমুখের মেয়েটির দিকে। অস্ফুস্বরে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘ ইমি……..
___________________
রান্নার কাজে রাইনাকে সহযোগীতা করছে মিনু। এ বাড়িতে এই একটি মেয়েই মিনুর ভালোলাগার মানুষ। এই মেয়েটার সাথে মনপ্রাণ খুলে সব শেয়ার করা যায়। মিনু তাই করে। ইশার সাথে বলা কথা শুনে রাইনা প্রচন্ড খুশি হয়েছে। এমনকি এ ও বলেছে যে সে নিজেই ইশার সাথে কথা বলবে। কত বছর পর ইশার গলা শুনতে পারবে। মেয়েটা ভালো আছে তো?
মিনু কাজে ব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,
‘ আদি বাবার যদি সব মনে পড়ে যেত? ইশার ছোট্ট সুন্দর একটি সংসার হতো। মেয়েটা ছোট থেকেই নিঃস্ব।
রাইনা মনোযোগ দিয়ে শোনে মিনুর কথা। বলে,
‘ মিনুমা ইশাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে খুব। শুধু একটিবার যদি দেখতে পেতাম?
মিনু হাঁফ ছেড়ে বলে,
‘ দেখে কি করবি? সে কি আগের ইশা আছে? সে এখন আমাদের থেকে পালাতে চায়। জানিনা কি হবে?
দুজনের কথা শেষ হতে না হতেই আদির গলার আওয়াজ শোনা যায়। দুজনই বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।
টেবিলের দিকে এগোতেই আদির গলার আওয়াজ এবার স্পষ্ট শুনতে পায় তারা। আদির হাতের লাল শাড়ি। হাতে শুকনো বকুল ফুলের মালা। সব চিরকুট।
সে ছুড়ে মারে সেসব আলিয়া চৌধুরীর দিকে। বলে,
‘ এসব কার? কে এই মিষ্টি? কি লুকোচুরি খেলা হচ্ছে আমার সাথে?
আজিজ আর আলিয়া চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তাকায় আদির দিকে। কথা বলতে যেন ভুলে যায়। দ্বিতীয় বার আদির চিৎকারে তাদের হুশ ফিরে। আদি চেঁচিয়ে বলে,
‘ দাভাই। রাইনা আপু । তাড়াতাড়ি আসো।
রাইনা দৌড়ে যায়। বলে,
‘ কি হয়েছে আদি? ডাকছিস?
আদি চুপ করে দেখে রাইনার অবাক হওয়া মুখখানা। বলে,
‘ দাভাই কোথায়?
চেহারায় অসম্ভব রকম বিরক্তি ফুটিয়ে আফি তেড়ে এল। বলল,
‘ কি হয়েছে সকাল সকাল? এটা তো ভদ্রলোকের বাড়ি বলে জানতাম।
আদির রক্তিম চোখ চোখে পড়ায় থেমে যায় সে। বলে,
‘ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কি বলেছি আমি?
আদি শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
‘ কিছুই বলোনি দাভাই। শুধু আমাকে এটা বলো আমার অজান্তে এ বাড়িতে কি হয়েছে। মিষ্টি মেয়েটা কে হয় আমার?
আফি ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায়। বলে,
‘ তোর মা বাবার কাছ থেকে জেনে নে। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস? আমি ওসবে নেই ভাই।
আফি গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায়। আদি গর্জন করে উঠে। বলে,
‘ কেউ কি বলবে আমায়? রাইনা আপু, মিনুমা….. তাড়াতাড়ি বলো।
রাইনা আর মিনু আড়চোখে তাকায় আজিজ আর আলিয়ার দিকে। আলিয়া এগিয়ে এল। শাড়িটা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘ আদি কে মিষ্টি? কোথাকার মিষ্টি? তুমি কার কথা বলছ?
আদির সোজা জবাব,
‘ এই শাড়িটার মালিক। কার শাড়ি এইটা? আমার ঘরে কেন পেলাম? এই বকুল ফুলের মালা কার? আলব্যামের ভাঁজে এত চিঠি কার? কে লিখেছে এত চিঠি? এ বাড়িতে তার দেওয়া চিঠি কি করে আসে? কার হাত দিয়ে আসে? কি করে আসে? এ বাড়ির সাথে নিশ্চয় তার কোনো সম্পর্ক ছিল। এখন ও হয়ত আছে। এতসব প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় পাব?
আলিয়া কুড়িয়ে নেয় সেসব চিরকুট। একেকটা ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেলে। আদি হতভম্ব হয়ে বলে, এসব কি করছ মা? আলিয়া সব একে একে ছিড়ে ফেলে। বলে,
‘ মিষ্টি বলতে তোমার জীবনে কেউ ছিল না আদি। না আছে। না থাকবে। কেউ নেই এই নামের।
আদি বিরক্তি নিয়ে বলে,
‘ কিন্তু তার সাথে আমার কথা হয়েছে।
ফোন দেখিয়ে বলে,
‘ এই দেখো অনেকক্ষণ কথা বলেছি। এখন ও মিথ্যে বলবে?
আলিয়া চট করে ফোনটা কেড়ে নেয়। নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়ে বলে,
‘ রাতটা ভুলে যাও আদি।
আদি রেগে মাথা চেপে ধরে একহাত দিয়ে। বলে,
‘ কিন্তু এই শাড়ি? এই শাড়ি কেন আমার কাছে? এই বকুল ফুল? মালা।
আলিয়া শাড়িটা কেড়ে নেয়। বলে,
‘ এটা ইমির শাড়ি। তুমি ইন্ডিয়াতে কিনেছিলে ইমিকে দেবে বলে। এখনো দাওনি কেন?
