” ছো*ট*লো*কে*র মেয়ে জীবনে কোনদিন এত খাবার, এত পোশাক, এত বিলাসবহুল জীবন দেখেছে? সে রান্নার কি বুঝবে! ওর বাবা ওকে জীবনে এত ভালো খাবার খাইয়েছে যে ভালো রান্না করতে জানবে! ছোটবেলা থেকে ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত থাকলে রান্নাও ভালো করতে জানতো। তোর বাবা কি যে দেখেছিল এর মধ্যে! না জানে রান্না, না জানে ম্যা*না*র্স, না জানে সোসাইটিতে চলতে। আজ সোহা এই বাড়ির বউ হয়ে আসলে আমার এত টেনশন করতে হতোনা। ” খাবার টেবিলে বাড়ির সবার সামনে এভাবে নিজ পুত্রবধূ তানিশাকে কথার আ*ঘা*তে জ*র্জ*রিত করে শায়লা চৌধুরী। মাংসের কালা ভুনায় সামান্য লবন কম হওয়ায় এভাবে বললেন তিনি।
শ্বাশুড়ির কথায় আজকাল মন খারাপ হয়না তানিশার। কিন্তু কষ্ট তখনই হয় যখন দেখে ওর স্বামী, ননদ, দেবর কেউই তাদের মায়ের কথার প্রতিবাদ না করে মিটিমিটি হাসে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। সাদিফ মনযোগ সহকারে খেয়ে যাচ্ছে তার মায়ের কথার কোন প্রতিবাদ না করে। দেবর, ননদ পারলে তাদের মাকে উস্কে দেয়। এমন নয় যে ও রান্না জানেনা। ছোটবেলা থেকেই মায়ের পাশে বসে তার রান্না দেখেতে দেখতে নিজেই সব শিখে নিয়েছিল। কিন্তু এখানে এতটুকু ভুলেরও ক্ষমা নেই।
” আহা মম তুমি জানোইতো ভাবি কোন কাজেরই নয়, তবুও তাকে রান্না করতে বলো কেন? ভাবির থেকে আমাদের মেইড ভালো রান্না জানে। তাকেই বলতে রান্না করতে। ভাবি কখোনো এসব দেখেছে যে জানবে! গরীব ঘরের মেয়ে সে, কচু-ঘেঁচু খেয়ে বড় হয়েছে। সে এসবের জানবেটা কি! দোষ তো তোমার। ” ননদের মুখের এমন কথায় কলিজা ছিঁ*ড়ে যাচ্ছিল তানিশার। টুপ করে একফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে জানিয়ে দেয়, আমি এসেছি।
বোনের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে তানিশার দেবর সাইফ।
” লাইক সিরিয়াসলি মম! প্রতিদিন তোমাদের এমন ড্রামা দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেছি। এবার নতুন কিছু করো। এই অ*প*দা*র্থ মেয়েকে কেন কাজ করতে দাও! কাজ না করলে কি ওকে খেতে দিবেনা? আমাদের কয়েকটা কুকুর, বিড়াল আছেতো? ওরা কি কাজ করে তবেই খেতে পায়? একেও তেমন ভাবোনা,তাহলেই তো ঝামেলা শেষ হয়। ” সাইফের কথার আ*ঘা*ত আর সহ্য করতে পারেনা তানিশা। মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে যায় পেছনের বারান্দায়। মেঝেতে ধপ করে বসে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। এত বড় বাড়িতে এই একটা মাত্র স্থান যেখানে সে মন খুলে কাঁদতে পারে, দুঃখ বিলাস করত পারে।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারেনা তানিশা। ঘোর কাটে রহিমা বেগমের কথায়। তিনি এ বাড়ির পুরোনো কাজের খালা।
” কি গো বউমা, এম্নেই বইসা থাকবা? বেলা যে পইড়া গেল, খাইবানা? তুমি তো জানোই হেরা এমনই। তাও কেন এত দুঃখ পাও কওতো? ”
রহিমা খালার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে তানিশা।সত্যিই তো তাই! এরা এমনই, তবে কেন বারংবার এদের কথায় দুঃখ পাই! এত দুঃখ পেলে, চোখ ঝড়ালে চলবে কেমন করে! এদের একপাশে ঠেলে দিয়ে আমাকে নিজের মত করে বাঁচতে শিখতে হবে। তবু কেন এত কষ্ট হয়! কষ্টেরা কেন এত নিলাজ হয়! যতই দূরে ঠেলে দিই ততই আমাকে আঁকড়ে ধরে!
