মায়ার বাঁধন পর্ব -২৯+৩০

#মায়ার_বাঁধন
২৯.
——
“আচ্ছা! তোর ভাবি খুশি হবে তো, অয়ন?”

অয়ন দাঁত কেলায়। হেলেদুলে বলে,
“কেন খুশি হবে না ভাই? ভাবি ভীষণ খুশি হবে।”

“অয়ন, আমার না কেমন জানি আনইজি লাগছে। আচ্ছা, সকলের সামনে না দিলে হয় না?”

“আহ ভাই, আজকের দিনে সকলের সামনে দিলে বেশি ভালো হয়৷ আর দেখবেন তাতে ভাবিও বেশি খুশি হবে।”

“বলছিস?”

অয়ন জোরে জোরে মাথা ঝাকায়। যার অর্থ হ্যাঁ সে নিশ্চিত হয়েই বলছে। তুরানের আর কী করার এমনিতেও তার কাছে আদার্স কোনো অপশন নেই। বাইক ক্রমাগত ভার্সিটির সন্নিকটে ছুটছে। যত কাছাকাছি আসছে তুরানের হৃদপিণ্ড ততই তড়িৎ গতি সম্পন্ন হচ্ছে। তড়াং তড়াং করে লাফাচ্ছে। আজব! এমন কেন হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আগে তো কখনো এমন হয়নি।ওহ আগে তো সে কখনো কোনো মেয়েকে প্রপোজ করতে যায়ওনি। তার ওপর এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সে শুধু একজন মেয়েকে নয় সয়ং তার বিয়ে করা বউকে পুরো ক্যাম্পাসের সম্মুখে প্রপোজ করতে যাচ্ছে। কী আছে কপালে আল্লাহই ভালো জানেন।

——-

গোলাপ ও রজনীগন্ধার সংমিশ্রণে তৈরি বুফে সমেত ক্যাম্পাসে পা রেখেছে তুরান। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার একরাশ অস্বস্তিতে গুটিয়ে যাচ্ছে। চতুর্দিকে কাপলের সমারোহ। তবুও তুরানের মধ্যে অসীম দ্বিধা। এমন শীতল পরিবেশেও
তার শরীর গলে জেগে উঠেছে ঘর্ম। অতিব নার্ভাসনেস কাবু করে ফেলেছে শক্তপোক্ত, বলবান পুরুষটিকে। তুরান অবিলম্ব জোর কদম ফেলে একেবারে বকুল তলা গিয়ে থামে। অয়নও দৌড়ঝাপ করে তার সঙ্গ নেয়। তুরান বকুল তলার চওড়া স্থানটায় আয়েশ করে বসে। পরপরই অয়নের
দিকে তাকিয়ে বলে,

“যা তোর ভাবিকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়। জিজ্ঞেস করলে বলবি দরকার আছে তাই। সত্যিটা বলবি না কিন্তু।”

অয়ন সতর্ক হয়। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। অতঃপর ছুটে চলে যায় নীরার ক্লাসে। তুরান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। শার্টের ওপরের বোতামটা খুলে দেয়। আপাততঃ তার রিল্যাক্স প্রয়োজন কিন্তু সেটা হয়তো হবার নয়।

সারা ক্লাস হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজেও নীরার দেখা মিলল না। অয়ন পুনরায় চোখ বুলায়। নাহ, নীরা নেই কোত্থাও।
সহসা অয়নের দৃষ্টি থামে অতশীর ওপর। পরপরই আশেপাশ তাকিয়ে সীমা,রুহিকেও দেখতে পায়। অয়ন এদের নাম জানে না তবে নীরার সঙ্গে বারকয়েক দেখেছে। অয়ন এগিয়ে যায় ওদের নিকট। উদগ্রীব কন্ঠে বলে,

“নীরা ভা… নীরা চৌধুরী কী তোমাদের ফ্রেন্ড?”

অতশী মাথা নাড়ে। ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “হু।”

অয়ন পুনরায় প্রশ্ন করে,
“সে কোথায়?”

“ও তো চলে গেছে অনেক আগেই।”

“কীহহ কোথায় গেছে?”

