#মায়াবতী
#পর্ব_৩
#সুলতানা_পারভীন
কতোক্ষণ এভাবে চেয়ারে বসে ছিল রাহাত নিজেও জানে না। নিজের প্রজেক্টের চিন্তার চেয়েও মায়ার কাঁদো কাঁদো মুখটাই ওর চোখের সামনে বেশি ভাসছে। বিশেষ করে মেয়েটার চোখ জোড়া। কি সুন্দর! কি শান্ত! অথচ যেন রাজ্যের কৌতূহল খেলা করছে সে চোখে! সাথে ভীত হরিণীর মতো সেই চাহনি! একেবারেই যেন রাহাতের চোখে আটকে গেছে সেই দৃষ্টি। বিনা অজুহাতেই মেয়েটাকে বার বার দেখতে ইচ্ছে করছে রাহাতের। কেন এমন হচ্ছে সে জানে না। জানার দরকারও দেখছে না এই মূহুর্তে। কি করে দেখবে সেটাই এখন ভাবছে শুধু রাহাত। কিছু একটা মনে হতেই টেলিফোনে ১ প্রেস করে ফোনটা কানের উপর ধরলো। কয়েকবার রিং হয়ে কলটা কেটে গেল। রাহাত ভ্রু কুঁচকে আবার কল করলো৷ এবারেও ফোনটা রিসিভ হলো না।
মেজাজটাই খারাপ হচ্ছে রাহাতের। মেয়েটা কি রুমে নেই? কল রিসিভ করে না কেন? আরো দুবার কল করলেও কেউ রিসিভ করলো না। এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে রাগ উঠলো রাহাতের। এই মেয়ের কপালে আজকে নিশ্চিত শনি আছে। প্রথমদিনেই এতোটা খামখেয়ালিপনা! কাজে মন নেই একটুও? রুমে না থেকে কোথায় গেছে! প্রথম দিনেই সবার সাথে খাতির পাতাতে গেছে নাকি! সেরকম কিছু হলে কঠিন শাস্তি আছে মিস মায়াবতীর।
নিজের মনেই রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমের দরজা ঠেলে বেরিয়েই সামনের রুমটায় ঢুকে গেল রাহাত। মায়াকে রুমের একপাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ওর দিকে পিঠ করে। রাগটা এবারে সপ্তমে উঠলো রাহাতের। রুমে থেকেও ফোন রিসিভ করা হচ্ছে না? দেখাচ্ছি দাঁড়াও।
মায়ার একটা হাত ধরে টেনে এক ঝটকায় দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো রাহাত। মায়া একে তো গভীরভাবে কিছু একটা চিন্তা করছিল। তার উপরে রাহাত এসেছে সেটা টেরই পায় নি। এর মধ্যে এমন আক্রমণে একেবারে ভয় পেয়ে গেল। কি করবে ভেবে না পেয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা কথায় কথায় এভাবে রেগে গিয়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরে কেন মায়া বুঝতেই পারে না। হতেই পারে পি.এ হিসেবে মায়াকে তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। তাই বলে এমন করবে?
রাহাত রেগে গিয়েও মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলো না। মেয়েটার চোখে মুখে কিছু একটার ভয় খেলা করছে। মায়ার ছলছল করা চোখ জোড়া যেন রাহাতকে টানছে প্রচন্ডভাবে। এই টান-এই ঘোর লাগা চোখের মায়া এড়ানো রাহাতের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই যেন এই মায়াবী চোখের মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে সে। কি আশ্চর্য অথচ কি সুন্দর একটা অনুভূতি কাজ করছে রাহাতের মনে। কই অন্য কারো জন্য তো কখনো এই ফিলটা আসে নি ওর? তবে আজই বা কেন! মেয়েটা নিতান্ত সাদামাটা অথচ কি দারুণ মায়া তার সমস্ত সত্তা জুড়ে! কোন এক রহস্যের মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে রাহাত!
-স্যার? লাগছে আমার—।
-হুম?
-ব্যথা লাগছে—।
-হুম?
-স্যার?
-উফ—। এতো চিল্লাও কেন? যত ইচ্ছে চিল্লাও। লাভ নেই–। রুমের একটা শব্দও বাইরে যাবে না–। সাউন্ড প্রুফ–। এয়ার টাইট রুম প্রত্যেকটা—-।
-মানে?
-মানে মানে পরে করো—। আগে বলো তো? কই ছিলা তুমি এতোক্ষণ? ফোনে কল করেছি কতোবার? রিসিভ করা যায় না?
-আমি তো ভাবলাম–। অন্য কেউ কল করেছে—। আমি কি করে জানবো—?
