#মায়ার_বাঁধন
২৫.
আজ দুদিন হলো জাহানারা চৌধুরীকে বাড়িতে শিফট করা হয়েছে। নীরা একবারের জন্যও তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়নি। এমনকি তাকে থাকতে হচ্ছে গেস্ট রুমে একপ্রকার বন্দী পাখির ন্যায়৷ তুরান তাকে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যাতে করে সে জাহানারা চৌধুরী, তুরান এবং আলহাম চৌধুরীর আশেপাশেও না যায়। জাহানারা চৌধুরী পুরোপুরি সুস্থ হওয়া অব্দি সে এ বাড়িতে ঠাই পাবে তারপরই তার ছুটি। এটা তুরানের সিদ্ধান্ত। আলহাম চৌধুরীও সবটা ক্লিয়ার না হয়ে কিছু করতে পারছেন না। তিনি অধির অপেক্ষায় আছেন স্ত্রীর সুস্থতা কামনায়। ডক্টরের কড়া নির্দেশ জাহানারা চৌধুরীকে কিছুতেই উত্তেজিত করা চলবে না। নয়তো বড় কোনো দু’র্ঘ’ট’না ঘটে যেতে পারে। সেই সুবাদে এখন নীরাকে নিয়ে কোনো প্রকার কথা তুলছে না তুরান। জাহানারা চৌধুরী থেমে নেই সে বারংবার নীরাকে খু্জে চলেছে কিন্তু প্রতিবারই তুরান শক্ত কন্ঠে নাকচ করছে তাকে।
গেস্ট রুমের বিছানায় গুটিশুটি মে’রে পড়ে আছে নীরা। ভঙ্গুর হৃদয়ে এক বিন্দু জলের বড্ড অভাব। তুরান তাকে অবিশ্বাস করছে, ভুল বুঝছে কিছুতেই মানতে পারছে না সে। এই দুদিনে সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তুরানকে সে ঠিক কতটা ভালবেসে ফেলেছে। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধে হয়ে জড়িয়ে গেছে এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে। এ বাঁধন খুলে বেড়িয়ে যাওয়া অতটা সহজ বিষয় নয়। আচ্ছা তুরান কী সত্যিই তাকে ছেড়ে দেবে? কিন্তু সে তো জেনে-বুঝে কোনো অন্যায় করে নি। তাকে ফাঁ’সা’নো হয়েছে। কিন্তু তুরান কী সেটা বুঝবে? সে তো নীরার কোনো কথাই শুনছে না। আর না দিচ্ছে এক্সপ্লেইমশানের সুযোগ।
——-
বাড়িতে বসে কষ্ট পাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে নীরা চলে যায় ভার্সিটিতে। সেখানে গেলে অন্তত মনটা কিছুটা সময় হালকা থাকবে। তুরান ভার্সিটি যাচ্ছে না এই কদিন। বাড়িতেই থাকছে। বিষয়টা নীরার জন্য অধিক সহজ হলো। তুরানকে দেখলেই তার কষ্ট বাড়ছে বৈ কমছে না। ড্রাইভারের সঙ্গে করে ভার্সিটি চলে যায় সে।
নীরাকে দেখতেই পরপর মুখ ঘুরিয়ে নেয় তার তিন বান্ধবী। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এদের আবার হলো টা কী? সে ম’র’ছে তার জ্বালায় এখন আবার এরা কী শুরু করল। কোথাও শান্তি নেই। নীরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায়। ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ে বেঞ্চিতে। অতশী, সীমা,রুহি তিনজনেই অন্য দিকে ফিরে আছে। নীরা বসতে বসতে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোদের? মুখে কুলুপ এঁটেছিস নাকি? আর আমার চেহারায় কী মরিচা পড়েছে যে কেউ ফিরেও দেখছিস না?”
অতশী সেভাবেই ভারী কন্ঠে উত্তর দেয়,
“আমাদের কোনো ফ্রেন্ড নেই। আমরা কাউকে চিনি না।”
তার সঙ্গে তাল মেলায় সীমা ও রুহি। নীরা ভাবলেশহীন জবাব দেয়,
“অভিনয় বাদ দিয়ে ডিরেক্ট বল কাহিনী কী?”
