মায়াবতী কাঞ্চনা পর্ব -০৯ ও শেষ

#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৯

আমি দেখছি,আপনি এখানেই থাকুন।

কথাটা বলে উঠে দাড়াতেই ডানহাত চেপে ধরে খাটে বসালো সেলিম।চোখ গরম করে কাঞ্চনার দিকে তাকিয়ে বললো-

সব সময় বেশী বোঝা আর হুট করে কোনো কাজ করা বন্ধ কর।চুপচাপ এখানেই বসে থাকবে।আমি দেখছি,

বলেই বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।জ্বরের অসহনীয় তাপমাত্রা’য় বারবার শরীর নুয়ে পড়ছে।ইচ্ছে করছে এভাবেই বিছানায় শুয়ে থাকতে।কিন্তু এই মুহুর্তে কষ্ট হলেও তাকে বাইরে যেতে হবে।গভীর রাতে দরজায় এমন অতর্কিত আক্রমণ খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না সেলিমের।ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে আলগোছে সিটকিনি খুললো।দরজা সামান্য ফাক হতেই ওপাশ থেকে পুনরায় হইচই এর শব্দ এলো। প্রায় সাত-আটজন গ্রামের মুরব্বি এবং ছেলে-পেলেরা দরজার সামনে বসে হাক ছাড়ছে।

সেলিম শক্ত কন্ঠে তাদের সামনে গিয়ে বললো-

কি সমস্যা আপনাদের?এতো রাতে দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন?

ফুসে উঠলো চাচা শফিক হাওলাদার।ষাটোর্ধ বয়স্ক লোকটি ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো-

তুমি রাইত বেরাইতে নষ্টামি করতে পারবা,আর আমরা দরজা ধাক্কাইলেই দোষ।ওই মাইয়া ডা কই?

এরইমধ্যে ভেতর থেকে কাঞ্চনা উকি দিলো। এলাকার মানুষ জন খুবই ভয়ংকর।সামান্য একটু কারন পেলেই এরা সেটাকে দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।অসুস্থ মানুষটাকে একা সবার মাঝখানে ছাড়াটা বিপজ্জনক। ভেবেই নিজেও সবার সামনে এলো।

________
________
সকাল আটটা।মির্জা বাড়ির সামনের বড় উঠোনে শালিস বসেছে।একপাশে এলাকার মুরব্বিরা চেয়ারে বসা। সাথে সুজন মির্জা এবং সুমন ও আছে।অন্যপাশে গ্রামের মানুষজন বসে আছে বিচার দেখার জন্য।সেলিম বামপাশের একটা চেয়ারে কপালে হাত রেখে বসে আছে।পাশেই কাঞ্চনা দাঁড়িয়ে আছে।সারা রাত বেশ ধকল গেছে নিজেদের কে রক্ষা করতে।গ্রামের মানুষ গুলোর থেকে বেশ কৌশলে সেলিম কে নিয়ে মির্জা বাড়িতে উঠেছে।মির্জা বাড়ির উপরে কেউ কথা বলবে না সেটা ভেবেই।

নিরবতা ভেঙে এলাকার চেয়ারম্যান ফজলু মুন্সি বললেন-

আজকে তোমার বিয়া সুমনের সাথে।অথচ বিয়ের আগের রাতেই তোমারে গ্রামের লোকজন তোমার প্রাত্তন স্বামীর সাথে হাতে-নাতে ধরছে।কারনটা কি কাঞ্চনা?তুমি মির্জা বাড়ির মেয়ে হইছো দেইখা তো আর যা ইচ্ছা তাই কইরা ছাড় পাবা না।

মাথা নিচু করে ফেললেন সুজন মির্জা।সুমন ও শান্ত ভাবে কাঞ্চনার দিকে তাকিয়ে আছে।

কাঞ্চনা বেশ আশ-ফাস করলো উত্তরটা দিতে।তার নিরবতা পেয়েই পুনরায় চেয়ারম্যান সেলিমের উদ্দেশ্য বললো-

তুমি থানার বড় বাবু।সবাই সম্মান করে তোমারে।আশা করি আইন তোমারে বোঝাইতে হবে না।একজন আইনের লোক হইয়া এরকম একটা নিকৃষ্ট কাজ কিভাবে করতে পারলা।

