#মরুর_বুকে_বৃষ্টি💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২ + ৩
★আদিত্য গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে মাত্রই চোখটা বন্ধ করেছিল, হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠল। আদিত্য তাকিয়ে দেখলো ওর চাচী ফোন করেছে। আদিত্যর ভালো করেই জানা আছে ওর চাচী কেন ফোন দিচ্ছে। তাই ফোন রিসিভ করে কোনরকম ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলো।
–আপনার একাউন্টে টাকা পৌঁছে গেছে চাচী, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ওকে রাখছি। কথাটা বলে আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সামনের মিররে তাকিয়ে দেখলো বিহান ওর দিকে কেমন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। বিহানের এই রাগের কারণ আদিত্য ভালো করেই জানে। তাই দুষ্টুমি করে বলে উঠলো।
–কিরে এভাবে তাকিয়ে আসিছ কেন? মেরে টেরে ফেলবি নাকি? এক্সিডেন্ট করে আমাকে ফেলার প্ল্যান করে থাকলে, তাহলে বলবো এটা এ্যাপসুলেটলি ফ্লপ আইডিয়া। কারণ এতে আমার থেকে তোরই উপরে যাওয়ার টিকেট আগে কাটবে।
বিহান তিরস্কার করে বললো।
–হা, হা,হা ভেরি ফানি। মোর হাচিতো থামাইবারই ফারতাচি না।
–তো আটকাচ্ছিস কেন? হাস না। তোর দাঁত গুলা দেখাতো।
–আদি মুই এক্কারেই মশকারির মুডে নাইক্কা। তুই গোচ্ছা হরলেও আজ মুই না কইয়া থাকবার পারতাচিনা । মুই ভাইব্বা পাইনা যার সামনে হগ্গলে ঝুইক্কা থাহে। হেই তুই ওই গোল্ড ডিগার মহিলার সামনে বারবার ঝুইক্কা যাচ ক্যালা? তুই কি বুঝবার পারচ না ওই মহিলা তোর টেহা ছাড়া আর কিচ্ছুই বুঝেনা?
(বিহান সবসময় এভাবেই কথা বলে। যদিও আদিত্যর সাহায্যে বিহান লেখাপড়া করেছে। তবুও ও এই ভাষা ছাড়তে পারেনা। আদিত্যও আর কিছু বলে না।)
–দেখ বিহান, আমি সবই বুঝি। তবুও সে যেমনই হোক না কেন সে আমার চাচার স্ত্রী। আর সেই হিসেবে আমার চাচী। আর তুইতো জানিসই বাবা মা মারা যাওয়ার পরে চাচাই আমাকে মানুষ করেছে। সে না থাকলে আমি হয়তো কখনো এ পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারতাম না। তার উপকারের প্রতিদান আমি আমার সারাজীবনেও চুকাতে পারবোনা। আর আবির আর আয়াত ওরাও তো আমার ভাই বোন।
–হেইয়া হইলেও..
–আরে বাদ দেনা। আমার এতো টাকা পয়সা দিয়ে আমি কি করবো? ওরা নাহয় একটু খরচ করছে করুক।
বিহান আরকিছু বললো না। ও জানে আদিকে বলে কোন লাভ নেই। ও এমনই।
________
রাত ৮-৩০
আদিত্য মাত্রই বাসায় এসে পৌঁছাল। ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে শরীর টা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। বাসায় আসলে আদিত্যর মনটা কেন যেন আপনা আপনি বিষন্ন হয়ে ওঠে। ও যে এই দুনিয়ায় শুধুই একা, এই ফাঁকা অট্টালিকা টা ওকে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয়। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকলেও রাতে যখন বাসায় ফেরে তখন এই একাকিত্ব ওকে কুঁড়ে কুড়ে খেতে চায়। এই একাকিত্ব যেন ওকে আঙুল দেখিয়ে তিরস্কার করে বলছে,দেখ আদিত্য এত অর্থ প্রাচুর্য থাকা সত্বেও তুই কত অভাগা। নিজেকে তখন সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি মনে হয়। যার নিজের একান্ত আপন বলতে কেউ নেই।
আদিত্যর জীবন সবসময় এমন ছিলোনা। বাকি সবার মতো ওরও জীবন ছিল হাসিখুশি। বাবার স্নেহ আর মায়ের মমতায় ঘেরা সুখের জীবন ছিল ওর। আদিত্যের বাবা একটা সরকারি চাকরি করতো। আদিত্যর পৃথিবী জুড়ে ছিল ওর বাবা মা। কিন্তু হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়ে ওর পৃথিবীটা তছনছ হয়ে গেল। কেড়ে নিয়ে গেল আদিত্যের সবকিছু। আদিত্যের যখন ১০ বছর বয়স তখন এক এক্সিডেন্টে আদিত্যের বাবা মা একসাথেই মারা যান। সেদিন থেকেই শেষ হয়ে যায় আদিত্যের সুখের জীবন। আদিত্য পুরো একা হয়ে যায়। আদিত্যকে দেখার মতো কেও