“বাড়িতেই। বলল শরীর খারাপ লাগছে। তারপরই চলে গেল।”

অয়ন ‘ওহ’ বলে চলে যায়। এদিকে তিন বান্ধবী এটা নিয়ে গবেষণায় নেমে পড়েছে। গবেষণার মূল বিষয়, অয়ন কেন নীরাকে খুঁজছে? ওদের ধারণা মতে অয়ন হয়তো আজকের দিনে নীরাকে প্রপোজ করতে চাইছে।

অয়ন যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে চলে আসে তুরানের সম্মুখে। ওকে দেখেই তুরান দাঁড়িয়ে যায়। ছটফটে ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুড়ে,

“কী বলল? আসছে তো? রাজি হয়েছে?”

অয়ন দম নিয়ে বলল,”ভাবি ক্লাসে নেই।”

“নেই মানে কোথায় গেছে?”

“তার বান্ধবীরা বলল শরীর খারাপ লাগছে বলে বাসায় চলে গেছে।”

তুরানের মুখশ্রী পরিবর্তন হলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,

“শরীর খারাপ লাগছে কেন? আমি কী তবে কালরাতে বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি?”

অয়নের কান পর্যন্ত আসে না সে কথা। তাই সে জিজ্ঞেস করে বসে,

“কিছু বললেন, ভাই?

“উম, হু, নাহ নাহ কিছু বলিনি। আচ্ছা তুই থাক আমি বরং বাড়িতে যাই।”

“আচ্ছা।”

তুরান তত্রস্থ পায়ে হাঁটা ধরে। পেছন থেকে অয়নকে বলতে শোনা যায়, “অল দ্যা বেস্ট, ভাই।”

তুরান হাত উঁচিয়ে ধন্যবাদ জানায়। পরপরই দ্রুত কদমে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

——-

বাড়ির আনাচে কানাচে একেবারে নীরার অস্তিত্ববিহীন। তুরান ব্যর্থ হয়ে জাহানারা চৌধুরীর নিকট যায় কিন্তু ফলাফল শূন্য। তিনি জানিয়েছেন নীরা সেই সকালে বেড়িয়েছে এখনো ফেরেনি। মায়ের মুখে এরূপ বাক্য শ্রবণ করে তুরানের পৃথিবী যেন সেখানেই থমকে। অজানা শঙ্কায় নিমজ্জিত হৃদয়। দুরুদুরু বক্ষে উঠানামা বেড়েছে তিনগুণ।
তুরান তব্দা মে’রে বসে পড়ে মেঝেতে। এক মনে শুধু ভাবছে,’ নীরা কোথায়,নীরা কোথায়?’ পরপরই পাগলের মতো হন্নে হয়ে খোঁজে সবখানে। কিন্তু ফলাফল সেই শূন্যের কোঠায়। তুরান একবার ভাবে নীরার বাবার বাড়িতে ফোন করবে। কিন্তু বিষয়টা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। তাই সে জাহানারা চৌধুরীকে দিয়ে কৌশলে ফোনটা করিয়েই ছাড়ে কিন্তু তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল সেখানেও নীরা যায়নি। জাহানারা চৌধুরী ও আলহাম চৌধুরী দুজনেই ভীষণ চিন্তিত। তারা সমানে তুরানকে বকে চলেছে। তাদের সন্দেহ তুরানের জন্যই নীরা কোথাও একটা চলে গেছে।

বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধা নেমে এসেছে। একরাশ ক্লান্তিতে ভর করে তুরান পুনরায় ছুটে এসেছে ক্যাম্পাসে। বিধস্ত, বিবর্ণ চেহেরাটা দেখা মাত্রই ছুট্টে এসেছে অয়ন। তুরানের এরূপ সঙ্গতিতে অয়নের বক্ষ চিনচিন করে ওঠে। তুরানকে সে নিজের আপন বড় ভাই রুপে শ্রদ্ধা করে এবং ভালবাসে
তুরানের সঙ্গে পরিচয় তার ভার্সিটি লাইফ থেকে। সেই থেকে কখনো তুরানের এমন অবস্থা নজরে পড়ে নি। তারমানে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটেছে। অয়ন আর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না। ব্যগ্র কন্ঠে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে ভাই? এনি প্রবলেম? ভাবি, ভাবি কিছু বলেছে? একসেপ্ট করেনি? কী হয়েছে কিছু তো বলুন?”

