কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -৩১

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী

” তোমার মনে কখনও প্রশ্ন জাগেনি, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করেছি? ” আরমানের কথা শুনে একটু চমকায় কান্তা। ও আরমানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর আরমান ওর চুলে বিলি কাটছে।

” অনেকবারই মনে প্রশ্ন জেগেছে। একবার তো আপনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু আপনি চোখ পাকিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। বারবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমার মত সাধারণ একটা মেয়েকে আপনি না দেখেই কেন বিয়ে করলেন? আর না কোন খোঁজ খবর নিলেন। যেখানে কোন সম্মান পাওয়ার আশা নেই সেই বাড়ির মেয়ের সাথে কেনইবা কোন বাবা-মা ছেলের বিয়ে করাবে? ”

” কে বলেছে, তোমাকে না দেখে বিয়ে করেছি? তোমার সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই বিয়ে করেছি এমনটা তোমার কেন মনে হল? তোমার আদ্যোপান্ত জেনেই তবে তোমাকে বিয়ে করেছি। খোঁজ না নিয়ে অচেনা কাউকে বিয়ে করার মত বোকা আমাকে তোমার মনে হয়? সারাজীবন যার সাথে কাটাব, তাকে একটু বাজিয়ে না দেখেই বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। ”

আরমানের কথা শুনে কান্তা উঠে বসে ওর সামনে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।

” আপনি আমাকে বিয়ের আগে দেখেছিলেন! আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন? কিন্তু কবে? আমি বা আমরা এ সম্পর্কেতো কিছুই জানিনা! কই আমিতো আপনাকে আগে কখনোই দেখিনি! ”

” তুমি নিজেকে যতটা চালাক ভাব আদতে ততটা চালাক তুমি নও। তুমি একটাবারও ভেবে দেখেছিলে, কোন আগন্তুক হঠাৎই তোমার সামনে এসে এক হাজার টাকার নোট খুচরা করতে চাইল কেন? যেখানে আশেপাশে অনেকগুলো দোকান আছে। সে ইচ্ছে করলে দোকান থেকেই টাকা খুচরা করতে পারত। আবার সেই আগন্তুক যখন বলল, তার দশ টাকা প্রয়োজন রিক্সা ভাড়ার জন্য। তুমি কোন প্রশ্ন না করেই দিয়ে দিলে। একবারও চিন্তা করলেনা, যে তোমার কাছে এক হাজার টাকার নোট খুচরা চাইল, সে কেন দশ টাকা তোমার কাছ থেকে চাইছে? এক হাজার টাকা খুচরা করেই সে-তো দশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিতে পারত। ”

আরমানের কথা শুনে কান্তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। সেদিনের সেই ব্যক্তি তাহলে আরমান ছিল! কান্তার চোখের সামনে ভেসে উঠে সেদিনের ঘটনা।

সেদিন কান্তা কলেজ থেকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই একজন মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিজের কাছে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ভরকে যায় কান্তা। সেখান থেকে সরে আসতে চাইলে মুখ খোলে আগন্তুক।

” এক্সকিউজ মি, ম্যাম। আপনার কাছে এক হাজার টাকার নোট খুচরা হবে? ”

” আমার কাছে এত টাকা নেই। ” বলেই কান্তা সরে আসতে চাইলে, আবারও কথা বলে সেই ব্যক্তি।

” দশ টাকা দিতে পারবেন আমাকে? রিক্সা ভাড়া দিতে পারছিনা। দশ টাকা আছেতো আপনার কাছে? ”

কান্তা আগন্তুকের কথার উত্তর না দিয়ে ব্যাগ হাতড়ে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় সামনে। আগন্তুক হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে কান্তাকে ধন্যবাদ জানায়।
কান্তা এবারও তার ধন্যবাদের জবাবে কিছুই বলেনা। সামনে একটা অটো আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। পুরোটা সময় কান্তা একবারও আগন্তুকের দিকে তাকায়নি।