‘ কিন্তু এটাতো বিয়ের শাড়ি মনে হচ্ছে। এত ভারী শাড়ি ইমি এমনিএমনি কেন পড়বে?
‘ এমনিএমনি প্রশ্নটা কেন আসছে আদি? তুমি দেবে তাই পড়বে। আইমি তোমাকে কতকিছু দেয়,তুমি কি ফেরত দাও? ও তোমাকে ও দেবে না। ওঁকে দিয়ে দিও শাড়িটা।
আদি চিন্তিত হয়ে বলে,
‘ কিন্তু মিষ্টি? তুমি জানো আমি মিনির ডাক শুনেছি। মিষ্টি সত্যিই আছে। কেন বিশ্বাস করছ না?
আজিজ চৌধুরী এবার আর চুপ করে থাকলেন না। বললেন,
‘ হ্যা আছে। মিষ্টি সত্যিই আছে। কিন্তু সে বিবাহিত।
আদি চমকায়। বলে, বিবাহিত?
আজিজ হেঁটে আদির কাছে আসে। বলে,
‘ মিষ্টি বিবাহিত।
‘ কিন্তু তার সাথে আমার, এই বাড়ির কি সম্পর্ক?
আজিজ চৌধুরী মিথ্যে রটালেন। মিথ্যে বললেন,
‘ তোমার দেখাশোনা করার জন্য তাকে রেখেছিলাম। সে অন্যজনের স্ত্রী। টাকার বিনিময়ে রেখেছিলাম তাকে। শুধু তোমার দেখাশোনা করত অন্যকিছু নয়।
আদি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে যায়। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ টাকার জন্য? বিবাহিত? এটা কেমন কথা বাবা? আমি বিশ্বাস করছিনা। আমার প্রমাণ চাই। তার ঠিকানা দাও। যতক্ষণ না তার মুখ থেকে শুনছি ততক্ষণ আমি এসব বিশ্বাস করছিনা।
আজিজ ত্যাড়া জবাব দিলেন। বললেন,
‘ ঠিকানা দিতে পারব না। তার স্বামী সংসার আছে। ঠিকানা দেওয়া বারণ।
আদি রেগে চিৎকার করে উঠে। বলে,
‘ বিবাহিত একজন মেয়েকে কেন আমার দেখাশোনার জন্য রাখবে তোমরা? মেয়ে কি কম পড়েছে? তার সাথে তো আমি দেখা করেই ছাড়ব।
আলিয়া দায়সারাভাবে বলে,
‘ তুমি তখন কাউকেই সহ্য করতে পারতেনা। না আমাদের না ইমিকে। নার্স ও রেখেছিলাম একজন। তা ও তোমার রাগের কারণে থাকেনি। কোনো উপায় না পেয়ে আমরা তাকে রেখেছিলাম। তখন আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না আদি।
আদি কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে। চোয়াল শক্ত করে সে তাকায় মিনুর দিকে। এগিয়ে যায়। বলে,
‘ মিনুমা তুমি অন্তত চুপ থেকোনা প্লিজ। সত্যিটা আমায় বলো। ঠিকানা দাও তার। আমি দেখা করতে চাই।
মিনু চোখ তুলে তাকায় আদির দিকে। পেছনে চোখ যায় তার। আলিয়া চৌধুরীর চোখের ভাষা বুঝে চুপ হয়ে যায়। বলে,
‘ আমি একদমই জানিনা সে কোথায় থাকে। জানলে বলে দিতাম।
আদি যেন এবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাথার দুদিকে হাত দিয়ে চেপে ধরে। বলে, কে বলবে আমায়? মিনিকে কোথায় পাব আমি?
ইমি! হ্যা ইমি। ইমিই বলতে পারে তার ঠিকানা কোথায়? দৌড়ে বেরিয়ে যায় আদি বাড়ি থেকে। তার পিছু পিছু ধাওয়া করে আজিজ চৌধুরী কোনো লাভ হয়না। আদি গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আলিয়া ফোন লাগায় আইমিকে। আদি এসব কি শুরু করেছে। আজিজ চৌধুরীর মাথায় রক্ত টগবগ করে ফুটে। কতবড় সাহস মেয়েটি এ বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছে। আবার যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে? এর শেষ দেখে নিতে হবে? এত লোভী মেয়েটা?
__________________________
এভাবে হনহন করে আদিকে আসতে দেখে আইমি প্রথমে ভড়কে গেল। আদি যখনই তার সামনাসামনি এসে দাঁড়াল। আইমি দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আজ সোজা বাড়িতে? এনি প্রবলেম?