থাকেনা। আদিত্যর নানা নানী অনেক আগেই মারা গিয়েছিল শুধু একটা মামা ছিল। কিন্তু সে আদিত্যর দায়িত্ব নিতে চাইনি। আদিত্যর দাদা দাদীও মারা গিয়েছিল। ওর বাবারা দুই ভাই এক বোন ছিল। আদিত্যর ফুপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাই আদিত্যকে নিজের কাছে রাখার জন্য তার শশুর বাড়ির লোক মানতো না। শেষমেশ আদিত্যের চাচা ওর সব দায়িত্ব নেই। আদিত্যকে ওর চাচা নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। আদিত্যও তার চাচাকে অনেক শ্রদ্ধা করতো। কখনো চাচার কথার অবাধ্য হতোনা। তবে আদিত্যের চাচী আদিত্যকে মোটেও পছন্দ করতো না। তারমতে আদিত্য শুধু একটা বাড়তি বোঝা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরজন্য আদিত্যর চাচী ওর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহারও করতো। তবে আদিত্যের চাচার সামনে সবসময় ভালো সেজে থাকতো। তবে আদিত্য কখনো কোন প্রতি উত্তর করতো না। চুপচাপ সবকিছু সহ্য করতো। ওর মতে তার চাচা এখানে থাকতে দিয়েছে,খাইয়ে পড়িয়ে লেখাপড়া করাচ্ছে এইতো অনেক। সেখানে নাহয় একটু সহ্য করলাম।
আদিত্য লেখাপড়ায় অনেক ভালো ছিল। তাই এইসএসসি পাস করার পর স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন চলে যায় স্টাডির জন্য। সেখান থেকে স্টাডি শেষ করে এসে বাংলাদেশে নিজের বিজনেস সেটাপ করে। ধীরে ধীরে আদিত্যর বিজনেস বড় হতে থাকে এবং আদিত্যর সফলতা আসমান ছুতে থাকে। এখন বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিত্যর ব্রাঞ্চ আছে। আদিত্য এখন সফলতার শীর্ষে। বিজনেস ছাড়াও আদিত্যের একটা মাফিয়া গ্যাং আছে। যদিও সেখানে কোন অনৈতিক বা অবৈধ কাজ হয়না। বরং যারা অন্যায়, অবৈধ কাজ করে তাদের শাস্তি দেওয়াই হলো এই গ্যাংয়ের মূল কাজ।
আদিত্য এখন নিজের বাড়ি কিনে এইবাড়িতেই থাকে। এত কিছুর পরেও দিনশেষে আদিত্য সেই নিশ্ব একা। মাঝে মাঝে আদিত্যরও ইচ্ছে হয় কেউ একজন ওর একান্ত হয়ে থাকুক। যে ওর জন্য অপেক্ষায় থাকবে। ওর জন্য চিন্তা করবে। যে ওর সুখে হাসবে, ওর দুঃখে কাঁদবে। দিনশেষে কান্ত শরীরে বাসায় ফিরে তার মুখের দর্শনে নিজের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। মুখে ভেসে উঠবে খুশির রেখা।
আদিত্য জানে ও চাইলেই হাজারো মেয়ে ওর জীবনে আসার জন্য লাইন ধরে যাবে। কিন্তু এরা সবাই শুধু ওর টাকা পয়সা আর বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য ওর জীবনে আসতে চায়। যেমন ওর চাচী। এই মহিলা আগে ওকে দেখতেই পারতো না আর এখন নিজে থেকেই অধিকার ফলাতে আসে। শুধুমাত্র ওর টাকার জন্য। আদিত্য সবই বোঝে কিন্তু বুঝেও কিছু বলেনা।থাকনা, নামের হলেও তো আপনজন। কেইবা আছে আমার এই নিস্ব জীবনে। একমাত্র বিহান ছাড়া।
বিহান ছোটবেলা থেকেই আদিত্যর সাথে থাকে।আদিত্যর যখন ১২ বছর বয়স, তখন বিহানকে পেয়েছিল আদিত্য। বিহানেরও এইদুনিয়ায় আপন বলতে কেও নেই। রাস্তায় রাস্তায় পানি বিক্রি করতো। একদিন আদিত্য রাস্তা দিয়ে হেটে স্কুলে যাচ্ছিল হঠাৎ ওর দিকে একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে ওর দিকে ছুটে আসতে থাকে সেই মূহুর্তে বিহান আদিত্যকে হাত ধরে টান দিয়ে বাচিয়ে ছিল। সেদিন থেকেই আদিত্য বিহানকে নিজের বন্ধু বানিয়ে নেই। যতটা পারত বিহানকে সবকিছুতে সাহায্য করতো। নিজের বিজনেস শুরু হওয়ার পর থেকে বিহানকে নিজের সাথেই রাখে আদিত্য। তবে আদিত্যের বাড়িতে থাকেনা। আদিত্যের বাকি স্টাফদের মতো স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। আদিত্য অনেক বলেছে ওর সাথে ওর বাসায় থাকতে। কিন্তু বিহানের একটাই কথা, বন্ধু হলেও ও আদিত্যের স্টাফ। তাই ও স্টাফ কোয়ার্টারেই থাকবে। তাই আদিত্যও আর কিছু বলেনা। ওর যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই থাকুক।
আদিত্যর ভাবনার মাঝেই এক সার্ভেন্ট এসে মাথা ঝুকিয়ে বললো।
