মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -০২

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী

ঘামে ভেজা চুপেচুপে শরীর নিয়ে একমনে রান্না করছে তানিশা। টুপটুপ করে কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। ওড়নার প্রান্ত দিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘাম মুছতে থাকে। আজ বোধহয় সূর্যিদেব বেশিই উত্তপ্ত হয়ে গেছে। ইশ! কত রাগে আজ আকন্ঠ তাপ বিলাচ্ছেন তিনি। কোন কুন্ঠা নেই। ঠিক যেন আমার পতিদেবের ন্যায়। আমার উপর উদার মস্তিষ্কে সমস্ত রাগ যেমন করে ঝাড়ে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয় ওর।

” আমার মা কোথায়? মাগো দেখো তোমার ছেলেটা সেই কখন থেকে ডেকে চলেছে, কিন্তু তোমার সাড়া নেই। ” ধরফরিয়ে উঠে বসে তানিশা। রান্না সেরে, গোসলের পর বিছানায় পিঠ দিতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। নিচ থেকে শ্বশুরের গলা পেয়ে উঠে পরে। ওড়না ঠিক করে দৌড়ে বের হয় রুম থেকে।
” বাবা! ” সালাম দিয়ে শ্বশুরের কাছে দাঁড়ায়।
” তুমি কেমন আছো মা? এ কয়দিন কোন অসুবিধা হয়নি তো? ”
” আমি ভালো আছি বাবা। কোন অসুবিধাই হয়নি আমার। কিন্তু আপনার চোখ-মুখ এমন শুকনা লাগছে কেন? ”
” বাইরের খাবার মুখে তুলতে পারিনা মা। তাই এমন শুকিয়ে গেছি। এই যে এখন থেকে তোমার হাতের খাবার খেয়ে আবার আগের মত হয়ে যাব।” তানিশার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন জামিল চৌধুরী।
আর ওদিকে শ্বশুর, বউমার এরুপ কথায় শায়লা চৌধুরী রে*গে লাল হতে থাকেন। বি*স্ফো*র*ণ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
” বাবা আপনি ফ্রেশ হয়ে আসেন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ”
” আচ্ছা মা আসছি।
শায়লা আমার সাথে এসো। ”

ইলিশ মাছের দোপেয়াজা শ্বশুরের পাতে তুলে সযত্নে তুলে দেয় তানিশা। জামিল চৌধুরীর মুখে হাসি এমন পুত্রবধূ পেয়ে। জহুরি জহর চিনতে ভুল করেনা। নিজ পুত্রের জন্য এমন রত্ন আনতে পেরে নিজেকে নিয়ে সব সময়ই গর্ব করেন তিনি।
” শায়লা তোমার বড় দামড়াটা কোথায়? অফিস করছে নিয়মিত? আমি বাপ বলে একজন যে আছি সে তো মনেই করেনা! ফোনে পাওয়া যায়না তাকে। কি এমন রাজকার্য করে শুনি! চাকরিতো আমিও করি। সবার সাথে যোগাযোগ রাখি, সামাজিক দ্বায়িত্ব পালন করি কোন কিছুই বাদ রাখিনা। আর তোমার দামড়া ছেলে কি একটা চাকরি করে, যে ভাব নিয়ে চলে, যেন একজন প্রসিডেন্ট । ”
শায়লা চৌধুরী ছেলেকে নিয়ে এভাবে কথা বলাতে খ্যাঁক করে উঠে।
” আমি তোমাকে এর আগেও বলেছি আমার ছেলেকে নিয়ে কিছু বলবেনা। আমার ছেলের মত সোনার টুকরা কয়জন হয়? ”
” ঐ টুকরা নিয়েই থাকো। টুকরা ভেঙে, গলিয়ে আর অলংকার বানানো লাগবেনা।
দাওতো মা আরেক টুকরা মাছ দাও।
হ্যাঁ কোথায় ছিলাম যেন? মনে পরেছে, রাস্তার মোড়ে বিলবোর্ড লাগিয়ে দাও তোমার সোনার টুকরা ছেলের নামে। ”
তানিশা শ্বশুরের কথা শুনে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। এখন হাসা মানেই শ্বাশুড়ির ধমক খাওয়া।
এদিকে শায়লা চৌধুরীর রা*গে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।