আদি প্রথমেই একটু নিশপিশ করল। তারপর অনেকক্ষণ পর বলল,
‘ ইমি খুব জরুরী প্রয়োজনে এসেছি। আমাকে তুমি সত্যিটা বলবে।
আইমি কিছু বলার আগে দেখে তার ফোন বেজে উঠেছে। ধরতে গিয়ে দেখে অলরেডি অনেক বার লিয়া আন্টির ফোন থেকে কল এসেছে। আদি তো এখানে। কেন কল দিচ্ছে।
আদি তার ফোন কেড়ে নেয়। বলে,
‘ ইমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে তুমি। প্লিজ।
আইমি সামনাসামনি দাঁড়ায়। বলে,
‘ বলুন কি বলবেন।
আদি কোনোরূপ ভঙ্গিমা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
‘ মিষ্টির ঠিকানা চায় আমার। ইমি আমাকে প্লিজ তার ঠিকানা দাও।
আইমি যেন কানে ভুল শুনল। আদির মুখে মিষ্টি নামটি আবার? এই বৃষ্টি, মিষ্টি নামগুলো পঁচে গলে যায়না কেন? আইমির হাসিহাসি চোখ ছলছল করে উঠে। বলে,
‘ আদি কে মিষ্টি?
আদি অবাক হয় ইমির চোখ দেখে। বলে,
‘ ইমি কেন এমন করছ? দেখো, ঠিকানা জানাটা আমার খুব প্রয়োজন। তার সাথে আমার দেখা করতে হবে। সত্যিটা আমার জানতেই হবে ইমি।
আইমির চোখের জল দৃশ্যমান হয়। সে চট করে মুছে নেয়। বলে,
‘ তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ আদি। আমি জানলে কি তোমায় বলতাম না?
আদি হতাশ হয়। ইমির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,
‘ ইমি তুমি কেন কাঁদছ? আমি কিন্তু এই ইমিকে সত্যিই চিনিনা। এত ছিঁচকাঁদুনে কখন হলে তুমি? আমি শুধু ঠিকানা জানতে চেয়েছি।
আইমি আদির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
‘ আমি এসব কিছুই জানিনা আদি। শুধু জানি টাকা দিয়ে একটি মেয়েকে রেখেছিল তোমার দেখাশোনা করার জন্য। এর বেশি কিছুনা।
আদি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,
‘ মিনি তার কাছে ইমি। মিনির জন্য বলেছিলাম। মিনিকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য বলেছি। তুমি অযথা রাগ করছ।
আইমি ফুঁপিয়ে উঠে কান্না থামিয়ে দেয়। বলে, আমি রাগ করিনি আদি। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো সেটাই আমাকে কষ্ট দেয়।
আদি অনেকক্ষণ পর হাসে। আইমিকে টেনে তার সামনে নিয়ে আসে। গলা একপাশে কাত করে বলে, তুমি রাগলে আমার কষ্ট হয়।
আইমি চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বলে,
‘ কষ্ট? ডং।
আদি হেসে উঠে। বলে,
‘ ডং না সত্যি। তিন সত্যি। ইমি রাগ করলে সত্যিই আদির কষ্ট হয়।
আইমি দুম করে কিল বসায় আদির বাহুতে। আদি লাফিয়ে উঠে। বলে,
‘ ব্যাথা পেয়েছি ইমি!
আইমি তাকে বিদ্রূপ করে বলে,
‘ ব্যাথা পেয়েছি ইমি।
দুজনই একসাথে হেসে উঠে। আফাজ আহমেদ দরজায় টোকা দিয়ে নক করলেন। দুজন দুজনের কাছ থেকে দূরে ছিটকে আসে। আদি মাথা চুলকিয়ে বলে,
‘ আন্কেল আপনি? আসুন।
আফাজ আহমেদ ঘরে ডুকে। বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে,
‘ বিয়ের আগে আমার মেয়ের বেডরুমে আমি কাউকে এলাও করিনা কিন্তু।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই তিনজনই খিলখিল করে হেসে উঠে। আদি বলে,
‘ কাউকে এলাও না করলে ও আদিকে করতেই হবে কিন্তু।
আইমি হেসে উঠে। আফাজ আহমেদ বলে,
‘ আগামী মাসের দিকে এনগেজমেন্ট হবে। আইমির চাচ্চু আর কাকিরা ও আসবে। ছোট্টখাট্টো একটা ফাংশন হবে। তার কয়েকদিন পরপরই বিয়ে। দুজনেই রেডি তো?
আইমি চোখ তুলে তাকায় আদির দিকে। আদি তাকাতেই সে লজ্জায় পড়ে যায়। আদি সামান্য হেসে বলে,
‘ তারিখ ও ঠিক করা হয়েছে? আমাকে তো জানানো হয়নি।
আফাজ আহমেদ আর আইমি অবাক হয় আদির কথায়। বলে, তুমি রেডি নও।
আদি আইমির দিকে তাকায়।
বলে, অন্য কোনো ব্যাপার নেই। আমার বন্ধুমহলের কাউকে জানানো হয়নি তাই বলছিলাম।
আইমি বলে,
‘ এখনো তো অনেক সময় আছে আদি। জানাতে পারবে।
আদি বলে, হ্যা সময় আছে। জানি। সবাইকে বলে দিতে হবে।
আফাজ আহমেদ আর আইমিকে অবাক করে দিয়ে আদি চলে যায়। বলে যায়, আমাকে একটা কাজে বেরোতে হবে। অনেক কাজ। ইমি ফোন দেব তোমায়।
______________________
মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো প্লাস্টিকের ঘোড়া, বক, পুতুল। তুলোর টেডিবিয়ার। গাড়ি। নানারকম খেলনা। মাঝখানে বসা পরী। তারপাশ ঘেষে পাউরুটির টুকরো ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে মিনি। ঝগড়া করার পরে আবার ও দুইজন খুব ভালো বন্ধু। এ কয়দিনে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমেছে। ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো কপালের সামনে এসে পড়ায় মেয়েটি হাতের মুঠো দিয়ে সরিয়ে দেয় চুলগুলো। আবার সামনে এসে পড়ে। পাশে থাকা টিয়ে পাখিটির দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়,
‘ মিননি…….