–সার আপনার ডিনার রেডি।
আদিত্য চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললো।
–ওকে ইউ ক্যান গো নাউ।
সার্ভেন্ট টা আস্তে করে মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল। আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের বেডরুমে এগুলো। বেডরুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলে, গায়ের ব্লেজারটা খুললো।শার্টের বোতাম খুলে শার্টটা খুলতেই নিচে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে নিচে তাকিয়ে দেখলো চকলেটের প্যাকেট। নিচু হয়ে চকলেট টা হাতে নিল আদিত্য। চকলেট টা দেখে হঠাৎ নূরের কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটির নিষ্পাপ চেহারা, তার হাসি,তার বাচ্চামো আচরণ গুলো মনে পড়তেই আদিত্যর ঠোঁট দুটো আপনা আপনি প্রসারিত হয়ে গেল। মেয়েটা সত্যিই নিষ্পাপ। দুনিয়া দাঁড়ির কোন ভাবাবেগ নেই ওর ভেতর। নেই কোন লোভ লালসা, চাওয়া পাওয়া। একদম নূরের আলোর মতোই নিষ্পাপ নূর। আমাকে বলে কিনা হিরো।
কথাটা ভেবে আদিত্যর ঠোঁটের হাসি আরও একটু হয়ে গেল।
আদিত্য চকলেট টা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখতে গেলে আয়নায় চোখ পড়ে যায়। আয়নার দিকে ভালো করে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় আদিত্য। নিজের ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসিটা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। ও হাসছে? সত্যিই হাসছে?তাও আবার একটা মেয়ের কথা ভেবে? লাইক সিরিয়াসলি?
আদিত্য আবরও ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, এখনো ওর ঠোঁটে হাসির রেখাটা লেগে আছে। আর এটা কোন দেখানো বা সৌজন্যমূলক হাসি না। এটা মন থেকে আসা সত্যিকারের খুশির হাসি। যেটা শুধু ওর ঠোঁটে না চোখে মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে।আদিত্যর মনে নেই শেষ কবে ও এমন মন থেকে হেসেছিল।
রাত ১২ টা
আদিত্য বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না।আদিত্যের সবকিছু টাইম টু টাইম হয়। খাওয়া, কাজ, ঘুমানো সবকিছু টাইম মতো করে। কিন্তু আজ টাইম পার হয়ে গেছে তবুও ওর চোখে ঘুম নেই। চোখ বন্ধ করলেই বারবার শুধু নূরের হাসিমুখ টা ভেসে উঠছে। কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না।কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। আদিত্য আর না পেরে উঠে বসে বিহানের নাম্বারে ফোন দিল।
বিহান ঘুমে কাদা হয়ে আছে। এদিকে ওর ফোনটা বেজেই যাচ্ছে ওর কোন খেয়াল নেই। ফোন না ধরায় আদিত্য আরও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। চারবারের বার বিহান ফোন ধরে ঘুমো ঘুমো কন্ঠে বললো।
–কোন হারামি রে? রাইতবিরাতে ফোন দিয়া মোর স্বাদের ঘুমডা ভাইঙ্গা দিসোচ। মনে চাইতাছে ফোনের মধ্যে ঢুইক্কা তোরে পিডাইয়া আহি।
–আচ্ছা আয়। মেরে যা। দেখি তোর কতো দম।
আদিত্যের কন্ঠ শুনে বিহান বেকুবের মতো ফোন সামনে এনে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য কল করেছে। বিহান একটা ঢোক গিলে ফোন কানে নিয়ে বললো।
–আদি তুই? তোরে আবার এত রাইতে কিসে কামরাইলো? তোর তো এতক্ষণে ঘুমের পয়লা ডোস কমপ্লিট হইয়া যাওয়ার কথা? তুই কি মোরে স্বপনে ফোন দিসোচ?
–শাট আপ ইডিয়ট। কখন থেকে আবোল তাবোল বলে যাচ্ছিস। আমকে কিছু বলতে দিবি?
–হ হ ক না মামা কি কবি?
আদিত্য একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–আমার নূরের সব ডিটেইলস চাই, সকালের ভেতরই।
বিহান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এই নূর ফুর আবার ক্যাডা মামা?
–আজ বিকেলে যে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল, যাকে আমার গাড়িতে বসিয়েছিলাম।ওই মেয়েটির কথা বলছি।
–আইচ্চা,ওই মাইয়াডা? তা তুই ওই হাফ মেন্টাল মাইয়ার ইনফো দিয়া কি করবি?
আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–ওর নাম নূর। বেশি কথা না বলে তোকে যা বললাম তাই কর।সকালের ভেতর সব ডিটেইলস চাই আমার ব্যাস।
কথাটা বলে আদিত্য ফোন রেখে দিল।
বিহান ব্যাঙ্গ করে বিড়বিড় করে বললো।
–সব ডিটেইলস চাই আমার ব্যাস। আরে হালুয়া নাকি? কইলেই ওইয়া গেল? শালা নিজেতো কইয়াই খালাস। আর মোর স্বাদের ঘুমডা হারাম কইরা দিল।
_________
সকাল ৮ টা
আদিত্য ফ্রেশ হয়ে নিচে এসেছে ব্রেকফাস্ট করার জন্য। তখনি বিহান এসে সোফার টি টেবিলের ওপর একটা ফাইল ঠাস করে রেখে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো।
–এই ল, এইটুক চময়ে খালি ঠিকানাই যোগাইবার পারচি। এর বেশি আর হইতো না। বাহিডা পরে করুমনে।
আদিত্য কিছু না বলে ফাইল হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর আস্তে করে বললো।
–হুম, আপাতত এইটুতেই চলবে। এখন চল ব্রেকফাস্ট করে বের হবো আমরা।
–বাইর হমু মানে?গাঞ্জাখোর গো মতো কতা কচ ক্যালা? তুই তো কইয়াই খালাস হইয়া আরামে ঘুুম দিছচ। আর মুই যে শিয়ালের মতো জাইগ্গা জাইগ্গা ইনফো জোগায়লাম। এহন আবার তোর লগে যাইবার কচ। তাইলে মুই ঘুমামু কহন?
আদিত্য ভাবলেশহীন ভাবে বললো
–দুই মিনিটের ভেতর উঠে ব্রেকফাস্ট শেষ কর।নাহলে কিন্তু না খেয়েই বের হতে হবে।
বিহান সোজা হয়ে বসে বললো।
–কেসটা কি কতো মামা? হঠাৎ ওই মাইয়াডার লাই এত ইন্টারেস্ট দেখাইবার লাগচ ক্যালা? কুচ কুচ লোচা হে কেয়া? তুই আবার ওই হাফ মেন্টাল মাইয়ার পিরিতে ফুল মেন্টাল হইয়া গ্যালা নি?
আদিত্য কিছু না বলে ব্রেকফাস্ট করতে লাগলো।
বিহান মনে মনে আদিত্যকো শক্তপোক্ত কয়েকটা গালি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো।
চলবে……
(আমি ঢাকাইয়া ভাষা তেমন জানিনা। তবুও দেওয়ার চেষ্টা করেছি।কিছু ভুল হয়ে গেলে ক্ষমার চোখে দেখবেন সবাই ।)
#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-৩
★বিহানের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী আদিত্যরা নূরের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে। আদিত্য নিজেও জানে না ও এখানে কেন এসেছে, আর কিইবা করতে চায়। শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটাকে একনজর না দেখলে ও শান্তি পাবে না।ওর ভেতরের অস্থিরতা দূর হবে না।
বিহান নূরের বাসার থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থামিয়ে বলে উঠলো।
–আইয়াতো (এসে) পরছি। অহন কি বাছার (বাসার) ভিতরে যাবি?
আদিত্য কি বলবে, ওতো নিজেই জানে না এখন কি করবে। এখানে চলে তো এসেছে, কিন্তু এভাবে একটা অপরিচিত বাসার ভেতর কিভাবে যাবে? আর বলবেই বা কি? দ্যাট ইস আ উইয়ার্ড সিচুয়েশন। আদিত্য গাড়ির থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে, নূরকে কোথাও দেখতে পায় কিনা সেই আশায়। মনে মনে ভাবলো, কি দিন এসে গেল তোর আদি। শেষমেশ কিনা রাস্তার ফোর টুয়েন্টি পোলাপানের মতো মেয়েদের স্টক করা শুরু করলি? এইটাই বাকি ছিল। এই মেয়েটার জন্য নাজানি আর কি কি করতে হবে?
হঠাৎ কোথাথেকে আসা হাসির রিনিঝিনি শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিত্যের। আদিত্য পাশে তাকিয়ে দেখলো রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট মাঠে কিছু বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। সেখান থেকেই এই হাসি শোনা যাচ্ছে। আদিত্য আনমনেই সেদিকে পা বাড়ালো। মাঠের ভেতর যেতেই দেখতে পেল কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটিকে। চোখে কাপড় বেঁধে বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে সে। মুহূর্তেই থমকে গেল আদিত্য। তার হাসির রিনিঝিনি শব্দে বুকের বাম পাশে হঠাৎ ঘুমন্ত কোন কিছু জেগে উঠে লাফাতে শুরু করলো। যেন সে আর বুকের ভেতর থাকতে রাজি নয়। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খেয়াল করলো,কাল রাত থেকে ওর ভেতর যে অস্থিরতা কাজ করছিল এখন আর তার ছিটেফোঁটাও নেই। বরং সেখানে এখন একরাশ প্রশান্তি আর ভালোলাগা কাজ করছে। আদিত্যের ঠোঁট জোড়ায় ভেসে উঠলো আবারও সেই ভালোলাগার হাসি।
নূর দুই হাত এদিক ওদিক বাড়িয়ে বাচ্চাদের ধরার চেষ্টা করছে। এভাবে হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় আদিত্যর কাছে চলে এলো নূর। হাত বাড়িয়ে আদিত্যকে কাছে পেয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো আদিত্যকে।তারপর প্রফুল্ল কন্ঠে বলতে লাগলো।
–ইয়েএএ..ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি,,,,
আদিত্য এতক্ষণ ঘোরের ভেতর প্যান্টের পকেটে দুুই হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ এভাবে নূরের জড়িয়ে ধরায় আদিত্য পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল শীতল বাতাস। মুখ কোন কথায় বের করতে পারছে না আদিত্য। শুধু ফ্যালফ্যাল করে নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
নূর আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে চোখের কাপড় খুলে আদিত্যর দিকে তাকালো। আদিত্যকে দেখে হাসিটা আরও প্রশ্বস্ত হচ্ছে গেল। ডাগর ডাগর চোখ দুটো বড়বড় করে উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–আর্রে হিরো, তুমি এখানে? তুমিও এখানে খেলতে এসেছ বুঝি?