রাতে সবাই একসাথে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। সাদিফ এখোনো ফেরেনি। ওকে রেখেই সবাই খেয়ে নিয়েছে। এটা অবশ্য নিয়মিত ব্যাপার। সাদিফ বারোটার আগে ফিরেনা। তাই একসাথে খাওয়াও হয়না। সাইরা, সাইফ বাবার আনা জিনিসপত্র মনযোগ দিয়ে দেখছে। মাঝে মাঝে আনন্দে লাফিয়ে উঠছে। সাইরা, সাইফের খুব পছন্দ হয়েছে ওদের জন্য আনা জিনিগুলো দেখে।
” থ্যাংকস ড্যাড। আমার খুব পছন্দ হয়েছে এগুলো। হাউ সুইট ইউ আর। ” একটা মেকআপ কিট হাতে নিয়ে আল্লাদী স্বরে বলে সাইরা।
” কথার কি ছিরি দেখ! আরে বাবা তোরা এসব কি ড্যাড-ফ্যাড বলিস! বাবা ডাকতে কষ্ট হয়? বলি বাবা ডাক কি গাঙের জলে ভেসে এসেছে? ছ্যা ছ্যা ছেলে-মেয়েরা আর মানুষ হলোনা। বিদেশি হলো শেষ পর্যন্ত। ” মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে জামিল চৌধুরী।
সাইরা বাবার কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে, ” তোমার সাথে এই মুহূর্তে তর্ক করবনা ড্যাড। শেষে দেখা যাবে আমার জিনিসগুলো নিয়ে নিয়েছো। তারচেয়ে বরং চুপ থাকি।

সাইফ বাবার সাথে আগ বাড়িয়ে লাগতে যায়না। সে জানে তার বাবা কেমন। সহজভাবে এক কথা বললে তিনি বেঁকিয়ে অন্য লাইনে নিয়ে যাবেন।

লাগেজ থেকে একটা প্যাকেট বের করে জামিল চৌধুরী তানিশার হাতে দেয়।
” মা এইযে এখানে তোমার জন্য কিছু জিনিস রয়েছে। বুড়ো বাপ পছন্দ করে এনেছে। দেখতো তোমার পছন্দ হয় নাকি। ”
” ধন্যবাদ বাবা। আপনি নিশ্চয়ই অপছন্দ হওয়ার মত কিছু আনেননি। ” হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে তানিশা।
তানিশাকে প্যাকেট দেয়া দেখে শায়লা চৌধুরীর মুখ কালো হয়ে গেছে। সাইরা, সাইফ থম মেরে বসে আছে। কিন্তু কারোরই কিছু বলার সাহস নেই। শুধু মনে মনে বলে, যতসব আদিখ্যেতা।

