মাত্র তিন মাস
পর্বঃ ৫
-কিরে অনামিকা তুই আজকাল খুব মন মরা হয়ে থাকিস।কি হয়েছে তোর?
উৎসর সাথে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি?
-না মা ও কিছুনা।এমনি।
-বাবা মায়ের কথা মনে হচ্ছে?যা তাহলে গিয়ে দেখে আয় উৎসকে নিয়ে।
-না মা এখন না।আর কয় দিন পরে যাবো।
-বাহ্!আমার বউমা দেখি আমাদের সাথে মিশে গেছে খুব সহজে।
এখান থেকে এখন সরতেই মন চায়না।
যেতেই মন চায়না আমাদের ছেড়ে।
-হ্যাঁ মা।
-আমি খুব খুশি জানিস,আমি চেয়েছিলাম আমার বউ দুইটা আমার মনের মত হোক।
দুজন ই আমার এই পরিবার টাকে নিজের পরিবার করে নিক।
নিজের পরিবারের মত ভাবুক।
মায়ার বন্ধনে বেধে রাখুক।
আর হয়েছেও তাই।
তোরা দু বউই আমার চোখের মণি।
মা আমাকে আর ভাবীকে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন।
সত্যিই!
বাড়ীর প্রতিটা মানুষ খুব ভালো।বাবা মা ভাবী,ভাইয়া সবাই ভালো।
উৎসও ভালো।তবে আমার জন্য হয়তো তার জন্ম না।
অন্য কারো জন্য।
আমি এ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলে এই মানুষ গুলোকে খুব মিস করবো।কোন দিন ভুলতে পারবোনা এদের।
তারা কি আমাকে ভুলতে পারবে?
এখন যেমন ভালবাসে ঠিক তেমনি কি ভালবাসবে পরেও?
নাকি ঘৃণা করবে আমায়?
-অনামিকা!কি হলোরে?
-কিছুনা ভাবী।
আচ্ছা আমি একটু আসছি।
-আচ্ছা যাও।
-মেয়েটার কি যে হলো হঠাৎ।শুধু মন মরা হয়ে থাকে।
-হ্যাঁ মা আমিও সেটা লক্ষ্য করেছি।
-এক কাজ কর,আজ উৎসকে ফোন দিয়ে বল বাসায় তাড়াতাড়ি আসতে।
তারপর আমি যা করার করছি।
-আচ্ছা মা।
:
:
-হ্যালো উৎস!
-জ্বী ভাবী।
-ভাই তুমি আজ একটু বাসায় তাড়াতাড়ি এসো তো।
-কেন ভাবী?
-মা তোমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলেছেন।
-আচ্ছা ভাবী।আমি ট্রাই করবো।
এদিকে প্রায় সন্ধ্যা।
মা আর ভাবী মিলে কি সব যেন করছেন।
আমাকে কেউ কিছুই বুঝতে দিচ্ছেন না।
সন্ধ্যা হলেই উৎস বাসায় চলে আসে।
ও তো এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেনা।
আজ হঠাৎ।
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
-অনু!
-জ্বী।
-মা আমাকে তাড়াতাড়ি কেন আসতে বলেছেন?
-জানিনা আমি।
-আচ্ছা ঠিকাছে।সরো দেখি আমি।
উৎস মায়ের রুমে যায়।
-মা,কি হয়েছে?কোন সমস্যা?
-না।কোন সমস্যা না।
-যা ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আয়।
-কি হয়েছে বলবে তো?
-আগে ফ্রেশ হয়ে আয় তো।
উৎস রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
-কি হয়েছে বলোতো অনু!কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।
-আমিও বুঝতে পারছিনা।ভাবী আর মা সারাদিন কি যেন করেছে।আমাকে একটু বুঝতেও দেয়নি।
-আচ্ছা দেখি এখন গিয়ে।
আমি উৎসকে এক কাপ চা করে এনে দিলাম।
উৎস চা টা পান করে আমাকে নিয়েই মায়ের রুমে ঢুকলো।
-কি হয়েছে মা?এখন বলো!