আদিত্য কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। চুপচাপ শুধু নূরকে দেখেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই দেখার কোন শেষ নেই।
এতক্ষণে অন্য সব বাচ্চারাও ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভেতর একটা বাচ্চা নূরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–খেলবে মানে? বললেই হলো নাকি? তুমি জানো না আমরা বন্ধু ছাড়া অন্য যেন তেন কাওকে খেলতে নেই না? এটা আমাদের গ্রুপের রুল?
বাচ্চাটির কথায় আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালো। এইটুকুন পুচকের এমন এটিটিউট দেখে অবাক না হয়ে পারলো না।
নূর বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বললো।
–আরে মিন্টু, তুই জানিস না। উনিনা অনেক বড়ো হিরো। নেইনা উনাকে খেলতে? অনেক মজা হবে।
বাচ্চাটি ভাব নিয়ে বললো।
— তো? হিরো হয়েছে তো কি হয়েছে? রুলস আর রুলস।
আরেকটি বাচ্চা বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ মিন্টু ঠিকই বলেছে। হিরো হবে উনি নিজের বাসায়। এখানে সবাই এক, কোন পার্শালিটি চলবে না।
আদিত্য এদের কথাবার্তা শুনে মনে মনে একটু হাসলো। তারপর বাচ্চাদের দিকে একটু ঝুঁকে বললো।
–হুমম,,তাহলে তো এটা অনেক গম্ভীর বিষয়। আচ্ছা তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমাকে তোমাদের বন্ধু বানিয়ে নাও। তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই তাইনা?
নূরও আদিত্যর কথায় সায় দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ হিরো ঠিক বলেছে। আমরা হিরোকে বন্ধু বানিয়ে নেই। তাহলে আর কোন সমস্যা হবে না।
মিন্টু এটিটিউট নিয়ে বললো।
— আমাদের বন্ধু হওয়া এতো সহজ না।আমাদের বন্ধু হতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সবার দ্বারা সম্ভব না।
নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বললো।
–ওরা না ঠিকই বলেছে। জানো আমারও ওদের বন্ধু হওয়ার জন্য কত্তোওও মেহনত করতে হয়েছে? পুরোওও বিশ টাকার ললিপপ খাইয়েছি, তারপর ওরা আমাকে বন্ধু বানিয়েছে। ভাবা যায় বলো? তোমার কাছে কি এতো টাকা আছে?
আদিত্য বেচারা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। বাংলাদেশের শীর্ষ বিজনেস ম্যানকে বলছে, তার কাছে বিশ টাকা আছে নাকি। সত্যিই লোকজন শুনলে হার্ট অ্যাটাক করেই মরে যাবে। এদের কথাবার্তায় চরম বিনোদন পাচ্ছে আদিত্য। আদিত্য বলে উঠলো।
–আরে এই অধমকে একটা সুযোগ তো দিয়ে দেখ। তোমরা যা চাও তাই খাওয়াবো ওকে?
নূর আদিত্যের সুপারিশ করে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ হিরো ঠিকই বলেছে। আর হ্যাঁ তোরা জানিস, হিরোর না এত্তোবড় গাড়ি আছে। তোরা চাইলে হিরো আমাদের ওই গাড়িতেও ঘুরাবে। তাইনা হিরো?
আদিত্যের দিকে তাকিয়ে কথাটি বললো নূর।
আদিত্য আলতো করে মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। গাড়িতে ঘুরবার অফার শুনে বাচ্চাদের মনে মনে লাড্ডু ফুটলো। তবুও উপরে উপরে এটিটিউট দেখিয়ে বললো।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে এতো করে যখন বলছো তখন একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। আমরা আবার অনেক দয়ালু।
আদিত্য বিনয়ী ভাবে বললো।
–জ্বি জ্বি আপনাদের মেহেরবানী। তাহলে চলুন।
আদিত্যের বলতে দেড়ি কিন্তু বাচ্চাদের দৌড়াতে দেরি নেই। সবাই হইহই করে গাড়ির দিকে দৌড়ালো,সাথে নূরও। আদিত্য মুচকি হেসে ওদের পিছে পিছে গেল। নূরের উৎসাহ দেখে আদিত্যেরও অনেক ভালো লাগছে। বাচ্চাদের বাহানায় হলেও নূরের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারবে এটা ভেবেই আদিত্যর ভালো লাগছে।
__________
বিহান গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাতে ঘুমাতে পারেনি তাই আদিত্য যাওয়ার পর ও গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ ধুপধাপ শব্দে বিহানের ঘুম ভেঙে হেল। বিহান ধড়ফড়িয়ে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখলো কয়েকটা বাচ্চা এসে গাড়ির চারিদিকে ঘিরে কাচে থাবড় মারছে।
বিহান ভ্রু কুঁচকে ভাবলো। এই চার আনার পয়সার পার্টি কইত্তন (কোথাথেকে) আইলো (আসলো)? বিহান দরজা খুলে বেড়িয়ে কিছু বলবে তার আগেই সবগুলো হুড়মুড় করে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। বিহান হকচকিয়ে বলতে লাগলো।
–আব্বে চার আনার পার্টি তোরা ছবগুলান(সবাই) গাড়িতে উইট্টা গেলি ক্যালা (কেন)? বাইর হ,বাইর হ কয়তাছি।
–আরে বিহান যেতে দে ওদের।
পেছন থেকে আদিত্যর কথা শুনে বিহান পেছনে ফিরে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বললো।
–যাইবার দিমু মানে? কি কছ এল্লা? আর বাইচ্চা পার্টি কারা?