রাত বাড়তেই যে যার মত নিজ রুমে চলে যায়। শুধু জামিল চৌধুরী বসে আছে ছেলের অপেক্ষায়। তানিশাও শ্বশুরের পাশে বসে থাকে। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দেয় তানিশা। সাদিফ কিছু না বলেই সোজা রুমের দিকে পা বাড়ায়।
” এই যে মহামান্য জেষ্ঠ্য পুত্র। আমি অধম বাবা এখানে আপনার অপেক্ষায় রত। এদিকে আপনার পদধূলি দিয়ে আমাকে ধন্য করুন। ” দু-হাত সামনে বাড়িয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জামিল চৌধুরী।
চমকে উঠে সেদিকে তাকায় সাদিফ। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকায় বাবার দিকে।
” এসব কি বাবা! তুমি কি দিনদিন ছোট হচ্ছো? ”
” শুনলাম তুমি নাকি প্রেসিডেন্টের পর্যায়ে চলে গেছো। তাই সম্মান জানানোর ছোট্ট প্রচেষ্টা আরকি। তোমার নাম বিলবোর্ডে উঠবে। ভাবা যায়! ”
” হোয়াট!! এই মাঝরাতে তুমি আমার সাথে ইয়ার্কি করছ! ” রাজ্যের বিরক্তি ভর করে সাদিফের চেহারায়।
এদিকে তানিশা বাপ-ছেলের কথপোকথন শুনে সেই মজা পাচ্ছে। একজন টিটকিরি মারছে তো আরেকজন ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছে।
” কি সাংঘাতিক! আমি জনাব প্রেসিডেন্ট মশাইয়ের সাথে ইয়ার্কি করতে পারি! আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা! ”
” জনাব প্রেসিডেন্ট মশাই! এ কেমন ভাষা বাবা?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলে সাদিফ। রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠেছে ওর।
জামিল চৌধুরীও ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলে,
” সম্মানিতদের এভাবেই সম্মান করতে হয়। যাক অন্তত হাফ মানুষ হয়েছ দেখছি! অন্য দুইটার মত ড্যাড না ডেকে বাবা ডাকছ। তা নবাবজাদা আপনি আহার করবেন কখন? রাতেরটা কি একবারে সকালে সাড়বেন? তাতে অবশ্য আমারই উপকার। কয়টা টাকা সাশ্রয় হত। ”
” আমি খেয়ে এসেছি। ” বলেই গটগট করে উপরে চলে যায় সাদিফ।
সাদিফ যেতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠে তানিশা। এতক্ষণ অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিল। কিন্তু বেচারির চেষ্টা বৃথা। ওর হাসির আওয়াজ সাদিফের কর্নকুহরে ঠিকই পৌঁছে গেছে।

তানিশা সব গোছগাছ করে উপরে আসে। ওর হাতের ব্ল্যাক কফির মগ। ততক্ষণে সাদিফ ফ্রেশ হয়েছে। বর্তমানে সে বিছানায় আধা শোয়া অবস্থায় মনযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। তানিশা চুপচাপ এসে সাদিফের পাশে দাঁড়ায়।
” আপনার কফি। ”
” আমি চেয়েছি?”
” আমি ভাবলাম ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, কফি খেলে ভালো লাগবে। ”
” আজকাল ভাবতেও শিখেছো দেখছি! সাথে বাবার কথার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতেও। ” মুখ স্বাভাবিক রেখে বলছে সাদিফ।
কিন্তু তানিশার পিলে চমকে যায় এতটুকুতেই।
” এই রে শুনে ফেলেছে। এখন আমার কি অবস্থা যে করবে। ” ভাবতে ভাবতে বিছানায় উঠে ঘাপটি মেরে পরে থাকে। কিন্তু বিধিবাম সাদিফ এক ঝটকায় তানিশার বাহু ধরে টেনে তুলে।
” আমার বাবাকে আমার নামেই উস্কে দেয়া হচ্ছে? কি ভেবেছো এভাবেই জিতবে আমাকে? তাহলেই ভালোবাসবো তোমাকে? কক্ষণো না। আর যাই হোক তোমাকে ভালোবাসা যায়না। নেভার এভার। আমার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তোমার আছে! ”
ডাগর ডাগর চোখ দুটি জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায় তানিশার। কথা আটকে থাকে বুকের ভিতর। এক সাগর কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার কাছে হাঁসফাঁস করে।
নিজের মনের সব রা*গ উগরিয়ে দিয়ে ধপ করে শুয়ে পরে সাদিফ।
তানিশা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে ব্যালকোনিতে আসে।