“কাহিনী আমরা নয় তুই বলবি।”
নীরা এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে,
“আমি?”
“হ্যাঁ তুই।”
“আচ্ছা কী জানতে চাস বল?”
“তুই ম্যারিড?”
অতসীর প্রশ্নে থমকায় নীরা। কেঁপে ওঠে ওষ্ঠ। সেই সঙ্গে বক্ষ। অথচ সর্বাঙ্গ কঠিন। নীরা ভেবেছে হয়তো এই কদিনের অনুপস্থিতি নিয়ে ওদের প্রশ্ন কিন্তু না এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভাবতেই পারেনি সে। তিন বান্ধবী অধির আগ্রহ নিয়ে নীরার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে। কিন্তু ফলাফল যখন শূন্য অতসী তখন পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে। বলে,
“কী হলো কথা বলছিস না যে? আর ইউ ম্যারিড?”
নীরা জিভের সাহায্যে ওষ্ঠ ভিজিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় পাল্টা প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“কারণ আছে নিশ্চয়ই? পাল্টা প্রশ্ন না করে যেটা সঠিক সেটাই বল।”
নীরা আমতা আমতা করছে। অতশী থামিয়ে দেয় ওকে। অভিমানী কন্ঠে বলে,
“ওকে বলতে হবে না। বুঝে গেছি আমরা আসলে তোর কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। এজন্যই এত লুকোচুরি। আচ্ছা এটা ধর এটা বোধহয় তোর। সেদিন কফিশপ থেকে বেড়ানোর পর পেয়েছিলাম।”
নীরা অতশীর থেকে ডায়েরিটা হাতে নেয়। ধক করে ওর হৃদয়। বুঝে যায় সব। তারমানে অতশী এটা পড়েই সব জেনেছে। ইশ কী বেখেয়ালি সে। এখন যদি ওরা চেপে ধরে ওর বরের পরিচয় জানতে তখন কী বলবে নীরা? ভাগ্যিস তুরানের নাম ডায়েরির কোথাও লেখা নেই। বুকে হাত চেপে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে নীরা। তখনই রুহি বলে ওঠে,
“তারমানে তুই বলবি না তাই তো? ওকে চল সবাই আমরা অন্য সারিতে গিয়ে বসব। ওর সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ। যে আমাদের আপন ভাবে না তার সঙ্গে আবার কীসের বন্ধুক্ত? চল সবাই।”
রুহির কথায় অতশী, সীমা উঠতে নেয় কিন্তু নীরা আটকায় ওদের। অভিমান ভাঙাতে বলে,
“আরেহ কোথায় চললি তোরা? বস বলছি। আমি বলছি সব আগে শান্ত হয়ে বস তো তোরা।”
সবাই শান্ত হয় তবে মুখ ভাড় করে থাকে। নীরা বলতে শুরু করে তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধীরে ধীরে পুরোটাই বিশ্লেষণ করে। বাদ রেখে যায় শুধু পরিচয় টুকু। কিন্তু সেটুকুও ধরে বসে অতশী। জোরদার কন্ঠে বলে,
“সবই তো বুঝলাম কিন্তু তোর বরের নাম কী? কোথায় থাকে? পরিচয় বল।”
নীরা কিছু একটা ভেবে বলে,
“কেন বলব? তুই কী আমাকে তোর তেনার পরিচয় দিয়েছিস এখনো?”
অতশী সীমাহীন লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে ফেলে। মিনমিনিয়ে বলে,
“বলেছি না সবকিছু ঠিকঠাক হলে সামনাসামনি দেখা করাব তোর সঙ্গে।”
“তাহলে আমার বরের পরিচয়ও না হয় সেদিনই নিস।”
অতশী বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“এটা কী হলো?”