আদিত্য বিহানের কাছে এসে বললো।
–ওরা আমার সাথে। তুই চিন্তা করিস না। ওদের নিয়ে একটু চক্কর দিয়ে আসবো।
বিহান যেন আকাশ থেকে পরলো। বেচারা পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে আদিত্যের কথায় । আদিত্য আজ পর্যন্ত কোন স্টাফকেই ওর গাড়িতে বসতে দেইনি। আদিত্যর গাড়িতে কেও টাচ করলে,গাড়িতে এক ফোটা ময়লা হলে আদিত্য রেগে আগুন হয়ে যায়। আর আজ কিনা কোথাকার একগাদা পোলাপান গাড়িতে ঢুকিয়ে বসে আছে। আদিরে কোন ভুতে টুতে ধরলোনা তো আবার? নাহ আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা কেমন যেন ভনভন করে ঘুরছে বিহানের।
বিহানকে এভাবে অটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদিত্য বলে উঠলো।
–কিরে স্টাচু হয়ে গেলি কেন? চল গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দে।
বিহান বেকুবের মতো ঘাড় ঝাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
সব বাচ্চারা পেছনের ছিটে ঠেসেঠুসে বসে পরেছে। নূর এসে দেখলো পেছনে আর কোন যায়গাই নেই। নূর ঠোঁট উল্টিয়ে বললো।
–আমি কোথায় বসবো? তোরাতো সবাই জায়গা দখল করে বসে আছিস।
একটা বাচ্চা বলে উঠলো।
–নূর আপু তুমি সামনে বসো।
মিন্টু বলে উঠলো।
–তাহলে হিরো কোথায় বসবে?
আদিত্য কাছে এসে বললো।
–কি হলো তুমি বসো।
–কোথায় বসবো জায়গা নেই।
আদিত্য ভেতরে তাকিয়ে দেখলো পেছনে কোন জায়গা নেই। আদিত্য একটু ভাবতে লাগলো। হঠাৎ আরেকটা বাচ্চা বলে উঠলো।
–আইডিয়া?
আদিত্য বললো।
–কি আইডিয়া?
–বলছি, আপনি আগে সামনের সিটে বসুন।
আদিত্য বাচ্চাটির কথামতো সামনের সিটে বসলো। তারপর বাচ্চাটি আবার বললো।
–নূর আপু তুমি এখন হিরোর কোলে বসো তাহলেই হয়ে গেল।
বাচ্চাটির কথা শুনে আদিত্য চমকে তাকালো নূরের দিকে। এই সিচুয়েশনে আদিত্যর কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। মানা করে দিবে? নাকি একটু স্বার্থপর হয়ে, নূরকে এতটা কাছে পাওয়ার সুযোগ টা লুফে নিবে?
কিন্তু নূরের তেমন কোন ভাবাবেগ হলোনা। বাচ্চাটার কথায় সায় দিয়ে নূর অনায়াসে আদিত্যর কোলে চড়ে বসলো।
নূর কোলে বসতেই আদিত্যের হৃৎস্পন্দন যেন হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটতে লাগলো। নূরের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ আদিত্যর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। আদিত্য চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণটা নিজের ভেতর লুফে নিচ্ছে।
এদিকে বিহানের চোখের মনি কোটর থেকে বেড়িয়ে আাসার উপক্রম। বেচারা বিস্ফোরক চোখে তাকিয়ে আছে আদিত্যের দিকে।নাহ বিহান আর নিতে পারছে না। ও নিশ্চয় এবার জ্ঞান হারাবে। ওর সামনে বসে থাকা এই লোকটা আদিত্য হতেই পারে না। কিছুতেই না।
বাচ্চারা অধৈর্য্যে হয়ে বললো।
–গাড়ি কি চলে, নাকি শুধু শো অফের জন্য রেখেছেন?