ফুসে উঠলো শফিক হাওলাদার। তেড়ে তেড়ে বললেন-

বাপ মা তো সব ক্ষুয়াইছিস।এবার আমাগোও খা।মান সম্মান তো কিচ্ছু রাখলি না।এতোই যদি মেয়া মানুষ ছাড়া না থাকতে পারিস তাইলে বিয়া করলেই তো পারতিস।রাইতের আন্ধারে ফষ্টিনষ্টি করবার কি ছিলো।

মাথা উচু করে তাকালো সেলিম। কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জ্ঞাতিশত্রু চাচার উপর।তারপর চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন-

আপনার কথাটা আমি ঠিক বুজলাম না চাচা।আমার শরীর টা ভালো না।কাল রাত থেকে আপনার লোকের জ্বালায় অতিষ্ঠ আমি।বেশী বাড়াবাড়ি করতে বারণ করবেন।ক্ষমতা আমার হাতেও আছে।এমন কিছু দয়া করে করবেন না যাতে আপনাকে সমস্যায় পড়তে হয়।

ফুসে উঠলো চেয়ারম্যান। নিজেকে সংযত করে পুনরায় বললো-

এলাকার মানুষ তোমারে আর কাঞ্চনারে কাইল হাতে নাতে ধরছে একই ঘরে।

তো?তাতে আপনাদের সমস্যাটা কি?আমার স্ত্রীকে নিয়ে এক বাড়িতে শুধু রাত কেন সারা জীবন কাটালেও আপনাদের সমস্যা কি সেটাই বুজতে পারলাম না।(গম্ভীর কন্ঠে সেলিম বললো)

দাত খিচিয়ে চেয়ারম্যান বললেন-

কাঞ্চনা তোমার বউ ছিল, কিন্তু এখন আর নাই। আজকেই তো অন্য বেটার সাথে তার বিয়ার কথা ছিল।

সেলিম-কে বলেছে,কাঞ্চনা আমার স্ত্রী ছিল?কাঞ্চনা আমার স্ত্রী ছিলো এবং বর্তমানেও আছে।দেখুন চাচা,আপনাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে আর কাঞ্চনা কে এক ঘরে পেয়েছেন মানে এখানে একটা কেলেংকারির ঘটনা বানাবেন। তাই তো?তাহলে শুনুন,কাঞ্চনার সাথে আমার মনমালিন্য ছিলো,যার কারনে আলাদা থাকতাম।এটা সম্পুর্নই আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার।যেটা আমি আপনাকে বলতে চাইছি না।যেটা বলছি সেটা হলো,কাঞ্চনার সাথে আমার ডিভোর্স হয়নি।আমরা স্বামী_স্ত্রী।এবার প্রশ্নটা হচ্ছে ও কেন তাহলে বিয়ে করছে?তাহলে এই উত্তরটাও আমার থেকে শুনুন।বিয়ে ঠিক হয়েছে এখনো হয় নি।আমরা আদোও ডিভোর্স দিব কি না, নাকি আবার বিয়ে করবো সেটা আমাদের তিন পরিবারের উপর ছেড়ে দিলেই খুশি হবো।দয়া করে আপনারা নাক গলাবেন না। যদি আপনাদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় তো আমরাই ডাকবো।এবার আসতে পারেন।

বেশ তেজ দেখিয়ে ব্যঙ্গ করে শফিক হাওলাদার বললো-

এহহহহ বউ,বউ।কইলেই কি আর বউ থাহে নাকি।এতগুলা দিন আলাদা থাকছো, ধর্ম মতে কি আর এই বিয়া আছে।এতো কবেই সম্পর্ক শেষ হইয়া গেছে।এখন আবার একসাথে থাকতে হইলে হিল্লা বিয়া পড়াইতে হইবে।বুঝছো?