ততক্ষণে রাত অন্ধকারে রুপ নিয়ে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে সামনের দিকে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শোঁশোঁ বাতাসের শব্দ কানে এসে ধাক্কা মারছে। নিকষ কালো অন্ধকারে এক বিষণ্ন রমনী ব্যালকোনির গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে মনযোগ দিয়ে অন্ধকার সুদূরে চেয়ে রয়েছে।
” আচ্ছা পৃথিবীর সব জায়গার অন্ধকারই কি একরকম? সব অন্ধকারই কি মন খারাপের হয়? অন্ধকারের কি নিজস্ব কোন কষ্ট আছে? অন্ধকারেরও মন খারাপ হয়? অন্ধকারও কি আমার মত একাকী? ” এমন হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় তানিশার মনে। সেই সাথে চলছে চোখ দিয়ে অশ্রুদের ছুটে আসার প্রতিযোগীতা।

একই বাড়িতে, একই ঘরে দুইজন দুই মেরুর মানুষ নিজেদের জীবনের হিসাবে ব্যস্ত।
তানিশা ভাবছে, কেন তার সাথে এমন হলো। একটুও ভালোবাসা পেতে পারেনা সে? কেন এত অবহেলা? এতটাই অযোগ্য আমি! ভালোই যদি না বাসবে তবে আমাকে তার জীবনে ঠাঁই দিল কেন! ”

সাদিফ ভাবছে, আমি তো আরো ভালো কিছু ডিজার্ভ করতাম। সোহা আমার জন্য সব সময়ই পারফেক্ট ছিল। শিক্ষায়, যোগ্যতায় সোহার ধারেকাছেও কেউ ভিড়তে পারবেনা। তবে কেন একটা মধ্যবিত্ত ঘরের এক সাধারণ মেয়ে আমার জীবনে এলো? কেন বাবা আমার মতামতের মুল্য দিলনা? পোল্যান্ডের নামকরা ইউনিভার্সিটির উচ্চ ডিগ্রীধারী ছেলের জন্য বাবা কেন গ্রামের মেয়েকে পছন্দ করল? আর পোল্যান্ড ফিরে যেতেও দিলনা। আমার কত স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে পোল্যান্ডেই সেটেল হব। আমি কেন বাবার হাতের পুতুল হলাম! আর কেনইবা এই মেয়েকে আমার সহ্য হয়না! ওকে দেখলেই আমার অপূর্ণ স্বপ্নেরা কেন হাহাকার করে!

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে তা কেউই বলতে পারেনা। একদিকে তানিশা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে অপরদিকে সাদিফ রাগে পারলে নিজের চুল ছিঁড়ে।
চোখ মুছে তানিশা রুমে আসে। বিছানায় উঠতে গেলে সাদিফ ধমকে উঠে।
” তুমি আজ বিছানায় থাকতে পারবেনা। যাও নিচে গিয়ে শোও। তোমাকে আমার জাষ্ট অসহ্য লাগছে। ”
তানিশা ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে ব্যালকোনিতে যায়। আজকে রাতে চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিবে সে।

ভোরের আলো চোখে পড়তেই মিটমিটিয়ে চায় তানিশা। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিল বুঝতেই পারেনি। একপাশে মাথা হেলিয়ে শোয়ায় ঘাড়ে একটু ব্যথা অনুভব করে। ঘাড়ে হালকা ম্যাসাজ করে রুমে আসে। সাদিফ তখন গভীর ঘুমে। তানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অজু করতে যায়।

রহিমা খালার সাথে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছে তানিশা। সকাল সকাল ওর খুব কাজের চাপ হয়ে যায়। নাস্তা করে সবাই যে যার কাজে বেরিয়ে যায়। আটটার মধ্যেই টেবিলে নাস্তা দিতে হয়। এর উপর একেকজন একেক খাবার খায়। সাদিফ পরোটা,ডিম ভাজা খায়। সাইফ পরোটার সাথে মাংস ভুনা, সেমাই খায়। সাইরার জন্য মিক্সড স্যালাদ আর জুস। ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি রুটি আর আলু ভাজি খায়। আর নাস্তা শেষে চা- কফি প্রতিদিনের রুটিন। আটটার ভেতর এসব করতে গেলে হাঁফ ধরে যায়।