মিনি আওয়াজ করে খেতে খেতে। কথা স্পষ্ট নয়। খাওয়া শেষে ডেকে উঠে,
‘ প্রিন্সেস……. প্রিন্সেস
পরী খিলখিল করে হেসে উঠে। গায়ের পড়নে লাল সাদা মিশেল ফ্রকটির কোণা মিনিকে দেখিয়ে দেয়। যার উদ্দেশ্য খেয়ে এখানে মুখ মুছে নাও। যেভাবে তার মাম্মা তাকে ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মুছে দেয়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব খেয়াল করছে তালহা আর জহির মিয়া। দুজনই পরীর কান্ড দেখে হাসে। ডাকে,
‘ দাদুমণি….
পরী ডাগর ডাগর চোখদুটো পাকিয়ে তাকায়। আবার মাথা নিচু করে খেলায় মনোযোগী হয়ে বলে,
‘ দাদ্দা…..
তালহা এগিয়ে এলেন। পরীর পাশে বসে পড়লেন। বললেন,
‘ দাদুমণি খাবেনা?
পরী দুপাশে মাথা নাড়ায়। মিনি ডেকে উঠে,
‘ খাব, খাব।
তালহার ধমকে চুপ হয়ে যায়।
‘ জিজ্ঞেস করছি কাকে বলছে কে? রাক্ষসী পাখি একটা।
মিনি খেতে খেতে মিনমিন করে ডাকে,
‘ বুড়ড়ি ব্যাড গার্ল। ব্যাড গার্ল।
তালহা শোনে। রেগেমেগে মিনিকে ধমক দেওয়ার আগেই পরী ডাকে,
‘ মিননননি……
জহির মিয়া হেসে উঠে। বলে,
‘ পরীর জন্য কিছু বলতে পারবে না। পরী তো মিনির বেস্ট ফ্রেন্ড।
মিনি খেয়ে ডানা ঝাপটায়। ডাকে, বেস্ট ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ড।
তালহা বেগম রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে মিনির দিকে। পরী হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঢলে ঢলে হাঁটতে হাঁটতে তালহার গা বেয়ে উঠে। দু গালে হাত দিয়ে আদর করে। নাকের সাথে নাক দুম দুম করে বাড়ি খেতে খেতে ডাকে,
‘ দাদ্দা,, দাদ্দা।
জহির মিয়া হো হো করে হেসে। তালহা বেগমের মুখে প্রশান্তির হাসি। জহির মিয়া দুচোখ ভরে দাদু নাতনীর কান্ড। তালহার একমাত্র দুর্বল জায়গা এই ছোট্ট মেয়েটি। এতটা ভালোবাসে তালহা মেয়েটিকে। পরী জহির মিয়ার কোলে চলে আসে। জহির মিয়ার দাড়ি টেনে দেয়। খিলখিল করে হাসে। জহির মিয়া যখন রাগ করার মতো চেহারা করে রাখে তখন পরী মুখ কালো করে ফেলে। গালে গাল লাগিয়ে ডাকে,
‘ দাদ্দা,,,
জহির মিয়া নিজেই হেসে উঠে হো হো করে। পরী ও হেসে উঠে।
মুনা হাতে ছোট্টখাট্টো একটা বাটিতে করে খাবার নিয়ে আসে। বলে,
‘ পরী খাবে। আসো।
‘ পরী দুপাশে মাথা নাড়ায়। ঠোঁট বাকায়। সিড়িতে দাঁড়িয়ে দুটো চোখ দেখে পরীর ঠোঁট বাকানো। পরীর রাগ। সেই রাগী চাহনী। কতটা মিল?
মুনা নরম কন্ঠে বলে,
‘ না খেলে মিনি কথা বলবে না তোমার সাথে। কেউ বলবে না। খেলবে ও না। এসো।
পরী জহির মিয়ার গলা ধরে পেছনে মুখ করে রাখে। বলে,
‘ নান নান না।
জহির মিয়া হাসে। বলে,
‘ রিককে পাঠাও। ও খাওয়াতে পারবে।
মুনা বলে, ও অফিসে বেরোবে। কি করে,,,,,,,
ইশার পাশ ঘেষে নিচে নেমে আসে রিক। অফিসের ড্রেস পড়া। মুনার হাতের বাটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ এখনো খায়নি।
মুনা দুপাশে মাথা নাড়ায় অসহায় হয়ে। রিক শক্ত চাহনি নিয়ে তাকায় মুনার দিকে। মুনা মাথা নামিয়ে নেয়।
রিক পরীর কাছে এগিয়ে যায়। পরী বেজায় খুশি। বাবার কোলে জাপটে পড়ে। গলা ধরে ডাকে গালে আদর বসিয়ে বলে ,,,পাপপপপা।
রিক হেসে বলে,
‘ মাই প্রিন্সেস না খেলে পাপপপা রাগ করবে। আড়ি দেবে।
পরী কি বুঝল কে জানে। রিকের মুখে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে মুখ দিয়ে বের করে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ। কোনোকিছুুর কোনো অর্থ নেই।
রিক মুনার কাছে নিয়ে যায় পরীকে। ইশারায় বলে খাইয়ে দিতে। রিক মিনিকে দেখিয়ে বলে, ওই দেখো মা মিনি খাচ্ছে। তুমি ও খাও। কি মজা!