“যা হবার তাই হলো।”
সীমা,রুহি দুজনে দুপাশ থেকে অতশীকে দুটো গাট্টা মা’র’ল। বলল,
“তোর জন্য মিস হয়ে গেল।”
——-
ভার্সিটি শেষে নিজের মতো করে বাড়ি ফিরে আসে নীরা। আজও অনেক চেষ্টা করেছে শ্বাশুড়ির সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তুরান এক চুল পরিমাণ নড়চড় করে না ওখান থেকে। সারাদিন গাঁট হয়ে বসে থাকে। অসহায় হয়ে পুনরায় গেস্ট রুমে ফিরে যায় নীরা। আড়ালে আবডালে এসব দেখে বিশ্বজয়ী আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে রিনা।
জাহানারা চৌধুরীর অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তুরান দিনরাত এক করে মায়ের সেবা করছে। একটুও ত্রুটি রাখছে না। রিনা এক ঝলক দেখা দিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায়। জাহানারা চৌধুরীকে ঔষধ খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে তুরান। জাহানারা চৌধুরী যখন পুরোপুরি ঘুমে কাতর তখন চুপিসারে বেলকনিতে চলে যায় সে। পকেট হাতড়ে বের করে সিগারেটের প্যাকেট। একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে নেয়। সিগারেটের ধোয়ায় উড়িয়ে দিতে থাকে দুশ্চিন্তা, কষ্ট গুলো। তার মনে একটাই অনুতাপ ঘোর পাক খাচ্ছে তা হলো নীরা। তার ধারণা মতে নীরার দ্বায়িত্ব – হীনতার কারণেই তার মায়ের এই করুণ পরিণতি। আর এই সম্পূর্ণ দ্বায় সে নিজের মাথায় নিয়ে নিয়েছে। কারণ সেদিন যদি সে নীরার ওপর দ্বায়িত্ব না ছেড়ে নিজেই দ্বায়িত্ব নিত তাহলে নিশ্চয়ই এমনটা হতো না। নীরার কথা স্মরণে আসতেই অগোচরে শক্ত হয় তার চোয়ালদ্বয়। তখনই ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে আসে মায়ের মমতাময়ী ডাক। নম্র কন্ঠের আকুতিভরা বানী,
“তুরান নীরা কোথায়?”
#মায়ার_বাঁধন
২৬.
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তুরান?”
মায়ের নিরেট কন্ঠে নড়ে ওঠে তুরান। মনে মনে ঘাবড়ায় কিন্তু প্রকাশ্যে বলে,
“ওর কথা মুখে এনো না। ওর জন্য আজ তোমার এই অবস্থা।”
জাহানারা চৌধুরী অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করে ছেলের পানে। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,
“কী বলছিস এসব ওর জন্য আমার এই অবস্থা হবে কেন?”
তুরান এগিয়ে আসে মায়ের নিকট। মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে অনুরোধিত কন্ঠে বলে,
“তোমার শরীর ঠিক নেই এখন এসব কথা থাক।”
জাহানারা চৌধুরী মানতে নারাজ। তিনি আজ সবকিছু জেনে তবেই ক্ষান্ত হবেন। তাই বলেন,
“আমি সত্যিটা জানতে চাই তুরান।”
তুরান মাথা নত করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তারপর বিগত কয়েকদিনের ঘটনা খুলে বলে। জাহানারা চৌধুরী হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। না জেনে শুনে হুটহাট ছেলের এমন কৃতকর্মে তিনি তীব্র আ’হ’ত। রাগ সংবরণ করতে না পেরে দূর্বল হাতে সপাটে চ’ড় বসান ছেলের গালে। তুরানও এবার একই রকম বিস্মিত। গালে হাত দিয়ে অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আছে মায়ের অগ্নি ঝরা দৃষ্টি পানে। জাহানারা চৌধুরী ক্রোধে হাসফাস করছে। পরপরু ক্ষীপ্র কন্ঠে বলেন,
“তোর মতো ছেলে জন্ম দিয়ে জীবনে অনুশোচনার আর সীমা রইল না আমার৷”
তুরানের গলা কেঁপে ওঠে। অসহায় কন্ঠে ডাকে,
“মা……”