বাচ্চাদের কথায় আদিত্য চোখ খুলে তাকালো।বিহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো বিহান হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিত্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–এভাবে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন?সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দে।
আদিত্যের কথায় বিহান সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। বাচ্চারা সব হই হুল্লোড় করতে লাগলো। নূরও সামনে থেকে ওদের হাসাহাসি করছে। আদিত্য শুধু মুগ্ধ নয়নে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নূরের এই নিষ্পাপ মুখের খিলখিল হাসি, আদিত্যর বুকের ভেতর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। আদিত্য বুঝতে পারছে না এই মেয়েটার হাসিতে কি যাদু আছে, যেটা ওর মতো পাথরের গড়া মানুষের ভেতরটাকে গলিয়ে দিচ্ছে।
নূর আদিত্যের কোলে বসলেও আদিত্য এখনো নূরকে ধরেনি। মেয়েটা নাহয় অবুঝ, তাই বলে ওতো আর মেয়েটার সরলতার সুযোগ নিতে পারে না। গাড়িতে জায়গা থাকলে হয়তো নূরকে কোলেও বসাতো না।
কিছুক্ষণ পর একটা রেস্টুরেন্ট দেখে আদিত্য গাড়ি থামাতে বললো। তারপর নূর আর বাচ্চাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে একটা টেবিলে বসে বাচ্চাদের বললো।
–তোমরা যে যা খেতে চাও অর্ডার করে দাও।
বাচ্চাদের আর পায় কে। ওরা ইচ্ছামতো নিজেদের পছন্দের খাবার অর্ডার করতে লাগলো। নূর আদিত্যের পাশেই বসে আছে । আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–নূর তোমার কি পছন্দ? কি খাবে তুমি বলো?
নূর প্রফুল্ল কন্ঠে বললো বললো।
–আমার রসমালাই পছন্দ। আমি রসমালাই খাবো।
আদিত্য ওয়েটারকে রসমালাই আনতে বললে,ওয়েটার জানাল তাদের এখানে রসমালাই নেই। আদিত্য ওয়েটারের হাতে দুই হাজার টাকার নোট দিয়ে বললো।
–তোমার হাতে দশ মিনিট সময় আছে,যেখান থেকে পারো রসমালাই নিয়ে আসো। আমার এখানে রসমালাই চাই বুঝতে পেরেছ?
ওয়েটার মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–জ্বি স্যার এখুনি আনছি।
খাবার চলে এলে বাচ্চারা খাবারে হামলে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে নূরের রসমালাই দিয়ে গেল। নূরের চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো। সেটা দেখে আদিত্য মুচকি হাসলো। নিজের জন্য একটা ব্লাক কফি অর্ডার করলো আদিত্য। কফি মুখে দিতেই হঠাৎ কান্নার শব্দ এলো। আদিত্য পাশে তাকিয়ে দেখলো নূর ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো নাক টেনে কাঁদছে। থুঁতনির নিচে আর জামার ওপর রসমালাই লেগে আছে। আদিত্য চমকে উঠে বললো।
–এই নূর কি হয়েছে কাঁদছ কেন? বলো আমাকে।
নূর নাক টেনে টেনে বললো।
–আ আমি খেতে পারছি না।
মিন্টু বলে উঠলো।
–আরে হিরো নূর আপু নিজের হাতে খেতে পারেনা। ওকে সবসময় ওর মা খাইয়ে দেয়। দেখ কেমন সারা গায়ে মাখিয়ে নিয়েছে।
আদিত্য কতক্ষণ মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। তারপর একটা টিস্যু নিয়ে নূরের থুতনিতে লেগে থাকা রসটুকু মুছে দিয়ে বললো।
–তুমি চাইলে আমি তোমাকে খাইয়ে দিতে পারি।আমি খাইয়ে দিব তোমায়?
নূর ঘাড় কাত করে শিশুসুলভ ভাবে বললো।
–আচ্ছা।
আদিত্য একটা চামচে করে রসমালাই নিয়ে নূরের মুখের কাছে ধরলো। নূর হাসিমুখে খাওয়া শুরু করলো।আদিত্য জীবনে এই প্রথম কাওকে খাইয়ে দিচ্ছে। আদিত্য পুরোটা সময় নূরের দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে ওকে খাওয়াতে লাগলো।আদিত্যর চোখে মুখে এক অন্যরকম খুশী ঝলকে উঠলো। আদিত্য জীবনে কত সফলতা দেখেছে। কিন্তু এভাবে এমন খুশী ও কখনো পায়নি। আজ এই মেয়েটার মাঝে যেন এক অদ্ভুত খুশী খুঁজে পাচ্ছে। যেটা এর আগে কখনো কোন কিছুতেই পায়নি আদিত্য।
খাওয়া দাওয়া শেষে আদিত্য বলে উঠলো।
–তাহলে কি এখন আমাকে তোমাদের বন্ধু করা যায়?
মিন্টু বলে উঠলো।
–আরে বন্ধু মানে, শুধু বন্ধু না।আজ থেকে আপনি আমাদের কলিজার বন্ধু। একদম হার্ট টু হার্ট ফ্রেন্ড।
নূরও বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ আজ থেকে আমরা বন্ধু।
আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
একটু পরে সবাইকে নিয়ে আবার আগের জায়গায় আসলো ওরা। আসার সময়ও নূর আদিত্যের কোলেই আসলো। গাড়ি থামলে সবাই যার যার মতো নেমে মাঠের ভেতর চলে গেল।
তখনি ওখানে নূরকে নেওয়ার জন্য ওখানে নিলা এলো।আদিত্যকে দেখে একটু অবাক হয়ে বললো।
–আরে ভাইয়া আপনি এখানে?