চমকে তাকালো কাঞ্চনা।এলাকার ইমাম সাহেব ও উপস্থিত আছেন।তিনি বারকয়েক উপস্থিত সবার দিকে তাকালেন।কাঞ্চনার চমকানো মুখশ্রী দেখে পরিষ্কার করলেন। বললেন-

স্বামীর থেকে তালাক হওয়ার পর যদি আবারো সেই স্বামীর ঘর করতে চায়, তাহলে সেই নারীকে ভিন্ন কোনো পুরুষের সাথে বিয়ে করতে হবে এবং সেখানে সংসার করতে হবে।এরপরে যদি সেই পুরুষ নিজ ইচ্ছায় সেই নারীকে তালাক দেয় তাহলেই সে পুনরায় প্রথম স্বামীকে বিয়ে করে সংসার করতে পারবে।

সেলিম কাঞ্চনার দিকে তাকালো।ছলছল করা চোখ গুলো বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে।কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ইমামকে বললো-

আমার আর কাঞ্চনার তো তালাক হয় নি।না আইনমতে আর না তো ধর্মমতে।তাহলে এখানে হিল্লা বিয়ের কোনো প্রশ্নই আসে না।দ্বিতীয়ত,যদি তারপরেও এতোদিন আলাদা থাকার কারনে কোনোরুপ সমস্যা হয়,তাহলে প্রয়োজনে আবার না হয় ওকে বিয়ে করেই ঘরে তুললাম।আশা করি, এতে আর কারো কোনো সমস্যা হবে না।

শফিক হাওলাদার বজলুল আলমের দিকে তাকিয়ে বললো-

আপনের পোলার লগে তো বিয়া হওয়ার কথা ছিল।এহন আবার সেলিমের লগে।এক মাইয়া কয়জন বিয়া করবেন?

এতক্ষণে নিরব থাকা সুমন মুখ খুললো এবার।শফিক এর দিকে তাকিয়ে বললো-

সেটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন চাচা।আমরা দেখে নেব বিষয়টা।

একে একে জনসমাবেশ ভাঙন ধরেছে।হঠাৎ ইমাম সাহেব কিছু একটা চিন্তা করে পুনরায় চেয়ারে বসলেন। সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললেন-

ঠিক আছে।তোমরা যদি আবারো সংসার করতে চাও, তাহলে এই বিচার সভায়ই বিয়েটা আবার হোক।নাহলে পরবর্তীতে আবারো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চমকালো সেলিম। এতক্ষণের কথাগুলো কাঞ্চনার যাতে সম্মান নষ্ট না হয় সে জন্য বললেও বিয়েটা তার পক্ষে আগ বাড়িয়ে করা সম্ভব নয়।বিচার সভা থেকে পাচ মিনিটের সময় চেয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো সে।চমকে উঠে সেলিমের হাত ধরলো কাঞ্চনা।এই বুঝি সেলিম আবারো তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ভরা জনসভায় লজ্জা,সরম সব বাদ দিয়ে ছলছল চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললো-

আমাকে নিবেন না। আমিও যাব বাড়িতে।

হাসলো সেলিম।যেন ওই হাসির মাঝখানে বিস্তর এক সুখ ছিল তার।কাঞ্চনার দিকে ঘুরে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো-

আমি তো তোমাকে তাড়িয়ে দেই নি কাঞ্চনা।তুমি নিজের ইচ্ছায় সেদিন ঘর থেকে বেরিয়েছো।আবার নিজের ইচ্ছায় কাল গভীর রাতে ঘরে ঢুকেছো। আমি তো বাধা দেয় নি।তোমার ঘর,তোমার সংসার।তুমি চাইলেই সেখানে যেতে পারো।সবটা তোমার মর্জি।এমনকি সম্পর্ক টা ভেঙে যদি নতুন ভাবে ও অন্যকারো সাথে জুড়তে চাও তাও আমি আটকাবো না তোমায়।

কথাগুলো বলে হাত ছাড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল সেলিম।কান্নায় ভেঙে পড়লো কাঞ্চনা।বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো-

ভাইজান,আমি আর পারছি না।এভাবে আর থাকা যায় না।আমি দ্বিতীয় কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।জানি,তোমার সম্মান নষ্ট হবে এতে।কিন্তু আমায় ক্ষমা করে দাও।আমি ওকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের ঘর করতে পারবো না।

এরইমধ্যে সভায় চলে এলো সেলিম। জ্বরে লাল হয়ে যাওয়া জর্জরিত শরীরটাকে কোনোমতে টেনে সুজন মির্জার সামনে এলো।হাতের পাচ লাখ টাকার বান্ডিলগুলো সুজন মির্জার হাতে দিয়ে বললো-

আমার আব্বা ভুল করছিলেন।এই ভুল অনেক আগেই শুধরোতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুযোগ হয়নি।এগুলো নিয়ে দয়া করে কাঞ্চনাকে ঋণমুক্ত করুন।
আমি চাই না,আমার স্ত্রী কারো কাছে ঋণী থাকুক।

