#মায়ার_বাঁধন
( ভ্যালেন্টাইন স্পেশাল)
২৭.
অয়নের কাঁধে হেলে আছে তুরান। অয়ন একইসঙ্গে অপরাধী, ভীতিগ্রস্ত, অনুশোচিত, অস্থিরতাপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার নীরার দিকে তো একবার এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। নীরার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার পূর্ণ মনোযোগ তুরানের দিকে। কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর নিশ্চল কন্ঠে তার বানী,
“ওনাকে আমার নিকট সপে দিয়ে তুমি আসতে পারো।”
অয়ন বুঝল নীরা তাকেই কথাটি বলেছে এবং তুরানের বিষয়ে বলেছে। অয়ন পুনরায় দাঁত কেলায়। প্রশ্নবোধক সুরে বলে,
“কিন্তু ভাবি আপনি কী পারবেন সামলে নিতে?”
নীরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “হুম।”
নীরার দৃঢ়তা দেখে অয়ন স্বস্তি পায়। এমনিতেই সে এখন কেটে পড়তে পারলে বাঁচে। রাত তো কম হলো না তারও তো বাড়িতে মা-বাবা আছে। দেরিতে ফিরলে কেলানি তাকেও তো খেতে হয়। তবুও ভাতৃপ্রেমে অন্ধ হয়ে সবকিছু অকপটে সহজ করে নেয়।
শেষমেশ অয়ন চলে যায়। নীরা তুরানকে কাঁধে সঙ্গে হেলান দিয়ে আরেকহাতে কোমর জাপ্টে ধরে ওপরে নিয়ে যায়। বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। নেশাগ্রস্ত হওয়ার নিজের শরীরের সমস্ত ভার প্রায় ছেড়েই বসে আছে তুরান। নীরা তাকে একপ্রকার টেনেটুনেই ঘরে নিয়ে যায়। এ কাজ অবশ্য নীরা কখনোই করতে আসত না যদি না বাড়িতে শ্বশুর শ্বাশুড়ি থাকত। তারা তুরানকে এ অবস্থায় দেখলে ভীষণ কষ্ট পেতেন। এতরাতে অয়নকে ভেতরে ঢুকিয়ে কোনো প্রকার হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি হোক চাইনি সে। এজন্যই নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে দ্বায়িত্বটা তুলে নিয়েছে।
——-
তুরানকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাড়ায় নীরা। ঘরের আশেপাশে চোখ বুলায়। আজ কয়েকটা দিন পর এই ঘরে সে পা রাখল। তুরান সজ্ঞানে থাকলে তাও বোধহয় সম্ভব হতো না। আরও একবার পুরো ঘরে দৃষ্টি বুলিয়ে গেস্ট রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরল সে। এখন তো তার স্থান সেখানেই। নীরা চলতেই সহসা বাঁধা পড়ল তার পথে। ওড়নার আঁচলে টান অনুভব করতেই ঘুরে দাড়াল সে।
অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যায় এবার সে। তুরান অর্ধ অচেতন অবস্থায় তার ওড়না টেনে ধরা আছে। নীরা কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ক্রমাগত কাঁপছে তার গলা। সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন ঘনীভূত হচ্ছে। নীরা ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। কম্পিত হাত বাড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ওড়নার কিছু অংশ। সর্বশক্তি দিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করে নিজের কাছে। হতে চায় মুক্ত। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় অন্যকিছু। অর্ধচেতন তুরান স্বজোরে টেনে নেয় তাকে নিজের ওপর। ঘটনা চক্রে হতভম্ব, বিস্মিত নীরা। তুরান বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলছে। নেশাগ্রস্ত কন্ঠে তা কেমন মৃদু আওয়াজ সৃষ্টি করছি শুধু। কী বলছে বোঝা দায়। নীরা খুব করে চেষ্টা করে বুঝতে কিন্তু পারে না। অকস্মাৎ কাঁধে কিছু অনুভব করতেই চমকে ওঠে সে। তুরান দু-হাতে নীরাকে আঁকড়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতিতে অবগত হতেই নীরার ছটফটানি শুরু। সে একনাগাড়ে চেষ্টা করছে তুরানের থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু তার ওই ছোট্ট শরীর নিয়ে অমন বলিষ্ঠ পুরুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মোটেও মুখের কথা নয়। পূর্ণ ধস্তাধস্তি করেও রেহাই মিলল না তার। নেশা করলে ছেলেদের শক্তি নাকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। কথাটি আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে নীরা। তুরান তাকে ঘুরিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়েছে। এখন নীরা বিছানায় আর তুরান ওর ওপরে।
নীরা ভ’য়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর যখন ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স আসছে না তখন ঘন পল্লব কাঁপিয়ে নিভু নিভু চাহনিতে চোখ খোলে নীরা। তুরান তার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে। চোখ অসম্ভব লালিত। ওই দৃষ্টিতে যেন কত আকুলতা। নীরা শুকনো ডোক গিলে। অতি কষ্টে ভাঙা কন্ঠে বলে,
“পি..পি…প্লিজ যেতে দি…দিন।”
তুরানের কর্ণে গেল কী সে কথা? হয়তো না। সে সেভাবেই তাকিয়ে। অকস্মাৎ হুট করেই হামলে পড়ে নীরার ওপর। আঁকড়ে ধরে নীরার অধর। নীরার ছটফটানি মাত্রা ছাড়ায়। কিন্তু লাভ হয় না। শেষমেশ পুরোপুরি দখল করে নেয় তুরান তাকে। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণাময় রাত উপহার দেয় তাকে। এটাকে কী উপহার বলা যায় নাকি অ’ভি’শা’প?