টেবিলে নাস্তা সাজানো শেষ হতেই একে একে সবাই আসে। সবাই খেতে বসে। তানিশা সার্ভ করে। এক টেবিলে তানিশা ছাড়া সবাই বসেছে, কেউ একটাবারও ওকে ডাকেনা খেতে।
জামিল চৌধুরী বিষয়টি লক্ষ্য করে বিরক্ত হয়।
” তানিশা মা তুমিও বসে খেয়ে নাও দেখি। আজ মা-ছেলেতে একসাথে খাই। ”
” বাবা আপনি খেয়ে নিন। আমি এত সকালে খেতে পারিনা। ভার্সিটি যাওয়ার আগে খেয়ে নিব। ”
” তোমার ক্লাস কয়টায় মা? আমি নামিয়ে দিয়ে যাই? ”
” সাড়ে দশটায় আমার ক্লাস। আমার অপেক্ষা করলে আপনার দেরি হয়ে যাবে। আপনি খেয়ে অফিসে যান। ”
জামিল চৌধুরী আর কথা বাড়ায়না নয়টার আগেই তার অফিসে ঢুকতে হবে।

আর এদিকে ওদের কথা শুনে সাদিফ বাদে সবাই ফুঁসছে। এসব কথায় সাদিফের কিছুই যায় আসেনা। তানিশার প্রতি জামিল চৌধুরীর ভালোবাসাকে সবাই আদিক্ষ্যেতা মনে করে। তারা কেউই চায়না তানিশাকে এত প্রাধান্য দিক জামিল চৌধুরী।

সবাই বেরিয়ে গেলে তানিশা সবকিছু পরিস্কার করে দুপুরের রান্না করতে যায়। শ্বাশুড়ির হুকুম যেখানেই যাও, যাওয়ার আগে যেন দুপুরের রান্না করা হয়। তানিশা সেই হুকুম অমান্য করেনি কখনো। যতই কষ্ট হোক না কেন দুপুরের রান্না করেই তবে ভার্সিটিতে যায়। অবশ্য বিয়ের পর একদিনও ফজরের নামাজ আদায় করে ঘুমায়নি। সোজা রান্নাঘরে এসে সব রেডি করে রাখে।

ভ্যাপসা গরমে মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে। আশেপাশে একটাও রিক্সা নেই। এদিকে খাঁখাঁ দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে কাজের চাপে খাওয়া হয়নি। ভার্সিটিতে এসে একটানা ক্লাস করার পর ক্লান্ত লাগছিল এমনিতেই। ক্ষুধা – পিপাসায় গলা-বুক শুকিয়ে গেছে। এদিকে বোতলের পানিও শেষ। বাধ্য হয়ে সামনের টং দোকানে যায় পানি নিতে। এক বোতল পানি নিয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। এরপর মুখ-চোখে পানির ছিটা দেয়। এতে একটু আরামবোধ করে। কিন্তু ক্ষুধারা একবারে জাঁকিয়ে বসেছে। নড়তেও কষ্ট হচ্ছে।

