#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_৬
মার্কেট থেকে এসে একটা লম্বা আড়মোড়া ভাঙলো ইহান। মিথুর দিকে তাকালে হাসি পাচ্ছে। গাড়িতে আসায় মেয়েটার খোলা চুলগুলা একেবারে কাকের বাসা হয়ে গেছে বাতাসে। ঘড়ি দেখল ইশিতা। আটটা বাজে। জামা কাপড়ের প্যাকেটগুলো রুমে রেখে রান্নাঘরে চলে গেল খিচুড়ি গরম করতে। মিথিলা বসেছে তার খাতা নিয়ে। আজ ওকে নতুন খাতা আর রংপেন্সিল কিনে দিয়েছে ইশিতা। সেই খুশিতে বাসায় আসার জন্য পাগল হয়ে ছিল। এসেই খাতা নিয়ে বসতে যাচ্ছিল। ইহান ধমক দিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে নিয়েছে।
চানাচুরের একটা প্যাকেট খুলে রান্নাঘরে ইশিতার কাজ দেখতে লাগল ইহান। ওকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কিছু বলবি?
– হুম।
খিচুড়ির ডেঁকচিটা চুলায় দিতে দিতে বলল, বল। ইহান মুখের চানাচুর শেষ করে বলল, আজকে ফারাবীর সাথে গুজগুজ করে কি বলছিলে? ইশিতা কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কিছু না। বলে কাজে মন দিল। আরো কিছু জিজ্ঞেস করলেও ইশিতা যে আর কিছু বলবে না তা বুঝতে পেরে রুমে চলে এল ও। মিথিলা সব সময় ওর রুমে বসে ছবি আঁকে। এখনো ওখানেই আছে। মিথিলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টেবিলে বসে পড়ল।
.
.
.
.
শেষ পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই ইহান বড় করে একটা শ্বাস নিল। মনের মতোই পরীক্ষাগুলো দিয়েছে। মনটা অনেক ভালো লাগছে। বেশিরভাগ উত্তর কমন ছিল। আশা করা যায় যেমন চাইছে তেমন ফল পাবে। ইহান বাসার দিকে রওনা দিতেই ফারাবী এসে কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কোথায় যাও ছোট্ট বন্ধু?
– বাসায় যাবো।
– আজ তো যাওয়া যাবে না।
– কেন?
– আজ আমার বাসায় যাবি৷ আম্মু আব্বু বাইরে গেছে। দুইজনে মিলে খেলবো চল।
– ইশুবু চিন্তা করবে।
– আরে কোনো চিন্তা নেই। চল তো।
ফারাবী জোর করে ইহানকে নিয়ে গেল ওদের বাসায়। ব্যাগগুলো সোফায় রেখে বলল, যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি দেখি কি খাওয়া যায়। ইহান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে রান্নাঘরে গেল। সেখানে ফারাবী চিপস ভাজি করছে। ইহান বলল, কি করিস? ভাজা চিপসগুলো তুলে আবার ভাজতে দিয়ে বলল, এই একটা জিনিসই এখন পর্যন্ত পারি রে ভাই। কড়াইয়ে তেল দিয়ে কেবল টুসটুস করে চিপসগুলো ছেড়ে দিবি। ব্যাস। কুচমুচ করে খাওয়ার জন্য রেডি। ইহান ফারাবীর কথা শুনে হেসে বলল, তোকে খালি ময়দানে রেখে আঙ্কেল আন্টি কোথায় গেছে?
– একটা কাজে। চল চিপস ভাজা হয়ে গেছে।
দুইজনে মিলে চিপস খেতে খেতে ভিডিও গেমস নিয়ে বসল। খেলার মাঝে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এই দেরি হয়ে যাচ্ছে। আড়াইটা বাজে। ইশুবু চিন্তা করবে। ফারাবী উত্তেজিত হয়ে বলল, ইয়েস, জিতে গেছি তুই হেরে গেছিস। আরে চিন্তা নিস না। আপু জানেন তুই এখানে আসবি। প্যারা নিস না।
– আমাকে বলিসনি তো আপু জানে।
– ভুলে গিয়েছিলাম। জানিস ইহান, আমারটা ছোট বেলা থেকে একটা বোনের শখ।
– তো আঙ্কেল আন্টিকে বল।
– ধুর, বললে যদি হয়ে যেত তাহলে তোকে বলি? তারাও কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমি হওয়ার একবছরের মাথায় আম্মুর অপারেশন হয় জরায়ুতে টিউমার হওয়ায়। তাই ফেলে দিতে হয়েছে। এখন হাজার চাইলে বোন পাওয়া সম্ভব না বুঝলি?