” ও বউমা, আবার কই হারাইলা? ”
হকচকিয়ে উঠে তানিশা।
” খালা আপনি যান। নিশ্চয়ই আপনি এখোনো খাননি? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? এভাবে না খেয়ে থাকবেননা খালা। আপনারতো বয়স হয়েছে, না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন আমার জন্য চিন্তা করবেননা।”
” তুমি চলো আমার সাথে, একসাথে খাব। আমি আগে খাইয়া লই, আর তুমি না খাইয়া থাক। তা হবার দিমুনা আমি। ”
এই মাতৃসমা বয়োবৃদ্ধার এহেন মায়ায় জ*র্জ*রি*ত কথায় আর বসে থাকতে পারেনা তানিশা। মনের গহীনে দীর্ঘশ্বাসদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ায়।
শেষ বিকেলে অন্ধকার তার চাদর দিয়ে ধরণীকে ঢেকে দিচ্ছে। যেন উদ্ধত কোন রমনীকে লজ্জার আভরন পড়িয়ে দিতে উন্মুখ হয়ে গেছে। আকাশের চেহারা আজ দেখার মত হয়েছে। বাদশাহী মেজাজ নিয়ে মেঘেরা একদিক থেকে আরেকদিকে সৈন্যবাহীনির মত নিরন্তর টহলে ব্যস্ত। থেকে বিজলির ঝলকানি ধরণীর প্রানিকুলের কলিজায় কাঁপন ধরাচ্ছে। সেই সাথে আছে বাতাসের দাপট। যেন মেঘ, বিজলি আর বাতাসের প্রতিযোগিতা চলছে, কে কাকে হারায়।
বেলকোনির এক কোনে দাঁড়িয়ে তানিশা প্রকৃতির প্রমত্তা রুপ দেখছে একমনে। নিজের সাথে প্রকৃতির এই রুপের যেন বড্ড মিল। এলোমেলো বাতাসে খোঁপা খুলে চুলগুলো অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করছে। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তানিশা। শেষমেশ পরাজিত হয়ে ওদের মর্জিতেই চলতে ছেড়ে দেয়। হিমেল হাওয়া ওর তনু-মন ছুঁয়ে জানান দিল আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। তানিশা দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে উপভোগ করছে মেঘ, বিজলি, বাতাসের প্রনয়। হঠাৎই এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল ওর শরীর। বৃষ্টির পরশ শরীরে লাগতেই কেঁপে উঠে সে। একটা ভালোলাগায় ছেয়ে যায় মন। মৃদু হাসিতে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয়। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ওর বরাবরই পছন্দের। পরম আবেশে ভিজতে থাকে বৃষ্টিতে। এখানে বাঁধা দেবার কেউ নেই। অথচ গ্রামে থাকলে মা কখোনই ভিজতে দিতনা। ও ছুটে যেত বৃষ্টির পরশ মাখতে আর মা চিল্লাতে থাকত মেয়ে অসুস্থ হবে সেই চিন্তায়।চোখ ভিজে আসে তানিশার। আজ কতদিন হয়ে গেছে মাকে দেখেনা! কতদিন যায়না ছোট্ট সেই কদম তলী গাঁয়ে! ধানক্ষেতের মাঝে আইল দিয়ে দৌড়ে দত্ত কাকার পুকুর পাড়ের আমলকি গাছটার কাছে যায়না কতদিন! সরিষা ক্ষেতের ভেতর থেকে বথুয়া শাক তোলেনা কতদিন! প্রতি ক্ষনেই ভেতর থেকে অনুভব করে কদম তলীর প্রতিটা মানুষ, গাছগাছালী এমনকি পশু-পাখিগুলোকেও।কত ভালোবাসা মিশে আছে কদম তলীর প্রতিটি ধূলিকণার সাথে। তানিশার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করে। কিন্তু বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেনা ও কাঁদছে। যদি চোখের পানির কোন রং হতো তাহলে ও কি এত নিঃসংকোচে কাঁদতে পারত!