পরী হাসে। মুনা তার ফাঁকে খাইয়ে দেয়। পরী মিনির সাথে তাল মিলিয়ে খেতে খেতে ডাকে,
‘ মিনননি……..
রিক এদিকওদিক হাঁটে পরীকে নিয়ে আর হাতে পড়া কব্জির দিকে তাকিয়ে ঘড়ির টাইম দেখে। মুনাকে বলে, আর ও কয়টা খাইয়ে দাও। আমার আর ও সময় আছে।
পরী খেতে খেতে দূরে দাঁড়ানো ইশাকে দেখে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় রিককে। বলে,, ফিপপপফি,,,
ইশা দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। মাথা দুলিয়ে বলে,, কি মজা! কি মজা!
পরী খেতে খেতে ইশার মত করে মাথা দুলায়।
মিনিকে দেখিয়ে দেয় ইশাকে। বলে,,, ফিপফি মিননি……..
ইশা হাসে।
পরী খাওয়া শেষে রিকের ঘাড়ে মুখ মুছে নেয়। মুনা হায় হায় করে বলে, এটা কি হলো? এখন কি হবে? আপনার ড্রেসে তো পরী,,,,,
রিক ঘাড় হাত দিয়ে মুছে ফেলে বলে,
‘ কিছু হবেনা। আমি পানি দিয়ে মুছে নেব।
পরীর ঠোঁট ফুলিয়ে তাকায় রিকের দিকে। যার অর্থ মাম্মা এভাবে কেন বলবে? সে রাগ করেছে।
রিক হেসে দেয় দেয় পরীর কান্ডে। বলে,
‘ রাগ করেছে আমার মা?
পরী মাথা দুলায়। তারপর রিককে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মুনাকে। বলে, উফ।
মুনা হেসে উঠে। বলে,
‘ বাবাকে পেলে তার আর কাউকে লাগেনা। আবার অভিযোগ কত?
রিক ও হেসে দেয়। পরী লেগে থাকে রিকের সাথে। যেন সে আন্দাজ করতে পেরেছে রিক এখন তাকে রেখে চলে যাবে। কোর্ট শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। তারপর মাথা ফেলে রাখে রিকের কাঁধে। ইশার পাশ কেটে রিপ নেমে আসে। জিজ্ঞেস করে, খেয়েছিস ইশু?
ইশা হ্যা বলে জবাব দেয়। রিপ এগিয়ে আসে পরীর দিকে। বলে, পরীমা কই? খেয়েছে?
পরী মাথা তুলে রিপের দিকে ফিরে। ডাকে, রিইইইই……
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠে। রিপ মুখ কালো করে বলে, দাভাই দেখেছ তোমার মেয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকে। ডাকে তো ডাকে। সুন্দর করে ও ডাকে না। রিইইইই কারো ও নাম হয়?
ইশা নিচে নেমে আসে। সামান্য হেসে বলে, তোমাকে রিইইই ডাকছে রিপুদা । কাল আমাকে রেগে কি ডেকেছে জানো? শাআআআ,,
আমার নাম নাম কি শআআআআ?
আরেকদফা হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল। রিক কথার ফাঁকে রিপকে ইশারা করল পরীকে কোলে নিয়ে নেওয়ার জন্য। রিপ ভুলিয়ভালিয়ে কোলে নিয়ে নেয়। যখনি পরী বুঝতে পারল রিক তাকে আদর করার কারণ,,, রিপের চুল টেনে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। রিপ ওরেব্বাপ বলে ঘোরাতে থাকে পরীকে।
রিক হেসে বেরিয়ে যায়। এসব অফিস টফিস কেন থাকে কে জানে? সারাক্ষণ মেয়ের সাথে সময় কাটাতে পারলে কতই না ভালো হতো।
পরী ঢোক তুলে তুলে কাঁদে। অনেক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে যায়। মাথা ফেলে রিপের কাঁধে। তাকায় আড়চোখে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইশার দিকে। ইশা ইশারায় হাসতে বলে। পরী মুখ ফিরিয়ে রাখে অন্যদিকে। ইশা কেন কোলে নিচ্ছে না তাকে? পরী কিছুক্ষণ পর আবার তাকায় ইশার দিকে। কিন্তু তারপরে ও ইশা তাকে কোলে নিচ্ছে না। রিকের ঘাড়ে জোরে চেপে ধরে মুখ। ই, ই, ই, ই শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। রাগে। অবহেলায়। চোখের জলে ভেসে যায় রিপের কাঁধ।
ইশা তা দেখে হাসে। পরী আড়চোখে দেখে ইশার হাসি। আবার ও ঢোক তুলে কাঁধে। জোরে কামড় বসায় রিপের কাঁধে। রিপ চেঁচিয়ে উঠে। ইশার কোলে দিয়ে দেয় তাকে। বলে,
‘পরী রিইই ব্যাথা পেয়েছে। তুমি ব্যাথা দিয়েছ।
পরী কাঁদতে কাঁদতে ইশার চুল টেনে ধরে। ওড়না টেনে ধরে। গলার কাছে গিয়ে জোরে কামড় বসায়। সর্বশক্তি দিয়ে। ছোট্টছোট্ট নখগুলো দিয়ে আঁচড় কাটে ইশার গলায়। দাঁত বসিয়ে দেয় গলায়। সবাই পরীকে ছাড়িয়ে নিতে যেন ভুলে যায়। ইশা ও ছাড়ায় না। তার চোখ বেয়ে শুধু হঠাৎ করে জল গড়ায়। পরী তার রাগ মিটিয়ে ইশার মুখের দিকে তাকায়। ইশার চোখে জল দেখে আর ও জোরে কাঁদে। মুখে মুখ লাগিয়ে তারপর আবার আদর করে। ডাকে,,, আমমমমা।
রিপ অবাক হয়ে দেখে ইশা আর পরীর কান্ড।
এগিয়ে যায়। পরীকে কোলে নিয়ে নেয়। চোখেমুখে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
এই ইশু তুই কাঁদছিস? তুই বেশি ব্যাথা পেয়েছিস? পরী কি করেছ তুমি এটা?