নূর ততক্ষণে বাচ্চাদের সাথে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। আদিত্য কিছুটা দূরে ছিল। হঠাৎ নিলার কথায় আদিত্য অপ্রস্তুত হয়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে ইতস্তত ভাবে বললো।
–আসলে আমি এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎ নূরকে এখানে দেখতে পেলাম তাই দেখা করতে আসলাম আরকি।
–ও আচ্ছা। তো আমাদের বাসায় আসুন না।বাবা মা আপনার সাথে দেখা করে অনেক খুশী হবেন। সেদিন আপুকে বাঁচিয়ে ছিলেন সেটা জেনে বাবা মা অনেক কৃতজ্ঞ হয়েছে।
–না না আজ না, অন্য একসময় যাবো। আমার একটু কাজ আছে।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আসবেন কিন্তু।
আদিত্য সৌজন্যমূলক হাসি দিল। নিলা চলে যেতে নিলে। আদিত্য কিছু একটা ভেবে নিলাকে ডাক দিয়ে বললো।
–আচ্ছা শোন।
নিলা ঘুরে তাকিয়ে বললো।
–জ্বি বলুন।
–আসলে কিছু মনে না করলে একটা কথা জানার ছিল।
–জ্বি ভাইয়া বলুন না?
–আসলে আমি জানতে চাইছিলাম, নূর কি সবসময় থেকেই এমন? আই মিন টু সে,,
–ইটস ওকে ভাইয়া। আমি বুঝতে পারছি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন। আসলে আপু সবসময় এমন ছিলনা। বাকি সবার মতো আপুও নরমাল মেয়ে ছিল। পড়ালেখায় অনেক ভালো আর বুদ্ধিমতী ছিল। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আপুর একটা রোড এক্সিডেন্ট হয়। তখন থেকেই আপু এমন হয়ে যায়।
–এক্সিডেন্ট?
–হ্যাঁ এক্সিডেন্ট। আপুর সেদিন এইসএসসির রেজাল্ট বের হয়েছিল। জিপিএ ফাইভ পেসেছিল আপু।অনেক খুশী ছিল সেদিন ও। আর সেই খুশী সেলিব্রেট করারা জন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল আপু। কিন্তু রাস্তায়ই আপু যে সি এন জিতে যাচ্ছিল সেটার এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছিল আপু। যার কারণে আপুর মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে যায় । আপু একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। আমরা আপুকে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোন ইমপ্রুভমেন্ট দেখা যায়নি।
সবকিছু শুনে আদিত্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নূরের হাসিমুখটা দেখে। কি সুন্দর হেসে হেসে বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে। কে বলবে এই মেয়েটার ওপর দিয়ে এতো ঝড় বয়ে গেছে।
আদিত্য নিলার দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি এখন আসি তাহলে। তুমি নূরকে বলে দিও আমি চলে যাচ্ছি।
নিলা মাথা ঝাকিয়ে নূরের কাছে গেল।
আদিত্য গাড়ির কাছে আসতেই, পেছন থেকে নূর এসে বললো।
–আরে হিরো তুমি চলে যাচ্ছ?
আদিত্য নূরের দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ চলে যাচ্ছি।
–আবার আসবে তো?
–হ্যা এখনতো মনে হচ্ছে আসতেই হবে।
আদিত্য প্যান্টের পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করে নূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–এটা তোমার জন্য।
চকলেট দেখে নূর খুশি হয়ে চকলেট টা হাতে নিয়ে বললো।
–হিরো তুমি সত্যিই অনেক ভালো।
কথাটা বলে আচমকা নূর আদিত্যের গালে একটা চুমু দিয়ে দিল। চুমু খেয়ে হাত নেড়ে টা টা বলে ওখান থেকে চলে গেল।
আর আদিত্য ওখানেই জমে গেল। আচমকা নূরের এহেন কাজে আদিত্য পুরো মূর্তি হয়ে গেল। নড়াচড়া ভুলে গেল। মনে হচ্ছে ও অন্য কোন জগতে চলে গেছে।
_____
রাত ১২ টা
আদিত্য মাথার নিচে হাত ভাজ করে রেখে চিত হয়ে শুয়ে আছে। চোখের নজর উপরের দিকে। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বারবার চোখের সামনে শুধু নূরের সাথে কাটানো ভালো মুহূর্ত গুলোই ভাসছে। সবশেষে নূরের দেওয়া সেই পরশ টা। সেটা ভাবতে ভাবতেই আদিত্যের হাতটা আপনা আপনি ওর গালে চলে গেল। ঠোঁট জোড়ায় ছেয়ে গেল সেই অদ্ভুত ভালোলাগার হাসিতে। আজকের দিনটা আদিত্যর কাছে অনেক স্পেশাল ছিল। কিছু ভালো লাগা আর খুশিতে ভরা। যেই খুশিটা আদিত্য সবসময় খুঁজেছে।
আদিত্যের অবচেতন মন হঠাৎই উপলব্ধি করলো যে,এই মেয়েটাকে তার চাই। খুব করে চাই। এই মেয়েটাই ওর হারানো খুশির ঠিকানা। নূরকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও সে থাকতে চায়না।
আদিত্য মনে মনে কিছু একটা ভেবে রহস্যময় হাসি দিল।
চলবে……