মা আমাকে আর উৎসকে দুইটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দেন।
-কি আছে এতে?
-আরে ভাই,রুমে গিয়ে খুলে দেখোনা।কি আছে এতে।
এত প্রশ্ন করতে পারোনা তুমি।
যাও যাও খুলে দেখো।
-হ্যাঁ যা।দুজন খুলে দেখ।
আর পরে আমার কাছে আয়।
আমি আর উৎস রুমে চলে এলাম।
প্যাকেট খুলে দেখি একটা শাড়ী।
আর কিছু জুয়েলারি।
উৎসও খুলে দেখে আমার শারীর রঙেরই একটা পাঞ্জাবী ওর প্যাকেটে।
-এগুলো কেন?শাড়ী,পাঞ্জাবি।
-আমি কি জানি?
-আমাদের কি আজ বিবাহ বার্ষিকী নাকি?
-বিয়ের এখনো তিন মাসও হয় নি।
আর এক বছর।
-ওহ তাইতো।
আচ্ছা কি আর করার চলো পরে নেই।মা তো পরে তারপর যেতে বলেছেন তার কাছে।
-হুম।
-তো পরো।
-আপনি বাইরে যান।
-বাইরে কেন যাবো?
-বাইরে কেন যাবো মানে?আমি শাড়ী কি আপনার সামনে পরবো নাকি?
-ওহ্ তাইতো।আচ্ছা যাচ্ছি দাঁড়াও।
আমি পাঞ্জাবি টা পরে নেই আগে।
-এই কি করছেন কি করছেন?
-পাঞ্জাবি পরবো।টিশার্ট টার উপরেই পরবো নাকি?তাই খুলছি।
-আপনার কি লজ্জা শরম কিছু নাই নাকি?
-বউ তুমি আমার।বউ এর সামনে কিসের লজ্জা শুনি?
-ধুর!আপনার সাথে কথা বলাই ঠিক না।
উৎস পাঞ্জাবী পরছে।
আর আমি পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি।
-হুম হয়ে গেছে।
এবার আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।আর তুমি শাড়ী পরে এসো।
-আচ্ছা।
-সাজুগুজু করতে আবার এক ঘন্টা লাগিয়ে দিওনা।
আমি উৎসকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলাম।
শাড়ী পরার কিছু ক্ষণ পর আমি দরজার সামনে গিয়ে ডাকলাম।
-আপনি কি আছেন এখানে?
-হুম আছি।
-আমার শাড়ীর কুঁচি গুলো একটু ধরে দিতে পারবেন?
আমি একা একা ঠিক করতে পারছিনা।
-হুম দরজা খোলো।
আমি দরজা খুলতেই উৎস আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
-এই যে!কুঁচি ধরার জন্য ডেকেছি।
এভাবে চেয়ে থাকার জন্য না।
-ওহ হ্যাঁ তাইতো।
তারপর উৎস নিচে বসে আমার শাড়ীর কুঁচি গুলো ঠিক করে দেয়।
-অনু!
-হুম।
-সারাজীবন তোমার শাড়ীর কুঁচি গুলো ঠিক করে দেয়ার অধিকার টুকু চাই।
দিবে আমায়?
উৎস আমার শাড়ীর কুঁচি ধরে উপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে কথা গুলো বলছে।
আমি কথা কাটিয়ে বললাম,
মা অপেক্ষা করছেন।চলুন তাড়াতাড়ি।
-ওহ হ্যাঁ চলো।
এই দাঁড়াও দাঁড়াও।
-কি?
-তোমার জন্য কিছু চুড়ি কিনেছিলাম।দেয়ার সাহস পাইনি।
শাড়ী এনেছিলাম,ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে।
কাঁচের ছিলোনা বলে ভাঙেনি।
চুড়ি গুলো কাঁচের।
তাই দেইনি।
-ওহ আচ্ছা।
-আমি আজ পরিয়ে দেই চুড়ি গুলো?