পরী চোখ বড় বড় করে তাকায় ইশার দিকে। ইশা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘ না ব্যাথা পাইনি। আর ও বেশি দেওয়া উচিত ছিল।
_____________________________
আকাশে মৃদুমৃদু মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি নামবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া অলরেডি শুরু হয়ে গিয়েছে। রিকশায় বসে তার বাড়ি ফেরার তাড়া। ইশা রিকশাচালককে বলে,
‘ মামা একটু তাড়াতাড়ি যাবেন। ছাতা আনিনি আজ। ভিজে যাব নয়ত। যাচ্ছি ও।
রিকশাচালক তার নিয়মেই চালায়। মেঘ ধীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চারদিকে। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় রত। ইশার চিন্তা বেড়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজলে তার জ্বর সর্দি লেগে যায় সাথে সাথে। জ্বর বাড়লে আনুষঙ্গিক ব্যামোগুলো ও বেড়ে যায়। বিছানা থেকে উঠতে ও তখন কষ্ট হয় খুব।
রিকশা চলতে থাকে। নীরা অর্পি আজ আসবে না জানলে সে ও আসত না। তাদের দুজনকে ছাড়া ক্লাসে ও মনোযোগ বসেনি আজ। তারা জানত বোধহয় আজ বৃষ্টি নামবে। বিরক্তিকর।
ঝিরঝির বৃষ্টি রূপ নেয় মুষলধারায়। রিকশাচালক ভিজে জবজবে হয়ে যায়। ইশার বিরক্তি নিয়ে বৃষ্টিকে বকে। আর আসার সময় পেলনা।
আঁকাবাকা করে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় একটি কথা। একটি চিরকুটে সে লিখেছিল, ডক্টরের সাথে বৃষ্টিবিলাসের কথা। এমন একটা দিন আসবে। চারদিকে নির্জন,নিস্তব্ধ পরিবেশ থাকবে। হয়ত রাত, হয়ত দুপুর,নয়ত বিকাল। বৃষ্টির ঝুপঝুপ শব্দের সাথে বাজবে তার নুপূরের রিমঝিম শব্দ। পড়নে থাকবে তার সাদা শাড়ি। বকুল গন্ধের ভরপুর থাকবে পরিবেশ। ডক্টর বকুল ফুলের মালা পড়িয়ে দেবে তার গলায়। বকুল দিয়ে ছুঁইয়ে দেবে তার নাক। সে লজ্জায় তখন নতবদনে হাসবে। ডক্টর সেই আগের ভোলাভালা চাহনি দিয়ে তাকাবে তার দিকে। পড়নে থাকবে সাদা ধবধবে পান্জাবী। চুলগুলো থাকবে কপালের কাছে ছড়ানো ছিটানো। খুব সযত্নে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রেখে বলবে,
‘ মিষ্টি,,,,, এই মন কেমনের বৃষ্টি আমাদের। এই বৃষ্টিবিলাস আমাদের। তোমার আমার। আদি মিষ্টির।
সেই চিরকুট তো ডক্টরের আর দেখা হলোনা। দেখলে কি একটা বাজে পরিস্থিতি হতো। ভালোই হয়েছে সরিয়ে ফেলেছে মিনুমা। ডক্টর তো এখন আইমির সাথে বৃষ্টিবিলাস করবে। এখন আইমিকে বলবে,
‘ ইমি এই বৃষ্টিবিলাস আমাদের। এই মন কেমনের বৃষ্টি আমাদের। আমার তোমার। আদি ইমির।
ইশা হেসে উঠে। রিকশা চলতে থাকে। তার আবার ও মনে পড়ে তিনবছর আগের ডক্টরের বলা সেই কথা।
‘ মিষ্টি,,, এই আদি,এই ডক্টর তোমায় ভালোবেসেছে। কিন্তু তুমি বাসোনি। কখনোই ভালোবাসোনি।
তুমি কষ্ট পাবে। খুব কষ্ট পাবে। ঠিক আমার মতো। ধুঁকে ধুঁকে মরবে। কাউকে দেখাতে ও পারবেনা, কাউকে বোঝাতে ও পারবেনা তোমার কষ্ট। তোমার যন্ত্রণা।
বৃষ্টির আওয়াজের সাথে মিশে যায় তার ডুকরে কেঁদে উঠা। ডক্টর এই কোন ধরণের অভিশাপ দিল তাকে? এত বড় অভিশাপ ডক্টর কি করে দিতে পারল? এই শাপের বোঝা আর কত বইতে হবে। এবার সে ক্লান্ত। মিষ্টি এবার খুব ক্লান্ত। ডক্টর কি কখনো এই ক্লান্তির গ্লানি মুছে দিতে আসবে না?