অতীত থেকে বেরিয়ে আসে কান্তা। ওর বিস্ময়ভাব এখনও কাটেনি। হঠাৎ করেই যেন অসার হয়ে আসছে শরীরটা। যেই মানুষটাকে চিনতে তার অনেকদিন সময় লেগেছে। সেই মানুষটাই তাকে আগে থেকে চিনে রেখেছে! জেনে নিয়েছে কান্তার আদ্যোপান্ত! শুরু থেকেই সবটাই তার নিয়ন্ত্রনে ছিল! হঠাৎই কান্তার ভেতরটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। যেন চারপাশে হাজারও ফুলের সৌরভ ম ম করছে। রংবেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে বুকের আকাশ জুড়ে।

” সেদিন সেই মানুষটা আপনি ছিলেন! আপনি কেমন করে জানলেন, আমি সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম! প্লিজ, পুরোটা বলুননা। এভাবে অর্ধেকটা বলে আমাকে অপূর্ণতায় রাখবেননা। ” কান্তার অনুনয় দেখে আরমানের ঠোঁট হালকা প্রসারিত হয়। তা দেখে কান্তার চোখে পানি আসে। মানুষটাকে কতদিন পর হাসতে দেখল। হোকনা সে হাসি যৎসামান্য। তবুও তো হেসেছে।

” শোন তবে। অনেকদিন আগে থেকেই আকলিমা খানম আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। সে অনুযায়ী পাত্রীও দেখছিল। আমি প্রতিবারই তাদের সব প্রস্তাব না করে দিই। আমি চাচ্ছিলাম নিজের পছন্দমত মেয়েকে বিয়ে করতে। আকলিমা খানমের ইচ্ছে ছিল, তার পরিচিত কিংবা আত্মীয় কাউকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে কোনঠাসা করে রাখার। তার ইচ্ছেতেই সবকিছু হোক এটা তার মনে ছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে পেরে না উঠে, শুরু করে গরীব ঘরের মেয়ে দেখতে। যাতে সে নিজের মত করে মেয়েটাকে পরিচালনা করতে পারে। এক কথায় সে একজন কাজের মেয়ে চাইছিল। এভাবে একদিন সে তোমার খোঁজ পায়। যখন জানল তোমার বাবা-মা নেই। তখন তাকে আর পায় কে। বরাবরের মত আমি এবারও তাদের প্রস্তাব না করে দিয়ে সেখান থেকে সরে আসতেই কানে গেল, মেয়েটা এতিম।আমার পুরো দুনিয়া টলে উঠল। যেখানে আমি ছোটবেলা থেকেই এতিমের মত জীবন কাটিয়েছি, সেখানে আরেকটা এতিমের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে! সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিব। কারন এতিম হওয়ার কষ্ট আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। তাই শ্রীজার কাছ থেকে তোমার বাড়ির ঠিকানা নিলাম। এরপর ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে তোমার গ্রামে গেলাম। সেখানে চারদিন কাটালাম তোমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে। যে আন্টি তোমার খোঁজ আকলিমা খানমকে দিয়েছিল, সেই আন্টির বোনের সাথে যোগাযোগ করে তোমার বাড়ি চিনে নিলাম। এরপর দেখলাম তোমাকে। বাইরের উঠানে সারাদিন ধরে কাজ করতে দেখলাম একটা মেয়েকে। কাজ করতে যার কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন অভিযোগ। আশেপাশের অনেকের কাছ থেকে শুনলাম মেয়েটার দূর্দশার কথা। একদিন বাজারে টং দোকানে বসে চা পান করছিলাম, তখন দেখলাম তুমি কোথাও যাচ্ছ। ব্যাস, তোমার পিছু নিলাম। তোমার অটোতে না উঠে অন্য অটোতে উঠে চললাম তোমার পিছুপিছু। তুমি কলেজে গেলে। আমি বসে রইলাম সামনের দোকানে। এরপর শুধুই অপেক্ষা। একসময় তোমার ক্লাস শেষ হল। তুমি অটোর জন্য অপেক্ষা করছিলে। আর তখনই আমার টাকা খুচরো করার দরকার পরল। এরপর ঢাকা যেয়ে শহিদ আহমেদকে জানালাম, তোমাকে বিয়ে করব। এতটুকুই গল্প। ”

