মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব – ৫

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৫
®মেহরুমা নূর

★অফিস থেকে আজ একটু সকাল সকালই ফিরেছে আদিত্য। তার পেছনে চারজন লোক হাতভর্তি খেলনা নিয়ে আদিত্যর পেছন পেছন হেঁটে আসছে। খেলনার ভীড়ে মানুষগুলো চোখে দেখায় কঠিন। এগুলো সব আসার সময় আদিত্য নিয়ে এসেছে নূরের জন্য। নূরের সাথে মিত্রতা করার প্রথম প্রচেষ্টা তার। কাল ওই পূরান, ছিঁড়া পুতুল দেখে মনে হয়েছিল নতুন খেলনা পেলে খুশি হবে সে হয়তো। তাই পুরো খেলনার দোকানই যেন নিয়ে এসেছে সে।পেছন থেকে বিহান মিটিমিটি হাসছে তার বন্ধুর কান্ড দেখে। খেলনাসহ মানুষ গুলো নিয়ে ভেতরে ঢুকলো আদিত্য। তবে ভেতরের পরিবেশ কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো তার। সার্ভেন্টগুলো আর জমিলা এদিক ওদিক কেমন খোঁজাখুজি করছে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি চলছে এখানে? ”
আদিত্যের কথায় যেন সবাই ভয়ে চুপসে গেল কেমন। কেউ কোনো উত্তর দিতে পারছেনা। আদিত্যর রাগ বাড়ল। সে আরেকটু রাগী স্বরে বলল,
“ক্যান সামওয়ান টেল মি! হোয়াটস গোয়িং অন হেয়ার! ”
জমিলা ভীতু গলায়,
“আসলে ছোট সাহেব, বউমনিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ঘন্টা খানিক আগে তাকে সোফায় টিভি দেখতে বসিয়ে দিয়ে আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। কাজ শেষ করে এসে দেখি আর নেই। তখন থেকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না।”
কথাগুলো সাধারণ ভাবেই বললেও আদিত্যের কানে যেন তা সাধারণ ভাবে প্রবেশ করলোনা। কেমন উত্তপ্ত জলীয় বাষ্পের ন্যায় মস্তিষ্কের নিউরনে ছড়িয়ে পড়ল যেন। হঠাৎই যেন ক্রিয়াশীল স্নায়ুতন্ত্র অক্রিয় হয়ে পড়ল ভীষণ ভাবে।এলোমেলো মস্তিষ্কে শুধু একটাই কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “নূরকে পাওয়া যাচ্ছে না।” আদিত্য নিজেও জানে না কি যেন ঘটছে ওর সাথে। এই অতি সামান্য কথাটা তার উপরে প্রভাব ফেলছে অসামান্য হারে।কেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এসির মাঝেও কপালে ঘাম জমে যাচ্ছে তার। এরমাঝে বিহান সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“পাওন যাইতাচে না! কি কছ তোরা!এইহানে মজা চলতাছে! পাওন যাইতাচে মানে কি! এত্তগুলা মাইনছের মধ্যে থাইকা একটা মানুছ গায়েব হইয়া গেল গা! আছেপাছেই কোথাও হইবো। যাইবো কই! ভালো কইরা খুঁইজা দেখ।”
একজন সার্ভেন্ট জবাবে বলল,
“খুঁজছিতো, কোথাও নেই।”
“মোর জালা! তাইলে তোরা আছস কিছের লাইগা! তোরা থাকতে ভাবি কেমতে হারাইলো! তোরা কি চোখ খুইলা ব্যাংকে রাইখা আইছচ!”