——-
অসহ্য যন্ত্রণা গায়ে মেখে বিছানা ছেড়ে দাড়ায় নীরা। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। ভোরের আলো ফুটেছে। দু একটা পাখির কিচিরমিচির কলরব ভেসে আসছে। নীরা চোখ ঘুরিয়ে বিছানায় ফেলে। তুরান বেঘোরে ঘুমিয়ে। কী নিষ্পাপ বদনে। আহা এই বদনখানিতে দৃষ্টি বুলালে কখনোই মনে হবে না সেই যন্ত্রনাময় রাতের একমাত্র খলনায়ক ছিল এই মানুষটি। রাতের কথা মনে পড়তেই ডুকরে উঠে নীরা। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে। একটা সুন্দর, পবিত্র সম্পর্ককে কীভাবে কলুষিত করল তুরান ভাবতেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। নিজের ওপরই এখন সে চরম বিরক্ত। কেন যে তখন নিজে আগ বাড়িয়ে তুরানকে আনতে গেল? সে যদি না যেত তবে কী এতসব কাহিনী ঘটত? হয়তো না। আর সহ্য করতে পারে না নীরা। ছুট্টে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে অজস্র অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। শরীরটা ব্যথায় অসার হয়ে আসছে। শাওয়ারের পানি গায়ে পড়তেই জায়গায় জায়গায় জ্বলে উঠছে। দাঁতে দাঁত কামড়ে সবটা সহ্য করে নেয় সে। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসে বাহিরে। বাহিরে এসে একপল তুরানকে দেখেই দৌড়ে চলে যায় গেস্ট রুমে। এ ঘরে আর কখনোই সে পা রাখবে না। আজ তুরান যা করল তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না। অর্ধচেতন হয়ে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে বসল যখন তার মাশুল তো তাকে গুনতেই হবে।
——-
বাড়িতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে নীরার। ওদিকে অতশী ফোন করছে বারংবার ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও গোছগাছ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় নীরা। বাড়িতে থাকলে মনের যন্ত্রণা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। তার-ওপর তুরানের সম্মুখে কিছুতেই পড়তে চায় না সে। ভার্সিটি গেলে বান্ধবীদের সঙ্গ পেয়ে অন্তত কিছুটা কষ্ট লাঘব হবে। সময়টাও কেটে যাবে। কিন্তু শরীরে কিঞ্চিৎ জ্বরের আভাস, বিতৃষ্ণ গায়ে ব্যথা নিয়ে এক বিন্দু এগোনোর সাধ্যি পাচ্ছে না। তবু অতি কষ্টে বাড়ির গাড়ি নিয়ে রোজকার মতো রওনা হয় গন্তব্যে। জাহানারা চৌধুরী এখন বেশ সুস্থ আছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন তবে বেশিক্ষণ নয়। আলহাম চৌধুরী আজ বাড়িতে রয়ে গেছেন। স্ত্রী সঙ্গে একটা সুন্দর সময় কাটানোর আশায়। আসলে বৃদ্ধ বয়সে স্বামী – স্ত্রী একে অপরের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সে সময় একজনের সামান্য জ্বর হলেও অন্য জন মনকষ্টে ভোগে। ভ’য় পায় হারিয়ে ফেলার। মনের কোণে বেড়ে ওঠা অযাচিত শঙ্কার আগমনেই তার এই সিদ্ধান্ত। জাহানারা চৌধুরীও মনে মনে খুশি হয়েছেন। অসুস্থতার সময়ে এভাবে স্বামীকে পাশে রাখা প্রতিটি নারীর কাম্য। এতে করে যেন তাদের রোগ আরও দ্রুত নিরাময় হয়ে যায়।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১১ টা বেজে ছত্রিশ মিনিট,