-যেই কল করুক–। এতোবার কল করলে তো ভদ্রতার খাতিরেও কলটা রিসিভ করতে হয়—–। এতোটুকু কমনসেন্স নেই তোমার?
মায়া ঢোক গিললো। এই রে! প্রথম দিনেই বড়সড় একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছে। এদিকে ভয়ে প্রাণ যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল ওর। পাড়ার ওই বদ ছেলেগুলো কোনভাবে নাম্বার জেনে কল করছে কিনা এই ভয়েই কল রিসিভ করে নি। সেটা এই খারুস লোকটাকে কি করো বলবে! তার উপরে হাতেও লাগছে কত! ছাড়ে না কেন! অসভ্য লোক একটা!
মায়া নিজের মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রাহাত ওর হাতটা ছেড়ে দিল। মায়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। হাতটায় ব্যথা হয়ে গেছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা ডলতে শুরু করেছে দেখে রাহাত একটু এগিয়ে এলেই আঁতকে উঠে মায়া এক পা পিছিয়ে গেল। মায়ার এভাবে আঁতকে ওঠা দেখা রাহাত ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকালো।
-কি সমস্যা মিস মায়াবাতী?
-স্যার–। আমার নাম মায়া—। আর কোন সমস্যা নেই—।
-তো সমস্যা না থাকলে এভাবে লাফাও কেন? আজব! —-বাই দা ওয়ে—-।আজকের মতো কাজ শেষ–। চলো শপিংয়ে যাব–।
-শপিংয়ে পি.এর কাজ কি?
-শপিংটা আপনার জন্য মিস মায়াবতী—। চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির সাথে কেউ ডিল করতে এলে তোমার ড্রেসআপ দেখেই তো ক্যানসেল করে চলে যাবে—-।
-মানুষ আপনার প্রোডাক্টের ইফিসেন্সি-কোয়ালিটি এসব দেখবে? নাকি আপনার পি.এ কি পড়েছে সেটা?
-যখন যা দেখতে হয় আর কি–। অন্য কোন কোম্পানির পি.এ যদি এই ড্রেসআপে আমার সামনে আসে আমি নিজেই তো ডিল করবো না–।
রাগে মায়া একটা কথাও বলতে পারলো না। অসভ্য লোক একটা। মনে মনে ইচ্ছে মতো গালি দিল রাহাতকে। রাহাত মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে ফেললো। তারপর রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
-মিস মায়াবতী? যত ইচ্ছে গালি দিন-তবে সেটা শপিংমলে যাওয়ার সময় রাস্তায় দিবেন—। আর হ্যাঁ আমাকে অসভ্য বলুন, খারুস বলুন, অভদ্র যা ইচ্ছে বলুন–। আমি কিন্তু কাউকে কখনো জোর করি না-। সবাই নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়–। আর একটা কথা-। এর পর কখনো কল করে না পেলে সোজা আমার চোখের সামনে রুমে নিয়ে বসিয়ে রাখবো সারাদিন–। যত ইচ্ছে কাজ করতে পারবে- তবে সেটা আমার চোখের সামনে বসে–। কেউ কখনো বিরক্ত করলে সেটাও আমাকে অবশ্যই জানাবে–। কে তোমাকে বিরক্ত করবে? তার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে আমিও একটু দেখতে চাই—। আর একটা কথা—। অফিস থেকে ফ্ল্যাট দেয়া হবে—। কালই উঠবা ফ্ল্যাটে–। বোঝা গেল?
-জি?
-পাঁচ মিনিট সময় দিলাম-। আমি নিচে গাড়িতে ওয়েট করছি। দেরি হলে সত্যি সত্যিই কপালে আজকে দুঃখ আছে আপনার মিস মায়াবতী–।
কথাটা বলেই রাহাত বেরিয়ে গেছে। মায়া থ মেরে দাঁড়িয়ে ভাবছে এটা কি হলো! মনের কথাও কি জানতে পেরে যায় নাকি এই খারুস লোকটা! এতো এতো যে বকা দিয়েছে তার জন্য কি শাস্তি দেয় কে জানে! পাঁচ মিনিটের কথা খেয়াল হতেই ব্যাগ নিয়ে ছুটলো মায়া। দেরি করলে কি হবে জানে না মায়া। তবে সেটা নিয়ে গবেষণা করারও বিন্দুমাত্র শখ নেই ওর এই মূহুর্তে। এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে দেখলো রাহাত একটা গাড়ির সামনে দাঁড়ানো। মায়া সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো রাহাত। তারপট মায়ার দিকে এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে। মায়া ভয়ে চোখ মুখ খিঁচেই দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে৷ কি আছে কপালে কে জানে!
চলবে