মিষ্টি যে ডক্টর নামক রোগটিতে আক্রান্ত হতে হতে নিঃশেষ হওয়ার পথে। ডক্টর কি করে অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে? ডক্টর যদি একটিবার খোঁজ নিত তাহলে খুঁজে পেত, তার খুব সুন্দর একটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীতে তার একটি রাণী আর একটি রাজকন্যা আছে। ডক্টর কেন খোঁজ নেয় না।
আনমনা হয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে যখন সে মগ্ন তখন চোখ যায় তার দূরে। রাস্তার মাঝখানে। শাড়ি পড়া মেয়েটি দুহাত মেলে চরকির মতো ঘুরছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ছেলেটি হাত ধরে টান দিল। থামানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি তারপর ও ঘোরা বন্ধ করল না। থামল না। ছেলেটি শেষমেশ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটির কান্ড দেখতে লাগল। ইশা রিকশাচালককে থামিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেমে যায়। রিকশাচালক বলে,
‘ আর ও পথ বাকি আছে।
ইশা বলে,
‘ পথ আজ এখানেই থামুক।
ভাড়া মিটিয়ে সে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা ধরে।
আদি ক্লান্ত ভঙ্গিতে গাড়িতে হেলান দেয়। বলে, চাকা পাঞ্চার হওয়ার আর সময় পেলনা। বিরক্তিকর।
আইমি শাড়ির আচঁলে পানি কুড়ায়। আদিকে ডেকে বলে,
‘ আদি ভালোই হয়েছে বৃষ্টি এসেছে। সাথে চাকা ও পাঞ্চার। মাঝরাস্তায় বৃষ্টিবিলাস। উফ দারুণ।
আদি হাসে। বলে, ‘ ইমি জ্বর সর্দি বাঁধালে বলোনা। আদি আমার জ্বর উঠেছে। সর্দি পেয়েছে।
আইমি হাসতে হাসতে ঘোরে। শাড়ির আঁচলের সবটুকু পানি নিয়ে আদির সামনে এসে দাঁড়ায়। আদি তখন গাড়িতে মাথা রেখে হেলান দেওয়া। আইমি দুষ্টুমি করে সব পানি ছুড়ে মারে আদির দিকে। আদি হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে।
বলে,ইমি কি করছ?
ইমি খিলখিল করে হেসে উঠে। আদি দেখে সেই হাসি। আইমি শাড়ির আঁচলের পানি আবার ছুড়ে মারার আগে আদি খপ করে ধরে ফেলে তাকে। আইমি হকচকিয়ে যায়। বলে, ছাড়ো।
আদি হাসতে হাসতে বলে, ভয় পেলে?
আইমি মাথা নেড়ে বলে, একদম না।
আদি হেসে আইমিকে ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জায় কুঁকিয়ে উঠে আইমি। আদি শাড়ি জড়িয়ে দেয় ইমির গায়ে। পকেট থেকে বের করে একমুঠো বকুল ফুল। কানে বেজে উঠে,
‘ যখনি আপনি মিষ্টিকে মনপ্রাণ দিয়ে খুঁজবেন তখনি গিয়ে দাঁড়াবেন বকুল তলায়।
বকুল ফুলের সুবাসে আপনি মিষ্টিকে খুঁজে পাবেন। মিষ্টিকে অনুভব করতে পারবেন।
সে সত্যিই গিয়েছিল আজ বকুল তলায়। অনুভব করতে পেরেছে কিনা কে জানে? কিন্তু এই বকুল ফুলগুলো পেয়েছে। মিষ্টি তো অন্যকারো। ইমিকে দিলে কেমন হয়? আইমি নড়েচড়ে উঠে। বলে, কি করছ আদি?
আদি পুরোটা সময় নিশ্চুপ। বকুল ফুলগুলো একে একে আইমির ভেজা চুলে গেঁথে দেয়। অনেকক্ষণ সময় লাগে। আইমি যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল পুরোটা সময়। আদির দিকে হুট করে ফিরল।
বলল, আমার জন্য?
আদি মাথা হেলিয়ে হ্যা জানাল। আইমি হাসল। তৃপ্তির হাসি। প্রশান্তির হাসি। আলতো করে সে মাথা রাখল আদির বুকে। মন কেমন করা ভালোবাসায় ডুব দিয়ে উচ্চারণ করল,
‘খুব,খুব ভালোবাসি আদি।
আদি কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করল। আইমিকে ধরতে চাইল। দু হাত বাধার আগেই চোখ যায় দূরে দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে। যদি সে খুব কাছ থেকে, খুব গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করত তাহলে বুঝতে পারত কি পরিমাণ যন্ত্রণা হচ্ছে মেয়েটির। কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। কি পরিমাণ তোলপাড় হচ্ছে তার বুকে। এ কখনোই তার ডক্টর নয়। ডক্টর কখনোই মিষ্টিকে ছাড়া অন্যকাউকে তার বুকে মাথা রাখতে দেবেনা। কখনোই অন্য কারো চুলে বকুল ফুল গুজে দেবেনা। অন্যকাউকে এত কাছে ঘেষতে দেবেনা। কখনোই না। এ কখনোই তার ডক্টর নয়। হতেই পারেনা। ডক্টর কখন এত পাষাণ হলো?