না মানে,তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আরকি।
-হুম।
-হুম কি?
-হুম মানে ঠিকাছে।দিন।
-এক মিনিট,
হাত বাড়াও।
-বাড়ালাম।
উৎস আমার হাতে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিচ্ছে।
আর হঠাৎ ই একটা ভাঙা চুড়ি আমার হাতে লেগে হাত একটু কেঁটে যায়।
আর আমি উঁহ শব্দ করে উঠি।
আর সাথে সাথে উৎস ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
-কিছু হবেনা অনু!কিছু হবেনা।
বাজে চুড়ি।আমার বউকে কষ্ট দিছে।
আমি কি জানতাম,চুড়ি গুলোর মাঝে যে আবার একটা ভাঙা চুড়িও থাকবে।
উফফ।খুব লেগেছে না?
-লেগেছে হাতে।বুকে না যে আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
-উফ শিট।
-দাঁড়াও আমি স্যাভলন ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছি।
-কিচ্ছু করা লাগবেনা।
হালকা একটু লেগেছে।
হাত কেটে পড়ে যায়নি।
আপনার রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে,না জানি কত খানি কেটে গেছে।
-তোমার অল্প আঘাতেও আমার পাহাড় সমান কষ্ট হয়।যদি বুঝতে।
-মানে?
-কিছুনা।
-চলুন মা অপেক্ষা করছেন।
-ক্রিম টা লাগিয়ে দিয়ে নেই।এক মিনিট।
ক্রিম লাগানোর পর আমি আর উৎস মায়ের রুমে যাই।
এত ক্ষণে রাত হয়ে গেছে।
-বাহ্ আমার ছেলে আর বউ মাকে তো দারুণ লাগছে।
-আসলেই মা।খুব সুন্দর লাগছে দুজনকে।
-এবার বলো কি বলবে,
-বড় বউমা,
-জ্বী মা।
-যাও ওদের নিয়ে যাও।
-কোথায় যাবো?
-আরে বাবা চলোই না আমার সাথে।
এত কথা কেন বলো?
ভাবী আমাকে আর উৎসকে ছাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
-ভাবী,এই রাতে ছাদে গিয়ে কি করবো?
ক্ষুধা পেয়েছে আমার।চলো নিচে চলো ডিনার করবো।
-আরে আগে তোমরা চলোতো আমার সাথে।
ছাদের দরজার সামনে গিয়ে ভাবী বলেন,
-এবার তোমরা দুজনই চোখ বন্ধ করো।আমি দরজা খুলবো।
-চোখ বন্ধ করলে যাবো কি করে?
-আমি দরজা খুলে দুজনকে নিয়ে যাবো,এত চিন্তা করা লাগবেনা।
তোমরা শুধু আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবেনা।
-উফ কি জ্বালা।ওকে ঠিকাছে।
আমরা দুজন চোখ বন্ধ করলাম।
ভাবী আমাদের দুজন কে হাত ধরে নিয়ে গেলেন।
কিছু ক্ষণ পর বললেন,
-এবার চোখ খোলো দুজন।
এক সাথে।
এক দুই তিন।
খোলো।
আমি আর উৎস চোখ খুলে অবাক।
-চারিদিক মোমবাতি জ্বালানো।
খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে মোমবাতি গুলো।
মাঝ খানে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার।
এখানে আছে খাবার আর কিছু মোমবাতি।
পাশেই দুইটা ছোট ছোট বক্স।
একটা কেক,ছুড়ি আর কিছু ফুল।
-এসব কি ভাবী?
-সারপ্রাইইইইজ।
-উফফ এসব কখন করলে তোমরা?