মাগরিবের আজান কানে আসতেই তড়িঘড়ি করে রুমে আসে। ভেজা চুপেচুপে শরীর নিয়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। কাপড় পাল্টিয়ে একবারে অযু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়ায়। এটা একান্তই তার সময় সৃষ্টিকর্তার সাথে কথপোকথনের। যে কথা সে কাউকে বলতে পারেনা, তা অনায়াসেই সৃষ্টিকর্তার কাছে তুলে ধরে।
রাত দশটা বেজে গেছে। সাদিফ এখোনো বাড়িতে ফিরেনি। কখন ফিরবে তাও জানেনা তানিশা। এদিকে খাবার সময় হয়ে গেছে। নিচে এসে টেবিলে খাবার দেয়। ওর শ্বাশুড়ি, দেবর,ননদ এসে বসে যায়। সবার প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তানিশা। কেউ একটিবারও ওকে খেতে বলেনা!
” মম বাপি কবে আসছে দেশে? ” সাইফ ওর মাকে জিজ্ঞেস করে।
” দুই- এক দিনেই চলে আসবে। ওখানকার সব কাজ শেষ। ” খেতে খেতে উত্তর দেয় শায়লা চৌধুরী।
শ্বাশুড়ির কথা শুনে এক চিলতে হাসি ফুটে তানিশার ঠোঁটে। এই বাড়িতে একমাত্র ওর শ্বশুর ওকে ভালোবাসে, আগলে রাখে সন্তানের মত।শ্বশুরের উপস্থিতিতে কেউই ওকে কিছু বলতে পারেনা।
” উফ্ মম বাপি আসলেই শুরু হবে আদিখ্যেতা। বউমাকে এটা বলোনা, বউমার সাথে ওটা করোনা। যেন বউমাই সব, আমরা কিছুই নই। যত্তসব ঢং শুরু হবে। ” বলতে বলতে মুখ বাঁকা করে তানিশার ননদ সাঈরা।
শায়লা চৌধুরীও মুখ বাঁকা করে খেতে থাকে।
ওদের খাওয়া শেষ হলে যে যার রুমে চলে যায়। তানিশা টেবিল পরিস্কার করে রহিমা খালাকে বলে রুমে যায়। আজ রাতে মোটেও খেতে ইচ্ছে করছেনা। মাথা ভারি হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজার ফল।
সাদিফের অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে বুঝতেই পারেনি তানিশা। গভীর রাতে কারো কামার্ত ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙ্গলো ওর। প্রথমে হকচকিয়ে উঠে। পরে বুঝতে পারল ওটা সাদিফের স্পর্শ। দিনে অবহেলা, অবজ্ঞা আর অপমানের চাদরে মুড়িয়ে রাখলেও রাতে ঠিকই নিজের সুখের জন্য মত্ত হয় তানিশার মাঝে। চাইলেও বাঁধা দিকে পারেনা তানিশা। শুধু নিজের উপর ঘৃণা জন্মায় বারেবার। কিন্তু একটা সময় সাদিফকে ঠিকই ভালোবাসত ও। শত অবহেলা, অনাদরের পরও সাদিফের একটু সঙ্গ পেতে কিনা করেছে ও। কিন্তু সাদিফ তানিশার ভালোবাসা পায়ে ঠেলেছে। ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতে চাইতে আজ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ওর। তাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর সাদিফের ভালোবাসা কামনা করেনা। সাদিফের একটু ছোঁয়ার জন্য পথ চেয়ে থাকেনা। এখন যা আছে তা শুধুই দায়বদ্ধতা। হয়তো আজও আগের মতই ভালোবাসে সাদিফকে। কিন্তু একটু একটু করে জমা অভিমানের পরত পরেছে সেখানে। তাই তানিশার মনে হয় আর সাদিফকে ভালোবাসেনা।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলে ঘুমন্ত সাদিফের দিকে নজর যায় তানিশার। বড্ড নিষ্পাপ লাগছে সাদিফকে।