” এইযে খুঁকি কেমন আছো? পানির কত সৌভাগ্য তোমার শরীর ছুঁতে পারে। আহা! আমি যদি পানি হতাম! তোমার শরীরের সর্বত্র খেলা করতাম। ” কুরুচিপূর্ণ কথায় ঘৃণাভরে পেছনে তাকায় তানিশা।
ভার্সিটিরই কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায় শরীর রি রি করতে থাকে। কোন জবাব না দিয়ে পা বাড়ায়। কিন্তু ছেলেগুলো ওর পিছু ছাড়েনা। নানাধরণের কুরুচিপূর্ণ কথা বলতেই থাকে। একপর্যায়ে একজন ওর হাত ধরে। এবার তানিশা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ঠাস করে থা*প্প*ড় বসিয়ে দেয় ছেলেটির গালে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই থ মেরে যায়। ওরা তেড়ে আসে তানিশার ক্ষতি করতে। দিশা না পেয়ে তানিশা একরকম দৌড়াতে শুরু করে। পিছনে ছেলেগুলোও দৌড়াচ্ছে। কিছুদুর যেতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে পরে যায়। আর ছেলেগুলোও এসে পড়ে। একজন তানিশার হাত ধরে নিজের দিকে টান দেয়।
” আস্তে ব্যাটা। এমনভাবে টানছিস যেন মেয়েটা তোর বাপ-দাদার সম্পত্তি! মেয়েদের আগলে রাখতে হয়, টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি নয়। তবেইনা তোদের মন, কলিজা, কিডনি, ফুসফুস দিয়ে ভালবাসবে। ” ধাক্কা লাগা আগন্তুকের কথায় তানিশা আকাশ থেকে পরে।
” এই তুই কে রে? কোন গাছের কদু? আমাদের খাবারের মাঝে হাড্ডি হতে চাস নাকি? এমন চিবানো চিবাবোনা হাড়-মাংস খুঁজে পাবেনা তোর বাপ-মা।”
” আমি কদু না মধু তা তোমরা একটু পরেই বুঝবে বাছাধনেরা। আমার হাড্ডি-মাংসের কথা চিন্তা না করে নিজেদের নিয়ে ভাব। যখন থানায় নিয়ে প্যাঁদানি দিতে শুরু করব তখন এত চোপা থাকবেনা, বুঝলি। এমন ছ্যাঁচা ছেঁচবনা নিজের বউকেও শরীর দেখাতে লজ্জা পাবি। ”
এবার ছেলেগুলো ভয় পেয়ে যায়। তানিশা এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল। অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে কেটে পরে। তানিশার চলে যাওয়া কেউই লক্ষ্য করেনা।
” স্য…স্যার আপনি পুলিশ? ”
মাথা নেড়ে সায় দেয় আগন্তুক।
” স্যার আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমরা আর এমন করবনা। এখন আসি স্যার। ” বলেই ছেলেগুলো পালানোর পথ খুঁজতে যায়।
” চুপচাপ গাড়িতে ওঠ। থানায় চল আগে তোদের খাতির যত্ন করি। তারপর ছাড়ার কথা ভাবব।
কি ম্যাডাম ঠিক বলেছি? ” বলেই পেছনে তাকায় আগন্তুক। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তানিশার ছায়া দেখতে পায়না।
” যাহ্ কেটে পরেছে। আসলাম উপকার করতে কিন্তু যার উপকার করলাম সেই হাওয়া। সাধেই দাদি-নানিরা বলতনা, উপকারিকে বাঘে খায়। ”
ছেলেগুলো হুমড়ি খেয়ে আগন্তুকের পায়ে পরে।
” স্যার এবাবের মত মাফ করে দেন। আর এরকম ভুল করবনা। আমাদের থানায় নিবেননা স্যার। ”
” মনে থাকবে তো আজকের কথা? কখনো যদি শুনি কোন মেয়েকে বিরক্ত করেছিস তাহলে সোজা শ্বশুর বাড়ি। আমি এখানকার নতুন এসপি। তোদের সব খবর রাখব। ”
ছেলেগুলো নাক-কান মলে ওয়াদা করে আর এরকম করবেনা। তবেই ছাড়া পায় তারা।