-ভাবী,আজ সারাদিন এগুলোর আয়োজনই করেছেন আপনি আর মা মিলে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে না?
-হ্যাঁ গো হ্যাঁ।
মায়ের ইচ্ছে ছিলো।তোমাদের জন্য ক্যান্ডেল নাইট ডিনারের আয়োজন করা।
নাও হয়ে গেছে আমাদের কাজ।
এবার তোমরা ইঞ্জয় করো।
আর হ্যাঁ।এই বক্স দুইটায় দুইটা জিনিষ আছে।একে অপরকে দিও।
আমি যাচ্ছি।
-ভাবী,থ্যাংক ইউ।আপ্নিও একটা চেয়ার এনে আমাদের সাথে বসুন না।
-দেখো মেয়ে কি বলে,
আমি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কি করবো শুনি?
তোমরা থাকো।আমি আসছি।
-থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাবী।
-হা হা হা।ওয়েলকাম।
ভাবী চলে যায়।
-অনু!
-হুম।
-সারপ্রাইজ টা দারুণ ছিলোনা?
-হ্যাঁ।
-বসো তাহলে।
উৎস আমার চেয়ার টা এগিয়ে দিলো।
আমি বসলাম।
উৎসও বসলো অন্য চেয়ার টাতে।
উৎস বক্স দুটো খুলে দেখে একটা ছেলেদের আংটি আরেকটা মেয়েদের আংটি।
-হাত টা দাও দেখি পরিয়ে দেই।
-না থাক।আমি একাই পরে নিবো।
-আরে দাওনা।
উৎস একাই আমার হাত টা ধরে আমার আংগুলে আংটি পরিয়ে দেয়।
আর অপর আংটিটা আমার হাতে দিয়ে দিয়ে বলে,
এই নাও এটা পরিয়ে দাও আমায়।
-আপনি একাই পরে নিন না।
-সারাজীবন তো থাকবেনা পাশে।
আংটিটাই না হয় পরিয়ে দাও।
তোমার স্মৃতি ভেবে আঙুলে সারাজীবন রেখে দিবো।
আমি উৎসর হাত থেকে আংটিটা নিয়ে ওর আঙুলে পরিয়ে দিলাম।
-কয়টা পিক তুলি?
সেল্ফি?
প্লিজ না করোনা।
-হুম।
উৎস আমাদের কিছু সেল্ফি নেয়।
তারপর দুজন মিলে আমরা কেক কাটি।
জ্বলতে থাকে মোমবাতি গুলো।
আমরা খাবার খাই।
-আমাকে এক লোকমা খাইয়ে দিবে?
আমার না খুব ইচ্ছে ছিলো।আমার বউ এর হাতে প্রতিদিন ডিনার করবো।কিন্তু পোড়া কপাল আমার।
দিবে আজ একটা লোকমা খাইয়ে?
আমি উৎসর মুখে খাবার তুলে দিলাম।
উৎসর দু চোখ জলে ছলছল করছে।
আরেক লোকমা নিন।
একবার খায়না।আর খাওয়ার সময় কান্না করেনা।
-হুম দাও।
আসলেই আজকের রাত টা যত দিন বাঁচি মনে থাকবে।
এমন সারপ্রাইজ আর কোন দিন পাবো কিনা জানা নেই।
ইচ্ছে করছে তিনটা মাস থেকেই যাই মানুষ গুলোর সাথে।কে জানে আর কোন দিন দেখা হবে কিনা।
খাওয়া দাওয়া শেষ।
চলো তাহলে নিচে যাই।
ঘুম পাচ্ছে।
-হুম চলুন।
-এই দাঁড়াও দাঁড়াও।
ফুল গুলো তো দিয়ে নেই।
উৎস ফুল গুলো হাতে নিয়ে যেই না আমাকে দেয়ার জন্য চেয়ার থেকে নেমে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ছাদে বসেছে।
আর তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠে।
সায়ান ইজ কলিং…
#চলবে