মুখ চেপে হেসে ফেললো কাঞ্চনা।তাহলে সেলিম টাকা দেওয়ার জন্যই বাড়িতে গিয়েছিল।আর সে ভেবেছিলো এই বুঝি চলে গেছে তাকে ছেড়ে।

উপস্থিত সবার মাঝখানে কাঞ্চনার হাত ধরে সেলিম সবার উদ্দেশ্যে বললো-

এবার তাহলে আপনারা বিয়ে পড়ানো শুরু করতে পারেন।যদি এরপরেও আপনাদের কোনো সমস্যা না থাকে।

উপস্থিত সবার মাঝখানে বেশ আলোচিত ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো।সুমন ও দ্বিমত করে নি। আর নাতো সুজন মির্জা।বিয়ে পড়ানোর পর এক কাপড়েই কাঞ্চনাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে সেলিম।নিজের হাতে বরণ ডালা সাজিয়ে বরন করে ঘরে এনেছে কাঞ্চনাকে।অতি সন্তপর্ণে লুকিয়ে রাখা সুখগুলো যেন হাসির মাধ্যমে বারবার বুক চিরে বাইরে প্রকাশিত হতে চাচ্ছে।আজ এতো বছর পর তার একাকীত্বের নগরে নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে।

ঘরে ঢুকেই বিছানার উপর শুয়ে পড়লো সেলিম।পাশেই রাতের রুটিগুলো রাখা।কাঞ্চনা ব্যাকুল হয়ে সেলিমের কাছে এলো। গায়ে হাত রেখে জ্বর চেক করতেই সেলিম বললো-

আগে গোসল করে এসো।খুব ক্লান্ত তুমি।

কাঞ্চনা আমতাআমতা করে বললো-

জামা-কাপড় তো কিচ্ছু আনা হয়নি।

আলতো হেসে আলমারির দিকে দেখিয়ে সেলিম বললো-

আলমারি খোলো।

দ্রুত পায়ে ছুটে গিয়ে আলমারি খুললো কাঞ্চনা।অবাক হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।পুরো আলমারি জুড়ে শাড়ির মেলা বসেছে।এক র ঙা শাড়ি যে খুব পছন্দ কাঞ্চনার। এগুলো সেলিম তার জন্যই কিনে রেখেছে তাহলে।হাসি চেপে রেখে সেলিমকে নিজের নাম জানার জন্য পুনরায় জিজ্ঞেস করলো-

এগুলো কার জন্য কিনেছেন?

জ্বরে ক্লান্ত সেলিম ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো কাঞ্চনার দিকে।মেয়েরা যে সবকিছু বোঝার পরেও নিজের নামটা শোনার জন্য বারবার একই প্রশ্ন করে সেটা তার অজানা নয়।কাঠকাঠ কন্ঠে বললো-

ভেবেছিলাম দ্বিতীয় বউকে দিব।কিন্তু তা তো আর তুমি হতে দিলা না। মাঝরাতে ছুটতে ছুটতে আমার রুমে ঢুকে পরে গ্রামের সামনে আমার ইজ্জতে দাগ লাগাইলা।শেষে আবারো তোমায় বিয়ে করতে হলো।এখন তো এগুলো তোমাকেই পড়তে হবে। আচ্ছা দেখো তো তোমার গায়ে লাগে কি না ব্লাউজ।

হাতের কালো রঙের ব্লাউজটা গায়ে জড়িয়ে সেলিমকে ভেংচি মেরে বললো-

এহহহ,মিথ্যা কথা। এগুলো সব আমার জন্য বানিয়েছেন আমার মাপের।

বলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে কালো রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ আর পেটিকোট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরের পাশেই বাথ্রুম।

সেলিম বারকয়েক ডাক দিয়ে বললো-

তাদের রুমের মধ্যেও লাগোয়া বাথ্রুম আছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। তেত্রিশোর্ধ রমনী তো আজ অষ্টাদশীর চাঁদ হাতে পেয়ে ষোড়শী কন্যা হয়ে গেছে।