সবেই আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলল তুরান। অলস ভঙ্গিতে উঠে বসল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘড়ির কাঁটায় চোখ বুঝলি তার চক্ষু চড়কগাছ। এত লেট করে সে কখনোই ঘুম থেকে উঠে না। তার ওপর ভার্সিটির নতুন ভিপি সে। কত দ্বায়িত্ব। তড়িঘড়ি করে কম্বল সরিয়ে নামতে গেলে দ্বিতীয় ধাক্কাটা খায় সে। নিজের পরনের কাপড় দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এমন অর্ধনগ্ন শরীরে সে ঘুমিয়েছে? কীভাবে সম্ভব? চিন্তান্বিত মুখশ্রীতে এগিয়ে যায় কাভার্ডের কাছে। প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। সহসা তার চোখ আটকায় ওয়াশরুমের মিররে।চমকিত দৃষ্টিতে আমার তড়িঘড়ি করে আরও একটু এগিয়ে যায় মিররের কাছে। ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখে বুকে, গলায় বাহুতে গভীর ক্ষ’ত। মনে হচ্ছে নখের আঁচড় টাইপ। টকটকে লালিত বর্ণ ধারণ করে আছে ক্ষ’তগুলো। তুরানের সন্দেহ ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে। গতরাতের কথা চিন্তা করতে করতেই সে শাওয়ার অন করে দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পড়ে শাওয়ারের নিচে। শাওয়ারের পানি গায়ে পড়তেই তার ভাবনা ছেদ ঘটে। সারা শরীর জ্বলছে। বিশেষ করে পৃষ্ঠদেশ। তুরান ফটাফট পেছন ঘুরে দাড়ায়। ঘাড় বাঁকা করে মিররের মধ্যে দেখার চেষ্টা করে পিঠের অবস্থা। বেশ ভালোই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সবকিছু তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এসব হচ্ছে টা কী তার সঙ্গে? ধীরে ধীরে ফিরে যায় সে গতকাল রাতে। সারাদিনের মনস্তাপ দূর করতে সে গিয়েছিল বারে। তারপর সেখানে বসে অনেক অনেক অনেক ম’দ্য’পান করে। তারপর অয়ন তাকে কিছু বলছিল। আর তারপর তারপর……….
#মায়ার_বাঁধন
২৮.
ক্যাম্পাসে পা রাখতেই চমকে উঠল নীরা। ক্যাম্পাসের দৃশ্যপট পুরোই ভিন্ন। সর্ব প্রাঙ্গন যেন সেজেছে নৈপুণ্যের ছোঁয়ায়। ধরনীর বুকে হলদে পাখিদের আনাগোনা। বাসন্তী শাড়িতে মেয়েদের যেমন লাগছে অপরুপা, স্নিগ্ধ শিশির। ছেলেরাও তেমনই বাসন্তী রঙা পাঞ্জাবিতে হুমায়ুন আহমেদের হিমু চরিত্রটি ধারণ করছে। এসব দেখে নীরার মনে পড়ে যায় আজ তো পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। এই দিনে বসন্তের ছোঁয়ায় কপোত-কপোতী তাদের হৃদয়ের প্রাঙ্গণে প্রণয় পবনের শীতলতায় মেতে ওঠে। আরও একটি নামে এই দিনটিকে আখ্যায়িত করা হয়৷ তা হলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে যার বাংলা অর্থ দাড়ায় ভালবাসা দিবস।
অপূর্ব কান্তিময় এই দৃশ্য অক্ষিপটে ধারণ করে নীরা নিজের মনের মধ্যে থাকা সকল বিষাদ ভুলে বসল মুহুর্তেই। উচ্ছসিত আদলে এগিয়ে গেল নিজ ক্লাসে। সেখানে গিয়েও আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে গেল সে। অতশীকে আজ মা’রা’ত্ম’ক সুন্দরী লাগছে। তাকে কেন্দ্র করে সীমা,রুহি কী যেন বলছে আর খোঁচাচ্ছে। আর অতশী, সে তো লজ্জায় মিয়িয়ে পড়ছে। কখনো কখনো দু’হাতে মুখ ঢেকে লজ্জা সংবরনের বৃথা চেষ্টা করছে। নীরা ভ্রু গুটিয়ে এগিয়ে যায় ওদের নিকটে। আলগোছে পাশে গিয়ে দাড়ায়। শুরুতে ওরা খেয়াল না করলেও পরপরই রুহি “নীরা” বলে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। রুহির সঙ্গে সঙ্গে অতশী, সীমাও ভীষণ খুশি হয়। কিন্তু সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কী হচ্ছে টা কী এখানে?”