“হ্যাঁ ঠিকই বলছি আমি। তোর জন্য শুরু থেকে মেয়েটা কষ্ট পেয়ে আসছে। পুরোপুরি না জেনে শুনে অন্যের কথার ওপর ভিত্তি করে এমন একটা সিদ্ধান্ত তুই কী করা নিলি তুরান? রিনাকে তুই চিনিস না ও কেমন? তারপরও তুই ওর কথা বিশ্বাস করে নীরাকে ভুল বুঝলি? এখন মনে হচ্ছে জোর করে মেয়েটাকে তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে চরম ভুল করেছি আমি। তুই ওর যোগ্যই না। ও তোর থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করে।”
তুরান নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু। জাহানারা চৌধুরী আবার বললেন,
“সেদিন নীরার কাছে একটা ফোন আসে। হয়তো ওপাশ থেকে ও এমন কিছু শুনে যার জন্য ও আমাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর সেই শোনার মূলে ছিলি তুই। নীরা শুধু মুখ থেকে ‘তুরান’ শব্দটা বের করেছিল। পরপরই পাগলের মতো হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। রিনাই তখন ওকে আশ্বাস দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল নয়তো মেয়েটা শুরুতে হাসফাস করছিল ঠিকই কিন্তু এক পা ও নড়ে নি। রিনার ওপর ভরসা করে বেড়িয়েছিল ও। আমি তখন নীরার মুখে ‘তুরান’ নাম শুনে আর ওর ওভাবে একা একা বেড়িয়ে যাওয়া নিয়ে টেনশন করে এই অঘটন ঘটিয়ে ফেলি। চোখ বন্ধ করার আগে স্পষ্ট দেখতে পাই রিনা আমার সেই করুণ সময়ে আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। আর কিছু জানা নেই আমার তারপর তো একেবারে হসপিটালে জ্ঞা’ন ফিরল।”
তুরান ধীর গতিতে উঠে দাড়ায়। সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়েছে তার। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে অন্তরিক্ষ। তুরান নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায় মায়ের ঘর থেকে। জাহানারা চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সেদিক পানে চেয়ে। এ কয়েকদিন তার খটকা লেগেছিল অনেক কিছুই আজ তার সত্যতা প্রমাণিত হলো।
——-
নীরার মনটা আনন্দে ভরপুর। এই এতদিনে বুকের ওপর থেকে ইয়া বড় কোনো পাথর সরলো যেন। শ্বাশুড়ি মায়ের জন্য বড্ড অস্থির হয়ে ছিল এতদিন। আজ সুযোগ হলো কাছাকাছি আসার। জাহানারা চৌধুরী নিজেই কাজের মেয়েকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন নীরাকে। এসে থেকেই শ্বাশুড়ির কোলে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে নীরা। চোখমুখ শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে এ কয়েকদিনে। জাহানারা চৌধুরী পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন নীরার মাথায়। নীরাকে তিনি নিজের আপন মেয়ে মনে করেন। তার মেয়ে কিয়া তো বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে তেমন আসতেই পারে না। বছরে একবার আসে হয়তো। আর রিনা তার কথা আর কী বা বলা যায়? সে হিসেবে, নীরাকেই তিনি নিজের মেয়ে রুপে আগলে রেখেছেন। নীরার কষ্টে নিজের বুকটা ফেটে চৌচির হচ্ছে বারংবার।
নীরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। তুরান বাড়িতে নেই। মায়ের ঘর থেকে বেড়িয়ে সেই যে বাহিরে পা রেখেছে এখন অব্দি ফেরেনি। নীরা মনে মনে ভীষণ কষ্টে আছে। তুরান ফিরে এসে হয়তো আবার তাকে বের করে দেবে। দূরে ঠেলে দেবে। বিয়ের পর থেকে তুরানের যত্ন, ছোট ছোট খুনসুটিতে নীরা বেশ অভস্ত্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সে সেগুলো ভীষণ মিস করছে। তুরানকে ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কিন্তু তুরান কী তা বুঝবে? হয়তো না, না হলে এতদিন কীভাবে ভুল বুঝে দূরে সরে থাকল? তুরান হয়তো তাকে একটুও মনে জায়গা দিতে পারেনি। সবটাই অভিনয় করে গেছে।