_________
নির্জন রাস্তা।চারদিকে গাছ-গাছালি দিয়ে ভরা মাঝখানে সুন্দর ভাবে সারিবদ্ধ ভাবে ইট দিয়ে সাজানো।বাড়ির গেটের সামনে একটা বাইক রাখা।তেতাল্লিশ বছরের এক মাঝবয়সী পুরুষ বেশ যত্ন সহাকারে বাইকে বসিয়ে দিচ্ছে এক চৌত্রিশ বছরের রমনীকে।হাত_পা ফোলা-ফ্যাপা সাত মাসের সেই পোয়াতি নারীর পা দুটো আলোগোছে ধরে বাইকের উপর ঠিকমতো বসালো।এতো যত্নের মাঝেও মুখ থেমে নেই প্রণয় পুরুষের। মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে অজস্র চিন্তাধারার ধমকিত সুর।

তোমায় কতবার বলেছি কাঞ্চনা,এই অবস্থায় স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।তুমি আমার কোনো কথাই শোনো না। এই অবস্থায় এভাবে প্রতিদিন হাটাচলা না করাই ভালো।

ঠোট উলটে করুন স্বরে কাঞ্চনা বললো-

আমার একা একা ঘরে থাকতে ভালো লাগে না।আর মাত্রই তো সাত মাস।আরেকটা মাস পরেই ছুটি নিয়ে নিব।

সেলিম -তোমার বাবার বাড়ি তো থাকতে পারো।ওনারা কি মনে করে বলো তো।কত বার নিতে এলো অথচ এক দিনের বেশী থাকতেই চাও না।শেফালী চাচি কেও আসতে বারণ করেছো।এই অবস্থায় রান্না বাড়া করা, সমস্ত কাজ করা কি উচিত। এতোটা খামখেয়ালী কেন কর তুমি?

কাঞ্চনা-আমার ওই ঘরটাতেই ভীষণ ভালো লাগে।আর রান্না করতে তো কষ্ট হয় না। কষ্ট হলে আমি নিজেই বলবো।এবার তাড়াতাড়ি চলুন তো,স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে।

সেলিম হাল ছেড়ে বললো-

ছুটির জন্য আবেদন করেছি।খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে যাবো।তারপর তোমার সব ঘাড় তেড়ামি বের করবো।

রাত বারোটা,ছাদের এক কার্নিশে পাটি বিছিয়ে পূর্নিমার আলোয় বসে আছে সেলিম।তার কোলের মাঝখানে আধশোয়া হয়ে বুকে মাথা রেখে আছে কাঞ্চনা।নিরবচ্ছিন্ন এই পরিবেশে দুজনেই নিরবতার খেলায় মেতে উঠেছে।এ যেন কোনো অতৃপ্ত আনন্দের পরিবেশ।হঠাৎ নিরবতা ভেঙে কাঞ্চনা বলে উঠলো-

আচ্ছা,আমি টানা তেরো বছর ছিলাম না আপনার কাছে।বিয়ে করেন নি কেন এ ক বছরে?

নড়েচড়ে বসলো সেলিম।কাঞ্চনার পেটের উপর থাকা হাতটা আরেকটু গভীর করে ধরে দুষ্টুমি করে বললো-

আমি কি তোমার মতো বিয়ে পাগল নাকি।যে বিয়ের কথা তুলতেই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যাব।এই সুমনকে তো আমার সামনেই বিয়ে করছিলে,পেছনে আরো কতগুলো বিয়ে করতে চেয়েছিলে কে জানে?

কাঞ্চনা তেড়ে উঠে বললো-

এই একদম খোটা দিবেন না।আমি ব্যাস,ভাইজানের কথাতেই ভুল করে রাজি হয়ে গেছিলাম।বিয়ে করি নি তো আর।আচ্ছা বলুন না,কেন করেন নি বিয়ে?ভাইজানের ভয়ে নাকি তালাক হয় নি তাই।

কাঞ্চনার থুতনি নরম ঠোট দুটোর স্পর্শ দিলো সেলিম।তারপর ঘাড়ের উপর ঠোট দুটোকে আলতো চেপে ধরে বললো-

এই তেরো বছরে ছাব্বিশটা বিয়ে করলেও আমাকে কেউ আটকাতে পারতো না।আর না তো সেলিম কাউকে ভয় পায়।