“আসলে, ম্যাডাম কখন উঠে গেছে কেউ দেখেই নি।গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম তারা বলল,ম্যাডামকে নাকি গেটের বাইরে যেতে দেখে নি।”
“তাইলে ভেতরেই কোথাও আছে। আইচ্ছা অহন প্যাঁচাল বাদ দিয়া, যা ছবাই আবার ভালো কইরা খোঁজ চারিদিকে। পাইয়া যামুনে।”
বিহানের কথায় সবাই চারিদিকে আবারও ছড়িয়ে পড়ে খোঁজা শুরু করে দিলো। বিহান খেয়াল করলো আদিত্য এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই আছে। বিহান আদিত্যর কাঁধে হালকা ঠেলা দিয়ে বলল,
“কিরে এমতে দাঁড়ায় আছস কেলা? ভাবিরে খুঁজন লাগবো না! চল আমরাও খুঁজি গিয়া।”
বলেই বিহান খোঁজ অভিযানে নেমে পড়ল। আদিত্য বিভ্রান্তের মতো শুধু এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ যেন গলা, বুক শুঁকিয়ে মরুভূমি হয়ে আসছে তার। হার্টবিট অস্বাভাবিক হচ্ছে। আদিত্য এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে পানির জগ নিয়ে ঢকঢক খেয়ে নিলো। নাহ,তবুও যেন শান্তি হচ্ছে না। কোথাও যেন কিছু আটকে আসছে তার। এত অশান্তি কেন হচ্ছে তার! দম কেন বন্ধ হয়ে আসছে! বুকটা জ্বলছে কেন! নূর হারিয়ে গেছে বলে! নূর! হ্যাঁ নূর। নূরকে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজতে হবে নূরকে। এখুনি খুঁজতে হবে। আদিত্য কেমন বিভ্রান্তের মতো ছুটলো এদিক থেকে ওদিক। সবাই মিলে খোঁজা খুঁজি করেও কোনো হদিস পাচ্ছে না নূরের। এদিকে গার্ড রা বলছে নূরকে গেটের যেতে দেখেনি তারা।সিসিটিভি ফুটেজেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে। দুপুরের দিকে বাসার বাইরে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু এরপর আর কোনো ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না তাকে। তাহলে মেয়েটা কোথায় গায়েব হয়ে গেল কেউ বুঝতে পারছেনা।যেন জলজ্যান্ত মেয়েটা ভুতের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। এদিকে আদিত্যরও আসার প্রায় দুই ঘন্টার মতো হয়ে গেছে। সন্ধ্যা হতে চলেছে প্রায়। এখনো পর্যন্ত নূরের কোনো খোঁজ নেই। আদিত্যর সব এলোমেলো লাগছে। দমবন্ধকর অনুভূতিতে দমে যাচ্ছে সে। এই প্রথম যেন তার মনে ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় খুব করে আহত করছে তাকে। এতটা বিবশতা আগে কখনোই অনুভব করেনি সে। এতটা বিবশ যে মাথায় কোনোকিছু কাজই করছেনা তার। নিজেকে এতটা অসহায় কখনোই মনে হয়নি যেন তার। এত এত ক্ষমতা তার অথচ একটা মেয়েকেই খুঁজে বের করতে বের করতে পারছেনা সে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। অসহ্য, গুমোট যন্ত্রণায় ছটফট করছে হৃদপিণ্ড টা। এই গুমোট দমবন্ধকর অবস্থা থেকে বাঁচতে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল আদিত্য। নিঃশ্বাস চলাচল ঠিক করার চেষ্টা তার। তখনই হঠাৎ কিছু কানে এলো তার। ছোট্ট ছোট্ট আওয়াজে বলা কারোর অস্পষ্ট গলা শুনতে পেল সে। সাথে হালকা হাসার শব্দও। আদিত্য ঝট নিচে উঁকি দিলো। নূরের জামার অংশ দেখতে পেল সে। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে তড়িৎ গতিতে নিচে দৌড়ে গেল সে।

দৌড়ে বাসার পেছন সাইডে এলো আদিত্য। দেখতে পেল কাঙ্খিত ব্যাক্তিটাকে। বাসারা পেছন সাইডে পিলারের কোনায় বসে আছে নূর রানী। বিড়ালের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর সাথে বসে আছে সে। তাদের হালকা করে ছুঁইয়ে খুশিতে আত্মহারা হচ্ছে যেন।এত কোনায় থাকাতেই সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছিল না তাকে। রাগে এদিকে আদিত্যর মুখমন্ডল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়ে মহারানী কি সুন্দর এখানে বিড়াল ছানা নিয়ে খেলছে! মনতো চাচ্ছে এখুনি উঠিয়ে একটা আছাড় মারি। আদিত্য চোয়াল শক্ত করে তেড়ে গেল নূরের সামনে। সামনে এসে নূরের এক হাত ধরে ঝটকা টান মেরে দাঁড় করাল তাকে। বেচারি নূরের হাসি মুখটা মুহূর্তেই ভয়ার্ত আতঙ্কে পরিবর্তীত হয়ে গেল। কাঁপতে লাগল ভয়ে সে। আদিত্য রাগী ভাবে তার কাছে এলেও হঠাৎ সে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখালো। সে হুট করে নূরকে টান দিয়ে তার বুকের মাঝে গেঁথে নিলো। দুই হাতের