তুরানের নির্জীব কন্ঠে আকুতি মেশানো বুলি,
“তোর ভাবিকে খুঁজে পাচ্ছি না, অয়ন। সে আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমার অপরাধের শাস্তি দিয়ে গেছে। আমার অবহেলার শাস্তি দিয়ে গেছে।”

কথাগুলো বলতে বলতে একটা সময় তুরান হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়ে। অয়ন ধরতে গিয়েও পারে না। সে ও তুরানের পাশে আসন নেয়। তুরান বিলাপ করছে আর বলছে,
“তোর ভাবিকে এনে দে, অয়ন। আমি একটা বার তার কাছে ক্ষমা চাইব। আমাকে একা করে সে কোথায় হারিয়ে গেল, অয়ন।”

তুরান যেন নিজের মধ্যে নেই। পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। ভার্সিটির প্রায় ছাত্রছাত্রী চলে গেছে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে আমার কিছু কিছু থেকে গেছে। তাদের মধ্যে অতশী, সীমা, রুহি তারাও আছে। তুরানের অপেক্ষা করতে করতে শেষমেশ ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে কেবলই ক্যাম্পাস ছাড়ার উদ্দেশ্যে উদ্যত হচ্ছিল সে। তার পেছন পেছন শান্তনার বানী শোনাতে শোনাতে আসছিল সীমা ও রুহি। পথিমধ্যেই তাদের দৃষ্টি আটকায় তুরানের অগোছালো, পাগলাটে চেহারায়। থমকে যায় পায়ের চলন। স্থির হয় দৃষ্টি। অতশী উদাস কন্ঠে বলে,

“কী হয়েছে তার? এমন অবস্থা কেন? অমন পরিপাটি মানুষটা এভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে কেন?”

সীমা, রুহি একে অপরের সঙ্গে চোখাচোখি করছে। পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে। অতশী আনমনেই ওদের কিছুটা কাছে চলে যায়। ওর সঙ্গে সঙ্গে ওরাও আসে। তুরান তখনও অয়নকে আঁকড়ে ধরে আবোলতাবোল বকে চলেছে। আশেপাশের কোনো কিছুতে তার ধ্যান নেই। তখনই আরেক জোড়া পা এসে থমকায় তার সম্মুখে। তুরান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। মায়ের মালিক তার অতিব পরিচিত। কিন্তু সে কেন?
#মায়ার_বাঁধন
৩০
———-
অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে অপ্রত্যাশিত বদনখানি তুরানের নিকট ভীষণ বিরক্তিকর লাগল। অপরদিকের মানুষটির চোখেমুখে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের ছাপ। অধরে স্মিত বক্রহাসি। তুরানকে ক্ষেপিয়ে তুলে ওই মানুষটিই প্রথম মুখ খুলল। কন্ঠে একরাশ কৌতুক মিশিয়ে বলল,

“ভার্সিটির নিউলি হ্যান্ডসাম ভিপি এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে?
নাইস ছিনারি। ভেরি নাইস।”

নেহাল নিজের বাক্যবাণ সম্পন্ন করে কুটিল হাসিতে মেতে উঠল। দু’হাতের তালুর সাহায্যে বাজালো দু’একবার করতালি। নেহালের এমন উপহাস সহ্য করতে পারল না তুরান। মুহুর্তেই বিক্ষিপ্ত হয় মস্তিষ্ক। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় নীরার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে নেহালেরই হাত রয়েছে। সেই ভাবনাকে অনুসরণ করে তেঁতে ওঠে তুরান। মাটি থেকে তোড়জোড়িয়ে উঠেই চে’পে ধরে নেহালের কলার। দন্ত পিষে বলল,

“তুইই নিশ্চয়ই আমার নীরার কিছু করেছিস। বল নীরা কোথায় বললললল?”

তুরানের এমন ব্যবহারে নেহাল বিস্ময়াবিষ্ট। অবিশ্বাস্য চাহনি তার। নেহালের সঙ্গে আরও ছেলেপুলে ছিল। তারা তুরানের দিকে এগিয়ে আসতে নেয় কিন্তু নেহাল ইশারায় থামিয়ে দেয় ওদের। নিজেই শক্ত হাতে ছাড়িয়ে নেয় তুরানের হাত। ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,

“নীরা কে? আর তোরই বা তারজন্য এত দরদ কীসের? আর কোথায় গেছে সে?”