নীরার প্রশ্নে অতশী লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে মাথা নত করে নেয়। নীরার কুঞ্চিত ভ্রু তা দেখে দ্বিগুণ কুঞ্চিত হয়। তখনই সীমা বলে,
“আরেহ জানিস না আজ তো পহেলা বসন্ত। তো একজনের মনে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। তার আরকি সেটা বাস্তবায়নের আয়োজন চলছে।”
“তাই নাকি। তা কী ঘোট পাকাচ্ছিস তোরা আমাকেও একটু শোনা?”
“আজ আমাদের অতশী রানি তার স্বপ্ন পুরুষকে নিজের ভালবাসার কথা জানান দেবে।”
নীরার বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে আসে। শিওর হতে বলে,
“সত্যি?”
অতশী তো মুখ তুলছেই না। নীরার প্রশ্নে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। নীরা কোমরে হাত রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“আজ আমি জেনেই ছাড়ব কে সেই মহান ব্যক্তি। যার জন্য আমার বেস্টু এমন তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে।”
রুহি অতশীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
“কী রে বলে দেব নাকি?”
অতশী চকিতে দেখে। দুপাশে মাথা দোলানোর সাথে সাথে মুখে আর্তনাদ করে, “নাহ,নাহ।”
নীরা ভ্রু কুঁচকে বলে, “কেন?”
অতশীও এবার নীরার মতো করেই কোমরে হাত রেখে দাড়ায়। বলে,
“কেন বলব তুই এখনো বলেছিস তোর বরের ব্যাপারে? আগে তুই বল তারপর আমি।”
নীরার ভঙ্গুর হৃদয়ে অপ্রত্যাশিত বিষন্নতা নেমে এলো। মনে পড়ে গেল গতরাতের দৃশ্যপট। ব্যথিত মস্তিষ্কে থমকে রইল কিয়ৎক্ষণ। তন্মধ্যেই অতশীর উৎফুল্ল কন্ঠ,
“কী হলো বল, বল।”
সীমা, রুহিও তাল মেলালো তার কথায়। পরিস্থিতি বিপাকে দেখে নীরা একটি বুদ্ধি এঁটে ফেলল। ফটাফট বলে দিল,
“আচ্ছা বলব তবে একটা শর্তে। আমি আর অতশী দুজনেই নিজের প্রিয় মানুষটির নাম খাতায় লিখব। তারপর চোখ বন্ধ করে একসঙ্গে সম্মুখে তুলে ধরব। তারপর একসঙ্গে চোখ খুলব। ব্যস হয়ে গেল না সমস্যার সমাধান?”