থেমে,
তোমরা মেয়েরা খুব সহজে যে কারো মায়ায় জড়িয়ে পড়ো।আবার হুট করেই মায়া কাটিয়ে দূর হয়ে যাও।কিন্তু আমরা তো আর তেমন নই।একবার কারো মায়ায় পড়ে গেলে সেখান থেকে নিজেকে আর আলাদা করতে পারি না।আমি তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম কাঞ্চনা।রাতে ঘুম হতো না,বুক টা ওজন হয়ে থাকতো।ঘুমের ঘোরে মনে হতো এই বুঝি তোমার মাথাটা আমার বুকে রাখা। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই সেই বুক একদম ফাকা হতে থাকতো।কতবার চেয়েছি ছুটে যাব তোমার কাছে, নিজের অধিকার খাটিয়ে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসবো আমার দুয়ারে।কিন্তু পারিনি,পরক্ষণেই মনে হতো,তুমি যদি আমায় অপমান করে নিজে থেকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।তার থেকে যেভাবে আছি সেভাবেই থাকি।ভাগ্যে থাকলে তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে।

কাঞ্চনা কিচ্ছু বললো না।চুপ করে শুনতে লাগলো সেলিমের অভিমান জড়ানো কথাগুলো।ভাবতে লাগলো-

ইশশ,যদি নিজেদের আত্নগরিমা,তেজ,আত্নসম্মান,এক বার ভুলে নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো তাহলে আজ আর এই তেরোটা বছর আফসোস করতে হতো না।
পেটের উপর হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো নিজ সত্তাকে।আর ভাবলো-

আজ এই সাময়িক বিচ্ছেদ না হলে এই ছোট্ট পাখিটা আজকে হয়তো তাদের দুজনার মাঝখানে জায়গা টুকু অধিকার করে নিতো।

______________সমাপ্ত_______________

সমাপ্তি বার্তা:
প্রিয় পাঠক,আপনারা হয়তো অনেকেই নারাজ হবেন যে আমি গল্পটা কেন মাত্র নয় পর্বেই শেষ করলাম।আরো তো পর্ব বাড়াতে পারতাম।কিন্তু পাঠক,আমার এই গল্পটা নিয়ে যতটুকু কাহিনি ভেবে রেখেছি ঠিক ততটুকু শেষ হয়েছে।এর থেকে আরো টেনে বড় করলে বিষয়টা আমার কাছে দৃষ্টিকটু দেখায়।তাই এখানেই ইতি টানলাম।আশা করি, পুরো গল্পটা আপনাদের মধ্যে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি।তার পরেও যদি কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে সেক্ষেত্রে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

আজকে সকল নিরব পাঠকদের রেসপন্স এবং সুন্দর মন্তব্য চাইছি।আমি দেখতে চাই ঠিক কতজন আমার এই গল্পটি পড়েছেন।

শিখনফল:
আমার প্রত্যেকটা গল্পেরই কিছু না কিছু শিখনফল থাকে।এটাও ব্যতিক্রম নয়।আমাদের সুন্দর সম্পর্ক গুলো নষ্টের প্রধান কারন হয় আত্নসম্মান এবং জেদ।”সে যদি আমায় মনে না করে,তাহলে আমি কেন তাকে মনে করবো। আমি কি এতটাই সস্তা”হ্যা প্রিয় পাঠক,এটাই হয় আমাদের স্লোগান।যার কারনে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ে সুন্দর সম্পর্ক গুলোতে।তাই নিজেদের মধ্যে একটু মানিয়ে নিতে শিখুন।প্রিয়জনের কাছে সামান্য একটু নিচু হলে তাতে আত্নসম্মান কমে না। বরং সম্পর্ক সুন্দর হয়।তবে মানিয়ে নিতে গিয়ে একেবারে নিজ সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে বসবেন না। প্রত্যেকেরই আত্নসম্মানের নিজস্ব একটা পরিসীমা থাকে।সেটার মধ্যেই থাকবেন।সম্পর্ক সুন্দর হবে।

পরিশেষে, গল্পটা যদি আপনাদের একটুও ভালো লেগে থাকে তাহলে ছোট্ট একটা রিভিউ দিবেন।আপনাদের সামান্য ক লাইন রিভিউ তেই আমাদের লেখার সার্থকতা।

ফিরে আসছি নতুন ভাবে,নতুন এক কাহিনি নিয়ে,নতুন কিছু সুন্দর চরিত্রের মধ্য দিয়ে আপনাদের মাঝে।সে পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
হ্যাপি রিডিং🌺🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here