রাস্তায় একটা রিক্সা পেতেই উঠে বসে তানিশা। সারা রাস্তা আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ঐ ভদ্রলোক না আসলে কি বিপদই না হতো! বাসার সামনে আসতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে যায়।
” এই যে শ্বশুরের আদরের বউমা, এত হনহনিয়ে ঢুকছো কেন? মনে হচ্ছে কুকুরের তাড়া খেয়েছো? স্বভাব এত লক্ষ্মী ছাড়া কেন? বাপ-মা ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারেনি দেখছি। বাড়ির বউদের হতে হয় শান্ত , নম্র-ভদ্র। কিন্তু তোমার ভেতর এসবের কিছুই নেই। এই মেয়েকে নিয়ে আমার ছেলে সারাজীবন কেমন করে কাটাবে! ”
শায়লা চৌধুরীর কথা কানে না নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় তানিশা।

ফ্রেশ হয়ে এসে প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিলে বসে।
এক লোকমা মুখে দিতেই শ্বাশুড়ির কথার আওয়াজ পায়। তিনি আপনমনে বকবক করে চলেছেন।
” ভাল ভার্সিটি ছাড়া বউমাকে পড়াবেননা। ছেলের বউকে পড়িয়ে জজ, ব্যারিস্টার বানাবেন। বাড়ির বউ বাড়িতে থাকবে, তা না উনি বউকে ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন। আমার কি ইচ্ছে করেনা ছেলের বউয়ের সেবা পেতে। আর এ মেয়েটাও কেমন! ধিঙি মেয়ের মত ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস গেলনা। বেশি পড়ালেখা করে যখন মুখে ঝামা ঘষে দিবে তখন শ্বশুর বুঝবে কি ভুল করেছি। ”

এক মুহূর্তের জন্য তানিশার হাত থেমে যায়। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে খেতে শুরু করে। খায় আর মনে মনে ভাবে, আমি কখন ঘুরে বেড়ালাম! মাসে পনের দিনই ভার্সিটিতে যাইনা, ক্লাস ছাড়াতো একদমই নয়! নিজেকে আরো শক্ত করার প্রবোধ দেয় মনকে।

বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে, আজও কি জায়গা হবেনা? কি করবে ভেবে পায়না তানিশা। সাদিফ কালকের মত যদি আজকেও করে! এদিকে মহাশয় ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। তার এদিকে তাকানোর সময়ই নেই! একমনে কাজ করে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তানিশা সোফায় বসে। গালে হাত দিয়ে একমনে সাদিফের কাজ করা দেখতে থাকে।

কাজ শেষ করতে সাদিফের অনেক সময় লেগে যায়। ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে চোখ যায় তানিশার দিকে। সে একমনে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
” কি ব্যাপার আজ রাত না ঘুমিয়ে থাকার প্ল্যান আছে নাকি। ” সাদিফের ঠান্ডা গলার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয় তানিশা
” না…মানে, আজ কোথায় ঘুমাব? ” তানিশার সরল মনে করা প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খায় সাদিফ।
নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয়,
” তোমার যেখানে খুশি সেখানেই শুতে পারো। ইনফ্যাক্ট ছাদে গিলে ঘুমালেও আমার আপত্তি নেই। ”
তানিশা বুঝল মনোভাব পজিটিভ। তাই সুরসুর করে বিছানায় এসে শুয়ে পরে।

বিছানায় শুতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে। কতক্ষণ কেটে গেছে জানেনা। কারো গভীর ছোঁয়ায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই বুঝতে সাদিফ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। সাদিফের গরম নিঃস্বাস আছড়ে পরছে তানিশার গলায়। বুকের ভিতর তোলপাড় হতে থাকে তানিশার। ও তো সব সময়ই চেয়েছে সাদিফ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরুক। ভালোবাসাহীন কামনায় কখনোই ভাসতে চায়নি তানিশা। ওর মনে সাদিফের জন্য আকাশ সমান ভালোবাসা। তবে ও নিজে কেন ভালোবাসাহীনতায় ভুগে! সাদিফের ওকে একটুখানি ভালোবাসলে কি এমন ক্ষতি হয়! বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারেনা। বাধ্য হয়ে সারা দিতে হয় সাদিফের কামনার।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here