তুরান হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। হাঁটু ভেঙে পুনরায় ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে নিজের চুল দু-হাতে খামচে ধরে। চিৎকার করে আর্তনাদ করে বলে ওঠে,

“সি ইজ মাই ওয়াইফ! সি ইজ মাই ওয়াইফ।”

নেহালের দৃষ্টিতে বিস্ময়াবৃতি দ্বিগুণ হয়। তুরান বিয়ে করেছে এটা ভাবতেই হৃদয়ে কিঞ্চিৎ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাকে ছাড়া কীভাবে করল তুরান বিয়ে? কথা ছিল যে দু বন্ধু একত্রে বিয়ের পিরিতে বসবে। পরপরই দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করল নেহাল। মনে পড়ল এখন আর কিছুই আগের মতো নেই। তারা এখন বন্ধু রুপি শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তবুও বন্ধুক্তের টান বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। সেখানেও হৃদয় পোড়ে। সেই টানেই সে সব দন্দ ভুলে এগিয়ে যায় তুরানের নিকট। আলতো শক্ত হাতে স্পর্শ করে কাঁধ। তুরান ঘুরে তাকায়। হাতের মালিকের মুখপানে তাকিয়ে অবাক হয় না বরংচ জাপ্টে ধরে একসময়ের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। উগলে দেয় সকল কষ্ট। নেহালও শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। ভরসার সহিত বলে,

“পেয়ে যাবি চিন্তা করিস না। চল একসঙ্গে খুঁজি।”

অয়ন ভীষণ খুশি হয়। দুই বছর আগের সেই মুগ্ধকর বন্ধুক্ত আজ আবার তাদের চোখের সম্মুখে। তবে কী এবার মিটবে সেই বিবাদ? ক্ষমতার নড়াই ছাপিয়ে জিতবে কী বন্ধুক্তের বন্ধন? এ পৃথিবীতে সবাই এক-একটা #মায়ার_বাঁধনে জড়িয়ে আছে। সেই টানে যতই দূরে যাক না কেন একসময় ঠিক ফিরে আসতেই হয়। অয়ন অগোচরে চোখ মুছে নেয়। সে আবার ভীষণ সফট হার্টেড। অল্পতেই ইমোশনাল হয়ে পড়ে আংশিক মেয়েদের মতো।

সকলে উঠে দাড়ায়। উদ্দেশ্য আশেপাশে ভালোভাবে খোঁজ করবে নীরার। তখনই কম্পিত এক নিথর কন্ঠ ভেসে আসে,

“আআআমি জানি নীরা কোথায়।”

তড়িৎ গতিতে পেছন ঘুরে তাকায়। অতশীর মুখটা তুরানের পরিচিত। ক্যাম্পাসে বহুবার দেখা হয়েছে। তারওপর নীরার সঙ্গে সর্বদাই এদের চোখে পড়ে। তুরান দ্রুত এগিয়ে গেল। উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল,

“তুমি জানো? তাহলে বলো কোথায় আছে নীরা? তাড়াতাড়ি বলো না কোথায় সে? আচ্ছা তুমি কীভাবে জানলে? বলে গিয়েছে ও তোমাকে?”

অতশীর কন্ঠ সেরকমই নিথর শোনায়। থেমে থেমে বলে,

” ওর ডায়েরিতে পড়েছিলাম মন খারাপ থাকলে সে একটা জায়গায় যায় সকলের অগোচরে। হয়তো সেখানেই আছে।”

“কোথায়, কোথায় সেই জায়গা বলো তাড়াতাড়ি?”

অতশী নাম বলতেই তুরান নেহাল, অয়নসহ সকলেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে। এক ধ্যানে সেদিক পানে বেদনার্ত দৃষ্টি
ফেলে রয় অতশী। সকলের প্রস্থান বিলয়কালে সে মন্থর দেহ ছেড়ে ঢলে পড়ে কোমল,ধূলিমাখা মৃত্তিকায়। এতক্ষণের লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ সশব্দে কন্ঠনালী গলিয়ে বেড়িয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই পাশ দিয়ে দুই বান্ধবী আগলে নেয়। এ ব্যথার অন্ত কোথায়? আছে কী কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা?