– হুম। বুঝলাম।
– তবে আজ আমি অনেক খুশি।
– কেন?
– কারণ আমি একটা বোন পাবো।
ইহান অবাক হয়ে বলল, কোথা থেকে? ফারাবী চোখ টিপে বলল, দেখবি। যখন পাবো তোকে দেখাবো। ইহান চিপস মুখে দিতে দিতে বলল, দত্তক নেবে নাকি?
– হুম। আমার বোনকে অনেক পছন্দ হয়েছে। শান্ত শিষ্ট অনেক।
– তাহলে তো ভালো।
ইহান শেষ চিপসটা মুখে পুরে দিয়ে বলল, যাইরে বাসায় কাজ আছে। ফারাবী ওকে আটকানোর চেষ্টা করে বলল, কি কাজ? থাক না আর কিছুক্ষণ। ইহান যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু ও নাছোড়বান্দা। এমন সময় কলিংবেল বাজতেই ফারাবী দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলল। দেখল ওর আব্বু আম্মু এসেছে। এসে বলল, এবার যেতে পারিস। ইহান কানে ফিসফিস করে বলল, তোদের বাসায় জিন পরী আছে নাকি? ফারাবী জিজ্ঞেস করল, কেন? দরজার কাছে যেতে যেতে বলল, যেভাবে আমাকে আটকাচ্ছিলি। আঙ্কেল আন্টি আসায় চলে যেতে বলছিস।
– হুস! যা যা। ভাগ।
ইহান হাসতে হাসতে বলল, আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন? আঙ্কেল বললেন, আরে ইহান যে। ওয়া আলাইকুম আসসালাম। এই তো আলহামদুলিল্লাহ। কি অবস্থা?
– জ্বি আঙ্কেল ভালো। আজ আসি।
– ওমা সেকি, কিছু বানিয়ে দেই। খেয়ে যাও।
– আজ না আন্টি আরেকদিন খাবো। আজকে একটু তাড়া আছে।
ইহান বেরিয়ে এল। বাসার কাছাকাছি একটা দোকানে এসে তিনটা কোন আইসক্রিম কিনল। মিথু খেতে পছন্দ করে। কলিংবেল টিপতেই মিথু দরজা খুলে দিয়ে রুমে চলে গেল। ওর মলিন মুখ দেখে ইহানের হাসি মিলিয়ে গেল। হলটা কি!
রাতে খাওয়ার সময় ইহান দেখলো সবাই চুপচাপ। মিথু কেন যেন ওকে এড়িয়ে চলছে। কথা বলছে না। খেতেও বায়না করে না এখন। নিজে নিজেই খায়। ইহান খাওয়ার মাঝেই জিজ্ঞেস করল, কিছু কি হয়েছে ইশুবু? ইশিতা খাওয়া শেষে উঠে যাচ্ছিল। ওর কথা শুনে বলল, কি হবে? ইহান শেষ লোকমা মুখে দিয়ে বলল, সবাই চুপচাপ। ইশিতা রান্নাঘরে প্লেট ধুতে ধুতে বলল, প্রত্যেকদিনই তো এমন থাকি। বলে কাজে লেগে গেল। ইহান মিথিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে অনেক চেষ্টায় অর্ধেক খাওয়া শেষ করেছে। ও ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমি খাইয়ে দেবো? মিথিলা মাথা নাড়ায়। ইহান হতাশ হয়ে বলল, কেন? ও একটা হাসি দিয়ে খাওয়া শেষ করার চেষ্টা করতে লাগল।
ইহান রুমে পায়চারি করছে। মিথিলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশিতা কাজ শেষ করে উঁকি মেরে দেখল ইহান ঘুমায়নি। রুমের একপাশ থেকে অপর পাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইশিতা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কি রে? ঘুমাবি না? আজ তো আর পড়াশোনা নেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে যা। কাল রবি চাচা আসবেন। ইহান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে ও বলল, আমরা অনেক ছোট থাকতে দেখতে এসেছিলেন একবার। তোর হয়ত মনে নেই। উনি অনেকদিন আমাদের খোঁজ পাননি৷ এখন খোঁজ পেয়ে কথা বলতে আসবেন। ইহান বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, দরকারের সময় যখন কাউকে পাইনি এখনো প্রয়োজন নেই। ইশিতা বলল, আমার প্রয়োজন। তোর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন। তুই চাচার সাথে সাউথ কোরিয়া যাবি। ওখানে ডাক্তারি পড়বি। আমি চাচার সাথে কথা বলেছি। উনি রাজি। ইহান এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল, না।
.
