মায়াবতী পর্ব -৩২

#মায়াবতী
#পর্ব:৩২
#তানিশা সুলতানা

অর্ণব বেশ অবাক হয়। তন্নিকে বিধস্ত দেখাচ্ছে। কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার? কেউ কি তাকে কিছু বলেছে?
অর্ণবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তন্নি পূণরায় বলে ওঠে

“যাবেন না?

অর্ণব দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। হাত দিয়ে ইশারা করে তন্নিকে পাশে বসতে। কিন্তু তন্নি আসে না। ওখানেই ঠায়য় দাঁড়িয়ে থাকে। এবার তার চোখ টলমল করছে। যখন তখন দুই গালে পানি গড়িয়ে পড়বে। অর্ণব নিজেই এগিয়ে যায়। তন্নির হাত ধরে তাকে খাটের এক কোণায় বসিয়ে দেয়৷ দরজাটা একটু ভিড়িয়ে তন্নির পাশে এসে বসে। কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলে

” কি হয়েছে আমাকে বলো? কেউ কিছু বলেছে? কোনো কিছু নিয়ে টেনশন হচ্ছে?
আমি আছি অথৈয়ের তন্নি।

তন্নি ওড়নার কোনা দিয়ে দুই গালে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছে ফেলে। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মন খুলে বলতে ইচ্ছে করছে অর্ণবকে। ভরসা পেতে চাইছে। মন থেকে দোটানা মুছে দিতে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে তন্নি। তার বলে

“আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবেন অর্ণব?

অর্ণব মৃদু হাসে। তন্নির নরম তুলতুলের হাতটা ধরে বলে

” সে তো করছিই।

“আরও অপেক্ষা। বছরের পর বছর।

” এমনটাই বলেছিলো অথৈ। আর আমিও মেনে নিয়েছি।

তন্নি তবুও ভরসা পায় না।

“আমার সাথে যদি আপনার বছরের পর বছর কথা না হয় দেখা না হয় তবুও আপনি আমার জন্যই ফিল করবেন। আমাকে নিয়েই ভাববেন। আমাতেই সন্তুষ্ট থাকবেন অর্ণব। আপনি প্রমিজ করেছিলেন আমায় ভালোবাসার চাদরে মুরিয়ে রাখবেন।
নিজের কথা রাখবেন অর্ণব।

তন্নির চোখে আবারও পানি চলে আসে।
অর্ণব হাত ছেড়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তন্নির চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।

” ডোন্ট ক্রাই

“আগে বলুন আমায়।

” আমি কখনো তোমায় ছাড়বো না। তুমি চাইলেও না। তুমি আমার অনির মাম্মা তুমি আমার অনির মাম্মাই থাকবে।

তন্নি অর্ণবের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে।

“আপনি বড্ড বেপরোয়া অর্ণব। এমনটা চলবে না। একটু গম্ভীর হবে। চঞ্চলতা একটু কমাবেন। আমার সাথে দুষ্টুমি কম করবেন। সারাক্ষণ আমার পেছনে পড়ে থাকবেন না।
আমি চাইছি না কেউ এখনই আমাদের সম্পর্কের কথা জানুক। একদম সিক্রেট থাকবে। বিয়ের কথা তো আরও কাউকে জানাবেন না।

অর্ণব তন্নির কথা গুলো শুনে এবং বলে

” কারণটা বলবা না?

“কারণ নেই কোনো। আমি চাইছি তাই। এই পৃথিবীতে বাবা আর অথৈ ছাড়া আমাকে কেউ ভালোবাসে নি। কেউ একটু সম্মান দেয় নি। শান্তনা পর্যন্ত পাই নি কারো থেকে।
আমার জীবনটা খুব কঠিন। এই টুকু বয়সে অনেক কিছু শিখেছি দেখেছি শুনেছি। আমি সুখে থাকতে চাই। ভালো থাকতে চাই। বাঁচতে চাই। হাসতে চাই আমি।
আমি ছাড়া আপনার অনেকেই আছে কিন্তু আপনি আর অথৈ ছাড়া এই মুহুর্তে আমার কেউ নেই।

আবারও কেঁদে ফেলে তন্নি। অর্ণব তন্নির দুই গালে হাত দিয়ে মুখখানা দেখতে থাকে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। আরও কিছু বলতে চাইছে সে। অর্ণবও শুনতে চাইছে। মনের মধ্যে কথা চেপে রাখলে দুঃখ বাড়ে।