———

পুরোনো এক ভঙ্গুর প্রাচীর ভেদ করে একটি অর্ধ পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রবেশ করল ওরা। বাহির থেকে দেখলে মনে হয় ভেতরে কারো নিবাস নেই। হয়তো বহুকাল পূর্বেই পরিত্যাগ করা হয়েছে এই ভূমি। কিন্তু নাহ এই পরিত্যক্ত ভূমিতেই কয়েকশত এতিমের বাসস্থল। বাহিরটা যতটা অগোছালো ভেতরটা ততটাই স্বচ্ছল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ক্রমাগত সবকিছু অবলোকন করে চলেছে ওরা। যাত্রা পথে কয়েকটি কামরা চোখে বিঁধে। কামরার মধ্যে শিশুরা নিজেদের কাজে মগ্ন। পরিপাটি বারান্দা পেড়িয়ে এগিয়ে যায় ওরা ভেতরের হল রুমে। সেখানে সুবিন্যস্ত আকারে বসার জন্য সোফার আয়োজন করা। নেহাল সহ বাকি সবাই আসন গ্রহণ করল। তুরানও বসল অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। একটু বাদেই সেখানে এলেন একজন ভদ্র মহিলা। মহিলা ওদের দেখে স্মিত ঘাবড়ে গেলেন। সঙ্গে অপ্রস্তুত। তুরান ব্যাপারটা আমলে নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,

“ভ’য় নেই। আমি নীরার হাসবেন্ড। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছি। একটু ডেকে দেবেন তাকে?”

মহিলাটি ধাতস্থ হয়। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পুনরায় চলে যায় ভেতরের ঘরে। এই মহিলাটি এতিমখানা রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেই সঙ্গে বাচ্চাগুলোর সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার দ্বায়িত্ব পালন করেন। এই এতিমখানার পেছনে নীরার অনেক বড় অবদান আছে। প্রতিমাসেই নীরা তার আর্থিক ফান্ড থেকে কিছু টাকা এদের নামে উৎসর্গ করে। প্রায়শই এসে এসে পদধূলিও ফেলে যায়। এতিম বাচ্চাদের প্রতি তার আলাদা একটা টান কাজ করে। এদের মুখের হাসি তার অন্তঃপুরে শৈথিল্য বয়ে আনে।

নীরা কেবলই বাচ্চাদের জন্য চানাচুর, মুড়ির আয়োজন করে ফিরছিল তখনই হুড়মুড়িয়ে তার কামরায় প্রবেশ করে রাহেলা। রাহেলার কন্ঠে আতঙ্ক, অবাকতা, সেই সঙ্গে ভালো লাগার মিশ্রণ। সে বলল,

“নীরা মা, তোমার স্বামী এসেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।”

কেঁপে ওঠে নীরার অন্তরিক্ষ। মুড়ির বিশাল পাত্রটি হাত থেকে খসে পড়তে পড়তেও আবার পড়ে না৷ সামলে নেয় সে। সেই সঙ্গে নিজেকেও। ধাতস্থ হয়ে চিবুক শক্ত করে। কন্ঠে কাঠিন্য মিশিয়ে বলে,

“কেন এসেছে? চলে যেতে বলো। এখুনি, এই মুহুর্তে।”

রাহেলা বুঝতে পারছেন নীরার অভিব্যক্তি। অভিমানে কেমন পাথর হয়ে বসেছে মেয়েটা। সে আর কোনোরূপ দিরুক্তি করে না। ফিরে যায় হল রুমে। সোফায় বসে থাকা চিন্তিত বদনের সুদর্শন যুবকটির উদ্দেশ্যে বলে,

“সে আসবে না। বয়স কম অভিমান গাঢ়। মনে হয় আপনাকেই যেতে হবে কষ্ট করে।”

নেহাল ঠাট্টার স্বরে বলে,

“যাও বন্ধু, বধূ অপেক্ষায়। মান ভাঙিয়ে এসো। আমরা তাহলে উঠি।”

নেহাল উঠে দাড়ায়। তুরানও উঠে দাড়ায় সঙ্গে সঙ্গে। পুনরায় জড়িয়ে ধরে নেহালকে৷ নেহাল ওর কথা পিঠে হালকা চাপড় মে’রে বলে,

“অল দ্যা বেস্ট।”

অতঃপর চলে যায় সকলে। অয়ন দাঁত কেলাতে কেলাতে সে ও চলে যায়। তুরান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে ভাবছে কোনো মুখে দাড়াবে নীরার সম্মুখে? কন্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দ কী বের হবে নিজের ফরে? নীরা কী মানবে তাকে?

চলবে,
®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here