কান্তার বলার মত আর কিছুই নেই। ও চুপচাপ আবারও আরমানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পরে। মানুষটা সব জেনেই ওকে বিয়ে করেছে! এজন্যই কখনও ওর বাবার বাড়ি নিয়ে কোন কথাই তোলেনি! উল্টো সেখানে যেতে নিষেধ করেছে! মানুষটার ওপর কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে যায় কান্তার মন। আড়াল থেকে মানুষটা ওকে কতভাবে সাপোর্ট দিয়েছে, অথচ একটাবারও টের পেতে দেয়নি!

” চুপ হয়ে গেলে যে? আর কিছু জানতে চাওনা? তোমার কষ্টের জীবন সম্পর্কে জেনেছিলাম জন্যই, আমি তোমাকে নতুন করে কোন কষ্ট দিতে চাইনি। আমার এই দুঃসময়েও তোমাকে আমার সাথে জড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছি সব কষ্টই আমার হোক, বিনিময়ে তুমি সুখের হাসি হাসো। একজীবনে অনেক কষ্ট সয়েছ। তোমার সেই কষ্টেই এখনও আমি প্রলেপ লাগাতে পারিনি। তাই নতুন করে আবার তোমাকে কষ্টে জড়াতে ইচ্ছে করলনা। কিন্তু তুমি সেটা না বুঝে, বুকে অভিমানের পাহাড় জমালে। মেয়ে, তুমি কি জানো, তোমার সকল অভিমানও জমা হয় আমার বুকের খাতায়? যেমন করে তোমার সকল ভালোবাসা জমা হয় আমার হৃদয় গহীনে। তোমার অভিমান বুঝতে না পারার মত বোকা আমি নই। এই পনেরদিন একটু দূরে দূরে থেকেছি বলেই ভেবে নিয়েছ, আমি তোমাকে দুঃখের সাথী করিনি? আমিতো শুধু নিজেকে সামলানোর জন্য সময় নিচ্ছিলাম। যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছ, সেদিন থেকে তুমিই আমার সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছ। ”

কান্তার আজ অবাক হবার পালা। মানুষটা ওকে কিভাবে চমকে দিচ্ছে! কান্তার অভিমান হয়েছিল, সে এটাও জেনে গেছে!

” আপনি এত কিছু জানেন কিভাবে? কই আমিতো এভাবে জানতে পারিনা, এভাবে বুঝতে পারিনা! ”

” আমার মত করে ভালোবেসে দেখ। তুমিও সব জানবে, সব বুঝবে। ভালোবাসার মাঝে কখনও জড়তা, সংকোচ, সন্দেহ এসব আনতে নেই। এসব যখন কারও ভালোবাসার মধ্যে থাকবেনা, তখন সেই ভালোবাসা হয়ে ওঠে পরিশুদ্ধ। আমার ভালোবাসাও তেমনি পরিশুদ্ধ। তোমার ভালোবাসার মধ্যে থেকে শুধু জড়তা আর সংকোচকে ছুঁড়ে ফেলে দাও, দেখবে তুমিও আমার মত করে ভালোবাসতে শিখে যাবে। তখন তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই পেয়ে যাবে? ”

কান্তার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। আজ শুধু ইচ্ছে করছে মানুষটাকে অনুভব করতে। মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা আজও তার জানা হয়ে উঠলনা। ও পরম আবেশে ঠোঁট ছোঁয়ায় মানুষটার লোমশ বুকে। এই বুকে মানুষটা কান্তার জন্য এত ভালোবাসা জমা রেখেছে! আবেগে ভিজে যায় কান্তার চোখ। এত ভালোবাসাও ওর ভাগ্যে ছিল!