অতশী কিছু একটা ভাবল। অতঃপর রাজি হয়ে গেল। দুজনেই খাতা, কলম বের করে লিখে ফেলল নিজেদের মনের মানুষটির নাম। সীমা, রুহিও অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায়। অতশীর বিষয়টি অবগত হলেও নীরার ব্যাপারে পুরোই অজানা তাদের। তাই কৌতুহলটাও একটু বেশি। লেখা শেষে দুজনেই মুখোমুখি দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। সীমা, রুহি কাউন্ট করতে শুরু করে।
“ওয়াননন, টু, থ্রি।”
দুজনেই নিজেদের লেখা সামনে তুলে ধরে এবং চোখ খুলে। এবং সেই সঙ্গে ঘটে যায় আরেক বিপত্তি। অতশীর চোখে কিছু একটা আটকে যায় আর সে সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে ওঠে। ওর হাতের লেখা খাতাটা পড়ে যায় মেঝেতে। সকলেই ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নীরা ওড়নার আঁচলে ভাপ দিয়ে ওর চোখে উষ্ণতা দেয়। সীমা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে অতশীর চোখে পানি দেয় আর রুহি টিস্যু দিয়ে ওর ভেজা চোখ মুছিয়ে আনে। এমন হুলুস্থুল অবস্থায় সহসা নীরার চোখ আটকায় মেঝেতে পড়ে থাকা খাতার পৃষ্ঠায়। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে সুস্পষ্টভাবে তুরানের নামটি জ্বলজ্বল করছে। লেখা আছে,
“তুরান তাসরিফ চৌধুরী।” নীরা বিস্ময়ে তব্দা খেয়ে যায়। অতশীর দিক থেকে মনোযোগ সরে গিয়ে তার পূর্ণ মনোযোগ এখন ওই লেখায়। সবটা বুঝতে তার বেশকিছু সময় লেগে যায়। টলমলে পায়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে নিচে। তুলে নেয় কাগজটি। চোখের সামনে তুলে ধরে কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে,”তুরান তাসরিফ চৌধুরী।।”
এতক্ষণে নীরার দিকে দৃষ্টি ফেলে ওরাও। অতশীর চোখ অনেকটা ঠিক আছে এখন তবে ফুলে লাল হয়ে গেছে। হয়তো কোনো পোকা পড়েছিল। নীরার মুখে নামটি শুনে রুহি বলে ওঠে,
“হ্যাঁ ঠিকই পড়েছিস। আমাদের ভার্সিটির নতুন ভিপি তুরান ভাই সে-ই তো অতশীর মনের মানুষ। ভার্সিটিতে জয়েন হয়েছে থেকে তুরান ভাইকে ঘিরে ওর কতশত লুকানো কাহিনী। অবশ্য তা দেখতে দেখতে আমরা এখন ফেড-আপ হয়ে গেছি।”
অতশী রুহির মাথায় দিল এক চাটি। সীমা ফিক করে হেসে দিল। নীরা স্তব্ধ। চোখ জোড়া স্থির। কন্ঠনালী অবরুদ্ধ। অন্তঃকোণে তীব্র জ্বলন। তখনই অতশীর বানী,
“এই যাহ নীরা তুই তো দেখে নিলি কিন্তু আমি তো দেখতে পারলাম না। কই দেখা আমাকেও কী লিখছিস তুই।”
সীমা বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমরাও তো দেখতে পাইনি। আমাদেরও দেখা।”
নীরার চিত্ত জাগে। আমতা আমতা করে বলে,
“এ্যা হ্যাঁ! তাই তো! আচ্ছা আমার না ভীষণ শরীর খারাপ করছে আমি বাড়িতে চললাম।”
কথা বলতে দেরি তো নীরার ছুটতে দেরি নেই। এক ছুটে তড়িঘড়ি করে চলে যায়। পেছন থেকে শুনতে পায় তিন বান্ধবীর উদগ্রীব কন্ঠস্বর। অতশী বলছে, “এই নীরা শরীর খারাপ নিয়ে একা একা যাস না আমি আসছি দাড়া। সীমা বলছে, কী হয়েছে বলে তো যা? রুহি বলছে, সাবধানে থেমে হাট।”
সকলের কথা কানে ভেসে আসে কিন্তু নীরা নিজের কাজে অটল। এক মুহূর্তে দাড়ায় না আর, আর না পেছন ঘোরে। একেবারে ক্যাম্পাস পেরিয়ে বেড়িয়ে যায় রাস্তায়। ড্রাইভার তো এখন আসবে না। তাই সোজা পথেই হাঁটা ধরল সে। এ এ শহর তার বড্ড অচেনা তবুও এগিয়ে চলেছে কিছু দূর।
——-
বাড়ি বাহিরে কোথাও শান্তি মিলছে না তুরানের। কী করে নীরার মুখোমুখি হবে এই চিন্তায় প্রায় অ’র্ধ’মৃ’ত সে। অতঃপর তার মস্তিষ্কে হানা দেয় এক দুর্বোধ্য বুদ্ধি। মনে পড়ে যায় আজ তো, “ভালবাসা দিবস।” আচ্ছা নীরাকে যদি এখন সে প্রপোজ করে নীরাকে তবে তাকে ফিরিয়ে দেবে? নাহ, নাহ এসব কী ভাবছে সে। নীরা কখনোই তাকে ফেরাবে না। বরংচ খুশি হয়ে ম’রে-টরেও যেতে পারে। তুরান একপল নীরার চেহারাটা ভেবে মুচকি হেসে বেরিয়ে যায় বাহিরে।
চলবে,
®অহমিকা মুনতাহাজ নিশি
.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ (লেখনীতে)