অজান্তেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। অগোচরে সেটুকু মুছে নেয় নীরা। পরপরই উঠে বসে। শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে বলে,
“তুমি বসো আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি। এতদিন তো একটুও সুযোগ পাইনি তোমার সেবা করার আজ সহজে ছাড়ছি না।”
জাহানারা চৌধুরী হাসলেন। তৃপ্তি ভরে দেখলেই নীরার উচ্ছসিত আদল। পরপরই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। নীরা দেরি করল না। ছুট লাগাল কিচেনে। উদ্দেশ্য কিছু খাবার নিজ হাতে তৈরি করবে।
——-
আধঘন্টা যাবৎ বারে বসে মদ্যপান করছে তুরান। নিজের মধ্যে অঙ্কুরিত অনুশোচনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এই মুখ নিয়ে কীভাবে সে নীরার সামনে গিয়ে দাড়াবে? ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কী মা’রা’ত্ম’ক ভুলটাই না করে বসেছে। এখন নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানাতে হচ্ছে। পাশেই অয়ন বসে। তুরানকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। একটা সময় তুরান ঢলে পড়ে। নেশায় মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে। আবোলতাবোল বকছে শুধু। অয়ন অনেক কষ্টে তুরানকে টেনেটুনে নিয়ে যায়। গাড়িতে করে সোজা পৌঁছে দেয় বাড়িতে।
অনেক দিন পর শ্বাশুড়ির সেবা করতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত নীরা। একেবারে রাত অব্দি লেগে ছিল শ্বাশুড়ির সঙ্গে। আলহাম চৌধুরী বাড়িতে ফিরে নীরার উপস্থিতিতে ভীষণ খুশি হন। জাহানারা চৌধুরীর মুখে সব কথা শুনে তিনি ছেলের ওপর চরম বিরক্ত হন। সেই সঙ্গে নীরার সম্মুখে ঘোষণা করেন অনুতপ্ততা। সবকিছু ভুলে তারা একটা সুন্দর মুহূর্ত কাটায়৷
ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটার কাটায় নীরা তখনো জেগে। জাহানারা চৌধুরী আর আলহাম চৌধুরী শুয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়েছেন কীনা বলা যাচ্ছে না। ছেলের ওপর রাগ দেখিয়ে দরজা দিয়েছেন হয়তো শুধু। কিন্তু নীরা! সে তো সারা ঘরময় পায়চারি করছে। একদন্ড শান্তি পাচ্ছে না। তার এই সকল অশান্তির মূলে তুরান। হ্যাঁ, তুরান এখনো বাড়ি ফেরেনি। টেনশনে ঘুম উবে গেছে নীরার। এই কয়েকদিনেও লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষটাকে দেখার সুযোগ মিস করেনি সে। আজ সেই যে গেছে আর ফিরল না। কোথায় গেল, কী করল কিচ্ছু বোধগম্য হচ্ছে না নীরার। এরই মধ্যে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। নীরা ছুট্টে গেল জানালায়। একটু পরই গাড়ি থেকে বের হলো অয়ন। পরপরই টেনেটুনে বের করল তুরানকে। তুরান হেলে পড়ছে বারংবার অয়নের গায়ে। সুদূর জানালার ফাঁক ভেদ করে এই দৃশ্য অবলোকন করে ছটফটিয়ে ওঠে নীরা। মনটা দ্বিগুণ অস্থির হয়ে উঠেছে তার। কম্পিত কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলে, “কী হলো মানুষটার? ঠিক আছেন তো মি.চৌধুরী?”
অস্থির চিত্তে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নীরা। হোঁচট খায় বারকয়েক তবু সামলে নিয়ে পুনরায় এগোয়। একেবারে সদর দরজায় গিয়ে ঠেকে।
.
চলবে,
®