কে বলবে এই মানুষটার সব রাগ তানিশার উপর! ডান কাত হয়ে শুয়ে অপলক নয়নে দেখতে থাকে সাদিফকে। টিকোলো নাক, কালচে খয়েরী পুরুষ্ঠ ঠোঁট, টানা ভ্রুযুগল একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে। ঘন চোখের পাপড়ি। বাদামী রঙের চোখের মনি। আর কাঁচা হলুদের ন্যায় শরীরের রং সবসময়ই টানে তানিশাকে। একটা পুরুষকে এত সুন্দর হতে হবে কেন? এই প্রশ্নটা সব সময়ই উঁকি দেয় তানিশার মনে। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় সাদিফের গাল৷ সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে আসে সাদিফের। তারাতারি করে হাত সরিয়ে নেয় তানিশা।
” বাপরে রাগ! ঘুমের মধ্যেও আমার উপর বিরক্ত হয়! আজব ক্যারেক্টার! এরকম মানুষ সারাদেশ খুঁজলেও বোধহয় একটাও পাওয়া যাবেনা! মেইড অনলি ওয়ান পিস! ” বিরবির করে বলতে বলতে বিছানা ছাড়ে।
সাদিফের ঘুম ভাঙ্গলে প্রতিদিনের ন্যায় হাতের কাছে সবকিছু পেয়ে যায়। এই জিনিসটা খুব ভালো লাগে সাদিফের। কষ্ট করে কোন কিছু খুঁজতে হয়না।
খাবার টেবিলে নাস্তা দিয়ে সবাইকে ডাকে তানিশা। সাদিফ একবারে রেডি হয়ে এসেছে। নাস্তা করে যে যার মত বেরিয়ে পরবে। সাদিফ আসলে ওর ব্ল্যাক কফি দেয় তানিশা। জরুরী কাজ থাকায় কফি খেয়েই বের হয় সাদিফ।
” এই যে কৃষকের মেয়ে আজ বিকেলে তোমার শ্বশুর আসবে। কি করে তার কান ভাঙানি দিতে হয় তার প্র্যাকটিস করো এখন থেকেই। তোমার কথা শুনলে তো তার আর অন্য কিছু লাগেনা। কি তাবিজ যে করেছ তাকে! কান খুলে শুনে রাখো আমাদের নামে উল্টাপাল্টা কিছু বললে ঘার ধা*ক্কা দিয়ে বের করে দিব। মনে থাকবে? ” শায়লা চৌধুরীর হু*ম*কি শুনে বুক ধ্বক করে উঠে তানিশার।
” জ্বি মা আমার মনে থাকবে। ”
” দেখেছো মম কেমন সাধু সাজতে চাচ্ছে! বাপির সামনেও এমন ভেজা বিড়ালের মত থেকেই আমাদের বাপির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ” চোয়াল শক্ত করে বলে সাঈরা।
” এত সহজ আমাদের কাছ থেকে বাপিকে আলাদা করা। প্রয়োজনে ওকেই তা*ড়া*বো এখান থেকে। ” সাইফের কন্ঠে রাগের ছটা।
” আর ভাইয়াটাও যে কি! একেই কেন বিয়ে করতে হলো? সে যতই বাপি বলুক না কেন। বিয়ের আগে ভাইয়া কিন্তু পারত পোল্যান্ড চলে যেতে। তাহলে অন্তত এই গেঁয়ো ভূ*ত*কে বিয়ে করতে হতোনা। ” সাঈরাও দ্বিগুণ রাগে বলে
তানিশা ওদের কথা আর শুনতে চায়না বিধায় রান্নাঘরে এসে টুকিটাকি কাজ করতে থাকে। রহিমা খালা ও আরেকজন কাজের মেয়ে অসহায় চোখে তানিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের করার কিছুই নেই।
কাজ সেরে, নাস্তা করে রুমে এসে বই নিয়ে বসেছে। সেমিস্টার ফাইনাল কিছুদিন পর। তাই মনযোগ দিয়ে পড়ছে তানিশা। প্রতিনয়ত দিন গুণছে কবে ভার্সিটির অধ্যায় শেষ হবে। কবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। ওর একটাই লক্ষ্য সামনে এগিয়ে যাওয়া।
#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#সূচনা_পর্ব
জাওয়াদ জামী