বৃষ্টিজলে ধুয়ে মুছে যায় মেয়েটির চোখের নোনাজল। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে বারবার। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ পৌঁছায় না ডক্টরের কানে। পৌঁছায় না নীরব অনুভূতিদের আর্তনাদ। পৌঁছায় না নীরব কান্নার আওয়াজ। পৌছাই না দীর্ঘশ্বাস। মেয়েটি খেয়াল করে তার দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে একটি ছেলে বাইক থেকে নেমে। ছেলেটির হাতে ছাতা। ছেলেটি তার সামনাসামনি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ তুই এখানে কেন? রিকশা থেকে এখানে নেমে গিয়েছিলি? দেখ কিভাবে ভিজে গেছিস। জ্বর সর্দি বাঁধিয়ে বসবি। সবার রাতের ঘুম হারাম করবি। তোর কি একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করেনা? ভালো রাখতে ইচ্ছে করেনা? কেন এমন তুই?
মেয়েটি খেয়াল করে এই আদুরে শাসন শুনে তার চোখের জল আর বাধা মানছেনা। এ কাকে ঠকিয়েছে সে? যে মানুষটা তাকে নিয়ে এতটা ভাবে। সে ডুকরে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে।
রিপ হকচকিয়ে যায়। বলে,
‘ এই ইশু কাঁদছিস কেন তুই। এই ইশু।
ইশা কেঁদে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়ে ছেলেটির বুকে। বলে,
‘ রিপুদা আমি অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে শাস্তি দাও। আমাকে মেরে ফেলো।
রিপ ছাতা মেলে ধরে। মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে বলে,
‘ যতবার ঝড় আসবে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াব তোর পাশে। যতবার ভুল করবি আমি শুধরে দেব। যতবার দূরে যাবি ততবার কাছে নিয়ে আসব। কিন্তু কখনো আমায় পর করে দিস না। আমার সব আপনজনের মাঝে তুই আমার খুব খুব প্রিয় একজন। আমাকে ছেড়ে কখনো যাস না। কখনো আঘাত দিসনা। তোর দেওয়া আঘাত আমি সহ্য করতে পারব না। আমি মরে যাব।
কান্নার আওয়াজ বৃষ্টির আওয়াজে মিলিয়ে একাকার হয়ে রিপের আকুতি। মেয়েটি শুনল কিনা কে জানে? অপরাধবোধ তার জাগ্রত হয় ধীরে ধীরে। কেন রিপদা তার কাছ থেকে এতকিছু আশা করে সে বুঝে পায়না। সে শুধু জানে এই মানুষটি তার ভরসাস্থল। তার আশ্রয়। তার একজন ভাই।
এমন এক বৃষ্টির দিনে আবার ও দুই বন্ধুর দেখা। রিপের পেছনের মেয়েটিকে গলা কাত করে দেখে আদি। আইমি ও। তার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। এতবছর পর এই মেয়েটা আবার তার আর আদির সামনে। দেখে মনে হচ্ছে এখনো ছোট্ট একটি মেয়ে। কলেজে পড়ে। ইশা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে রিপের পেছনে। রিপ বকবক করে আদির সাথে। আদি ও বলে। আড়চোখে ওই মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করে।
কথা বলা শেষ করে রিপ বাইকে গিয়ে বসে। ইশা ধীর পায়ে হেঁটে যায় রিপের পিছু পিছু। থমকে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকায় আইমির দিকে। আইমির চোখে ভয় দেখে সে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে। তার চোখে হাসি দেখে আইমি যেন স্বস্তি পেল। আদির হাত শক্ত করে ধরল। আদির বাহু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মাথা রাখল।
ইশা আর পিছু ফিরেনা। গটগট পায়ে হেঁটে উঠে বসে বাইকের পেছনে। রিপ বলে,
‘ ভালো করে বোস।
ইশা বসে। ছেলেটির কাঁধে হাত রাখে। বাইক ছেড়ে দেয়। চলে যায় বহুদূর। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয় ডক্টর। ডক্টরের সেই চাহনি।
আদি অবাক চোখে তাকায় বাইকটি চলে যাওয়ার দিকে। দেখতে দেখতে একসময় বিলীন হয়ে যায় সেই বাইক।
ইশা কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ছেলেটির পিঠে মাথা রাখে। কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠে। কিছুদূর যেতে না যেতেই ছেলেটি বাইক কষে। মেয়েটি ভড়কে যায়। ছেলেটি মেয়েটির দিকে ফিরে বলে,
‘ এভাবে ধরিস কেন ইশু? আমি বাইকে চালাতে মনোযোগ দিতে পারছিনা। এভাবে ছুঁবিনা আমায়।
আদি হাঁটা ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে। আইমি তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারেনা। বলে, আদি আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল।
আদি হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়।
‘ আজ আর কোথাও যাব না ইমি। আমার শরীর খারাপ লাগছে। হঠাৎ করে। যা অপ্রত্যাশিত। এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা।
চলবে,
( দেরীতে দেওয়ার জন্য জন্য দুঃখিত। আপনাদের মতামত জানাবেন)
( আপনাদের মতামত জানাবেন)