বাঁধনে মিশিয়ে নিলো তাকে বক্ষমাঝে। এতক্ষণে যেন তার নিঃশ্বাস যেন সঠিক গতি খুঁজে পেল। হৃদয় খুঁজে পেল তার প্রশান্তি। এই দুইটা ঘন্টার দমবন্ধকর,যন্ত্রণাদায়ক অসহনীয় অনুভূতিটা আদিত্যকে হারে হারে বুঝিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটা তারজন্য কি। এই মেয়েটা যে এখন তার জীবন হয়ে গেছে তা বুঝতে পেরে গেছে সে। বুঝে গেছে নূর ছাড়া সে নিঃস্ব, শূন্য। নূরকে ছাড়া তার চলবে না৷ না তার নিঃশ্বাস, না তার হৃৎস্পন্দন। কোনোকিছুই চলবে না৷ কিছুতেই না৷ তার সবটা জুড়ে দখল করে নিয়েছে নূর নামক প্রাণভোমরাটা। ভালোবাসে ফেলেছে সে তার নূরকে। অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। যে ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। নেই কোনো আয়ত্ত। নিজের অনুভূতি বুঝতে পেরেই আদিত্যের ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল। এদিকে নূরের ভয়ে আত্মা উড়ে মহাকাশে চলে যাবার জোগাড়। আজ কি রাক্ষস টা তাকে সত্যি সত্যিই খেয়ে ফেলবে! তাই যেন এভাবে চেপে ধরেছে সে। নূর নিজেকে ছাড়ানোর হাসফাস করছে। একসময় আদিত্য নিজেই হাতের বাঁধন আগলা করল। তবে পুরোপুরি ছেড়ে দিলোনা। দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে তার কপালে কপাল ঠেকালো। নূরের ভীতু মুখটাতে চেয়ে হাসছে আদিত্য। এ হাসি তার নতুন অনুভূতির আগমনের খুশির বহিঃপ্রকাশ। নূরের নাকে নাক ঘষে হাসছে আদিত্য। বেচারি নূর কি আর বুঝল আদিত্যের এই হাসির কারণ। সে’তো অন্যই কিছু ভাবছে। ভাবছে রাক্ষসটা তাকে খাওয়ার খুশিতে এভাবে হাসছে। সে আরও ভয়ে নিজেকে আদিত্যর হাতের বাঁধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ছাড়ল না আদিত্য। বরং উল্টো পাঁজা কোলে তুলে নিলো নূরকে। অবুঝ নূর ভয়ে এবার কেঁদেই দিলো। হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বলল,
“ছেড়ে দিন, আমাকে খেয়েন না দয়া করে। দেখুন আমি খেতে একদমই মজা না। আমার মাংস একেবারে তিতা। আমি খালি করল্লা খাইতো তাই আমার মাংস, হার সব বি,ষের মতো তিত্তা। আমাকে খেলে আপনার পেট তিতায় নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি বরং আমাকে ছেড়ে দিন হ্যাঁ।তার বদলে আপনি আমাদের গ্রামের জমিলরে খেয়ে ফেলেন৷ অনেক মোটা, মাংসও অনেক বেশি পাবেন। পঁচা লোকটা আমারা আম পাড়তে গেলেই মারে শুধু। আপনি বরং তাকেই খেয়ে ফেলুন হ্যাঁ! আমাকে ছেড়ে দিন।”

আদিত্য থেমে গেল। ভ্রু কুচকে তাকালো নূরের মুখপানে। তারপর হঠাৎ হো হো করে হেঁসে উঠল। জীবনে এই প্রথম বোধহয় এভাবে উচ্চস্বরে মন খুলে হাসলো আদিত্য। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“চুপচাপ নাহলে সত্যি সত্যিই খেয়ে ফেলবো। মুখে আঙুল দাও।”
নূর ভয়ে ঝট করে ঠোঁটে আঙুল রাখল। ভুলেও সে কথা বলবে না৷ মরার ইচ্ছে নেয় তার। নূরের এমন ভঙ্গিমা দেখে আবারও হাসি পেল আদিত্যর। মেয়েটা সত্যিই কিউটের ডিব্বা। আদিত্যের নিরামিষ, অন্ধকার জীবনে আলো ছড়াতে এসেছে যেন। তার জীবনের এঞ্জেল। আদিত্য মাথা ঝুকিয়ে নূরের কপালে অধর ছোঁয়াল। তারপর তাকে নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকল। তাদের দেখে বাসার সার্ভেন্ট গুলো হা করে তাকিয়ে রইলো। যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে তারা। তবে বিহানের ঠোঁটে হাসি। সে খুশি তার বন্ধুর জন্য। কারণ তার বন্ধু আজ জীবনের আসল খুশির উৎস পেয়ে গেছে।
আদিত্য নূরকে নিয়ে সোজা নিজের রুমে এলো। রুমে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলো তাকে। বসিয়ে দিয়ে একটু সরে যেতেই নূর সুযোগ বুঝে নেমে দৌড় মারতে চাইল। তা দেখে আদিত্য তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“দাঁড়াও, কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
নূর ভীতু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“জমিলার কাছে যাবো।”
রাগ হলো আদিত্যর।বলতে ইচ্ছে হলো জমিলা কি তোমার বর! কিন্তু এই অবুঝ মেয়ের সেসব কি আর বোধগম্য হবে! তাই সে বলে উঠল,
“এখন থেকে তুমি এখানেই আমার সাথে থাকবে। এটাই তোমার আসল রুম।”
বোকা নূর বলে উঠল,
“তাহলে ওটা কি নকল রুম ছিলো?”
আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“চুপচাপ বসো এখানে। আসল,নকল সবই এখন এটাই তোমার।”
নূর এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“আমি এখানে থাকবোনা। আমি জমিলার কাছে যাবো।”
আদিত্য এবার একটু ধমকের সুরে বলল,
“চুপ। একদম কান্নাকাটি করবে না। এখানেই থাকতে হবে তোমাকে। আমার কথা না শুনলে আমি কি করবো জানোতো!”
নূর বিড়বিড় করে মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,
“কি আর করবেন, খেয়ে ফেলবেন। রাক্ষস যে।”
বিড়বিড় করে বললেও আদিত্য ঠিকই শুনতে পেল। মনে মনে হাসলো সে। বলল,
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। আমি রাক্ষস। আমার কথা না মানলে খেয়ে ফেলবো একদম। যাও, চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসো। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি। এখন থেকে তোমার কাজও আমিই করবো। অন্য কারোর কাছে যাবে না তুমি।”

নূরের ভয়ে কলিজা জমে গেল। কি বলে লোকটা! এখন আমাকে এই রাক্ষসের সাথে থাকতে হবে! ভয়ে নূর ঠিকমতো কাঁদতেও পারছেনা। আদিত্য নূরের খাবার নিয়ে এসে নূরকে খাইয়ে দিতে চাইলো। নূর প্রথমে না করলেও আদিত্যর ভয়ে শেষে খেতে বাধ্য হলো। নূর খাচ্ছে আর ভাবছে রাক্ষস তাকে খাওয়ার আগে মোটাতাজা করার জন্য তাকে এভাবে খাওয়াচ্ছে। কিভাবে বাঁচবে সে এই রাক্ষসের হাত থেকে! খাওয়া শেষে এবার ঘুমানোর পালা এলো। এবারতো ভয় আরও বাড়ছে নূরের। সে এই রাক্ষসের সাথে একা কিভাবে থাকবে! ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে রইল নূর৷ আদিত্য বলল,
“রাত হলো ঘুমাবে না? ওখানে বসে আছ কেন? বিছানায় আসো।”
নূর ভীতু গলায় বলল,
“আমি এখানেই থাকবো। বিছানায় শুইনা আমি।গ্রামেওতো আমাকে মাটিতে পাটি পেরে শুতে দিতো। তাই বিছানায় ঘুম ধরে না আমার।”
আদিত্য বুঝল জোর করলে কাজ হবে না। নূরের মন জয় করতে হবে তাকে। সে তখনকার আনা খেলনা গুলো দেখালো নূরকে। বড় বড় টেডি বিয়ার গুলো দেখিয়ে বলল,
“এই দেখ তোমার জন্য কত সুন্দর সুন্দর পুতুল এনেছি। ওই পঁচা পুতুল দিয়ে আর খেলতে হবে না। এগুলো দিয়ে খেলবে।”
নূর তখন বলে উঠল,
“কেন? আমার পুতুল ফেলে দিবো কেন? ও আমার বন্ধু না! বন্ধু পূরানো হয়ে গেলে কি কেউ ফেলে দেয় নাকি! ও আমার সাথেই থাকবে।”
অবুঝ নূর কথাটা অতটা না বুঝে বললেও আদিত্যর মনে ঠিকই দাগ কেটে গেল কথাটা। বুঝতে পারল নূরের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, নিস্পাপ। সামান্য একটা পুতুলকে কতটা ইমোশন দিয়েছে।এইজন্যইতো মেয়েটা তাকে এতটা মুগ্ধ করে। এমন নিস্পাপ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কেউ দিতে পারে না। আদিত্যের যেন লোভ হচ্ছে। নূরের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ। নূরের মবে তারজন্য জায়গা পাওয়ার লোভ। তবে আদিত্য জানে তা খুব একটা সহজ হবে না। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়া যে এত সহজ না৷ তবে আদিত্য হার মানবে না। একদিন সে ঠিকই ওই মনে নিজের জন্য একটু জায়গা করে নিবেই।

অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। কিন্তু নূর বিছানায় আসছে না। আদিত্য কতভাবে তাকে ডাকার চেষ্টা করছে কিন্তু আসছেই না৷ আদিত্যর নিজের পরিস্থিতিতে নিজেরই করুনা হচ্ছে যেন। যেখানে হাজারটা মেয়ে আদিত্যের বিছানায় আসতে লাইন ধরে থাকে। আর আজ আদিত্যকে কিনা নিজের বিয়ে করা বউকে বিছানায় আনতে কত খাটুনি করতে হচ্ছে। ভাবতেই হাসি পায় তার। আদিত্য এবার নূরকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে বলল,
“জানো সোফার ভেতর কিন্তু ইয়া বড় বড় ইদুর লুকিয়ে থাকে। জলদি চলে আসো নাহলে কিন্তু তোমাকে খেয়ে ফেলবে।”
কিন্তু বেচারার এই প্রয়াসও ব্যার্থ গেল। নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ইদুর কি মানুষ খায় নাকি! আমাকে পাগল ভেবেছেন! ”
আদিত্য মেকি হেঁসে বলল,
“না না তুমি কেন পাগল হবে! পাগলতো আমি। আমার বাপ পাগল,আমার চৌদ্দ গুষ্টি পাগল।”
এসব বলে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিত্য। প্রথম দিনেই বোধহয় সে ফেল হয়ে গেল। মুখ হতাশ করে বিছানার খেলনাগুলো সরাতে নিলো আদিত্য। হঠাৎ হাতের ছোঁয়া লেগে একটা খেলনার মিউজিক বেজে উঠল।মিউজিকের শব্দে নূরের চোখ গেল সেদিকে। আদিত্যর পাশেই একটা মিউজিক্যাল বলডান্সের খেলনা। কাচের একটা বলের মতো। যার ভেতর এক জোরা কাপল ডান্সের পুতুল ডান্স করছে৷ তার মাঝে স্নো হোয়াইট ছড়াচ্ছে চারিদিকে। নূরের চোখ যেন আঁটকে গেল তাতে। চোখ পিটপিট করে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে সেদিকে। সেটা খেয়াল করল আদিত্য। সুযোগ বুঝে সে খেলনাটা হাতে নিয়ে নূরের দিকে দেখিয়ে বলল,
“এটা নিবে? দেখো কত সুন্দর! নিতে চাইলে এখানে এসো।”
নূরের যেন এই মুহুর্তে ভয়ের কথা আর মনে থাকল না। তার সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন ওই আশ্চর্যজনক জিনিসটা। নূর সেটা দেখার লোভে ধীরে ধীরে উঠে গেল আদিত্যর কাছে। বিছানায় এসে বসলো সে। চোখের দৃষ্টি শুধুই ওই খেলনাটাতে। বিছানায় বসে খেলনাটা নিজের হাতে নিলো সে। হাসি ফুটল আদিত্যর ঠোঁটে। যাক শেষমেশ নূরকে তার কাছে আনাতেতো পেরেছে। নূর খেলনাটা হাতে নিয়ে বিস্ময়কর নজরে তাকিয়ে দেখতে লাগল আর খেলনার ভেতরের ডান্স দেখে হাসতে লাগল সে। আদিত্য মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখল তাকে। নূর তার কাছে আছে। এখন তার সবটা জুড়েই শুধু প্রশান্তি। নূর খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে একসময় নিজেই ঘুমে ঢুলে পড়তে নিলো। তা দেখে আদিত্য ধরে ফেলল তাকে। আস্তে করে শুইয়ে দিলো তাকে বালিশে। মায়াময় চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের মুখপানে। মুখ নামিয়ে অধর ছোঁয়াল কপালে। নূরের গালে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে মায়াবী চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আম সরি। তোমাকে আগে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। তবে আর না। আজ আমার জীবনে তোমাকে পুরোপুরি স্বাগতম। আজ থেকে তোমাকে আর এক মুহূর্তের জন্যেও অবজ্ঞা করবোনা। তুমি আমার রাজ্যের রানী। আমার জান। আমার এঞ্জেল।”
এরপর নূরকে নিজের বুকে জড়িয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো আদিত্য।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here