” শুধু তিনটা চুমুর জন্য এত গল্প শোনালাম! ভালোবাসায় এত কিপ্টামো করলে হয়না, বুঝলে? আজ থেকে তোমার সব কিপ্টামো বাদ। শেষে দেখা যাবে আমার মেয়েটাও তোমার মত কিপ্টে হয়েছে। তখন বেচারা জামাই বাবাজিকে আমার মত ভালোবাসাহীনতায় থাকতে হবে। ভালোবাসতে হয় প্রানখুলে। বুঝলে আমার বোকা, বউ? ”

আরমানের কথা শুনে কান্তা মুখে হাত চাপা দেয়। ওর দুইটা রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে৷
এই বেহায়া লোক বলে কি!

” ছিহ্ আপনার একটুও লজ্জা নেই! মেয়ের দুনিয়ায় আসতে এখনও কত মাস বাকি আছে। আর আপনি কিনা এখন থেকেই এসব আজেবাজে কথা ভাবছেন? মেয়ে জন্মাবে, বড় হবে, পড়াশোনা শিখবে তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করব। হিসেব করলে দেখা যাবে পঁচিশ বছরের আগে হবেইনা। আর আপনি বাবা হয়ে এখনই এসব ভাবছেন! লজ্জাহীন লোক একটা। ”

” তোমার জন্যই তো এসব বলতে হচ্ছে। ভালোবাসায় একটু উদারতা দেখালে কি হয়? কতদিন তোমাকে কাছে পাইনি সেই হিসেব তোমার আছে? এতদিন পর একটু চুমু দিলে, তাও আবার তিনটা। কেন, একসাথে আনলিমিটেড চুমু দিলে ঠোঁট কি ক্ষয়ে যাবে? ” কান্তা আরমানের মুখে হাত দিয়ে ওকে থামায়। ও জানে মানুষটাকে কথা বলার সুযোগ দিলে এখন ননস্টপ উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েই যাবে।

আরমানও হাঁফ ছাড়ে। যাক, অবশেষে তার বউয়ের মন ভালো করতে পেরেছে। কয়দিন থেকেই মেয়েটা মনমরা হয়ে ছিল। ওকে মনমরা দেখতে আরমানেরও ভালো লাগছিলনা।

আরমানের বুকে মাথা রেখে কান্তা ভাবছে, ও মানুষটার মন একটু হলেও ভালো করতে পেরেছে। কয়েকটাদিন তার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলনা কান্তা। অবশেষে, তার মুখে আজ হাসি ফোটাতে পেরেছে কান্তা।

শহিদ আহমেদের শরীর ভালো নেই। তিনি স্ত্রী ও মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তার নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হচ্ছে। এত বছর পর তার মনে হচ্ছে, সেদিন মা’য়ের কথাগুলো মেনে নেয়া তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কেন মা’য়ের কথায় প্রভাবিত হয়ে, আইরিনকে খোঁজার চেষ্টা করলনা? কেন সহজেই মেনে নিল, আইরিন অন্যের সাথে পালিয়ে গেছে? কেন, মায়ের কথায় আকলিমাকে বিয়ে করল? আর কেনইবা নিজের সন্তানকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেল? এসব প্রশ্ন তার ভেতরে আসতেই অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছেন তিনি। তার জন্যই আজ তার ছেলেটার জীবন অন্যরকম। তার ছেলেটা সবার থেকে দূরে চলে গেছে। কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবেন তিনি? আর কিভাবেই বা ছেলের কাছে ক্ষমা চাইবেন।
বিছানায় শুয়ে তড়পাতে থাকেন শহিদ আহমেদ। এখন তার মাঝেমধ্যেই মনে হয়, তার পুরোটা জীবন ভুলে ভরা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here