.
.
.
ইশিতা সকাল সকাল কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে মিথিলাকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়ে গেল। ইহান তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠলেও বিছানা থেকে নামেনি। চুপচাপ শুয়ে আছে। আজ কোনো পড়ালেখা নেই৷ একেবারে নেই যে তা নয়৷ ভর্তির জন্য পড়তে হবে। ভাবতেই কাল রাতের কথা মনে পড়ল। কাল ইশিতার সাথে একদফা তর্ক হয়ে গেছে রবি চাচার সাথে বিদেশ যাওয়া নিয়ে। ইহান কিছুতেই ইশিতাকে ফেলে বিদেশ যেতে চায় না। এদিকে ইশিতাও ওকে বিদেশ না পাঠিয়ে ক্ষান্ত হবে না। ভাবতেই বেশ বিরক্ত লাগল ইহানের। শেষে বিরক্তি নিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে এল। বসার ঘরে মিথিলা খাবার শেষ করে বসে আছে। ইহান গিয়ে বলল, খেয়েছো? না খাইয়ে দিবো? মিথিলা মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে যায় ইশিতার রুমে। ইহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাস্তা করতে বসল। এখন মিথিলা খেতে চায় না দেখে কেন যেন ওর মন খারাপ হয়। আগে ওর পেছনে ঘুরঘুর করলে বিরক্ত লাগতো আর এখন করে না দেখে একলা লাগে। যেন অনেকদিন পরে পাওয়া সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলছে।
খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে এসে বসল। কালকেও মিথিলা খাতা নিয়ে বসেনি। আজও ইশিতার রুমে। পেন্সিলের কোনো আওয়াজ নেই। হঠাৎ আঁকাআকি বন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে না। ওকে কি বলেছে বিদেশে যাওয়ার কথা? তাই কি মন খারাপ? কিন্তু ও তো যাচ্ছে না। ইহান হুট করে ছুটে ইশিতার রুমে গিয়ে বলল, মিথু! মিথিলা আগের আঁকা ছবিগুলো দেখছিল। সব ছড়িয়ে রেখেছে বিছানার উপর। ওর হুট করে আসায় চমকে উঠে বলল, হা!? ইহান এগিয়ে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো বিছানার কাছে। ছবিগুলো দেখে বলল, আমাকে কেন আঁকো মিথু? ইহান ওর চোখের দিকে তাকাল। আজকে মিথিলা ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়েছে। অন্য সময় চোখ সরিয়ে ফেলতো। ইহান যেন ওর সরল চোখে হারিয়ে গেল। তারপরই হঠাৎ মিথিলা একটা হাসি দিয়ে বলল, ভালো লাগে। ইহান ওর হাসিতে একটু ভড়কে গিয়ে মনে মনে বলে উঠল, কিউট!
কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। ইহান গিয়ে দেখল আজ মিথিলা দরজা মেরেছে। দিন দিন অনেক কিছু শিখে নিচ্ছে। দরজা খুলতে একজন লোককে চোখে পড়ল। শার্ট কোর্ট পরা। বেশ সাহেবী কিন্তু বয়স পঞ্চাশ হবে। মাথার চুল আধা কাঁচা পাকা। সাথে একটা লাগেজ। পেছনেই ইশিতা। ইহানের বুঝতে বাকি রইল না লোকটা কে। সে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়াল।
লোকটা আসলো দুই ঘন্টাও হলো না লোকটার লেজে লেজে ঘুরতে লাগল মিথিলা। ইশিতার রুমে বসে লোকটা গল্প করেই যাচ্ছে আর মিথিলা হা করে গিলছে। ইহান রুমের বাইরে উঁকি মেরে কপাল কুঁচকে দেখতে লাগল আর দেয়াল খুঁটতে লাগল। মনে মনে বলল, আসতে না আসতে দাঁত কেলাচ্ছে বুড়ো ভামটার সাথে আর কাল থেকে আমার সাথে ঠিক মতো কথাও বলছে না। হুহ্। ইশিতা হঠাৎ পেছন থেকে বলল, মেয়েটা ভ্রমণকাহিনী বেশ পছন্দ করে। ইহান চমকে উঠে পিছনে তাকালো। ইশিতা পানি খাচ্ছে আর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, যাবি কোরিয়া? ইহান ‘না’ বলে নিজের রুমে চলে গেল। ইশিতা হাসতে হাসতে বলল, ভাইটা হিংসে করতেও শিখে গেছে দেখছি।
চলবে…