” অর্ণব আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি আপনাকে। আমার জীবনে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ নেই অর্ণব।
আমার কোনো অপশন নেই আপনার মতো। আমি চাই ও না।
আমার শুধু আপনি হলেই চলবে অর্ণব। শুধু আপনি হলেই চলবে।

অর্ণব মৃদু হেসে তন্নির মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। অর্ণব থামায় না। কাঁদতে থাকুক। কাঁদলে মন হালকা হয়।
বেশ অনেকখন পরে অর্ণব তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে

“তুমি ভয় পেয়ো না অথৈয়ের তন্নি। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। যাই হয়ে যাক। আমি অপেক্ষা করবো। সারাজীবন ও অপেক্ষা করতে রাজি আমি।
আগে কি হয়েছে ভুলে যাও। বাকি জীবনে আমার হৃদয়ে অনির মাম্মা ছাড়া আর কোনো নাম থাকবে না। আই প্রমিজ।

” আমায় ভালোবাসেন অর্ণব?

অর্ণব এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো।

“কি মনে হয় তোমার?

” আমি আপনাকে ভালোবাসি।

“আমিও তোমায় ভালোবাসি৷ মারাক্তক ভালোবাসি।

তন্নির কান্না থেমে গেছে। সে এমনিতেই ঘাপটি মেরে পড়ে ছিলো অর্ণবের বুকে৷ অর্ণবের কথা শুনে মাথা তুলে। অর্ণবের দিকে তাকায়। অর্ণবও তাকিয়ে ছিলো।

তন্নি দাঁড়িয়ে অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়ায়। অর্ণবের ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। অর্ণব মৃদু হাসে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ভালো করে অর্ণবের মুখটা পর্যবেক্ষণ করে তন্নি। তারপর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে অর্ণবের কপালে গাড়ো চুম্বন এঁকে দেয়। তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে অর্ণবের ঠোঁটের কোণে। তন্নি আর দাঁড়ায় না। বড়বড় পা ফেলে চলে যায় অর্ণবের রুম থেকে।

অথৈয়ের রুমে গিয়ে দেখে অথৈ এখনো ঘুমচ্ছে। তন্নি অথৈয়ের কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।

এই বাড়ির চৌকাঠ পেরুনোর আগে তন্নি আবারও পেছন ঘুরে তাকায়। ততদিন পর্যন্ত এই বাড়িতে পা রাখবে না যতদিন অর্ণব তাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে এখানে আনছে। এটা তন্নির প্রতিজ্ঞা।

__

বাড়ি ফিরতেই দেখে ইতি বেগম রান্না করছে আর তামিমকে পড়াচ্ছে৷ তন্নিকে দেখেই তামিম দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরে। তন্নিও মুচকি হেসে ভাইকে আদর করে।
ইতি বেগম এই সময় তন্নিকে আশা করে নি। তাই বেশ অবাক হয়।

তন্নি মায়ের পাশে বসে মায়ের থেকে বটি নিয়ে তরকারি কাটতে থাকে।

ইতি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে

” এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে?

তন্নি তরকারি কাটতে কাটতে মুচকি হেসে জবাব দেয়।

“নুন পান্তা খেয়ে বড় হয়েছি মা। ছেঁড়া কাঁথায় ঘুমানোর অব্ভ্যাস। এতো বড় বাড়ি দামি খাট ভালোভালো খাবার এসবে আমার পোষায় না।
এভাবেই ঠিক আছি।

ইতি মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না।

” এতো মা*রি তোকে। এতো কাজ করাই। ওখানে থেকে গেলেই তো ভালো থাকতিস।

তন্নি ইতির দিকে তাকায়

“তোমার মধ্যে মা মা গন্ধ পাই আমি। যা আমাকে সুখ এনে দেয়। কলিজা ঠান্ডা করে। মনে হয় এটাই পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ জায়গা। আমার মা আমার সাথে। তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারি না।

ইতির চোখ ভিজে ওঠে। সে নিজের দুর্বলতা তন্নিকে বুঝতে দেবে না বলে উঠে চলে যায়।
তন্নি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here